কিরাআত পাঠ শেষ করে তিনি রাফউল ইয়াদাইন করতেন এবং ‘আল্লাহু আকবার’ বলে রুকূতে যেতেন। উভয় হাতের তালু তাঁর উভয় হাঁটুর উপর রাখতেন। মনে হত, তিনি যেন উভয় বাহুকে খুঁটির মত শক্ত করে উভয় হাত দিয়ে উভয় হাঁটু ধরে আছেন। বাহুদ্বয়কে পার্শ্বদেশ হতে পৃথক করে রাখতেন। পিঠকে সোজাভাবে লম্বা করে রাখতেন। মাথা উপরের দিকে বেশী উঠিয়েও রাখতেন না এবং নীচু করেও রাখতেন না; বরং পিঠ বরাবর সোজা করে রাখতেন। রুকূতে তিনি বলতেন-

سُبْحَان رَبِّي الْعَظِيم ‘‘আমি প্রশংসার সাথে মহান প্রভুর পবিত্রতা বর্ননা করছি।’’[1] কখনও এই দু’আটির সাথে পড়তেন-

سُبْحَانك اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِك اللّٰهُمَّ اِغْفِرْ لِي

‘‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু। তোমার প্রশংসার সহিত তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর’’।[2]

কখনও শুধু সুবহানা রাববীয়াল আযীম পড়তেন। তিনি সাধারণতঃ রুকুতে এতটুক সময় অবস্থান করতেন যে, তাতে স্বাভাবিকভাবে দশবার সুবহানা রাববীয়াল আযীম পড়া যেত। সিজদাতেও তিনি অনুরূপ সময় অবস্থান করতেন।

কখনও কখনও তিনি রুকু ও সিজদাতে সমান পরিমাণ সময় অবস্থান করতেন। তবে তিনি কেবল রাতের সলাতেই কখনও কখনও এমনটি করতেন। অধিকাংশ সময় নাবী (ﷺ) এর সলাতগুলো ভারসাম্যপূর্ণ হত। অর্থাৎ সলাতের প্রতিটি রুকন পালনে প্রায় সমান পরিমান সময় ব্যয় করতেন। একটির তুলনায় অন্যটি পালনের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করতেন না। রুকুতে তিনি এই দু’আও পড়তেন-

سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوحِ

‘‘ফিরিস্তাকূল এবং জিবরীলের প্রতিপালক অতি পবিত্র’’।[3]

আবার কখনও তিনি বলতেন-

اللّٰهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَلَكَ أَسْلَمْتُ خَشَعَ لَكَ سَمْعِى وَبَصَرِى وَمُخِّى وَعَظْمِى وَعَصَبِى

‘‘হে আল্লাহ! তোমার জন্যই রুকু করেছি’’। একমাত্র তোমার প্রতিই ঈমান এনেছি এবং তোমার কাছেই আত্মসমর্পন করেছি। তোমার ভয়ে ও শ্রদ্ধায় আমার কান, আমার চোখ, আমার মন-মগজ, আমার হাড় এবং আমার পেশী বিনীত হয়েছে।’’ তবে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে এটি তিনি রাতের সলাতের রুকুতে পাঠ করতেন। অতঃপর তিনি বলতেন-

سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রশংসা করে আল্লাহ্ তা শুনে থাকেন।’’[4]

পাঠ করতে করতে রুকু হতে মাথা উঠাতেন এবং রাফউল ইয়াদাইন করতেন। তিনি সব সময় রুকু হতে উঠে পিঠ সোজা করে দাঁড়াতেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়াতেন। দুই সিজদার মাঝখানেও তিনি পরিপূর্ণরূপে সোজা হয়ে বসতেন। তিনি বলেছেন-

لَا تُجْزِئُ صَلَاةٌ لَا يُقِيمُ الرَّجُلُ فِيهَا صُلْبَهُ فِي الرُّكُوعِ وَالسُّجُود

‘‘ঐ ব্যক্তির সলাত বিশুদ্ধ হবেনা, যে রুকু ও সিজদায় পিঠ সোজা করেনা’’।[5]

রুকু হতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন-

رَبَّنَا وَ لَكَ الْحَمْدُ

‘‘হে আমাদের প্রভু! তোমার জন্যই সমস্ত প্রশংসা’’। কখনও তিনি মাঝখানে ওয়াও বাদ দিয়ে বলতেন- رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ। কখনও বলতেন- اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَ لَكَ الْحَمْدُ তবে আল্লাহুম্মা এবং ওয়াও বৃদ্ধিসহ বর্ণনাটি সহীহ নয়।[6]

রুকুতে তিনি যে পরিমাণ সময় অবস্থান করতেন, রুকু হতে উঠেও তিনি সেই পরিমাণ সময় অবস্থান করতেন। রুকু হতে উঠে দাঁড়িয়ে এই দীর্ঘ দু’আটিও পড়তেনঃ

اللّٰهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَوَاتِ وَمِلْءَ الأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَىْءٍ بَعْدُ أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْد وكُلُّنَا لَكَ عَبْدُ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ

‘‘হে আল্লাহ! তোমার জন্য আকাশ-পৃথিবী পূর্ণ প্রশংসা এবং এতদুভয় ছাড়া তুমি অন্য যা কিছু চাও তা ভর্তি প্রশংসা তোমার জন্য। হে আল্লাহ! তুমি প্রশংসা, বড়ত্ব ও সম্মানের অধিকারী! তোমার প্রশংসায় বান্দা যা বলে, তুমি তার চেয়েও অধিক প্রশংসার হকদার। আমরা সকলেই তোমার বান্দা। হে আল্লাহ! তুমি যা দাও তাতে বাধা দেয়ার কেউ নেই। তুমি যা বারণ কর তা দেয়ার মত কেউ নেই। আর তোমার পাকড়াও হতে কোন বিত্তশালী ও পদমর্যাদার অধিকারীকে তার ধন সম্পদ বা পদমর্যাদা রক্ষা করতে পারবেনা’’।[7]

তিনি এই দু’আও পড়তেন-

اللّٰهُمَّ اغْسِلْنِى مِنْ خَطَايَاىَ بِالثَّلْجِ وَالْمَاءِ وَالْبَرَدِ وَ نَقِّنِى مِنْ الذُّنُوْبِ وَالخَطَايَاَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ وَ بَاعِدْ بَيْنِى وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ

‘‘হে আল্লাহ! আমাকে বরফ, পানি এবং শিশির দ্বারা পবিত্র কর। হে আল্লাহ! আমাকে ভুল-ত্রুটি এবং পাপ থেকে এমনভাবে পবিত্র কর যেমন সাদা কাপড় থেকে ময়লা পরিষ্কার করা হয়। হে আল্লাহ! তুমি আমার এবং আমার পাপসমূহের মাঝে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও যেমন দূরত্ব সৃষ্টি করেছ পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে’’। সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বারবার لِرَبِّىَ الْحَمْدُ পাঠ করতেন, যাতে রুকুর পর দাঁড়ানোর সময় রুকুতে অবস্থান করার সময়ের সমান হয়ে যেত।

ইমাম মুসলিম (রহঃ) আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী (ﷺ) سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলার পর এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, আমরা মনে করতাম তিনি ভুলে গেছেন। অতঃপর তিনি সিজদা করতেন। সিজদাহ হতে উঠেও তিনি এতক্ষণ বসে থাকতেন যে আমরা মনে করতাম তিনি ভুলে গেছেন।

এটিই ছিল নাবী (ﷺ) এর প্রসিদ্ধ রীতি। এই রুকন দু’টি অতি সংক্ষেপে পালন করা বনী উমাইয়ার শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতার অন্তর্ভুক্ত। তারাই সর্বপ্রথম রুকু হতে উঠে এবং দুই সিজদার মাঝখানে অতি সামান্য সময় অবস্থান করার নিয়ম চালু করে। এরপর লোকেরা এটাকেই সুন্নাত মনে করে নিয়েছে।

[1]. মুসলিম, হাএ. হা/১৬৯৯, ইফা. ১৬৮৪, ইসে. ১৬৯১, আবু দাউদ,আলএ. হা/ ৮৭১ ইফা. হা/৮৭১ নাসায়ী, মাপ্র.হা/১৬৬৪, ইফা. ১৬৬৭, তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৬২, সহীহ ইবনে মাজাহ, মাশা. হা/৭২৫, মিশকাত, হাএ. হা/৮৮০

[2]. বুখারী, তাও. হা/৮১৭, ইফা. হা/৭৮০, নাসায়ী, মাপ্র. ১১২২, ইফা.হা/১১২৬,মিশকাত, হাএ. হা/৮৭১, সহীহ, তাহক্বীক্বব: আলবানী রহ.

[3]. মুসলিম, হাএ. হা/ ৯৭৮, ইফা. হা/৯৭৩, ইসে. হা/৯৮৪, আবু দাউদ,আলএ. হা/৮৭২, নাসায়ী, মাশা. হা১০৪৮, মিশকাত, হাএ. হা৭৮২, সহীহ, আলবানী রহ.

[4]. বুখারী, তাও. হা/৭৩২, ইফা. হা/৬৯৬, আপ্র. হা/৬৮৮, মুসলিম. হাএ. হা/৭৫৪, ইফা.হা/৭৫২, ইসে. হা/৭৬৫, আবু দাউদ,আলএ.হা/৬০১, নাসায়ী, মাপ্র. হা/৮৭৬, তিরমিযী, মাপ্র.হা/২৬৭, মিশকাত, হা/১১৩৯

[5]. সুনানে নাসাঈ, অধ্যায়ঃ সলাতে পিঠ সোজা করা। ইমাম আলবানী রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ ওয়া যঈফু সুনানে নাসাঈ, হা. ১০২৭।

[6]. তবে ইমাম আলবানী রহঃ) তাঁর সালাত বিষয়ক কিতাবে একে সহীহ বলেছেন।

[7]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ রুকু হতে মাথা উঠিয়ে কি বলবে?