কুরআন কারীমের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তাওহীদ ও শিরক বিষয়ক আলোচনা। হাদীস শরীফেও শিরকের আলোচনা ব্যাপক। স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণও শিরক-কুফর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। শিরকের প্রকৃতি অনুধাবন করার জন্য তারা শিরককে বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন। শিরকের ভয়াবহতা অনুসারে শিরকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) শিরক আকবার অর্থাৎ বৃহত্তর শিরক বা প্রকৃত শিরক এবং (২) শিরক আসগার অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর শিরক। তাওহীদের বৈপরীত্যের ভিত্তিতে শিরককে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবার কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত শিরকী কর্মসমূহের ভিত্তিতে শিরককে অনেকভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। আমরা প্রথমে তাওহীদের বৈপরীত্যের ভিত্তিতে শিরক আকবারের প্রকারভেদ ও শিরক আসগারের পরিচয় ও প্রকারভেদ আলোচনা করব। এরপর শিরক প্রতিরোধে কুরআন-সুন্নাহর পদক্ষেপ আলোচনা প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন প্রকারের শিরক আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

৫. ২. ৩. ১. তাওহীদের বৈপরীত্যে শিরকের প্রকারভেদ

আমরা দেখেছি যে, তাওহীদের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তাওহীদের বিপরীতই শিরক। এজন্য শিরককেও তিনভাগে ভাগ করা হয়:

৫. ২. ৩. ১. ১. প্রতিপালনের শিরক্ (الشرك في الربوبية)

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি বা প্রতিপালনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে শরীক করা। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে সৃষ্টি, সংহার, প্রতিপালন, রিয্ক দান, জীবন দান, মৃত্যু দান, বিশ্ব পরিচালনা, মঙ্গল-অমঙ্গল ইত্যাদি ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা। এখানে উল্লেখ্য যে, মহান আল্লার রুবূবিয়্যাত বা রুবূবিয়্যাতের কোনো বিষয় অস্বীকার করাও এ পর্যায়ের শিরক। কারণ এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী প্রকৃতি বা অন্য কোনো জাগতিক শক্তিকে রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতাসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করে।

৫. ২. ৩. ১. ২. নাম ও গুণাবলির শির্ক (الشرك في الأسماء والصفات)

আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর পূর্ণতার গুণাবলি ও মহাসম্মানিত পবিত্র নামসমূহ রয়েছে। এসকল গুণ বা নামের ক্ষেত্রে কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এ পর্যায়ের শিরক। মহান আল্লাহকে কোনোভাবে মানুষ বা সৃষ্টির সাথে তুলনা করা অথবা মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টিকে কোনোভাবে মহান আল্লাহর সাথে তুলনীয় মনে করা এ পর্যায়ের শিরক।

৫. ২. ৩. ১. ৩. ইবাদতের শিরক (الشرك في الألوهية)

‘ইবাদত’-এর ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা বা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইবাদত করাকে ‘ইবাদতের শির্ক’ বলা হয়। ইবাদতের অর্থ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ প্রগাঢ় ভয় ও আশা-মিশ্রিত চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় ও অসহায়তব প্রকাশ। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি এরূপ অলৌকিক ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশই ইবাদতের শিরক।

৫. ২. ৩. ২. শির্ক আস্গার (الشرك الأصغر)

যে বিশ্বাস, কথা বা কর্ম শিরকের মত হলেও প্রকৃত শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে নি তাকে শিরক আসগার বলা হয়। যেমন আল্লাহর ইবাদত করার ক্ষেত্রে মানুষদের থেকে প্রশংসা, সুনাম বা জাগতিক কোনো কিছু আশা করা, অথবা এমন কথা বলা যাতে বাহ্যত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে তুলনীয় বলে মনে হতে পারে, যদিও বক্তার উদ্দেশ্য তা নয়।

আমরা দেখেছি যে, প্রকৃত শির্ক হলো আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার বা আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকার যুক্তিতে বা অন্য কোনো যুক্তিতে বিশ্ব পরিচালনায় কিছু অধিকার এবং ইবাদত লাভের অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করা, এবং তার নিকট থেকে অলৌকিক সাহায্য, দয়া, বর, আশীর্বাদ বা নেকদৃষ্টি লাভের জন্য বা তার অলৌকিক ক্রোধ, অভিশাপ বা বিরক্তি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য তার নিকট চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তি ও বিনয় প্রকাশ করা। পক্ষান্তরে শির্ক আসগারের ক্ষেত্রে ইবাদতকারী কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ, রুবূবিয়্যাত বা উলূহিয়্যাতের অধিকারী বলে বিশ্বাস করে না, তবে তার কর্ম ও কথা এরূপ বিশ্বাসের কাছাকাছি চলে যায়। যে কোনো শিরক আসগর শিরক আকবরে পরিণত হতে পারে। কারণ মূল বিষয়টি নির্ভর করে উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের উপরে। শিরক আসগারের বিভিন্ন প্রকার আলোচনা করলে উভয় পর্যায়ের শিরকের মধ্যে পার্থক্য আরো সুস্পষ্ট হবে।

শিরক আসগারের প্রকার ও প্রকাশগুলির মধ্যে অন্যতম: