আমরা দেখেছি যে,  কুরআন কারীমে সুস্পষ্টত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রায় সকল আলিম একমত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাজদা করাই শির্ক। কারণ, ইবাদত ছাড়া বা চূড়ান্ত ভক্তির প্রকাশ ছাড়া কেউ কাউকে সাজদা করে না। জাগতিক ভয়, ভীতি, সম্মান ইত্যাদির জন্য একজন আরেকজনের পা জড়িয়ে ধরতে পারে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে একমাত্র অলৌকিক ও অপার্থিব ভক্তি ও বিনয়ের অর্ঘ্য ছাড়া কেউ কারো জন্য সাজদা করে না।

আল্লামা ইবনু আবেদীন বলেন:

والسجود أصل لانه شرع عبادة بلا قيام كسجدة التلاوة، والقيام لم يشرع عبادة وحده، حتى لو سجد لغير الله تعالى يكفر بخلاف القيام.

‘‘সাজদাই হলো মূল; কারণ সাজদা কেবলমাত্র ইবাদত হিসেবেই শরীয়তে নির্ধারিত, কিয়াম বা দন্ডায়মান হওয়া তদ্রূপ নয়, দাঁড়ানো কেবলমাত্র ইবাদত হিসেবে শরীয়তে নির্ধারিত নয়। এজন্য যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সাজদা করে তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে, দাঁড়ানোর বিষয়টি তদ্রূপ নয়।’’[1]

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা যাইলায়ী বলেন: ‘‘ইমাম মুহাম্মাদের ‘যিয়াদাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সালাতের মধ্যে সাজদাই মুল, কিয়াম বা দাঁড়ানো হলো দাঁড়ানো থেকে সাজদায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ... এর কারণ সাজদাই হলো মাটির উপর কপাল রেখে আল্লাহর জন্য চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় প্রকাশ করা। এজন্য যদি কেউ মাটিতে কপাল রেখে আল্লাহ ছাড়া কারো সাজদা করে তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য দাঁড়ালে বা রুকু করলে কাফির বলে গণ্য হবে না।’’[2]

হানাফী ফিক্হের অন্যতম ইমাম আল্লামা সারাখসী তাঁর মাবসূত গ্রন্থে বলেন: ‘‘...এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে তাযীম বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য সাজদা করা কুফ্রী।’’[3]

মুসলিম উম্মাহর অনেক আলিম সাজদাকে দুভাগে ভাগ করেছেন: (১) সুজূদু তাহিয়্যাহ (سجود تحية) বা সালামের সাজদা এবং (২) সুজূদু ইবাদাত (سجود عبادة) বা ইবাদতের সাজদা। তাঁরা বলেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের সাজদা করা সরাসরি শির্ক। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সালাম-জ্ঞাপক সাজদা করা হারাম ও কঠিন গোনাহের কাজ, তবে তা সরাসরি শির্ক বলে গণ্য হবে না। যদি কেউ এরূপ হারাম কাজকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে তবে তা কুফর বলে গণ্য হবে।

কুরআন থেকে জানা যায় যে, ফিরিশতাগণ আদমকে সাজদা করেন এবং ইউসুফ (আঃ)-এর পিতামাতা ও ভ্রাতৃগণ তাঁকে সাজদা করেন। তাদের এ সাজদা কিরূপ ছিল তা নিয়ে মুফাস্সিরগণের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তারা মাটিতে মাথা রেখে পরিপূর্ণ সাজদা করেন এবং কেউ বলেছেন যে, তারা রুকুর মত মাথা ঝুকিয়ে সালাম করেন, আর রুকু করাকেও কুরআন কারীমে সাজদা বলা হয়েছে।[4] সর্বাবস্থায় এরূপ সালাম জ্ঞাপক সাজদা বা ‘প্রণাম’ করা পূর্ববর্তী শরীয়তে বৈধ ছিল, তবে ইসলামে তা হারাম করা হয়েছে, যেমন ভাইবোনে বিবাহ, দুবোনকে একত্রে বিবাহ, মদপান ইত্যাদি বিষয় পূর্ববর্তী কোনো কোনো শরীয়তে বৈধ ছিল কিন্তু ইসলামী শরীয়তে হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সম্মান জ্ঞাপক বা সালাম জ্ঞাপক সাজদা করার নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক হাদীসগুলি মুতাওয়াতির পর্যায়ের। আবূ হুরাইরা, মু‘আয ইবনু জাবাল, সুহাইব, যাইদ ইবনু আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, সুরাকা ইবনু মালিক, আয়েশা, ইসমাহ, আনাস ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী আওফা, কাইস ইবনু সা’দ () প্রমুখ সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[5] এক হাদীসে আয়েশা (রাঃ) বলেন,

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ (ﷺ) كَانَ فِي نَفَرٍ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنْصَارِ فَجَاءَ بَعِيرٌ فَسَجَدَ لَهُ فَقَالَ أَصْحَابُهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَسْجُدُ لَكَ الْبَهَائِمُ وَالشَّجَرُ فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَسْجُدَ لَكَ فَقَالَ اعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَأَكْرِمُوا أَخَاكُمْ وَلَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا, وفي حديث آخر: لاَ يَنْبَغِيْ لأَحَدٍ أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ ... وفي حديث آخر: لاَ يَصْلُحُ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ وَلَوْ صَلَحَ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর কতিপয় মুহাজির ও আনসার সাহাবীর সাথে অবস্থান করছিলেন। এমতাবস্থায় একটি উট এসে তাঁকে সাজদা করে। তখন সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ সকল অবলা জীব-জানোয়ার ও বৃক্ষলতা আপনাকে সাজদা করে, কাজেই আমাদেরই অধিকার বেশি যে আমরা আপনাকে সাজদা করব। তখন তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর এবং তোমাদের ভ্রাতাকে সম্মান কর। আমি যদি কাউকে অন্যের সাজদা করতে বলতাম তবে স্ত্রীকে বলতাম তার স্বামীকে সাজদা করতে। অন্য হাদীসের বর্ণনায় তিনি বলেন: ‘‘কারো জন্য বৈধ নয় অন্যকে সাজদা করা’’, অন্য হাদীসে: কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয় অন্য মানুষকে সাজদা করা; যদি কোনো মানুষের জন্য অন্য মানুষকে সাজদা করা বৈধ হতো, তবে আমি স্ত্রীকে আদেশ করতাম তার স্বামীকে সাজদা করতে।[6]

অন্য হাদীসে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন:

إِنَّهُ أَتَى الشَّامَ فَرَأَى النَّصَارَى يَسْجُدُونَ لأَحْبَارِهِمْ وَعُلَمَائِهِمْ وَفُقَهَائِهِمْ فَقَالَ لأَيِّ شَيْءٍ تَفْعَلُوْنَ هذا قَالُوا هذِه تَحِيَّةُ الأَنْبِيَاءِِ. قُلْنَا فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَصْنَعَ بِنَبِيِّنَا (ﷺ) فَلَمَّا قَدِمَ عَلَى النَّبِيِّ (ﷺ) سَجَدَ فَقَالَ: مَا هذا يَا مُعَاذُ؟ قَالَ: إِنِّي أَتَيْتُ الشَّامَ فَرَأَيْتُ النَّصَارَى يَسْجُدُونَ لأَسَاقِفَتِهِمْ وَقِسِّيْسِهِمْ وَرُهْبَانِهِمْ وَبَطَارِقَتِهِمْ وَرَأَيْتُ الْيَهُوْدَ يَسْجُدُونَ لأَحْبَارِهِمْ وَفُقَهَائِهِمْ وَعُلَمَائِهِمْ فَقُلْتُ لأَيِّ شَيْءٍ تَصْنَعُونَ هذا وَتَفْعَلُوْنَ هذا قَالُوا هذه تَحِيَّةُ الأنْبِيَاءِ قُلْتُ فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَصْنَعَ بِنَبِيِّنَا فَقَالَ نَبِيُّ اللهِ (ﷺ): إنهم كَذَبُوا عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ كَمَا حَرَّفُوا كِتَابَهُمْ، (في روياة ابن ماحه: لاَ تَفْعَلُوا) لَوْ أَمَرْتُ أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا

‘‘তিনি সিরিয়া গমন করেন। তথায় তিনি দেখেন যে, খৃস্টানগণ তাদের নেককার বুজুর্গগণ ও আলিমদেরকে সাজদা করে। তিনি বলেন, তোমরা কেন এরূপ কর? তারা উত্তরে বলে: এ হলো নবীগণের তাহিয্যাহ বা সালাম। আমরা বললাম: আমাদের নবীকে এরূপ করার অধিকার আমাদের বেশি। তিনি যখন নবী (ﷺ)-এর নিকট প্রত্যাগমন করলেন তখন তিনি তাঁকে সাজদা করলেন। তিনি বলেন: হে মু‘আয, এ কি? তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গমন করে দেখলাম যে, খৃস্টানগণ তাদের পাদরি, দরবেশ ও বিশপদের সাজদা করে এবং ইহূদীগণ তাদের আলিম ও বুজুর্গ ও ফকীহদের সাজদা করে। আমি বললাম, তোমরা এ কি কর? তারা বলে বলে, এ হলো নবীগণের সালাম। আমি বললাম: আমাদের নবীকে এরূপ করার অধিকার তো আমাদের বেশি। তখন নবীউল্লাহ (ﷺ) বলেন, ওরা ওদের নবীগণের নামে মিথ্যা বলেছে, যেমন ওরা নবীগণের কিতাব বিকৃত করেছে। তোমরা এরূপ করো না। আমি যদি কোনো মানুষকে অন্য মানুষের সাজদা করার নির্দেশ দিতাম তবে আমি স্ত্রীকে তার স্বামীর সাজদা করতে নির্দেশ দিতাম।’’[7]

অন্য হাদীসে কাইস ইবনু সা’দ (রাঃ) বলেন:

أَتَيْتُ الْحِيْرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ فَقُلْتُ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) أَحَقُّ أَنْ يُسْجَدَ لَهُ فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللهِ (ﷺ) فَقُلْتُ أِنِّي أَتَيْتُ الْحِيْرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ، فَأَنْتَ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) أَحَقُّ أَنْ يُسْجَدَ لَكَ قَالَ أَرَأَيْتَ لَوْ مَرَرْتَ بِقَبْرِيْ أَكُنْتَ تَسْجُدَ لَهُ قُلْتُ لاَ قَالَ فَلاَ تَفْعَلُوا لَوْ كُنْتُ آمِراً أَحَداً أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْواجِهِنَّ

‘‘আমি (পারস্যের সীমান্তবর্তী) হীরা নামক স্থানে গমন করি। আমি দেখলাম যে, তারা তাদের একজন নেতাকে সাজদা করছে। তখন আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার বেশি যে তাঁর জন্য সাজদা করা হবে। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বলি, ‘আমি হীরা গমন করে দেখলাম যে, তারা তাদের একজন নেতাকে সাজদা করছে। আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনারই অধিকার বেশি যে আপনার জন্য সাজদা করা হবে। তিনি বলেন, তুমি বলতো, তুমি যদি আমার কবরের নিকট গমন কর, তখন কি তুমি কবরকে সাজদা করবে? আমি বললাম: না। তিনি বলেন, তোমরা এরূপ করবে না, আমি যদি কোনো মানুষকে অন্য মানুষের সাজদা করতে অনুমতি দিতাম তবে স্ত্রীগণকে অনুমতি দিতাম তাদের স্বামিগণকে সাজদা করতে।’’[8]

উপরের হাদীসগুলি আলোচনা করে আল্লামা কুরতুবী বলেন:

وهذا السجود المنهي عنه قد أتخذه جهال المتصوفة عادة في سماعهم وعند دخولهم على مشايخهم وأستغفارهم فيرى الواحد منهم إذا أخذه الحال بزعمه يسجد للأقدام لجهله سواء أكان للقبلة أم غيرها جهالة منه ضل سعيهم وخاب أملهم

‘‘এ সকল হাদীসে যে সাজদা নিষেধ করা হয়েছে সে সাজদা জাহিল সূফীগণ তাদের রীতিতে পরিণত করেছে তাদের সামার মাজলিসে এবং তাদেরর পীর-মাশাইখের নিকট প্রবেশের সময়ে এবং তাদের দু‘আ-ইসতিগফারের সময়ে। তাদেরকে আপনি দেখবেন যে, তাদের দাবিমত যখন তাদের কারো হাল এসে যায় তখন পায়ের কাছে সাজদায় পড়ে যায় কিবলামুখি অথবা অন্যমুখি হয়ে। তাদের মুর্খতার কারণেই তা তারা করে। তাদের কর্ম বিভ্রান্ত হয়েছে এবং তাদের আশা বিনষ্ট হয়েছে।’’[9]

ইবাদতের বা ‘তাযীমের’ সাজদা ও তাহিয়্যাহ বা সালাম-সম্ভাষণমূলক সাজদার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তাহিয়্যা বা সালামের সাজদা জাগতিক, লৌকিক ও মানবীয় সাধারণ কর্মের অন্তর্ভুক্ত। তা চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তি নয়, বর সাধারণ ও লৌকিক ভক্তি। অলৌকিক ভয়, ভালবাসা বা ভক্তির কারণে মানুষ তা করে না, বরং লৌকিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে তা করে। এর প্রচলন যে সমাজে রয়েছে সে সমাজের বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, সকল মানুষই তার পিতা, মাতা, শিক্ষক, সমাজপতি বা রাজাকে এভাবে সম্মান প্রদর্শন করে। যেমন অন্য সমাজে দাঁড়িয়ে, মাথা ঝুকিয়ে বা স্যালুট দিয়ে এরূপ শিষ্টাচার প্রদর্শন করা হয়। এরূপ সাজদা পূর্ববর্তী কোনো কোনো শরীয়তে বৈধ ছিল এবং ইসলামে তা সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ ও হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে ইবাদতের সাজদা হলো চূড়ান্ত ও অলৌকিক ভক্তি। মানুষ যাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তার কাছে নিজের চূড়ান্ত সমর্পন, অসহায়ত্ব ও অলৌকিক ভক্তি প্রদর্শনের জন্য এরূপ সাজদা করে। পিতা, মাতা, সমাজপতি, রাজা বা সাধারণ মানবীয় ক্ষমতা বা মর্যাদার অধিকারীকে কেউ এরূপ সাজদা করে না, বরং স্রষ্টা, স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিত কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা সম্পর্কযুক্ত দ্রব্য, ব্যক্তি বা ব্যক্তির স্মৃতিবিজড়িত স্থানেই সে এরূপ সাজদা করে। সকল শরীয়তেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে এরূপ সাজদা করা সরাসরি শির্ক ও কুফর।

আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু হুসাইন ইবনু আলী আত-তূরী আল-কাদেরী আল-হানাফী (মৃ. ১১৩৮ হি) ‘তাকমিলাতুল বাহরির রায়িক’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘রাজা-বাদশার সামনে যে সাজদা করা হয় তা হারাম। যে করে এবং যে এরূপ কর্মে রাযি থাকে উভয়েই পাপী। কারণ এ কর্ম মুর্তিপূজকদের অনুকরণ। সাদর শহীদ উল্লেখ করেছেন যে, এরূপ সাজদার কারণে কাফির বলে গণ্য হবে না, কারণ সে শুধু সালাম বা সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এরূপ করেছে। শামসুল আয়িম্মা সারাখসী বলেন: তাযীম বা সম্মানপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ ছাড়া কারো সাজদা করা কুফ্রী।’’[10]

আল্লামা শামী তাঁর ‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার গ্রন্থে বলেন:

تَقْبِيلِ الأَرْضِ بَيْنَ يَدَيْ الْعُلَمَاءِ وَالْعُظَمَاءِ فَحَرَامٌ وَالْفَاعِلُ وَالرَّاضِي بِهِ آثِمَانِ لأَنَّهُ يُشْبِهُ عِبَادَةَ الْوَثَنِ وَهَلْ يَكْفُرَانِ: عَلَى وَجْهِ الْعِبَادَةِ وَالتَّعْظِيمِ كُفْرٌ وَإِنْ عَلَى وَجْهِ التَّحِيَّةِ لا وَصَارَ آثِمًا مُرْتَكِبًا لِلْكَبِيرَةِ

‘‘আলিম ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে ভূমি-চুম্বন বা জমিন-বুসী করা হারাম। যে ব্যক্তি তা করে এবং যে তাতে রাজি থাকে উভয়েই পাপী; কারণ তা মূর্তিপূজার অনুকরণ। এখন প্রশ্ন হলো: এরূপ ভূমি-চুম্বন-কারী এবং তাতে সন্তুষ্ট ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে কিনা? যদি ইবাদত ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য তা করে তবে তা কুফর বলে গণ্য। আর যদি সালাম বা সম্ভাষণ প্রদানের জন্য করে তাবে কুফর হবে না, তবে এরূপ ব্যক্তি কবীরা গোনাহে লিপ্ত বলে গণ্য হবে।’’[11]

লক্ষণীয় যে, পিতা, মাতা, সমাজপতি, রাজা ও অন্যান্য জাগতিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে তাহিয়্যার সাজদা বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য সালাম জ্ঞাপক সাজদার কল্পনা করা গেলেও নবী, ওলী বা অলৌকিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত কারো ক্ষেত্রে বা কারো কবর-মাযারের ক্ষেত্রে তাহিয়্যার সাজদা কল্পনা করা যায় না। কারণ মানুষ যখন তার মাতা, পিতা, শিক্ষক বা রাজাকে সাজদা করে তখন সে কোনো অলৌকিক বা অপার্থিব ভয় বা ভক্তি নিয়ে তা করে না, বরং একান্তই জাগতিক ভয়, ভক্তি বা শিষ্টাচার হিসেবে তা করে। পক্ষান্তরে অলৌকিক ব্যক্তিত্বদেরকে কখনোই কেউ লৌকিক শিষ্টাচার হিসেবে সাজদা করে না, বরং অলৌকিক ও চূড়ান্ত ভক্তি হিসেবেই সাজদা করে। এজন্য চাঁদ, সূর্য, কবর, স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিচিহ্ন, প্রতিকৃতি, মূর্তি, পূজনীয় ব্যক্তি বা দ্রব্যকে সাজদা করলে তা ব্যাখ্যতীতভাবে শিরক বলে গণ্য হবে।

আরো লক্ষণীয় যে, তাহিয়্যাহ বা শিষ্টাচারের সাজদার অস্তিত্ব মূলত ইসলামের আগমনের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মুসলিম সমাজে ইবাদত হিসেবে আল্লাহকে সাজদা করা ছাড়া অন্য কোনোরূপ সাজদার প্রচলন থাকে না। অনুরূপভাবে অন্যান্য ধর্মে ও সমাজেও মূলত অলৌকিক ব্যক্তিত্ব, মূর্তি, বস্ত্ত ইত্যাদিরই সাজদা করা হয়ে থাকে। এজন্যই মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ আলিম উভয় প্রকারের সাজদার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য না করেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা সরাসরি কুফর বা শিরক বলে গণ্য করেছেন। আর যারা পার্থক্য করেছেন তাঁরা একমত যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে তাহিয়্যার সাজদা করা হারাম এবং এরূপ হারাম কর্মকে বৈধ বলে মনে করা কুফর।

[1] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৪৮০, ৬/৪২৬।
[2] যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক ২/৩২৫।
[3] সারাখসী, আল-মাবসূত ২৭/৪২২; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকাইক ১৬/৪০০।
[4] সূরা (২) বাকারা ৫৮; সূরা (৪) নিসা: ১৫৪; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৬১ আয়াত।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৪৬৫; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৯৫; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৯/৪৭০, ৪৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/২০৬, ৪/১৮৯-১৯০; যিয়া আল-মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৫/২৬৬, ৬/১৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩০৬-৩১১, ৯/৪-৯।
[6] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩১০; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৯/৪৭০-৪৭৯; মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৫/২৬৬। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[7] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৯০; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৯৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩০৯-৩১০। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[8] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/২০৪। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[9] কুরতুবী, জামি লি আহকামিল কুরআন ১/২৯৪।
[10] মুহাম্মাদ ইবনু হুসাইন তূরী, তাকমিলাতুল বাহরির রায়িক ৮/৩৬৪।
[11] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ৬/৩৮৩।