আকীদার উৎসের বিচ্যুতির কারণে, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের গভীর অধ্যয়ন পরিত্যাগ করে, আভিধানিক অর্থ, নিজের বুদ্ধি-বিবেক, দর্শন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে তাওহীদের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে অনেক পন্ডিত মনে করেছেন যে, ‘তাওহীদ’ অর্থ মহান আল্লাহকে একমাত্র অনাদি সত্তা বা একামত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান হিসেবে বিশ্বাস করা। তাদের এ চিন্তা কুরআন ও হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনের অগণিত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, আরবের ও অন্যান্য জাতির কাফিরগণ আল্লাহর অস্তিত্বের একত্বে বিশ্বাস করত এবং তাঁকেই একমাত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান প্রতিপালন হিসেবে বিশ্বাস করত। এতটুকুতেই যদি তাওহীদ পরিপূর্ণ হয়, তবে তো আর তাদেরকে কাফির বলার বা তাদের হেদায়াতের জন্য নবী-রাসূলগণের আগমনের প্রয়োজন থাকত না।

কুরআন ও হাদীসের অগণিত বিবরণের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের একাধিক পর্যায় বা স্তর রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ

‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।’’[1]

এ আয়াত থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের পর্যায় রয়েছে, যে কারণে ঈমানের সাথে সাথে শিরক্ একত্রিত হতে পারে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী ইবনু আববাস (রা) বলেন,

من إيمانهم إذا قيل لهم من خلق السماء ومن خلق الأرض ومن خلق الجبال قالوا الله وهم مشركون .... وهم مع ذلك يشركون به ويعبدون غيره  ويسجدون للأنداد دونه

‘‘তাদের ঈমান হলো, যদি তাদের বলা হয়, আকাশ কে সৃষ্টি করেছে? পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে? পাহাড় কে সৃষ্টি করেছে? তারা বলে: আল্লাহ, অথচ তারা শিরক করে ... এরপরও তারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে, আল্লাহকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করে, আল্লাহ ব্যতীরেকে অন্যদের সাজদা করে।’’[2]

প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির মুজাহিদ ইবনু জাবর (১০৪ হি) বলেন:

إيمانهم قولهم الله خالقنا ويرزقنا ويميتنا فهذا إيمان مع شرك عبادتهم غيره

‘‘তাদের ঈমান হলো তারা বলে, (একমাত্র) আল্লাহই আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই আমাদের রিযক দেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যুদেন। এ হলো তাদের ঈমান, এর সাথে তারা তাদের ইবাদতে গাইরুল্লাহর ইবাদত করে শিরক করে।’’[3]

অনুরূপভাবে সাঈদ ইবনু জুবাইর (৯৫হি), আমির ইবনু শারাহীল শা’বী (১০৪ হি), ইকরিমাহ মাওলা ইবনু আববাস (১০৫ হি), আতা ইবনু আবী রাবাহ (১১৫ হি), কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ (১১৭ হি), আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৭০ হি) ও অন্যান্য তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী মুফাস্সির বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, সকল কাফিরই আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো।[4]

এ ভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের অন্তত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং কাফিরগণ একটি বিশ্বাস করতো এবং একটি অস্বীকার করত। কুরআন কারীমের এজাতীয় অগণিত নির্দেশনা ও সাহাবী-তাবিয়গণের এ সকল তাফসীরের আলোকে পরবর্তী যুগের আলিমগণ ‘তাওহীদ’-কে দুভাগে ভাগ করেছেন। কেউ কেউ দুটি পর্যায়কে আরো বিস্তারিতভাবে তিনটি বা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।

হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা সাদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আলাউদ্দীন আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবিল ইয্য দিমাশকী (৭৩১-৭৯২ হি) তাঁর রচিত ‘শরাহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’ পুস্তকে তাওহীদকে প্রথমত দু পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা'রিফাহ (توحيد الإثبات والمعرفة) বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং (২) তাওহীদুত তালাবি ওয়াল কাসদি (توحيد الطلب والقصد) বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।[5] অন্যত্র তিনি উক্ত প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন: (১) তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত, (২) তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত ও (৩) তাওহীদুল ইলাহিয়্যাহ।[6]

প্রসিদ্ধ আলিম ও সংস্কারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেন এবং এভাবে তিনি তাওহীদকে চার পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন:

(১) আল্লাহকে একমাত্র অনাদি অনন্ত সত্তা বলে বিশ্বাস করা

(২) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করা

(৩) আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্বাস করা।

(৪) আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ বা উপাস্য হিসেবে বিশ্বাস করা।[7]

এভাবে আমরা দেখছি যে, তাওহীদের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে এবং প্রথম পর্যায়টির একাধিক পর্যায় রয়েছে। এখানে আমরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে তাওহীদের প্রকারভেদ ব্যাখ্যা করব।

২. ৪. ১. জ্ঞান পর্যায়ের  তাওহীদ

আমরা দেখেছি যে, এ পর্যায়ের তাওহীদকে তাওহীদুল ইসবাত ওয়াল মা’রিফাহ বা জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ বলা হয়। কখনো বা  (التوحيد العلمي الخبري) অর্থাৎ ‘জ্ঞান ও সংবাদের একত্ব’ বলা হয়।[8] জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের দুইটি মূল বিষয় রয়েছে: ১)  সৃষ্টি  ও প্রতিপালনের একত্ব, ও ২) নাম ও গুণাবলীর  একত্ব।

২. ৪. ১. ১. সৃষ্টি  ও প্রতিপালনের  একত্ব

আরবীতে একে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্’ (توحيد الربوبية) ‘‘প্রতিপালনের একত্ব’’ বলা হয়।[9] এর অর্থ বিশ্বের সকল কিছুর সৃষ্টি, প্রতিপালন, সংহার ইত্যাদির বিষয়ে আল্লাহর একত্ব। তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ বা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বে বিশ্বাস করার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহই এ মহাবিশ্বের  একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, সংহারক, রিযিকদাতা, পালনকর্তা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

কুরআন কারীমে বিভিন্ন আয়াতে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ’ বা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’’[10]

তিনি আরো বলেছেন:

أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘জেনে রাখ! সৃষ্টি ও নির্দেশনা (পরিচালনা) একমাত্র  তাঁরই, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ মহিমাময়।’’[11]

তিনি আরো বলেছেনঃ

إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহই  মহাশক্তিময় রিয্ক-দাতা।’’[12]

অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ

وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا

‘‘তিনি সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।’’[13]

এভাবে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের কথা বলা হয়েছে।

[1] সূরা (১২) ইউসূফ: ১০৬ আয়াত।
[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৮।
[3] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৮।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১৩/৭৭-৭৯।
[5] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৮৯।
[6] ইবনু আবিল ইযয, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮।
[7] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৬।
[8] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ১৫।
[9] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ ১৫।
[10] সূরা (১) ফাতিহা: ১ আয়াত।
[11] সূরা (৭) আরাফ: ৫৪ আয়াত।
[12] সূরা (৫১) যারিয়াত: ৫৮ আয়াত।
[13] সূরা (২৫) ফুরকান: ২ আয়াত।