আমরা দেখেছি যে, ইহূদী, খৃস্টান এবং মুশরিকগণ ফিরিশতাগণ, নবীগণ, জিন্নগণ ও প্রকৃত বা কাল্পনিক ওলীগণের ইবাদত করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এ সকল বান্দাকে মহান আল্লাহ কিছু ‘ক্ষমতা’ প্রদান করেছেন। এদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হয়। এদের সুপারিশ আল্লাহ শুনেন। এরূপ রুবূবিয়্যাতের শিরকের ভিত্তিতে তারা ইবাদতের শিরক করত। তারা সাধারণ বিপদ আপদ ও প্রয়োজনে এদেরকে ডাকত, এদের কাছে সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনা করত, এদের নামে মানত, নযর, উৎসর্গ, কুরবানী ইত্যাদি করত, এদের মুর্তি বা স্মৃতিবিজড়িত স্থানে সাজদা করত, এদের উপর তাওয়াক্কুল করত, ভয়, ভালবাসা, আনুগত্য ইত্যাদি বিষয়ে তারা শিরক করত।

ইহূদী ষড়যন্ত্রকারী এবং তাদের অনুসারী এ সকল বিভ্রান্ত শীয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা অবিকল একই যুক্তিতে এবং একই প্রকারের শিরক মুসলিম সমাজে প্রচলন করে। তবে স্বভাবতই তারা তাদের অনুসারীদের বুঝান যে, এ সকল বিষয় কখনোই শিরক নয়। বরং এগুলি নবী, নবী বংশের মানুষদের ও ওলীদের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন মাত্র। আর যারা এভাবে নবী-পরিবার, ইমামগণ বা ওলীগণের বিষয়ে ‘শুভধারণা’ পোষণ করে না, তাদের ডাকে না বা তাদের মাধ্যমে ছাড়া সরাসরি আল্লাহকে ডাকে তারা বেয়াদব ও নবী-বংশের অবমাননাকারী।

ক্রমান্বয়ে সাধারণ মুসলিম সমাজেও এদের যুক্তিগুলি প্রচার ও প্রসার লাভ করতে থাকে। সাধারণত শিরকের দ্বারা যারা জাগতিক ভাবে লাভবান হন সে সকল মানুষেরা এবং অনেক সরলপ্রাণ নেককার মানুষ ও আলিম বিভিন্ন বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এ সকল শিরককে বৈধতা প্রদান করতে থাকেন। তাদের অনেকেই দাবি করেন যে, মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাতকে প্রশংসা করেছেন এবং সর্বোত্তম উম্মাত বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এ উম্মাত কিয়ামত পর্যন্ত হক্কের উপর থাকবে। এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, এ উম্মাতের মধ্যে শিরক-কুফর প্রবেশ করবে না। তৃতীয় অধ্যায়ে একটি হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘আমাকে পৃথিবীর ভান্ডারসমূহের চাবিগুলি অথবা তিনি বলেন, আমাকে পৃথিবীর চাবিগুলি প্রদান করা হয়েছে এবং আল্লাহর কসম, আমি এ ভয় পাই না যে, আমার পরে তোমরা শিরক করবে, বরং ভয় পাই যে, তোমরা পৃথিবীর ভান্ডারসমূহ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।’’

অন্য হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ أَنْ يَعْبُدَهُ الْمُصَلُّونَ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِي التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ

‘‘শয়তান নিরাশ হয়েছে যে, আরব উপদ্বীপে মুসাল্লীগণ তার ইবাদত করবে। তবে তাদের মধ্যে শত্রুতা ও হানাহানি থাকবে।’’[1]

তারা দাবি করেন যে, এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শিরক প্রবেশ করবে না। বস্ত্তত এসকল সাধারণ ফযীলত জ্ঞাপক আয়াত বা হাদীসের অর্থ সাধারণভাবে উম্মাতের মর্যাদা প্রকাশ করা। উম্মাতের মধ্যে কোনো কাফির, মুশরিক বা মুনাফিক থাকবে না, কেউ কুফরী, শিরক বা নিফাকে লিপ্ত হবে না এরূপ কথা এ সকল হাদীস থেকে প্রমাণ করা একান্তই বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। অন্যান্য অগণিত হাদীসে বিভ্রান্তির কথা জানানো হয়েছে। এছাড়া ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয় যে, ভন্ড নবীগণ, মুরতাদগণ ও বিভিন্ন বিভ্রান্ত সম্প্রদায় আরব উপদ্বীপে ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সুস্পষ্টভাবেই শয়তানের ইবাদত করেছে এবং শিরক-কুফরে লিপ্ত হয়েছে।

শিরকী কর্মগুলির পক্ষে তাদের কেউ বলতে থাকেন যে, আল্লাহকে যতক্ষণ রাববুল আলামীন বা একমাত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করছে ততক্ষণ তাকে মুশরিক বলা যায় না। কেউ বলেন, নবী-বংশের ইমামগণ বা ওলীগণকে তো এরা স্রষ্টা বা প্রতিপালক বলে বিশ্বাস করে না, এরা স্বয়ং কোনো ক্ষমতা রাখেন তাও বলে না। বরং তারা বিশ্বাস করে যে, মহান আল্লাহর ক্ষমতাতেই তারা ক্ষমতাবান এবং আল্লাহই তাদের এরূপ ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই এ বিশ্বাস শিরক নয়। আমরা দেখেছি যে, এগুলি যদি শিরক না হয় তবে ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের মুশরিকদেরকেও মুশরিক বলা যায় না। তারা সুস্পষ্টভাবেই মহান আল্লাহকে একমাত্র প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করত এবং শরীকগণকে আল্লাহই ক্ষমতা দিয়েছেন বলে দাবি করত। কিন্তু কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং প্রচলিত বিভিন্ন মতামতের প্রাধান্যের কারণে অনেকেই এরূপ মত প্রকাশ করেছেন।

অনেকে বলেছেন যে, এরা যখন ইমামগণ বা ওলীগণকে ডাকে বা তাদের কাছে গাইবী সাহায্য চায় তখন মূলত আল্লাহর কাছেই চায়, এ সকল নেক মানুষের নাম নিয়ে মূলত এদের ওসীলা দিয়ে তারা আল্লাহর কাছে চায়। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া আর কারো কাছে চাওয়ার মধ্যে আসমান ও জমিনের পার্থক্য। কেউ যদি বলে, হে আল্লাহ, আলী (রাঃ) বা অমুকের ওসীলায় আপনি আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিন, তবে সে মূলত আল্লাহর নিকটেই চাচ্ছে, ওসীলা পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব। আর যে বলছে, হে আলী, হে আবুল খামীস, হে আববাস, হে অমুক আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, সে মূলত তার আহবানকৃত ব্যক্তিকে গাইবী জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করছে তার ইবাদত করছে।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১৬৬।