হাদীসের নামে জালিয়াতি যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

সিয়াম বিষয়ক অনেক জাল হাদীস ও মনগড়া কথা ‘বার চান্দের ফযীলত’ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। আরো দু একটি ভিত্তিহীন বিষয় নিম্নরূপ:

১. সিয়ামের নিয়্যাত

আমরা দেখেছি, ‘নাওয়াইতু আন’ বলে যত ‘নিয়্যত’ সবই ‘বানোয়াট’। কোনো ইবাদতে এরূপ নিয়্যাত পাঠের কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি।

২. ৩০ দিন সিয়াম ফরয হওয়ার কারণ

বিভিন্ন ইবাদতের কারণ নির্ণয় করা একটি বিশেষ বাতুল আগ্রহ। ফলে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে। রামাদানের ফরয সিয়ামের বিষয়ে জালিয়াতগণ বানিয়েছে:

اِفْتَرَضَ اللهُ عَلَى أُمَّتِيْ الصَّوْمَ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً ... وَذَلِكَ أَنَّ آَدَمَ لَمَّا أَكَلَ الشَّجَرَةَ بَقِيَ فِيْ جَوْفِهِ مِقْدَارَ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً، فَلَمَّا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ أَمَرَهُ بِصِيَامِ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً بِلَيَالِيْهِنَّ، وَافْتَرَضَ عَلَى أُمَّتِيْ بِالنَّهَارِ.

‘‘আমার উম্মতের উপরে ৩০ দিনের সিয়াম ফরয করা হয়েছে। কারণ আদম যখন গাছ (ফল) খেয়েছিলেন তখন তা তাঁর পেটের মধ্যে ৩০ দিন বিদ্যমান থাকে। যখন আল্লাহ আদমের তাওবা কবুল করলেন তখন তাকে ত্রিশ দিন ও ত্রিশ রাত একটানা সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। আমার উম্মতের উপরে শুধু দিবসে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। ...’’[1]

৩. ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খানার হিসাব না হওয়া

সমাজে প্রচলিত আছে যে, ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খাওয়ার হিসাব নেই। এ অর্থের বানোয়াট হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ثَلاَثَةٌ لاَ يُسْأَلُوْنَ عَنْ نَعِيْمِ الْمَطْعَمِ وَالْمَشْرَبِ: الْمُفْطِرُ، وَالْمُتَسَحِّرُ، وَصَاحِبُ الضَّيْفِ.

‘‘তিন ব্যক্তির পানাহারের নেয়ামতের হিসাব গ্রহণ করা হবে না: ইফতার-কারী, সাহরীর খাদ্যগ্রহণকারী ও মেহমান-সহ খাদ্য গ্রহণকারী।’’[2]

এ সকল ভিত্তিহীন কথাবার্তার কারণে রামাদান মাসকে আমরা ‘নিজে খাওয়ার’ মাসে পরিণত করেছি। অথচ রামাদান হলো অন্যকে খাওয়ানোর ও সহমর্মিতার মাস। এছাড়া আমাদের ‘হিসাব হবে কিনা’ তা বিবেচনা না করে ‘সাওয়াব বেশি হবে কিনা’ তা বিবেচনা করা উচিত।

৪. আইয়াম বীযের নামকরণ

চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামুল বিদ’ বা শুভ্র রাতের দিনগুলো’ বলা হয়; কারণ এ তারিখগুলোতে পূর্ণ চাঁদের কারণে প্রায় সারারতই শুভ্রতা বা আলো বিরাজমান থাকে।[3] কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়াম বীয’-এর নামকরণ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। যেমন:

‘‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পরে যখন আদম (আঃ) পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তাঁর দেহ কাল হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফিরিশতাগণ তাঁর জন্য কাঁদতে থাকেন। ...তখন আল্লাহ আদমকে বলেন, তুমি আমার জন্য ১৩ তারিখ সিয়াম পালন কর। তিনি ১৩ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং এতে তাঁর একতৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৪ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৪ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর দুই তৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৫ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর পুরো দেহ শুভ্র হয়ে যায়। এজন্য এই দিনগুলিকে ‘আইয়ামুল বীয’ বা ‘‘শুভ্রতার দিনগুলি’’ নাম রাখা হয়।’’[4]

৫. আইয়াম বীযের সিয়াম পালনের ফযীলত

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () মুমিনগণকে সকল নফল ইবাদত অল্প হলেও নিয়মিত পালন করার উৎসাহ দিয়েছেন। নফল সিয়ামের ক্ষেত্রে প্রতি চান্দ্র বা আরবী মাসে অন্তত তিন দিন সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসে বিশেষ করে প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল সিয়াম পালনের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।[5]

এ দিনগুলোতে সিয়াম পালনের বিশেষত্ব তিনটি: প্রথম, রাসূলুল্লাহ () বিভিন্ন হাদীসে এ তিন দিন সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।[6] দ্বিতীয়, তিনি নিজে সর্বদা এ তিন দিন সিয়াম পালন করতেন।[7] তৃতীয়, এ তিন দিন সিয়াম পালন করলে বা প্রতি মাসে অন্তত তিন দিন সিয়াম পালন করলে সারা বছর সিয়াম পালনের সাওয়াব হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।[8]

মুমিনের জন্য এগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়াম বীয’-এর ফযীলতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। যেমন, ‘‘যদি কেউ আইয়াম বিযের সিয়াম পালন করে তবে ১ম দিনে (তের তারিখ) তাকে ১০ হাজার বছরের পুরস্কার প্রদান করা হবে, দ্বিতীয় দিনে (১৪ তারিখ) তাকে ১ লাখ বছরের পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং তৃতীয় দিনে (১৫ তারিখে) তাকে তিন লাখ বছরের সাওয়াব প্রদান করা হবে।’’ কোনো কোনো জালিয়াত একটু কমিয়ে বলেছে: ‘‘১ম দিনে ৩ হাজার বৎসরের সাওয়াব, দ্বিতীয় দিনে ১০ হাজার বছরের এবং তৃতীয় দিনে ২০ হাজার বছরের সাওয়াব পাবে...।’’[9]

এরূপ আরো অনেক বানোয়াট কথা তারা প্রচার করেছে।

[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১০১; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৯৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১১৯।

[2] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৬; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৪।

[3] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৪/২২৬; আব্দুর রাঊফ মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/২২৯।

[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৭৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৮৩-৪৮৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৫৪-৫৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৫।

[5] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[6] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৩৮৯-৩৯০; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[7] আলবানী, সহীহুল জামি ২/৮৭৬।

[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, ৩/৩৮৯-৩৯০; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[9] সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৬-১০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৮।