সূরা পাঠ শেষ হলে দম নেওয়ার জন্য নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) একটু চুপ থাকতেন বা থামতেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৫) অতঃপর তিনি নিজের উভয়হাত দুটিকে পূর্বের ন্যায় কানের উপরি ভাগ বা কাঁধ পর্যন্ত তুলতেন। এ ব্যাপারে এত হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তা ‘মুতাওয়াতির’-এর দর্জায় পৌঁছে।

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন নামায শুরু করতেন, যখন রুকূ করার জন্য তকবীর দিতেন এবং রুকূ থেকে যখন মাথা তুলতেন তখন তাঁর উভয়হাতকে কাঁধ বরাবর তুলতেন। আর (রুকূ থেকে মাথা তোলার সময়) বলতেন, “সামিআ’ল্লা-হু লিমানহামিদাহ্‌।” তবে সিজদার সময় এরুপ (রফয়ে য়্যাদাইন) করতেন না।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৩নং)

মহানবী (ﷺ) এর দেহে চাদর জড়ানো থাকলেও হাত দুটিকে চাদর থেকে বের করে ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করেছেন। সাহাবী ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, তিনি দেখেছেন যে, নবী (ﷺ) যখন নামাযে প্রবেশ করলেন, তখন দুই হাত তুলে তকবীর বলেহাত দুটিকে কাপড়ে ভরে নিলেন। অতঃপর ডান হাতকে বামহাতের উপর রাখলেন। তারপর যখন রুকূ করার ইচ্ছা করলেন, তখন কাপড় থেকে হাত দু’টিকে বের করে পুনরায় তুলে তকবীর দিয়ে রুকূতে গেলেন। অতঃপর যখন (রুকূ থেকে উঠে) তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বললেন, তখনও হাত তুললেন। আর যখন সিজদা করলেন, তখন দুই হাতের চেটোর মধ্যবর্তী জায়গায় সিজদা করলেন। (মুসলিম, মিশকাত ৭৯৭ নং)

এই সকল ও আরো অন্যান্য হাদীসকে ভিত্তি করেই তিন ইমাম এবং অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফকীহ্‌গণের আমল ছিল এই সুন্নাহর উপর। কিছু হানাফী ফকীহও এই অনস্বীকার্য সুন্নাহর উপর আমল করে গেছেন। যেমন ইমাম আবূ ইউসুফের ছাত্র ইসাম বিন ইউসুফ, আবূ ইসমাহ্‌ বালখী রুকূ যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠার সময় ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করতেন। (আল-ফাওয়াইদ ১১৬পৃ:) বলাই বাহুল্য যে, তিনি দলীলের ভিত্তিতেই ইমাম আবূহানীফা (রহঃ) এর বিপরীতও ফতোয়া দিতেন। (আল-বাহ্‌রুর রাইক্ব ৬/৯৩, রসমুল মুফতী ১/২৮) বলতে গেলে তিনিই ছিলেন প্রকৃত ইমাম আবূহানীফার ভক্ত ও অনুসারী। কারণ, তিনি যে বলে গেছেন, ‘হাদীস সহীহ হলেই সেটাই আমার মযহাব।’

আব্দুল্লাহ্‌ বিন আহমাদ তাঁর পিতা ইমাম আহমাদ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, উক্ববাহ্‌ বিন আমের হতে বর্ণনা করা হয়, তিনি নামাযে ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নামাযীর জন্য প্রত্যেক ইশারা (হাত তোলার) বিনিময়ে রয়েছে ১০টি করে নেকী।’ (মাসাইল ৬০পৃ:)

আল্লামা আলবানী বলেন, হাদীসে ক্বুদসীতে উক্ত কথার সমর্থন ও সাক্ষ্য মিলে; “যে ব্যক্তি একটি নেকী করার ইচ্ছা করার পর তা আমলে পরিণত করে, তার জন্য ১০ থেকে ৭০০ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়---।” (বুখারী, মুসলিম, সহিহ তারগিব ১৬ নং, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৫৬ ও ১২৮-১২৯পৃ:) যেহেতু ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ হল সুন্নাহ্‌। আর সুন্নাহর উপর আমল নেকীর কাজ বৈকি?

দেহে শাল জড়ানো থাকলে শালের ভিতরেও কাঁধ বরাবর হাত তোলা সুন্নত।

ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, ‘আমি শীতকালে নবী (ﷺ) এর নিকট এলাম। দেখলাম, তাঁর সাহাবীগণ নামাযে তাঁদের কাপড়ের ভিতরেই ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৯ নং)

‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ হল মহানবী (ﷺ) এর সুন্নাহ্‌ ও তরীকা। তার পশ্চাতে হিকমত বা যুক্তি না জানা গেলেও তা সুন্নাহ্‌ ও পালনীয়। তবুও এর পশ্চাতে যুক্তি দর্শিয়ে অনেকে বলেছেন, হাত তোলায় রয়েছে আল্লাহর প্রতি যথার্থ তা’যীম; বান্দা কথায় যেমন ‘আল্লাহ সবার চেয়ে বড়’ বলে, তেমনি তার ইশারাতেও তা প্রকাশ পায়। উক্ত সময়ে এই অর্থ মনে আনলে বান্দার নিকট থেকে দুনিয়া অদৃশ্য হয়ে যায়। নেমে আসে সে রাজাধিরাজ বিশ্বাধিপতির ভীতি ও তা’যীম।

কেউ বলেন, হাত তোলা হল বান্দা ও আল্লাহর মাঝে পর্দা তোলার প্রতি ইঙ্গিত। যেহেতু এটাই হল বিশেষ মুনাজাতের সময়। একান্ত গোপনে বান্দা আল্লাহর সাথে কথা বলে থাকে।

কেউ বলেন, এটা নামাযের এক সৌন্দর্য ও প্রতীক। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪)

কেউ বলেন, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ হল আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করার প্রতি ইঙ্গিত। অপরাধী যখন পুলিশের রিভলভারের সামনে হাতে-নাতে ধরা পড়ে, তখন সে আত্মসমর্পণ করে হাত দু’টিকে উপর দিকে তুলে অনায়াসে নিজেকে সঁপে দেয় পুলিশের হাতে। অনুরুপ বান্দাও আল্লাহর নিকট অপরাধী। তাই বারবার হাত তুলে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করা হয়। (কাইফা তাখশাঈনা ফিস স্বালাহ্‌ ৩১পৃ: দ্র:)

পক্ষান্তরে আর এক শ্রেণীর বিকৃত-প্রকৃতির চিন্তাবিদ রয়েছেন, যাঁরা এর যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেন, ‘সাহাবীরা বগলে মূর্তি (বা মদের বোতল) ভরে রেখে নামায পড়তেন! কারণ ইসলামের শুরুতে তখনো তাঁদের মন থেকে মূর্তির (বা মদের বোতলের) মহব্বত যায়নি। তাই নবী করীম (ﷺ) তাঁদেরকে বারবার হাত তুলতে আদেশ করেছিলেন। যাতে কেউ আর বগলে মূর্তি (বা মদের বোতল) দাবিয়ে রাখতে না পারে।’ (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।) বক্তার উদ্দেশ্য হল, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’-এর প্রয়োজন তখনই ছিল। পরবর্তীকালে সাহাবীদের মন থেকে মূর্তি (বা মদের বোতলে)র মায়া চলে গেলে তা মনসূখ করা হয়!!

এই শ্রেণীর যুক্তিবাদীরা আরো বলে থাকেন, ‘সে যুগে ক্ষুর-ব্লেড ছিল না বলেই দাড়ি রাখত! সে যুগের লোকেরা খেতে পেত না বলেই রোযা রাখত---!!’ অর্থাৎ বর্তমানে সে অভাব নেই। অতএব দাড়ি ও রোযা রাখারও কোন প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নেই। এমন বিদ্রুপকারী যুক্তিবাদীদেরকে মহান আল্লাহর দু’টি আয়াত স্মরণ করিয়ে দিই, তিনি বলেন, “আর যারা মু’মিন নারী-পুরুষদেরকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহর ভার নিজেদের মাথায় চাপিয়ে নেয়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৫৮) “অতঃপর ওরা যদি তোমার (নবীর) আহ্‌বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবে ওরা তো কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অমান্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।” (কুরআন মাজীদ ২৮/৫০)

পরন্তু ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করতে সাহাবাগণ আদিষ্ট ছিলেন না। বরং হযরত রসূলে কারীম (ﷺ) খোদ এ আমল করতেন। সাহাবাগণ তা দেখে সে কথার বর্ণনা দিয়েছেন এবং আমল করেছেন। তাহলে বক্তা কি বলতে চান যে, ‘তিনিও প্রথম প্রথম বগলে মূর্তি দেবে রেখে নামায পড়তেন এবং তাই হাত ঝাড়তেন?! (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।)

পক্ষান্তরে ঐ শ্রেণীর নামাযী বক্তারাও তাকবীরে তাহ্‌রীমার সময় ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করে থাকেন। তাহলে তা কেন করেন? এখনো কি তাঁদের বগলে মূর্তিই থেকে গেছে? সুতরাং যুক্তি যে খোঁড়া তা বলাই বাহুল্য।

প্রকাশ থাকে যে, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ না করার হাদীস সহীহ হলেও তা নেতিবাচক এবং এর বিপরীতে একাধিক হাদীস হল ইতিবাচক। আর ওসূলের কায়দায় ইতিবাচক নেতিবাচকের উপর প্রাধান্য পায়। তাছাড়া কোন যয়ীফ হাদীস এক বা ততোধিক সহীহ হাদীসকে মনসূখ করতে পারে না। অতএব মনসূখের দাবী যথার্থ নয় এবং এ সুন্নাহ্‌ বর্জনও উচিৎ নয়।