৬. ৫. ৫. আহলুস সুন্নাতের আকীদা ব্যাখ্যায় ইমামগণ

উপরে আমরা মুসলিম উম্মাহর ইফতিরাক বা দলাদলি ও ফিরকা-বিভক্তির কারণ, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি জানতে পেরেছি। এ প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর আলিম ও ইমামগণ বিকৃতি ও বিভ্রান্তি থেকে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করতে এবং সঠিক আকীদা ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট থাকেন। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মার প্রসিদ্ধ ৪ মুজতাহিদ ইমাম বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

প্রথমত, আকীদার মূলনীতিতে তাঁরা একমত ছিলেন। এতে তাঁদের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) তাঁর ফিকহুল আকবারে যে আকীদা লিখেছেন এবং ইমাম আবূহানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহ)-এর আকীদা বর্ণনা করে ইমাম আবূ জা’ফর তাহাবী (রাহ) যা লিখেছেন তাই ৪ ইমামের আকীদা। আমলের সাথে ঈমানের সম্পর্ক ব্যাখ্যার ন্যায় সামান্য দু-একটি বিষয়ে খুটিনাটি বর্ণনায় সামান্য শাব্দিক পার্থক্য ছাড়া তাদের আকীদার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

দ্বিতীয়ত, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। সকল বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তাঁরা ছিলেন খগড়হস্ত। বিশেষত আকীদাগত বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তাঁরা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতেন। তাঁদের গ্রন্থাবালিতে বিভিন্নভাবে আকীদার বিষয় আলোচনা করেছেন।

তৃতীয়ত, ৪ ইমামের মধ্যে ইমাম আযম আবূ হানীফা (রাহ) ও ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল (রাহ) আকীদার বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। বস্ত্তত ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ হওয়া সত্ত্বেও ফিক্হ-এর বিষয়ে নিজে কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। তাঁর ফিকহী মতামতসমূহ আমরা তাঁর ছাত্রদের লেখা গ্রন্থাদি থেকে জানতে পরি। কিন্তু তিনি আকীদার বিষয়ে অনেকগুলি পুস্তিকা রচনা করেন। এগুলির মধ্যে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

চতুর্থত, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর আকীদা ব্যাখ্যায় ইমাম তাহাবীর প্রচেষ্টা বিশেষভাবে স্মরণীয়। ইমাম আবূ জা’ফর আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আত-তাহাবী ২৩৯ হিজরীতে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলম শিক্ষা, প্রচার ও ব্যাপক খিদমাত ও প্রসিদ্ধির পরে ৩২১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠ ফকীহগণের অন্যতম ছিলেন।  তাঁর রচিত ‘আকীদাতু আহলিস্ সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আত’ পুস্তিকাটি আহলুস সুন্নাতের আকীদা ব্যাখ্যায় মুসলিম উম্মাহর সর্বজন স্বীকৃত ও পঠিত বই। এ পুস্তকের প্রথমে তিনি বলেন:

هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة، على مذهب فقهاء الملة آبي حنيفة النعمان بن ثابت الكوفي، وأبي يوسف يعقوب بن إبراهيم الأنصاري، وأبي عبد الله محمد بن الحسن الثيباني رضوان الله عليهم أجمعين، وما يعتقدون من أصول الدين ويدينون به رب العالمين

‘‘এ হলো আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদার বর্ণনা, যা মিল্লাতের ফকীহগণ: ইমাম আবু হানীফা নু’মান বিন সাবিত কূফী (১৫০হি), আবু ইউসুফ ইয়াকুব বিন ইব্রাহীম আল-আনসারী (১৮২হি) ও আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ বিন হাসান আশ-শাইবানী (১৮৯ হি)-এর মাযহাবের ভিত্তিতে রচিত। তাঁদের সকলের উপর আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হোন। তাঁরা দীনের উসূল বা মূলনীতির বিষয়ে যে আকীদা পোষণ করতেন এবং যে নীতিতে তাঁরা রাববুল আ’লামীনের আনুগত্য করে গেলেন তারই অনুসরণে রচিত।’’[1]

হানাফী মাযহাবের অন্য একজন প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) রচিত ‘শরাহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকটিও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যায় সর্বজন স্বীকৃত ও প্রামাণ্য পুস্তক।

পঞ্চমত, আকীদার বিষয়ে ৪ মুজতাহিদ ইমামের একমত হওয়ার মূল কারণ আকীদার উৎসের বিষয়ে তাঁদের ঐকমত্য। আমরা দেখেছি যে, আকীদা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির মূল কারণ আকীদার উৎস ও ভিত্তি নির্ধারণে বিভ্রান্তি। উৎসের বিষয়ে মতভেদ না হলে ব্যাখ্যায় মৌলিক কোনো মতভেদ হয় না। যারা আকীদার ক্ষেত্রে একমাত্র কুরআন ও হাদীসকে উৎস হিসেবে গণ্য করেছেন এবং কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়গণের ইজমা বা জামা‘আতকে মানদন্ড হিসেবে গণ্য করেছেন তাদের মধ্যে মূলত সামান্য শাব্দিক বা ব্যাখ্যাগত কিছু মতভেদ ছাড়া কোনো মৌলিক মতভেদ নেই। কারণ মূল উৎস এক এবং তা বহুমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

পক্ষান্তরে যারা ইজতিহাদ, কিয়াস, আকল, যুক্তি, দর্শন ইত্যাদিকে কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি আকীদার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে মতভেদ ব্যাপক এবং মতভেদের সমাধান অসম্ভব। কারণ উৎস বহুমুখি এবং সেগুলির একমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মানবীয় ইজতিহাদ, কিয়াস, আকল, বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক ইত্যাদির ক্ষেত্রে একজনের সাথে অন্য জনের অমিল হবেই। যুগ, দেশ, পরিবেশ ও ব্যক্তির কারণে এগুলি ভিন্নতা দেখ দেবেই। কাজেই আকীদার ক্ষেত্রেও বিভাজন, বিভক্তি ও দলাদলি আবশ্যম্ভাবী।

ইজতিহাদ, বুদ্ধি, আকল বা কিয়াস-এর প্রয়োজন হয় ফিকহের ক্ষেত্রে। কারণ যুগের পরিবর্তনে কুরআন বা হাদীসে নেই এরূপ অনেক নতুন বিষয় মুসলিমের কর্মের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে এবং সে বিষয়ে বিধান দিতে হয় ফিকহের ক্ষেত্রে। কিন্তু আকীদার বিষয় তা নয়। কুরআন বা হাদীসে নেই এরূপ কোনো বিষয় মুসলিমের আকীদার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আকীদার সম্পর্ক গাইবী জগতের সাথে এবং আল্লাহ, ফিরিশতা, নবীগণ, কিতাব, আখিরাত, তাকদীর ইত্যাদির সাথে। এসকল বিষয়ে কোনো কিছু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে ছিল না কিন্তু পরে মুমিনের আকীদা বা বিশ্বাসের সাথে সংযোজিত না হলে তার আকীদার ত্রুটি হতে পারে এরূপ বাতুল চিন্তা কোনো মুসলিম করেন না। এ বিষয়ে ৫ম হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা ইবনু আব্দল বার্র ইউসুফ ইবনু আব্দুল্লাহ (৪৬৩ হি) বলেন:

لا خلاف بين فقهاء الأمصار وسائر أهل السنة ، وهم أهل الفقه والحديث في نفي القياس في التوحيد وإثباته في الأحكام

‘‘সকল দেশের ফকীহগণ এবং আহলুস সুন্নাতের সকল ইমাম, যারা হাদীস ও ফিকহের ইমাম তাঁরা সকলেই একমত যে, ইলমুত তাওহীদ বা ইলমুল আকীদার ক্ষেত্রে কিয়াস নিষিদ্ধ এবং ফিকহী আহকামের ক্ষেত্রে কিয়াস প্রযোজ্য।’’[2]

এভাবে সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী মূলধারার মুসলিম উম্মাহ বা আহলূস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত একমত যে, বিশ্বাসের একমাত্র উৎস ওহীর জ্ঞান এবং ওহীর জ্ঞান অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ঐকমত্য অর্থাৎ তাঁদের ইজমা বা জামা‘আতের উপর নির্ভর করতে হবে।

এজন্য ৪ ইমাম একমত যে, আকীদার উৎস মূলত দূটি: (১) কুরআন কারীম এবং (২) সহীহ হাদীস। আর কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ইজমা বা জামা‘আত হলো তাঁদের মানদন্ড। তাঁরা একমত যে, কুরআন-হাদীসে যা যেভাবে আছে তা সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে এবং যা নেই তা আকীদর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না এবং সে বিষয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। একান্ত প্রয়োজনে কুরআন ও হাদীসের সকল বক্তব্য সঠিক অর্থে ব্যাখ্যা ছাড়া গ্রহণ করার জন্য সমন্বয় মূলক কিছু কথা বলা যেতে পারে। এরূপ কথাও ইজতিহাদ হিসেবে গণ্য এবং আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য নয়। এজন্য এরূপ বিষয়ে মতভেদ মেনে নেওয়া হয়েছে।

আমরা ইতোপূর্বে ধর্মীয় ব্যাপারে, এবং বিশেষত গাইবী বিষয়ে ইজতিহাদ ও বিতর্ক এড়িয়ে চলা এবং ওহীর কথাকে বিনা বিতর্কে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ), ইমাম তাহাবী (রাহ) প্রমুখের বক্তব্য দেখেছি।

[1] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭।
[2] ইবনু আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, পৃ. ৭৪।