আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী কয়েক প্রকার বড় শিরকের বর্ণনা শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১ টি

التوكل শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, নির্ভর করা ও সোপর্দ করে দেয়া। এটি অন্তরের কাজ। যেমন বলা হয়ে থাকে, توكل في الأمر ‘‘সে কাজটি বুঝে নিল’’। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন সে কাজটি করার দায়িত্ব বুঝে নেয়। আরো বলা হয়, ووكلت أمري إلى فلان  ‘‘আমি আমার কাজটি অমুকের নিকট সোপর্দ করলাম। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন সে কাজটি সম্পাদন করার ব্যাপারে তার উপর নির্ভর করে।

যেসব ইবাদত এখলাসের সাথে কেবল আল্লাহর জন্যই সম্পন্ন করা আবশ্যক, তার প্রকারসমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা বিরাট একটি ইবাদত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾

‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’। (সূরা মায়িদা: ২৩)


আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করার প্রকারসমূহ


আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর التوكل বা ভরসা করার প্রথম প্রকার হলো, যেসব বিষয়ের উপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমতা রাখে না ঐসব বিষয়ের উপর ভরসা করা। যেমন সাহায্য, বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তা, রিযিক, শাফা‘আত ইত্যাদি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মৃত ব্যক্তি, অনুপস্থিত অথবা তাগুতের উপর ভরসা করা বড় শিরক।

দ্বিতীয় প্রকার التوكل হলো, বাহ্যিক উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর করা। যেমন কেউ রাজা-বাদশাহর উপর নির্ভর করলো অথবা শাসকদের উপর নির্ভর করলো অথবা অন্য কোনো জীবিত ক্ষমতাবান ব্যক্তির ঐসব ক্ষমতার উপর নির্ভর করলো, যা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন যেমন দান করা কিংবা দুঃখ-কষ্ট দূর করা অথবা অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ে বাহ্যিক উপকরণের উপর নির্ভর করলো। এ ধরণের নির্ভর করা ছোট শিরক। কেননা এতে আল্লাহর পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষের উপর ভরসা করা হয়।

তৃতীয় প্রকার التوكل হলো, যেমন মানুষ এমন কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করলো, যে তার কাজ-কর্মগুলো করে দিবে। যেমন ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি। এটি জায়েয। তবে যে জন্য তাকে উকীল নিযুক্ত করা হলো, তা অর্জনের ব্যাপারে তার উপর ভরসা করা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরই ভরসা করবে। তিনি যেন তার ঐসব কাজ সহজ করে দেন, যা তিনি নিজে অর্জন করতে চাচ্ছেন অথবা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে অর্জন করতে চাচ্ছেন। কেননা বৈধ বিষয়াদি অর্জনের ক্ষেত্রে কাউকে উকীল বানানো উপায়-উপকরণ গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত। উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর করা যাবে না। বরং কেবল আল্লাহ তা‘আলার উপরই নির্ভর করতে হবে। তিনিই সকল উপায় উপকরণের স্রষ্টা, তিনি উপায়-উকরণ এবং সেটা গ্রহণ করার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলেরও স্রষ্ট।

অকল্যাণ প্রতিরোধ করা, রিযিক লাভ করা এবং যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ দিতে পারে না, তা পাওয়ার জন্য কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করা বিরাট একটি ইবাদত। সুতরাং এসব বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর নির্ভর করা বড় শিরক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾

‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’। সূরা আল মায়িদা: ২৩।

আল্লাহ এখানে কেবল তার উপরই ভরসা করার আদেশ দিয়েছেন। কেননা বাক্যের মধ্যে معمول কে عامل এর পূর্বে উল্লেখ করা হলে সীমাবদ্ধতার অর্থ প্রদান করে। আর এখানে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে ঈমান সহীহ হওয়ার শর্তারোপ করা হয়েছে। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলা কারো ইসলাম সহীহ হওয়ার জন্যও তার উপর ভরসা করার শর্তারোপ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ﴾

‘‘ মূসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুস: ৮৪)

উপরের আয়াত দু’টি প্রমাণ করে যে, যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে না অথবা তাকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করে তাদের ঈমান বা ইসলাম কোনোটিই সঠিক নয়। যেসব বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনো ক্ষমতা নেই তাতে কবরবাসী ও সমাধিস্থ ব্যক্তিগণ এবং মূর্তিদের উপর নির্ভর করা হলে ঈমান ও ইসলাম উভয়টি ভঙ্গ হয়ে যাবে।

সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরয। তাই এখলাসের সাথে তার উপর ভরসা করা আবশ্যক। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উপর ভরসা সমস্ত ইবাদতের মূল, তাওহীদের সর্বোচ্চ স্তর। কেননা এ থেকেই অন্যান্য সৎ আমলের উৎপত্তি হয়। কেননা বান্দা যখন তার দুনিয়া-আখিরাতের সমস্ত কাজে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং তিনি ব্যতীত অন্যান্য জিনিষের উপর ভরসা করা বাদ দিবে, তখনই তার এখলাস বিশুদ্ধ হবে এবং আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কও ঠিক হবে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন কেউ কোনো সৃষ্টির কাছে আশা-আকাঙ্খা করেছে এবং তার উপর ভরসা করেছে, তখন সেই সৃষ্টির ব্যাপারে তার ধারণা ব্যর্থ হয়েছে। শাইখুল ইসলামের উক্তি এখানেই শেষ।

সূরা ফাতিহার আয়াত ﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾ ‘‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি ও শুধু তোমার কাছেই সাহায্য চাই’’

এর সর্বোচ্চ স্তর হলো আল্লাহর উপর ভরসা করা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করা ব্যতীত তাওহীদের তিনটি প্রকার কেউ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿رَّبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلًا﴾

 ‘‘তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তাই তাকে নিজের উকীল হিসাবে গ্রহণ করো’’। সূরা আল মুয্যাম্মিল:৯।

আল্লাহর উপর ভরসা করার আদেশ সম্বলিত অনেক আয়াত রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ﴾

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই’’। (সূরা তালাক: ৩)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾

‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’ সূরা আল মায়িদা: ২৩।

-এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ এখানে ঈমানদার হওয়ার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করার শর্তারোপ করেছেন। এতে বুঝা গেলো আল্লাহর উপর ভরসা না থাকলে ঈমান থাকে না। বান্দার ঈমান যতই বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর উপর তার ভরসাও ততো মজবুত হবে। ঈমান যখন দুর্বল হবে, তখন ভরসাও দুর্বল হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসার দুর্বলতা বান্দার ঈমান দুর্বল হওয়ার প্রমাণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের অনেক জায়গায় তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও ইবাদতকে একসাথে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল ও ঈমানকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং তাকওয়াকে একসাথে মিলিয়ে, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং ইসলামকে একসাথে মিলিয়ে আবার কোথাও তাওয়াক্কুল এবং হিদায়াতকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন।  এতে বুঝা গেলো, ঈমানের সকল স্তরের মধ্যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল হলো মূল আর ইহসান বা ইখলাস হলো ইসলামের সমস্ত আমলের মূল। আর ঈমানের মধ্যে তাওয়াক্কুলের মর্যাদা দেহের মধ্যে মাথার মর্যাদার মতোই। দেহ ছাড়া যেমন মাথার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি তাওয়াক্কুলের ভিত্তি ছাড়া অন্য কিছুর উপর ঈমান, ঈমানের শাখাসমূহ ও ঈমানের আমলসমূহ ঠিক হয় না।

আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ভরসা ও নির্ভর করাকে মুমিনদের সর্বাধিক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনফালের ২ নং আয়াতে বলেন,

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾

‘‘মুমিন তো তারাই, যাদের অন্তরসমূহ আল্লাহর নাম নেয়া হলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। আর যখন তার আয়াত তাদের সামনে পাঠ করা হয়, তখন সেটা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে। আর তারা তাদের প্রভুর উপর ভরসা রাখে’’।

অর্থাৎ তারা অন্তর-মন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার উপর নির্ভর করে। তাকে ছাড়া তারা অন্য কারো কাছে কিছুই কামনা করে না। উপরোক্ত আয়াতে প্রকৃত মুমিনদেরকে ইহসানের তিনটি গুণে বিশেষিত করেছেন।

(১) তারা আল্লাহকে ভয় করে।

(২) আল্লাহর আয়াত শুনে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং

(৩) তারা একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে।

আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার চেষ্টা করার পরিপন্থী নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাক্বদীরে নির্ধারিত জিনিসগুলো উপায়-উপকরণের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি তার উপর ভরসা করার সাথে সাথে উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করার আদেশ দিয়েছেন।

সুতরাং উপায়-উপকরণ গ্রহণ করাও আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে গণ্য। কেননা তিনি তা গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের মধ্যে গণ্য। আর আল্লাহর উপর ভরসা করা অন্তরের আমল। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انفِرُوا جَمِيعًا﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! সতর্কতা অবলম্বন করো। অতঃপর পৃথক পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়ো অথবা এক সাথে বের হয়ে পড়ো’’। (সূরা আন নিসা: ৭১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ﴾

‘‘আর তোমরা তাদের যথাসাধ্য শক্তি ও সুসজ্জিত ঘোড়া যোগাড় করে রাখো। এর মাধ্যমে তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে’’। (সূরা আনফাল: ৬০)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

  ﴿فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

‘‘অতঃপর যখন সালাত শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। যাতে তোমরা সফলকাম হও’’। (সূরা জুমআ: ১০)

কোনো কোনো সালাফ বলেছেন, যে ব্যক্তি চেষ্টা করা, পরিশ্রম করা, উপার্জন করা এবং উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা বর্জন করলো, সে রসূলের সুন্নাতের মধ্যে আঘাত করলো এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা বর্জন করলো, সে তার ঈমান নষ্ট করে ফেললো।

ইমাম ইবনে রজব হান্বালী রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দার আমল মোট তিন প্রকার।

(১) এমন আনুগত্যের আমল, যা আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে সম্পাদন করার আদেশ দিয়েছেন, সেটাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়-উপকরণ ও জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম বানিয়েছেন। আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তার কাছে সাহায্য চাওয়ার সাথে সাথে এ আমলগুলো সম্পাদন করা জরুরী। কেননা আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয় এবং তার শক্তি ব্যতীত ভালো কাজ সম্পন্ন করাও অসম্ভব। তিনি যা চান, তাই হয় এবং তিনি যা চান না, তা হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি এ কাজগুলো থেকে কোনো একটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ত্রুটি করবে, সে তাক্বদীরের নির্ধারণ ও শরী‘আতের হুকুম অনুযায়ী দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে শাস্তির হকদার হবে।

ইউসুফ ইবনে আসবাত রহিমাহুল্লাহ বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, তুমি ঐ ব্যক্তির ন্যায় আমল করো, যাকে তার আমল ব্যতীত অন্য কিছু নাজাত দিবে না। আর ঐ ব্যক্তির ন্যায় ভরসা করো, যে তার ভাগ্যে নির্ধারিত জিনিস ব্যতীত অন্য কিছুই অর্জন করার আশা করে না।

(২) আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সকল সৃষ্টির মধ্যে স্বভাব ও সৃষ্টিগত যেসব রীতিনীতি চালু করেছেন বান্দাদেরকে তা গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন ক্ষুধা লাগলে খাবার গ্রহণ করা, পিপাসা লাগলে পান করা, রোদ্রের তাপ লাগলে ছায়া গ্রহণ করা, শীত লাগলে উত্তাপ গ্রহণ করা ইত্যাদির উপকরণ গ্রহণ করা বান্দার উপর ওয়াজিব। যার এগুলো ব্যবহার করার ক্ষমতা রয়েছে, সে যদি অবহেলা বশতঃ এগুলো ব্যবহার বর্জন করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে অবহেলা করার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। তবে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের কাউকে পানাহার বর্জন কিংবা গরম-ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষেত্রে এত শক্তিশালী করেন, যতটা অন্যদেরকে করেন না। যে বান্দাকে খাস করে অন্যের তুলনায় অতিরিক্ত শক্তি দেয়া হয়েছে, সে যদি তার শক্তি অনুপাতে কাজ করে, তাহলে তার কোনো দোষ নেই। তাই তো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাগাতার একদিন বা দুই দিন পর্যন্ত না খেয়ে সিয়াম রাখতেন। অথচ তিনি তার সাহাবীদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলতেন, আমি তোমাদের মতো নই। আমাকে আল্লাহর পক্ষ হতে খাওয়ানো হয় ও পান করানো হয়। পানাহার বর্জনে সালাফদের অনেকেরই এমন শক্তি ছিল, যা অন্যদের ছিল না।

সুতরাং যার শক্তি আছে, সে যদি শক্তি অনুসারে পানাহার ছেড়ে দিয়েও আল্লাহর আনুগত্য করতে দুর্বল না হয়, তাহলে তার কোনো অপরাধ হবে না। আর যে নিজের নফস্কে কষ্ট দিতে গিয়ে ফরয ইবাদত করতে দুর্বল হয়ে যায়, তার কাজের প্রতিবাদ করা হবে।

(৩) আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার অধিকাংশ সৃষ্টির মধ্যে স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত যেসব রীতিনীতি ও প্রথা চালু করেছেন বান্দাদেরকে তা গ্রহণ করার আদেশ করেছেন। তিনি তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার জন্য ইচ্ছা করেন, তার ব্যাপারে উক্ত সাধারণ রীতিনীতির ব্যতিক্রম করেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا

‘‘তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলার উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করতে, তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেভাবেই রিযিক দিতেন, যেভাবে তিনি পাখিদেরকে রিযিক দিয়ে থাকেন। পাখি খালি পেটে সকালে বাসা থেকে বের হয় আর বিকালে ভরা পেটে ফিরে’’।[1]

এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সামান্য তাওয়াক্কুলের কারণে এবং বাহ্যিক উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার কারণে রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা যদি অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করতো, তাহলে তাদেরকে সামান্য পরিশ্রমের মাধ্যমেই প্রচুর পরিমাণ রিযিক দিতেন। যেমন তিনি সকাল-বিকাল বাসা থেকে শুধু বের হওয়ার কারণেই পক্ষীকূলকে রিযিক দিয়ে থাকেন। এটিও এক প্রকার অন্বেষণ। তবে তা খুবই সামান্য।  পরিশেষে ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামানবাসীরা হজ্জে আসতো। কিন্তু পাথেয় সাথে আনতো না। তারা বলতো, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরকারী। সুতরাং তারা মক্কায় এসে হজ্জ করার সময় মানুষের কাছে হাত পাততো। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন,

﴿وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ﴾

‘‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো। তাকওয়াই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আল বাকারা: ১৯৭)

ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল রহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, যে ব্যক্তি বসে থাকে, জীবিকার জন্য চেষ্টা করে না এবং বলে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করলাম, তার ব্যাপারে আপনার মত কী?

জবাবে তিনি বললেন, সমস্ত মানুষেরই আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত, একই সঙ্গে জীবিকা অর্জনের জন্য নিজেকে অভ্যস্ত করা উচিত। নবী-রসূলগণ অন্যদের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর এবং উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের কাজ করে দিতেন। তারা বলেননি যে, আমরা বসে থাকবো। আল্লাহ আমাদেরকে বিনা পরিশ্রমেই রিযিক দিবেন।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ﴾

তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। (সূরা জুমু‘আ: ১০)

আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, এক লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো,

يَا رَسُولَ اللَّهِ أَعْقِلُهَا وَأَتَوَكَّلُ أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ قَالَ اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ

‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি কি উট বাঁধবো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করবো? না কি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করবো? তিনি বললেন, বাধোঁ এবং ভরসা করো’’।[2]

উপরে যেসব আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হলো, তা প্রমাণ করে যে, আল্লাহর উপর ভরসা করা বৈধ উপায়-উপকরণ অন্বেষণ করার প্রতিবন্ধক নয়। বরং উভয়টি একসাথে গ্রহণ করাই উত্তম।উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামানের একদল লোকের সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোন গোত্রের লোক? তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর ভরসাকারী। তিনি বললেন, তা নয়; বরং তোমরা লোভী এবং অন্যের খাবারে অংশগ্রহণকারী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসাকারী হলো ঐব্যক্তি, যে যমীনে বীজ বপন করে অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে।

[1]. সহীহ: মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৭০, সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/৪১৬৪।

[2]. তিরমযী, হাদীছ নং- ২৪৪১।