এখানে দুটি শব্দ রয়েছে ‘আব্দ’ ও ‘হু’, অর্থাৎ তাঁহার আব্দ বা আল্লাহর আব্দ। আরবী ‘আব্দ’ (عَبْد) শব্দের ফার্সী ভাষায় অর্থ (বান্দা)। সাধারণভাবে বাংলাভাষায় এই ফার্সী শব্দটি প্রচলিত। আবদ বা বান্দার বাংলা অর্থ ‘‘দাস’’, ‘‘ক্রীতদাস’’ বা ‘‘চাকর’’। আরবী ভাষায় সাধারণভাবে (আব্দ)  বলতে সৃষ্টি বা মানুষ বুঝানো হয়, কারণ প্রতিটি মানুষই আল্লাহর দাস বা বান্দা। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় দু‘আর মধ্যে বলতেন:

أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْدُ وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ اللَّهُمَّ لا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ

‘‘আমরা সবাই তো আপনার দাস, আর একজন দাসের সবচেয়ে বড় সত্য ও সঠিক কথা হলো: হে আল্লাহ, আপনি যা দান করেন তা কেউ রোধ করতে পারে না, আর আপনি যা রোধ করেন তা কেউ দিতে পারে না এবং কোনো ক্ষমতাবান বা ধনবানের ক্ষমতা বা ধন আপনার কাছে তার কোনো উপকারে আসে না।’’[1]

আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে শিরকের আলোচনায় দেখব যে, যুগে যুগে মানুষের বিশ্বাসের বিভ্রান্তি ও শির্কে নিপতিত হওয়ার মূল কারণ ছিল, ফিরিশতা, জিন, নবী, নেককার মানুষ, তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান, দ্রব্য গাছ, পাথর বা প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে ইশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক শক্তি কল্পনা করে বা এদের সাথে মহান আল্লাহর বিশেষ সুপারিশ বা লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করে জাগতিক বিপদ, আপদ, সমস্যা, অনাবৃষ্টি, অসুস্থতা, ফসলহীনতা ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য এদের কাছে ধর্না দেওয়া, প্রার্থনা করা এবং এরা যেন তুষ্ট হয়ে ডাকে সাড়া দেয় সে জন্য এদের নামে বা এদের কবর, মূর্তি বা স্মৃতি বিজড়িত স্থানে মানত, ভেট, ফুল, সাজদা ইত্যাদি প্রদান।

নবী-রাসূলগণকে নিয়ে তাঁদের পরবর্তী উম্মতগণ এভাবে শির্কের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। যে নবী রাসূলগণ মানবজাতিকে শির্কের অন্ধকার  থেকে তাওহীদের আলোয় আনতে জীবনপাত করেছেন, তাঁদেরই উম্মতেরা তাঁদের তিরোধানের পরে তাঁদের মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনা করে তাঁদের ইবাদত শুরু করে। তাঁদের মু’জিজা ও অলৌকিক নিদর্শনাবলীকে তারা তাঁদের ঐশ্বরিক শক্তির প্রমাণ হিসাবে পেশ করে আল্লাহর পরিবর্তে তাঁদের কাছেই প্রার্থনা, সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি চাওয়া, তাঁদের খুশি করতে ভেট, মানত ইত্যাদি প্রদান করা শুরু করে।

সৃষ্টির মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনার প্রধান দুটি দিক: প্রথমত, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার বিশেষ সম্পর্ক দাবী করা। তাকে ইশ্বরের পুত্র, কন্যা বা বংশধর বলে দাবী করা। খ্রীষ্টানগণ আল্লাহর মহান রাসূল ঈসা (আঃ)-কে ‘‘আল্লাহর পুত্র’’ রূপে দাবী করে। তারা ‘‘পুত্রত্ব’’ বলতে জাগতিক পিতাপুত্র সম্পর্ক বুঝায় না। তাদের কাছে পুত্রতব অর্থ স্রষ্টা ঈসাকে (আ.) তার নিজের জাত বা সত্তা (Same Substance) থেকে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই তাঁর মধ্যে ইশ্বরত্ব রয়েছে। অগণিত বিভ্রান্তি ও জঘন্য মিথ্যা কথা দিয়ে তারা বাইবেলের তাওহীদমূলক অসংখ্য নির্দেশনা ও উক্তিকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করে এই মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনুরূপভাবে আরবের কাফিরগণ ফিরিশতাগণকে আল্লাহর সন্তান বা কন্যাসন্তান বলে বিশ্বাস করব।

সৃষ্টির মধ্যে ইশ্বরত্ব দাবীর দ্বিতীয় দিক হলো অবতারত্ব (Incarnation) দাবী। অমুকের মধ্যে স্র্ষ্ঠা বা তাঁর বিশেষ কোনো গুণ বা শক্তি মিশে গিয়েছে বা স্রষ্ঠার সাথে তার মিলন হয়েছে বা তিনি তাঁর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন।

এ ধরনের সকল শিরকে মূলোৎপাটন করতে এবং সেগুলির দরজা বন্ধ করতে ইসলামী ঈমানের মধ্যে ‘‘মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূুলূহু’’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তিনি আল্লাহর মনোনিত রাসূল, তাঁর মহত্তম সৃষ্টি ও তাঁর প্রিয়তম। কিন্তু সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর বান্দা, দাস ও মানুষ। তিনি স্রষ্টার অবতার নন, স্রষ্টার সত্তার অংশ নন, স্রষ্টা বা তাঁর কোনো গুণের সাথে মিলে মিশে তিনি একাকার হয়ে যান নি। কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি নন। তাঁর মর্যাদা আল্লাহর পূর্ণতম বান্দা ও উপাসক হওয়ার মধ্যে। তাঁকে পরিপূর্ণ ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদানের সাথে সাথে সকল প্রকার শিরক মূলত বাড়াবাড়ি ও অতিভক্তি থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করার জন্য এই বিশ্বাস রক্ষা কবজ।

পূর্ববর্তী নবীগণও তাঁদের উম্মতকে ‘‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’’ বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের উম্মতের পরবর্তীতে ভক্তিকে আনুগত্যের উপরে স্থান দিয়ে তাদেরকে পুত্র বা অবতার বলে দাবী করেছে। এভাবে তাঁদের শিক্ষা, ধর্ম ও শরীয়ত বিকৃত ও নষ্ট হওয়ার পরে আল্লাহ সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে এভাবে তাওহীদের হেফাযত করেছেন।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৪৭; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ২/৩৩২; আযীম আবাদী, আউনুল মা‘বুদ ৩/৫৯।