যুগে যুগে শীয়াগণের মধ্যে, বিশেষত মূলধারার দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়াগণের মধ্যে অনেক আলিমের আবির্ভাব ঘটেছে যারা কুরআন কারীমের উপর নির্ভর করে শীয়াদের বিভিন্ন বিভ্রান্তি সংশোধন করতে চেয়েছেন। কিন্তু স্বভাবতই সাধারণ মানুষদের অতিভক্তি, অজ্ঞতা, পেটপূজারী আলিমদের বিরোধিতা ইত্যাদি কারণে তাদের চেষ্টা সফল হয় নি। আধুনিক যুগের এমন একজন সুপ্রসিদ্ধ শীয়া আলিম ইমাম ড. মূসা আল-মূসাবী। তিনি তার লেখা ‘আশ-শীয়াতু ওয়াত তাসহীহ’ অর্থাৎ ‘শীয়াগণ ও সংস্কার’ নামক গ্রন্থে শীয়াদের মধ্যে প্রচলিত অতিভক্তি ও শিরক সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছেন। ‘আল-গুলূ’ বা অতিভক্তি শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি বলেন:

অতিভক্তি বা সীমালঙ্ঘন শুরু হয় বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় কর্মের মধ্য দিয়ে। বিশ্বাসের সীমালঙ্ঘন হলো একজন মানুষ অন্য কোনো মানুষের বিষয়ে ধারণা করবে যে, সাধারণ মানুষ যা পারে না এমন কারামত, মুজিযা বা অলৌকিক কাজ সে করতে সক্ষম। যেমন জীবিত বা মৃত কোনো মানুষের বিষয়ে বিশ্বাস করা যে, তিনি অন্য কোনো মানুষের জীবনে দুনিয়াতে বা আখিরাতে মঙ্গল বা অমঙ্গল এনে দিতে পারেন অথবা ভাল বা মন্দ কোনো প্রভাব রাখতে পারেন।

বিশ্বাসের সীমালঙ্ঘনের মূল সূত্র আমাদের শীয়া মতাবলম্বীদের হাদীসের গ্রন্থাবলি এবং জীবনী ও গল্পমূলক গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখ কৃত গল্প-কাহিনীসমূহ। এ সকল গল্পে আমাদের ইমামগণ, আওলিয়ায়ে কেরাম ও পীর-মাশাইখের নামে অদ্ভুৎ অদ্ভুত অলৌকিক কর্ম সম্পাদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলিই কর্মের সীমালঙ্ঘনের প্রবণতা তৈরি করেছে। সাধারণ মানুষেরা ইমামগণ, ওলীগণ ও পীর-মাশাইখের কবর-মাযারে যেয়ে তাদের সামনে নিজেদের দাসত্ব, অসহায়ত্ব ও ভক্তি প্রকাশ করে এবং তাদের নামে নযর-মানত পেশ করে, সরাসরি তাদের নিকট হাজত মেটানোর আবদার পেশ করে এবং আরো অগণিত এ জাতীয় কর্ম করে। এ সকল কর্মের কারণ ও উৎস এ সকল গল্প-কাহিনী।

অতিভক্তি বা সীমালঙ্ঘনের মানবীয় প্রবণতা অমুসলিমদের মধ্যেও রয়েছে। শীয়া ছাড়া অন্যান্য মুসলিম ফিরকা ও জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তাদের ইমাম ও ওলীগণের ক্ষেত্রে এরূপ অতিভক্তি ও সীমালঙ্ঘন বিদ্যমান। ... তবে এ ক্ষেত্রে শীয়াগণই অগ্রগামী এবং তারাই এ সব কিছুর সূচনা করেছে। এর কারণ হলো আমাদের পুস্তকগুলিতে যাচাই বাছাই না করে সব গল্প-কাহিনী সংকলন করা হয়েছে এবং আমাদের আলিম ও ফকীহগণ এগুলির বিষয়ে কোনো সমালোচনা বা যাচাই বাছাই মূলক কথা বলেন না। ... এ সকল গল্প-কাহিনী বিশুদ্ধ না বানোয়াট সে বিতর্কে না যেয়েও সুনিশ্চিত বলা যায় যে, এগুলি সবই বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।....

ইমামগণ ও ওলীগণের নামে যে সকল উদ্ভট কাহিনী বানানো হয়েছে সেগুলি শুনে সন্তানহারা মায়েরও হাসি পায়। ইমাম ও ওলীদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য এগুলি বানানো হলেও এগুলি মূলত তাদের মর্যাদ হ্রাস করে।...

আমাদের আলিমগণ ইমামদের ইসমাত বা নিষ্পাপত্ব ও নির্ভুলত্ব দাবি করেন। তাঁরা তাঁদের ইলম লাদুন্নী দাবি করে। আমি বুঝি না এগুলির মাধ্যমে কিভাবে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়? একজন মানুষ কোনো পাপ করার বা ভুল করার ক্ষমতাই রাখে না। অথবা বিনা কষ্টে ইলম লাদুন্নী লাভে কিভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়? মানুষের মর্যাদ তো বাড়ে নিজের চেষ্টায় পাপ থেকে বেঁচে থাকা এবং নিজের চেষ্টায় ইলম অর্জন করায়। উপরন্তু তাঁরা দাবি করেন যে ইমামগণ সকল গাইবী বিষয় জানেন। যে কুরআন মুমিনদের জন্য নূর ও জ্যোতিরূপে নাযিল হয়েছে সে কুরআনে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি গাইব জানতেন না। তাহলে আমাদের মনগুলি কিভাবে সায় দেয় যে, আমাদের ইমামদের জন্য এমন বিশেষণ দাবি করব যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিশেষণের চেয়েও বড়?

ইমাম ড. মুসাবী বলেন: শীয়াদের মধ্যে ইমামগণ ও ওলীগণের বিষয়ে যে অতিভক্তি ও সীমালঙ্ঘন বিদ্যমান তার অন্যতম দিগগুলি নিম্নরূপ:

(১) তাঁদের ইসমাত (عصمة) বা নিষ্পাপত্ব ও নির্ভুলত্ব দাবি করা

(২) তাদের ইলম লাদুন্নী দাবি করা

(৩) তাদের ইলহাম-ইলকা দাবি করা

(৪) তাদের মুজিযা ও কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা দাবি করা

(৫) তাদের গাইবী ইলম দাবি করা

(৬) মাযারে চুমু খাওয়া এবং প্রয়োজন মেটানোর আব্দার করা

তিনি বলেন, সর্বশেষ বিষয়টি অতিভক্তি ও সীমালঙ্ঘনের ব্যবহারিক ও কর্মগত প্রকাশ। এরা ইমামগণ, ওলীগণ ও পীর-মাশাইখের কবরে যেয়ে তাদের নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের হাজত-প্রয়োজন পেশ করছে এবং তা মেটানোর আব্দার করছে, সরাসরি তাদের নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করছে। এছাড়া এ সকল মাজারে চুমু খাওয়ার বিষয়টিও খুবই ব্যাপক। মাজারে চুমু খাওয়ার বিষয়ে আমাদের ফকীহ ও আলিমগণের সাথে আলোচনা ও তর্ক করতে করতে আমি সত্যই বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। তারা একই কথা বারবার বলে এরূপ কর্মের ওজর পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক হাজার আসওয়াদ বা কাবাগৃহের কাল পাথরে চুমু খাওয়ার সাথে তারা কবর চুমু খাওয়ার তুলনা করেন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাজারে আসওয়াদে চুমু খাওয়া হলো বিশেষ স্থানে ও বিশেষ ইবাদতের সুন্নাত, এটি কোনো সাধারণ অনুমোদন বা কর্ম নয়। এ বিষয়ে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাবের (রাঃ) বক্তব্য প্রণিধান যোগ্য। তিনি হাজারে আসওয়াদের সামনে দাড়িয়ে বলেন: ‘‘ হে পাথর, আমি জানি যে, তুমি পাথর ছাড়া কিছু নও, তুমি কোনো ক্ষতিও করতে পার না এবং উপকারও করতে পার না। শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমাকে চুম্বন করেছেন তাই তোমাকে চুম্বন করছি।’’

এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাউকে তাঁর হস্ত চুম্বন করতে দেন নি। বরং তিনি মুসাফাহা করতেন। এছাড়া আমরা কোথাও পড়িনি যে, ইমাম আলী (রাঃ) কাউকে তাঁর হস্ত বা পরিধেয় চুম্বন করতে দিয়েছেন। একব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিকের লাঠি চুম্বন করে; কারণ লাঠিটি ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর। এতে রাগন্বিত হয়ে ইমাম জাফর সাদিক বলেন: ‘‘... যা তোমার কোনো ক্ষতিও করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না কেন তাকে চুম্বন করছ?’’

ইমাম মুসাবী বলেন: আমি অনেক মুসলিম দেশে আওলিয়ায়ে কেরামের মাযারে গিয়েছি। সেখানে দেখেছি যে, আমাদের দেশের শীয়াগণ ইমামগণের মাযারে যা করে তারাও তথায় একই কর্ম করে। আমি বিশ্বের অনেক দেশে খৃস্টানদের গীর্জায় গিয়েছি। সেখানেও দেখেছি যে তারা একইরূপ কর্ম করে। অবিকল একইভাবে তারা ঈসা মাসীহের (আঃ) প্রতিকৃতি স্পর্শ করে বা মরিয়ম (আঃ)-এর পায়ের কাছে বসে বরকত গ্রহণ করছে। এরা মহান আল্লাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে ঈসা মসীহ ও মরিয়ম (আঃ) এর নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের হাজত পেশ করছে এবং সাহায্য প্রার্থনা করছে। আমি বৌদ্ধদের, শিনটোদের, হিন্দুদের এবং শিখদের মন্দির বা ধর্মালয়ে গিয়েছি। মুসলিম সমাজের মাযারে এবং খৃস্টানদের গীর্জায় যা দেখেছি এ সকল মন্দিরে বা ধর্মালয়েও তাই দেখেছি। এরা সকলেই একই ভাবে মাযার বা প্রতিকৃতির সামনে নযর-মানত বা উৎসর্গ পেশ করছে এবং নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার আব্দার করছে। মাযার-প্রতিকৃতিতে চুম্বন করছে, মাথা ঝুকিয়ে প্রণাম জানাচ্ছে এবং এগুলির সামনে বিনয়, ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে।

এভাবে আমি দেখেছি যে, অলীক কল্পনা ও মিথ্যা ধারণার মধ্যে সাতার কাটছে মানবতা। ...অথচ কুরআন এ বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। একদিকে বারংবার উল্লেখ করেছে যে,  স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও কোনো গাইবী ইলম বা ক্ষমতার মালিক নন, অপরদিকে বারংবার বলা হয়েছে যে, একমাত্র মহান আল্লাহই সব জানেন এবং সব ক্ষমতার মালিক এবং কেবলমাত্র তাঁর কাছেই তোমরা সাহায্য চাও। আল্লাহ বলেছেন:

(১) ‘‘বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতাও আমার নেই। আমি যদি গাইব জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম, আর কোন অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো কেবলমাত্র ভয়পপ্রদর্শনকারী এবং সুসংবাদদাতা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।’’[1]

(২) ‘‘বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে, অদৃশ্য (গায়েব) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই, আর আমি তোমাদেরকে একথাও বলি না য, আমি ফিরিশতা। আমি তো শুধুমাত্র আমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করা হয় তারই অনুসরণ করি।’’[2]

(৩) ‘‘বল: আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য (গাইব) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[3]

(৪) ‘‘আমার বান্দাগণ যখন আমর সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে তখন আমি তার আহবানে সাড়া দিই।’’[4]

(৫) ‘‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।’’[5]

ড. মূসাবী বলেন, এ ঘৃণ্য অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাদের (শীয়া সম্প্রদায়ের) আলিমদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আমাদের পুস্তকগুলিকে যাচাই বাছাই করে অশুদ্ধ ও জাল কাহিনীগুলি বাদ দিয়ে প্রকাশ করতে হবে। তিনি এ বিষয়ক বিভিন্ন মূলনীতি উল্লেখ করেছেন।[6]

[1] সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৮ আয়াত।
[2] সূরা (৬) আনআম: ৫০ আয়াত। আরো দেখুন (সূরা ১১ হূদ: ৩১ আয়াত)
[3] সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।
[4] সূরা (২) বাকারা: ১৮৬ আয়াত।
[5] সূরা (৫০) কাফ: ১৬ আয়াত।
[6] ইমাম ড. মূসা আল-মুসাবী, আশ-শীয়াতু ওয়াত তাসহীহ, পৃ. ১০৯-১২০।