৬. ১. ২৯. ঈশ্বর বিষয়ক পরস্পর বিরোধী বিশেষণ / ৬. ১. ২৯. ১. প্রেম-মমতা বনাম ক্রোধ-নিমর্মতা

৬. ১. ২৯. ঈশ্বর বিষয়ক পরস্পর বিরোধী বিশেষণ

বাইবেলে ঈশ্বর বিষয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী ও অশোভন বিশেষণ বিদ্যমান। উপরে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমরা কিছু বিষয় দেখেছি। এখানে কয়েকটা বিষয় দেখুন:

৬. ১. ২৯. ১. প্রেম-মমতা বনাম ক্রোধ-নিমর্মতা

দ্বিতীয় বিবরণ ৩২/১০ বনি-ইসরাইলের বিষয়ে ঈশ্বরের মমতা প্রসঙ্গে বলছে: ‘‘তিনি তাহাকে বেষ্টন করিলেন, তাহার তত্ত্ব লইলেন, নয়ন-তারার ন্যায় তাহাকে রক্ষা করিলেন।’’ পক্ষান্তরে গণনা পুস্তক ২৫/৪, ৯: ‘‘সদাপ্রভু মোশিকে কহিলেন, তুমি লোকদের সমস্ত অধ্যক্ষকে সঙ্গে লইয়া সদাপ্রভুর উদ্দেশে সূর্যের সম্মুখে উহাদিগকে টাঙ্গাইয়া দেও; তাহাতে ইস্রায়েলের উপর হইতে সদাপ্রভুর প্রচন্ড ক্রোধ নিবৃত্ত হইবে। ... যাহারা ঐ মহামারীতে মরিয়াছিল, তাহারা চবিবশ সহস্র লোক।’’

ঈশ্বর মোশিকে নির্দেশ দিলেন এ প্রিয় জাতির সকল অধ্যক্ষকে  (নেতা ও গোত্রপতিকে) ক্রুশবিদ্ধ করতে এবং তিনি তাদের ২৪ হাজার মানুষকে ধ্বংস করলেন! ‘নয়ন-তারার মত সংরক্ষণের’ সাথে এরূপ নির্মম ক্রোধ কি সাংঘর্ষিক নয়?

দ্বিতীয় বিবরণ ৮/৫: ‘‘মনুষ্য যেমন আপন পুত্রকে শাসন করে, তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাকে তদ্রূপ শাসন করেন।’’ কিন্তু গণনাপুস্তক ১১/৩২: ‘‘কিন্তু সেই মাংস তাহাদের দন্তের মধ্যে থাকিতে, কাটিবার পূর্বেই লোকদের প্রতি সদাপ্রভুর ক্রোধ প্রজ্বলিত হইল; আর সদাপ্রভু লোকদিগকে ভারী মহামারী দ্বারা আঘাত করিলেন।’’

অসহায় মানুষগুলো যখন কিছু মাংস যোগাড় করে খাওয়া শুরু করল, তখন মুখের খাবার মুখের মধ্যে থাকা অবস্থাতেই তাদেরকে তিনি ভারী মহামারী দ্বারা আঘাত করলেন!! পিতা কর্তৃক পুত্রকে শাসনের সাথে কি এটা সাংঘর্ষিক নয়?

মীখা ৭/১৮: ‘‘কে তোমার তুল্য ঈশ্বর? ... কারণ তিনি দয়ায় প্রীত।’’ কিন্তু অন্যত্র নির্মম ও দয়াহীন গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে ঈশ্বর বলেন: ‘‘আর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু যখন তোমার সম্মুখে তাহাদিগকে সমর্পণ করিবেন, এবং তুমি তাহাদিগকে আঘাত করিবে, তখন তাহাদিগকে নিঃশেষে বিনষ্ট করিবে; তাহাদের সহিত কোন নিয়ম করিবে না, বা তাহাদের প্রতি দয়া করিবে না। ... আর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমার হস্তে যে সমস্ত জাতিকে সমর্পণ করিবেন, তুমি তাহাদিগকে কবলিত করিবে; তোমার চক্ষু তাহাদের প্রতি দয়া না করুক।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৭/২-১৬)

এভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচার গণহত্যার নির্দেশ ও তাদেরকে দয়া করতে নিষেধ করা কি ঈশ্বরের দয়ায় প্রীত হওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?

যাকোব ৫/১১: ‘‘প্রভুর পরিণামও দেখিয়াছ, ফলতঃ প্রভু স্নেহপূর্ণ ও দয়াময়।’’ কিন্তু হোশেয় ১৩/১৬: ‘‘শমরিয়া দন্ড পাইবে, কারণ সে আপন ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারিণী হইয়াছে, তাহারা খড়গে পতিত হইবে, তাহাদের শিশুগণকে আছড়াইয়া খন্ড খন্ড করা যাইবে, তাহাদের গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের উদর বিদীর্ণ করা যাইবে।’’

শিশু ও গর্ভবতীদের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত কি স্নেহ ও দয়ার আধিক্য প্রমাণ করে?

যিরমিয়ের বিলাপ ৩/৩৩: ‘‘কেননা তিনি অন্তরের সহিত দুঃখ দেন না, মনুষ্য-সন্তানগণকে শোকার্ত করেন না।’’ কিন্তু অন্যান্য স্থানে আমরা বিপরীত চিত্র দেখি। ঈশ্বর অস্দোদ ও তার আশেপাশের জায়গার লোকদের মলদ্বারের মধ্যে টিউমার রোগ দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে তাদের মেরে ফেললেন (১ শমূয়েল ৫/৬)। ৫ জন রাজার সমবেত সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যকে তিনি আকাশ থেকে মহাশিলা বর্ষণ করে হত্যা করেন (যিহোশূয় ১০/১১)। ঈশ্বর ও মোশির বিষয়ে সামান্য আপত্তি প্রকাশ করাতে তিনি ইস্রায়েল বংশের অনেক মানুষকে সর্প প্রেরণ করে হত্যা করেন (গণনাপুস্তক ২১/৫-৬)। এগুলো কি মানুষকে দুঃখ না দেওয়া ও শোকার্ত না করার নমুনা?

১ বংশাবলি ১৬/৪১ ‘‘কেননা তাঁহার দয়া অনন্তকালস্থায়ী।’’ গীতসংহিতা ১৪৫/৯: ‘‘সদাপ্রভু সকলের পক্ষে মঙ্গলময়, তাঁহার করুণা তাঁহার কৃত সমস্ত পদার্থের উপরে আছে।’’ কিন্তু ঈশ্বর নোহের সময়ে বিশ্বের সকল মানুষ ও প্রাণি পস্নাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করেন। আর তিনি সদোম ও ঘমোরার অধিবাসীদেরকে এবং পার্শবর্তী সকল এলাকার মানুষদেরকে আকাশ থেকে গন্ধক ও অগ্নি বর্ষণ করে ধবংস করেন। (আদিপুস্তক ৭/২১-২৪, ১৯/২৩-২৫।) এগুলো কি অনন্তকাল স্থায়ী দয়া ও সকল সৃষ্টির জন্য মঙ্গলময় করুণার নমুনা?

গীতসংহিতা ৩০/৫ ‘‘কেননা তাঁহার ক্রোধ নিমেষমাত্র থাকে’’। কিন্তু গণনাপুস্তক ৩২/১৩: ‘‘তখন ইস্রায়েলের প্রতি সদাপ্রভুর ক্রোধ প্রজ্বলিত হইল, আর তিনি চল্লিশ বছর পর্যন্ত, সদাপ্রভুর দৃষ্টিতে কুকর্মকারী সমস্ত লোকের নিঃশেষ না হওয়া পযন্ত, তাহাদিগকে প্রান্তরে ভ্রমণ করাইলেন।’’ এ কি ঈশ্বরের নিমেষমাত্রের ক্রোধের প্রকাশ?