আল্লাহ ছাড়া কাউকে ক্ষমতায় ও সৃষ্টিতে বা সকল দিক থেকে আল্লাহর সমতুল্য মনে করা যেমন শিরক, তেমনি মহান আল্লাহ কাউকে নিজের শরীক বানিয়ে নিয়েছেন, বা কাউকে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, ‘উলূহিয়্যাত’ বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করাও শিরক। তবে সাধারণত কোনো মুশরিকই কাউকে সকল দিক থেকে বা স্বকীয় ভাবে আল্লাহর সমতুল্য বলে শিরক করেনি, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের শিরকই সর্বদা ব্যাপক।

ইতোপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে দেখেছি যে, আরবের মুশরিকগণ কাউকে আল্লহর মত বা আল্লাহর সমতূল্য স্রষ্টা, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান বা স্বকীয় ক্ষমতায় ইলাহ বা মাবূদ হিসেবে আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য বলে মনে করত না। বরং মহান আল্লাহকেই একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান, মহাবিশ্বের একমাত্র সার্বভৌম মালিক, রিয্কদাতা, মৃত্যুদাতা ও সকল কিছুর পরিচালক বলে বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত যে সকলেই আল্লাহর বান্দা। তবে তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর কিছু বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে সাধারণ বান্দাদের চেয়ে উর্ধ্বে উঠেন, যাদেরকে আল্লাহ খুশি হয়ে নিজের কর্মে ও ক্ষমতায় শরীক করেছেন। এদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ও এদের শাফা‘আত দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য তারা এদের ইবাদত করত। এভাবে আমরা দেখি যে, কিছু ‘‘অলৌকিক ক্ষমতায়’’ এবং ‘‘ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতায়’’ তারা আল্লাহর কিছু বান্দাকে আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য বলে বিশ্বাস করত। আর এরূপ করাকেই কুরআন ও হাদীসে ‘আল্লাহর সমকক্ষ বা সমতুল্য নির্ধারণ করা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) বলেন: ‘‘শিরকের হাকীকত এই যে, কোনো মানুষ কোনো কোনো সম্মানিত মানুষের ক্ষেত্রে ধারণা করবে যে, উক্ত ব্যক্তি দ্বারা যে সকল অলৌকিক কার্য সংঘটিত বা প্রকাশিত হয় তা উক্ত ব্যক্তির পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত হওয়ার কারণে। এ সকল অলৌকিক কার্য প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না এরূপ কিছু বিশেষ গুণ উক্ত ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান। এরূপ গুণ মূলত একমাত্র আল্লাহরই আছে। আল্লাহ যাকে ‘উলূহিয়্যত’ বা এরূপ বিশেষত্ব প্রদান করেন, অথবা ‘আল্লাহ’ যে ব্যক্তির সত্তার সাথে সংমিশ্রিত হন, অথবা যে ব্যক্তি আল্লাহর যাত বা সত্তার মধ্যে ‘ফানা’ বা বিলুপ্তি লাভ করে এবং আল্লাহ সত্তার সাথে ‘বাকা’ বা অস্তিত্ব লাভ করেন, বা অনুরূপ কোনো ভাবে যে ব্যক্তিকে আল্লাহ এরূপ ক্ষমতা বা পূর্ণতা প্রদান করেন তিনিই কেবল তা প্রাপ্ত হন। এভাবে মানুষের উলূহিয়্যাত বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা গুণ লাভের পদ্ধতি ও প্রকার সম্পর্কে মুশরিকদের মধ্যে অনেক ভিত্তিহীন কুসংস্কার বিদ্যমান। এ বিষয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, আরবের কাফিরগণ হজ্জের ‘তালবিয়া’র মধ্যে ও কাবাঘর তাওয়াফের সময় বলত:

لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ إِلا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ

লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক.... আপনার কোনো শরীক নেই, তবে আপনি নিজে যাকে আপনার শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন, আপনারই বান্দা, উক্ত শরীক ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন ...।[1]

অন্যত্র তিনি আরবের মুশরিকদের ইবরাহীম (আঃ)-এর দীন থেকে বিচ্যুতি ও শিরকের মধ্যে নিপতিত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তাদের শিরকের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে বলেন: ‘‘এ সকল মুশরিক বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে এবং বিশ্বের বিৃহৎ বিষয়গুলি পরিচালনার ব্যপারে আল্লাহর কোনো শরীক আছে বলে বিশ্বাস করত না। তারা একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহ যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেন বা কোনো বিষয় নির্ধারণ করেন তবে তা পরিবর্তন বা রোধ করার ক্ষমতাও কারোরই নেই। তারা কেবলমাত্র বিশেষ কিছু বিষয়ে কিছু বান্দাকে শরীক করত। কারণ তারা মনে করত যে, একজন মহারাজ তার দাসদেরকে এবং তার নিকটবর্তী প্রিয় মানুষদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোটখাট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসকল ছোটখাট বিষয় নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করার ক্ষমতা তাদেরকে প্রদান করেন। তারা আরো ধারণা করত যে, একজন মহারাজ তার প্রজাগণের খুটিনাটি বিষয় নিজে সম্পন্ন বা পরিচালনা করেন না, বরং অধীনস্থ প্রশাসক ও কর্মকর্তাদেরকে এ সকল বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এ সকল কর্মকর্তার অধীনে যারা কর্ম করেন বা তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন তাদের বিষয়ে এ সকল কর্মকর্তার সুপারিশ তিনি গ্রহণ করেন। সকল রাজার মহারাজা রাজাধিরাজ মহান আল্লাহও অনুরূপভাবে তাঁর কিছু নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাকে উলূহ্যিায়ের উপঢৌকন প্রদান করেছেন এবং এদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টিকে তার অন্যান্য বান্দাদের ক্ষেত্রে প্রভাবময় করে দিয়েছেন।

এ জন্য তারা মনে করত যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বানদার নৈকট্যলাভের চেষ্টা করা জরুরী, যেন তা প্রকৃত মহারাজের নিকট তাদের কবুলিয়্যাতের ওসীলা হতে পারে। আর হিসাব ও প্রতিফলের সময় এদের শাফা‘আত মহান আল্লাহর দরবারে কবুল্যিয়াত ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এ ধারণা তাদের মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রেথিত হয়ে যায়। এজন্য তাদের মন বলে যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সামনে সাজদা কর, তাদের জন্য জবাই-উৎসর্গ কর, তাদের নামে কসম কর, তাদের অলৌকিক ক্ষমতার কারণে তাদের কাছে ত্রান ও সাহায্য প্রার্থনা কর, পাথরে, তামায়, পিতলে বা অন্য কিছুতে তাদের ছবি ও প্রতিকৃতি একে রাখ, এদের এ সকল প্রতিৃকতি সামনে রেখে এদের রূহের (আত্মার) প্রতি মুতাওয়াজ্জাহ হও। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী প্রজন্মগুলির মানুষেরা মুর্খতার কারণে এদের এ সকল মুর্তি ও প্রতিকৃতিকেই প্রকৃত ইলাহ বা মা‘বূদ বলে বিশ্বাস করতে থাকে।’’[2]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩; তাবারী, তাফসীর ১৩/৭৮-৭৯।
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৫।