কাব বিন মালেক (রাঃ) এবং তাঁর সাথীদের ঘটনা

কা’ব বিন মালেক (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) যত যুদ্ধ করেছেন, তাবুক যুদ্ধ ব্যতীত তার সবগুলোতেই আমি শরীক ছিলাম। তবে এর আগে আমি বদরের যুদ্ধেও অনুপস্থিত ছিলাম। বদরের যুদ্ধে যারা অনুপস্থিত ছিল, তাদের কাউকেই তিনি দোষারোপ করেন নি। কারণ তিনি বের হয়েছিলেন কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে ধরার জন্য। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে এবং তাদের শত্রুবাহিনীকে অনির্দিষ্ট একটি স্থানে এবং সময়ে একত্রিত করেছেন। আর আমি রসূল (ﷺ) এর সাথে আকাবার রাত্রিতে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমরা সকলেই ইসলামের বায়আত করেছিলাম। আকাবার বায়আতের চেয়ে আমার কাছে বদরের যুদ্ধে শরীক হওয়া অধিক পছন্দনীয় ছিল না। যদিও বদরের যুদ্ধের ঘটনাটি আকাবার ঘটনার চেয়ে অধিক আলোচিত বিষয় ছিল।

কা’ব বিন মালেক (রাঃ) বলেন- তাবুক যুদ্ধ হতে পিছিয়ে থাকার সময় আমি অন্য সময়ের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও স্বচ্ছল অবস্থায় ছিলাম। আল্লাহর শপথ! ইতিপূর্বে আমার নিকট কখনো একসাথে দু’টি সওয়ারী ছিলনা। অথচ এ যুদ্ধের সময় আমি দু’টি সওয়ারীর মালিক হয়ে গিয়েছিলাম। রসূলুল্লাহ্ (ﷺ)এর নিয়ম ছিল তিনি যখনই কোন যুদ্ধের ইচ্ছা করতেন, তখন সুস্পষ্ট করে যুদ্ধের স্থানের নাম জানাতেন না; বরং তিনি প্রথমে অস্পষ্ট কতিপয় শব্দ ব্যবহার করতেন। রসূল (ﷺ) যখন তাবুক যুদ্ধ করলেন তখন ছিল প্রচন্ড গরম। পথ ছিল দীর্ঘ ও বিপদাপদপূর্ণ। শত্রুর সংখ্যা ছিল প্রচুর। এ জন্যই তিনি মুসলমানদের কাছে বিষয়টি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করলেন। যাতে তারা ভালভাবে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং তিনি সেই যুদ্ধের কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমান তাঁর সাথে যাত্রা করলেন। তবে এমন কোন খাতা (রেজিষ্ট্রি খাতা) ছিলনা, যাতে তাদের সকলের নাম লিপিবদ্ধ থাকতো। কা’ব বলেন- যে ব্যক্তি সেদিন অনুপস্থিত থাকার ইচ্ছা পোষণ করতো, তার ধারণা ছিল যে অহী না আসা পর্যন্ত তার ব্যাপারটি রসূল (ﷺ) জানতে পারবেন না। রসূলুল্লাহ (ﷺ) সেই যুদ্ধটি এমন এক সময় করলেন, যখন ফল পেকে গিয়েছিল এবং ছায়ায় বসা আরামদায়ক মনে হত। রসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাথীগণ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন। আমি সকাল বেলা প্রস্ততি গ্রহণ করার কথা চিন্তা করতাম। কিন্তু সারা দিন চলে যেতো অথচ আমি কোন সিদ্ধামেত্মই উপনীত হতে পারতাম না। আমি মনকে এ বলে শান্তনা দিতাম যে, আমি প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। এভাবে দিন অতিবাহিত হতে থাকে। এরই মধ্যে লোকেরা পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিয়ে ফেলল। একদিন সকাল বেলা নাবী (ﷺ) মুসলমানদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। অথচ তখনো আমি কোন প্রস্ত্ততিই গ্রহণ করি নি। আমি বললামঃ এই তো এক দিন বা দু’দিনের মধ্যেই প্রস্ত্ততি নিয়ে নেবো এবং পথে তাদের সাথে মিলিত হয়ে যাবো। তাদের চলে যাবার পরের দিন সকালে আমি প্রস্ত্ততি নিতে চাইলাম। দিন চলে গেল। অথচ আমি কোন প্রস্ত্ততিই নিতে পারলামনা। তারপরের দিন আবার প্রস্ত্ততি নিতে চাইলাম, কিন্তু এবারও কিছুই করতে পারলাম না। দিনের পর দিন আমার এ অবস্থা চলতে থাকলো। এখন তো সকলেই দ্রুত গতিতে চলে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গিয়েছে। আমি পুনরায় বের হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম এবং তাদের সাথে মিলিত হতে চাইলাম। আহা! যদি আমি এমনটি করে ফেলতাম! কিন্তু তা আমার পক্ষে সম্ভব হলনা। রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বের হয়ে যাওয়ার পর আমি যখন শহরে লোকদের মাঝে বের হতাম এবং পথে-ঘাটে ঘুরাফেরা করতাম তখন এ বিষয়টি আমাকে খুবই ব্যথিত করতো যে, তখন শহরে মুনাফিক অথবা দুর্বল হওয়ার কারণে যাদেরকে আল্লাহ্ পিছনে থাকার অনুমতি দিয়েছেন তাদেরকে ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। তাবুক না পৌঁছে রসূল (ﷺ) রাস্তায় কোথাও আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন না। তবে তাবুকে পৌঁছে যখন তিনি সবাইকে নিয়ে বসলেন, তখন আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- কাবের কি হয়েছে। বনী সালামার এক লোক বলল- হে আল্লাহর রসূল! তার সুস্বাস্থ্য ও সম্পদের দু’টি চাদর তাকে আটকে দিয়েছে এবং সেই চাদর দু’টির কিনারায় তাকিয়ে দেখাতে ব্যস্ত রয়েছে। এ কথা শুনে মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বললেন- তুমি কতই না নিকৃষ্ট কথা বললে। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রসূল! আমি তার ব্যাপারে ভাল ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। রসূল (ﷺ) এ কথা শুনে চুপ করে থাকলেন।

কা’ব বিন মালিক (রাঃ) বলেন- যখন আমি জানতে পারলাম রসূল (ﷺ) ফিরে আসছেন, তখন আমি চিন্তা করতে লাগলাম এমন কোন মিথ্যা বাহানাবাজি করা যায় কি না, যার মাধ্যমে আমি তাঁর ক্রোধ হতে বেঁচে যেতে পারি। এ লক্ষ্যে আমি ঘরের প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোকের কাছে পরামর্শ চাইলাম। পরবর্তীতে যখন বলা হলো যে, রসূল (ﷺ) মদ্বীনার নিকটবর্তী হয়ে গেছেন, তখন আমার অন্তর থেকে সমস্ত বাতিল চিন্তা বের হয়ে গেল। আর আমি বুঝতে সক্ষম হলাম যে, মিথ্যা কথা আমাকে তাঁর ক্রোধ হতে বাঁচাতে পারবেনা। কাজেই আমি সত্য কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। সকালে রসূল (ﷺ) মদ্বীনায় পৌঁছে গেলেন। আর তাঁর নিয়ম ছিল যখনই তিনি সফর হতে ফিরে আসতেন প্রথমে মদ্বীনায় মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকআত সলাত পড়তেন। তারপর লোকদের সাথে কথা বলার জন্য বসে যেতেন। যখন তিনি সলাত শেষ করে বসে গেলেন, তখন তাবুক যুদ্ধ হতে পিছিয়ে থাকা লোকেরা আসতে লাগল। তারা নিজেদের ওযূহাত পেশ করতে লাগল এবং শপথ করতে লাগল। তাদের সংখ্যা ছিল আশির উপরে। রসূল (ﷺ) তাদের ওযর কবুল করে নিলেন। তাদের কাছ থেকে পুনরায় বায়আত নিলেন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করলেন। আর তাদের মনের গোপন বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করলেন। কা’ব বলেন- আমিও তাঁর কাছে আসলাম। আমি সালাম দিলে তিনি ক্রোধ মিশ্রিত মুচকি হেসে সালামের জবাব দিলেন। তারপর বললেন- এসো এসো। আমি গিয়ে তার সামনে বসে পড়লাম। তিনি আমাকে বললেন- তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? তুমি কি সওয়ারী কিনে রাখোনি? আমি বললামঃ হ্যাঁ আমি তা করেছিলাম। তবে আল্লাহর কসম! আমি যদি আপনি ছাড়া দুনিয়ার আর কোন মানুষের সামনে বসতাম, তাহলে তার ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য কোন মিথ্যা ওযূহাত পেশ করে চলে যেতাম। কারণ আমাকে কথা বলার যথেষ্ট যোগ্যতা প্রদান করা হয়েছে। কা’ব ইবনে মালেক বলেন- আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই অবগত আছি যে, আমি যদি আজ আপনার কাছে মিথ্যা বলে আপনাকে খুশী করে যাই, তাহলে কাল আল্লাহ্ আপনাকে আমার উপর নাখোশ করে দিবেন। আর আজ যদি আমি আপনার সামনে সত্য কথা বলে যাই, তাতে নাখোশ হলেও এতে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশা আছে। আল্লাহর কসম! আমার কোন ওযূহাত ছিলনা। আল্লাহর কসম! আমি যখন আপনার থেকে পিছনে রয়ে যাই তখন আমি যে রকম শক্তিশালী ছিলাম তেমন শক্তি ও সামর্থের অধিকারী অন্য কোন সময় ছিলামনা।

এ কথা শুনে রসূল (ﷺ) বললেন- কা’ব সত্য কথা বলেছে। ঠিক আছে চলে যাও। দেখো আল্লাহ্ তোমার ব্যাপারে কি ফয়সালা দেন। কা’ব বলেন- আমি উঠে পড়লাম। বনী সালামার কিছু লোকও আমার সাথে চলতে লাগল। তারা আমাকে বলল- আল্লাহর কসম! আমরা তো এ পর্যন্ত তোমার কোন গুনার কথা জানিনা। পিছনে থেকে যাওয়া অন্যান্য লোকদের মত তুমিও রসূল (ﷺ)এর নিকট একটি বাহানা পেশ করতে অক্ষম হয়ে গেলে? রসূল (ﷺ)এর ইসতেগফার তোমার গুনার জন্য যথেষ্ট হতো। আল্লাহর কসম! তারা বার বার আমাকে দোষারোপ করতে থাকলো। এমন কি এক পর্যায়ে আমি রসূল (ﷺ)এর নিকট ফিরে এসে প্রথম কথাটি মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে মনস্থ করলাম। তারপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ আমার মত আর কেউ আছে কি, যে রসূল (ﷺ)এর কাছে নিজের ভুল স্বীকার করেছে? তারা বলল- আরো দুইজন লোক আছে। তারাও আপনার মতই সত্য কথা স্বীকার করেছে। তাদেরকেও সেই কথা বলা হয়েছে, যা আপনাকে বলা হয়েছে। আমি তাদেরকে বললামঃ তারা কারা? লোকেরা জবাব দিল যে, তারা দু’জন হচ্ছেনঃ মুরারাহ ইবনে রাবীআ আল-আমরী ও হিলাল ইবনে উমাইয়া আল-ওয়াকিফী। মোট কথা, তারা আমার কাছে এমন দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করলেন, যারা ছিলেন ভাল লোক। তারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা ছিলেন খুবই আদর্শবান। তারা যখন তাদের নাম বলল, তখন আমি চলতে শুরু করলাম।

এদিকে রসূল (ﷺ) পিছনে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্য থেকে এই তিনজনের সাথে কথা বলা সকল মুসলমানের জন্য নিষেধ করে দিলেন। কাজেই লোকেরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগল। তাদের অবস্থা এত পরিবর্তন হয়ে গেল যে, তারা যেন আমাদেরকে চিনেইনা। পরিশেষে আমার অবস্থা এমন হলো যে, চিরচেনা পৃথিবীর সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশটি রাত কাটালাম। আমার অন্য ভাই দু’জন ঘরের মধ্যে বসে গেলেন এবং ক্রন্দন শুরু করলেন। আমি যেহেতু গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম, তাই আমি ঘর থেকে বের হতাম এবং মুসলমানদের সাথে সলাতে যোগ দিতাম এবং বাজারে ঘুরাফেরা করতাম। রসূল (ﷺ) যখন সলাতের পর লোকদেরকে নিয়ে বসতেন, তখনও আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিতাম। আমি মনে মনে ভাবতাম, আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়লো কি না? অতঃপর আমি তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে সলাত পড়তাম এবং বাঁকা দৃষ্টিতে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখতাম। আমি লক্ষ্য করতাম যে, আমি যখন সলাতে মশগুল থাকি, তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আবার আমি যখন তার দিকে চাইতাম, তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত লোকদের বিমুখতা যখন আমাকে দিশেহারা করে দিল, তখন একদিন আমার চাচাতো ভাই আবু কাতাদার বাগানের দেয়াল টপকে তার কাছে আসলাম। সে ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয়। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের জবাব দিলনা। আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আল্লাহর কসম দিয়ে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জাননা আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে ভালবাসি? সে চুপ করে থাকলো। আমি আবার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম। সে এবারও চুপ থাকলো। আমি তাকে তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলাম। এবার সে জবাব দিলঃ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলই ভাল জানেন। এ কথা শুনে আমার দু'চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। আমি দেয়াল টপকে চলে আসলাম। এ সময় আমি একদিন মদ্বীনার বাজারে হাঁটছিলাম। এসময় সিরিয়ার একজন খৃষ্টান কৃষক মদ্বীনার বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে এসেছিল। সে বলতে লাগল- কে আমাকে কা’ব বিন মালেকের ঠিকানা বলে দিতে পারে? লোকেরা আমার দিকে ইশারা করে তাকে বলে দিতে লাগল। সে আমার কাছে এসে গাস্সানের বাদশার একটি চিঠি আমার হাতে দিল। চিঠিতে বাদশা লিখছেনঃ আমি জানতে পেরেছি যে, আপনার নেতা আপনার উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। অথচ আল্লাহ্ আপনাকে লাঞ্জনা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখেন নি। আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন। আমরা আপনাকে মর্যাদা ও আরামের সাথে রাখবো। পত্রটি পড়ে আমি বললামঃ এটাও আর একটা পরীক্ষা। পত্রটি নিয়ে আমি চুলার নিকট গেলাম এবং তা পুড়ে ফেললাম। এভাবে পঞ্চাশ দিনের মধ্যে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এমন সময় রসূল (ﷺ)-এর একজন দূত আমার কাছে এসে বললেন- আল্লাহর রসূল তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললামঃ তালাক দিব? না অন্য কিছু করব? তিনি বললেন- না; বরং তার থেকে আলাদা থাক এবং তার কাছে যেয়োনা। আর আমার অন্য দু’জন সাথীর কাছেও অনুরূপ বার্তা পাঠালেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললামঃ তুমি নিজের আত্মীয়দের কাছে চলে যাও। আল্লাহ্ আমার ব্যাপারে কোন ফয়সালা না দেয়া পর্যন্ত তাদের কাছে অবস্থান করতে থাকো।

কা’ব বিন মালেক বলেন- হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী রসূল (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন- হে আল্লাহর রসূল! হেলাল ইবনে উমাইয়া অতি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে। তার কোন খাদেম নেই। আমি যদি তার খেদমত করে দেই, তাতে কোন অসুবিধা আছে কি? জবাবে তিনি বললেন- কোন ক্ষতি নেই। তবে সে যেন তোমার কাছে না আসে। হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী বললেন- আল্লাহর কসম! তার মধ্যে এধরণের কোন আকাঙ্খা নেই। আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে এঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে সে কেঁদে চলছে এবং আজো সে কাঁদছে। কাব বললেন- আমার পরিবারের কেউ কেউ আমাকে বলল- রসূল (ﷺ) হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রীকে তার স্বামীর খেদমত করার জন্য যেমন অনুমতি দিয়েছেন তেমন তুমিও তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে একটা অনুমতি নিয়ে আসতে পার। আমি বললামঃ আল্লাহর কসম! আমি রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর কাছে অনুমতি আনতে যাবোনা। আমি জানি না রসূল (ﷺ) এর কাছে এ ব্যাপারে অনুমতি চাইতে গেলে কি বলবেন। আর আমি তো একজন যুবক লোক। এরপর আমি দশ রাত কাটালাম। রসূল (ﷺ) আমাদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের পঞ্চাশ দিন পূর্ণ হয়ে গেল। পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হওয়ার পর ফজরের সলাত পড়লাম। সলাত শেষে আমি আমাদের ঘরের সামনে বসেছিলাম। এ সময় আমার অবস্থা সে রকমই ছিল যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআন মজীদে বর্ণনা করেছেন। আমার জীবন আমার নিকট যন্ত্রনাদায়ক হয়ে গেল। পৃথিবী বিশাল হওয়া সত্ত্বেও তা আমার নিকট অত্যন্ত সংকীর্ণ মনে হচ্ছিল। তখন আমি একটা আওয়াজ শুনলাম। সালা পাহাড়ের উপর থেকে কে একজন চিৎকার করে বলল- হে কা’ব বিন মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর। কা’ব বলেন- এ কথা শুনে আমি সেজদায় পড়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার কষ্ট কেটে গেছে। ফজরের সলাতের পর রসূল (ﷺ) আমাদের তাওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। লোকেরা আমাদের কাছে এসে সুসংবাদ দিতে লাগলো। আমার অপর দু’জন সাথীর কাছে গিয়েও সুসংবাদ ও মুবারকবাদ দিতে লাগলো। একজন তো ঘোড়ায় চড়ে এক দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি দৌড়িয়ে পাহাড়ে উঠলেন। তার কথা অশ্বারোহীর চেয়েও দ্রুততর হলো। আমি যেই সুসংবাদ গ্রহণকারীর আওয়াজ শুনেছিলাম, তিনি যখন আমার কাছে আসলেন তখন আমি এতো খুশী হলাম যে, আমার পোশাক জোড়া খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! তখন আমার কাছে ঐ কাপড় জোড়া ছাড়া আমার কোন কাপড় ছিলনা। তারপর আমি এক জোড়া কাপড় ধার করে নিলাম এবং পরিধান করে রসূল (ﷺ) এর সাথে সাক্ষাত করতে বের হলাম। চলার পথে লোকেরা দলে দলে আমার সাথে সাক্ষাত করতে লাগল। তাওবা কবুল হওয়ার কারণে আমাকে মুবারকবাদ জানাতে লাগল। তারা বলতে লাগলোঃ আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এজন্য তোমাকে মুবারকবাদ। কা’ব বলেন- আমি যখন মসজিদে গেলাম, তখন দেখলামঃ রসূল (ﷺ) বসে আছেন। লোকেরা চার পাশ থেকে তাঁকে ঘিরে বসে আছে। এ সময় তালহা বিন উবাইদুল্লাহ্ আমার দিকে দৌড়ে এসে আমার সাথে মুসাফাহা করলেন এবং আমাকে মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! মুহাজিরদের মধ্য হতে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ আমার নিকট এসে মুবারকবাদ দেন নি। তালহার এই আচরণ আমি কখনই ভুলতে পারবো না। কা’ব বলেন- তারপর আমি রসূল (ﷺ)কে সালাম দিলাম। তখন তাঁর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বললেন- হে কা’ব! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ করো। আজকের দিনটি তোমার জন্য মুবারক হোক, যা তোমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত অতিক্রান্ত দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল। কা’ব বলেন- আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ হতে? না আল্লাহর পক্ষ হতে? তিনি বললেন- না; বরং তা আল্লাহর পক্ষ হতে। আর রসূল (ﷺ) যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা মুবারক চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। আর আমরা চেহারা দেখে তাঁর খুশী বুঝতে পারতাম। আমি তাঁর সামনে বসে বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার তাওবা কবুলের শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সমস্ত সম্পদ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের পথে সাদকা করতে চাই। রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন- সম্পদের কিছু নিজের জন্য রেখে দাও। তাতে তোমার ভাল হবে। আমি বললামঃ তাহলে আমি শুধু খায়বারের অংশটুকু আমার জন্য রাখলাম। তারপর আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি সত্য বলার কারণে আল্লাহ্ আমাকে নাজাত দিয়েছেন। কাজেই আমার তাওবা কবুল হওয়ার কারণে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে আমি সত্য কথাই বলতে থাকবো। আল্লাহর কসম! রসূল (ﷺ) এর কাছে সত্য কথা বলার কারণে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ্ আমাকে যেমন সুন্দরভাবে পরীক্ষা করেছেন তার চেয়ে অধিক সুন্দর পরীক্ষা অন্য কোন মুসলমানকে করেছেন কি না- তা আমার জানা নেই। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোন মিথ্যা কথা বলিনি। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোয় আল্লাহ্ আমাকে মিথ্যা থেকে বাঁচাবেন বলে আশা করি। আর আল্লাহ্ তাঁর রসূলের উপর নিম্নের এই আয়াতটি নাযিল করেছেনঃ
لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ-إلى قوله وَكُوْنُوا مَعَ الصَّادِقِيْنَ


‘‘আল্লাহ নাবী, মুহাজির ও আনসারদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখান থেকে ‘‘তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাকো’’ পর্যন্ত। (সূরা তাওবা-৯:১১৭-১১৯) কা’ব বলেন- আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহণ করার পর এর চেয়ে বড় আর কোন অনুগ্রহ আমার উপর হতে দেখিনি যে, রসূল (ﷺ) এর সামনে সত্য কথা বলার তাওফীক দান করে আমাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। অন্যথায় অন্য মিথ্যাচারীদের ন্যায় আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম। কেননা অহী নাযিল হওয়ার সময় আল্লাহ্ তা‘আলা মিথ্যাবাদীদের সম্পর্কে যে মারাত্মক কথা বলেছেন তা আর কারোর সম্পর্কে বলেন নি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-


سَيَحْلِفُونَ بِاللهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللهَ لا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ


‘‘তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে তারা তোমাদের নিকট আল্লাহর নামে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা কর। কাজেই তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা কর, তারা অপবিত্র, তাদের বাসস্থান জাহান্নাম। তারা যা করেছে, তার বিনিময়ে এটাই তাদের ন্যায্য প্রাপ্য। তারা তোমাদের কাছে শপথ করবে, যাতে তোমরা তাদের উপর খুশী হয়ে যাও। কিন্তু তোমরা তাদের উপর খুশী হলেও আল্লাহ্ অবাধ্য সম্প্রদায়ের উপর খুশী হবেন না। (সূরা তাওবা-৯:৯৫-৯৬)