পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ১০. ২. আনুমানিক সমাধানের কয়েকটা নমুনা

ব্যবসায় প্রশাসন এবং ইঞ্জিয়ারিং ডিগ্রিধারী, পেশায় তেল-গ্যাস ইকুইপমেন্ট সাপ্লায় কোম্পানির পরিচালক পল টবিন (Paul Tobin) নামে একজন লেখক The Rejection of Pascal's Wager: A Skeptic's Guide to the Bible and the Historical Jesus নামে একটা বই লেখেছেন। এ পুস্তকের অনলাইন ভার্শন পড়া যাবে rejectionofpascalswager.net ওয়েবসাইটে। এ পুস্তকে বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন সাংখ্যিক বৈপরীত্য, যেমন অহসিয় রাজার ২২ বা ৪২ বছরে রাজা হওয়া, যিহোয়াখীনের ১৮ বা ৮ বছরের রাজা হওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:

‘‘এটা একটা জ্বলন্ত বৈপরীত্য। মৌলবাদী প্রচারকরা কিভাবে এটার ব্যাখ্যা করবেন? এটা অধ্যয়ন মৌলবাদী ধর্মতাত্ত্বিকদের মানসিকতা অনুধাবনের আকর্ষণীয় অনুশীলন। এতে দেখা যায় যে, তারা সকল বৈপরীত্যের ক্ষেত্রে সর্বরোগ নিবারক ধন্বন্তরী সমাধান দেন ‘লিপিকারের ভুল’। তাঁরা বলতে চান যে, বাইবেলের বর্তমান রূপের মধ্যে উপরের মত কিছু বৈপরীত্য বিদ্যমান। এগুলো লিপিকারদের ভুলের কারণে বাইবেলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অন্য কথায়, লিপিকারদের হাতে আসার আগে মূল পাণ্ডুলিপিটা ত্রুটিমুক্ত ছিল। এ ব্যাখ্যার সাথে কিছু সমস্যা রয়েছে:

প্রথমত, মূল পাণ্ডুলিপিগুলো আর বিদ্যমান নেই! এজন্য এ ব্যাখাটার ভিত্তি শুধু একটা ধারণা যে, মূল বাইবেল ভুলমুক্ত ছিল। এখানে একটা বৃত্তাকার বিতর্কের শুরু: বাইবেল ভুলমুক্ত, যদি কোনো ভুল বিদ্যমান থাকে তবে অবশ্যই তা পরবর্তীকালে এর মধ্যে প্রবেশ করেছে; কারণ বাইবেল ভুলমুক্ত, এর মধ্যে ভুল থাকা সম্ভব নয়! ..

দ্বিতীয়ত, যদি ধারণা করা চলে যে, এটা লিপিকারের ভুল, তবে এরূপ দাবি করাও সম্ভব যে, বংশাবলির মূল লেখকই ভুলগুলো করেছিলেন। কারণ, বংশাবলির লেখক ২ রাজাবলি থেকে তাঁর অধিকাংশ তথ্য অনুলিপি করেছিলেন। কাজেই সমানভাবে সম্ভব যে, বংশাবলির মূল লেখকই ভুল সংখ্যা লেখেছিলেন। লিপিকারের ভুল তথ্য দিয়ে বাইবেলকে ভুলমুক্ত দাবি করা যাচ্ছে না।  ... এরপরও পাঠক দেখবেন যে, মৌলবাদীরা সুযোগ পেলেই এ অজুহাতটা ব্যবহার করছেন।’’[1]

উপরে আমরা রাজাবলি ও বংশাবলির মধ্যে বিদ্যমান অনেক বৈপরীত্য উল্লেখ করেছি, যেমন শলোমনের প্রধান কর্মচারীর সংখ্যা, অশ্বশালার সংখ্যা, জলাধারের জলধারণের ক্ষমতা ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে পল টোবিন (Paul Tobin)- লেখেছেন:

“Now how does the apologists account for these discrepancaies? Of course, the usual “copyist’s error” explanation is used -with the same difficulty we have mentioned above. Perhaps aware that using the same unproved assumption could be hazardous to their ecclesiastical paychecks-some apologists have provided other ad hoc explanations. The funny thing is that they often provide these explanations side by side with the “copyist’s error” one. In other words what they are saying, in effect, is  “well, this may be an explanation but if you don’t like this one, try another!”. This is NOT a rational method. An explanation has to be probable-just because an explanation is possible does not mean that the contradiction has been accounted for. The Encyclopedia of Biblical Errancy quotes a typical fundamentalist attempt (William Arndt, Does the Bible Contradict Itself?) at “solving the problem” of Solomon’s stalls (I Kings 7:26 and II Chronicles 9:25) [T]he First Kings deals with the affairs of Solomon and the beginning of his reign, while that in Second Chronicles belongs to the closing verses of the section describing the life and deeds of the wise king [at the end of his reign] The explanation is ad hoc, since in no way does the verses lead one to conclude what Arndt had suggested. It is introduced purely as an attempt to get out of the obvious contradiction. One sense that he himself is not too happy with such a defence when he later says: If anyone feels that the difficulty is not fully removed by this method, he may assume that a copyist’s error has crept into the text, a scribe writing 40,000 instead of 4,000. Amazing! Notice that it does not matter which explanation is true, so long as it can be used! It is obvious that apologists are not looking for the truth but merely for ways to keep to their faith.”

‘‘এখন প্রচারকরা কিভাবে এ বৈপরীত্য সমাধান করবেন? স্বভাবতই নিয়মিত অজুহাত ‘লিপিকারের ভুল’ এ বৈপরীত্য ব্যাখ্যাতেও ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ অজুহাতের মধ্যে উপরে বলা একই সমস্যাগুলো বিদ্যমান থাকছে। সম্ভবত প্রচারকরা সচেতন যে, একই অপ্রমাণিত অজুহাত বারবার ব্যবহার করা তাদের যাজকীয় বেতনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য কোনো কোনো প্রচারক আরো কিছু আন্দাজ-অপ্রমাণিত ব্যাখ্যা পেশ করেন। মজার বিষয় যে, প্রায়ই তারা ‘লিপিকারের ভুল’ অজুহাতের পাশাপাশি অন্যান্য অজুহাত পেশ করেন। অন্য ভাষায় তাঁরা মূলত বলতে চাচ্ছেন, ‘ঠিক আছে, এটাও একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে আপনি যদি এটা পছন্দ না করেন তবে আরেকটা চেষ্টা করে দেখুন!’ এটা কোনো যৌক্তিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি নয়। একটা ব্যাখ্যাকে অবশ্যই সুস্পষ্ট সম্ভাব্য হতে হবে। অসম্ভব নয় বা হতেও পারে বলে একটা ব্যাখ্যা পেশ করার অর্থ এ নয় যে, বৈপরীত্যটার সমাধান হয়ে গেল। ‘বাইবেলীয় ভুলভ্রান্তির বিশ্বকোষ’-এ এরূপ একটা গতানুগতিক মৌলবাদী প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছে। উইলিয়াম আরডনট ‘বাইবেল কি স্ববিরোধী?’ পুস্তকে শলোমনের অশ্বশালার সংখ্যার বৈপরীত্য সমাধানে বলেন: ‘১ রাজাবলি শলোমনে রাজত্বের প্রথম সময়ের অবস্থা বর্ণনা করেছে। আর ২ বংশাবলি মূলত এ মহান রাজার রাজত্বের শেষ দিকের অবস্থা বর্ণনা করেছে।’ এ সমাধানটা একেবারেই অস্থায়ী আন্দায-অনুমান। কারণ আরডনট যে দাবি করেছেন বাইবেলের শ্লোকগুলো কোনো পাঠককে কোনোভাবেই সে সিদ্ধান্তে নিয়ে যাচ্ছে না। সুস্পষ্ট বৈপরীত্য থেকে বের হওয়ার জন্য একান্তই একটা প্রচেষ্টা হিসেবে এটাকে পেশ করা হয়েছে। আরডনটের বক্তব্য থেকে পাঠক অনুভব করেন যে, আরডনট নিজেই নিজের এ সমাধানে খুশি হতে পারেন নি। এজন্যই তিনি এরপর বলছেন: যদি কেউ অনুভব করেন যে, এ পদ্ধতিতে সমস্যাটার পূর্ণ সমাধান হল না তবে তিনি অনুমান করতে পারেন যে, এ পাঠের মধ্যে লিপিকারের ভুল প্রবেশ করেছে। কোনো লিপিকার ৪,০০০ এর পরিবর্তে ৪০,০০০ লেখেছে।’

চমৎকার! অপূর্ব! লক্ষ্য করুন, কোন্ ব্যাখ্যা সঠিক তা কোনো বিষয়ই নয়! এটা কোনো রকমে ব্যবহার করার মত কিনা সেটাই বিষয়! খুবই সুস্পষ্ট যে, প্রচারক সত্য অনুসন্ধান করছেন না। শুধু তার বিশ্বাসকে বহাল রাখতে রাস্তা খুঁজছেন মাত্র।’’[2]

আমরা দেখেছি যে, শলোমনের পানির চৌবাচ্চার বা জলাধারের ধারণ ক্ষমতা বর্ণনায় রাজাবলি ও বংশাবলির মধ্যে ২২ হাজার লিটারের অদ্ভুত বৈপরীত্য বিদ্যমান। এ সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন:

“Here’s another lame explanation, this time regarding the contradiction of the capacity of the tank built by Solomon (Carl Johnson, So the Bible is Full of Contradictions?): There are at least two possible solutions to this. It could be a copyist’s error, or it could be that the molten sea ordinarily contained 2,000 baths, but that when filled to capacity it received and held 3,000 baths. Either way there is no real contradiction here. Note, again the ad hoc explanation. There is no hint in any of the passages that I Kings gave the ‘ordinary’ capacity while the Chronicler gave the “maximum” capacity. It was introduced purely to resolve the problem. And, if that it not good enough, try ‘copyist’s error’!”

‘‘এখানে আরেকটা খোঁড়া ব্যাখ্যা দেখুন। সেটা শলোমনের জলাধারের ধারণ ক্ষমতা প্রসঙ্গে। কার্ল জনসন ‘তাহলে বাইবেল বৈপরীত্য পূর্ণ?’ পুস্তকে লেখেছেন: ‘এখানে অন্তত দুটো সম্ভাব্য সমাধান বিদ্যমান। এটা লিপিকারের ভুল হতে পারে। অথবা সম্ভবত জলাধারটা সাধারণভাবে ২ হাজার বাথ ধারণ করত। তবে এটা যখন পুরোপুরি ভরা হত তখন তিন হাজার বাথ ধারণ করত। দুটোর যেটাকেই গ্রহণ করা হোক, এখানে প্রকৃত কোনো বৈপরীত্য আর থাকল না।’ এখানে পুনরায় অনুমান নির্ভর অস্থায়ী অজুহাতের বিষয়টা লক্ষ্য করুন। বাইবেলের বক্তব্যের মধ্যে সামান্যতম ইঙ্গিতও নেই যে, ১ রাজাবলির সাধারণ ধারণ ক্ষমতা ও বংশাবলি চূড়ান্ত ধারণ ক্ষমতার কথা লেখেছে। একান্তই সমস্যাটার সমাধান করতে এ অজুহাত পেশ করা হয়েছে। আর যদি এ সমাধান বেশি ভাল মনে না হয় তবে ‘লিপিকারের ভুল’ চেষ্টা করে দেখুন!’’[3]

দাউদের লোকগণনা বিষয়ক বৈপরীত্য আমরা দেখেছি। ২ শমূয়েল বলছে আট লক্ষ ও পাঁচ লক্ষ, মোট তের লক্ষ। কিন্তু ১ বংশাবলি বলছে: এগার লক্ষ ও চার লক্ষ সত্তর হাজার, মোট পনের লক্ষ সত্তর হাজার। দাউদের বন্দিদের সংখ্যার বৈপরীত্য আমরা দেখেছি : ২ শমূয়েল বলছে: ১,৭০০ ঘোড়সওয়ার+ ২০,০০০ পদাতিক। কিন্তু ১ বংশাবলি বলছে: ১,০০০ রথ+ ৭,০০০ ঘোড়সওয়ার+ ২০,০০০ পদাতিক। এ সকল বৈপরীত্য এক নজরেই প্রমাণ করে যে, এ সকল তথ্য পবিত্র আত্মা তো দূরের কথা সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষের লেখাও নয়। একান্তই সাধারণ কোনো সংকলকের নির্বিচার সংকলন। এরপরও অভ্রান্ততাবাদীরা এখানে লিপিকারের ভুল অজুহাতের পাশাপাশি ‘রাউন্ড ফিগার’ সমাধান প্রদান করেন। তারা বলেন, একজন লেখক সম্ভবত ভাংতি সংখ্যা না বলে পূর্ণ সংখ্যা বলেছেন। এখানে সংখ্যাগুলো এত বেশি বিপরীত যে, লিপিকারে ভুলে এক সংখ্যার স্থলে অন্য সংখ্যা লেখার সম্ভাবনা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। অনুরূপভাবে ৮ লক্ষকে ১১ লক্ষর ‘রাউন্ড ফিগার’ অথবা ৭ হাজারকে ১৭০০-এর রাউন্ড ফিগার বলা অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে পল টবিন (Paul Tobin) লেখেছেন:

The numbers are so different here that even the “copyist’s error” excuse does not work. Apologists have tried other ad hoc explanations: one is that the numbers of one verse are simple “rounded off” versions of the other. It is hard to see how 1.1 million could be a “rounded off” figure of 800,000! Here is another example of one verse with two contradictions: II Samuel 10:18 And the Syrians fled before Israel; and David slew the Syrians the men of seven hundred chariots, and forty thousand horsemen.. I Chronicles 19:18 And the Syrians fled before Israel; and David slew of the Syrians the men of seven thousand chariots, and forty thousand footsoldiers... So which is which, did David slay the men of 700 or 7,000 chariots? And were there 40,000 footsoldiers or horsemen?

‘‘এ সংখ্যাগুলো এত বিপরীত যে এখানে ‘লিপিকারের ভুল’ অজুহাত কার্যকর নয়। প্রচারকরা আরো ক্ষণস্থায়ী অনুমান নির্ভর অজুহাত পেশ করেন। একটা ‘রাউন্ড ফিগার’ বা পূর্ণ সংখ্যা তত্ত্ব। অর্থাৎ একটা সংখ্যা অন্য সংখ্যার পূর্ণ রূপ। ১১ লক্ষ কিভাবে ৮ লক্ষর পূর্ণরূপ হল তা ধারণা করা কঠিন। একই শ্লোকে একাধিক বৈপরীত্যের আরেকটা উদাহরণ দেখুন। ২ শমূয়েল ১০/১৮: দাউদ পলায়নপর সিরীয় বাহিনীর সাত শত রথচালক ও চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ার হত্যা করলেন। ১ বংশাবলি ১৯/১৮: দাউদ পলায়নপর সিরিয় বাহিনীর ৭ হাজার রথ চালক ও চল্লিশ হাজার পদাতিককে হত্যা করলেন। তাহলে কোনটা ঠিক? দাউদ ৭ শত না ৭ হাজার রথচালক হত্যা করেন? চল্লিশ হাজার নিহত কি পদাতিক না ঘোড়সওয়ার ছিলেন?’’[4]

[1] http://www.rejectionofpascalswager.net/numerical.html
[2] http://www.rejectionofpascalswager.net/numerical.html#solomon
[3] http://www.rejectionofpascalswager.net/numerical.html#solomon
[4] http://www.rejectionofpascalswager.net/numerical.html#solomon