২.৫০ জানাযা বহন - ১৮৬, জানাযা বহন করার সময় কী কী নিয়ম-নীতি মেনে চলা আবশ্যক?

১. জানাযা বহন করা ও তার অনুসরণ করা ওয়াজিব (বা ফরযে কেফায়া)। এটা জীবিতদের উপর মৃত ব্যক্তির হক। আবু হোরায়া (রা.) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের পাঁচটি হক রয়েছে,
(ক) সালামের জবাব দেওয়া, (খ) অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেওয়া, (গ) জানাযায় শরীক হওয়া, (ঘ) দাওয়াত কবুল করা এবং (ঙ) হাঁচির উত্তর দেওয়া অর্থাৎ হাঁচিদাতা হাঁচি দিয়ে আল্-হামদুলিল্লাহ বলবে। শ্রোতা এর উত্তরে বলবে ‘ইয়াহামুকাল্লাহ্'। (বুখারী: ১২৪০) আরেক হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“তোমরা রোগীর সেবা করো এবং জানাযায় যাও। এটা তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।”

জানাযা পড়লে এক কীরাত’ এবং দাফন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দুই কীরাত পরিমাণ নেকী হয়। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন কীরাত' কী? নবী (সা.) বললেন, এক ‘কীরাত হলো ১টি উহুদ পাহাড় সমতূল্য। (মুসলিম: ১৫৭০) অর্থাৎ যে লোক জানাযাও পড়লো, আবার দাফনও করে গেল সে লোক ২টি উহুদ পাহাড়ের ওজনের সমপরিমাণ নেকী পেয়ে গেল।

২. তোমরা জানাযায় যাও- এ নির্দেশটি পুরুষদের জন্য। তাই মহিলারা জানাযা বহন ও অনুসরণ করবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) মেয়েদেরকে জানাযায় যেতে নিষেধ করেছেন। তবে এ নিষেধাজ্ঞায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। (বুখারী: ১২৭৮) কিন্তু কোন মসজিদে যদি জানাযা হয়, আর মেয়েরা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকে তাহলে তারাও জানাযার সালাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাছাড়া মক্কা ও মদীনায় মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে নারীরা সব ওয়াক্তেই উপস্থিত থাকে। সে অবস্থায় জানাযার ঘোষণা আসলে মেয়েরাও জামাআতের সাথে জানাযায় শরীক হয়।উল্লেখ্য যে, মক্কায় মসজিদুল হারামে জানাযা পড়লে এক লক্ষ এবং মদীনায় মসজিদে নববীতে পড়লে এক হাজার ‘কীরাত' অর্থাৎ এক হাজার উহুদ পাহাড় পরিমাণ নেকী হাসিল হয়। ইনশা আল্লাহ মহিলারাও এ সাওয়াব পাবে। কারণ ফযীলতের এ বর্ণনাটি আ'ম অর্থাৎ সবার জন্য প্রযোজ্য।

৩. লাশ বহনের সময় উঁচু স্বরে আওয়াজ করে কান্নাকাটি করবে না, ধুপ-ধুয়া-আগরবাতি, আগুন ইত্যাদি কোন কিছুই সাথে নিয়ে যাওয়া জায়েয নেই। (দেখুন আবূ দাউদ: ৩১৭১, আহমাদ: ৯২৩১)

৪. জানাযার কফিন বহন করার সময় বিশেষ কোন যিকির নেই, বিশেষ কোন দু'আ নেই। বরং সে সময় এগুলো করা বিদআত। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবাগণ জানাযার সামনে। উঁচু স্বরে কথা বলা অপছন্দ করতেন। (বায়হাকী- ৪/৭৪)। এমনকি জানাযা বহনের সময় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র যিকির করাও জায়েয নেই, এমনকি নিঃশব্দে হলেও না। কারণ খ্রিস্টানরা তাদের লাশের নিকট ইঞ্জিল কিতাব পাঠ করে, তাই এ কাজ তাদের সাথে মিলে যায়। আর তাই কাফেরদের এ অনুকরণ আমাদের জন্য নিষেধ। খাট বা লাশের পাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করাও বৈধ নয়। এ কাজ রাসূল (সা.)ও করেননি, সাহাবারাও করেননি। (দেখুন আল বানীর আহকামুল জানায়িয গ্রন্থ, মাসআলা নং ৪৮ ও ৪৯)।
সে সময় উচ্চঃস্বরে কোন প্রকার পার্থিব কথাবার্তা তর্ক-বিতর্ক করাও ঠিক নয়। ইমাম নববী (রহ) তাঁর প্রণীত আযকার কিতাবের ২০৩ পৃ. লিখেছেন যে, সালফে সালেহীনগণ জানাযা বহনের সময় নীরব ও চুপচাপ থাকতেন, জোরে আওয়াজ করে কোন কিছু পড়তেন না।

৫. মৃত ব্যক্তির কফিন দ্রুত নিয়ে হাটবে। তবে দৌড়াবে না। একদল আলেম দ্রুত চলাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তবে আলবানীর মতে দ্রুত চলা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

 “তোমরা জানাযা নিয়ে দ্রুত গতিতে চলো। যদি সে ভালো লোক হয় তাহলে তোমরা তাকে কল্যাণের দিকে দ্রুত এগিয়ে দিচ্ছ। আর যদি সে ভালো লোক না হয়, তাহলে একটা আপদ তোমাদের কাঁধ থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলছাে। (বুখারী: ১৩১৫)


কোন কোন এলাকায় লোকেরা এক কদম, এক কদম করে হাটে। এটা যেমন সুন্নাত বিরোধী কাজ, তেমনই এটা বিদ'আত এবং বিধর্মীদের অনুসরণ। (আল বানীর আহকামুল জানায়িয, মাসআলা নং ৪৯ ও ৫০) উল্লেখ্য যে, দ্রুত হাঁটার সময় খেয়াল রাখবে যেন লাশের উপর কোন ঝাঁকুনি না আসে।

৬. লাশের সামনে, পেছনে, ডানে, বামে সবদিক দিয়েই হাঁটা জায়েয আছে। তবে জানাযার অনুসরণ করতে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে বুঝা যায়- লাশের পেছনে পেছনে চলাই উত্তম। (দেখুন তিরমিযী: ১০৩১, ১০০৭)।
আলী (রা.) বলেছেন, একা নামাযের তুলনায় জামাআতে নামাযের মর্যাদা যেমন বেশি। জানাযার সামনে চলার চেয়ে পিছনে চলা তেমনিই উত্তম। (ইবনে আবি শাইবা- ৪/১০১)

৭. কেউ যানবাহনে চড়ে গেলে তারা নাজাযার পিছনে চলবে, সামনে নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যারা বাহনে চড়ে যাবে তারা জানাযার পিছনে চলবে।” তবে পায়ে হেঁটে যাওয়া উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখেছেন, ফেরেশতারাও জানাযায় পায়ে হেঁটে চলেছেন। (আবু দাউদ: ২৭৬৩) বৃষ্টি-বর্ষা, প্রচণ্ড শীত গ্রীষ্ম বা অনিবার্য কোন কারণ থেকে থাকলে অথবা লাশ বহনের লোক না। থাকলে প্রয়োজনের খাতিরে গাড়িতে বা এম্বুলেন্সে করে লাশ নেওয়া জায়েয আছে, অন্যথায় নয়।

৮. লাশ বহনের সময় মাথা কোন দিকে থাকবে এ মর্মে হাদীসে কোন দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না। তবে মাথাটা সামনের দিকে থাকাই উত্তম।

৯. তাছাড়া লাশ বহনের সময় ঘুরে ঘুরে পালা বদলানো। পার্শ্ব বদলানো- এগুলো সহীহ হাদীসে নেই। অতএব, প্রয়োজন ছাড়া এসব করা বিদআত।

১০. জানাযার আগে-পরে চাল-ডাল, খই-মুড়ি, মিষ্টি-মিঠাই বিতরণ ও টাকা-পয়সা সদকা করা এবং ফুল ছড়ানো অবৈধ কাজ ও বিদআত।

১১. মাইয়্যেত ভালো লোক হলে তার লাশের ওজন হালকা হবে- এমন ধারণা ভিত্তিহীন ও বিদআত।

১২. ওযূ করে জানাযা বহন করা মুস্তাহাব।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি (লাশ) বহন করে সে যেন (এর আগে) ওযু করে নেয়।” (আবু দাউদ: ২৭৪৯)