কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা চতুর্থ অধ্যায়: আরকানুল ঈমান ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, গাইবী বিষয়ে বা বিশ্বাসের বিষয়ে ওহীর শিক্ষাকে আক্ষরিক ও সরল অর্থে বিশ্বাস না করে যুক্তি, তর্ক, ব্যক্তিগত অভিমত, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির আলোকে বিচার, গ্রহণ, সংযোজন ইত্যাদি করা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির মূল কারণ। মক্কার কাফিরগণ তাকদীর বিষয়ে এরূপ কিছু বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত ছিল। মহান আল্লাহ বলেন:

وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ نَحْنُ وَلا آَبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلا الْبَلاغُ الْمُبِينُ

‘‘মুশরিকরা বলে, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা ও আমরা; তিনি ব্যতীত অপর কোন কিছুর ইবাদাত করতাম না এবং তাঁর অনুজ্ঞা ব্যতীত আমরা কোন কিছু নিষেধ করতাম না।’ তাদের পূর্ববর্তীরা এরূপ করত। রাসুলদের কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী প্রচার করা।’’[1]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلا آَبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلا تَخْرُصُونَ قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ

‘‘যারা শিরক করেছে তারা বলবে, ‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তবে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শির্ক করতাম না।’ এ-ভাবে তাদের পূর্ববতীগণও কুফ্রী করেছিল, অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বল, ‘তোমাদের নিকট কোন ‘ইলম’ আছে? থাকলে আমার নিকট তা পেশ কর; তোমরা শুধু ধারণারই অনুসরণ কর এবং শুধু মিথ্যাই বল। বল, ‘চুড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই; তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করতেন।’’[2]

কাফিরদের এ বিকৃতির ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করি। কাফিরগণ বলেছে: ‘‘আল্লাহ চাইলে আমরা এরূপ করতাম না’’। এ কথা দ্বারা তারা বুঝাচ্ছে যে, আমরা যে শিরক করছি তা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হচ্ছে এবং আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট রয়েছেন। কাজেই এ কাজের প্রতিবাদ করা বা একে অন্যায় বলা যায় না।

মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমাদের নিকট ‘ইলম’ থাকলে তা দেখাও।’’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর বিষয়ে যা বলছ তা ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো ইলম বা কিতাবে থাকলে তা দেখাও। তোমরা যা বলছ তা ওহীর জ্ঞান নয়, বরং তা যুক্তি-তর্ক ভিত্তিক ‘ধারণা’ মাত্র। আর প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর নামে মিথ্যা। এরপর আল্লাহ ওহীর জ্ঞানটি জানিয়ে দিলেন, তা হলো: ‘‘তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে সৎ পথে পরিচালিত করতেন।’’

এখানে ওহীর জ্ঞান: ‘‘আল্লাহ চাইলে তোমাদের সকলকে হিদায়েত করতেন।’’ ওহীর অন্যান্য নির্দেশনার আলোকে আল্লাহর এ বাণীর অর্থ: আল্লাহ শিরক অপছন্দ করেন এবং ঈমানকে পছন্দ করেন তা তোমাদেরকে ওহীর জ্ঞান ও বিবেকের নির্দেশনার মাধ্যমে জানিয়েছেন। তবে তোমরা তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও  কর্মশক্তিকে অপব্যবহার করে কুফরী করেছ। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন। তবে তোমাদের অবাধ্যতার কারণে তোমরা সে দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত হয়েছ।

আর কাফিরদের দাবি: ‘‘আল্লাহ চাইলে আমরা পাপ করতাম না।’’ কাফিরদের দাবি ওহীর বিকৃতি ও ওহীকে নিজেদের মর্যি মত ব্যাখ্যার ফল। তারা ওহীর অন্য সকল নির্দেশনা বাদ দিয়ে দু একটি নির্দেশনাকে নিজেদের মর্যি মত ব্যাখ্যা করেছে। তাদের যুক্তি আমরা নিম্নভাবে সাজাতে পারি: আল্লাহ বলেছেন: ‘তিনি চাইলে আমাদেরকে হেদায়াত করতেন।’ এতে বুঝা যায় যে তিনি চাইলে আমরা শিরক করতাম না। এতে বুঝা যায় যে, তিনি চান বলেই আমরা শিরক করি। এতে বুঝা যায় যে, আমাদের কর্মে সন্তুষ্ট।’’ কাফিররা যে দাবি করছে হুবহু সে কথা কোনোভাবে কোনো ওহীর শিক্ষায় নেই। তা ওহীর মনগড়া ব্যাখ্যা, যুক্তি-তর্ক নির্ভর ‘ধারণা’ এবং আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা মাত্র।

এখানে আল্লাহ জানিয়েছেন যে, এ সকল মনগড়া তর্ক বিতর্কের মধ্যে প্রবেশ করা রাসূলের দায়িত্ব নয়। বরং ওহীর হুবহু শিক্ষা তাদেরকে জানিয়ে দেওয়াই তাঁর দায়িত্ব।

[1] সূরা (১৬) নাহল: ৩৫ আয়াত।
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ১৪৮-১৪৯ আয়াত।