প্রিয় মুসলিম ভাই! আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ও আপনাকে ইসলামী আকীদা জানা, মেনে চলা এবং এটার দিকে দাওয়াত দেয়ার তাওফীক দিন। আপনি জেনে রাখুন যে, নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট ইসলামী আকীদার মূলনীতিগুলো হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান, আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান এবং তাক্বদীরের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।

আকীদার এ মূলনীতিগুলোর পক্ষে কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ এগুলো আকীদা ও ঈমানের মূলনীতি হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾

‘‘তোমরা তোমাদের মুখম-ল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে প্রত্যাবর্তিত করার মধ্যে কোন ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা আল বাকারা: ১৭৭)

তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছি নির্দিষ্ট পরিমাপে’’। (সূরা কামার: ৪৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ﴾

 ‘‘রসূলের উপর তার রবের পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি তিনি ঈমান এনেছেন এবং ঈমানদারগণ। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে: আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না’’। (সূরা আল বাকারা: ২৮৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَمَن يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا﴾

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ, তার ফেরেশতাবর্গ, তার কিতাবসমূহ, তার রসূলগণ ও পরকালের প্রতি কুফুরী করলো সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূর চলে গেলো’’। (সূরা আন নিসা: ১৩৬)

 সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন,

أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ

‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেশতাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার নবী-রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভালো-মন্দের উপর’’।[1]

আকীদার এ বিরাট মূলনীতিগুলোকে ঈমানের রুকন বলেও নামকরণ করা হয়। সমস্ত নবী-রসূল এবং সমস্ত আসমানী শরী‘আত এগুলো ঈমানের রুকন ও আকীদার মূলনীতি হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। আসমানী কিতাবসমূহ এ মূলনীতিগুলোসহ নাযিল হয়েছে। ঈমানের গ-- থেকে বের হয়ে যারা কাফেরে পরিণত হয়েছে, তারা ব্যতীত অন্য কেউ এগুলোকে অথবা এগুলো থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করতে পারে না। যেমন-

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ أُولَٰئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا﴾

‘‘যারা আল্লাহ ও তার রসূলদের সাথে কুফুরী করে, আল্লাহ ও তার রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করি ও কারো প্রতি কুফুরী করি। আর তারা কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই আসলে কট্টর কাফের। আর এহেন কাফেরদের জন্য আমি অবমাননাকর শাস্তি তৈরী করে রেখেছি। বিপরীত পক্ষে যারা আল্লাহ ও তার রসূলদেরকে মেনে নেয় এবং তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না, তাদেরকে আমি অবশ্যই পুরস্কার দান করবো। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়’’। (সূরা আন নিসা: ১৫০-১৫২)

এ হলো আকীদার বিরাট মূলনীতিগুলো এবং ঈমানের সুদৃঢ় ও মজবুত রুকনগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা বিরণ প্রদান করা দরকার। আমরা এ কিতাবে যথাসাধ্য এ মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা করবো ইনশা-আল্লাহ।


[1]. সহীহ মুসলিম, হা/৮, সহীহ বুখারী, হা/৫০, ইবনে মাজাহ, হা/৬৩, আবূ দাউদ, হা/৪৬৯৫।

الأصل الأول: الإيمان بالله عزوجل - প্রথম মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান

আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়ন করাই হচ্ছে আকীদার প্রধান মূলনীতি। الإيمان بالله বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হলো অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, তিনিই প্রত্যেক জিনিসের একমাত্র রব ও মালিক। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। সমগ্র সৃষ্টিজগতের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। সে সঙ্গে আরো বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র বান্দার ইবাদতের হকদার, এতে তার কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া আর যত মাবুদ রয়েছে, তা সবই বাতিল। এগুলোর ইবাদতও বাতিল।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা লুকমানের ৩০ নং আয়াতে বলেন,

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ﴾

‘‘এসব কিছু এ কারণে যে, আল্লাহই সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য যেসব জিনিসকে তারা ডাকে তা সবই মিথ্যা, আর আল্লাহই সুউচ্চ ও সুমহান’’।

আরো বিশ্বাস করা যে, তিনি সিফাতে কামালিয়া তথা উত্তম ও পূর্ণতার গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত এবং প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত।

আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান বলতে তিন প্রকার তাওহীদকেই বুঝায়। তাওহীদুর রুবুবীয়্যা, তাওহীদুল উলুহীয়া এবং তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত। এতে রয়েছে কয়েকটি অনুচ্ছেদ।

المبحث الأول: توحيد الربوبية - প্রথম অনুচ্ছেদ: তাওহীদুর রুবুবীয়্যা

তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা একই সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা। সব কিছুর ব্যবস্থাপক, পরিচালক, জীবন দাতা, মৃত্যু দাতা। তিনিই রিযিক দানকারী এবং প্রবল শক্তিধর। এ প্রকার তাওহীদকে মেনে নেয়ার প্রবণতা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। মানব জাতির কেউ এ বিষয়ে তেমন কোনো মতভেদ করেনি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾

‘‘তুমি যদি এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ﴾

‘‘তুমি যদি এসব লোকদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা এগুলো সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা যুখরুফ: ৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ سَيَقُولُونَ الله﴾

‘‘তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ’’। (সূরা মুমিনুন: ৮৬-৮৭)

এ রকম আয়াত কুরআনে অনেক রয়েছে। কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত স্বীকার করতো। তারা বিশ্বাস করতো আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, রিযিক দাতা, জীবন দাতা এবং মৃত্যু দাতা। মানব জাতির সামান্য লোকই কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াত এবং প্রভুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।

কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রভু ও স্রষ্টাকে অস্বীকার করলেও গোপনে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে। অহংকার করার কারণেই কেবল তারা প্রকাশ্যে প্রভুকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন সম্পর্কে বলেন যে, সে বলেছিল,

﴿يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي ﴾


‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোনে প্রভু আছে বলে জানি না’’। (সূরা কাসাস: ৩৮)

আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালামের কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তা‘আলা মূসার উক্তি উল্লেখ করে বলেন,

﴿قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ﴾

‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

﴿وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا﴾

‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মনমগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে’’। (সূরা নামাল: ১৪)

তারা সত্য অস্বীকারের ক্ষেত্রে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। কেবল অহংকার করেই তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾

‘‘এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এ জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোনো জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার উপর নির্ভর করে এসব কথা বলে’’। (সূরা জাছিয়া: ২৪)

সুতরাং তাদের কাছে এমন কেনো জ্ঞান ছিল না, যা তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার পথ দেখিয়েছে: বরং আসমানী শরী‘আত, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সবই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার ও সাব্যস্ত করেছে।

এ সৃষ্টিজগত এবং তাতে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার একত্ব এবং তার প্রভুত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। সৃষ্টিজগতে যা কিছু প্রবর্তিত হচ্ছে, তার জন্য প্রবর্তক থাকা আবশ্যক।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ﴾

‘‘তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তুর: ৩৫-৩৬)

কবি বলেছেন, وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ... تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِد  প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি একক। তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? এ প্রশ্নটির জবাব দেয়া আবশ্যক। তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নাস্তিকরা এলোমেলো জবাব দিয়েছে। তারা কখনো বলেছে, প্রকৃতির নিয়মেই এ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তকে প্রকৃতি বলা হয়। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের সবকিছু তাদের নিকট প্রকৃতি। এ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে!!

তারা কখনো বলেছে, উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তর বিভিন্ন স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের নামই প্রকৃতি। যেমন গরম হওয়া, ঠান্ডা হওয়া, আদ্র হওয়া, শুস্ক হওয়া, মসৃণ হওয়া, মোটা হওয়া, নড়াচড়া করা, স্থির হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, প্রজনন, বংশ বিস্তার করা ইত্যাদি সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে হয়। তাদের মতে বস্ত্তসমূহের স্বভাব এবং বিভিন্ন অবস্থায় সেটা রূপান্তরিত হওয়ার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে তাকেই প্রকৃতি বলা হয়। তাদের মতে এ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যগুলোই সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছে।

উভয় দিক থেকেই তাদের কথা বাতিল। যদি বলা হয় উদ্ভিদ, জীব ও জড় পদার্থগুলোর নামই প্রকৃতি এবং প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে, তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী প্রকৃতি একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আবশ্যক হয় যে, পৃথিবী নিজেই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে, আকাশও নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে কথা একই...। এটি অসম্ভব।

এভাবে প্রকৃতির নিয়মে এক বস্ত্তর সত্তা থেকে সমজাতীয় আরেক বস্ত্তর সত্তা সৃষ্টি হওয়া যদি অসম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সৃষ্টি হওয়া আরো বেশী কঠিন। অর্থাৎ কেননা কোনো বস্ত্ত নিজেই যদি নিজেকে সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বস্ত্তর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বস্ত্তকে সৃষ্টি করা আরো বেশী অসম্ভব। কেননা موصوف বা বিশেষিত সত্তার সাথে যুক্ত না হয়ে صفة বা স্বভাব ও বিশেষণ অস্তিত্বশীল হয় না। সুতরাং ছিফাত কিভাবে মাউসুফকে সৃষ্টি করতে পারে!! অথচ ছিফাত নিজেই মাউসুফের প্রতি মুখাপেক্ষী। সুতরাং যখন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে মাউসুফ সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে ছিফাতও সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি কথা বুঝা দরকার যে, প্রকৃতির কোনো অনুভুতি নেই। এটি একটি যন্ত্রের মত। সুতরাং তা থেকে কিভাবে এত বিশাল বিশাল ও সুনিপুন-অভিনব কাজ-কর্ম তৈরী হতে পারে, যা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং যা পরস্পর মিলে একটি সুশৃঙ্খল বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।

নাস্তিকদের কেউ কেউ বলে থাকে, এ সৃষ্টিজগত আকস্মিকভাবে তৈরী হয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে অনেকগুলো অণু-পরমাণু ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্ত একসাথে মিলিত হয়ে প্রাণ তৈরী হয়। এতে কোনো স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনা ও কলা-কৌশলের প্রয়োজন হয় না। এটি একটি বাতিল কথা। বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাব এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। কেননা আপনি যখন এ সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের মহাশূন্য, ভূপৃষ্ঠ এবং মহাকাশে সুক্ষ্ম, বিস্ময়কর ও সুবিন্যস্তভাবে চলাচলকারী সৃষ্টিসমূহের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয় যাবে যে, প্রজ্ঞাবান এক স্রষ্টা ব্যতীত এসব তৈরী হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, তুমি স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নাস্তিককে জিজ্ঞাসা করো, ঐ মেশিনের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী, যা একটি নদীতে রাখা হয়েছে। তার যন্ত্রাংশগুলো মজবুত, সেগুলো মজবুতভাবে লাগানো হয়েছে এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলো তৈরী করা হয়েছে। দর্শক মেশিনের ভিতরে যেমন কোনো দোষ ধরতে পারে না তেমনি তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কোনো ত্রুটি খুঁজে পায় না। আর এ মেশিনটি দিয়ে বিরাট একটি বাগানে পানি দেয়া হচ্ছে। বাগানে রয়েছে প্রত্যেক প্রকার ফলফলাদির গাছপালা। মেশিনটি বাগানের গাছপালা ও ফল-ফসলের চাহিদা মোতাবেক পানি সরবরাহ করছে। ঐদিকে বাগানকে ঠিক-ঠাক রাখার জন্য তাতে একজন পরিচর্যাকারী রয়েছে। সে ভালোভাবে বাগানের যত্ন নেয়, খোঁজ-খবর রাখে এবং বাগানের সার্বিক কাজ-কর্ম সম্পন্ন করে। বাগানের কোনো কিছুই ত্রুটিযুক্ত রাখে না। অতঃপর লোকটি বাগানের ফল-ফসল উঠিয়ে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে তাদের মধ্যে ভাগ-বন্টন করে দেয়। প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকেই প্রয়োজন মোতাবেক দান করে। সর্বদা সে এ রকমই করতে থাকে। তুমি কি মনে করো কোনো কারিগর ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই বাগান এবং তার সবকিছু আকস্মিকভাবে হয়ে গেছে?

বাগানে পানি দেয়ার মেশিনটি এমনিতেই হয়ে গেছে? বাগান ও তার ভিতরকার পরিবেশ হঠাৎ করেই তৈরী হয়েছে?

কোনো কর্তা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই এসব কিছু আকস্মিকভাবেই হয়ে গেছে?

তোমার যদি বিবেক-বুদ্ধি থাকে, তাহলে এসবের ব্যাপারে তোমার বিবেক কী বলে তা খেয়াল করো। তোমার বিবেক কী জবাব দেয় তা ভালোভাবে বুঝো এবং কী দিক নির্দেশনা দেয় তা অনুধাবন করো। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি এ যে, তিনি এমন কিছু অন্তর সৃষ্টি করেছেন, যা সম্পূর্ণ অন্ধ, তাতে কোনো আলো নেই। যার কারণে সে উজ্জ্বল ঝকঝকে নিদর্শনগুলো কেবল ঐসব চতুষ্পদ জন্তুর মতোই দেখতে পায় যাদের চক্ষু আছে ঠিকই; কিন্তু তাতে কোনো আলো নেই। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।

المبحث الثاني: توحيد الألوهية - দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ: তাওহীদুল উলুহীয়া

সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাসভাবে সম্পন্ন করাকে توحيد الألوهية বলা হয়। উলুহীয়াত অর্থ ইবাদত। الإله অর্থ মাবুদ। এ জন্যই এ প্রকার তাওহীদকে توحيد العبادة বলেও নামকরণ করা হয়।

العبادة শব্দের আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, বশীভুত হওয়া, পদদলিত হওয়া ইত্যাদি। যখন কোনো রাস্তার উপর দিয়ে পদচারণ করা হয়, তখন তাকে  طريق معبد বলা হয়। অর্থাৎ পদদলিত ও বশীভুত রাস্তা। আলেমগণ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে তার মূল অর্থে সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

একদল আলেমের মতে প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও বিবেক-বুদ্ধির দাবি ছাড়াই যা বাস্তবায়ন করার জন্য শরী‘আতের পক্ষ হতে আদেশ করা হয়েছে, তাই ইবাদত। আরেক দল আলেমের মতে পরিপূর্ণ বিনয় মিশ্রিত পরিপূর্ণ ভালোবাসাকে ইবাদত বলা হয়।

 শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة

আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যেসব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই ইবাদত।

ইবাদতের এ সংজ্ঞাটিই সর্বাধিক সূক্ষ্ম ও অধিকতর ব্যাপক। কেননা দীনের সবকিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। যারা বিনয় মিশ্রিত ভয়কে ইবাদত বলে নামকরণ করেছেন, তাদের কথা হলো পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে পরিপূর্ণ ভালোবাসা প্রিয়পাত্রের আনুগত্য করা ও তার সামনে নত হওয়ার দাবি জানায়। বান্দাকে কেবল ভালোবাসা ও বিনয়ই প্রিয়পাত্রের জন্য নত করে। সুতরাং বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা ও তার সামনে নত হওয়া অনুপাতেই বান্দার আনুগত্য হয়ে থাকে। বান্দার তরফ থেকে তার রবের প্রতি ভালোবাসা এবং তার রবের সামনে বিনয়ী ও নত হওয়া একমাত্র তারই ইবাদতের দাবি জানায়। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই।

ইসলামী শরী‘আতে যেসব ইবাদতের আদেশ এসেছে, তাতে একই সঙ্গে বিনয়-নম্রতা ও ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। এতে তিনটি রুকন থাকা জরুরী। ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা এবং ভয়-ভীতি। ইবাদতের মধ্যে এসব বিষয় একসাথে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তির মধ্যে এগুলো থেকে শুধু একটি পাওয়া যাবে, সে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী নয়। অন্তরে শুধু ভালোবাসা নিয়ে ইবাদত করা সুফীদের তরীকা, শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ইবাদত করা মুরজিয়াদের তরীকা, আর শুধু ভয় নিয়ে ইবাদত করা খারেজীদের তরীকা।

বিনয়হীন ভালোবাসা ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো জিনিসকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু তার সামনে নত হয় না, সে তার ইবাদতকারী হিসাবে গণ্য নয়। যেমন কোনো মানুষ তার সন্তান ও বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা ইবাদত নয়। এমনি ভালোবাসাবিহীন নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। যেমন রাজা-বাদশা কিংবা যালেম ও সন্ত্রাসীর ক্ষতি থেকে বাচার জন্য মানুষ তাদের সামনে নত হয়। এ নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের ক্ষেত্রে এ দু’টি বিষয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা হলে ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বান্দার নিকট আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক প্রিয় হওয়া আবশ্যক। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সামনে বান্দা সর্বাধিক বিনয়ী হওয়া ও নতি স্বীকার করা আবশ্যক।

সুতরাং বান্দার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুব প্রিয় এবং এটা তার সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মাখলুক সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾

‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন.

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন নাহল: ৩৬)

ইবাদতের অনেক প্রকার রয়েছে। যেমন সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ, কথা-বার্তায় সত্য বলা, আমানত আদায় করা, পিতা-মাতার সেবা করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করা, সৎকাজের আদেশ দেয়া, অন্যায় কাজে বাধা দেয়া, কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, জীবের প্রতি দয়া করা, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও দাস-দাসির প্রতি অনুগ্রহ করা, জীব-জন্তুর প্রতি ইহসান করা, আল্লাহর নিকট দু‘আ করা, আল্লাহর যিকির করা, কুরআন তেলাওয়াত করা ইত্যাদি। এসবগুলোই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। এমনি আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসা, আল্লাহর রসূলকে ভালোবাসা, আল্লাহকে ভয় করা এবং তার নিকট তাওবা করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এমনি কুরবানী করা, মানত করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া এবং ফরিয়াদ করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য করা আবশ্যক। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই। এগুলো থেকে কোনো কিছু যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সম্পাদন করলো, যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করলো, অথবা কুরবানী করলো কিংবা মানত করলো, কিংবা মৃত-অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট সাহায্য বা আশ্রয় চাইলো অথবা জীবিত উপস্থিত ব্যক্তির নিকট এমন বিষয়ে সাহায্য চাইলো, যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না, সে বড় শির্কে লিপ্ত হলো এবং এমন ভয়াবহ গুনাহয় লিপ্ত হলো, যা তাওবা ছাড়া ক্ষমা করা হবে না। চাই সে এগুলো থেকে কোনো কিছু মূর্তির উদ্দেশ্যে বা গাছের উদ্দেশ্যে অথবা পাথরের উদ্দেশ্যে অথবা কোনো নবীর উদ্দেশ্যে বা কোনো মৃত বা জীবিত অলীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত করুক, সবই শিরক। যেমন বর্তমানে কবরের উপর নির্মিত সমাধিগুলোর নিকট করা হয়ে থাকে। ইবাদতের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কেউ অন্যকে শরীক করুক, -এটি আল্লাহ তা‘আলা মোটেই পছন্দ করেন না। চাই কোনো নৈকট্যশীল ফেরেশতা, প্রেরিত রসূল, অলী বা অন্য কাউকে শরীক করা হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ﴾

‘‘আল্লাহ তার সাথে শিরক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শিরক ছাড়া অন্যান্য যেসব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন।’’ (সূরা আন নিসা: ৪৮)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا﴾

‘‘মসজিদসমুহ আল্লাহর ইবাদত করার জন্যই। অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেকো না’’। (সূরা আল জিন: ১৮)

সূরা আন নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا﴾

‘‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না’’।

অত্যন্ত আফসোসের ব্যাপার হলো বর্তমানে বেশ কিছু দেশে ইসলামের দাবিদার অনেক লোক কবরকে মূর্তি বানিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে সেগুলোর পূজা করছে। কখনো কখনো তাদের কেউ কেউ কবর ছাড়া অন্যান্য স্থানেও আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করে থাকে। কেউ কেউ বসা থেকে উঠার সময় কিংবা আকস্মিক কোনো বিপদা-পদের সম্মুখীন হয়ে বলে ফেলে, ইয়া রসূলাল্লাহ! অথবা বলে মদদ ইয়া রসূলাল্লাহ! মদদ ইয়া ফুলান!

তাদেরকে এ ধরণের কাজ থেকে নিষেধ করা হলে তারা বলে, আমরা জানি এদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই বা এদের কিছু করার নেই, তবে এরা আল্লাহর সৎ বান্দা, আল্লাহর নিকট তাদের মান-মর্যাদা ও ক্ষমতা আছে। আমরা তাদের মান-মর্যাদার উসীলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। অথচ কুরআন পড়া সত্ত্বেও তারা কুরআনের এ কথা ভুলে গেছে কিংবা ভুলে যাওয়ার ভান করছে যে, হুবহু এ কথাই ছিল মক্কার মুশরিকদের। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কথাকে উল্লেখ করেছেন। যেমন-আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

‘‘আর তারা ইবাদত করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্ত্তর, যা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। তুমি বলো, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছো, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে? তিনি পবিত্র সেসব বস্তু থেকে যাকে তোমরা শরীক করছো’’। (সূরা ইউনুস: ১৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ﴾

‘‘যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য অলী-আওলীয়াকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা করে দিবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’’। (সূরা আয যুমার: ৩)

আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মিথ্যুক ও কাফের হিসাবে নাম দিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করে তাদের প্রয়োজন পুরণের জন্য এসব অলী-আওলীয়া আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মধ্যে শুধু মধ্যস্থতাকারী। বর্তমানে কবরপূজারীরা এ কথাই বলে। আসলে তাদের অন্তর এবং আইয়্যামে জাহেলীয়ার মুশরিকদের অন্তর পরস্পর সমান।

আলেম সমাজের উপর আবশ্যক হলো, তারা যেন এ নিকৃষ্ট শিরকের প্রতিবাদ করেন এবং মানুষের জন্য এর ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। মুসলিম শাসকদের উচিত এ কবরগুলো ভেঙ্গে ফেলা এবং যেসব মসজিদে কবর রয়েছে, তা থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলে মসজিদগুলো পবিত্র করা।

মুসলিমদের অনেক ইমাম এসব শিরকের প্রতিবাদ করেছেন, তা থেকে নিষেধ করেছেন, সাবধান করেছেন এবং এর ভয়াবহ পরিণতির ভয় দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার সুযোগ্য শিষ্য ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আস সানআনী, মুহাম্মাদ ইবনে আলী আশ শাওকানী এবং অতীত ও বর্তমানের আরো অনেক ইমাম রয়েছেন। এ বিষয়ে লেখা তাদের কিতাবগুলো আমাদের হাতেই রয়েছে।

ইমাম শাওকানী রহিমাহুল্লাহ স্বীয় কিতাব নাইলুল আওতারে বলেন, কবরের উপর সমাধিগুলো মজবুতভাবে নির্মাণ করা এবং সেটাকে সৌন্দর্যম--ত করার এমন ফিতনা-ফাসাদ চালু হয়েছে, যার জন্য ইসলাম তার চোখের পানি ফেলছে। অজ্ঞ মুসলিমরা এগুলোর প্রতি ঐ রকমই আকীদা পোষণ করছে, যেমন আকীদা পোষণ করেছিল কাফেররা তাদের মূর্তিগুলোর প্রতি। ক্ষেত্র বিশেষে এর চেয়ে ভয়াবহ আকীদাও রাখছে। তাদের ধারণা এই কবরগুলো তাদের উপকার করতে এবং বিপদাপদ দূর করতে সক্ষম। তাই তারা প্রয়োজন পুরণের জন্য এগুলোকে উদ্দেশ্য হাসিলের স্থান ও আশ্রয় স্থলে পরিণত করেছে। এখান থেকে তারা সেটাই চাচ্ছে, যা আল্লাহর বান্দারা কেবল তার কাছেই চায়। এগুলোর দিকে তারা সফর করছে, এখানে তারা কবর ও সমাধিগুলো স্পর্শ করছে এবং ফরিয়াদ করছে। মোটকথা মক্কার মুশরিকরা জাহেলী যুগে তাদের মূর্তির নিকট যা করতো এ যুগের কবর পূজারীরা কবরের নিকট তা থেকে একটিও বাদ দেয়নি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এত বড় অন্যায় ও কুফরী মুসলিম সমাজে বিদ্যমান থাকার পরও কাউকে আল্লাহর জন্য রাগান্বিত হতে এবং তার পবিত্র দীনের জন্য ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায় না। কোনো আলেম, ছাত্র, শাসক, মন্ত্রী বা বাদশাহ কেউই এগুলোর প্রতিবাদ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে না!!

বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের কাছে অনেক খবর এসেছে যে, অনেক কবরপূজারী আছে, তাদেরকে যদি কোনো ব্যাপারে আল্লাহর নামে কসম করতে বলা হয়, তখন আল্লাহর নামে সরাসরি মিথ্যা কসম খেয়ে বসে। অতঃপর যখন তাকে ঐ বিষয়ে তার শাইখের নামে অথবা তার অলীর নামে কসম খেতে বলা হয়, তখন তোতলানো ও ইতস্ততা শুরু করে এবং গড়িমসি করে। পরিশেষে তার অলীর নামে কসম খেতে অস্বীকার করে এবং ঐ ব্যাপারে সত্য স্বীকার বরে। এটি সত্য সুস্পষ্ট দলীল যে, তাদের শিরক ঐসব লোকের শিরকের চেয়েও ভয়াবহ, যারা বলে নিশ্চয় আল্লাহ দুই মাবুদের এক মাবুদ অথবা তিন মাবুদের এক মাবুদ। হে মুসলিমদের আলেম সম্প্রদায়! হে মুসলিমদের শাসক গোষ্ঠি! আপনারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন।

ইসলামের জন্য কুফরের চেয়ে অধিক বিপর্যয় আর কিছু আছে কি? এ দীনের মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করার চেয়ে অধিক বিপদ আর কিছু আছে কি? মুসলিমরা যত মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে থাকে এর মতো আর কোনো মুছীবত নেই। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যদি ওয়াজিব না হয়, তাহলে প্রতিবাদ করার মত আর কোনো অন্যায় মুসলিমদের সামনে আছে বলে আমি মনে করি না। কোনো এক আরব কবি বলেছেন,

لقد أسمعت لو ناديت حيا + ولكن لا حياة لمن تنادي
ولو نارا نفخت بها أضاءت + ولكن أنت تنفخ في رماد

তুমি যদি কোনো জীবিত মানুষকে ডাকতে, তাহলে তুমি তাকে শুনাতে সক্ষম হতে। কিন্তু তুমি এমন কাউকে ডাকছো, যে প্রাণহীন। তুমি যদি আগুনে ফুঁ দিতে তাহলে সেটা আলোকিত করতো। কিন্তু তুমি যাতে ফুঁ দিচ্ছো, তা ছাই ব্যতীত অন্য কিছু নয়। ইমাম শাওকানীর কথা এখানেই শেষ।

ইমাম শাওকানী রাহিমাহুল্লাহ তার সময়ের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তার যুগের পর মুছীবত আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

علاقة توحيد الألوهية بتوحيد الربوبية والعكس - তাওহীদুল উলুহীয়া এবং তাওহীদুর রুবুবীয়ার মধ্যকার সম্পর্ক

উপরোক্ত দু’প্রকার তাওহীদের এক প্রকারের সাথে অন্য প্রকারের সম্পর্ক হলো, তাওহীদুর রুবুবীয়া তাওহীদুল উলুহিয়াকে আবশ্যক করে। অর্থাৎ তাওহীদুর রুবুবীয়াহকে স্বীকৃতি দেয়া তাওহীদুল উলুহীয়ার স্বীকৃত প্রদানকে আবশ্যক করে এবং সেটাকে বাস্তবায়ন করার দাবি জানায়।

সুতরাং যে ব্যক্তি জানতে পারবে, আল্লাহ তার প্রভু, স্রষ্টা এবং তার সকল কাজের ব্যবস্থাপক, তার উপর আবশ্যক হয়ে যাবে যে, সে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই।

এমনি তাওহীদুল উলুহীয়া তাওহীদুর রুবুবীয়াকেও শামিল করে। অর্থাৎ তাওহীদুর রুবুবীয়াহ তাওহীদুল উলুহীয়ার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে না, সে অবশ্যই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলাই তার একমাত্র প্রভু ও স্রষ্টা। যেমন ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম বলেছেন,

﴿أَفَرَأَيْتُم مَّا كُنتُمْ تَعْبُدُونَ أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُونَ فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّي إِلَّا رَبَّ الْعَالَمِينَ الَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهْدِينِ وَالَّذِي هُوَ يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِ وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ وَالَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحْيِين وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ﴾

‘‘তোমরা ভেবে দেখেছো কি তার সম্বন্ধে যার ইবাদত করছো? তোমরা এবং তোমাদের অতীতের পিতৃপুরুষেরা। বিশ্বজগতের প্রতিপালক ব্যতীত এরা তো সবাই আমার দুশমন। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ দেখান। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। তিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন এবং পুণর্বার আমাকে জীবন দান করবেন। এবং আশা করি তিনি কিয়ামতের দিন আমার অপরাধসমূহ মার্জনা করবেন। (সূরা শুআরা: ৭৫-৮২)

তাওহীদুল উলুহীয়া এবং রুবুবীয়া কখনো একসাথে উল্লেখ করা হয়। যখন উভয়টি একসাথে উল্লেখ করা হবে, তখন উভয়ের অর্থ আলাদা হবে এবং একটি অন্যটির অংশ হবে।  যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) إِلَهِ النَّاسِ﴾

‘‘বলো, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের রবের। মানুষের অধিপতির। মানুষের মাবুদের’’। (সূরা নাস: ১-৩)

এখানে الرب অর্থ সৃষ্টির মালিক এবং তাদের মধ্যে কর্তৃত্বকারী। আর الإله অর্থ হবে সত্য মাবুদ, যিনি ইবাদতের একমাত্র হকদার।

কখনো উভয় প্রকার তাওহীদের একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়। তখন উভয়টি একই অর্থ প্রদান করে। যেমন কবরে নাকীর-মুনকার ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, من ربك তোমার প্রভু কে? এখানে ربك অর্থ হবে তোমরা মাবুদ ও স্রষ্টা কে? যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ﴾

‘‘যাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল, আল্লাহ আমাদের রব’’। (সূরা আল হজ: ৪০)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ﴾

‘‘বলো, আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো রবের সন্ধান করবো অথচ তিনিই সবকিছুর মালিক? (সূরা আল আন‘আম:১৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمْ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ﴾

‘‘নিশ্চয় যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে তাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে বলতে থাকে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমাদের মন চায় এবং তোমরা যা দাবী কর। এটা ক্ষমাশীল করুণাময়ের পক্ষ থেকে সাদর আপ্যায়ন। (সূরা হামীম সাজদাহ: ৩০-৩২)

রসূলগণ উপরোক্ত দু’প্রকার তাওহীদের মধ্য থেকে যে প্রকার তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, সেটা হলো তাওহীদুল উলুহীয়াহ। কেননা অধিকাংশ জাতিই তাওহীদুর রুবুবীয়াহকে স্বীকার করে নিয়েছে। অল্প সংখ্যক লোক কেবল ইহাকে অস্বীকার করেছে। তারাও আবার প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে। অন্তরে অন্তরে তারা স্রষ্টার অস্তিত্ব ও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করতো।

তবে শুধু রুবুবীয়াতকে স্বীকার করা মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ইবলীসও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করেছিল। সে বলেছিল,

﴿رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ﴾

‘‘হে আমার রব! তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করলে ঠিক তেমনিভাবে আমি পৃথিবীতে এদের জন্য প্রলোভন দেখিয়ে এদের সবাইকে বিপথগামী করবো’’। (সূরা আল হিজর: ৩৯)

মক্কার যেসব মুশরিকের নিকট আল্লাহ তা‘আলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন তারাও রুবুবীয়াতকে স্বীকার করেছিল। অনেক সুস্পষ্ট আয়াত এ কথা প্রমাণ করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾

‘‘আর যদি তোমরা এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদের সৃষ্টি করেছে তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)

সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু তাওহীদুর রুবুবীয়ার স্বীকৃতি প্রদান করলো সে মুসলিম হবে না। যতক্ষণ না সে তাওহীদুল উলুহীয়াতের স্বীকৃতি দিবে এবং এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে। তাওহীদুল উলুহীয়াতের স্বীকৃতি না দিলে তার জান-মাল নিরাপদ হবে না।

এর মাধ্যমে ঐসব সুফী ও যুক্তিবাদীদের বিভ্রান্তিকর ধারণা বাতিল প্রমাণিত হলো, যারা বলে বান্দাদের থেকে যে তাওহীদ উদ্দেশ্য তা হলো তারা কেবল এই স্বীকৃতি দিবে যে আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপক। যারা এ কথা স্বীকার করবে তারাই তাদের নিকট মুসলিম হিসাবে গণ্য হবে। এ জন্যই তারা আকীদা বিষয়ে যেসব কিতাব লিখেছে, তাতে তারা তাওহীদের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াতের উপর প্রযোজ্য হয়। তারা বলে, তাওহীদ হলো আল্লাহ আছে এ কথার স্বীকৃতি দেয়া, তিনিই রিযিক দাতা এবং তিনিই সৃষ্টিকর্তা.....। এরপর তারা শুধু তাদের কথার উপর রুবুবীয়াতের দলীলগুলো পেশ করে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যেসব যুক্তিবাদী আলেম তাদের ইলমে কালামের কিতাবসমূহে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা তাওহীদকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তারা বলে,

(১) আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সত্তায় একক। তার কোনো অংশ নেই।

(২) তিনি তার ছিফাতসমূহের ক্ষেত্রে একক। তার কোনো সদৃশ নেই এবং

(৩) তিনি তার কর্মসমূহে একক। তার কোনো শরীক নেই। এ তিন প্রকারের মধ্যে তাদের নিকট সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হলো আল্লাহ তা‘আলার কর্ম সম্পর্কিত তাওহীদ। তাহলো সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা মাত্র এক। তারা এর উপর التمانع এবং অন্যান্য দলীল পেশ করে থাকে।[1] তাদের ধারণায় এটিই হলো আসল তাওহীদ এবং এটিই আমাদের কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ। তারা সৃষ্টি করার উপর ক্ষমতা রাখাকেই উলুহীয়াতের অর্থ হিসাবে নির্ধারণ করেছে।

জানা কথা যে, আরবের যেসব মুশরিকের নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানো হয়েছিল, তারা এ বিষয়ে তার বিরোধীতা করেনি। বরং তারা স্বীকার করতো যে, আল্লাহ তা‘আলাই প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা। এমনকি তারা তাক্বদীরের প্রতিও ঈমান আনয়ন করতো। এরপরও তারা মুশরিকই ছিল। এই হলো শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার বক্তব্য। এখানে সুস্পষ্টভাবে ঐসব লোকের আকীদার প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বলে সৃষ্টির পক্ষ হতে কাঙ্খিত তাওহীদ হলো কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করা। কুরআনের এ আয়াতটি শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহর কথাকে সমর্থন করে।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’ (সূরা আন নাহাল ১৬:৩৬)।

রসূলগণ তাদের জাতিকে এটি বলেননি যে, তোমরা স্বীকার করো যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা। কেননা তারা আগে থেকেই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতো। এ জন্যই তারা বলেছেন,

﴿اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো (সূরা আন নাহল ১৬:৩৬)।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, রসূলগণ যে প্রকার তাওহীদ নিয়ে এসেছেন, তা হলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলুহীয়াত সাব্যস্ত করা। লোকেরা এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না। তিনি আরো বলেন, তাওহীদ বলতে শুধু তাওহীদুর রুবুবীয়াত উদ্দেশ্য নয়। তাওহীদুর রুবুবীয়াহ হলো এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করেছেন। সুফী এবং কালাম শাস্ত্রবিদরা এ রকমই মনে করে। তারা মনে করে, দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে যখন তা সাব্যস্ত করা হবে, তখন তারা সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক পরিপূর্ণ তাওহীদ সাব্যস্ত করেছে। তারা যখন এটি সাব্যস্ত করে এবং এর মধ্যে ফানা-বিলীন হয়ে যায়, তখন তারা সর্বোচ্চ তাওহীদের মধ্যেই ফানা-বিলীন হয়েছে বলে মনে করে।

কোনো মানুষ আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় ও উপযুক্ত ছিফাতগুলো সাব্যস্ত করলেই, তিনি নিজেকে যেসব ত্রুটিযুক্ত স্বভাব থেকে পবিত্র করেছেন, তা থেকে তার পবিত্রতার ঘোষণা দিলেই এবং এটি স্বীকার করলেই তাওহীদপন্থী মুসলিম হয়ে যায় না যে, আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা। যতক্ষণ পর্যন্ত এ সাক্ষ্য না দিবে যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, এটি স্বীকার না করবে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র মাবুদ হওয়ার যোগ্য, তিনিই বান্দাদের ইবাদতের একমাত্র হকদার এবং সে সঙ্গে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের পাবন্দী না হবে,  ততক্ষণ পর্যন্ত তাওহীদপন্থী মুসলিম বলে গণ্য হবে না।

إله অর্থ হলো সে মাবুদ, যিনি বান্দাদের ইবাদত পাওয়ার একমাত্র হকদার। সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়াই ইলাহ-এর অর্থ নয়। সুতরাং যারা إله -কে এভাবে ব্যাখ্যা করবে যে, তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম বা তিনি ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই, যারা বিশ্বাস করবে, এটিই ইলাহ এর সবচেয়ে বড় গুণ এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ অর্থ সাব্যস্ত করাই তাওহীদের মূল উদ্দেশ্য, তারা তাওহীদের হাকীকত বুঝতে পারেনি। যে তাওহীদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে পাঠিয়েছেন, তারা সেটা বুঝতে পারেনি। আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্তকারী কালাম শাস্ত্রবিদরা আবুল হাসান আশআরী ও তার অনুসারীর বরাত দিয়ে তাওহীদের উপরোক্ত ব্যাখ্যাই করে থাকে। আরবের মুশরিকরাও স্বীকার করতো যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই সবকিছু সৃষ্টিকারী। এটি স্বীকার করার পরও তারা মুশরিক ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ﴾

‘‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী অধিকাংশ মানুষ মুশরিক’’ (সূরা ইউসুফ: ১০৬)।

সালাফদের একদল আলেম বলেছেন, তাদেরকে যদি এ কথা জিজ্ঞাসা করা হয় আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা বলে, আল্লাহ। এ কথা স্বীকার করারও পরও তারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ لِمَنِ الأرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৪) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ (৮৫) قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ (৮৬) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ (৮৭) قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৮) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ﴾

‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তাহলে বলো, পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বসবাস করছে তারা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, সবই আল্লাহর। বলো, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ। বলো, তবুও কি তোমরা ভয় করবেনা? তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জেনে থাকো তাহলে বলো, কার হাতে সব বস্তুর কর্তৃত্ব? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তার মুকাবেলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয় বলবে এ বিষয়টি আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। বলো, তাহলে কোথা থেকে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে?’’ (সূরা মুমিনূন: ৮৪-৮৯)।

আল্লাহ তা‘আলাকে প্রত্যেক বস্ত্তর রব ও স্রষ্টা বলে স্বীকার করলেই মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী হয়ে যায় না এবং সবকিছু বাদ দিয়ে তার কাছে দু‘আকারী হয়ে যায় না। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা জন্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী কারী, আল্লাহ তা‘আলার জন্য শত্রুতা পোষণকারী এবং রসূলদের অনুসারী হয়ে যায় না। সব মুশরিকই আল্লাহ তা‘আলাকে স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার করেছে। কিন্তু যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে এবং যাদেরকে তার সমকক্ষ মনে করেছে তাদেরকে তারা আল্লাহর নিকট সুপারিশ ও মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, যারা কেবল রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করাকেই প্রকৃত তাওহীদ মনে করে তাদের অনুসারীদের মধ্য থেকে যারা সূর্য, চন্দ্র ও তারকাকে সেজদাহ করে, এগুলোকে আহবান করে, এদের জন্য সিয়াম রাখে, কুরবানী করে এবং তাদের নৈকট্য হাসিল করে অতঃপর বলে এটি শিরক নয়; বরং শিরক তখনই হবে, যখন আমি এ বিশ্বাস করবো যে, এরা আমার কাজকর্মের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। আমি যখন এগুলোকে মাধ্যম ও মধ্যস্থতাকারী মনে করবো তখন আমি শিরককারী হবো না। অথচ দীন ইসলামের সাধারণ জ্ঞান যার আছে, সে বুঝতে সক্ষম হবে যে, এ কাজ শিরক। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য এখানেই শেষ। আমি বলছি যে, বর্তমান সময়ের কবরপূজারীরা একই কথা বলে। বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে তারা কবরবাসীর নৈকট্য হাসিল করে এবং বলে এটি শিরক নয়। কেননা আমরা এ আকীদা পোষণ করিনা যে, কবরে সমাধিস্থ অলী-আওলীয়ারা সৃষ্টি ও তদবীর করতে পারে। আমরা কেবল কবরবাসীকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নির্ধারণ করি এবং তাদের উসীলা দেই মাত্র।

[1] . المنع শব্দের অর্থ التمانع এর মধ্যে বিদ্যমান। এটি কোনো জিনিস অর্জিত না হওয়া বা বাধা প্রদান করার অর্থ প্রদান করে। কুরআন ও হাদীছের কোথাও আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের ব্যাপারে التمانع শব্দের উল্লেখ না থাকলেও এর অর্থ কুরআনুল কারীমে উল্লেখ আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾

‘‘আল্লাহ কাউকে নিজের সন্তানে পরিণত করেননি এবং তার সাথে অন্য কোনো ইলাহও নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেতো এবং তারপর একজন অন্যজনের উপর চড়াও হতো। এরা যেসব কথা তৈরী করে তা থেকে আল্লাহ পাক-পবিত্র’’। (সূরা মুমিনুন: ৯১)

যুক্তিবিদরা আল্লাহ তা‘আলার একত্বের ব্যাপারে এটি উল্লেখ করে থাকে। ইমাম রাযি বলেন, কালাম শাস্ত্রবিদ একত্বের অনেক প্রমাণ উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হলো دليل التمانع অর্থাৎ এক সঙ্গে দুই স্রষ্টার ধারণা অসম্ভব হওয়ার দলীল।

 ইমাম বাকেলানী التمانع এর দলীলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সৃষ্টিজগতের দুই স্রষ্টা হওয়া অবৈধ। এর চেয়ে বেশী হওয়াও নিষেধ। কেননা দুইজন মতভেদ করতে পারে। একজন অন্যজনের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। পরস্পর মতভেদ করার সময় একজন যদি কোনো সৃষ্টিকে জীবিত রাখতে চায় এবং অন্যজন সেটাকে মৃত্যু দিতে চায়, তাহলে উভয়ই স্বীয় ইচ্ছা পুরণ করতে অক্ষম হবে অথবা তাদের একজনের উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না। জীবিত রাখা কিংবা মৃত্যু দেয়া যেহেতু পরস্পর বিপরীত দু’টি বিষয়, তাই একই সৃষ্টিতে একই  সময় একত্র হওয়া অসম্ভব। সুতরাং দুই স্রষ্টার দুই উদ্দেশ্য এক সাথে পুরণ হওয়া অথবা একজনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। যার উদ্দেশ্য পুরণ না হবে, সে অক্ষম বলে প্রমাণিত হবে। আর উভয়ের ইচ্ছা পুরণ না হলে উভয়ই অক্ষম স্রষ্টা বিবেচিত হবে। অক্ষম হওয়া সৃষ্টির বিশেষণ। অবিনশ্বর অনন্ত চিরন্তন সত্তার জন্য অক্ষম হওয়া অবৈধ। সুতরাং প্রমাণিত হলো সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা মাত্র একজন।  

اساليب القرأن في الدعوة إلى توحيد الألوهية - তাওহীদুল উলুহীয়ার দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে কুরআনের পদ্ধতি

ফিতরাত বা সৃষ্টিগত স্বভাবের দাবি ও সৃষ্টিজগতের নিদর্শনাবলী দেখেই মানুষ যখন তাওহীদুর রুবুবীয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করেছে, আর শুধু স্বীকৃতি প্রদানই যেহেতু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের জন্য যথেষ্ট নয় এবং স্বীকৃতি প্রদান কাউকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাবে না, তাই রসূলগণ তাওহীদুল উলুহীয়াতের দিকে দাওয়াত দেয়ার উপরে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে সর্বশেষ ও সর্বোত্তম রসূল আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়টির উপর সবেচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি মানুষকে لاإله إلا الله বলার দাবি জানাতেন। এর দাবি হলো একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং তিনি ছাড়া অন্যের ইবাদত বর্জন করা। লোকেরা তার কথা শুনে দূরে চলে যেতো। তারা বলেছিল,

﴿أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ﴾

‘‘সে কি বহু মাবুদকে এক মাবুদে পরিণত করে দিয়েছে? নিশ্চয় এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদ: ৫)

তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দাওয়াত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে এবং তাদেরকে মূর্তিপূজার উপর ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এই জন্য তারা সকল প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কখনো তারা লোভ দেখিয়েছে আবার কখনো ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছে। তিনি বলতেন আল্লাহর কসম! তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় এবং এর বিনিময়ে আমাকে এ দীনের দাওয়াত ছেড়ে দিতে বলে, তাতেও আমি সম্মত হবো না। আল্লাহ তা‘আলা এ দীনকে বিজয়ী না করা পর্যন্ত অথবা আমরণ আমি এ দাওয়াত চালিয়ে যাবো।

তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দেয়ার আদেশসহ এবং মুশরিকদের সন্দেহগুলোর প্রতিবাদে কুরআনের আয়াতগুলো তার উপর নাযিল হতো। তাতে তাদের দীনের অসারতা প্রমাণের জন্য দলীল-প্রমাণও কায়েম করা হতো। তাওহীদুল উলুহীয়াতের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে কুরআনে অনেক পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্য থেকে আমরা এখানে কয়েকটি পদ্ধতি উল্লেখ করবো:

    আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র তার ইবাদত করা এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত বর্জন করার আদেশ দিয়েছে।

সূরা আন নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا﴾

‘‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। আর তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না’’।


আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,  

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (২১) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

‘‘হে মানব জাতি। ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, এভাবেই তোমরা নিষ্কৃতি লাভের আশা করতে পারো। তিনিই তোমাদের জন্য মাটিকে বিছানা স্বরূপ বিছিয়েছেন, আকাশকে ছাদ স্বরূপ করেছেন, আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে সব রকমের ফসলাদি উৎপন্ন করে তোমাদের আহার যুগিয়েছেন। অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না’’। (সূরা আল বাকারা: ২১-২২)

(২) কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি জিন-ইনসানকে একমাত্র তার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ﴾

‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬)।

 (৩) কুরআন সংবাদ দিয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত রসূলকে একমাত্র তার দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্য এবং তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করতে নিষেধ করার জন্য পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন নাহাল: ৩৬)

(৪) তিনিই একমাত্র রব, স্রষ্টা এবং ব্যবস্থাপক বলে সংবাদ দেয়ার মাধ্যমে তাওহীদুল উলুহীয়ার উপর দলীল পেশ করেছেন। যেমন একটু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ﴾

‘‘হে মানব জাতি। ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্বে যারা অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন’’ (সূরা আল বাকারা:২১)।

 

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُلَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ﴾

‘‘রাত-দিন এবং চন্দ্র ও সূর্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। সূর্য ও চাঁদকে সিজদা করো না, সে আল্লাহকে সিজদা করো যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, যদি সত্যিই তোমরা তার ইবাদতকারী হয়ে থাকো’’। (সূরা হামীম সাজদা: ৩৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿أَفَمَن يَخْلُقُ كَمَن لَّا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾

 ‘‘যে সৃষ্টি করেন এবং যে কিছুই সৃষ্টি করে না তারা উভয় কি সমান? তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?’’ (সূরা আন নাহাল: ১৭)

(৫) তিনিই একমাত্র পূর্ণ গুণ দ্বারা বিশেষিত হওয়া এবং মুশরিকদের মাবুদদের মধ্য থেকে সেটা নাকোচ করার মাধ্যমে তার ইবাদত আবশ্যক হওয়ার দলীল প্রদান করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿رَّبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا﴾

‘‘তিনি আসমান ও যমীন এবং এ দুয়ের মাঝখানের সবকিছুর রব। কাজেই তুমি তার ইবাদত করো এবং তার ইবাদতের উপর অবিচল থাকো। তোমার জানা মতে তার সমকক্ষ কোনো সত্তা আছে কি? (সূরা মারইয়াম: ৬৫)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,

﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾  

‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো সুন্দরতম নাম রয়েছে। সুতরাং তাকে সেই নামেই ডাকো এবং তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা করে আসছে, তার ফল অবশ্যই তারা পাবে’’।

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলেন,

﴿إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنكَ شَيْئًا﴾

‘‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা যখন ইবরাহীম নিজের বাপকে বললো, আববাজান! আপনি কেন এমন জিনিষের ইবাদত করেন, যা শোনেও না দেখেও না এবং আপনার কোনো উপকারও করতে পারে না?’’ (সূরা মারইয়াম: ৪২)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴾ ﴿إِن تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ

‘‘তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পারে না এবং শুনলেও তোমাদের কোনো জবাব দিতে পারে না’’। (সূরা ফাতির: ১৪)


আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَاتَّخَذَ قَوْمُ مُوسَىٰ مِن بَعْدِهِ مِنْ حُلِيِّهِمْ عِجْلًا جَسَدًا لَّهُ خُوَارٌ أَلَمْ يَرَوْا أَنَّهُ لَا يُكَلِّمُهُمْ وَلَا يَهْدِيهِمْ سَبِيلًا اتَّخَذُوهُ وَكَانُوا ظَالِمِينَ﴾

‘‘ মূসার অনুপস্থিতিতে তার জাতির লোকেরা নিজেদের অলংকার দিয়ে বাছুরের মূর্তি তৈরী করলো। তার মুখ দিয়ে গরুর মতো হাম্বা রব বের হতো। তারা কি দেখতে পেতো না যে, ঐ বাছুর তাদের সাথে কথা বলে না আর কোনো ব্যাপারে তাদেরকে পথ নির্দেশনাও দেয় না? কিন্তু এরপরও তাকে মাবুদে পরিণত করলো। বস্তুত তারা ছিল বড়ই যালেম’’। (সূরা আরাফ: ১৪৮)

(৬) মুশরিকদের মাবুদদের অক্ষমতা বর্ণনা করার মাধ্যমে নিজের তাওহীদের দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَيُشْرِكُونَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَسْتَطِيعُونَ لَهُمْ نَصْرًا وَلَا أَنْفُسَهُمْ يَنْصُرُونَ﴾

‘‘তারা কি আল্লাহর সাথে এমন সব বস্তুকে শরীক করে, যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনা? বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট হয়। আর তারা না তাদেরকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারে, না নিজেদের সাহায্য করতে পারে’’। (সূরা আরাফ: ১৯১-১৯২)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইসরার ৫৬ নং আয়াতে বলেন,

﴿قُلِ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم مِّن دُونِهِ فَلاَ يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنكُمْ وَلاَ تَحْوِيلاً﴾

‘‘বলো, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে করো, তারা তো তোমাদের কষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখেনা এবং তা পরিবর্তনও করতে পারে না’’।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাহালের ৭৩ নং আয়াতে বলেন,

﴿وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَهُمْ رِزْقًا مِّنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ شَيْئًا وَلَا يَسْتَطِيعُونَ﴾

‘‘আর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব বস্তুর পূজা করে যারা আসমান ও যমীন থেকে তাদের কিছু রিযিক দেবার ক্ষমতা রাখে না’’।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা হজ্জের ৩৭ নং আয়াতে বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَاباً وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئاً لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ﴾

‘‘হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা করো, তারা কখনো একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই অসহায়’’।

(৭) যেসব মুশরিক আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যসব বস্ত্তর ইবাদত করে, তাদেরকে তিনি মূর্খ বলে উল্লেখ করেছেন। ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম শিরকের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْ أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾

‘‘ইবরাহীম বললো, তোমরা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমনসব জিনিসের পূজা করছো যারা তোমাদের না উপকার করতে পারে, আর না করতে পারে ক্ষতি? ধিক তোমাদেরকে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব উপাস্যের তোমরা পূজা করছো তাদেরকে। তোমাদের কি বুদ্ধি নেই?’’ (সূরা আম্বীয়া: ৬৬-৬৭) ।

আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন,

    ﴿وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ﴾

‘‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে আল্লাহকে ছাড়া এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবেনা। তারা তো তাদের দু‘আ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আহকাফ: ৫-৬)

(৮)  যেসব মুশরিক আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করে, তিনি তাদের শাস্তি বর্ণনা ও পরিণাম বর্ণনা করেছেন। তারা যাদের ইবাদত করে, তারাও তাদের পরিণতি ভোগ করবে। কিয়ামতের কঠিন ময়দানে এ মাবুদগুলো তাদের অনুসারীদের থেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি ঘোষণা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ (১৬৬) وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ﴾

‘‘যালেমরা যা কিছু অনুধাবন করার তা যদি আজ অনুধাবন করতো যে, সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর অধীন এবং শাস্তি ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর। যখন তিনি শাস্তি দেবেন তখন এ সমস্ত নেতা ও প্রধান ব্যক্তিরা, দুনিয়ায় যাদের অনুসরণ করা হতো, তাদের অনুগামীদের সাথে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করতে থাকবে। কিন্তু শাস্তি তারা পাবেই এবং তাদের সমস্ত উপায়- উপকরণের ধারা ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যেসব লোক দুনিয়ায় তাদের অনুসারী ছিল তারা বলতে থাকবে, হায়! যদি আমাদের আর একবার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আজ এরা যেমন আমাদের সাথে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করছে তেমনি আমরাও এদের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে যেতাম। এরা যে সমস্ত কাজ করছে সেগুলো আল্লাহ তাদের সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবেন যাতে তারা কেবল আক্ষেপই করতে থাকবে কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে তারা বের হতে পারবেনা। (সূরা আল বাকারা: ১৬৫-১৬৭)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ﴾

‘‘কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। বসত্মুত আল্লাহর ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবে না’’। (সূরা ফাতির: ১৩-১৪)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ﴾

‘‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছাড়া এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবেনা। তারা তো তাদের দু‘আ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আহকাফ: ৫-৬)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلَائِكَةِ أَهَؤُلَاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ (৪০) قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيُّنَا مِنْ دُونِهِمْ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجِنَّ أَكْثَرُهُمْ بِهِمْ مُؤْمِنُونَ﴾

‘‘যেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন এবং ফেরেশতাদেরকে বলবেন, এরা কি তোমাদেরই পূজা করত? ফেরেশতারা বলবে, আপনি পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত আপনিই আমাদের বন্ধু; বরং তারা জিনের পূজা করত। তাদের অধিকাংশই ছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসী’’। (সূরা সাবা: ৪০-৪১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ﴾

‘‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করো? ঈসা বলবেন, আপনি পবিত্র। আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে তুমি অবশ্যই পরিজ্ঞাত; তুমি তো আমার মনের কথাও জান এবং আমি জানি না যা তোমার মনের মধ্যে রয়েছে। নিশ্চয় তুমি অদৃশ্য বিষয়ে পরিজ্ঞাত’’। (সূরা মায়িদা: ১১৬)

(৯) মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের মধ্যে যে মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারী নির্ধারণ করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিবাদ করেছেন। তাদের প্রতিবাদ এভাবে করা হয়েছে যে, শাফা‘আতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো কাছে শাফা‘আত চাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ তার নিকট শাফা‘আত করতে পারবে না। সে সঙ্গে যার জন্য সুপারিশ করা হবে তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি থাকা অপরিহার্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَمِ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ قُل لِّلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا﴾

‘‘তবে কি ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে সুপারিশকারী বানিয়ে রেখেছে? বলো, তাদের কোনো ক্ষমতা যদি নাও থাকে এবং তারা কিছু না বুঝলেও কি সুপারিশ করবে? বলো, সমস্ত শাফা‘আত কেবল আল্লাহরই মালিকানাধীন’’। (সূরা যুমার: ৪৩-৪৪)

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,

﴿مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾

‘‘তার অনুমতি ব্যতীত তার নিকট কে শাফা‘আত করতে পারে?’’ (সূরা আল বাকারা: ২৫৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى﴾

‘‘আকাশমণ্ডলে এমন অনেক ফেরেশতা রয়েছেন, যাদের শাফা‘আত কোনো কাজেই আসবে না, তবে আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশী তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিলে সে কথা ভিন্ন। (সূরা আন নাজম: ২৬)

আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতগুলোতে বর্ণনা করেছেন যে, শাফা‘আত একমাত্র তারই মালিকানাধীন। সেটা তার নিকটেই চাইতে হবে। শাফা‘আতকারীকে সুপারিশের অনুমতি দেয়ার আগে এবং যার জন্য শাফা‘আত করা হবে, তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি না থাকলে সেটা অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।

(১০) তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীমের আরেকটি পদ্ধতি হলো, আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন যে, তাকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদের ইবাদত করা হচ্ছে কোনভাবেই এসব মাবুদ তাদের অনুসারীদের উপকার করতে পারবে না। সুতরাং যে তার অনুসারীর উপকার করতে পারে না, সে উপাস্য হওয়ার যোগ্য নয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ﴾

    হে নবী! বলো, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে করো, তাদেরকে আহবান করো। তারা নভোম-ল ও ভূমণ্ডলের অণু পরিমাণ বস্তুরও মালিক নয়, এতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহর সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, সে ব্যতীত আল্লাহর কাছে অন্য কারো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না। (সূরা সাবা: ২২)

(১১) তার মধ্য থেকে আরেকটি পদ্ধতি হলো, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এমন অনেক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, যার দ্বারা মুশরিকদের শিরক বাতিল হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾

‘‘এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে নিক্ষেপ করল’’। (সূরা আল হজ: ৩১)

উচ্চতা, প্রশস্ততা এবং মান-মর্যাদার দিক থেকে আল্লাহ তা‘আলা এখানে তাওহীদকে আসমানের সাথে তুলনা করেছেন এবং তাওহীদ বর্জনকারীকে আসমান থেকে যমীনের সর্বনিমণস্তরে নিপতিত ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা সে ঈমানের শীর্ষস্থান থেকে কুফরীর সর্বনিমণস্তরে পড়ে গেছে। যে শয়তান তাকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়, তাকে এমন পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তার যে প্রবৃত্তি তাকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে সেটাকে ঐ বাতাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা তাকে দূরবর্তী কোনো স্থানে নিক্ষেপ করে। শিরকের অসারতা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে মুশরিকদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ব্যাপারে কুরআনে যেসব দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে এটি অন্যতম।[1]

তাওহীদুল উলুহীয়াতের দাওয়াত দিতে গিয়ে এবং শিরকের অসারতা বর্ণনায় কুরআনুল কারীম যেসব দৃষ্টান্ত ও উপমা পেশ করেছে, তার মধ্য থেকে আমরা এখানে যা উল্লেখ করলাম, তা খুবই অপ্রতুল। মুসলিমদের উচিত চিন্তা-গবেষণার সাথে কুরআন পড়া। তাতেই সে অনেক কল্যাণ, সন্তোষজনক দলীল এবং এমন উজ্জ্বল প্রমাণাদি খুঁজে পাবে, যা মুমিনের অন্তরে তাওহীদের বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করবে এবং তা থেকে শিরকের সকল সন্দেহের মূলোৎপাটন করবে। ইনশা-আল্লাহ।


[1] . শির্কের অসারতা ও মুশরিকদের মূর্খতা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আরো কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَنْ يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِنْ يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَا يَسْتَنْقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ﴾

‘‘হে লোক সকল! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে শোনো, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব উপাস্যকে তোমরা ডাকো তারা সবাই মিলে একটি মাছি সৃষ্টি করতে চাইলেও করতে পারবে না। বরং মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাহলে তারা তা ছাড়িয়েও নিতে পারবে না। সাহায্য প্রার্থীও দুর্বল এবং যার কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে সেও দুর্বল। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا عَبْدًا مَمْلُوكًا لَا يَقْدِرُ عَلَى شَيْءٍ وَمَنْ رَزَقْنَاهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ سِرًّا وَجَهْرًا هَلْ يَسْتَوُونَ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (75) وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلَيْنِ أَحَدُهُمَا أَبْكَمُ لَا يَقْدِرُ عَلَى شَيْءٍ وَهُوَ كَلٌّ عَلَى مَوْلَاهُ أَيْنَمَا يُوَجِّهْهُ لَا يَأْتِ بِخَيْرٍ هَلْ يَسْتَوِي هُوَ وَمَنْ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَهُوَ عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ﴾

‘‘আল্লাহ একটি উপমা দিচ্ছেন, একজন গোলাম, যে অন্যের অধিকারভুক্ত এবং নিজেও কোনো ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়জন এমন এক ব্যক্তি যাকে আমি নিজের পক্ষ থেকে ভালো রিযিক দান করেছি এবং সে তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে। বলো, এরা দু’জন কি সমান? আলহামদু লিল্লাহ, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। আল্লাহ আরেকটি উপমা দিচ্ছেন। দুজন লোক, একজন বধির ও বোবা, কোনো কাজ করতে পারে না। নিজের প্রভুর ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে আছে। যে দিকেই তাকে পাঠায় সে ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারে না। দ্বিতীয়জন ইনসাফের হুকুম দেয় এবং নিজে সত্য সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত আছে। বলো, এরা দু’জন কি সমান?’’ (সূরা নাহাল: ৭৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ (13) إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ﴾

তাকে বাদ দিয়ে অন্য যাদেরকে তোমরা ডাকছো তারা তো একটি খেজুরের বীচির উপরের পাতলা পর্দার অধিকারীও নয়। তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পারে না এবং শুনলেও তোমাদের কোনো জবাব দিতে পারে না এবং কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। প্রকৃত অবস্থান এমন সঠিক খবর একজন সর্বজ্ঞ ছাড়া কেউ তোমাদের দিতে পারে না’’। (সূরা ফাতির: ১২-১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ فَادْعُوهُمْ فَلْيَسْتَجِيبُوا لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ﴾

‘‘তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকো তারা তো তোমাদের মতই বান্দা। তাদের কাছে দু‘আ করে দেখো, তাদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তারা তোমাদের আহবানে সাড়া দিক’’। (সূরা আরাফ: ১৯৪)

﴿مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সা, যে ঘর তৈরী করে। আর ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো সবচেয়ে দুর্বল। যদি তারা জানতে পারতো’’। (সূরা আনকাবুত: ৪১)

حدوث الشرك في توحيد الألوهية - তাওহীদুল উলুহীয়াতের মধ্যে শিরক শুরু হলো কখন থেকে?

মুসলিমের উচিত, হক্ব জানার পর তার বিপরীতে যে বাতিল রয়েছে, তাও জানবে। যাতে করে সে বাতিল বর্জন করতে পারে এবং সেটা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে। যেমন বলা হয়,

عرفت الشر لا للشر لكن لتوقيه ومن لا يعرف الشر من الخير يقع فيه

অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্যই আমি সেটা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছি। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণ সম্পর্কে জানতে পারেনি, সে তাতে লিপ্ত হবেই।

হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

كان الناس يسألون رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الخير، وكنت أسأله عن الشر؛ مخافة أن أقع فيه

‘‘লোকেরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত। আর আমি তাকে অকল্যাণ ও অমঙ্গল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। এ আশঙ্কায় যে, আমাকে তা পেয়ে বসে কি না’’।[1]

এ জন্যই আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,

يوشك أن تنقض عرى الإسلام عروة عروة إذا نشأ في الإسلام من لا يعرف الجاهلية

 অচিরেই ইসলামের বন্ধন (হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান) একটি একটি করে খুলে ফেলা হবে। বিশেষ করে যখন ইসলামের মধ্যে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুফর ও শিরক সম্পর্কে অজ্ঞ হবে।

ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালামও তার সন্তানদের মধ্যে শিরক ও মূর্তিপূজা অনুপ্রবেশ করার আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন যে,

﴿رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ﴾

‘‘হে আমার রব! এ শহরকে তুমি নিরাপদ করো এবং আমাকে ও আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করো। হে আমার প্রতিপালক, এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে’’ (সূরা ইবরাহীম: ৩৫)।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শিরক থেকে বিরত থাকা আবশ্যক এবং সেটা থেকে বাঁচার জন্য সেটার পরিচয় জানা থাকাও আবশ্যক।


[1]. সহীহ বুখারী হা/৩৬০৬, ৭০৮৪, সহীহ মুসলিম হা/১৮৪৭, আবূ দাউদ হা/৪২৪৪।

ইবাদতের প্রকারসমূহ থেকে কোনো কিছু আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সম্পাদন করাকে শিরক বলে। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু‘আ করা, গাইরুল্লাহর জন্য কুরবানী করা, মানত করা এবং এমন বিষয়ে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নিকট উদ্ধার কামনা করা, যা থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ রাখে না। আর তাওহীদ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য ইবাদতকে নির্দিষ্ট করা।

তাওহীদ বনী আদমের মূল বিষয়। পরে তাদের মধ্যে শিরক প্রবেশ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ﴾

‘‘প্রথমে সব মানুষ একই পথের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে যখন মতভেদ শুরু হলো তখন আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন। তারা ছিলেন সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং বেঠিক পথ অবলন্বনের পরিণতির ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শনকারী। আর তাদের সাথে সত্য কিতাব পাঠান, যাতে সত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তার মীমাংসা করা যায়’’। (সূরা আল বাকারা: ২১৩)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতি পর্যন্ত একহাজার বছরের ব্যবধান ছিল। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সকল মানুষই তাওহীদের উপর ছিল। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথাটি সঠিক। ইমাম ইবনে কাছীরও এ কথাকে সহীহ বলেছেন। অতঃপর নূহ (আ.) এর জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম শিরকের আবির্ভাব হয়। কতিপয় সৎ লোককে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই তাদের মধ্যে শিরক প্রবেশ করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا﴾

‘‘কাফেররা বলল, তোমরা নিজেদের মাবুদগুলোকে পরিত্যাগ করো না। বিশেষ করে ‘ওয়াদ’, ‘সুআ’, ‘ইয়াগুছ’ ‘ইয়াঊক’ এবং ‘নাসর’কে কখনও পরিত্যাগ করো না’’। (সূরা নূহ: ২৩)

সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এগুলো হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালামের গোত্রের কতিপয় সৎ ব্যক্তির নাম। তারা যখন মৃত্যুবরণ করল, তখন শয়তান তাদের কওমকে বুঝিয়ে বলল, যেসব জায়গায় তাদের মজলিস বসতো, সেসব জায়গাতে তাদের মূর্তি স্থাপন করো এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের নামেই মূর্তিগুলোর নামকরণ করো। তখন তারা তাই করল। তাদের জীবদ্দশায় মূর্তিগুলোর পূজা করা হয়নি ঠিকই; কিন্তু মূর্তি স্থাপনকারীরা যখন মৃত্যু বরণ করল এবং পরবর্তীরা মূর্তি স্থাপনের ইতিহাস ভুলে গেল, তখনই মূর্তিগুলোর ইবাদত শুরু হলো।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, অনেক সালাফ বলেছেন, যখন সৎ লোকগুলো মারা গেল, তখন তারা তাদের কবরগুলোর উপর অবস্থান করতে লাগল। অতঃপর তারা তাদের মূর্তি বানালো। অতঃপর যখন বহু সময় পার হলো, তখন তারা সেগুলোর ইবাদত শুরু করলো।

সৎ লোকদেরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, তাদের ছবি নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা, সেগুলোকে তাদের মজলিসে স্থাপন করার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তা থেকে আমরা ছবি নির্মাণ করা, সেটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা, মাঠে-ময়দানে ও রাজপথে সেটা স্থাপন করার ভয়াবহতা অনুভব করতে পারি। এগুলো মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। এ ছবিগুলো এবং রাজপথে ও মাঠে-ময়দানে স্থাপিত মূর্তিগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এমনভাবে বাড়তে থাকে যে, এক সময় এগুলোর ইবাদত শুরু হয়ে যায়। যেমন হয়েছিল নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের মধ্যে।

এ জন্যই ইসলামে ছবি অঙ্কন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছবি অংকনকারীকে অভিশাপ করেছেন এবং তাকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। আর ছবি অঙ্কনের মাধ্যমে যাতে এ উম্মতের মধ্যে শিরক প্রবেশ করতে না পারে, তাই এ দরজাকে বন্ধ করার জন্য এবং আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সাদৃশ্য করা থেকে দূরে রাখার জন্যই বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন ছবি অংকনকারীরাই সবচেয়ে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হবে।

নূহ আলাইহিস সালামের জাতির বিভ্রান্তির ঘটনা থেকে আমরা পথভ্রষ্ট করা ও তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করার ক্ষেত্রে অভিশপ্ত শয়তানের সুদূর প্রসারি চেষ্টা ও আগ্রহের কথা জানতে পারলাম। মানুষকে গোমরাহ করার জন্য সে কখনো তাদের আবেগ ও সহানুভূতিকে কাজে লাগায় এবং তাদেরকে ভালো কাজে উৎসাহ দেয়ার বেশ ধরে। সে যখন নূহ আলাইহসি সালামের জাতির লোকদের মধ্যে সৎ লোকদের প্রতি প্রচুর ভালোবাসা দেখতে পেলো, তখন এতে আরো বাড়াবাড়ি করার আহবান জানালো। তাদেরকে সৎ লোকদের স্মরণার্থে ছবি স্থাপন করার আদেশ দিলো। এতে ইবলীসের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে ধীরে ধীরে হক থেকে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যাওয়া। সে শুধু তার সামনে উপস্থিত লোকদেরকেই গোমরাহ করে ক্ষ্যান্ত হতে চায়নি; বরং পরবর্তীতে আগমনকারী স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী ও মূর্খতায় আচ্ছন্ন প্রজন্মকেও গোমরাহ করার সুদূর প্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেছিল। সুতরাং সে তাদের জন্য এ ছবিগুলোর ইবাদত করাকে সুশোভিত করে দেখালো এবং শির্কে আকবারে লিপ্ত করে ছাড়লো। তারা তাদের নবী নূহের সাথে এ বলে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করলো, لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ ‘‘তোমরা নিজেদের মাবুদগুলোকে পরিত্যাগ করো না’’।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, শয়তান মুশরিকদেরকে নিয়ে বিভিন্ন রকম খেল-তামাশা  করে এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত করে। প্রত্যেক জাতির বিবেক-বুদ্ধি অনুপাতে তার খেল-তামাশা হয় বিভিন্ন রকম।

মৃত মানুষের ছবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে শয়তান কোনো কোনো সম্প্রদায়কে তার নিজের ইবাদতের আহবান জানায়। যেমনটি নূহ আলাইহিস সালামের জাতির মধ্যে লক্ষ্যণীয়। সাধারণ মুশরিকদের গোমরাহির কারণ এটিই। আর বিশিষ্ট ও অভিজাত শ্রেণীর মুশরিকরা তাদের ধারণারূপ সৃষ্টিজগতে প্রভাব বিস্তারকারী তারকাসমূহের আকৃতিতে মূর্তি বানিয়ে সেগুলোর উপাসনা করতো। এগুলোর জন্য তারা ঘর তৈরি করতো, দারোয়ান নিযুক্ত করতো, তাদের সামনে পর্দা ঝুলিয়ে রাখতো এবং তাদের জন্য কোরবানি পেশ করতো। পৃথিবীতে এগুলো অতীত ও বর্তমানের সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়। বেদীন মুশরিকদের থেকে এ প্রথাগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এরা ছিল ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গোত্রের ঐসব লোক, শিরকের অসারতা বর্ণনা করার জন্য ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বিতর্কে নেমেছিলেন। আর তিনি তার ইলমের মাধ্যমে মুশরিকদের দলীল-প্রমাণগুলো খ-ন করেছিলেন এবং স্বীয় হাত দিয়ে তাদের বাতিল মাবুদগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছিলেন। এর কারণে মুশরিকরা তাকে আগুনে পুড়ে হত্যা করার দাবি জানিয়েছিল।

আরেক শ্রেণীর মুশরিক রয়েছে, যারা চন্দ্রের আকৃতিতে মূর্তি বানিয়েছে। তাদের ধারণা চন্দ্র তাদের ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। তাদের ধারণা মতে নিমণজগত চন্দ্রের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাধীন।

তাদের আরেক শ্রেণী আগুনের পূজা করে। এরা হলো অগ্নিপূজক। আরেক শ্রেণীর লোক পানির ইবাদত করে। কেউ আবার জীব-জানোয়ারের উপাসনা করে। কেউ ঘোড়ার, কেউ গরুর, কেউ জীবিত মানুষের ইবাদত করে, কেউ মৃত মানুষের ইবাদত করে, কেউ জিনের ইবাদত করে, কেউ গাছের ইবাদত করে আবার আরেক শ্রেণীর লোক ফেরেশতাদের ইবাদত করে থাকে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর অর্থ জানা গেল,

﴿وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾  

এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে নিক্ষেপ করল’’। (সূরা হজ্জ: ৩১)

আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর অর্থও জানা গেল, তিনি বলেন,

  ﴿يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘হে আমার জেলখানার সাথীরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো, বহু সংখ্যক রব উত্তম, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে এমন কতগুলো নামের ইবাদত করে থাকো, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ এদের কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম করার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না। এটিই সঠিক দীন। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’’। (সূরা ইউসুফ: ৩৯-৪০)

আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর অর্থও বুঝা গেল, তিনি বলেন,

﴿ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلًا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। একজন ক্রীতদাস লোকের মনিব অনেক, যারা তাতে পরস্পর কলহপ্রিয় শরীক এবং আরেক ব্যক্তির মনিব কেবল একজন। তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না’’। (সূরা আয যুমার: ২৯)

এ মুশরিকরা যখন এক আল্লাহ তা‘আলার সে ইবাদত বর্জন করেছে, যার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যাতেই তাদের সৌভাগ্যের বিষয়টি নিহিত রয়েছে তখন তারা শয়তানের ইবাদত করার ফিতনায় পড়েছে। প্রবৃত্তির প্ররোচনায় পড়ে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। যেমন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

هربوا من الرق الذي خلقوا له + فبلوا برق النفس والشيطان

যার দাসত্ব করার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দাসত্ব বর্জন করে তারা এখন নাফ্স ও শয়তানের ইবাদতের ফিতনায় পড়েছে। সুতরাং তাওহীদ ব্যতীত মানুষের অন্তরসমূহ এক হবে না এবং পৃথিবীর মানুষগুলো সংশোধনও হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَمِ اتَّخَذُوا آلِهَةً مِّنَ الْأَرْضِ هُمْ يُنشِرُونَ لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾

‘‘এরা যমীন হতে যেসব উপাস্য গ্রহণ করেছে সেগুলো কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম? নভোম-ল ও ভূমণ্ডলে যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকতো, তাহলে আসমান-যমীন ধ্বংস হয়ে যেতো। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র’’। (সূরা আম্বীয়া: ২১-২২)

এ জন্যই যখন পৃথিবী তাওহীদ মুক্ত হবে, তখনই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। যেমন ইমাম মুসলিম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لَا يُقَالَ فِي الْأَرْضِ اللَّهُ اللَّهُ

‘‘পৃথিবীতে যতদিন আল্লাহ আল্লাহ বলা হবে ততোদিন কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না’’।[1]

পূর্বকালের মুশরিকরা যেমন তাদের ইবাদত ও মাবুদগুলো নিয়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছিল, আজও কবরপূজারীরা কবরের ইবাদত নিয়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত। তাদের প্রত্যেকেরই একটি করে খাস সমাধি রয়েছে, যে বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে সেটার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। প্রত্যেক সুফী তরীকার একজন করে শাইখ আছেন, যাকে মুরীদরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের রব হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তাদের রব এমন দীনের প্রবর্তন করে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোনো অনুমতি নেই।

 এভাবেই শয়তান বনী আদমের সাথে খেল-তামাশা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের উপায় অবলম্বন ছাড়া, তার কিতাব ও তার রসূলের সুন্নাতকে মজবুতভাবে ধারণ করা ব্যতীত শয়তানের চক্রান্ত ও প্ররোচনা ছাড়া মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।


আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি তিনি যেন আমাদের সামনে সত্যকে সত্য হিসাবে তুলে ধরেন এবং সেটার অনুসরণ করার তাওফীক দেন। আর বাতিলকে বাতিল হিসাবে আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দেখান এবং আমাদেরকে যেন সেটা থেকে দূরে রাখেন। তিনিই আমাদের অভিভাবক। তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক, কতই না উত্তম সাহায্যকারী।


[1] . মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।

خطر الشرك ووجوب الحذر منه بتجنب أسبابه - শিরকের ভয়াবহতা এবং যেসব বিষয় মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়, তা বর্জন করার মাধ্যমে শিরক থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক

শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, যারা শিরক থেকে তাওবা করবে না, তিনি তাদের জন্য ক্ষমার কোনো ব্যবস্থা রাখেননি। অথচ আল্লাহ তা‘আলা নিজের উপর রহমত করাকে আবশ্যক করেছেন। শিরকের অবস্থা যেহেতু এরকমই এবং তা যেহেতু সর্বাধিক বড় গুনাহ, তাই বান্দার উপর আবশ্যক হলো শিরক থেকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা এবং সেটাকে খুব ভয় করবে। শিরক থেকে বাঁচার জন্য সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে। কেননা সর্বাধিক নিকৃষ্ট গুনাহ এবং সবচেয়ে বড় যুলুম। লুকমান আলাইহিস সালাম স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾

‘‘হে প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা যুলুম’’। (সূরা লুকমান: ১৩)

শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ হওয়ার কারণ হলো এতে আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মর্যাদা কমানো হয় এবং অন্যকে আল্লাহ তা‘আলার সমান করে দেয়া হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ﴾

অতঃপর কাফেররা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে। (সূরা আল আনআম: ১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,  

﴿فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সাথে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। (সূরা আল বাকারা: ২২)

আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশ্যে মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, শিরক সে উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং আল্লাহ তা‘আলাই যে হুকুম করার একমাত্র মালিক, শিরক তারও পরিপন্থী। শিরক করার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সাদৃশ্য করা হয়। অভাবী অক্ষম সৃষ্টিকে ক্ষমতাবান এবং সৃষ্টি থেকে অভাবমূক্ত অমুখাপেক্ষী সত্তার সাথে তুলনা করা সর্বনিকৃষ্ট সাদৃশ্য স্থাপন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে শিরক থেকে সাবধান করেছেন এবং শিরকের দিকে নিয়ে যায় এমন সমস্ত পথ বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছেন, তখন আরবের অবস্থা এমনকি অল্প সংখ্যক আহলে কিতাব ব্যতীত সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসীর অবস্থা ছিল খুব নিকৃষ্ট।


আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

   ﴿لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾

‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি তাদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়ে বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তার আয়াতসমূহ তাদেরকে পাঠ করে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৬৪)

এ সময় মানুষ সঠিক পথের দিশা হারিয়ে মূর্তিপূজার মধ্যে ডুবে ছিল। তারা পাথর খোদাই করে নির্মিত মূর্তিকে এবং মাঠে-ময়দানে স্থাপিত ভাস্কর্যকে তাদের মাবুদ হিসাবে গ্রহণ করতো। ইবাদতের নিয়তে তারা এগুলোর উপর অবস্থান করতো, এগুলোর চারপাশে তাওয়াফ করতো, এগুলোর জন্য তাদের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ থেকে কোরবানী করতো। এমনকি তারা তাদের সন্তা-সন্ততিও উৎসর্গ করতো।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿وَكَذَٰلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٍ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ قَتْلَ أَوْلَادِهِمْ شُرَكَاؤُهُمْ لِيُرْدُوهُمْ وَلِيَلْبِسُوا عَلَيْهِمْ دِينَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ﴾

‘‘আর এভাবেই বহু মুশরিকের জন্য তাদের শরীকরা নিজেদের সন্তান হত্যা করাকে সুশোভিত করে দিয়েছে, যাতে তাদেরকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করতে এবং তাদের দীনকে তাদের কাছে সংশয়িত করে তুলতে পারে। আল্লাহ চাইলে তারা এমনটি করতে পারতো না। কাজেই তাদেরকে ছেড়ে দাও। তারা নিজেদের মিথ্যা রচনায় ডুবে থাকে’’। (সূরা আল ‘আনআম: ১৩৭)

ঐ সময় আরেকদল ছিল আহলে কিতাব। আহলে কিতাবদের একদল ছিল খৃষ্টান। তারাও দিশেহারা হয়ে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছিল। তারা তিন মাবুদের ইবাদত করতো। তারা তাদের পাদ্রীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছিল। আর ধ্বংসকারী ইয়াহূদীরা তো পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেই যাচ্ছিল, ফিতনার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল, আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেই যাচ্ছিল এবং তারা তাদের কিতাবের মূলবক্তব্য নিয়ে খেল-তামাশা করে সেটাকে স্বীয় স্থান হতে পরিবর্তন করেই যাচ্ছিল।

তৃতীয় আরেকদল লোক ছিল অগ্নিপূজক। তারা আগুন পূজা করতো। তারা দুই মাবুদের ইবাদত করতো। তাদের মতে এক মাবুদ কল্যাণের স্রষ্টা আরেক মাবুদ অকল্যাণের স্রষ্টা।

চতুর্থ আরেকদল ছিল, বেদীন। তারা গ্রহ-নক্ষত্রের ইবাদত করতো। তারা মনে করতো, পৃথিবীর উপর এগুলোর প্রভাব রয়েছে। পঞ্চম আরেক দল ছিল দাহরিয়া সম্প্রদায়। এরা কোনো দীন মানতো না। এমনকি পুনরুত্থান কিংবা আখিরাতে হিসাব-নিকাশে বিশ্বাস করতোনা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেরণের সময় পৃথিবীর অধিবাসীদের অবস্থা এরকমই ছিল। মূর্খতায় পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল এবং গোমরাহীর অন্ধকারে পৃথিবী ভরে গিয়েছিল। অতঃপর যে তার দাওয়াত কবুল করলো এবং তার আহবানে সাড়া দিল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসলেন। তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহাপবিত্র দীনে হানীফ ফিরিয়ে আনেন এবং শিরক থেকে নিষেধ করেন ও শিরকের দিকে নিয়ে যায় এমন সকল পথই বন্ধ করার চেষ্টা করলেন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »