’তাওহীদ’ শব্দটি আরবী ‘ওয়াহাদা (وَحَدَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘এক হওয়া’, ‘একক হওয়া’ বা ‘অতুলনীয় হওয়া’ (to be alone, unique, singular, unmatched, without equal, incomparable)। তাওহীদ অর্থ ‘এক করা’, ‘এক বানানো’, ‘একত্রিত করা’, ‘একত্বের ঘোষণা দেওয়া’ বা ‘একত্বে বিশ্বাস করা’। তাওহীদের ব্যবহারিক অর্থের ব্যাখ্যা প্রদান করে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে অগণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যেগুলি আমরা এ অধ্যায়ে আলোচনা করব। প্রথমেই আমরা পূর্ববর্তী হাদীসে উল্লিখিত তাওহীদের পরিচিতি আলোচনা করব।

আমরা দেখেছি যে, উপরের হাদীসগুলিতে তাওহীদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: (لا إله إلا الله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই।’’ বিভিন্ন বর্ণনায় এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে: (وحده لا شريك له) ‘‘তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই।’’ আমরা প্রথমে এ বাক্যটির বিভিন্ন শব্দের অর্থ বুঝার চেষ্টা করব।

আরবীতে (لا) শব্দের অর্থ হলো নেই, মোটেও নেই  বা একেবারে   নেই। এই বাক্যে শব্দটি (نفي الجنس) বা মোটেও নেই বা একেবারেই নেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

(إله) শব্দের  অর্থ হলো ‘‘মাবুদ’’, অর্থাৎ উপাস্য বা পূজ্য, যার কাছে মনের আকুতি পেশ করা হয়, প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা  করা হয়। ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিধ ও অভিধান-প্রণেতা আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন:

الهمزة واللام والهاء أصل واحد، وهو التعبد. فالإله الله تعالى، وسمي بذلك لأنه معبود

‘‘হামযা, লাম ও হা=ইলাহ: ধাতুটির একটিই মূল অর্থ, তা হলো ইবাদত করা। আল্লাহ ইলাহ কারণ তিনি মাবুদ বা ইবাদতকৃত।’’[1]

আরবী ভাষায় সকল পূজিত ব্যক্তি, বস্ত্ত বা দ্রব্যকেই ‘ইলাহ’ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ‘ইলাহাহ’ (الإلاهة); কারণ কোনো কোনো সম্প্রদায় সূর্যের উপাসনা বা পূজা করত।[2] মহান আল্লাহ বলেন:

وَقَالَ الْمَلأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآَلِهَتَكَ

‘‘ফিরাউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল, আপনি কি মূসাকে এবং তার সম্প্রদায়কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে এবং আপনার উপাস্যদেরকে বর্জন করতে দিবেন?’’[3]

ইবনু আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এখানে ‘আলিহাতাকা (آلِهَتَكَ) স্থলে ‘ইলাহাতাকা’ (إلاهَتَك) পড়তেন। ‘ইলাহাত’ অর্থ ইবাদত, অর্থাৎ আপনি কি তাদেরকে আপনাকে এবং  আপনার ইবাদত করা বর্জন করতে দিবেন?’’[4]

এভাবে আমরা দেখছি যে, (ইলাহাহ্) শব্দটি আরবীতে (ইবাদাহ্) শব্দের সমার্থক[5]। এই ‘ইবাদাত’ বা ‘ইবাদাহ’ (العبادة) শব্দের অর্থ আমরা বাংলায় সাধারণভাবে উপাসনা বা পূজা বলতে পারি। তবে ইসলামের পরিভাষায়  ‘ইবাদাত’ অত্যন্ত ব্যাপক  অর্থবহ এবং এর বিভিন্ন প্রকার ও স্তর রয়েছে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করব। আমরা আমাদের আলোচনায় সাধারণভাবে উপাসনা, পূজা, ইত্যাদি শব্দের পরিবর্তে ‘ইবাদাত’ ব্যবহার করব, যেন আমরা এই ইসলামী গুরুত্বপূর্ন  শব্দটির সকল অর্থ ও ব্যবহার  ভালভাবে বুঝতে পারি।

(إلا) শব্দের অর্থঃ  ব্যতীত, ছাড়া বা ভিন্ন।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, (لا إله إلا الله) বাক্যটির অর্থ: ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই’’। অর্থাৎ যদিও আল্লাহ ছাড়া অন্য অনেক কিছুকেই ইবাদত, উপাসনা, পূজা বা আরাধনা করা হয়, তবে সত্যিকারভাবে ইবাদত করার যোগ্য বা মাবুদ হওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। আল্লাহই সকল প্রকার ইবাদাতের তিনিই একমাত্র  অধিকারী। ইসলামের পরিভাষায় ইবাদাত বলা হয় এমন সব কিছই একমাত্র তাঁর জন্য।

বিভিন্ন হাদীসে এই বাক্যের সাথে যোগ করা হয়েছে: (وحده لا شريك له)। আমরা দেখেছি যে, আরবীতে (وَحَدَ) ক্রিয়াপদটির অর্থ: এক হওয়া বা অতুলনীয় হওয়া।

(لا) শব্দটি মোটেও নেই বা কিছুই নেই অর্থ প্রকাশ করছে।

(شريك) অর্থ অংশীদার বা সহযোগী। শব্দটি আরবী থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছে এবং ‘অংশীদার’ অর্থে ‘শরিক’ এখন বাংলা ভাষায় অতি পরিচিত শব্দ। আরবীতে শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। সাধারণভাবে ‘শির্ক’ শব্দটিকেও আরবীতে ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহার করা হয়।[6]

(له) অর্থ ‘তাঁর’ বা ‘তাঁর জন্য’।

এভাবে দেখছি যে, তাওহীদের ঘোষণা বা সাক্ষ্যের এই অংশের অর্থ: মহান আল্লাহ একক ও অতুলনীয়, তাঁর কোনো অংশীদার বা সহযোগী নেই।

[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসুল্লুগাহ ১/১২৭।
[2] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২১।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ১২৭ আয়াত।
[4] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/৫৪।
[5] ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১৩/৪৬৮-৪৬৯।
[6] আল-ফাইয়ূমী, আল-মিসবাহুল মুনীর, পৃ. ৩১০।