সর্বাঙ্গ সুন্দর ইসলামের সুষ্ঠ এক বিধান হল জামাআত তথা তার পরিচালক একক ইমাম বা নেতার বিধান। ইমাম হলেন সমাজের নেতা। সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠ জীবন-যাপন করার জন্য নেতার দরকার একান্ত। যিনি হবেন মুসলিমের সমাজ-কেন্দ্র মসজিদের ইমাম এবং তিনিই হবেন ইসলামী-শরীয়ত ব্যাখ্যা দাতা তথা নির্দেশ প্রদানকারী। তিনি হবেন সকলের সকল কাজের আগে। তাঁর মুগ্ধকারী আখলাক-চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং সর্বপ্রকার আচরণে সমাজের জন্য দিক-নির্ণয়ক তারা। তিনি প্রচলিত ‘মোল্লা’ নন, তাঁর দৌড় মসজিদ পর্যন্তই নয়। বরং তাঁর দৌড় গোরের পরেও পরপারের সুখময় জীবন পর্যন্ত।

তিনি সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়। তিনি সমাজ-সংস্কারক, সুপরামর্শদাতা, কল্যাণকামী ও শুভানুধ্যয়ী। তিনি ইসলামের বিশাল ইবাদত নামাযের নেতা, তিনিই জিহাদের ময়দানে প্রধান সেনাপতি।

ইমামতির সবচেয়ে বেশী যোগ্য তিনি, যিনি কুরআনের হাফেয; যিনি (তাজবীদ সহ্‌) ভালো কুরআন পড়তে পারেন। তাজবীদ ছাড়া হাফেয ইমামতির যোগ্য নয়। পূর্ণ হাফেয না হলেও যাঁর পড়া ভালো এবং বেশী কুরআন মুখস্থ আছে তিনিই ইমাম হওয়ার অধিক যোগ্য।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তি হলে ওদের মধ্যে একজন ইমামতি করবে। আর ইমামতির বেশী হ্‌কদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে।” (মুসলিম, মিশকাত ১১১৮নং)

তিনি আরো বলেন, “লোকেদের ইমাম সেই ব্যক্তি হবে যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে। পড়াতে সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যে বেশী সুন্নাহ্‌ জানে, সুন্নাহর জ্ঞান সকলের সমান থাকলে ওদের মধ্যে যে সবার আগে হিজরত করেছে, হিজরতেও সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যার বয়স বেশী সে ইমাম হবে। আর কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১১৭নং)

উল্লেখ্য যে, সাধারণ নামাযীর মত ইমামতির জন্যও সুন্নতী লেবাস উত্তম। তবে মাথায় পাগড়ী, রুমাল বা টুপী হওয়া কিংবা মাথা ঢাকা ইমামতির জন্য শর্ত, ফরয বা জরুরী নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮৬, ৩৮৯) সুতরাং যার মাথা ঢাকা আছে তার থেকে যার মাথা ঢাকা নেই, সে ভালো কুরআন পড়তে পারলে সেই ইমামতির হ্‌কদার।

এমন কতক লোক আছে যাদেরকে আপাত:দৃষ্টিতে ইমামতির অযোগ্য মনে হলেও প্রকৃতদৃষ্টিতে তাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ। অবশ্য শুরুতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি মনে রাখলে এ প্রসঙ্গে অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তির নামায শুদ্ধ, তার ইমামতিও শুদ্ধ এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ। আর যার নামায শুদ্ধ নয়, তার ইমামতিও শুদ্ধ নয় এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৬-৩১৭)

যারা ইমাম হওয়ার যোগ্য নয় বলে ধারণা হতে পারে অথচ (ইমামতির গুণাবলী বর্তমান থাকলে) তারা আসলে তার যোগ্য এমন কিছু লোক নিম্নরুপ :-

১ । অন্ধ :

অন্ধ মানুষের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সন্দেহ্‌ থাকলেও সব অন্ধ সমান নয়। সুতরাং যোগ্যতা থাকলে সে ইমাম হতে পারে। আল্লাহর রসূল (ﷺ) অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূমকে দু-দু বার মদ্বীনার ইমাম বানিয়েছিলেন এবং তিনি লোকেদের নামাযের ইমামতি করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১২১নং)

২। ক্রীতদাস :

ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দী দাস, মুক্তদাস, সাধারণ দাস, ভৃত্য, চাকর, বা রাখাল যোগ্য হলে তার ইমামতি শুদ্ধ এবং এমন আতরাফদের পশ্চাতে আশরাফদেরও নামায শুদ্ধ। মহানবী (ﷺ) যখন মদ্বীনায় প্রথম প্রথম হিজরত করে এলেন, তখন মুহাজেরীনরা কুবার নিকটবর্তী উসবাহ্‌ নামক এক জায়গায় অবস্থান শুরু করলেন। সেখানে আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর মুক্ত করা দাস সালেম (রাঃ) লোকেদের ইমামতি করতেন। তাঁর সবার চাইতে বেশী কুরআন মুখস্থ ছিল। অথচ তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীদের মধ্যে হযরত উমার এবং আবূ সালামাও ছিলেন। (বুখারী, ৬৯২, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৮নং, মিশকাত ১১২৭নং)

তদনুরুপ হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মুক্ত করা দাস আবূ আম্‌র নামাযের ইমামতি করতেন। (মুসনাদ ইমাম শাফেয়ী) তাঁর যাকওয়ান নামক আর এক মুক্ত করা দাসও ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)

৩। মুসাফির :

মুসাফিরের জন্য সফরে নামায জমা ও কসর করা সুন্নত হলেও এবং সে ইমামতি করার সময় নামায কসর করে পড়লেও তার পিছনে গৃহ্‌বাসীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গৃহ্‌বাসীরা ঐ মুসাফির ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায পূরণ করে নেবে। অর্থাৎ, ইমাম ও মুক্তাদী মিলে ২ রাকআত হয়ে গেলে মুক্তাদীরা ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একা একা আরো বাকী ২ রাকআত পড়ে নেবে। আর সে নামায জমা করে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা তা করবে না।

৪। দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি :

দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ। তবে মুক্তাদীরাও (দাঁড়ানোর সময়) বসে নামায পড়বে। মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইমাম এ জন্যই বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং --- সে যখন দাঁড়িয়ে নামায পড়বে, তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড় এবং যখন বসে নামায পড়বে তখন তোমরাও বসে নামায পড়। আর সে বসে থাকলে তোমরা দাঁড়াও না; যেমন পারস্যর লোকেরা তাদের সম্মানার্হ ব্যক্তিদের জন্য করে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৩৫৬নং)

কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বসে নামায পড়লে তাঁর পশ্চাতে সাহাবীগণ দাঁড়িয়েই নামায পড়েছেন। এর ফলে উলামাগণ বলেন যে, ইমাম সাময়িক অসুবিধার কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বে। নচেৎ, শেষ জীবনে বাধ্যক্যজনিত কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরা (দাঁড়ানোর সময়) দাঁড়িয়েই নামায পড়বে।

বলা বাহুল্য, তাঁর পূর্বেকার আমল মনসূখ নয়। কারণ, তাঁর আমল দ্বারা তাঁর আদেশ মনসূখ হয় না। তাছাড়া তাঁর পরবর্তীতে সাহাবাগণও ইমাম বসে নামায পড়লে বসেই নামায পড়েছেন। অবশ্য ঐ ক্ষেত্রে বসে নামায পড়া ওয়াজেব না বলে মুস্তাহাব বলা যেতে পারে। (মিশকাত ১১৩৯নং, ১/৩৫৭ আলবানীর টীকা সহ্‌ দ্র:)

৫। তায়াম্মুমকারী :

যে ব্যক্তি ওযূ করতে না পেরে তায়াম্মুম করে নামায পড়ে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে যারা ওযূ করে নামায পড়ে তাদের নামায শুদ্ধ।

হযরত আম্‌র বিন আস (রাঃ) বলেন, যাতুস সালাসিল যুদ্ধ-সফরে এক শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হল। আমার ভয় হল যে, যদি গোসল করি তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) ফজরের নামায পড়লাম। আমার সঙ্গীরা একথা নবী (ﷺ)-র নিকটে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “হে আম্‌র! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সঙ্গীদের ইমামতি করেছ?” আমি গোসল না করার কারণ তাঁকে বললাম। আরো বললাম যে, আল্লাহ তাআলার এ বাণীও আমি শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমরা আত্মহ্‌ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড় দয়াশীল।” (কুরআন মাজীদ ৪/২৯)

একথা শুনে তিনি হাসলেন এবং আর কিছুই বললেন না। (বুখারী, সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৩নং, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

৬। কেবল মহিলাদের জন্য মহিলা :

মহিলা মহিলা নামাযীদের ইমামতি করতে পারে। উম্মে অরাকাহ্‌ বিন নাওফাল (রাঃ) মহানবী (ﷺ)-এর নির্দেশমতে তাঁর পরিবারের মহিলাদের ইমামতি করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯১-৫৯২নং)

অবশ্য এ ক্ষেত্রে মহিলা ইমাম মহিলাদের কাতার ছেড়ে পুরুষের মত সামনে একাকিনী দাঁড়াবে না। বরং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবে। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, মুহাল্লা ৩/১৭১-১৭৩) আশেপাশে বেগানা পুরুষ না থাকলে সশব্দে তকবীর ও কিরাআত পড়বে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৩০/১১৩)

৭। কেবল মহিলাদের জন্য পুরুষ :

কোন পুরুষ কেবল মহিলা জামাআতের ইমামতি করতে পারে। তবে শর্ত হল, মহিলা যেন এগানা হয়, নচেৎ বেগানা হলে যেন একা না হয়, পরিপূর্ণ পর্দার সাথে একাধিক থাকে এবং কোন প্রকার ফিতনার ভয় না থাকে অথবা তার সঙ্গে যেন কোন এগানা মহিলা বা অন্য পুরুষ থাকে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৫২)

একদা ক্বারী সাহাবী হযরত উবাই বিন কা’ব (রাঃ) আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর কাছে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! গতরাত্রে আমি একটি (অস্বাভাবিক) কাজ করেছি।’ তিনি বললেন, “সেটা কি?” উবাই বললেন, ‘কিছু মহিলা আমার ঘরে জমা হয়ে বলল, আপনি (ভালো ও বেশী) কুরআন পড়তে পারেন, আমরা পারি না। অতএব আপনি আজ আমাদের ইমামতি করেন। তাদের এই অনুরোধে আমি তাদেরকে নিয়ে ৮ রাকআত এবং বিতর পড়েছি।’ এ কথা শুনে মহানবী (ﷺ) চুপ থাকলেন। অর্থাৎ তাঁর এই নীরব থাকা এ ব্যাপারে তাঁর মৌনসম্মতি হয়ে গেল। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা)

৮। নাবালক কিশোর :

জ্ঞানসম্পন্ন নাবালক কিশোরের জন্য যদিও নামায ফরয নয়, তবুও বড়দের জন্য ফরয-নফল সব নামাযেই তার ইমামতি শুদ্ধ।

আম্‌র বিন সালামাহ্‌ ৬-৭ বছর বয়সে লোকেদের ইমামতি করেছেন। আর তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে বেশী কুরআনের হাফেয। (বুখারী ৪৩০২, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৫নং)

৯। জারজ :

ব্যভিচারজাত সন্তানের কোন দোষ নেই। তার মা-বাপের দোষ তার ঘাড়ে আসতে পারে না। সুতরাং অন্যান্য দিকে যোগ্যতা থাকলে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে নামায শুদ্ধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৪৭-১৪৮)

১০। যে নফল বা ভিন্ন ফরয নামায পড়ছে :

যে নফল নামায পড়ছে তার পিছনে ফরয নামায শুদ্ধ; যেমন তারাবীহ্‌র জামাআতে এশার নামায, অথবা আসরের জামাআতে যোহরের কাযা নামায অথবা কাযা নামায আদায়কারীর পিছনে ফরয নামায আদায় করা শুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও তা কোন দোষের নয়। যেহেতু জরুরী হল বাহ্যিক কর্মাবলীতে ইমামের অনুসরণ করা।

হযরত মুআয বিন জাবাল মহানবী (ﷺ)-এর সাথে এশার নামায পড়তেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজের গোত্রের লোকেদের ঐ নামাযই পড়াতেন। এক বর্ণনায় আছে যে, এ নামায তাঁর নফল হত এবং লোকেদের হত ফরয। (বুখারী, মুসলিম, শাফেয়ী, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ৩/৮৬, মিশকাত ১১৫০-১১৫১নং)

১১। সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত লোকের ইমামতি

সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত ব্যক্তির ইমামতি বৈধ। একদা আব্দুর রহ্‌মান বিন আওফের পশ্চাতে মহানবী (ﷺ) নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪নং)

১। পুরুষের জন্য মহিলা :

পুরুষের জন্য মহিলার ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ নয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “সে জাতি কোন দিন সফল হবে না, যে জাতি তাদের কর্মভার একজন মহিলাকে সমর্পণ করবে।” (বুখারী, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)

বলা বাহুল্য, মহিলা যত বড়ই যোগ্য হোক, মুক্তাদী নিজের ছেলে হোক অথবা অন্য কেউ হোক, স্বামী জাহেল এবং স্ত্রী কুরআনের হাফেয হোক তবুও কোন ক্ষেত্রেই মহিলা পুরুষের ইমামতি করতে পারে না। এটি পুরুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮২)

২। মুশরিক ও বিদআতী :

যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন ইবাদতে অন্য কোন সৃষ্টিকে শরীক করে, যেমন মাযার পূজা করে, মাযারে গিয়ে সিজদা, নযর-নিয়ায, মানত, কুরবানী, তওয়াফ প্রভৃতি নিবেদন করে, সেখানে সুখণ্ডসমৃদ্ধি বা সন্তান চায়, সাহায্য প্রার্থনা করে, যে ব্যক্তি গায়বী (অদৃশ্যের খবর জানার) দাবী করে ও লোকেরহাত বা ভাগ্য-ভবিষ্যৎ বলে দেয়, যে (কোন পশু বা পাখীর চামড়া, হাড়, লোম বা পালক দিয়ে, কোন গাছপালার শিকড় বা ফুল-পাতা দিয়ে, কারো কাপড়ের কোন অংশ দিয়ে, ফিরিশ্তা , জিন, নবী, সাহাবী, ওলী বা শয়তানের নাম লিখে অথবা বিভিন্ন সংখ্যার নকশা বানিয়ে, অথবা তেলেসমাতি বিভিন্ন কারসাজি করে, নোংরা ও নাপাক কোন জিনিস দিয়ে) শির্কী তাবীয লিখে, যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে) প্রেম বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য তাবীয করে, যোগ বা যাদু করে, এ শ্রেণীর ইমামের নামায শুদ্ধ নয়, ইমামতি শুদ্ধ নয় এবং তার পশ্চাতে নামাযও শুদ্ধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৫৯, ২২/৮২, ২৪/৭৮, ৮৯, ২৬/৯৭, ২৮/৫৫)

তদনুরুপ বিদআতী যদি বিদআতে মুকাফফিরাহ্‌ বা এমন বিদআত করে যাতে মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাহলে সে বিদআতীর পিছনে নামায শুদ্ধ নয়।

৩। ফাসেক :

ফাসেক হল সেই ব্যক্তি, যে অবৈধ, হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ করে এবং ফরয বা ওয়াজেব কাজ ত্যাগ করে; অর্থাৎ কাবীরা গুনাহ করে। যেমন, ধূমপান করে, বিড়ি-সিগারেট, জর্দা-তামাক প্রভৃতি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে, অথবা সূদ বা ঘুস খায়, অথবা মিথ্যা বলে, অথবা (অবৈধ প্রেম) ব্যভিচার করে, অথবা দাড়ি চাঁছে বা (এক মুঠির কম) ছেঁটে ফেলে, অথবা মুশরিকদের যবেহ্‌ (হালাল মনে না করে) খায়, (হালাল মনে করে খেলে তার পিছনে নামায হবে না।) অথবা স্ত্রী-কন্যাকে বেপর্দা রেখে তাদের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়, অথবা মা-বাপকে দেখে না বা তাদেরকে ভাত দেয় না ইত্যাদি।

উক্ত সকল ব্যক্তি এবং তাদের অনুরুপ অন্যান্য ব্যক্তির পিছনে নামায মাকরুহ (অপছন্দনীয়)। বিধায় তাকে ইমামরুপে নির্বাচন ও নিয়োগ করা বৈধ ও উচিৎ নয়।

কিন্তু যদি কোন কারণে বা চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই তার পিছনে নামায পড়তেই হয়, তাহলে নামায হয়ে যাবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/২৯০, ৩০০, ৬/২৫১, ১৫/৮০, ১৮/৯০, ১১১, ১৯/১৫২, ২২/৭৫, ৭৭, ৯২, ২৪/৭৮)

সাহাবাগণের যামানায় সাহাবাগণ ফাসেকের পিছনে নামায পড়েছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) হাজ্জাজের পিছনে নামায পড়েছেন। (বুখারী) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মারওয়ানের পিছনে নামায পড়েছেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)

হযরত ওসমান (রাঃ) ফিতনার সময় যখন স্বগৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন, তখন উবাইদুল্লাহ্‌ বিন আদী বিন খিয়ার তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আপনি জনসাধারণের ইমাম। আর আপনার উপর যে বিপদ এসেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ফিতনার ইমাম আমাদের নামাযের ইমামতি করছে; অথচ তার পশ্চাতে নামায পড়তে আমরা দ্বিধাবোধ করি।’ তিনি বললেন, ‘নামায হল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। সুতরাং লোকে ভালো ব্যবহার করলে তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার কর। আর মন্দ ব্যবহার করলে তাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাক।’ (বুখারী ৬৯৫, মিশকাত ৬২৩নং)

৪। ইমামতির বিনিময়ে অর্থগ্রহণকারী ব্যক্তি :

ইমামতিকে যে অর্থকরী পেশা মনে করে ইমামতি করে; অর্থাৎ, কেবল পয়সার ধান্দায় ইমামতি করে, এমন ইমামের পশ্চাতে নামায মাকরুহ।

আবূ দাঊদ বলেন, (ইমাম) আহমাদ এমন ইমামের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলেন, যে বলে, ‘আমি এত এত (টাকার) বিনিময়ে রমযানে তোমাদের ইমামতি করব।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। কে এর পেছনে নামায পড়বে?’ (মারা: ৯৯পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, ইমামতির জন্য সৌজন্য সহকারে ইমামকে বেতন, ভাতা বা বিনিময় দেওয়া মুক্তাদীদের কর্তব্য। ইমামের উচিৎ, কোন চুক্তি না করা; বরং মুক্তাদীদের বিবেকের উপর যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে ইমামতির দায়িত্ব পালন করা। পক্ষান্তরে জামাআতের উচিৎ, ইমামের এই দ্বীনদারীকে সস্তার সুযোগরুপে ব্যবহার না করা। বরং বিবেক, ন্যায্য ও উচিৎ মত তাঁর কালাতিপাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেমন উচিৎ নয় এবং আদৌ উচিৎ নয়, ইমাম সাহেবকে জামাআতের ‘কেনা গোলাম’ মনে করা।

৫। ক্বিরাআত ভুল যার :

যে কুরআন পড়তে এমন ভুল পড়ে, যাতে মানে বদলে যায়, তার ইমামতি ও তার পিছনে যে ভালো কুরআন পড়তে পারে তার নামায শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৬৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২০/১৪৮)

বলা বাহুল্য, ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে ক্বারীর নামায শুদ্ধ নয়। তবে অক্বারীর নামায হয়ে যাবে। অবশ্য যদি কোন ক্বারী ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে অজান্তে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে নেয়, তাহলে তার নামায হয়ে যাবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১২১পৃ:)

সুতরাং যে সকল মসজিদে সস্তা দরে অক্বারী ইমাম রাখা হয়, সে সকল গ্রাম শহরের ক্বারীদের (যারা ইমাম অপেক্ষা ভালো কুরআন পড়তে পারে তাদের) নামাযের অবস্থা কি হবে তা মসজিদের মতওয়াল্লীদেরকে ভেবে দেখা দরকার।

৬। যাকে মুক্তাদীরা অপছন্দ করে :

চরিত্রগত বা শিক্ষাগত কোন কারণে মুক্তাদীরা ইমামকে অপছন্দ করলে ইমামের নামায আল্লাহর দরবারে কবুল নয়। সুতরাং জেনেশুনে তার ইমামতি করা বৈধ নয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)

অবশ্য ব্যক্তিগত কোন কারণে কেউ কেউ ইমামকে অপছন্দ করলে, দোষ নেই অথচ তাকে খামাখা কেউ অপছন্দ করলে অথবা বেশী সংখ্যক লোক পছন্দ এবং অল্প সংখ্যক লোক অপছন্দ করলে কারো কোন ক্ষতি হয় না। অবশ্য ক্ষতি তার হয়, যে একজন নির্দোষ মানুষকে খামাখা অপছন্দ করে। তবুও জ্ঞানী ইমামের উচিৎ, যে জামাআতের অধিকাংশ লোক তাকে অপছন্দ করে, সে জামাআতের ইমামতি ত্যাগ করা এবং তার ইমামতিকে কেন্দ্র করে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি না করা।

৭। সুন্নাহ্‌ত্যাগী :

যে মানুষ সুন্নাহর পাবন্দ নয়; সুন্নত নামায-রোযা ইত্যাদি ত্যাগ করে, নিশ্চয় সে মানুষ পরহেযগার ও ভালো লোক নয়। তবে সে যে পাপী তা কেউবলতে পারে না। অতএব তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। তদনুরুপ কোন বিতর্ক থাকার ফলে বা কোন সন্দেহের কারণে কেউ কোন সুন্নাহ্‌ ত্যাগ করলে; যেমন বুকের উপরহাত না বাঁধলে, রুকূর আগে-পরে রফ্‌য়ে ইয়াদাইন না করলে বা জোরে আমীন না বললেও তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৫/৪৬)

৮। পেশাব-ঝরা রোগী :

যে ব্যক্তির সর্বদা পেশাব ঝরার রোগ আছে সে ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯৭)

৯। বোবা :

বোবার পিছনে নামায পড়লে নামায শুদ্ধ। কিন্তু তাকে ইমাম করা যাবে না। যেহেতু সে তকবীর শুনাতে ও জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করতে অক্ষম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩২০)

১০। জলদিবাজ :

যে ব্যক্তি ঠকাঠক কাকের দানা খাওয়ার মত নামায পড়ে এবং পশ্চাতে মুক্তাদীরা তার অনুসরণ করতে সক্ষম হয় না, রুকূ ও সিজদা থেকে উঠে পিঠ সোজা করে না, তার নামায এবং তার পশ্চাতে মুক্তাদীদেরও নামায হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৬৭)

১১। বেওযূ ব্যক্তি :

কোন ইমাম নাপাক বা বেওযূ অবস্থায় নামায পড়লে এবং সালাম ফিরার পর তা জানতে পারলে কেবল তার নামায বাতিল হবে এবং মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। কেবল ইমামই ঐ নামায পুনরায় পড়বে, মুক্তাদীরা নয়। (আহ্‌কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্‌সিন আল-মুনীফ ১৪৭পৃ:) জেনেশুনে কোন বেওযূর পিছনে নামায হবে না।

১২। রেডিও-টিভির ইমাম :

কোন পুরুষ অথবা মহিলা, সুস্থ অথবা অসুস্থ, ওজরে অথবা বিনা ওজরে রেডিও বা টিভির পিছনে দাঁড়িয়ে সম্প্রচারিত কোন মসজিদের ফরয অথবা নফল, জুমুআহ অথবা অন্য যে কোন নামাযে তার ইমামের অনুসরণ করা বৈধ নয়। যদিও তাদের বাসা উক্ত মসজিদের পাশে হোক অথবা সামনে, উপরে হোক অথবা পিছনে। কোন অবস্থাতেই মসজিদে হাজির না হয়ে দূর থেকে কেবল শব্দ অথবা শব্দ ও ছবির অনুকরণ করে জামাআত পাওয়া যায় না। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৭৩পৃ:)

ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম

মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।

১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (ﷺ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্‌র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)

নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।

এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)

জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)

২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।

জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (ﷺ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)

উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্‌ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (ﷺ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (ﷺ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্‌ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।

৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)

৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।

একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (ﷺ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (ﷺ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)

৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।

৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০৯২নং)

প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৪পৃ:)

৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)

প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১পৃ:)

৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিৎ নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিৎ।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিৎ, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)

৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।

এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (ﷺ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)

অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিৎ। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্‌রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।

পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।

তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।

ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।

বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।

১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (ﷺ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)

একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্‌ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)

পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)

১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)

তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)

একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্‌মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)

১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)

১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)

১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)

১। ইমামতির নিয়ত :

সাধারণভাবে ইমামতির নিয়ত (সংকল্প) জরুরী। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭০) অবশ্য একাকী নামায পড়া অবস্থায় কেউ জামাআতের নিয়তে তার সাথে শামিল হলে জামাআত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে নামায পড়তে পড়তে ইমামতির সংকল্প করে নেওয়া যথেষ্ট হবে। নামায শুরু করার আগে থেকে ইমামতির নিয়ত জরুরী নয়। (ঐ ১৭/৫৯) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, এক রাত্রে আমি আমার খালা মায়মূনার ঘরে শুয়ে ছিলাম। নবী (ﷺ) রাত্রে উঠে যখন নামায পড়তে লাগলেন, তখন আমিও তাঁর সাথে শামিল হয়ে গেলাম। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ)

একদা মহানবী (ﷺ) এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়া দেখে বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্‌ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)

২। কাতার সোজা করতে বলা :

নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) নামাযে ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে তাদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। (বুখারী ৭১৯নং) যেমন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও।” “কাতার সোজা কর।” “কাতার পূর্ণ কর।” “ঘন হয়ে দাঁড়াও।” “সামনে এস।” “ঘাড় ও কাঁধসমূহকে সমপর্যায়ে সোজা কর।” “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” “কাতারের ফাঁক বন্ধ কর।” “বাজারের মত হৈ-চৈ করা থেকে দূরে থাক।” ইত্যাদি।

কাতারে কেউ আগে-পিছে সরে থাকলে তাকে বরাবর হতে বলা এমন কি নিজে কাছে গিয়ে কাতার সোজা করা ইমামের কর্তব্য। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না কাতার পূর্ণরুপে সোজা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত নামায শুরু করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৬) বরং কাতার সোজা ও ঠিক হওয়ার আগে ইমামের নামায শুরু করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:)

নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নামাযে দাঁড়ালে আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদের কাতার সোজা করতেন। অতঃপর আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে তবেই তকবীর দিতেন।’ (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৫নং)

৩। মুক্তাদীদের খেয়াল করে নামায হাল্কা করে পড়া :

জামাআতে বিভিন্ন ধরনের লোক নামায পড়ে থাকে। ইমামের উচিৎ, নিজের ইচ্ছামত নামায না পড়া; বরং তাদের খেয়াল রেখে ক্বিরাআত ইত্যাদি লম্বা করা। অবশ্য কারো ইচ্ছা অনুসারে নামায এমন হাল্কা করা উচিৎ নয়, যাতে নামাযের বিনয়, ধীরতা-স্থিরতা, পরিপূর্ণরুপে রুক্‌ন-ওয়াজেব-সুন্নত আদি আদায় ব্যাহত হয়। বলা বাহুল্য, যাতে উভয় দিক বজায় থাকে তার খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে।

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (ﷺ) অপেক্ষা কোন ইমামের পিছনে অধিক সংক্ষেপ অথচ অধিক পরিপূর্ণ নামায পড়ি নি। এমন কি তিনি যখন কোন শিশুর কান্না শুনতেন তখন তার মায়ের উদ্বিগ´ হওয়ার আশংকায় নামায সংক্ষেপ করতেন।’ (বুখারী ৭০৮নং, মুসলিম, সহীহ)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি অনেক সময় নামায শুরু করে তা লম্বা করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু যখন আমি কোন শিশুর কান্না শুনি, তখন আমার নামাযকে সংক্ষেপ করি। কারণ, তার কান্নায় তার মায়ের মনের উদ্বেগ যে বেড়ে যাবে তা আমি জানি।” (বুখারী ৭০৯নং)

তিনি বলেন, “যখন তোমাদের কেউ লোকেদের নামায পড়ায়, তখন সে যেন হাল্কা করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও বৃদ্ধ লোক থাকে। অবশ্য যখন তোমাদের কেউ একা নামায পড়ে, তখন সে যত ইচ্ছা লম্বা করতে পারে।” (বুখারী ৭০৩নং, মুসলিম, সহীহ)

এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি ফজরের নামাযে অমুকের কারণে হাজির হ্‌ই না; সে আমাদের নামায খুব লম্বা করে পড়ায়।’ আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘এর পর সেদিন আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে ওয়াযে যেরুপ রাগান্বিত হতে দেখেছি সেরুপ আর অন্য কোন দিন দেখি নি। তিনি বললেন, “তোমাদের কেউ কেউ লোকদেরকে (জামাআতের প্রতি) বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তোমাদের যে কেউ কোন নামাযের ইমামতি করে সে যেন নামায সংক্ষেপ করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও (বিভিন্ন) প্রয়োজন-ওয়ালা লোক আছে।” (বুখারী ৭০২নং, মুসলিম, সহীহ)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “জামাআতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির খেয়াল করে নামায পড়াও। আর এমন মুআযযিন রেখো না, যে আযানের পারিশ্রমিক চায়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৭৭৩নং)

তিনি মুআয (রাঃ) কে এশার ইমামতিতে লম্বা ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করে বলেছিলেন, “তুমি কি লোকদেরকে ফিতনায় ফেলতে চাও হে মুআয? তুমি যখন ইমামতি করবে তখন ‘অশশামসি অয্বহা-হা, সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা, ইক্বরা বিসমি রাব্বিকা, অল্লাইলি ইযা য়্যাগশা’ পাঠ কর। কারণ তোমার পশ্চাতে বৃদ্ধ, দুর্বল ও প্রয়োজনে উদ গ্রী ব মানুষ নামায পড়ে থাকে। (বুখারী ৭০৫, মুসলিম, না, মিশকাত ৮৩৩ নং)

আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিনত্বারখান বলেন, একদা আমরা শায়খ ইমাদের পশ্চাতে নামায পড়ছিলাম। আমার পাশে এক ব্যক্তি নামায পড়ছিল, -আমার মনে হয়- তার কোন ব্যস্ততা ছিল। যখন নামায থেকে ফারেগ হ্‌লাম, তখন সে কসম করে বলল, আর কখনো তাঁর পিছনে নামায পড়বে না। আর সেই সঙ্গে মুআযের ঐ হাদীস উল্লেখ করল। আমি তাকে বললাম, তুমি কেবল এই হাদীসটিই জান? অতঃপর আমি তার কাছে নবী (ﷺ)-এর নামায লম্বা করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলি উল্লেখ করলাম। এরপর আমি শায়খ ইমাদের পাশে বসলাম এবং ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং এই কামনা করি যে, আপনার বিরুদ্ধে যেন কোন প্রকার সমালোচনা না হয়। সুতরাং যদি আপনি নামাযকে একটু হাল্কা করে পড়তেন। তিনি আমার এ কথা শুনে বললেন, ‘সম্ভবত: অতি নিকটে ওরা আমার ও আমার নামায থেকে নিস্ক্রিতি পাবে। ইয়া সুবহানাল্লাহ্‌! ওদের কেউ কেউ (দুনিয়ার) রাজা-বাদশার সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলে কোন প্রকারের বিরক্তি প্রকাশ করে না; অথচ ওরা ওদের (দ্বীন-দুনিয়ার বাদশা) প্রভুর সামনে সামান্য সময় দাঁড়াতে বিরক্তিবোধ করে?! (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ১৮৮পৃ:)

৪। দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত দীর্ঘ করা :

প্রথম রাকআতকে একটু লম্বা করে পড়া উত্তম। যাতে পিছে থেকে যাওয়া মুসল্লীরা প্রথম রাকআতেই এসে শামিল হতে পারে।

আবূ কাতাদাহ্‌ কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (ﷺ) যোহরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত লম্বা করে পড়তেন। অনুরুপ আসর ও ফজরের নামাযেও। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮০০ নং) আবূ দাঊদের বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, আমরা মনে করতাম, তিনি তা এই জন্য করছেন; যাতে লোকেরা প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারে।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নামাযের ইকামত হয়ে যেত, আর আমাদের কেউ কেউ বাকী গিয়ে নিজের প্রয়োজন (প্রস্রাব-পায়খানা) সেরে ওযূ করে প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারত। কারণ, নবী (ﷺ) ঐ রাকআতকে লম্বা করে পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তদনুরুপ ইমাম রুকূতে থাকা কালে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার জন্য রুকূ একটু লম্বা করা বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২) পক্ষান্তরে বেশী লম্বা করে জামাআতের মুসল্লীদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। অভিজ্ঞ ইমাম তাঁর মুক্তাদীদের অভ্যাস ও আচরণের মাধ্যমে তাদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টির কথা অবশ্যই বুঝতে পারবেন।

৫। দুআয় নিজেকে খাস না করা :

দুআর সময় এক বচন শব্দ ব্যবহার করে নিজের জন্য দুআকে খাস করা ইমামের জন্য বৈধ নয় বলে যেহাদীস মহানবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (দ্র: তামামুহ্‌ মিন্নাহ্‌ ২৭৮-২৮০পৃ:) আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (ﷺ) নিজে ইমাম হয়েও অনেক সময় একবচন শব্দ ব্যবহার করে নামায পড়েছেন। উদাহ্‌রণস্বরুপ ‘বা-ইদ বাইনী’রহাদীস।

তবুও সাধারণ দুআর সময় এক বচনের স্থলে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা দোষাবহ্‌ নয়। ইমাম বগবী (রহঃ) বলেন, ইমাম হলে (দুআয়) এক বচনের স্থলে বহু বচন শব্দ ব্যবহার করবে। ‘আল্লাহুম্মাহ্‌দিনা---- অআ-ফিনা --- বলবে এবং দুআকে নিজের জন্য খাস করবে না। (শারহুস সুন্নাহ্‌ ৩/১২৯) অনুরুপ বলেন ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ্‌। (স্বালাতুত তারাবীহ্‌ ৪১পৃ:, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১৭০-১৭১পৃ:)

৬। সালাম ফিরে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসা :

নামাযে সালাম ফিরার পর ডান অথবা বাম দিকে ঘুরে মুক্তাদীদের প্রতি মুখ করে বসা ইমামের জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ১০৪১, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৯৪৪নং)

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে বহুবার বাম দিক হতে ঘুরতে দেখেছি। (বুখারী ৮৫২নংও মুসলিম ৭০৭নং, মিশকাত ৯৪৬নং)

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে অধিকাংশ ডান দিক হতে ঘুরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম৭০৮নং)

৭। যিক্‌র-আযকারের পর জায়গা বদলে সুন্নত আদি পড়া :

মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইমাম যে জায়গায় (ফরয) নামায পড়ে সে জায়গাতেই সে যেন (সুন্নত) নামায না পড়ে। বরং সে যেন অন্য জায়গায় সরে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬১৬নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

শুধু ইমামই নয়; বরং মুক্তাদীর জন্যও জায়গা বদলে সুন্নত পড়া মুস্তাহাব। নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউকি (সুন্নত পড়ার জন্য) তার সামনে, পিছনে, ডাইনে বা বামে সরে যেতে অক্ষম হবে?” (আবূদাঊদ, সুনান ১০০৬, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, জামে ২৬৬২নং)

সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ)-এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৮৩, আবূদাঊদ, সুনান ১১২৯নং, আহমাদ, মুসনাদ৪/৯৫, ৯৯)

উদ্দেশ্য হল, নামাযের জায়গা বেশী করলে, কিয়ামতে ঐ সকল জায়গা আল্লাহর আনুগত্যের সাক্ষ্য দেবে। (মিশকাত ৯৫৩হাদীসের টীকা দ্র:)

অবশ্য এ সময় খেয়াল রাখা উচিৎ, যাতে উক্ত মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে কোন নামাযীর সিজদার জায়গার ভিতর বেয়ে পার হয়ে গুনাহ না হয়ে বসে।

১। ইমামের অপেক্ষা করা :

ইমাম থাকতে তাঁর জায়গায় তাঁর বিনা অনুমতিতে অন্যের ইমামতি করা অবৈধ, আর তা বড় বেপরোয়া লোকের কাজ। এ সব লোকেদের ইমামের একটু দেরী সয় না। সামান্য দেরী হলেই আর তাঁর অপেক্ষা না করে জামাআত খাড়া করে দেয়। এ ধরনের ধৈর্যহারা মানুষরা কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমান।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত (নামাযের জন্য উঠে) দাঁড়াও না।” (বুখারী ৬৩৭, মুসলিম, সহীহ ৬০৪নং)

তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৬৭৩নং)

অবশ্য অস্বাভাবিক বেশী দেরী হলে মুক্তাদীদের অধিকার আছে জামাআত করার। কিন্তু ইমাম উপস্থিত হওয়ার যথাসময় পার হওয়ার পর মুক্তাদীদের কোন এক উপযুক্ত ব্যক্তি ইমামতি শুরু করলে ইতিমধ্যে যদি নিযুক্ত ইমাম এসে পড়েন, তাহলে ইমাম অগ্রসর হয়ে নিজ ইমামতি করতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে ঐ মুক্তাদী ইমাম পিছে হ্‌টে যাবেন। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৮৩) যেমন দু-দুবার হযরত আবূ বাক্‌র (রাঃ) নামায পড়াতে শুরু করলে ইতিমধ্যে মহানবী (ﷺ) এসে উপস্থিত হন এবং আবূ বাক্‌র পিছে হ্‌টে যান ও তিনি ইমামতি করেন। (বুখারী ৬৮৪, ৭১২, মুসলিম, সহীহ)

অবশ্য ইমাম চাইলে মুক্তাদী হয়েও নামায সম্পন্ন করতে পারেন। যেমন একদা এক সফরে মহানবী (ﷺ) নিজ প্রয়োজনে দূরে গেলে আসতে দেরী হল। হযরত আব্দুর রহ্‌মান বিন আওফ (রাঃ) ইমামতি করতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলে আব্দুর রহ্‌মান পিছে হ্‌টতে চাইলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে ইঙ্গিতে বললেন যে, তুমি ইমামতি করতে থাক। অতঃপর তিনি সেদিন মুক্তাদী হয়ে নামায পড়লেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১২৩৬নং)

২। ইক্তিদার নিয়ত :

ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময় মনে মনে ইক্তিদার নিয়ত (সংকল্প) করা জরুরী। যেহেতু মুক্তাদী অবস্থায় ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব, ইমামের পিছনে মুক্তাদী ভুল করলে সহু সিজদা করতে হয় না এবং অনেক সময় ইমামের নামায বাতিল হলে মুক্তাদীরও বাতিল; তাই এই নিয়ত জরুরী। সুতরাং নিয়ত না হলে মুক্তাদীর নামায জামাআতী নামায হবে না। (আহ্‌কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্‌সিন আল-মুনীফ ২০৬পৃ:)

জ্ঞাতব্য যে, ‘ইক্তাদাইতু বিহাযাল ইমাম’ বলে মুখে উচ্চারিতব্য নিয়ত বিদআত।

৩। যথাসময়ে জামাআতে দাঁড়ানো :

ইকামত হয়ে গেলে এবং ইমাম দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে থাকা অথবা তেলাওয়াত বা মুনাজাতে মশগুল থাকা অথবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকা উচিৎ নয়। বরং সত্বর উঠে ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্‌রীমা দিয়ে নামায শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ।

যেমন তাকবীরে-তাহ্‌রীমা ইমামের সাথে না পাওয়া এক বড় বঞ্চনার কারণ। অতএব ইমাম তকবীর দিয়ে ফেললে কোন কথাবার্তায় অথবা মনগড়া নিয়ত আওড়ানোতে অথবা মিসওয়াকের সুন্নত পালনে ব্যস্ত হয়ে তকবীর দিতে দেরী করা মোটেই উচিৎ নয়। ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্‌রীমার একটি পৃথক মর্যাদা রয়েছে শরীয়তে। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্‌রীমার তকবীরও পাবে, সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হয়; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)

মুজাহিদ বলেন, এক বদরী সাহাবী একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি আমাদের সাথে জামাআত পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘প্রথম তাকবীর পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘যা তোমার ছুটে গেছে তা এক শত কালো চক্ষুবিশিষ্ট (উৎকৃষ্ট) উটনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর!’ (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২০২১নং)

অনুরুপভাবে জামাআত শুরু হয়ে গেলে সুন্নত নামাযে মশগুল থাকাও বৈধ নয়। বৈধ নয় কোন সুন্নত শুরু করা। ফজরের সুন্নত হলেও জামাআতের ইকামত শোনার পর তা আর পড়া চলে না। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন নামায খাড়া হয়, তখন ফরয (বা সেই) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।” (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৪, মুসলিম, সহীহ ৭১০ নং, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫২, প্রমুখ) অর্থাৎ, জামাআত খাড়া হলে ফরয বা (ঐ নামায তাকে পড়তে হলে) ঐ নামাযে শামিল হওয়া ছাড়া পৃথক করে কোন নফল বা সুন্নত নামায পড়া বৈধ নয়। অর্থাৎ ইকামতের পর আর কোন সুন্নত বা নফল নামায শুদ্ধ হবে না।। (শরহুন নওবী ৫/২২১, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১)

এক ব্যক্তি মসজিদে এল। তখন আল্লাহর রসূল (ﷺ) ফজরের নামাযে ছিলেন। সে ২ রাকআত নামায পড়ে জামাআতে শামিল হল। নামায শেষে আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাকে বললেন, “হে অমুক! তোমার নামায কোন্‌টা? যেটা আমাদের সাথে পড়লে সেটা, নাকি যেটা তুমি একা পড়লে সেটা? (নাসাঈ, সুনান ৮৬৮নং)

একদা এক ব্যক্তি মুআযযিনের ইকামত বলার সময় নামায পড়ছিল। তা দেখে তিনি বললেন, “একই সাথে কি দুটি নামায!” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭১, ২৫৮৮নং)

একদা ফজরের নামাযের ইকামত হওয়ার সময় মহানবী (ﷺ) দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে। তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ফজরের নামায ৪ রাকআত পড়বে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১১, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭২)

একদা তিনি ফজরের নামায পড়ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এক প্রান্তে ২ রাকআত নামায পড়ে তাঁর সাথে জামাআতে শামিল হল। সালাম ফিরার পর তিনি তাকে বললেন, “ওহে অমুক! তুমি কোন্‌ নামাযকে (ফরয বলে) গণ্য করলে? তোমার একাকী পড়া নামাযকে, নাকি আমাদের সাথে পড়া নামাযকে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১২নং)

অবশ্য কারো সুন্নত পড়া কালে যদি ইকামত হয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয় রাকআতে থাকলে বাকীটা হাল্কা করে পড়ে পূর্ণ করে নেবে। পক্ষান্তরে প্রথম রাকআতে থাকলে নামায ছেড়ে জামাআতে শামিল হয়ে যাবে। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২৪/১৪, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৫)

প্রকাশ যে, নামায ছাড়ার সময় সালাম ফিরা বিধেয় নয়। বরং নিয়ত বাতিল করলেই নামায থেকে বের হওয়া যায়। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্‌, মুহাম্মাদ সালেহ্‌ আল-মুনাজ্বিদ ২২পৃ:)

৪। যথা নিয়মে কাতার বাঁধা :

মহান আল্লাহর তা’যীম প্রকাশের উদ্দেশ্যে কাতার বাঁধার যে নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী কাতার বাঁধা মুক্তাদীর কর্তব্য। আর তা যথাক্রমে নিম্নরুপ :-

কাতার সোজা করা :

কাতার সোজা করা ওয়াজেব। কাতার সোজা হবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক অপরের কাঁধ ও পায়ের গাঁট বরাবর সোজা রেখে; যাতে একজনের কাঁধ আগে এবং অপর জনের পিছে না হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আঙ্গুল মিলিয়ে কাতার সোজা হবে না। কারণ, পা ছোট-বড় থাকার ফলে কাতার বাঁকা থেকে যাবে। আর বসা অবস্থায় বাহুমূল বা কাঁধের সাথে বাহুমূল বা কাঁধ বরাবর থাকলে কাতার সোজা বলে ধরা যাবে।

যেমন মসজিদে কাতারের দাগ থাকলে দাগের মাথায় বুড়ো আঙ্গুল রেখে কাতার সোজা হয় না। কারণ, এতে যার পা লম্বা সে কাতার থেকে পিছনের দিকে এবং যার পা ছোট সে কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে থাকবে। সুতরাং পায়ের গোড়ালিকে দাগের মাথায় রাখলে তবেই কাতার বাঞ্ছনীয় সোজা হবে।

কাতার সোজা করার ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর। কারণ, কাতার সোজা করা নামায প্রতিষ্ঠা বা পরিপূর্ণ করার অন্তর্গত কর্ম।” (বুখারী ৭২৩, মুসলিম, সহীহ ৪৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৮নং)

আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নামাযের (কাতার বাঁধার) সময় নবী (ﷺ) আমাদের বাহুমূল স্পর্শ করতেন ও বলতেন, “সোজা হয়ে দাঁড়াও এবং বিভিন্নরুপে দাঁড়াও না; তাতে তোমাদের অন্তরসমূহ বিভিন্নমুখী হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮নং)

কাতার মিলিয়ে ঘন হয়ে জমে দাঁড়ানো এবং মাঝের ফাঁক বন্ধ করা :

কাতারে দাঁড়ানোর সময় ঘন হয়ে দাঁড়ানো জরুরী; যাতে মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। পার্শ্ববর্তী নামাযীর পায়ের পাতার সাথে পায়ের পাতা (পায়ের বাইরের দিকটা সোজা কেবলামুখী করে কনিষ্ঠা আঙ্গুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অংশ) ও বাহুর সাথে বাহু লাগিয়ে জমে দাঁড়াতে হবে নামাযীকে। আল্লাহর এ দরবারে আমীর-গরীব, ছোট-বড় ও প্রভু-দাসের কোন ভেদাভেদ নেই, কোন বেআদবী নেই। সাহাবাগণ কাতারে পরস্পর এইভাবেই দাঁড়াতেন। তাহলে কি তাঁরা বেআদব ছিলেন? আল্লাহর কসম! না। ঐ দেখেন না, একজন ছাত্র যদি তার শিক্ষকের গায়ে গা লাগিয়ে বসে, তাহলে শিক্ষক ও সমস্ত লোক তাকে বেআদব বলবেই। কিন্তু সেই ছাত্রই যদি বাস বা ট্রেনের সীটে ঐরুপ বসে, তাহলে তখন আর কেউ তাকে বেআদব বলে না। বলা বাহুল্য নামাযের সারিতে পাশাপাশি এই প্রেমের সূত্রে বড়-ছোটর কোন প্রভেদ নেই।

আসলে মনের সাথে মনের মিল থাকলে পায়ের সাথে পা মিলে যাওয়া দূরের কথা নয়। আর মনের মাঝে দূরত্ব থাকলে, মনের মাঝে ঔদ্ধত্ব, অহংকার ও ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকলে অথবা ভুল বুঝাবুঝির ফলে অভিমান ও ক্ষেfভ থাকলে অবশ্যই দেহের দূরত্ব বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে আরো মনের দূরত্ব। দূর হবে সম্প্রীতির বাঁধন। শয়তান সেই ভুল বুঝাবুঝির সুযোগে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা আনতে বড় কৃতকার্য হবে।

পরন্তু যদি আপনি মনে করেন যে, পাশের মুসল্লী থেকে আপনি বড় এবং সে আপনার পায়ে পা লাগালে আপনার সম্মানে বাধবে, তাহলে আপনি আপনার পা তার পায়ে লাগিয়ে দিন। আর এ ক্ষেত্রে আশা করি আপনার মনের ঐ আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে না।

পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর আমল মহানবী (ﷺ)-এর যামানায় প্রচলিত ছিল। তিনি সাহাবাদের সে আমল দেখেও বেআদবী মনে করে বাধা দেননি। তিনি নামাযের মধ্যে যেমন সামনে দেখতেন তেমনি পিছনে। ঘন হয়ে দাঁড়ানোর ব্যাখ্যাতে সাহাবাগণের এই আমল অবশ্যই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাতে তিনি-সম্মতি প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, এ কাজ যে সুন্নত তাতে কোন সন্দেহ্‌ থাকতে পারে না।

কিন্তু বড় দু:খের বিষয় যে, তাবেঈনদের যামানা থেকেই এ আমল অনেকের কাছে বর্জনীয় হয়ে চলে আসছে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আজকে যদি কারোর সাথে ঐ কাজ করি, তাহলে সে সেরকশ (দুরন্ত) খচ্চরের মত চকে যাবে।’ (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৪৭) সুতরাং আল্লাহ তার প্রতি রহ্‌ম করেন যে এই মৃত সুন্নতকে জীবিত করে। (মারা: ২২৫পৃ:)

মহানবী (ﷺ) নামাযের কাতার তীরের মত সোজা করতেন। অতঃপর সাহাবাগণ যখন সে কাজ সমAক বুঝে উঠতে পেরেছেন এ কথা বুঝতে পারতেন, তখন তিনি তাকবীরে তাহ্‌রীমা দিতেন। একদিন তাকবীরে দিতে উদ্যত হতে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটা লোকের বুক কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর বান্দাগণ! হয় তোমরা ঠিকমত কাতার সোজা কর, নচেৎ আল্লাহ তোমাদের চেহারাসমূহের মাঝে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে দেবেন।” (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৩, মিশকাত ১০৮৫নং)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নামাযের ইকামত হল। নবী (ﷺ) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর এবং ঘন হয়ে দাঁড়াও। নিশ্চয় আমি আমার পিছন দিক হতেও দেখে থাকি।” আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর আমাদের প্রত্যেকে নিজ বাহুমূল তার পার্শ্ববর্তী সঙ্গীর বাহুমূলের সাথে এবং নিজ পা তার পায়ের সাথে (হাঁটু তার হাঁটুর সাথে, পায়ের গাঁট তার পায়ের গাঁটের সাথে) লাগিয়ে দিত। (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬২নং)

হযরত জাবের বিন সামুরাহ্‌ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদের কাছে এলেন। সে সময় আমরা গোলাকার দলে দলে বিভক্ত ছিলাম। তিনি বললেন, “তোমাদেরকে আমি বিক্ষিপ্তরুপে দেখছি কেন?” অতঃপর একদিন তিনি আমাদের কাছে এসে (আমাদেরকে অনুরুপ বিক্ষিপ্ত দেখে) বললেন, “তোমরা প্রতিপালকের সামনে ফিরিশ্‌তাবর্গের কাতার বাঁধার মত কাতার বেঁধে দাঁড়াবে না কি?” আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! ফিরিশ্‌তাবর্গ তাঁদের প্রতিপালকের সামনে কিরুপে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।’ তিনি বললেন, “প্রথমকার কাতারসমূহ পূর্ণ করেন এবং ঘন হয়ে জমে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩০, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬১, মিশকাত ১০৯১নং)

প্রকাশ থাকে যে, ঘন করে দাঁড়ানোর অর্থ এই নয় যে, পরস্পর ঠেলাঠেলি ও চাপাচাপি করে দাঁড়াতে হবে। বরং এইরুপ দাঁড়ানোতে নামাযের একাগ্রতা ও বিনয় নষ্ট হতে পারে। অতএব যাতে পায়ে পা এবং বাহুতে বাহু স্বাভাবিকভাবে লেগে থাকে তারই চেষ্টা করতে হবে। আর তার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই পা ফাঁক করে দাঁড়াতে হবে।

সামনের কাতার খালি থাকলে (রাকআত বা রুকূ ছুটে যাওয়ার ভয়ে) পিছনে দাঁড়ানো বৈধ নয়। যেমন সামনের কাতারে ফাঁক দেখা দিলে তা বন্ধ করা জরুরী। সামনে কাতারে যেতে দূর হলে এবং নামাযের মধ্যে হলেও অগ্রসর হয়ে যেতে হবে কাতার মিলানোর উদ্দেশ্যে। এর জন্য রয়েছে আদেশ, পুরস্কার এবং তিরস্কারও।

নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) বলেন, “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭১নং)

তিনি বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর, বাহুমূলসমূহকে পাশাপাশি সমপর্যায় করে দাঁড়াও, কাতারের ফাঁক বন্ধ কর, পার্শ্ববর্তী নামাযী ভাইদের জন্য নিজ নিজহাতসমূহকে নরম কর এবং শয়তানের জন্য (কাতারে) ফাঁক রেখো না। আর যে ব্যক্তি কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায় সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ মিলন (সম্পর্ক) রাখেন এবং যে ব্যক্তি কাতার ছিন্ন করে সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ (সম্পর্ক অথবা কল্যাণ) ছিন্ন করেন।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৬নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের প্রতি রহ্‌ম করেন এবং ফিরিশ্‌তাবর্গ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন, যারা কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায়। আর যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ১৮৪৩নং)

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি (কাতারের মাঝে) কোন ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তার জন্য জান্নাতে এক গৃহ্‌ নিমাGণ করেন।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম আওসাত্ব, সহিহ তারগিব ৫০২নং)

তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাবর্গ দুআ করতে থাকেন তাদের জন্য যারা প্রথম কাতার মিলিয়ে (ব্যবধান না রেখে) দাঁড়ায়। আর যে পদক্ষেপ দ্বারা বান্দা কোন কাতারের ফাঁক বন্ধ করতে যায় তা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অন্য কোন পদক্ষেপ অধিক পছন্দনীয় নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, অবশ্য এতে পদক্ষেপের উল্লেখ নেই, সহিহ তারগিব ৫০৪নং)

পাশের নামাযীর জন্য নিজের বাহুকে নরম করে দাঁড়ানো :

পাশের নামাযী যাতে মনে কষ্ট না পায় তার জন্য প্রত্যেক নামাযীর কর্তব্য নিজ নিজ বাহুকে নরম করে রাখা। এতে উভয়ের মনে বিদ্বেষ দূর হয়ে প্রীতির সঞ্চার হবে। দূর হবে ঘৃণা ও কাতারের ফাঁক।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক তারাই, যারা নামাযের মধ্যে নিজেদের বাহুসমূহকে (পাশের নামাযীর জন্য) নরম রাখে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭২নং)

বলা বাহুল্য, পায়ে পা লাগাবার সময়, বাম পা-কে ডান পায়ের নিচে বের করে বসার সময়ও পাশের নামাযীর সাথে কঠেfরতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ নয়। বরং কাতারে চাপাচাপি বা ঠসাঠসি থাকলে পা বের করে অপরকে কষ্ট দেওয়ার চাইতে পা না বের করে উক্ত সুন্নত পালন না করাই উত্তম। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ২২/৩০)

কাতারসমূহের মাঝে বেশী দূরত্ব না রাখা :

ইমাম ও প্রথম কাতার এবং অনুরুপ দ্বিতীয় ও তার পরের কাতারসমূহের মাঝে প্রয়োজনের অধিক দূরত্ব রাখা উচিৎ নয়। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা তোমাদের কাতারসমূহকে ঘন কর, কাতারগুলোর মাঝে ব্যবধান কাছাকাছি কর এবং তোমাদের ঘাড়সমূহকে সমপর্যায়ে সোজা রাখ। সেই আল্লাহর কসম! যাঁর হাতে আমার জান আছে, নিশ্চয় আমি শয়তানকে কাল ভেঁড়ার বাচ্চার মত তোমাদের কাতারের ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করতে দেখছি।” (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪২৩, ৪৩৩, ৪৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৭নং)

সামনে কাতার করার মত জায়গা ফাঁক থাকলে পিছনে কাতার বেঁধে নামায হবে না। যেমন পিছনে কাতার বাঁধলে এবং সামনে ফাঁকা জায়গায় রাস্তায় লোক চলাচল করলেও নামায হবে না। মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলে তারপর রাস্তা পূর্ণ হবে এবং তার পরে দোকান ইত্যাদিতে কাতার বাঁধা চলবে। রাস্তা খালি থাকতে দোকানে কাতার বাঁধা বৈধ হবে না। (মাজমূউফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ ২৩/৪১০, দ্র: তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮২পৃ:)

থামসমূহের ফাঁকে কাতার না বাঁধা :

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর যামানায় এই (থামের ফাঁকে কাতার বাঁধা) থেকে দূরে থাকতাম।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭৩নং, তিরমিযী, সুনান)

হযরত কুর্রাহ্‌ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর যুগে আমাদেরকে থামের ফাঁকে কাতার বাঁধতে নিষেধ করা হত এবং কেউ বাঁধলে তাকে সেখান থেকে দস্তুর মত তাড়িয়ে দেওয়া হত।’ (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০০২, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী)

এর কারণ হল এই যে, মাঝে থাম হওয়ার ফলে কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই জন্য ইমাম বা একাকী নামাযীর জন্য দুই থামের মাঝে দাঁড়িয়ে নামায পড়া নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। যেমন অধিক ভিঁড়ে মসজিদে জায়গা না থাকলে ঐ জায়গাতেও কাতার বাঁধা প্রয়োজনে বৈধ। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ২০৮-২০৯পৃ:)

পরিশেষে ইবনুল কাইয়েম (রহঃ)-এর একটি মূল্যবান উক্তির উল্লেখ করে এ বিষয়ের ইতি টানি; তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সামনে বান্দার দুই সময় দাঁড়াতে হবে। নামাযে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হয় এবং তাঁর সাক্ষাতের সময় (কিয়ামতে) তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে (নামাযে) সঠিকভাবে দাঁড়াবে, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো সহ্‌জ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে দাঁড়ানোতে অবহেলা প্রদর্শন করবে এবং তার যথার্থ হ্‌ক আদায় করবে না, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’

৫। ইমামের অনুসরণ করা :

যথা নিয়মে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজেব এ বং তাঁর অন্যথা আচরণ গুনাহর কাজ।

ইমামের পশ্চাতে সাধারণত: মুক্তাদীর ৪ প্রকার আচরণ হতে পারে :

(ক) অগ্রগমন : অর্থাৎ ইমামের আগে-আগে রুকূ-সিজদা করা অথবা মাথা তোলা। এমন আচরণ গুনাহর কাজ। বরং জেনেশুনে স্বেচ্ছায় করলে নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (মিন আহ্‌কামিস স্বালাহ্‌, ইবনে উসাইমীন ৪৬পৃ:) যেমন ইমামের আগে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দিলে নামাযের বন্ধনই শুদ্ধ হবে না। ভুলে দিয়ে ফেললে পুনরায় ইমামের তকবীর দেওয়ার পর তকবীর দিতে হবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৬৩পৃ:)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইমাম এই জন্য বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং তার বিরুদ্ধাচরণ করো না।” (মুসলিম, সহীহ ৪১৪নং) “তোমরা ইমামের পূর্বে (কিছু করতে) তাড়াতাড়ি করো না। যখন সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তখন তোমরাও ‘আল্লাহু আকবার’ বল। --- যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকালহাম্‌দ’ বল।” (ঐ ৪১৫নং) “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬০৩নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কি এ কথার কে উভয় করে না যে, ইমামের আগে মাথা তুললে তার চেহারা অথবা আকৃতি গাধার মত হয়ে যাবে।” (বুখারী ৬৯১, মুসলিম, সহীহ ৪২৭, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌)

একদা তিনি মুক্তাদীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১৩৭নং)

(খ) পশ্চাদগমন : অর্থাৎ ইমামের অনেক পিছনে দেরী করে রুকূ-সিজদা করা। ইমাম রু কূ বা সিজদা থেকে উঠে গেলেও মুক্তাদীর দেরী করে রুকূ বা সিজদাতে পড়ে থাকা। এমন করাও বৈধ নয়। কারণ, রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর।”

(গ) সহ্‌গমন : অর্থাৎ চটপট ইমামের সাথে সাথেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। এরুপ করাটাও অবৈধ।

(ঘ) অনুগমন : অর্থাৎ, ইমাম রুকূ-সিজদা করলে তবেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। আর এরুপ করাটাই ওয়াজেব।

নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) বলেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।”

সাহাবী বারা’ বিন আযেব (উক্ত আমলের ব্যাখ্যায়) বলেন, ‘আমরা নবী (ﷺ)-এর পিছনে নামায পড়তাম। যখন তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলতেন, তখন আমাদের মধ্যে কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করার জন্য নিজের পিঠ ঝুকাত না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি মাটিতে নিজের কপাল রেখে নিতেন।’ (বুখারী ৬৯০নং, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌)

ইমামের তকবীর বলার পর তকবীর বলতে হবে। ইমামের ‘আমীন’-এর ‘আ-’ বলতে শুরু করার পরেই ‘আমীন’ বলতে হবে।

কোন ওজরের ফলে ইমামের আগে হয়ে গেলে নামায বাতিল নয়। যেমন কোন ব্যথার কারণে অসহ্য যন্ত্রণায় তাড়াতাড়ি ইমামের আগে সিজদা থেকে উঠে পড়লে তা ধর্তব্য নয়।

তদনুরুপ কোন ওজরের ফলে কেউ ইমামের পিছনে থেকে গেলে তাও ধর্তব্য নয়। যেমন যদি কেউ সিজদায় গিয়ে ঘুমিয়ে গেল, অতঃপর পরের রাকআতে রুকূর সময় জেগে উঠল অথবা কোন বড় জামাআতে বা মসজিদের অন্য তলায় নামায পড়তে পড়তে সূরা ফাতিহা শোনার পর মাইকের শব্দ বন্ধ হওয়ার ফলে ইমামের রুকূ করার কথা ঠিকমত বুঝা না গেলে হ্‌ঠাৎ করে জানতে পারা গেল যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু---’ বলে রুকূ থেকে উঠছেন -এ ক্ষেত্রে ছুটে যাওয়া রুক্‌ন নিজে নিজে আদায় করে বাকী নামাযে ইমামের অনুসরণ করবে। আর তার এ নামায হয়ে যাবে।

তবে যে জায়গা থেকে নামায ছুটে গেছে পরের রাকআতে সেই জায়গায় যদি ইমাম চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে তার এক রাকআত বাতিল হবে। সেখান থেকেই ইমামের অনুসরণ করে বাকী নামায পড়ে ইমামের (দুই) সালাম ফিরার পর উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত নিজে পড়ে নেবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৪-২৬৫)

ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে মুক্তাদীর সালাম ফিরা বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১২/৯১)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। সুতরাং তোমরা রুকূ, সিজদা, কি য়াম ও বৈঠকে, আর না সালামে আমার অগ্রবর্তী হ্‌য়ো না।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত১১৩৭নং)

আফযল হল ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরার পরই সালাম ফিরা। অবশ্য যদি কেউ ইমামের ডান দিকে সালাম ফিরার পর ডান দিকে এবং তাঁর বাম দিকে সালাম ফিরার পর বাম দিকে সালাম ফিরে, তাহলে তা দোষের নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭)

অনেকের মতে ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে যদি মুক্তাদী সালাম ফিরে দেয় অথবা বাকী নামায পড়ার জন্য উঠে যায়, তাহলে তার নামায নষ্ট হয়ে নফলে পরিণত হয়ে যায়। (ফাতওয়া শায়খ সা’দী ১৭৪পৃ:, মুত্বাসা ৯৭পৃ:)

জ্ঞাতব্য যে, গুপ্ত বিষয়সমূহ ইমামের আগে-পিছে বা সাথে-সাথে হলে কোন দোষের নয়। যেমন সির্রী নামাযে সূরা ফাতিহা, কোনও নামাযে তাশাহহুদ ইমামের আগে বা সাথে সাথে পড়া হলে তাতে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, সাধারণত: এর শুরু ও শেষ বুঝা যায় না এবং এ ব্যাপারে ইমামের অনুসরণ করতে মুক্তাদী আদিষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭-২৬৮)

বুকেহাত বাঁধেন না এমন ইমামের পশ্চাতে বুকেহাত বেঁধে এবং রফ্‌য়ে ইয়াদাইন করেন না এমন ইমামের পশ্চাতে রফ্‌য়ে ইয়াদাইন করে মুক্তাদীর নামায পড়া ইমামের বিরুদ্ধাচরণ নয়। যেমন যে ইমাম তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতবিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে বাম পা-কে ডান পায়ের রলার নিচে বের করে বসেন না, তাঁর পিছনে মুক্তাদী ঐরুপ বসলে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ হয় না।

জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্‌ করেন না এমন ইমামের পিছনে নামায পড়লে প্রথম বা তৃতীয় রাকআতের সিজদা থেকে সরাসরি উঠে গেলে মুক্তাদীর জন্য বসা বৈধ নয়। কারণ, এটি ইমামের বাহ্যিক কর্ম। অতএব তিনি দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে যাওয়া চলবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১২)

অবশ্য অনেকে বলেন, এটি হাল্কা বৈঠক। এতে ইমামের বিরুদ্ধাচরণ হয় না। অতএব ইমাম জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্‌র সুন্নত পালন না করলেও মুক্তাদীর হাল্কা বসে সাথে সাথে উঠে গিয়ে তা পালন করায় দোষ নেই।

ইমাম ফজরের নামাযে হাত তুলে কুনুত পড়লে মুক্তাদীর জন্য হাত তুলে আমীন বলে তাঁর অনুসরণ করা জরুরী। তবে সেই ইমামের পিছনে নামায পড়া উত্তম, যে ফজরে কুনুত পড়ে না। যেহেতু তা বিদআত। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৯৩)

ইমাম সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের প্রতি ফিরে না বসা পর্যন্ত মুক্তাদীর উঠে মসজিদ ত্যাগ করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৩২, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯১)

ইমাম তাশাহ্‌হুদে দেরী করলে মুক্তাদীর চুপচাপ বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং এ সময়ে সহীহ নববী দুআ দ্বারা মুনাজাত করে আল্লাহর কাছে বহু কিছু চেয়ে নেওয়া উচিৎ। কারণ, এটা হল দুআ কবুল হওয়ার সময়। অনুরুপ প্রথম তাশাহ্‌হুদে দেরী করলে আধা তাশাহহুদ পড়ে নীরব বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং তাশাহহুদের পর দরুদ এবং তার পরেও সময় থাকলে মু নাজাত করা উচিৎ। আর এ ব্যাপারে তাশাহহুদের বর্ণনায় (১ম খন্ডে) আলোচনা করা হয়েছে।

সতর্কতার বিষয় যে, তাশাহহুদের বৈঠকে ইমামকে দেরী করতে দেখে অনেকে গলা ঝাড়তে শুরু করে। এমন করা তাদের ধৈর্যহীনতা ও অজ্ঞতার পরিচয়।

ইমাম সশব্দে ক্বিরাআত করলে মুক্তাদীকে ক্বিরাআত করতে হয় না। বিশেষ করে সশব্দে কোন সূরা পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য বৈধ নয়। বরং ইমামের ক্বিরাআত চুপ করে শুনতে হয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

(وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا)

অর্থাৎ, যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শো ন এবং চুপ থাক। (কুরআন মাজীদ ৭/২০৪)

সাহাবাগণ নামাযে সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন। একদা কোন জেহরী নামায থেকে সালাম ফিরে আল্লাহর নবী (ﷺ) বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কি আমার সাথে (সশব্দে) কুরআন পড়েছে?” এক ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “তাতেই আমি ভাবছি যে, আমার ক্বিরাআতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হ্‌চ্ছে কেন।” আবূ হুরায়রা বলেন, এই কথা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল। (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ৮৫৫নং)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “যার ইমাম আছে, তার ইমামের ক্বিরাআত তার ক্বিরাআত।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, জামে ৬৪৮৭নং)

তিনি বলেন, “ইমাম তো এই জন্য বানানো হয় যে, তার অনুসরণ করা হবে। অতএব সে যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহু আকবার’ বল এবং যখন ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাক।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে আবী শাইবা, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বায়হাকী, জামে ২৩৫৮-২৩৫৯নং)

এ হল সাধারণ হুকুম। জেহরী নামাযে সশব্দে মুক্তাদী কোন ক্বিরাআত করতে পারবে না। কিন্তু নিঃশব্দে কেবল সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। কারণ, সূরা ফাতিহার রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “সেই ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)

“সেই ব্যক্তির নামায যথেষ্ট নয়, যে তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)

“যে ব্যক্তি এমন কোনও নামায পড়ে, যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ঐ নামায (গর্ভচ্যুত ভ্রুণের ন্যায়) অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩নং)

“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)

“উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা) এর মত আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল্‌ তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ২১৪২ নং)

সাহাবী উবাদাহ্‌ বিন সামেত বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর পশ্চাতে ফজরের নামায পড়ছিলাম। তিনি ক্বিরাআত পড়তে লাগলে তাঁকে ক্বিরাআত ভারী লাগল। সালাম ফিরার পর তিনি বললেন, “সম্ভবত: তোমরা ইমামের পিছনে ক্বিরাআত কর।” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রসূল! (আমরা তো তা করি।) তিনি বললেন, “না, ক্বিরাআত করো না। অবশ্য সূরা ফাতিহা পড়ো। কারণ, যে তা পড়ে না তার নামায হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৮২৩নং)

পক্ষান্তরে ইমাম জেহরী নামাযের শেষ এক বা দুই রাকআতে অথবা সির্রী নামাযে নিঃশব্দে ক্বিরাআত করলে অথবা তাঁর ক্বিরাআত শুনতে না পাওয়া গেলেও মুক্তাদী সূরা ফাতিহা অবশ্যই পড়বে এবং সেই সাথে অন্য সূরাও পড়তে পারে।

যে আবূ হুরাইরা বলেন, ‘এই কথা আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল।’ সেই (সূরা ফাতিহার গুরুত্ব নিয়ে হাদীস বর্ণনাকারী) আবূ হুরাইরাকে প্রশ্ন করা হল যে, (সূরা ফাতিহার এত গুরুত্ব হলে) ইমামের পশ্চাতে কিভাবে পড়া যাবে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার মনে মনে পড়ে নাও। কারণ, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি ; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রা র্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)

যদি বলেন, আদবের নিয়ম এই যে, জামাআতের মধ্যে একজন কথা বলবে এবং বাকী সবাই চুপ থাকবে। সবাই কথা বললে শ্রোতা বুঝতে পারে না এবং সম্মানিত শ্রোতার শানে বেআদবী হয়।

তাহলে আমরা বলব যে, তাই যদি হয়, তাহলে ইস্তিফতাহ্‌, তাসবীহ্‌, তাশাহহুদ ইত্যাদি কেন সবাই বলে থাকে? তাতে কি বেআদবী হয় না? তা কি বুঝতে আল্লাহর অসুবিধা হয় না? তাছাড়া একই সাথে বিশ্বের কত শত মুসলমান একই সময়ে এক সাথে কত ইমাম, কত নফল নামাযী নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন কি এই অসুবিধা হয় না? মানুষের সাথে আল্লাহর তুলনা? নাকি আল্লাহর কুদরতে সন্দেহ্‌? আসলে যেখানে দলীল আছে সেখানে আকেল দ্বারা কাজ নেওয়া আ ক্কে লের কাজ নয়।

প্রকাশ থাকে যে, যদি কোন কারণবশত: মুক্তাদী ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তে ভুলে যায়, তাহলে তাতে তার নামায হয়ে যাবে। ঐ রাকআত তাকে কাযা করতে হবে না। কারণ, ভুলের আমল ধর্তব্য নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)

সির্রী নামাযে ইমামের পিছনে মুক্তাদী সিজদার আয়াত পাঠ করলে তিলাওয়াতের সিজদা করতে পারে না। তিলাওয়াতের সিজদা সুন্নত। আর ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব। অতএব সুন্নত পালন করতে গিয়ে গুনাহ করতে কেউ পারে না। আবার এ কথা জেনে শুনে কেউ সিজদা করলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ঐ ১/২৯০)

মুক্তাদীর জামাআতে শামিল হওয়ার বিভিন্ন অবস্থা

জামাআত শুরু হয়ে যাওয়ার পর কোন নামাযী নামাযে শামিল হতে চাইলে নিয়মিত দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দিয়ে তাকে তাই করতে হবে, যা ইমাম করছেন। তাড়াহুড়ো না করে ইমাম যে অবস্থায় থাকবেন সেই অবস্থায় ধীরে-সুস্থ শামিল হতে হবে।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “নামাযে আসার সময় ধীর-স্থিরতার সাথে এস এবং তাড়াহুড়ো করে এসো না। এরপর যা পাবে, তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যাবে, তা পুরা করে নাও।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, জামে ২৭৫নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের কেউ নামাযে এলে এবং ইমাম কোন অবস্থায় থাকলে, সে যেন তাই করে, যা ইমাম করছে।” (তিরমিযী, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৮৮, জামে ২৬১নং)

ইমাম সির্রী নামাযে প্রথম রাকআতে কিয়াম অবস্থায় থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দিয়ে ইস্তিফতাহ্‌র দুআ পড়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পাঠ করবে। কিন্তু ইমামের রুকূ চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। ফাতিহা পাঠ করতে করতে ইমাম রুকূ চলে গেলে পুরো না পড়েই রুকূতে যেতে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৯) এ ক্ষেত্রে ফাতিহা পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বৈধ নয়।

জেহরী নামাযে ইমামের সূরা ফাতিহা বা অন্য সূরা পাঠ করা অবস্থায় শামিল হলে মুক্তাদী ইস্তিফতাহ্‌ বা সানা পড়বে না। বরং চুপে চুপে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪)

ইমাম রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদী তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থ যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর রুকুতে যাওয়ার তকবীর পড়ে রুকূতে যাবে এবং রুকূর তাসবীহ পাঠ করবে। অবশ্য সময় সংকীর্ণ বুঝলে কেবল তাহ্‌রীমার তকবীরই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তকবীরের পর বুকে হাতও রাখবে না এবং সানা বা ফাতিহাও পড়বে না। কারণ, ইমামের অনুসরণ জরুরী। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪২-২৪৩)

রুকূ পেলে রাকআত গণ্য :

ইমামের সাথে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হবে কি না সে বিষয়টি বিতর্কিত। বর্তমান বিশ্বের সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের সুচিন্তিত মতানুসারে রুকু পেলে রাকআত গণ্য হবে।

এ ব্যাপারে যে সকল স্পষ্ট হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও এক জামাআত সাহাবার আমল এ কথার সমর্থন করে।

এ ব্যাপারে ইবনে মাসঊদ, ইবনে উমার, যায়দ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র প্রভৃতি কর্তৃক রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে। পক্ষান্তরে আবূ বাকরার সহীহ হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে হাদীসটিকে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার দলীল হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আবূ বাকরাহ্‌ একদা মসজিদ প্রবেশ করতেই দেখলেন নবী (ﷺ) রুকূতে চলে গেছেন। তিনি তাড়াহুড়ো করে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই রুকূ করলেন। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। একথা নবী (ﷺ)-কে বলা হলে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, “আল্লাহ তোমার আগ্রহ্‌ আরো বৃদ্ধি করুন। আর তুমি দ্বিতীয় বার এমনটি করো না। (অথবা আর তুমি ছুটে এসো না। অথবা তুমি নামায ফিরিয়ে পড়ো না।)” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১১০নং)

উক্ত হাদীসে রুকূ পেলে রাকআত পেয়ে নেওয়ার কথা ইঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া আর একটি সুন্নতের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে ইমামকে রুকূর অবস্থায় দেখে তাহলে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই তার জন্য রুকূ করা সুন্নত। তাতে যদি সে ইমামের মাথা তোলার পর কাতারে শামিল হয় তাহলেও তার ঐ রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৮৬পৃ:)

ইবনুয যুবাইর (রাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে (জামাআতের) লোকেরা রুকূর অবস্থায় আছে, তাহলে সে যেন প্রবেশ করেই রুকূ করে। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে শামিল হয়। কারণ, এটাই হল সুন্নাহ্‌।” (ত্বাবরানী, আওসাত্ব, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ১৫৭১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৪, বায়হাকী ৩/১০৬, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২২৯নং, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/২৬০-২৬৫)

মোট কথা, কেউ যদি ইমামকে রুকূর অবস্থায় পেয়ে তাঁর সাথে রুকূর (কমপক্ষে একবার) তাসবীহ পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে তার সে রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। কিয়াম ও সূরা ফাতিহা না পেলেও রাকআত হয়ে যাবে। সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। কিন্তু কিয়াম অবস্থায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে ইমামের সাথে রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদীর হ্‌ক্কে তা মার্জনীয়। কারণ, সাধারণ দলীল থেকে এ ব্যাপারটাও ব্যতিক্রম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪৪) পরন্তু ইচ্ছা করে যদি কেউ কিয়ামে শামিল না হয়ে (লম্বা তারাবীহ্‌র) রুকূতে শামিল হয়, তাহলে তার ঐ রাকআত হবে না। কারণ সে ইচ্ছাকৃত নামাযের একটি রুক্‌ন কিয়াম ও সূরা ফাতিহা ত্যাগ করে।

সতর্কতার বিষয় যে, ইমাম রুকূ অবস্থায় থাকলে মসজিদে প্রবেশ করে অনেক মুক্তাদী তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার আশায় গলা ঝাড়া দিয়ে ইমামকে সতর্ক করে। এমন করা বৈধ নয়।

ইমাম কওমার অবস্থায় থাকলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর কওমার দুআ পাঠ করবে। এ ক্ষেত্রে আর রাকআত গণ্য হবে না।

ইমাম সিজদায় চলে গেলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর (বুকেহাত না বেঁধে) আবার তকবীর বলে সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করবে। আর এ ক্ষেত্রেও রাকআত গণ্য হবে না এবং ইমামের দ্বিতীয় রাকআতে কিয়ামে দাঁড়ানোর সময় ইস্তিফতাহও পড়বে না। বরং ‘আঊযু বিল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমরা সিজদারত থাকা অবস্থায় তোমরা নামাযে এলে তোমরাও সিজদা কর এবং সেটাকে কিছুও গণ্য করো না।” (বুখারী ৫৫৬, মুসলিম, সহীহ ৬০৭-৬০৮, আবূদাঊদ, সুনান ৮৯৩নং)

ইমাম দুই সিজদার মাঝের বৈঠকে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকেহাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ বৈঠকের দুআ পাঠ করবে।

ইমাম শেষ সিজদায় থাকলেও তাঁর জন্য উঠে দাঁড়ানোর অপেক্ষা বৈধ নয়। বরং যথানিয়মে সিজদায় যেতে হবে এবং যথানিয়মে ইমামের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্‌-বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।

এখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিজদা খামাখা নষ্ট করা উচিৎ নয়। কারণ, মহানবী (ﷺ) বলেন, “তুমি আল্লাহর জন্য অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও; কারণ যখনই তুমি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করবে তখনই আল্লাহ তার বিনিময়ে তোমাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং তার দরুন একটি গুনাহ মোচন করবেন।” (মুসলিম, সহীহ ৪৮৮নং তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “প্রত্যেক বান্দাই, যখন সে আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন, তার একটি গুনাহ ক্ষালন করে দেন এবং তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী করে সিজদা কর।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সহিহ তারগিব ৩৭৯নং)

বলাই বাহুল্য যে, ইমামের রুকূ থেকে মাথা তোলার পর রাকআতের কোন অংশে শামিল হলে ঐ রাকআত গণ্য হবে না। ইমাম সালাম ফিরে দিলে ঐ নামাযী সালাম না ফিরে তকবীর দিয়ে উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত একাকী যথানিয়মে পূরণ করে সালাম ফিরবে।

অনুরুপ দ্বিতীয় রাকআতে শামিল হলে অনুরুপভাবে রাকআত গণ্য ও অগণ্য হবে।

ইমাম তাশাহ্‌হুদে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকে হাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ তাশাহহুদের দুআ পাঠ করবে। এর ফলে কোন কোন ৪ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ বার, ৩ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ থেকে ৪ বার এবং ২ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ২ বার তাশাহহুদ হয়ে যেতে পারে।

যেমন যোহ্‌র, আসর বা এশার নামাযের প্রথম তাশাহ্‌হুদে জামাআতে শামিল হলে মুক্তাদী ইমামের সাথে ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। আর তার হবে প্রথম তাশাহহুদ। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ তাশাহহুদ।

অনুরুপভাবে দ্বিতীয় রাকআতে বা শেষ তাশাহ্‌হুদে শামিল হলে ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায আদায় করলেও যথানিয়মে তার ৩টি তাশাহহুদ হবে।

মাগরেবের নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর পর বা প্রথম তাশাহ্‌হুদে জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথে শেষের রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়তে প্রথম যে রাকআত সে একাকী পড়বে সেটি তার দ্বিতীয় রাকআত। ফলে সে তার হিসাবে সে প্রথম তাশাহহুদ পড়বে। তারপর উঠে তৃতীয় রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে ঐ মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ রাকআতে ৪টি তাশাহহুদ।

কিন্তু এই নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর আগে বা রুকূতে শামিল হলে প্রত্যেক রাকআতে ১টি করে মোট ৩টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে। যেমন শেষ তাশাহ্‌হুদে শামিল হলেও যথানিয়মে ৩টি তাশাহহুদ হবে।

ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতে অথবা তাশাহ্‌হুদে শামিল হলে ২ রাকআত নামাযে ২টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে।

অবশ্য তাশাহহুদ বেশী হওয়ার জন্য কোন সহু সিজদা লাগবে না।

প্রকাশ থাকে যে, মুক্তাদী ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একাকী যে নামায পড়বে সেগুলো তার শেষ রাকআত। অতএব শেষ রাকআত গুলো সে একাকী যে নিয়মে পড়ে ঠিক সেই নিয়মে আদায় করবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৬৬, ১৮/১০৭, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৮) জেহরী নামায হলে জেহরী ক্বিরাআতে যদি পাশের নামাযীর ডিষ্টার্ব না হয়, তাহলে জেহরী, নচেৎ সির্রী ক্বিরাআত করে নামায শেষ করবে। যেহেতু একাকী নামাযে জোরে জোরে ক্বিরাআত বাধ্যতামূলক নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৪০)

ইমাম সালাম ফিরে দিলে আর জামাআতে শামিল না হয়ে অন্য নামাযী থাকলে তাকে নিয়ে দ্বিতীয় জামাআত করে নামায পড়বে।

ইমাম প্রথম সালাম ফিরে শেষ করলেই মসবূক নিজের বাকী নামায পড়ার জন্য উঠতে পারে। কারণ, এক সালামেও নামায হয়ে যায়। তবে সতর্কতার বিষয় যে, তাঁর সালাম শুরু করার সাথে সাথে উঠবে না। পক্ষান্তরে অনেকে বলেছেন, ইমাম যতক্ষণ দ্বিতীয় সালাম থেকে ফারেগ না হয়েছেন, ততক্ষণ উঠা বৈধ নয়। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, কোন মসবূক যেন ইমামের উভয় সালাম ফিরে শেষ না করা পর্যন্ত তার বাকী নামায আদায় করতে না উঠে। (মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ৪১পৃ:) মহানবী (ﷺ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)

অনেকে বলেছেন, ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে উঠে গেলে মসবূকের নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ফাতাওয়াশ শায়খ ইবনি সা’দী ১৭৪পৃ:, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ৯৬-৯৭পৃ:) অতএব নামাযী সাবধান!

যদি কোন নামাযী মসজিদে এসে দেখে যে জামআত শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু মসবূক (যাদের কিছু নামায ছুটে গেছে তারা) উঠে একাকী নামায পূর্ণ করছে, তাহলে জামাআতের সওয়াব লাভের আশায় ঐ নামাযীর কোন এক মসবূকের ডাইনে দাঁড়িয়ে তার ইক্তিদা করে নামায পড়া বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৬)

কিন্তু শায়খ ইবনে উষাইমীন (রহঃ) বলেন, এর যেহেতু সঠিক প্রমাণ নেই এবং অনেকে এরুপ শুদ্ধ নয় বলেছেন, সেহেতু তা না করাই উত্তম। আর মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে বিষয়ে সন্দেহ্‌ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ্‌ নেই।” (তিরমিযী, সুনান ২৫১৮, জামে ৩৩৭৮নং) “সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে।” (বুখারী ৫২, মুসলিম, সহীহ ১৫৯৯নং) বলা বাহুল্য, অনেকে তা জায়েয বললেও না করাটাই উত্তম। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৭১, লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ৫৩-৫৪পৃ:)

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »