الولاء والبراء - আল ওয়ালা ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব রাখা এবং শত্রুতা পোষণ করার নীতিমালা)

‘‘সংক্ষিপ্তভাবে ইসলামী আকীদার মৌলিক বিষয়গুলো বর্ণনা করার পর একটি আবশ্যিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি। তা হলো ইসলামী আকীদার এসব বিষয়কে দীন হিসাবে গ্রহণকারী প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো, যারা উপরোক্ত বিষয়গুলোকে তাদের আকীদা হিসাবে গ্রহণ করে তাদেরকে বন্ধু বানাবে এবং যারা এগুলোর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে তাদেরকে শত্রু বানাবে। সুতরাং সে তাওহীদ ও ইখলাস ওয়ালাদেরকে ভালোবাসবে এবং তাদেরকে বন্ধু বানাবে। সেই সঙ্গে মুশরিকদেরকে ঘৃণা করবে এবং তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে। এটি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার সাথীদের দীনের অন্তর্ভুক্ত। আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুমতাহানার ৪নং আয়াতে বলেন,

﴿قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ﴾

‘‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীগণের মধ্যে চমৎকার নমুনা রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত করো, তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করছি। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চির শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে’’।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীনের কথাও তাই। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসাবে পরিগণিত করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অবশ্যই আল্লাহ যালেমদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’’। (সূরা মায়েদা: ৫১) এ আয়াতে খাস করে আহলে কিতাবদেরকে বন্ধু বানানো হারাম করা হয়েছে। সমস্ত কাফেরদেরকে বন্ধু বানানো হারাম ঘোষণা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنْ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيل﴾

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য আগমন করেছে, তারা তা অস্বীকার করছে। তারা রসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিস্কার করে, এই অপরাধে যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এবং আমার পথে জেহাদ করার জন্যে বের হয়ে থাক, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়ে যায়’’। (সূরা মুমতাহানাহ: ১)

আল্লাহ মুমিনদের উপর কাফেরদেরকে বন্ধু বানানো হারাম করেছেন। যদিও তারা তার বংশের সর্বাধিক নিকটবর্তী লোক হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنْ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الإِيمَانِ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা কুফরকে ঈমানের উপর প্রাধান্য দেয়। তোমাদের মধ্য হতে যারা তাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, তারাই হবে যালেম’’। (সূরা তাওবা: ২৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

 ﴿لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ  وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ۚ﴾

‘‘যারা আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না। হোক না এই বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জাতি-গোত্র’’। (সূরা মুজাদালা: ২২)

এ বিরাট মূলনীতিটি সম্পর্কে অনেক মানুষ অজ্ঞ রয়েছে। আমি আরবী ভাষায় প্রচারিত একটি রেডিও অনুষ্ঠানে একজন আলেম ও দাঈকে খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, খৃষ্টানরা আমাদের ভাই। এ রকম ভয়ঙ্কর কথা খুবই দুঃখজনক।

আল্লাহ তা‘আলা যেমন ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের দুশমন কাফেরদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করা হারাম করেছেন, ঠিক তেমনি তিনি মুমিনদেরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করা ও তাদেরকে বন্ধু বানানো ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ * وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ﴾

‘‘আল্লাহ, তার রসূল এবং মুমিনগণই হচ্ছেন তোমাদের বন্ধু। যারা সালাত  কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং রুকু করে। আর যে আল্লাহ তার রসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধু বানায়, তারাই আল্লাহর দলভুক্ত। নিশ্চয় আল্লাহর দল বিজয়ী’’। (সূরা মায়িদা: ৫৫-৫৬) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ﴾

‘‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। আর যারা তার সাথে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল’’। (সূরা ফাত্হ: ২৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

‘‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও’’। (সূরা হুজরাত: ১০)

সুতরাং মুমিনগণ পরস্পর দীন ও আকীদা সম্পর্কিত ভাই। যদিও তাদের বংশ, দেশ ও যামানার মধ্যে অনেক দূরত্ব বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾

‘‘যারা অগ্রবর্তী লোকদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এবং আমাদের সেসব ভাইকে মাফ করে দাও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে। আর আমাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের রব! তুমি অত্যন্ত মেহেরবান ও দয়ালু’’। (সূরা হাশর: ১০)

অতএব মুসলিমগণ সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত পরস্পর ভাই ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও তাদের জন্মভূমি ও যামানার মধ্যে অনেক দূরত্ব থাকে। তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি সর্বপ্রথম ব্যক্তিকে আদর্শ স্বরূপ গ্রহণ করে। তাদের একজন অন্যজনের জন্য দু‘আ করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

মানুষের সাথে বন্ধুত্ব রাখা এবং শত্রুতা পোষণ করার কিছু বাহ্যিক রূপ রয়েছে। এ বাহ্যিক রূপগুলো বন্ধুত্ব রাখা কিংবা শত্রুতা পোষণের প্রমাণ বহন করে।

أولا- مظاهر موالاة الكفار - প্রথম. কাফেরদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার কিছু বাহ্যিক রূপ

আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে কাফেরদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক রূপে গ্রহণ করার বাহ্যিক রূপসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে

(১) পোষাক-পরিচ্ছদ ও কথা-বার্তায় কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা। কেননা পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা ও অন্যান্য বিষয়ে কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা তাদেরকে ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

‘‘যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুসরণ করবে, সে উক্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে’’।[1]

সুতরাং কাফেরদের খাস স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, তাদের অভ্যাস, ইবাদত, পথ-পদ্ধতি ও আখলাক-চরিত্রের সাদৃশ্য গ্রহণ হারাম। যেমন দাড়ি কামিয়ে ফেলা, মোচ লম্বা করা, বিনা প্রয়োজনে বিদেশী ভাষা শিক্ষা করা, বিনা প্রয়োজনে বিদেশী ভাষায় কথা বলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, পানাহার এবং অন্যান্য বিষয়ে কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম।

(২) কাফেরদের দেশে বসবাস করা এবং তা থেকে মুসলিমদের দেশে দীন নিয়ে হিজরত না করা। কেননা অমুসলিমদের দেশে দীন নিয়ে বসবাস করা সম্ভব না হলে মুসলিমদের উপর হিজরত করা ওয়াজিব। এমতাবস্থায় কাফেরদের দেশে বসবাস করা তাদেরকে ভালোবাসা ও বন্ধুরূপে গ্রহণ করার প্রমাণ।

(৩) এ জন্যই হিজরত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের উপর আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের মাঝে বসবাস করা হারাম করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (97) إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا (98) فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا﴾

‘‘যারা নিজেদের উপর যুলুম করে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতাগণ বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম। তারা বলে, তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না? এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান। তবে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না তাদের কথা ভিন্ন। আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মার্জনাকারী, পরম ক্ষমাশীল’’। (সূরা আন-নিসা: ৯৭-৯৯)

যেসব দুর্বল লোকেরা হিজরত করার সামর্থ রাখে না, তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে কাফেরদের দেশে বসবাস করার অনুমতি দেননি। তবে অমুসলিমদের দেশে যাদের বসবাস করার মধ্যে দীনের কল্যাণ রয়েছে যেমন আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া, কাফেরদের দেশে ইসলাম প্রচার করা তাদের জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করার অনুমতি রয়েছে।

(৪) আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন ও ভোগ-বিলাসের জন্য কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করাও তাদেরকে বন্ধু বানানোর লক্ষণ। বিনা প্রয়োজনে কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা হারাম। তবে চিকিৎসা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা বৈধ। এমনি অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা ব্যতীত মানুষের কল্যাণার্থে যেসব বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়, ঐসব বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনার্থেও অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা বৈধ। এসব প্রয়োজনে অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা জায়েয। প্রয়োজন শেষ হলেই মুসলিম দেশে ফিরে আসা আবশ্যক। এসব উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করা জায়েয হওয়ার শর্ত হলো মুসলিম সেসব দেশে গিয়ে স্বীয় দীনের নিদর্শনাবলী প্রকাশ করবে এবং ইসলামকে নিয়ে গর্বিত থাকবে। সেই সঙ্গে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য ক্ষতিকর স্থানগুলো থেকে দূরে থাকবে। এমনি আল্লাহর দীনের দাওয়াত প্রচারের জন্য কাফেরদের দেশে সফর করা বৈধ অথবা ওয়াজিব।

(৫) মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের প্রশংসা করা ও তাদের পক্ষপাতিত্ব করাও তাদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করা ও বন্ধু বানানোর আলামত। এটি ইসলাম ভঙ্গের ও মুরতাদ হওয়ার অন্যতম কারণ। আমরা আল্লাহর কাছে এ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

(৬) বিনা প্রয়োজনে অমুসলিমদের সাহায্য নেয়া, তাদেরকে বিশ্বস্ত মনে করা, মুসলিমদের গোপন বিষয়গুলোতে ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদেরকে নিয়োগ করা, তাদেরকে ঘনিষ্ট ও উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করাও তাদেরকে অভিভাবক বানানোর লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ (118) هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (119) إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো ত্রুটি করবে না।  যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই তাই তারা কামনা করে। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ থেকে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চেয়েও মারাত্মক। আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি। যদি তোমরা অনুধাবন করো। তোমরা তাদেরকে ভালোবাসো; কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসেনা অথচ তোমরা সমস্ত আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে বলে, আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতো বেশী বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে থাকে। তাদেরকে বলো, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন। তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের উপর কোনো বিপদ এলে তারা খুশি হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা বেষ্টন করে আছেন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১১৮-১২০)

উপরোক্ত আয়াতগুলো কাফেরদের অন্তরের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে, মুসলিমদের প্রতি তারা যে হিংসা-বিদ্বেষ গোপন রাখে, তাদের বিরুদ্ধে তারা যে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে, মুসলিমদের যে ক্ষতি তারা পছন্দ করে এবং যে কোনো উপায়ে তারা মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয়ার যে পরিকল্পনা তারা করে, উপরোক্ত আয়াতগুলো তাও প্রকাশ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এ সংবাদও দিয়েছেন যে, মুসলিমগণ অমুসলিমদের প্রতি যে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে তারা তাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে এবং তাদেরকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ আবু মূসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললাম, আমার একজন খ্রিষ্টান সেক্রেটারী রয়েছে। তিনি বললেন, তোমার কী হলো? আল্লাহ তোমার অকল্যাণ করুন! তুমি কি আল্লাহর এ কথা শোন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অব্যশ্যই আল্লাহ যালেমদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’’। (সূরা মায়েদা: ৫১)

তুমি কেন একজন মুসলিমকে লেখক নিযুক্ত করোনি। আবু মূসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! সে আমার লেখক হিসাবে কাজ করবে এবং তার দীন সে পালন করবে। তিনি তখন বললেন, আল্লাহ যেখানে তাদেরকে অপদস্ত করেছেন, আমি সেখানে তাদেরকে সম্মানিত করবো না। আল্লাহ যেহেতু তাদেরকে দুর্বল করেছেন, তাই আমি তাদেরকে শক্তিশালী করবো না। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, তাই আমি তাদেরকে কাছে টানতে যাবো না।

ইমাম আহমাদ ও মুসলিম আরো বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বদরের উদ্দেশ্যে বের হলেন, তখন মুশরিকদের জনৈক লোক তার পিছনে বের হলো। হাররার নিকট সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করলো। সে বললো, আমি আপনার সাথে যুদ্ধে শরীক হতে চাই। তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান রাখো? সে বললো, না। তিনি বললেন, ফেরত যাও। আমি কোনো মুশরিকের সাহায্য নিবো না।[2]

উপরোক্ত দলীলগুলোর মাধ্যমে আমাদের নিকট মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্মে কাফেরদেরকে নিয়োগ করা হারাম হওয়ার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল। বিশেষ করে ঐসব গুরুত্ব পূর্ণ দায়-দায়িত্বে তাদেরকে নিয়োগ করা হারাম, যার মাধ্যমে তারা মুসলিমদের অবস্থা ও তথ্যসমূহ অবগত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা ও তাদেরকে কষ্ট দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে মুসলিমদের দেশে বিশেষ করে হারামাইন শরীফাইনের দেশে কাফেরদেরকে নিয়ে আসা, তাদেরকে শ্রমিক, গাড়িচালক, সেবক ও বাড়িঘরের পরিচর্যাকারী হিসেব নিযুক্ত করা এবং তাদেরকে পরিবারের সাথে মিশ্রিত করে রাখা অথবা মুসলিমদের সাথে তাদেরকে বসবাস করতে দেয়া অমুসলিমদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর লক্ষণ।

(৭) কাফেররা দিন-তারীখ গণনা করার জন্য যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে তা ব্যবহার করা তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর অন্যতম লক্ষণ। বিশেষ করে যেসব ক্যালেন্ডারের মধ্যে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও ঈদ-উৎসব সনাক্ত করা আছে, তা ব্যবহার করাও তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত। যেমন ইংরেজী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা। মূলত এটি ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম তারিখকে স্মরণ করে রাখার জন্যই তৈরী করা হয়েছে। এটি খ্রিষ্টানরা নিজেদের পক্ষ হতে তৈরী করেছে। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিবস পালন করা এবং তাকে স্মরণ করে রাখার জন্য ক্যালেন্ডার বানানো তার দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এ ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা তাদের ধর্মীয় নিদর্শন ও উৎসবকে পুনর্জীবিত করায় অংশগ্রহণ করার শামিল।

উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে সাহাবীগণ যখন মুসলিমদের জন্য তারিখ নির্ধারণ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন তারা কাফেরদের সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের তারিখ পরিহার করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের বছর থেকে হিজরী সাল ও তারিখ গণনা শুরু করলেন। এতে প্রমাণ মিলে যে, সাল ও তারিখ গণনার ক্ষেত্রেও কাফেরদের বিরোধিতা করা আবশ্যক। এ ছাড়াও কাফেরদের অন্যান্য খাস অভ্যাসগুলোর বিরোধিতা করা জরুরী।

(৮) কাফের-মুশরিকদের ঈদ-উৎসবে শরীক হওয়া অথবা তা উদযাপনে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভিনন্দন জানানো এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াও তাদেরকে বন্ধু বানানোর লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,

وَالَّذِيْنَ لاَيَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ ﴾ ﴿

‘‘এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না কিংবা মিথ্যা কথা বলে না’’ (সূরা ফুরকান ২৫:৭২)। এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন যে, আল্লাহর বান্দাদের গুণাবলী হলো, তারা কাফেরদের ঈদ-উৎসবে উপস্থিত হয় না।

(৯) কাফেরদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু বানানোর আরেকটি লক্ষণ হলো তাদের প্রশংসা করা এবং তাদের তামাদ্দুন, সভ্যতার সুনাম করা এবং তাদের বাতিল আকীদা ও ভ্রান্ত দীনের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই শুধু তাদের স্বভাব-চরিত্র, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিকে পছন্দ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿ وَلا تَمُدَّنَ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجاً مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى﴾

‘‘আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি কখনো তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না। তোমার প্রতিপালকের জীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও স্থায়ী’’। (সূরা ত্বহা: ১৩১)

উপরোক্ত কথার অর্থ এ নয় যে, মুসলিমগণ কাফেরদের থেকে বিভিন্ন পেশা শিক্ষা করা, বৈধভাবে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করা এবং যুদ্ধনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে শক্তিশালী হওয়ার উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করবে না; এ সব বিষয়ে তাদের থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُم﴾

‘‘আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থের মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়ার মধ্য থেকে। তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু এবং তোমাদের শত্রুদেরকে’’ (সূরাতুল আনফাল: ৬০)

এ উপকারী জিনিসসমূহ এবং সৃষ্টিজগতের গোপন সম্পদগুলো আসলে মুসলিমদের জন্যই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ﴾

‘‘বলো, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বলো, পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত জিনিস ঈমানদারদের জন্যই’’। (সূরা আরাফ: ৩২) আল্লাহ তা‘আলা সূরা জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলেন,

﴿وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾   

‘‘এবং তিনি আসমান ও যমীনের সমস্ত জিনিসকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবকিছুই তার পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’। (সূরা জাসিয়া: ১৩) তিনি আরো বলেন,

﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا﴾

‘‘তিনি তোমাদের জন্য ভূপৃষ্টের সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ২৯)

সুতরাং এসব উপকারী সম্পদগুলো কাজে লাগানোর জন্য মুসলিমদের অগ্রসর হওয়া উচিত। এগুলো অর্জন করার জন্য কাফেরদের দ্বারস্থ হওয়া ঠিক নয়। মুসলিমদেরও শিল্প-কারখানা, কারিগরি ও প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।

(১০) কাফেরদের নামে মুসলিমদের নামকরণ করাও তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করার নামান্তর। পিতা-মাতা, দাদা-দাদি ও মুসলিম সমাজের সুপ্রসিদ্ধ নামগুলো বাদ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য বিদেশী নাম চয়ন করা কাফের-মুশরিকদেরকে বন্ধু বানানোর অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম নাম হলো আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রাহমান। ইসলামী নাম পরিবর্তন করার কারণেই বর্তমানে এমন প্রজন্ম দেখা যাচ্ছে, যারা অদ্ভুত ও অপরিচিত নাম রাখে। মুসলিমদের নাম পরিবর্তন করা এমন একটি বিষয়, যা তাদের নতুন প্রজন্মকে পূর্ববতী লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কারণ হতে পারে এবং যেসব পরিবার বিশেষ নামের মাধ্যমে পরিচিত ছিল, তারাও অপরিচিত হয়ে যেতে পারে।

(১১) কাফেরদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং তাদের জন্য রহমত কামনা করাও তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা এহেন কর্মকে হারাম করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُوْلِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ﴾

‘‘নবী ও ঈমানদারদের জন্য উচিত নয় যে তারা কোন মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা তাদের নিকটাত্মীয় হয়। যখন পরিস্কার হয়ে গেল যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী’’। (সূরা তাওবা: ১১৩) কেননা কাফের-মুশরেকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তাদেরকে ভালোবাসা এবং তাদের দীনকে সঠিক বলার লক্ষণ।


[1]. হাসান সহীহ: আবু দাউদ ৪০৩১, অধ্যায়: কিতাবুল্ লিবাস।

[2]. এ হাদীছটি অপ্রয়োজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বলা হয়েছে যে, এ হুকুম মানসুখ হয়ে গেছে। কেননা পরবর্তীতে তিনি কতক কাফেরের সহায়তা নিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ثانيا: مظاهر موالاة المؤمنين - দ্বিতীয়: মুমিনদের বন্ধু বানানোর লক্ষণসমূহ

আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে মুমিনদেরকে বন্ধু বানানোর বেশ কিছু লক্ষণ বর্ণনা করেছে। তার মধ্যে

(১) কাফেরদের দেশ পরিত্যাগ করে মুসলিমদের দেশে হিজরত করা। কাফেরদের দেশ থেকে মুসলিমদের দেশে দীন নিয়ে পলায়ন করাকে হিজরত বলা হয়। এ উদ্দেশ্যে হিজরত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়া পর্যন্ত হিজরত ওয়াজিব থাকবে। যেসব মুসলিম কাফেরদের মাঝে বসবাস করে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের থেকে দায়মুক্ত হয়েছেন। সুতরাং কাফেরদের দেশে মুসলিমদের বসবাস করা হারাম। তবে সেখান থেকে যদি হিজরত করার ক্ষমতা না রাখে কিংবা সেখানে বসবাস করার মধ্যে কোনো দীনি কল্যাণ থাকে, যেমন আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া ও ইসলাম প্রচার করা, তাহলে সে কথা ভিন্ন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (97) إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا (98) فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا﴾

‘‘যারা নিজেদের উপর যুলুম করে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতাগণ বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম। তারা বলে, তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না? এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান। তবে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না তাদের কথা ভিন্ন। আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মার্জনাকারী পরম ক্ষমাশীল’’। (সূরা আন-নিসা: ৯৭-৯৯)

(২) মুসলিমগণ তাদের দীন ও দুনিয়ার যেসব বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, তাদেরকে জান-মাল ও জবান দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾

‘‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু। এরা ভালো কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করে’’। (সূরা তাওবা: ৭১)আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوا وَّنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُم مِّن وَلَايَتِهِم مِّن شَيْءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا ۚ وَإِنِ اسْتَنصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَاقٌ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾

‘‘যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরাতকারীদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, আসলে তারাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক। আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই, কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্বের কোন সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয। কিন্তু এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন’’। (সূরা আনফাল: ৭২)

(৩) মুসলিমদের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া এবং তাদের আনন্দে আনন্দিত হওয়া। তিনি আরো বলেন,

«تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى» (بخارى:6011)

‘‘পরস্পরের প্রতি দয়া-মায়া ও ভালোবাসা প্রদর্শনে এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার ক্ষেত্রে তুমি মমিনদেরকে একটি দেহের মত দেখতে পাবে। দেহের কোনো অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ অনিদ্রা এবং জ্বরে তার শরীক হয়ে যায়’’।[1] নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا وَشَبَّكَ أَصَابِعَهُ»

‘‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীর সদৃশ। তারা একে অপরকে শক্তিশালী করে। এই বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাতের আঙুল অপর হাতের আঙ্গুলের ফাঁকা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেন’’।[2]

(৪) মুসলিমদের কল্যাণ কামনা করা, তাদের ভালো কিছু ভালোবাসা, তাদেরকে ধোঁকা না দেয়া এবং তাদের সাথে কোনো প্রকার প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

«لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ». (بخارى:13)

 ‘‘তোমাদের কেউ ততোক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ না সে তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে’’।[3]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

«الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ وَلَا يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنْ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ»

‘‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। সে তার ভাইয়ের উপর যুলুম করতে পারে না, তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না এবং তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে না। তাকওয়া হলো এখানে। এ কথা বলে তিনি তিনবার তার বক্ষদেশের দিকে ইঙ্গিত করলেন। কোনো ব্যক্তি নিকৃষ্ট চরিত্রবান হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে অপদস্ত ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। একজন মুসলিমের জান, মাল ও সম্মানসহ সবকিছুই অন্য মুসলিমের উপর হারাম’’।[4]

আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

«لا تَبَاغَضُوا، وَلا تَحَاسَدُوا، وَلا تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا، وَلا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ». (بخارى:6065)

‘‘তোমরা একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করো না। পরস্পর হিংসা করবে না এবং একে অন্যের অসাক্ষাতে নিন্দা করবে না। আর তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলমানের পক্ষে তার মুসলিম ভাইকে তিন দিনের অধিক সময় বর্জন করা বৈধ নয়।[5]

(৫) মুসলিমদেরকে বন্ধু বানানোর আরেকটি লক্ষণ হলো তারা তাদেরকে সম্মান করবে, তাদের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করবে এবং তাদের মানহানি করবে না ও তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ ﴿هُمُ الظَّالِمُونَ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রুপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর কাউকে ফাসেক নামে ডাকা অত্যন্ত জঘণ্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই যালেম। হে ঈমানদারগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গুনাহ। অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া পছন্দ করবে?  দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু’’। (সূরা হুজুরাত: ১১-১২)

(৬) মুসলিমদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার আরেকটি লক্ষণ হলো অভাব-অনটন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং বিপদাপদ ও আরাম-আয়েশ সকল অবস্থায় তাদের সাথে থাকবে। তারা মুনাফেকদের বিপরীত। কেননা মুনাফেকরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশের সময় মুসলিমদের সাথে থাকে এবং বিপদাপদের সময় কেটে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

﴿الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ﴾

 ‘‘যারা তোমাদের (শুভাশুভ পরিণতির) প্রতীক্ষায় থাকে, তাদের অবস্থা হলো আল্লাহর অনুগ্রহে তোমাদের বিজয় হলে তারা বলে, আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের আংশিক বিজয় হয়, তাহলে তারা কাফেরদেরকে বলে আমরা কি তোমাদের উপর জয়ী ছিলাম না এবং বিশ্বাসীদের থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করিনি? অতএব আল্লাহই কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার-মীমাংশা করবেন’’। (সূরা নিসা: ১৪১)

(৭) মুসলিমদের সাথে সাক্ষাত করা, ভালোবাসা, বিনিময়ের জন্য পরস্পর মিলিত হওয়া এবং তাদের সাথে একত্রিত হওয়া।

হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, «وجبت محبتي للمتزاورين فيّ» ‘‘আমার সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর সাক্ষাতকারীদের প্রতি আমার ভালোবাসা আবশ্যক হয়ে গেছে। অন্য হাদীছে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

     «أَنَّ رَجُلًا زَارَ أَخًا لَهُ فِي قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيدُ قَالَ أُرِيدُ أَخًا لِي فِي هَذِهِ الْقَرْيَةِ قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لَا غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ فَإِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ»

‘‘জনৈক লোক তার এক ভাইয়ের সাক্ষাতে অন্য একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলো। আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য রাস্তায় একজন ফেরেশতা বসিয়ে রাখলেন। লোকটি যখন ফেরেশতার নিকট আসলো, তখন তিনি বললেন, কোথায় যাও? সে বললো, আমি এ গ্রামে আমার একজন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছি। ফেরেশতা বললেন, তার কাছে তোমার এমন কোনো সম্পদ আছে কি, যার খোজ-খবর নিতে ও ঠিকঠাক করতে যাচ্ছো? সে বললো, না তবে আমি তাকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসি। ফেরেশতা তখন বললো, আমি আল্লাহর পক্ষ হতে দূত হিসাবে এসেছি এ খবর দেয়ার জন্য যে, তুমি যেমন তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসো, সেরকমই আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন’’।[6]

(৮) মুসলিমদের অধিকারসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কোনো মুসিলম তার মুসলিম ভাইদের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করবে না, তাদের দরদামের উপর দরদাম করবেনা এবং তাদের প্রস্তাবের প্রস্তাব করবে না। এমনি যেসব হালাল ও বৈধ বিষয়ের প্রতি মুসলিমগণ অগ্রগামী হয়েছে তার পথে বাধা সৃষ্টি করবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«وَلا يَبِيعُ الرَّجُلُ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ، وَلا يَخْطُبُ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيهِ» (بخارى: 2140)

‘‘কেউ যেন তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় না করে এবং কেউ যেন তার ভাইয়ের প্রস্তাবের প্রস্তাব না করে’’।[7] অন্য  বর্ণনায় আছে, কেউ যেন তার ভাইয়ের দামাদামির উপর দামাদামি না করে’’।

(৯) মুসলিমদের দুর্বলদের প্রতি দয়া করা। যেমন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«لَيْسَ مِنَّا مَنْ يُوَقِّرْ كَبِيرَنَا وَلَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا»

‘‘যে ব্যক্তি আমাদের বড়দেরকে সম্মান করে না এবং ছোটদের প্রতি রহম করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’’।[8]

তিনি আরো বলেছেন,«هَلْ تُنْصَرُونَ وَتُرْزَقُونَ إِلاَّ بِضُعَفَائِكُمْ»  ‘‘তোমাদের দুর্বল ও অসহায়দের কারণেই তোমরা রিযিক ও সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাকো’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطاً﴾

‘‘তুমি নিজেকে তাদের সঙ্গে রাখো, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে আহবান করে। তারা তার সন্তুষ্টি চায়। তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক থেকে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। আর তুমি তার অনুসরণ করো না, যারা অন্তরকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি। সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে’’। (সূরা কাহাফ: ২৮)

(১০) মুসলিমদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার অন্যতম লক্ষণ হলো, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দু‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ﴾

‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার গুনাহর জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ﴾

‘‘তারা বলে, ‘‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে ক্ষমা করো। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না’’। (সূরা হাশর: ১০)


[1]. সহীহ বুখারী, হা/ ৬০১১।

[2]. সহীহ বুখারী, হা/ ৪৮১।

[3]. সহীহ বুখারী, হা/ ১৩।

[4]. সহীহ বুখারী, হা/ ২৪৪২, সহীহ মুসলিম ২৫৬৪।

[5].  সহীহ বুখারী, হা/ ৬০৬৫।

[6]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৪৬৫৬।

[7]. সহীহ আল-বুখারী, হাদীছ নং- ২১৪০।

[8]. তিরমিযী, হাদীছ নং- ১৯২১।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَّا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَارِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾

‘‘যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন’’। (সূরা মুমুতাহিনা: ৮)

এ আয়াতের অর্থ হলো যেসব কাফের মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয় না, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না এবং মুসলিমদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে বের করেও দেয় না, মুসলিমগণ তার বিনিময় স্বরূপ তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে এবং দুনিয়াবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে তাদের সাথে ইনসাফ করবে। তবে তারা তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না’’। তিনি এটি বলেননি যে, তাদেরকে বন্ধু বানাতে এবং ভালোবাসতে নিষেধ করেন না। মুসলিমদের কাফের পিতা-মাতার ব্যাপারেও আল্লাহ তা‘আলা অনুরূপ বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وصاحبهما في الدنيا معروفا واتبع سبيل من أناب إليّ﴾

‘‘তোমার পিতা-মাতা যদি এমন কিছুকে আমার সাথে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তাহলে তাদের আনুগত্য করো না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো এবং যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন করো’’। (সূরা লুকমান: ১৫)

একদা আসমা বিনতে আবু বকরের কাছে তার মা এসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার আবেদন করলো। সে ছিল কাফের। তিনি এ ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে বললেন, صلي أمك  তোমার মার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾

‘‘যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো! আল্লাহর দলই সফলকাম হবে’’। (সূরা মুজাদালা: ২২)

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও পার্থিব বিষয়াদির বদলা দেয়া এক জিনিস এবং অন্তরের ভালোবাসা অন্য জিনিস। কেননা অমুসলিম আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করা যায়। এটি দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম। তবে এটি অন্তর দিয়ে ভালোবাসা এবং বন্ধু বানানোর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাফেরদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসলে এবং অভিভাবক বানানো হলে তাদের দীনের স্বীকৃত প্রদান করা হয় এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা বুঝায়। এতে করে ইসলামের প্রতি তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

কাফেরদেরকে অন্তরের বন্ধু বানানো হারাম হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাদের সাথে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য করা, তাদের কাছ থেকে পণ্যদ্রব্য, তাদের তৈরী করা উপকারী জিনিস-পত্র আমদানি করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা উপকৃত হওয়া ও তাদের অত্যাধুনিক আবিস্কৃত জিনিসগুলো ব্যবহার করাও হারাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পথে আব্দুল্লাহ ইবনে আরীকাত লাইছীকে ভাড়া করেছিলেন। যাতে করে সে তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়। অথচ সে ছিল তখন কাফের। কতিপয় ইয়াহূদী থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন। বর্তমানেও মুসলিমগণ কাফেরদের নিকট থেকে পণ্যসামগ্রী ও তাদের তৈরী জিনিস আমদানি করে আসছে। মূল্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে এগুলো ক্রয় করে আনছে। এতে করে আমাদের উপর তাদের কোনো ফযীলত সাব্যস্ত হয় না। এটি তাদেরকে ভালোবাসা ও অভিভাবক বানানোর কারণও নয়। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক বানানো আবশ্যক করেছেন এবং কাফেরদেরকে ঘৃণা করা ও তাদেরকে দুশমন মনে করা ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوا وَّنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُم مِّن وَلَايَتِهِم مِّن شَيْءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا ۚ وَإِنِ اسْتَنصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَاقٌ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (72) وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾

‘‘যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরতকারীদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই পরস্পরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয। কিন্তু এমন কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন। যারা কুফুরী করেছে তারা পরস্পরের বন্ধু। যদি তোমরা এটা না করো তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে’’। (সূরা আনফাল: ৭২-৭৩)

ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ﴿إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ﴾ ‘‘যদি তোমরা এটা না করো তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে’’ -এর অর্থ হলো তোমরা যদি মুশরিকদের থেকে দূরে না থাকো এবং মুমিনদেরকে অভিভাবক ও বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করো, তাহলে মানুষের মধ্যে বিরাট ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দিবে। তা হলো সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণ এবং কাফেরদের সাথে মুমিনদের মিশে যাওয়া। এতে করে মানুষের মাঝে ভয়াবহ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়বে। ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ। আমি বলছি, সাম্প্রতিক কালে তাই হয়েছে। আল্লাহ সহায়।

أقسام الناس فيما يجيب في حقهم من الولاء والبراء - মানুষকে ভালোবাসা, বন্ধু বানানো কিংবা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা আবশ্যক হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের শ্রেণীবিন্যাস

ولاء (ওয়ালা) এবং براء (বারা) তথা মানুষকে ভালোবাসা, বন্ধু বানানো কিংবা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষেত্রে তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।

 (১) যাদেরকে শুধু ভালোবাসতে হবে: তারা হলেন ঐসব লোক, যাদের সাথে খালেস ভালোবাসা রাখা আবশ্যক এবং কোনো প্রকার শত্রুতা পোষণ করা যাবে না। তারা হলেন খাঁটি মুমিন। যেমন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মশীলগণ। তাদের সর্বাগ্রে রয়েছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাকে নিজের জীবন, সন্তানাদি, পিতা-মাতা এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসা আবশ্যক। অতঃপর মুমিনদের জননী তার সম্মানিত স্ত্রীগণ, তার পবিত্র আহলে বাইতগণ, সম্মানিত সাহাবীগণ, বিশেষ করে খেলাফায়ে রাশেদীনগণ, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবী, আনসার ও মুহাজিরগণ, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ, বাইআতুর রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী অতঃপর অবশিষ্ট সাহাবীগণ। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট হোন। অতঃপর তাবেঈগণ, সম্মানিত তিন যুগের লোকগণ, এ উম্মতের সালাফগণ এবং ইমামগণ যেমন চার ইমামকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾

‘‘যারা অগ্রবর্তী লোকদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এবং আমাদের সেসব ভাইকে মাফ করে দাও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে। আর আমাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের রব! তুমি অত্যন্ত মেহেরবান ও দয়ালু’’। (সূরা হাশর: ১০)

যার অন্তরে ঈমান আছে, সে এই উম্মতের সাহাবী ও সালাফদেরকে মোটেই ঘৃণা করতে পারে না। বক্র অন্তরের অধিকারী, মুনাফেক ইসলামের শত্রু যেমন রাফেযী, খারেজী ইত্যাদি পথভ্রষ্ট লোকেরাই তাদেরকে ঘৃণা করতে পারে। আমরা আল্লাহর কাছে উপরোক্ত কাজ থেকে মুক্তি চাই।

(২) যাদেরকে শুধু ঘৃণা করতে হবে: সম্পূর্ণরূপে ঘৃণা করতে হবে এবং যাদের সাথে ভালোবাসা ও অভিভাবকত্বহীন শত্রুতা পোষণ করতে হবে, তারা হলো নিরেট কাফের, মুশরিক, মুনাফেক মুরতাদ এবং বিভিন্ন শ্রেণীর নাস্তিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ  وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ ۚ﴾

‘‘যারা আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেনা। হোক না এই বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জাতি-গোত্র’’। (সূরা মুজাদালা: ২২) আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে দোষারোপ করতে গিয়ে বলেন,

﴿تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ﴾

‘‘তাদের অনেককে তুমি অবিশ্বাসীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে। তাদের কৃতকর্ম এতো নিকৃষ্ট, যে কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আর তারা চিরকাল শাস্তিভোগ করবে। যদি এ লোকেরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ, নবী এবং নবীর উপর যা নাযিল হয়েছিল তা মেনে নিতো তাহলে কখনো কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতো না।[1] কিন্তু তাদের অনেক লোক আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করেছে’’। (সূরা মায়িদা: ৮০-৮১)

(৩) যাদেরকে একই সঙ্গে ভালোবাসতে হবে এবং ঘৃণা করতে হবে: তৃতীয় আরেক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যাদেরকে এক দৃষ্টিকোন থেকে ভালোবাসতে হবে এবং অন্যদিক মূল্যায়ন করে ঘৃণা করতে হবে। এ রূপ ব্যক্তির মধ্যে একসঙ্গে ভালোবাসা ও ঘৃণার স্বভাব একত্রিত হয়। এরা হলো পাপাচারী মুমিন। তাদের মধ্যে ঈমানের যে বিশেষণ রয়েছে, তার কারণে তাদেরকে ভালোবাসতে হবে এবং তাদের মধ্যে শিরক ও কুফুরী ব্যতীত অন্যান্য যেসব পাপাচার রয়েছে, তার কারণে তাদেরকে ঘৃণা করতে হবে।

এ শেণীর লোকদেরকে ভালোবাসার দাবি হলো তাদেরকে নছীহত করা এবং তাদের অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করা। তাদের পাপাচারগুলোর সামনে চুপ থাকা মোটেই বৈধ নয়; বরং তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হবে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেয়া হবে এবং তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হবে। তারা যেন অন্যায় কাজ থেকে ফিরে আসে ও মন্দকাজ থেকে তাওবা করে সে জন্য ইসলামী শরী‘আতের দন্ডবিধি কার্যকর করতে হবে এবং শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। তবে এই শ্রেণীর লোকদেরকে সম্পূর্ণরূপে ঘৃণা করা যাবে না এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। যেমন শিরকের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কবীরা গুনাহতে লিপ্ত ব্যক্তির ব্যাপারে খারেজীরা বলে থাকে। ঠিক তেমনি তাদের সাথে খালেস ভালোবাসা পোষণ করে তাদেরকে অভিভাবক ও বন্ধুরূপে গ্রহণও করা যাবে না। যেমন বলে থাকে মুর্জিয়ারা। বরং তাদের ব্যাপারে উপরোক্ত পন্থায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হবে। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা ঈমানের সবচেয়ে শক্তিশালী রশি। যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসবে, কিয়ামতের দিন সে তার সাথেই থাকবে। যেমনটি হাদীছে উল্লেখ আছে।

বর্তমানে অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং মানুষের অধিকাংশ ভালোবাসা-বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা দুনিয়ার স্বার্থেই হয়ে থাকে। কারো কাছে যদি তাদের দুনিয়ার স্বার্থ থাকে, তাহলে তাকে বন্ধু বানায়। যদিও সে আল্লাহ ও তার রসূল এবং মুসলিমদের দীনের দুশমন হয়। আর যদি কোনো মানুষের কাছে তাদের দুনিয়ার স্বার্থ না থাকে, তাহলে তারা তাকে সামান্য কারণেও দুশমন মনে করে, তাকে কষ্ট দেয় এবং তিরস্কার করে যদিও সে আল্লাহ ও তার রসূলের বন্ধু হয়ে থাকে।  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,

«من أَحِبَّ فِي اللَّهِ وَأَبْغَضَ فِي اللَّهِ وَوَالَى فِي اللَّهِ وَعَادَى فِي اللَّهِ فَإِنَّما تُنَالُ وِلايَةُ اللَّهِ بِذَلِكَ وَلن يَجِدُ عَبْدٌ طَعْمَ الإِيمَانِ وَإِنْ كَثُرَتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ حَتَّى يَكُونَ كَذَلِكَ وَصَارَتْ عامة مُؤَاخَاةُ النَّاسِ فِي أَمْرِ الدُّنْيَا وَ ذَلِكَ لا يُجْدِيْ عَلَى أَهْلِهِ شَيْئًا»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসে, আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ঘৃণা করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে; তার এ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভ করা যাবে। আর এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া ব্যতীত কোনো বান্দাই ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, তার সালাত -রোযার পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন। বর্তমানে মানুষের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্থিব স্বার্থ। এ ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের দ্বারা তার কোনো উপকার হবেনা।[2] ইমাম ইবনে জারীর হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।


আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছে কুদসীতে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

«مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ قبض نَفْسِ عبدي الْمُؤْمِنِ، يَكْرَهُ الْمَوْتَ، وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ ولا بد له منه»

‘‘যে ব্যক্তি আমার কোন অলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো। আমার বান্দা যে সব ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিল করে থাকে, তার মধ্যে ঐ ইবাদতের চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয় আর কোন ইবাদত নেই, যা আমি তার উপর ফরয করেছি। বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে সর্বদা আমার এতটুকু নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, যার কারণে আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। আমি যখন তাকে ভালোবাসতে থাকি তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে শুনে, আমি তার চোখ হয়ে যাই যার মাধ্যমে সে দেখে, আমি তার হাত হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে স্পর্শ করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে চলা ফেরা করে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, আমি তাকে তা দিয়ে দেই। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে আমি তাকে আশ্রয় প্রদান করি। আমি আমার মুমিন বান্দার জান বের করতে যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি, অন্য কোনো কাজ করতে গিয়ে ততটা দ্বিধা-সংকোচ করি না। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তাকে দীর্ঘ হায়াত দিয়ে অতি বৃদ্ধ করে কষ্ট দেয়াকে অপছন্দ করি।[3]

যারা সাহাবীদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে এবং তাদেরকে গালি দেয় তারাই আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে বড় দুশমন।

ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي اللَّهَ اللَّهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِي فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِي وَمَنْ آذَانِي فَقَدْ آذَى اللَّهَ وَمَنْ آذَى اللَّهَ يُوشِكُ أَنْ يَأْخُذَهُ»

‘‘তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার পাত্রে পরিণত করো না। যে ব্যক্তি আমার সাহাবীদেরকে ভালোবাসলো, সে আমার ভালবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসলো। আর যে ব্যক্তি তাদেরকে ঘৃণা করলো, সে আমাকে ঘৃণা করার কারণেই তাদেরকে ঘৃণা করলো, যে তাদেরকে কষ্ট দিল, সে আমাকেই কষ্ট দিলো। আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিলো, সে স্বয়ং আল্লাহকেই কষ্ট দিলো। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে কষ্ট দিবে, অচিরেই আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন।[4]

সাহাবীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা এবং তাদেরকে গালি দেয়াকে কিছু কিছু সম্প্রদায় দীন ও আকীদা হিসাবে গ্রহণ করেছে। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে তার ক্রোধ ও কঠিন শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।  


[1]. অর্থাৎ তাদের ঈমান যদি সঠিক হতো এবং ঈমানের দাবি অনুযায়ী যদি আমল করতো, তাহলে তারা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু মনে করতো না।

[2]. ইবনে জারীর এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে এ সনদে হাদীছটি দুর্বল। দেখুন কুররাতুল উয়ুন, পৃষ্ঠা নং- ২৭৬।

[3]. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৬৫০২। যদি প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার কান, চোখ ইত্যাদি হওয়ার প্রকৃত তাৎপর্য কি? উত্তর হচ্ছে বান্দা যখন আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য তাঁর এবাদতে মগ্ন হয়ে যায় এবং এবাদত করতে করতে তার ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়, তখন তার শরীরের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শরীয়াতের অনুগামী হয়ে যায়। তখন কান দিয়ে শুধু আল্লাহর আনুগত্যের কথাই শুনে এবং তা দিয়ে কোন হারাম নিষিদ্ধ আওয়াজ শুনার চিন্তাও করে না। চোখ দিয়ে শুধু আল্লাহর পছন্দনীয় জিনিসই দেখে। হাত দিয়ে শুধু ভাল জিনিসই স্পর্শ করে এবং পা দিয়ে শুধু আনুগত্যের পথেই চলে। এক কথায় আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সন্তোষজনক কাজ করার তাওফীক দিয়ে থাকেন। যারা এ হাদীছ থেকে স্রষ্টা সৃষ্টিতে বিলীন হওয়ার কথা সাব্যস্ত করতে চান তারা অপব্যাখ্যার পাশাপাশি স্রষ্টার অস্তিত্বকে গুড়েবালি করে ফেলেন। যার ফলে তারা নিজেরাই স্রষ্টাকে খুঁজে পান না; বরং এক পর্যায়ে সৃষ্টিরই পূজা শুরু করেন, যা গুরুবাদের নামান্তর। তাদের ধারণা আত্মা + পরমাত্মার মিশ্রণে সব একাকার হয়ে গেছে।

[4]. সহীহ ইবনে হিববান, ইমাম তিরমিযী এ হাদীছ বর্ণনা করার পর বলেন, হাদীছটি হাসান গরীব। হাদীছটি এই সনদ ব্যতীত অন্য কোনো সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ইমাম আলবানী যঈফ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলায়ে যঈফা, হা/২৯০১।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে