কোনো কিছুর চারদিকে প্রদক্ষিণ করাকে শাব্দিক অর্থে তাওয়াফ বলে। হজ্জের ক্ষেত্রে কাবা শরীফের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। পবিত্র কাবা ব্যতীত অন্য কোনো জায়গায় কোনো জিনিসকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা হারাম।

হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করল, ও দু’রাকাত সালাত আদায় করল, তার এ কাজ একটি গোলাম আযাদের সমতুল্য হল।[1] হাদিসে আরো এসেছে, ‘তুমি যখন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলে, পাপ থেকে এমনভাবে বের হয়ে গেলে যেমন নাকি আজই তোমার মাতা তোমাকে জন্ম দিলেন।[2]

[1] - من طاف بالبيت وصلى ركعتين كان كعتق رقبة (ইবনু মাযাহ : ২৯৫৬; আলবানী এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন: সহীহু ইবনি মাযাহ: ২৩৯৩)

[2] - فإذا طفت بالبيت خرجت من ذنوبك كيوم ولدتك أمك (মুসান্নাফু আব্দিুররাজ্জাক : ৮৮৩০)
তাওয়াফের প্রকারভেদ ১. তাওয়াফে কুদুম

এফরাদ হজ্জকারী মক্কায় এসে প্রথম যে তাওয়াফ আদায় করে তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। কেরান হজ্জকারী ও তামাত্তু হজ্জকারী উমরার উদ্দেশ্যে যে তাওয়াফ করে থাকেন তা তাওয়াফে কুদুমেরও স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়।

তবে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী কেরান হজ্জকারীকে উমরার তাওয়াফের পর ভিন্নভাবে তাওয়াফে কুদুম আদায় করতে হয়। হানাফি মাজহাবে তামাত্তু ও শুধু উমরা পালনকারীর জন্য কোনো তাওয়াফে কুদুম নেই।

কুদুম শব্দের অর্থ আগমণ। সে হিসেবে তাওয়াফে কুদুম কেবল বহিরাগত হাজিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীরা যেহেতু অন্য কোথাও থেকে আগমন করে না, তাই তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম সুন্নত নয়।

সকল হজ্জকারীকেই এ তাওয়াফটি আদায় করতে হয়। এটা হল হজ্জের ফরজ তাওয়াফ যা বাদ পড়লে হজ্জ সম্পন্ন হবে না। তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের আওয়াল ওয়াক্ত শুরু হয় ১০ তারিখ সুবহে সাদেক উদয়ের পর থেকে। জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পন্ন করা ভাল। এর পরে করলেও কোনো সমস্যা নেই। সাহেবাইন (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) এর নিকট তাওয়াফে এফেদা আদায়ের সময়সীমা উন্মুক্ত। ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকট তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের ওয়াজিব সময় হল ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এ সময়ের পরে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করলে ফরজ আদায় করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে তবে ওয়াজিব তরক হওয়ার কারণে দম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল হয় না।

বায়তুল্লাহ শরীফ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে বিদা বলে। এ তাওয়াফ কেবল বহিরাগতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেহেতু মক্কায় বসবাসকারী হাজিদের জন্য প্রযোজ্য নয়, তাই এ তাওয়াফ হজ্জের অংশ কি-না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা হজ্জের অংশ হলে মক্কাবাসী এ থেকে অব্যাহতি পেত না। মুসলিম শরীফের একটি হাদিস থেকেও বুঝা যায় যে বিদায়ি তাওয়াফ হজ্জের অংশ নয়। হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন, يقيم المهاجربمكة بعد قضاء نسكه ثلاثا মুহাজির ব্যক্তি হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর মক্কায় তিন দিন অবস্থান করবে।[1] ‘হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর’ এই বাক্য দ্বারা বুঝা যায় যে বিদায়ি তাওয়াফের পূর্বেই হজ্জের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে বহিরাগত হাজিদের জন্য বিদায়ি তাওয়াফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হানাফি মাজহাবে ওয়াজিব। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)তাগিদ দিয়ে বলেছেন, বায়তুল্লাহর সাথে শেষ সাক্ষাৎ না দিয়ে তোমাদের কেউ যেন না যায়।[2] তবে এ তাওয়াফ যেহেতু হজ্জের অংশ নয় তাই ঋতুস্রাবগ্রস্থ মহিলা বিদায়ি তাওয়াফ না করে মক্কা থেকে প্রস্থান করতে পারে।

[1] - মুসলিম : হাদিস নং ২৪০৯

[2] - لا ينفرن أحد حتى يكون آخر عهده بالبيت (মুসলিম)

উমরা আদায়ের ক্ষেত্রে এ তাওয়াফ ফরজ ও রুকন। এ তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা উভয়টাই রয়েছে।

ইহা মান্নত হজ্জকারীদের ওপর ওয়াজিব।

ইহা মসজিদুল হারামে প্রবেশকারীদের জন্য মুস্তাহাব। তবে যদি কেউ অন্য কোনো তাওয়াফ করে থাকে তাহলে সেটিই এ তাওয়াফের স্থলাভিষিক্ত হবে।

যখন ইচ্ছা তখনই এ তাওয়াফ সম্পন্ন করা যায়।

তাওয়াফের পূর্বে পবিত্রতা জরুরি। কেননা আপনি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছেন যা পৃথিবীর বুকে পবিত্রতম জায়গা। বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)প্রথমে ওজু করেছেন, তারপর তাওয়াফ শুরু করেছেন। [1] আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)যেভাবে হজ্জ করেছেন আমাদেরকেও তিনি সেভাবেই হজ্জ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘خذوا عنى مناسككم - আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ্জকর্মসমূহ জেনে নাও।’[2] ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তাওয়াফকে সালাতের তুল্য বলা হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, আল্লাহ তা’আলা এতে কথা বলা বৈধ করে দিয়েছেন, তবে যে কথা বলতে চায় সে যেন উত্তম কথা বলে।[3] এহরাম অবস্থায় আয়েশা (রাঃ) এর ঋতুস্রাব শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)তাঁকে তাওয়াফ করতে নিষেধ করে দেন।[4] এ হাদিসও তাওয়াফের সময় পবিত্রতার গুরুত্বের প্রতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে কারণেই ইমাম মোহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ ওজু অবস্থায় তাওয়াফ করাকে ওয়াজিব বলেছেন।[5]

তাওয়াফের সময় সতর ঢাকাও জরুরি। কেননা জাহেলি-যুগে উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করার প্রথাকে বন্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,

يَا بَنِي آَدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ.

- হে বনী আদম, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সৌন্দর্য অবলম্বন করো।[6] ইবনে আব্বাস (রাঃ) সৌন্দর্য অর্থ পোশাক বলেছেন। এক হাদিস অনুযায়ী তাওয়াফও একপ্রকার সালাত তা পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে। তাছাড়া ৯ হিজরীতে, হজ্জের সময় পবিত্র কাবা তাওয়াফের সময় যেন কেউ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ না করে সে মর্মে ফরমান জারি করা হয়।[7]

তাওয়াফের শুরুতে নিয়ত করা বাঞ্ছনীয়। তবে সুনির্ধারিতভাবে নিয়ত করতে হবে না। বরং মনে মনে এরূপ প্রতিজ্ঞা করলেই চলবে যে আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছি। অনেক বই-পুস্তকে তাওয়াফের যে নিয়ত লেখা আছে-আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাওয়াফা বায়তিকাল হারাম ফা য়াস্সিরহু লি ওয়া তাকাববালহু মিন্নি—হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই।

সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করা উচিৎ। চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করা কখনো উচিৎ নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইনদের মধ্যে কেউ চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করেছেন বলে হাদিস ও ইতিহাসে নেই।

তাওয়াফ হজ্জরে আসওয়াদ থেকে শুরু করে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে শেষ করতে হবে। কেউ যদি হজ্জরে আসওয়াদের বরাবর আসার একটু পূর্বেও তাওয়াফ ছেড়ে দেয় তাহলে তার তাওয়াফ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে না।

তাওয়াফ করার সময় রামল ও ইযতিবা

কোন কোন তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা আছে তা নিয়ে ফেকাহবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। উমরার তাওয়াফ ও কুদুমের তাওয়াফেই কেবল ইযতিবা আছে, এটাই হল বিশুদ্ধ অভিমত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এ দু’ধরনের তাওয়াফে রমল ও ইযতিবা করেছেন।[8] হানাফি মাজহাব অনুসারে যে তাওয়াফের পর সাফা-মারওয়ার সাঈ আছে সে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল ও পুরা তাওয়াফে ইযতিবা আছে।

নারীর তাওয়াফ

নারী অবশ্যই তাওয়াফ করবে। তবে পুরুষদের সাথে মিশ্রিত হয়ে নয়। যখন ভিড় কম থাকে তখন নারীদের তাওয়াফ করা বাঞ্ছনীয়। অথবা, একটু সময় বেশি লাগলেও দূর দিয়ে নারীরা তাওয়াফ করবে। পুরুষের ভিড়ে নারীরা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে যাবে না। আয়েশা (রাঃ) এর তাওয়াফের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে—

كانت عائشة رضى الله عنها تطوف حجرة من الرجال ، لا تخالطهم ، فقالت امرأة: انطلقى نستلم يا أم المؤمنين . قالت: انطلقي -- عنك ، وأبت .

-আয়েশা (রাঃ) পুরুষদের একপাশ হয়ে একাকী তাওয়াফ করতেন। পুরুষদের সাথে মিশতেন না। এক মহিলা বললেন: চলুন, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করি। তিনি বললেন, তুমি যাও—আমাকে ছাড়। তিনি যেতে অস্বীকার করলেন।[9]

ঋতুস্রাব অবস্থায় নারীরা তাওয়াফ করবে না। প্রয়োজন হলে হজ্জের সময়ে ঋতুস্রাব ঠেকানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, ব্যবহার করার বৈধতা রয়েছে। তাওয়াফের সময় নারীর জন্য কোনো রামল বা ইযতিবা নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)নারীকে রামল ইযতিবা করতে বলেননি।

হজ্জের ফরজ তাওয়াফের সময় যদি কারও ঋতুস্রাব চলে আসে এবং ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করা কোনো ক্রমেই সম্ভব না হয়, পরবর্তীতে এসে ফরজ তাওয়াফ আদায় করারও কোনো সুযোগ না থাকে, এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ ওলামাগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে ন্যাপকিন দিয়ে ভালো করে বেঁধে তাওয়াফ আদায় করে নিতে পারে।

[1] - أن أول شيء بدأ به النبي صلى الله عليه وسلم حين قدم ، أن توضأ ثم طاف بالبيت

(ফাতহুল বারী : ৩/৩০৩ , হাদিস নং ১৬৪১)

[2] - শারহুননববী আলা মুসলিম: খন্ড ৮ , ২২০

[3] - عن ابن عباس رضى الله عنهما : أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الطواف صلاة إلا أن الله تعالى أحل فيه الكلام ، فمن تكلم فلا يتكلم إلا بخير بالبيت (মুহাদ্দিস নাসীরুদ্দিন আল-বানী এ হাদিসটি সহিহ বলেছেন: এরওয়া : ২১)

[4] - فاقضي ما يقضي الحاج ، غير أن لا تطوفي بالبيت حتى تغتسلى - অন্য হাজীরা যা করে তুমিও তাই করবে, তবে পবিত্র হয়ার পর গোসলের পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। (মুসলিম)

[5] - ইমাম মুহাম্মদ আশ্শানকীতি: খালিসূল জুমান,পৃ: ১৮২

[6] সূরা আরাফ : ৩১

[7] - ইবনে কাছীর : খন্ড১, পৃ: ১৫৭

[8] - দেখুন : ফাতহুল বারী : ৩/২৬৯

[9] - বুখারি : ১৫১৩
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »