শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ৮ টি
সাধারণ মুসলিমদেরকে শির্কে পতিত করানোর ক্ষেত্রে শয়তানের বিভিন্ন অপকৌশল

 আমরা কমবেশী সকলেই জানি যে, শয়তান অহঙ্কারবশত আল্লাহ তা‘আলার আদেশকে অমান্য করে আদম আলাইহিস সালামকে সেজদা না করার কারণে মহান আল্লাহ তাকে তাঁর রমহত থেকে বিতাড়িত করে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বহিষ্কৃত হওয়ার প্রাক্কালে সে এ মর্মে প্রতিজ্ঞা করে বের হয়েছিল যে, বনী আদমের মধ্যকার আল্লাহর একনিষ্ঠ অল্প সংখ্যক বান্দাদের ব্যতীত অবশিষ্ট সবাইকেই সে তার বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সরল ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করবে।

আল্লাহ তা‘আলা তার এ প্রতিজ্ঞার জবাবে বলেছিলেন: ‘‘আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নেই, তবে পথভ্রষ্টদের মধ্যকার যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদের কথা সতন্ত্র’’।[1] শয়তান তার এ প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য সকল বনী আদমের পিছনে জিন ও মানুষের মধ্যকার তার অনুসারীদেরকে দিবানিশি লাগিয়ে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে তাদের ঈমান ও ‘আমল নষ্ট করার কাজে সর্বদা তৎপর রয়েছে। সাধারণ মানুষতো দুরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরও ‘আমল নষ্ট করার ব্যাপারে চেষ্টা করতেও তার অনুসারীরা ত্রুটি করে নি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেন:

‘‘জিনদের মধ্যকার একটি দুষ্ট জিন এসে গত রাতে আমার সালাত ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আক্রমণ করেছিল। তাকে পাকড়াও করার ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, ফলে আমি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে মসজিদের পায়ার সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম, যাতে তোমরা সকালে এসে তাকে দেখতে পাও। কিন্তু ততক্ষণে আমার মনে পড়লো সুলায়মান এর সেই দো‘আর কথা, তিনি বলেছিলেন: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন রাজত্ব দান করুন যা আমার পরে আর কারো জন্যে শোভা পায়না। তাঁর এ দো‘আর কথা মনে পড়ায় আমি তাকে ছেড়ে দেই।’’।[2]

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘আমল নষ্ট করার ক্ষেত্রে শয়তানের অনুসারীদের ষড়যন্ত্র সীমাবদ্ধ থাকলেও তাঁর উম্মতগণের ঈমান ও ‘আমল উভয়ই নষ্ট করার ক্ষেত্রে তার অনুসারীদের রয়েছে নানাবিধ কৌশল। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানব সমাজে যে-সব শির্কী ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও অভ্যাসের প্রচলন রয়েছে, তা তাদের ষড়যন্ত্রেরই ফসল। তারা যাকে যে কৌশল অবলম্বন করলে পথভ্রষ্ট করা যায়, তাকে সে কৌশলেই পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে চলেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আল্লাহর তা‘আলার রহমতে কেবল তারাই রক্ষা পেতে পারে যাদের শরী‘আত সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রয়েছে।

আল্লাহর অলিগণের ওসীলা ও তাঁদের শাফা‘আত সম্পর্কে সাধারণ মুসলিম জনমনে শয়তান যে অতিরঞ্জিত ধারণা প্রদান করেছে, সে ধারণা দু’টিকে সাধারণ জনগণের অন্তরে বদ্ধমূল করা এবং এ দু’টিকে কেন্দ্র করে তাদেরকে প্রত্যক্ষ শির্কে নিমজ্জিত করার জন্য তার রয়েছে বিভিন্ন অপকৌশল। নিম্নে তার কিছু অপকৌশলের বর্ণনা প্রদান করা হলো:

প্রথম অপকৌশল:

কোন কবরে কারো প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া

ওলিগণ আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী হওয়ার বিষয় দু’টিকে প্রমাণ করার জন্য শয়তান সাধারণ মানুষদের কাছে কৌশল হিসেবে সে-সব লোকদের উদাহরণ এনে উপস্থাপন করে যারা তাদের কোনো প্রয়োজন কোনো কবরে উপস্থাপন করার পর তা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করে। এ ধরনের লোকদের উদাহরণ উপস্থাপন করে শয়তান সাধারণ লোকদের অন্তরে এ কুমন্ত্রণা দেয় যে, অলিগণের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেই সে-সব লোকদের মনস্কামনা তাঁদের কবরে পূর্ণ হয়েছে।

শয়তানের এ অপকৌশল থেকে বেরিয়ে আসার উপায়:

শয়তানের এ-জাতীয় অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জনগণকে জানতে হবে যে, আল্লাহই হলেন মানুষের ভাগ্যের একক নিয়ন্তা। প্রতিটি মানুষ তার জীবনে কী কর্ম করবে এবং জীবিতদের মধ্য থেকে কারা তার প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা বা দো‘আ করবে, এ-সব কিছু আগাম জানার ভিত্তিতে তিনি হিকমত ও পরীক্ষার বিষয়কে সামনে রেখে তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তারতম্য করেছেন। তাই সকলেই সম্পদশালী হতে চাইলেও একসাথে সবাই সম্পদশালী হতে পারেনা। সবাই সুস্থ শরীর, দীর্ঘায়ূ ও সন্তানাদি কামনা করলেও তা পায়না।

আল্লাহর বিচারে যাকে যখন যা দেয়া উচিত, তখন তাকে তিনি তা দিয়ে থাকেন। সে-জন্য কেউ সন্তান আগে পায়, কেউ পরে পায়, আবার কেউ অদৌ পায়ই না। এ ভাবে যারা ভাগ্যের পরীক্ষায় পড়ে তাদের করণীয় হচ্ছে- ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যখন যে কর্ম করা প্রয়োজন তখন তা নিজে বা অপর জীবিত মানুষদের সহযোগিতা নিয়ে করতে হবে। অতঃপর কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য আল্লাহর উপরে অগাধ আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে।

মনে মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস লালন করতে হবে যে, আজ হোক কাল হোক আল্লাহর ইচ্ছায় আমার ভাগ্যে পরিবর্তন আসবেই। কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে আল্লাহর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অন্য কারো দারস্থ বা শরণাপণ্ণ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে কোনো মৃত ওলি বা দরবেশের কবরের দারস্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, কোনো মানুষ তিনি যত বড় মাপেরই ওলি হয়ে থাকুন না কেন- মরে গেলে তাঁর পক্ষে পরের উপকার করাতো দূরের কথা তখন তিনি তাঁর নিজেরই কোনো উপকার করতে পারেন না।

ইহজগতে থাকাবস্থায় মানুষের দেহের সাথে তার আত্মার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে বিধায়, একজন মানুষ সাধ্যানুযায়ী তার নিজের ও অপর মানুষের উপকার করতে পারে। কিন্তু মরে যাওয়ার পর তার দেহের সাথে আত্মার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকেনা বিধায়, তার পক্ষে নিজের ও পরের কারোই কোনো উপকার করা সম্ভব হয়না। সে-জন্য তখন তাঁরা জীবিতদের দো‘আর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। তাই সাধারণ, ওলি ও দরবেশ নির্বিশেষে সকলের কবর যিয়ারতে কেবল তাদের মাগফিরাত কামনা ও তাদের জন্য দো‘আ করার উদ্দেশ্যেই যেতে হয়, তাঁদের কাছে কিছু চাওয়ার জন্যে নয়।

এতো হলো শরী‘আতে কথা। কিন্তু শয়তান কবর যিয়ারতের এ উদ্দেশ্যকেই সাধারণ মানুষের কাছে বিকৃত করে দিয়েছে। তাদের এ বুদ্ধি দিয়েছে যে, কবর যিয়ারতের উক্ত বিধান ওলিদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। কেননা, তাঁরা আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভ করে জান্নাতবাসী হয়ে গেছেন। সুতরাং তাদের জন্য মাগফিরাতের দো‘আ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদের কবর যিয়ারতে যেতে হবে নিজের প্রয়োজনের কথা তাঁদের জানানোর জন্যে! কেননা, তাঁরা মরেও মরেন নি। তাঁদের এ মৃত্যু কেবল স্থান পরিবর্তন বৈ আর কিছুই নয়। দুনিয়াতে থাকাকালে যেমন তাঁরা মানুষের কল্যাণ করেছেন, ইন্তেকালের পরেও তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেদের নিবেদিত করে রেখেছেন। যারা তাঁদের কাছে নিজেদের প্রয়োজনের কথা জানায়, তাঁরা তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন?! নাউজুবিল্লাহ ।

শয়তানের এ প্রবঞ্চনা থেকে বাঁচার উপায়:

শয়তানের এ-জাতীয় প্রবঞ্চনা থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে যে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো কবরে আবদার করে কারো উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে থাকলেও আসলে তা কবরস্থ ওলির কারণে পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, কবরে আবেদনকারীর উদ্দেশ্য দু’ভাবে পূর্ণ হতে পারে:

এক, কবরে অবেদনকারীর প্রয়োজন যদি সন্তান দান, রোগ মুক্তি ইত্যাদির মত বিষয় হয় যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অপর কেউ পূর্ণ করতে পারে না, তা যদি কোনো কবরে চেয়ে বা কবরের কূপের পানি ও গাছের ফল খেয়ে কেউ পেয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে যে, আসলে সে ব্যক্তির এ প্রয়োজন আল্লাহ তা‘আলাই পূর্ণ করেছেন। এর সাথে সে ওলির মধ্যস্থতা ও শাফা‘আতের কোনই সম্পর্ক নেই। আল্লাহই সে ব্যক্তির ঈমানী পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তার ভাগ্যে তা বিলম্বে দানের বিষয়টি লিখে রেখেছিলেন। সে যদি কবরে না যেয়ে ধৈর্যের সাথে এ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার বাড়ীতে বসেই আল্লাহর কাছে বিনয়ের সাথে তা চাইতে থাকতো, তা হলে ঠিক এ সময়েই তার বাড়ীতে বসেও তার এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হতো। কিন্তু তা না করে কবরে যাওয়ার কারণে তার ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষায় সে অকৃতকার্য হয়েছে বলে নিজেকে প্রমাণ করে দিল।

দুই, আর যে সকল প্রয়োজন আল্লাহ ব্যতীত অপর কোনো মানুষ বা জিনের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে পূর্ণ করা সম্ভব, কারো এমন কোনো প্রয়োজন কোনো কবরে আবেদনের পর পূর্ণ হয়ে থাকলে বুঝতে হবে যে, শয়তান নিজেই কবরে আবেদনকারী এবং অন্যান্য আরো লোকদের ঈমান নষ্ট করার জন্য সে ব্যক্তির প্রয়োজন পূর্ণ করে দিয়েছে।

আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, কারো উত্তম জীবন ও জীবিকা লাভ করা তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। আমরা এ-জগতে যেমন নিজেদের ইচ্ছায় আগমন করি নি, তেমনিভাবে সবাই আল্লাহর কাছে উত্তম জীবিকা চাইলেও তা সমানভাবে পাই না। আবার যারা আল্লাহকে বিশ্বাসই করেনা তারাতো আল্লাহর কাছে কিছুই চায় না। তা সত্ত্বেও তারা এ দুনিয়ায় আমাদের অনেকের চেয়ে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভ করে। এতে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভের জন্য আমাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম করার নির্দেশ করেছেন এবং কারা কী করবে তা আগাম জানার আলোকে আমাদের ভাগ্যে তা লিখে রেখেছেন।

এখন আমরা যদি তাঁর তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম করে তাঁর কাছে তা কামনা করি, তা হলে তা পাই আর না পাই, অন্তত আমাদের ঈমান ঠিক থাকবে। আর যারা তাঁকে বিশ্বাস করেনা, অথচ উত্তম জীবন ও জীবিকা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে, অথবা তাঁর উপর বিশ্বাস রাখে কিন্তু মৃত অলিগণের কাছে বা তাঁদের মাধ্যম ও শাফা‘আতে উত্তম জীবন ও জীবিকা চেয়ে তা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে, তিনি হিকমতের ভিত্তিতে তাদের অনেককেও তা দিয়ে থাকেন কেননা; তারা সকলেই তাঁর সৃষ্টি। তারা তাঁকে বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, তাঁর তাওহীদে বিশ্বাসী হোক আর না-ই হোক এবং তাঁর কাছে সরাসরি কিছু চাক আর না-ই চাক, কাফির-মুশরিক-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্যই তাঁর দান অবারিত।[3] তাই কোনো কবরে কারো প্রয়োজন পূর্ণ হলে এতে কারো বিভ্রান্ত হবার কোনই অবকাশ নেই।

এছাড়াও আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, কালোবাজারী করে সম্পদ অর্জন করলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকে, তেমনিভাবে কোনো কবরে কিছু চাওয়ার পর তা পেলে তাও আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে। এতে কালোবাজারী করা যেমন বৈধ হয়ে যাবেনা, তেমনি এতে কবরে কিছু চাওয়াও বৈধ হয়ে যাবেনা। সম্পদ দেওয়ার মালিক যেমন আল্লাহ, তেমনি বিপদ থেকে রক্ষা করার মালিকও তিনিই। এতে মৃত অলিগণের ওসীলা ও শাফা‘আতের কোনই হাত নেই। ‘কুরায়শরা লাত, উয্যা, মানাত ও হুবল নামের সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের মূর্তি ও জিনের মাধ্যম ও শাফা‘আতে আল্লাহর কাছে উত্তম জীবন ও জীবিকা এবং বৃষ্টির জন্য আবদার করে অনেক সময় তা পেতো।[4]

তাই বলে কি এ-কথা স্বীকার করা যাবে যে, তারা তাদের দেব-দেবীদের ওসীলা ও শাফা‘আতেই এ-সব পেতো? বা তাদের দেব-দেবীদের এ-সব দেয়ার যোগ্যতা ছিল? তা যদি স্বীকার করা না যায়, তা হলে আমাদের কিছু প্রাপ্তির পিছনেও মৃত ওলিগণের মধ্যস্থতা, শাফা‘আত ও দানের বিষয়কে স্বীকার করা যাবে না। কেননা, তাঁরা ওয়াদ, সুয়া‘, ইয়াগুছ, য়াউক ও নছর এবং ফেরেশ্তা ও জিনদের মতই আল্লাহর সৃষ্ট জীব। তাঁরা আল্লাহর ওলি হয়ে এবং ফেরেশ্তারা আল্লাহর অনুগত বান্দা হয়েও যদি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে নিজ থেকে মানুষের কোনো উপকার করতে না পারেন, তা হলে আমরা যাদের ওলি বলে মনে করি, তাঁরাও মৃত্যুর পর মানুষের কোনো উপকার করতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে ওলিদের ব্যাপারে এ ধরনের ধারণা করা কুফরী বৈ আর কিছুই নয়।

এ সম্পর্কে প্রখ্যাত হানাফী আলেম আল্লামা শামী বলেন:

(إن ظن أن الميت يتصرف في الأمور دون الله اعتقاده ذلك كفر)

‘‘যদি (কেউ) এ ধারণা করে যে, আল্লাহ ব্যতীত মৃত মানুষেরা পার্থিব বিষয়াদি পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করেন, তা হলে তার এ ধারণা কুফরের অন্তর্গত বলে বিবেচিত হবে’’।[5]

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কারো কোনো উপকার করতে পারেন না:

কোন মৃত মানুষ যদি কারো উপকার করতে পারে তা হলে সর্বাগ্রে তা আমাদের রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এরই পারার কথা। অথচ বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর তিরোধানের পর মুসলিমগণ বহু অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন; কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য কখনও কোনো সাহাবীকে তাঁর রওজা মুবারকে যেয়ে তাঁর নিকট কোনো অভিযোগ করতে বা সাহায্য চাইতে দেখা যায় নি। বা তাঁকে তাঁদের বিপদ দূর করতে এবং সমস্যার সমাধান করে দেয়ার জন্য কিছু বলেছেন বলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সাহাবীগণ যেমন তাঁর কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাননি, তেমনি তিনি নিজ থেকে আগ্রহী হয়েও তাঁদের কোনো উপকার করেন নি। তাঁর যদি কোনো উপকার করার সামর্থ্য থাকতো, তা হলে তাঁর তিরোধানের পরপরই খিলাফতের বিষয় নিয়ে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না।

‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে একজন অগ্নিপূজকের হাতে শহীদ হতে হতো না। ‘উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদৎ বরণ করতে হতো না। ‘উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার বিষয়কে নিয়ে ‘আলী ও মু‘আবিয়া এর মধ্যে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হতো না। ইয়াজীদ ইবনে মু‘আবিয়ার সৈনিকদের দ্বারা মদীনায় লুটতরাজ, গণহত্যা ও শ্লীলতাহানির মত জঘন্য কর্ম সংঘটিত হতো না। সর্বোপরি কারবালা প্রান্তরে ইয়াযীদের সৈন্যদের হাতে তাঁর দৌহিত্র হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্মমভাবে শাহাদৎ বরণ করতে হতো না। তাঁর হাদীসসমূহ মানুষের বানানো হাদীসের সাথে মিলে একাকার হয়ে যেতো না। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তাঁর রওযা মুবারকের পার্শ্বে যেয়ে তাঁর নিকট থেকে তাঁর হাদীসগুলো জেনে নিতেন।

ফলে মুসলিম উম্মাহের মাঝে বিভিন্ন ‘আমলের ক্ষেত্রে তাঁর হাদীসকে কেন্দ্র করে কোনো মতভেদের সৃষ্টি হতো না। তাঁর হাদীসসমূহের মধ্যে কোন্টি নাসিখ ও কোন্টি মানসূখ, তাও জেনে নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি তিনি এ-সব ক্ষেত্রে কোনো কিছুই করতে পারেন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর এ-সব ক্ষেত্রে কাউকে কোনো সাহায্য করার কোনই সামর্থ্য নেই। এই যদি হয় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব ও আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মানুষের অবস্থা, তা হলে তাঁর উম্মতের মাঝে এমন কে থাকতে পারেন, যিনি মৃত্যুর পর জীবিত মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন? বস্তুত কোনো মানুষ মরে যাওয়ার পর যদি তার ব্যাপারে এ ধারণা করা হয় যে, তিনি এখনও মানুষের উপকার করতে পারেন এবং এ ধারণার ভিত্তিতে যদি সে ব্যক্তিকে আহ্বান করা হয়, তা হলে তা হবে প্রকাশ্য শির্ক। এ-জাতীয় শির্ককারীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:

﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ ﴾ [فاطر: ١٤]

‘‘তোমরা যদি তাদেরকে (সাহায্যের জন্য) আহ্বান কর, তা হলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না, আর শুনলেও তারা তোমাদের ডাকের কোনো জবাব দিবেনা। আর কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ককে অস্বীকার করবে’’।[6] তারা বলবে: প্রভু হে ! আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি বলে ওরা আমাদের প্রতি মিছেমিছি যে ধারণা করেছিল, সে ধারণার ভিত্তিতেই ওরা আমাদেরকে তাদের সাহায্য করার জন্য আহ্বান করেছে। আমরা কখনও তাদেরকে সাহায্যের জন্য আমাদেরকে আহ্বান করতে বলিনি। আপনাকে সাহায্যের জন্য আহ্বান না করে আমাদেরকে আহ্বান করার করণে ওরা যে শির্ক করেছে, আমরা তাদেরকে তা শিক্ষা দেইনি।

ওলিগণ কারো উপকার করতে না পারার প্রমাণ

ওলিগণ যে মৃত্যুর পর মানুষের কোনো উপকার করতে পারেন না এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো- দীর্ঘকাল থেকে তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মূর্খ মানুষেরা কত শির্কী কর্ম করে চলেছে, কত লোকেরা তাঁদের কবরে সেজদা করছে, তাঁরা জীবিত থাকতে এমনটি কেউ করলেতো তাঁরা তাতে অবশ্যই বাধা দিতেন। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে যে-সব শির্কী কর্ম করা হচ্ছে, তাত্থেকে তাঁরা কাউকে বারণ করছেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা আসলে কিছুই করতে পারেন না।

যদি পারতেন তা হলে অন্তত তাঁদের কবরে সেজদা করা থেকে লোকদের বারণ করতেন। সাধারণ লোকেরা তাঁদেরকে অসীম শক্তির অধিকারী বলে মনে করে। তাঁরা যা চান তাই করতে পারেন বলে মনে করে। ২০০৩ সালে যখন ইরাক ইঙ্গ-মার্কিনীদের অবৈধ হামলার শিকার হয়, তখন ওলীদের গোপন শক্তি থাকার ব্যাপারে বিশ্বাসী লোকেরা ভেবেছিল এবার বুশ-ব্লেয়ারের খবর হয়ে যাবে। যে মাটিতে শুয়ে আছেন গউছুল আ‘যম আব্দুল কাদির জীলানী, সে মাটিতে এবার ওদের বারোটা বাজবেই। তাঁর অভিসম্পাতে ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ওরা এ-সব মুসলিমদের কাল্পনিক বিশ্বাসকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে দিয়ে এক মাসের মধ্যেই সমগ্র ইরাক দখল করে নিল। কই বড় পীরতো তাঁর দেশ রক্ষার জন্য কিছুই করলেন না।

এমনকি তাঁদের শক্তিতে বিশ্বাস পোষণকারীদের প্রবঞ্চনা করার জন্য শয়তানের পক্ষ থেকেও কিছু করা সম্ভব হলোনা। হাজারো নিরপরাধ শিশু ও নারী অন্যায়ভাবে দুস্কৃতিকারী দখলদারদের হাতে নির্মমভাবে আত্মাহুতি দিল, তা দেখেও তিনি কিছু করলেন না। এরপরেও কি এ-কথা বিশ্বাস করা যায় যে, ওলিগণ অনেক কিছু করতে পারেন!? কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, সাদ্দাম হোসেনের স্বৈরশাসন থেকে দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য হয়তো আব্দুল কাদির তাঁকে সাহায্যের জন্য আহ্বানকারীদের ডাকে সাড়া না দিয়ে নীরব ছিলেন।

এমন চিন্তাকারীকে বলবো: সাদ্দাম হোসেনকে যদি সরাতেই হয়, তা হলে তা বুশ আর ব্লেয়ারকে দিয়ে কেন? সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি নিজেই তো তাকে সরানোর জন্য যথেষ্ট ছিলেন। তা না হয় আল্লাহর কাছে বলে দিতেন-প্রভু! সাদ্দামকে সরিয়ে দাও। ফলে আল্লাহ তাকে সরিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না। যা হবার তা-ই হয়ে গেল। এ-সব কিছু মিলে এ-কথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, আসলে ওলিগণ সাধারণ মানুষের মতই মৃত। সাধারণ মৃত মানুষের মত তাঁরাও কারো জন্যে কিছুই করতে পারেন না। কোনো অন্যায়ের কথা তাঁরা নিজ থেকে জানতে পারেন না, জানতে পারলেও তাঁরা তা রোধ করতে পারেন না। সে জন্যেই যুগ যুগ ধরে তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে শির্কী কর্ম অহরহ হয়েই চলেছে। এর পরেও কি আমরা তাঁদের নিয়ে এ-সব আকাশকুসুম ও অলীক কল্পনা লালন করতেই থাকবো? اللهم لا

[1].এ প্রসংগে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ٤٢ ﴾ [الحجر: ٤٢]

দেখুন: আল-কুরআন:সূরা:আল-হিজর: ৪২।

[2].বুখারী, প্রাগুক্ত; (আবওয়াবুল মাসাজিদ, বাব নং ৪২, হাদীস নং৪৪৯), ১/১৭৬ ;মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল মাসাজিদ, বাবনং-৮, হাদীস নং-৫৪১), ১/৩৮৪;= =রাহওয়ায়হ, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ইবন মিখলদ, মুসনাদ; সম্পাদনা: ড.আব্দুল গফুর আল-বেলূচী, (মদীনা: মাকতাবাতুল আইমান, ১ম সংস্করণ, ১৯৯১ খ্রি.); ১/১৪৮।

[3].এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন:

{كُلًا نُمِدُّ هَؤْلاَءِ وَ هَؤُلاَءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ وَ مَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُوْراً

‘‘আমি তোমার রবের দান থেকে এদের ও ওদের সবাইকে দিয়ে থাকি। আর তোমার রবের দান কারো জন্যে নিষিদ্ধ নয়’’। আল-কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল: ২০।

[4]. ইবনে তাইমিয়্যাঃ, এক্বতেদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম; পৃ. ৩২০।

[5]. ইবনে ‘আবিদীন, প্রাগুক্ত;২/১৭৫।

[6]. আল-কুরআন, সূরা ফাতির : ১৪।
দ্বিতীয় অপকৌশল: বেলায়তের দাবীদারদের দ্বারা কিছু তেলেশমাতি প্রকাশ

 আমাদের এ বিষয়টি জানা আবশ্যক যে, যারা ঈমান ও সৎ কর্ম করে বা না করে ওলি হওয়ার দাবী করে এবং বাহ্যিকভাবে চমক সৃষ্টিকারী কিছু কাজ-কর্ম দ্বারা তারা জনগণকে নিজেদের ওলি হওয়ার কথা প্রচার করতে চায়, তারা কোনো দিনই আল্লাহর ওলি নয়। প্রকৃত পক্ষে তারা শয়তানেরই ওলি। এদের দ্বারা কিছু আশ্চর্যজনক কাজ-কর্ম সংঘটিত হয়ে থাকলেও তা মূলত শয়তানেরই তেলেশমাতি। শয়তান এদের কারো অবগতি এবং কারো অবগতির বাইরে তাদের রক্ত-মাংসের সাথে মিশে গিয়ে তাদের দ্বারা অনেক অদ্ভূত কর্ম সংঘটিত করায়। অনেক সময় তাদের কাছে কেউ আগমন করলে তারা আগমনকারীকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই তার নাম ও আগমনের উদ্দেশ্য বলে দিতে পারে।

অনেক সময় তাদের সামনে উপস্থিত লোকদেরকে তারা কারো আগমনের আগাম সংবাদ দেয়। বাস্তবের সাথে তাদের কথা মিলেও যায়। অনেকে যখন পাগলের বেশে গোরস্থান ও বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তখন মস্তবড় একজন আল্লাহওয়ালা ও অচেনা মানুষের আকৃতিতে এসে শয়তান নিজেকে তাদের কাছে খিযির--এর পরিচয় দিয়ে কিছু উপদেশবাণী দিয়ে যায়। কখনও খিযির এর পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করার জন্য কোনো গাছ বা কোনো বস্তু দিয়ে যায়। আবার কাউকে স্বপ্নের মাঝে কিছু দিয়ে জনগণকে তা তা‘বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়ার উপদেশ দিয়ে যায়। আবার যখন তারা কোনো ওলির কবরের পার্শ্বে বসে মুরাকাবা করে তখন অদৃশ্যে থেকে সে তাদের সাথে অনেক সময় কথাও বলে।

শয়তানের এ ধরনের তেলেশমাতি প্রকাশ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাঃ (রহ.) বলেন:

ّ‘‘যারা শয়তাদের পছন্দনীয় কর্ম যেমন: শির্ক, ফাসেকী ও অপরাধমূলক কাজ করে, শয়তান তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। ফলে তাদের বন্ধু যাতে তার কাশফ প্রকাশ করতে পারে সে-জন্যে কখনও তারা তাকে গায়েব সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের তথ্য প্রদান করে। কখনও যাকে সে কষ্ট দিতে চায় তাকে তারা হত্যা, অসুস্থতা ইত্যাদি দ্বারা কষ্ট দেয়, কখনও কোনো মানুষকে সে ধরে আনতে চাইলে তারা তাকে ধরে নিয়ে আসে, কখনও তারা তার জন্য মানুষের কোনো অর্থ সম্পদ, খাদ্য দ্রব্য ও পোশাক ইত্যাদি চুরি করে এনে দেয় এবং সে এ-সবকে ওলিদের কারামত বলে মনে করে, কখনও তারা তাকে বাতাসে উড়িয়ে অনেক দূরবর্তী কোনো স্থানে নিয়ে যায়, কখনও ‘আরাফার দিন বিকেলে মক্কা শরীফে নিয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকই আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং সে এটাকে (নিজের) কারামত বলে মনে করে, অথচ সে মুসলিমদের হজ্জ করেনি, হজ্জের জন্য কোনো এহরামও বাঁধেনি, তলবিয়াও পাঠ করেনি, কা‘বা শরীফের তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়াতে সা‘য়ীও করেনি, অথচ সর্বজন বিদিত ব্যাপার যে, এ ধরনের কর্ম মারাত্মক ধরনের পথ ভ্রষ্টতা ’’।[1]

তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন:

‘‘মুশরিকদের পথভ্রষ্টতার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সেই সব বিষয়াদি যা তারা কবর নামের প্রতিমার কাছে দেখতে বা শুনতে পায়। উদাহরণস্বরূপ সে-সব বিষয়ের কথা বলা যায় যা তারা কোনো অনুপস্থিত ব্যক্তির আগমন সম্পর্কে আগাম সংবাদ অথবা এমন কোনো বিষয় যার দ্বারা কোনো প্রয়োজন পূর্ণ হয়েছে বা অনুরূপ কিছু শুনতে বা দেখতে পায়। সেই সব মুশরিকদের মধ্যকার কেউ যখন কোনো কবর ফেটে উজ্জ্বল কোনো শেখকে বেরিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করতে অথবা তার সাথে কথা বলতে দেখে, তখন সে মনে করে এই শেখ হলেন কবরস্থ নবী। অথচ প্রকৃতপক্ষে নবীর কবর ফেটে যায় নি, শয়তানই তাকে তা নাটক করে দেখিয়েছে’’।[2]

তিনি আরো বলেন:

‘‘যারা মৃত কোনো নবী বা অপর কাউকে আহ্বান করতে বা তাদের নিকট সাহায্যের জন্য আবেদন করতে অভ্যস্ত হয়েছে তারা দূর থেকে যখন তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আবেদন করে তখন তারা তাঁদের আকৃতিতে কাউকে দেখতে পায় অথবা যাকে তারা দেখতে পায় তাকে তারা তাঁদের আকৃতির মত বলে মনে করে এবং সে দৃশ্যমান লোক তাদেরকে বলে: আমি অমুক, এই বলে সে তাদের সাথে কথা বলে, তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে দেয়, তখন তারা মনে করে: যে মৃত ব্যক্তিকে তারা সাহায্যের জন্য আহ্বান করেছিল সেই ব্যক্তিই তাদের সাথে কথা বলেছে ও তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে দিয়েছে, অথচ এ কথোপকথনকারী হচ্ছে জিন ও শয়তান’’।[3]

এভাবে বিভিন্ন উপায়ে শয়তান তার তেলেশমাতি প্রকাশ করে এদেরকে ও সাধারণ লোকদেরকে তাদের ওলি হওয়া এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত বিষয়াদিকে তাদের ওলি হওয়ার নিদর্শন বা কারামত বলে বুঝাতে চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ওলি সাধারণত তাঁদের দ্বারা কোনো কারামত প্রকাশিত না হওয়ায় এবং তাঁদের দ্বারা শয়তানের কোনো তেলেশমাতিও প্রকাশিত না হওয়ায় অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সাধারণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে।

অপরদিকে যে সকল সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা তাঁদের জীবনকালে আল্লাহ কোনো কারামত প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের কবরগুলোকেও শয়তান তার তেলেশমাতি প্রকাশের আস্তানায় পরিণত করে। তাঁদের কবরের খাদিমদের রক্ত-মাংসে মিশে যেয়ে যেমন তাদের দ্বারা অনেক তেলেশমাতি প্রকাশ করে, তেমনি কবরে অবস্থান গ্রহণকারী বা যিয়ারতকারীদেরকেও নানাভাবে তেলেশমাতি দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। সময়ের পরিবর্তনে ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষের অজ্ঞতা যতই বাড়ছে শয়তানের তেলেশমাতী প্রকাশের ধরনও ততই বাড়ছে। যারা ফকিরী বেশে রাস্তায় উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, শয়তান তাদের সাথেও মিশে তার তেলেশমাতি প্রকাশ করছে। এ অবস্থায় কবরে যারা ঘুরে বেড়ায়, অজ্ঞ লোকদের দৃষ্টিতে তাদেরকেও ওলি বানিয়ে ছাড়ে। এ-জাতীয় ওলিদের প্রসঙ্গে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) বলেন:

‘‘কেউ যদি তার কাশফ দ্বারা অদৃশ্য কোনো বিষয় বা ভবিষ্যতের কোনো বিষয়ের সংবাদ দেয়, তা হলে এটি সে ব্যক্তির কামিল হওয়ার কোনো দলীল নয় এবং এটি তার আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ারও প্রমাণ বহন করেনা। কারণ, কারো কাশফ হওয়ার জন্য সে ব্যক্তির মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। কেননা, কাশফ একজন পাগল ও কাফির ব্যক্তিরও হতে পারে। প্রকৃত কথা হলো: অদৃশ্য সম্পর্কে কাশফ হওয়ার বিষয়টি শরীরের একটি গোপন শক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি একজন কাফির, ফাসিক ও পাগলেরও হতে পারে এবং তাদের অধিকাংশ কাশফ বাস্তবের সাথে মিলেও যায়।

এ-জাতীয় কাশফ প্রকাশকারীদের আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার সাথে কোনই সম্পর্ক নেই। তবে সাধারণ লোকেরা বর্তমানে এ ধরনের কাশফের দ্বারাই আকৃষ্ট হয়। যখনই এমন কোনো ব্যক্তির দ্বারা কোনো কাশফ হতে দেখে, তখনই তারা সে ব্যক্তিকে কামিল মানুষ বলে মনে করে, ফলে নিজেরা এতে বিভ্রান্ত হয়, অপরকেও বিভ্রান্ত করে’’।[4] তাই কারো দ্বারা কোনো কাশফ হওয়া বা কোনো ধরনের তেলেসমাতি প্রকাশিত হওয়া দেখলেই আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। এ-জাতীয় লোকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য ইমাম শাফিঈ (রহ.) বলেন:

"إذا رأيتم الرجل يمشي على الماء ، و يطير في الهواء ، فلا تغتروا به حتى تعرضوا أمره على الكتاب و السنة."

‘‘যখন তোমরা কোনো ব্যক্তিকে পানির উপর চলতে এবং বাতাসে উড়ে বেড়াতে দেখ, তখন কুরআন ও সুন্নাতের সাথে সে ব্যক্তির কর্ম ও আচরণ মিলিয়ে না দেখে তার দ্বারা প্রতারিত হবে না।’’।[5]

মানুষের ঘাড়ে শয়তানের সওয়ার হওয়ার প্রমাণ:

যারা ওলি না হয়েও বেলায়তের মিথ্যা দাবী করে, শয়তান যে তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তেলেশমাতি দেখায় এর প্রমাণে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ هَلۡ أُنَبِّئُكُمۡ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ ٱلشَّيَٰطِينُ ٢٢١ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٖ ٢٢٢ ﴾ [الشعراء: ٢٢١، ٢٢٢]

‘‘আপনি বলুন:আমি কি তোমাদেরকে তাদের সন্ধান দেব যাদের উপরে শয়তানরা অবতীর্ণ হয় ? শয়তানতো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক মিথ্যুক ও পাপিষ্ঠের উপর’’।[6]

শয়তান মানুষদের পথভ্রষ্ট করার জন্য যেমন বেলায়তের মিথ্যা দাবীদার ও পাপিষ্ঠদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে, তেমনি সে অনেক ভাল মানুষদেরকেও বিভ্রান্ত করার জন্য তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যারা শরী‘আতের জ্ঞানে পরিপক্ক থাকেন আল্লাহর রহমতে তারা তার বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু যাদের জ্ঞানের পরিধি স্বল্প তারা অনেক সময় তার বিভ্রান্তির শিকার হন। একদা আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-কেও শয়তান বিভ্রান্ত করতে এসেছিল। তিনি বলেন:

‘‘একদা আমি উপাসনায় লিপ্ত ছিলাম, হঠাৎ করে একটি বড় আরশ দেখতে পেলাম, যার উপরে রয়েছে একটি নূর, সে নূর থেকে আমাকে সম্বোধন করে বলা হলো: হে আব্দুল কাদির ! আমি তোমার রব, অন্যের উপর আমি যা হারাম করেছি, তোমার জন্য তা হালাল করে দিলাম। এ-কথা শুনার পর আব্দুল কাদির বললেন: (أنت الله الذي لا إله إلا هو) তুমি কি সেই আল্লাহ যিনি ব্যতীত অপর কোনো ইলাহ নেই? হে আল্লাহর শত্রু ! দূর হও এখান থেকে। তিনি বলেন: এ-কথার পর আরশের সেই আলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এবং তা অন্ধকারে পরিণত হল। অবশেষে আমাকে লক্ষ্য করে শয়তান বললো : দ্বীনের ব্যাপারে তোমার অগাধ জ্ঞান ও তোমার নিজের অবস্থা সম্পর্কে তোমার সম্যক অবগতির দ্বারা আমার চক্রান্ত থেকে তুমি বেঁচে গেলে। আমি এই প্রক্রিয়ায় সত্তর ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করেছি’’।[7]

শয়তান যদি আব্দুল কাদির জীলানীর মত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে পারে, তা হলে যারা জ্ঞান ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সমতুল্য নয়, তাদের কাছে যে সে কতভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বস্তুত যারা নিজেদেরকে আল্লাহর ওলি বলে প্রচার করে, যারা বেলায়ত লাভের ফিকির নিয়ে বিভিন্ন কবর ও জঙ্গলে পাগল বা মজ্যুব হয়ে ঘুরে বেড়ায়, শয়তান এদেরকে অধিক হারে তার তেলেশমাতী দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। সে জঙ্গলে ও কবরে তাদের নিকট খিযির এর পরিচয় দিয়ে আগমন করে। আবার কারো কাছে আব্দুল কাদির (রহ.)-এর নিকট আগমনের ন্যায় আল্লাহর পরিচয় দিয়ে আগমন করে। যেমন মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী এমনটি দাবী করেছে। সে নাকি আল্লাহ তা‘আলাকে একটি যুবকের মত দেখেছে।[8]

মোটকথা যারাই আল্লাহর ওলি হওয়ার শরী‘আত নির্ধারিত ঈমান ও তাকওয়ার পথ বাদ দিয়ে বৈরাগ্য অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর ওলি হতে চায় এবং এ অবস্থায় আল্লাহ, রাসূল, খিযির ও কোনো ওলির সাথে সাক্ষাৎ পেতে চায়, শয়তান তাদের সাথে কোনো একটি আকর্ষণীয় আকৃতিতে এসে বলে- আমি আল্লাহ বা রাসূল বা খিযির অথবা সেই অলি, যার সাথে তুমি সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছো। কিন্তু তারা তাদের অজ্ঞতার কারণে এ কথা বুঝে উঠতে পারেনা যে, আসলে তাদের সাথে যে সাক্ষাত করেছে সে হলো শয়তান।

[1].তিনি বলেন:

و الشياطين يوالون من يفعل ما يحبونه من الشرك و الفسوق و العصيان ، فتارة يخبرونه ببعض الأمور الغائبة ليكاشف بها ، و تارة يؤذون من يريد إيذائه بقتل أو تمريض و نحو ذلك ، و تارة يجلبون له من يريد من الإنس ، و تارة يسرقون له ما يسرقون من أموال الناس من نقود وطعام و ثياب و غير ذلك ، فيعتقد أنه من كرامات الأولياء ، و تارة يحملونه في الهواء فيذهبون به إلى مكان بعيد فيذهبون به إلى مكة عشية عرفة و يعودون به فيعتقد هذا كرامة مع أنه لم يحج حج المسلمين : لا أحرم و لا لبى و لا طاف بالبيت وبين الصفا و المروة و معلوم أن هذا من أعظم الضلال ".

ইবনে তাইমিয়্যাঃ, আল-ক্বা’ইদাতুল জালীলাঃ ফিত তাওয়াসসুলি ওয়াল অছীলাঃ; সম্পাদনায় সৈয়দ রশীদ রেজা, (...: মাকতাবাতিছ ছেক্বাফাতিত দ্বীনিয়্যাঃ, স্ংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীণ), পৃ. ২৯।

[2]. তিনি বলেন,

إن من أعظم ضلال المشركين ما يرونه أو يسموعونه عند الأوثان كإخبار عن غائب أو أمر يتضمن قضاء حاجة و نحو ذلك ، فإذا شاهد أحدهم القبر انشق و خرج منه شيخ بهي عانقه أو كلمه ، ظن أن ذلك هو النبي المقبور ، و القبر لم ينشق و إنما الشيطان مثل له ذلك

ইবনে তাইমিয়্যাঃ, আত্তাওয়াস্সুল ওয়াল ওসীলাতু ; পৃ.৩১, ৩২।

[3]. তদেব; পৃ.৩০।

[4].মুহাম্মদ শফী’, মাজালিসু হাকীমিল উম্মাত; (দিল্লী: রববানী বুক ডিপো, সংস্করণ বিহীন, ১৩৯৬হি:), পৃ. ৪৯-৫০।

[5]. ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত ; পৃ.৫৭৩।

[6]. আল-কুরঅন, সূরা শু’আরা: ২২১-২২২।

[7]. ইবনে তাইমিয়্যাহ, আত-তাওয়াসসুলু ওয়াল ওসীলাতু; পৃ. ৩১। আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল : এ আলো যে শয়তানের, তা আপনি কী করে বুঝলেন? জবাবে তিনি বলেন : আমি তার কথা (قد أحللت لك ما حرمت على غيرك) এর দ্বারা তাকে বুঝতে পেরেছি। কেননা, আমি জানি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরী’আত রহিত ও পরিবর্তন হবার নয়। তা ছাড়া সে বলেছিল: আমি তোমার রব। কিন্তু তার পক্ষে (أنا الله الذي لا إله إلا هو) এ কথা বলা সম্ভব হয়নি। এত্থেকেও তার শয়তান হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি।’’

[8]. দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪০ নং টীকা দ্রষ্টব্য।
আল্লাহ ও রাসূলকে কারা স্বপ্নে দেখতে পারেন?

আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে কেবল তারাই দেখতে পারেন যারা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর গুণে গুণান্বিত।[1] কিন্তু, যাদের অবস্থা উপরে বর্ণিত হয়েছে তারা কোনো দিন তাঁদেরকে জাগ্রত অবস্থায় দেখাতো দূরের কথা, কখনো স্বপ্নে দেখারও কথা নয়। তা ছাড়া আল্লাহ তা‘আলাকে জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে থাকাকালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও দেখেন নি। মে‘রাজের রাতে কোনো এক স্থানে আল্লাহর সাথে তাঁর একান্ত কথা-বার্তা হওয়ার সময় তিনি কি আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন? এ নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে স্বচক্ষে দেখেছেন। তবে অধিকাংশ মনীষীদের মতে স্বচক্ষে দেখেন নি। বরং অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখেছিলেন।[2] এবং পর্দার অন্তরাল থেকেই উভয়ের মাঝে কথা-বার্তা হয়েছিল। কুরআনুল কারীম দ্বারা এ কথারই সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ ۞وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللَّهُ إِلَّا وَحۡيًا أَوۡ مِن وَرَآيِٕ حِجَابٍ أَوۡ يُرۡسِلَ رَسُولٗا فَيُوحِيَ بِإِذۡنِهِۦ مَا يَشَآءُۚ ﴾ [الشورا: ٥١]

‘‘আর কোনো মানুষের পক্ষে এমনটি হওয়া সম্ভবপর নয় যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তবে তিনি মানুষের সাথে ইলহাম বা পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন। অথবা (সে জন্য) তিনি কোনো দূত প্রেরণ করেন, অতঃপর সে দূত আল্লাহ যা চান তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেন’’।[3]এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষের সাথে মোট তিনভাবে কথা বলেন:

এক, ওহী অর্থাৎ গোপন পন্থায় ইলহাম বা স্বপ্নের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নবী-রাসূল ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন।

দুই, পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন।

তিন, রাসূল তথা ফেরেশ্তা প্রেরণের মাধ্যমে কথা বলেন। মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী‘ও উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।[4]

আল্লাহ তা‘আলা যখন মানুষের সাথে উপর্যুক্ত এ তিন মাধ্যমে কথা বলে থাকেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ-কথা প্রমাণিত হয় যে, মে‘রাজের রজনীতে তিনি রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে পর্দার অন্তরাল থেকেই কথা বলেছিলেন। মূসাও আল্লাহ তা‘আলাকে সরাসরি দেখার জন্য আবেদন করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বলেছিলেন:

﴿ قَالَ لَن تَرَىٰنِي وَلَٰكِنِ ٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡجَبَلِ فَإِنِ ٱسۡتَقَرَّ مَكَانَهُۥ فَسَوۡفَ تَرَىٰنِيۚ فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُۥ لِلۡجَبَلِ جَعَلَهُۥ دَكّٗا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقٗاۚ ﴾ [الاعراف: ١٤٣]

‘‘তুমি আমাকে কস্মিনকালেও (সরাসরি) দেখতে পারবে না, তবে তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও সেটি যদি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তাঁর প্রভু পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, তখন তিনি সেটাকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন’’।[5] এ আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, এ দুনিয়াতে থাকাবস্থায় বা আখেরাতের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলাকে চর্মচক্ষে দেখা কোনো নবী-রাসূল ও ওলিদের পক্ষেও সম্ভবপর নয়।

যুক্তির দিক থেকে দুনিয়ায় আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখার সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে যখন মূসা এবং আমাদের রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে সরাসরি দেখা সম্ভব হয়নি, তখন অন্য কারো পক্ষে যে তা আদৌ সম্ভবপর হবে না, তা বলা-ই বাহুল্য। এর পরেও কেউ যদি এ দুনিয়ায় আল্লাহকে সরাসরি স্বচক্ষে দেখেছে বলে দাবী করে, তবে সে যে একজন মস্তবড় মিথ্যুক হবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ব্যতীত অপর কারো জন্যে এ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখার কথাকে বিশ্বাস করে এদেরকে ইমাম কাওয়াশী অমুসলিম বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]

আক্বীদা বিষয়ক কবিতায় জনৈক কবি বলেন:

و من قال في الدنيا يراه بعينه ** فذاك زنديق طغا و تمردا

و خالف كتاب الله و الرسل كلها ** و زاغ عن الشرع الشريف و أبعدا

‘‘যে বলে আল্লাহকে দুনিয়ায় স্বচক্ষে দেখা যায়, সে হলো যিন্দীক, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। আল্লাহর কিতাব এবং সকল রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আর শরী‘আত থেকে বিপথগামী হয়ে বহু দূরে চলে গেছে’’।[7]

অপর দিকে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর তাঁকেও তাঁর সাহাবীগণ কখনও জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পায়নি। এমতাস্থায় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার কথা বলে তারা আসলে শয়তানকেই দেখে। ‘‘রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা স্বপ্নে দেখে তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখতে পাবে’’[8] এ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়ে থাকলেও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখ নিঃসৃত মূল বাণীটি কী, এ নিয়ে এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মুসলিম এর বর্ণনায় বর্ণনাকারীগণ সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন:‘‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে, অথবা সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখলো’’।[9] রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল বাণী যদি ‘‘সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখলো’’ এমনটি হয়, তা হলে এ হাদীস নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। তা না হয়ে যদি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল বাণী ‘‘সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে’’ হয়ে থাকে, তা হলে এ হাদীসের সঠিক অর্থ কী হবে, এ নিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা বলেছেন:

যদি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মূল বাণী হয় ‘‘সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে’’- তা হলে এ বাক্যটি তাঁদের মতে একটি জটিল বাক্য। এর সমাধানে তারা মোট ছয়টি মতামত ব্যক্ত করেছেন। যা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে বর্ণিত হলো:

এক, এটি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- একটি উপমা স্বরূপ বলেছেন। অর্থাৎ -যে তাঁকে স্বপ্নে দেখবে, তার এ দেখাটি তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার মতই হবে।

দুই. যে এমনটি দেখবে সে জাগ্রত হয়ে তার এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা যথাযথভাবে দেখতে পাবে।

তিন. এ হাদীসটি তাঁর সমসাময়িক লোকদের সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ-তাঁর সময়কার যে ব্যক্তি তাঁকে না দেখে ইসলাম গ্রহণ করার পর এমন স্বপ্ন দেখবে, সে তাঁকে তাঁর জীবদ্দশায় কিছু দিন পরে হলেও দেখতে পারে।

চার. যে এমন স্বপ্ন দেখবে সে রাসূলের আয়নাতে তাঁকে দেখতে পাবে। যেমনটি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখেছিলেন।

পাঁচ. যে এমনটি দেখবে, সে কেয়ামতের দিন তাঁকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে দেখতে পাবে। ছয়. যে এমনটি দেখবে, সে বাস্তবে তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে। তবে এ অর্থ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু সমস্যা রয়েছে যা তা গ্রহণের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে।[10] হাদীসবিদ ইবনে হাজার ‘আসক্বালানী উক্ত বাহ্যিক অর্থকে একটি জটিল ও অবিশ্বাস্য অর্থ বলে মন্তব্য করেছেন।[11]

>
[1]. যারা আহলুত তাওফীক কেবল তাঁরাই রাসূল কে স্বপ্নে দেখতে পারে। কিন্তু যারা তাদের দলভুক্ত নয়, তাদের স্বপ্নে দেখার বিষয়টি সত্য হতেও পারে, আবার মিথ্যাও হতে পারে। কেননা, শয়তানের চক্রান্তের মাধ্যমে একজন যিন্দিক তথা কাফিরের দ্বারাও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন তা হয়ে থাকে একজন সত্যবাদীর জন্য কারামতস্বরূপ। তবে উভয়ের মাঝে পার্থক্য অর্জিত হবে কিতাব ও সুন্নাতের অনুসরণের দিক বিবেচনা করে। যিনি কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী হবেন তাঁর স্বপ্ন সত্য হবে, আর যিনি কিতাব ও সুন্নাতের অনুসারী হবেন না, তার স্বপ্ন মিথ্যা হবে। দেখুন: ইবনে হাজার আসক্বালানী, ফতহুলবারী; ১২/৩৮৫।

ثم ذكر أنه عام في أهل التوفيق وأما غيرهم فعلى الاحتمال فان خرق العادة قد يقع للزنديق بطريق الإملاء والإغواء كما يقع للصديق تحصل التفرقة بينهما باتباع الكتاب والسنة انتهى.

[2]. এ প্রসঙ্গে মুল্লা আলী ক্বারী হানাফী বলেন:

" إن أهل السنة و الجماعة و إن أجازوا رؤية الله في الدنيا عقلا ، وواقعة و ثابتة في العقبى سمعا ونقلا ، لكنهم اختلفوا في جوازاها في الدنيا شرعا . والذين أثبتوها في الدنيا خصوا وقوعها له صلى الله عليه وسلم في ليلة الإسراء، على خلاف في ذلك بين السلف والخلف من العلماء و الأولياء... ثم قال و الصحيح أنه صلى الله عليه وسلم إنما رأى ربه بفؤاده ، لا بعينه"

--:দেখুন: ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত;পৃ. ১৮৪।

[3]. মাওলানা মুহাম্মদ শফী‘;প্রাগুক্ত; পৃ.১২২৬।

[4]. তদেব; পৃ.১২২২।

[5]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৪৩।

[6].ইমাম কাওয়াশী সূরা নাজম এর তাফসীরে বলেন:

" ومعتقد رؤية الله تعالى هنا بالعين لغير محمد صلى الله علية وسلم غير مسلم".

:দেখুন:ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত;১৮৪।

[7]. তদেব; পৃ.১৮৬।

[8]. " مَنْ رَأَنِيْ فِيْ المَنَامِ فَسَيَرَانِيْ فِي الْيَقْظَةِ وَ لاَ يَتَمَثَّلُ بِيْ الشَّيْطَانُ."বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুর রু’য়া, বাব নং ১০, হাদীস নং ৬৫৯২), ৬/২৫৬৭; ইবনে হাজার ‘আসক্বালানী, ফতহুলবারী; ১২/৩৮৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুর রু’য়া, হাদীস নং ২২৬৬), ৪/১৭৭৫।

[9].ইমাম মুসলিম এর বর্ণনায় সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়েছে (فسيراني في اليقظة أو لكأنما رأني في اليقظة) ‘‘আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে অথবা সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থার মতই দেখলো’’এ কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইসমাঈলী উক্ত কথার বদলে বলেছেন: (فقد رأني في اليقظة) ‘‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখলো’’। দেখুন:মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/১৭৭৫।

[10].তিনি বলেন:

الحاصل من الأجوبة ستة أحدها أنه على التشبيه والتمثيل ودل عليه قوله في الرواية الأخرى فكأنما رأني في اليقظة، ثانيها: أن معناها سيرى في اليقظة، ثالثها:أنه خاص بأهل آلاف ممن آمن به قبل أن يراه، رابعها:أنه يراه في المرآة التي كانت له إن أمكنه ذلك ، وهذا من أبعد المحامل، خامسها: أنه يراه يوم القيامة يمزيد الخصوصية لا مطلق من يراه حينئذ ممن لم يره في المنام، سادسها: أنه يراه في الدنيا حقيقة و يخاطبه ، و فيه ما تقدم من الإشكال

দেখুন: ইবনে হাজার, ফাতহুলবারী, ১২/৩৮৫।

[11]. এক দল সালেহীন থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখার পর পুনরায় তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখেছেন। কিছু বিষয় সম্পর্কে তারা তাঁকে জিজ্ঞাসাও করেছেন। এবং জিজ্ঞাসার ফলাফলও সঠিকমত পেয়েছেন। ইবনে হাজার এ-কথা উল্লেখ করে বলেন: তাদের এ দাবী যদি সত্যি হয়, তা হলে তা একটি জটিল বিষয় হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, এতে তারা সাহাবী হওয়ার মর্যাদা পাবেন, এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা এভাবে রাসূলকে দেখেছে বলে দাবী করবে, তারাও সাহাবী হওয়ার মর্যাদা পাবে। অপর পক্ষে এমনও কিছু মনীষী রয়েছেন, যাঁরা রাসূলকে স্বপ্নে দেখেছেন বলে বর্ণানা করেছেন, কিন্তু তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার কথা বলেন নি। সে-জন্য যারা রাসূলকে জাগ্রত দেখার কথা বলেন তাদের কথাকে বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করলে তা একটি জটিল অর্থ বলেই প্রতীয়মান হয়। দেখুন: তদেব।

খিযির আলাইহিস সালাম জীবিত আছেন কি না, এটি একটি বিতর্কিত বিষয়। যদি তিনি জীবিত থাকতেন, তা হলে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তাঁর সাহাবীদের সাথে কম হলেও দু’একবার সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু তাঁদের সাথে কখনও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়না। এমতাবস্থায় বেলায়তের দাবীদার ও পাগলদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা কী করে সত্য হতে পারে? এতে প্রমাণিত হয় যে, বেলায়তের দাবীদারগণ শর‘য়ী দৃষ্টিতে কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর ওলি নয়, তারা শয়তানের অলি।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে সাধারণ মানুষের কাছে এরাই হলো আল্লাহর বড় অলি। শয়তান এদের মাধ্যমেই সমাজে তার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে। বড় বড় ওলিদের কবরে আস্তানা গেড়ে বসে থেকে সেখানে নিবেদনকারীদের যে-সব মনোবাঞ্ছা তার পক্ষে পূর্ণ করা সম্ভব, তা সে পূর্ণ করে দিচ্ছে। আর এর দ্বারা সাধারণ লোকদেরকে সহজেই তার শিকারে পরিণত করছে। সাধারণ লোকেরা এ-গুলোকে সে-সব ওলি ও বেলায়তের মিথ্যা দাবীদারদের রূহানী শক্তির বলে প্রকাশিত কারামত হিসেবে মনে করছে।

যারা ঈমান ও তাক্বওয়ার গুণে গুণান্বিত মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁরাই যে সত্যিকারের ওলি সে কথা আমরা এ পরিচ্ছেদের মধ্যেই একটু পূর্বে বর্ণনা করে এসেছি। সে অনুযায়ী যারাই এ’দুটি গুণ অর্জন করতে সক্ষম হবে তাঁরাই হবে আল্লাহর অলি। মানব সমাজে তাদের পরিচিতি আলেম, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, কৃষক, ক্ষেতমজুর, ঝাড়ুদার ও মূচি যা-ই থাকুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই একেকজন আল্লাহর ওলি হয়ে থাকবে। তাদের প্রত্যেকের জন্যেই আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভের অভয়বাণী থাকবে। প্রত্যেক মুসলিমকে নিজের পরকালীন মুক্তির জন্য ঈমান ও তাক্বওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে। যারা এ যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেন, তারা কস্মিনকালেও নিজেদেরকে আল্লাহর ওলি হয়েছেন বলে দাবী করতে পারেন না। ওলিদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আখেরাতে যে অভয়বাণীর কথা বলা হয়েছে, তারা বেশী হলে সেই সুসংবাদ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারেন।

কোনো অবস্থাতেই এর জন্য তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেন না। কেননা, তাদের ধর্ম-কর্ম আল্লাহর কাছে গৃহীত হচ্ছে কি না, তা তো কেবল আল্লাহ ব্যতীত আর কেউই সঠিক করে বলতে পারেনা। তাঁরা নিজের ধর্ম-কর্ম স্রে্ফ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যেই করে থাকেন বলে কোনো দিনই তাঁরা নিজের ব্যাপারে ‘আমি আল্লাহর ওলি হয়ে গেছি’ বলে এ ধরনের কোনো দাবী করতে এবং এ নিয়ে কোনো আত্মতৃপ্তিও অনুভব করতে পারেন না। এ ধরনের দাবী করা কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক ও প্রকৃত মু’মিনের কাজ হতে পারে বলেও তাঁরা মনে করতে পারেন না। তাঁদের দ্বারা কোনো কারামত প্রকাশিত হয়ে থাকলে কারো কাছে তাঁরা তা বলে বেড়াতেও পারেন না।

তৃতীয় অপকৌশল : ওলিগণ মানুষের আহ্বান শ্রবণ করতে পারেন বলে ধারণা প্রদান

যে মানুষ মরে যায়, সে মানুষ আমাদের দৃষ্টিতে কোনো ওলি হোন আর না-ই হোন, তিনি মরে যাওয়ার পর তার আর কোনো অনুভূতি থাকেনা। তাকে হাজার বার আহ্বান করলেও তিনি আর তা শুনতে পান না। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। কিন্তু, শয়তান অলিগণের ব্যাপারে সাধারণ জনমনে একটি স্বতন্ত্র ধারণা দিতে চেষ্টা করেছে যে, তাঁরা মরেও মরেন না। তাঁরা কেবল ইনতেকাল বা স্থানান্তরিত হন। স্থান পরিবর্তনের পর তাঁদের রূহানী শক্তি পূর্বের চেয়ে আরো বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই যে যেখান থেকেই তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করুক না কেন, তাঁরা নিজ নিজ কবর থেকেই তা শুনতে পান এবং আহ্বানকারী ব্যক্তির উপকার করেন। প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেন।

শয়তানের এ অপকৌশল ছিন্ন করার জন্য আমাদেরকে দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে:

এক, মানুষের দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার পর মানুষ কি মরে যায়, না ইন্তেকাল করে? মৃত্যুর পর রূহ কোথায় যায় ?

দুই, মৃত মানুষের শ্রবণের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য কী?

মানুষ মরে না ইন্তেকাল করে?

এ-কথা সত্য যে, আমাদের দেহের সাথে রূহের সহঅবস্থান যতদিন থাকে, ততদিন আমরা এ ইহজগতে জীবিত থাকি। আর যখন তা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন আমাদের এ দেহ মরে যায়। আমাদের দেহ মরে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা বরযখী জগতে স্থানান্তরিত হই। এটি হচ্ছে পরজগতের প্রথম ধাপ। এ সময় আমাদের দেহ মরে গেলেও রূহ মরে না। এমতাবস্থায় একজন মানুষ মরে যাওয়ার পর তিনি মরে গেছেন না ইন্তেকাল করেছেন কোনটি বলবো ?

মৃত্যুর মাধ্যমে সকল মানুষ পরজগতে স্থানান্তরিত হলেও কুরআনুল কারীমের পরিভাষায় তাদেরকে স্থানান্তরিত হয়েছেন না বলে মরে গেছেনই বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ মানুষ বলে কুরআন ও হাদীসে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুকে মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّكَ مَيِّتٞ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ ٣٠ ﴾ [الزمر: ٣٠]

‘‘নিশ্চয় তোমারও মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে’’।[1] অপর স্থানে বলেছেন:

﴿ وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٞ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهِ ٱلرُّسُلُۚ أَفَإِيْن مَّاتَ أَوۡ قُتِلَ ٱنقَلَبۡتُمۡ عَلَىٰٓ أَعۡقَٰبِكُمۡۚ ﴾ [ال عمران: ١٤٤]

‘‘আর মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র, তাঁর পূর্বেও রাসূলগণ অতিবাহিত হয়েছেন, তিনি যদি মরে যান বা নিহত হন, তা হলে তোমরা কি তোমাদের পিছনে ফিরে যাবে’’।[2]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণও তাঁর মৃত্যুকে ইন্তেকাল না বলে মৃত্যু বলেই মনে করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর যখন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যরূপ চিন্তা করেছিলেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সবাইকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন:

[مَنْ كَانَ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ وَ مَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنَّ اللهَ حَيٌّ لاَيَمُوْتَ.]

‘‘যে মুহাম্মদ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপাসনা করে সে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে আল্লাহর উপাসনা করে সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ নিশ্চিত জীবিত, তিনি মরেন না’’।[3] রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুকে আল্লাহ ও সাহাবীদের দৃষ্টিতে যদি ইন্তেকাল না বলে মৃত্যু বলা হয়, তা হলে অন্য কারো মৃত্যুকে মৃত্যু না বলে ইন্তেকাল বা স্থানান্তরিত বলার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। তর্কের খাতিরে যদি তা স্বীকার করেও নেয়া হয়, তবুও কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া মৃতদের রূহের শ্রবণের বিষয়টি স্বীকার করা যায়না।

মৃত্যুর পর মানুষের রূহ কোথায় যায়?

মৃত মানুষের রূহের শ্রবণ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে মৃত্যুর পর মানুষের রূহ কোথায় যায়-এ বিষয় সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা হলে মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কিত অনেক জিজ্ঞাসারই জবাব আমরা অতি সহজেই অবগত হতে পারবো।

এ বিষয়ে কুরআন, হাদীস ও মনীষীগণের মতামত যাচাই করে যা জানা যায় তা হলো:মানুষ মরে যাওয়ার পর নাকীর ও মুনকার ফেরেশ্তাদ্বয়ের জিজ্ঞাসাবাদের পূর্বে মানুষের শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর সে সম্পর্ক পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর রূহ কোথায় যায় আল্লামা ইবনু আবিল ইয্‌য আল-হানাফী এর বর্ণনানুযায়ী এ নিয়ে মনীষীদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। নিম্নে এর উল্লেখযোগ্য কয়কেটি মত বর্ণিত হলো:

১. মু’মিনদের রূহসমূহ জান্নাতে অবস্থান করে এবং কাফিরদের রূহসমূহ জাহান্নামে অবস্থান করে।

২. মু’মিনদের রূহসমূহ জান্নাতের বাইরে এর দরজার নিকটবর্তী প্রাঙ্গনে থাকে, সেখানে থেকেই তারা জান্নাতের সুঘ্রাণ ও জীবিকা লাভ করে।

৩. ইমাম মালিক (রহ.) বলেন: আমার নিকট এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, রূহসমূহ মুক্ত থাকে এবং তা যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ায়।

৪. কা‘ব আল-আহবার এর মতে মু’মিনদের রূহ সপ্তম আকাশে অবস্থিত ‘ইল্লিয়্যীন’ নামক স্থানে অবস্থান করে এবং কাফিরদের রূহ সপ্তম জমিনের নিচে ‘সিজ্জীন’ নামক স্থানে থাকে।

৫. ইমাম ইবনে হাযাম বলেন: শরীর সৃষ্টির পূর্বে রূহ যেখানে ছিল মৃত্যুর পর তা সেখানে অবস্থান করে।

৬. ইমাম ইবনে ‘আব্দিল বার বলেন:শহীদদের রূহসমূহ জান্নাতে থাকে এবং অন্যান্য সাধারণ মু’মিনদের রূহ তাদের কবর প্রাঙ্গনে থাকে।[4]

৭. শেখ আব্দুর রহমান আল-জাযা-ইরী বলেন: কবরে জিজ্ঞাসাবাদের পর মানুষের রূহসমূহ ইল্লিয়্যীন অথবা সিজ্জিনে থাকে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা এ-ভাবেই বন্দী অবস্থায় থাকে। প্রত্যেকের শরীরের সাথে তার রূহের সম্পর্ক ঠিক সেভাবে হয়ে থাকে যেভাবে মোবাইল ফোনের সংযোগ টাওয়ারের সাথে থাকে। এ সংযোগের মাধ্যমেই একজন কবরবাসী তাকে যিয়ারতকারী ও সালামকারীদের সম্পর্কে অবগত হয়ে থাকে।[5]

৮. ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাঃ বলেন: রূহ দু’প্রকার:এক, শাস্তি ভোগকারী রূহ। দুই, আরাম ভোগকারী রূহ। যারা শাস্তির মধ্যে রয়েছে তারা কেউ কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না। আর যারা শান্তিতে রয়েছে তারা পরস্পরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে।[6]

উপর্যুক্ত মতামতসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে এ-কথা প্রমাণিত হয় যে, মৃত্যুর পর রূহ কোথায় যায়, এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট দলীল না থাকার কারণেই মনীষীগণ এ ব্যাপারে উপর্যুক্ত মতামত ব্যক্ত করেছেন। রূহ কবরে থাকে এ-কথা যদি নিশ্চিত করে বলা না যায়, তা হলে রূহকে সম্বোধন করে কিছু বললে তা শ্রবণ করতে পারে, এ-কথা নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই।

মৃত মানুষের শ্রবণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য :

কুরআন ও হাদীসের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিদান করলে দেখা যায় যে, জীবিত মানুষ যেভাবে শ্রবণ করতে পারে মৃত মানুষ সেভাবে শ্রবণ করতে পারেনা। এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য আমরা নিম্নে বর্ণিত আয়াতসমূহের প্রতি লক্ষ্য করতে পারি। যারা জীবিত থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে সত্যকে গ্রহণ না করে মৃত মানুষের ন্যায় আচরণ করে মহান আল্লাহ তাদের ব্যাপারে বলেন:

﴿ فَإِنَّكَ لَا تُسۡمِعُ ٱلۡمَوۡتَىٰ ﴾ [الروم: ٥٢]

‘‘তুমি মৃতদের শ্রবণ করাতে পারবে না’’।[7] অপর আয়াতে বলেছেন:

﴿ وَمَا يَسۡتَوِي ٱلۡأَحۡيَآءُ وَلَا ٱلۡأَمۡوَٰتُۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُسۡمِعُ مَن يَشَآءُۖ وَمَآ أَنتَ بِمُسۡمِعٖ مَّن فِي ٱلۡقُبُورِ ٢٢ ﴾ [فاطر: ٢٢]

‘‘শ্রবণ করার ক্ষেত্রে জীবিত আর মৃতরা এক নয়, নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শ্রবণ করান, তুমি কবরে শায়িতদেরকে শুনাতে পারবে না’’[8] অত্র আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা‘আলা জীবিত মুশরিক ও কাফিরদের কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা না শুনার অবস্থাকে কবরবাসীদের শ্রবণ না করার অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। কবরবাসীরা শ্রবণ করতে পারে কি না, এ-কথা বলা এ আয়াত দু’টির মুখ্য উদ্দেশ্য না হয়ে থাকলেও যেহেতু আয়াত দু’টিতে মুশরিকদের শ্রবণ না করার অবস্থাকে মৃত মানুষ বা কবরস্থ মানুষের না শুনার সাথে তুলনা করা হয়েছে, এতে প্রমাণিত হয় যে, আসলে মৃত মানুষেরা নিজ থেকে কিছু শুনতে পারে না। কেননা, একটি বস্তুকে অপর বস্তুর বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনা কেবল তখনই করা হয় যখন সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্যে উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য থাকে বা অপর বস্তুর মধ্যে সে বৈশিষ্ট্যটি অধিকমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এতে বুঝা যায় যে, মৃতরা নিজ থেকে আদৌ কিছু শুনতে পারে না বলেই মুশরিকদের না শুনাকে মৃতদের না শুনার সাথে তুলনা করা হয়েছে।

উপর্যুক্ত আয়াত দু’টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত হাদীসবিদ আল্লামা আলবানী (মৃত ১৯৯৯ খ্রি.)বলেন:‘‘উক্ত আয়াত দু’টিতে মুশরিকদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা না শুনার অবস্থাকে মৃত মানুষের শ্রবণ না করার অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, মৃত লোকেরা আসলে নিজ থেকে কিছুই শ্রবণ করতে পারে না। একজন মানুষের সাহসিকতার প্রশংসা করে যদি তাকে সিংহের সাথে তুলনা করা হয়, তা হলে এতে যেমন সিংহের দুর্দান্ত সাহসিকতা প্রমাণিত হয়, ঠিক তেমনি উক্ত আয়াত দু’টিতে কাফিরদের শ্রবণ না করাকে মৃত মানুষের শ্রবণ না করার সাথে তুলনা করাতে মৃতদের শ্রবণ না করার কথাই প্রমাণিত হয়।

শুধু তা-ই নয়, আরবী ভাষায় দক্ষ প্রতিটি মানুষই এ তুলনার দ্বারা এ-কথাই বুঝবে যে, মৃতরা শ্রবণ করার ক্ষেত্রে জীবিতদের চেয়ে অধিক অক্ষম। আর সে কারণেই জীবিতদের শ্রবণ না করাকে মৃতদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, মৃতরা আদৌ কিছুই শ্রবণ করতে সক্ষম নয়’’।[9]

মৃতরা নিজ থেকে জীবিতদের কর্মের ভাল-মন্দ অবগত হতে পারলে সর্বপ্রথম তা নবী ও রাসূলগণেরই অবগত হওয়ার কথা। তাদের পরবর্তী উম্মতগণ শরী‘আত অনুসারে চলেছে কি না, বা তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে কেউ শির্ক করেছে কি না, তা তাঁদের খুব ভাল করেই জানা থাকার কথা। কিন্তু কুরআনের বক্তব্যানুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা মৃত্যুর পর এ-সব বিষয়ে নিজ থেকে কিছুই অবগত হতে পারেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞يَوۡمَ يَجۡمَعُ ٱللَّهُ ٱلرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَآ أُجِبۡتُمۡۖ قَالُواْ لَا عِلۡمَ لَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ١٠٩ ﴾ [المائ‍دة: ١٠٩]

‘‘যেদিন আল্লাহ সকল রাসূলদেরকে একত্রিত করবেন তখন তিনি তাঁদেরকে বলবেন:তোমরা (তোমাদের পরবর্তী উম্মতদের পক্ষ থেকে) কী উত্তর পেয়েছিলে? তাঁরা বলবেন: (এ ব্যাপারে) আমাদের কোনই জ্ঞান নেই, আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে মহা জ্ঞানী’’।[10] রাসূলগণ মরে যাওয়ার পর মোট দু’টি মাধ্যমে তাঁদের জ্ঞান আহরণের সম্ভাবনা থাকতে পারে:

এক.মৃত্যুর পরেও হয়তো তাঁরা জীবিত থাকার ন্যায় নানাভাবে জ্ঞান আহরণ করে থাকবেন এবং সে অনুযায়ী কারা তাঁদের অনুসরণ করলো আর কারা করলো না, তা তাঁরা জেনে থাকতে পারেন।

দুই.নতুবা মৃত্যুর পর আল্লাহ তা‘আলা নিজ থেকে তাদেরকে শ্রবণ করার ও জানার এমন কোনো অতিরিক্ত যোগ্যতা দিয়ে থাকবেন, যার মাধ্যমে তাঁরা মরে গিয়ে থাকলেও দুনিয়ায় কে কী করলো, তা শুনে ও জেনে থাকবেন।কিন্তু এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলগণ মরে যাওয়ার পর জ্ঞান আহরণের উপর্যুক্ত দু সম্ভাবনার কোনো সম্ভাবনা দিয়েই তাঁরা কোনো জ্ঞান আহরণ করতে পারেন না। জীবিত মানুষেরা কী করে, তাঁরা এর কোনো কিছুই অবগত হতে পারেন না। যদি পারতেন, তা হলে তাঁরা তাঁদের পরবর্তী উম্মতদের অনুসরণের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারতেন।

তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে যারা শির্ক করেছে, আখেরাতে তাঁরা আল্লাহর প্রশ্নের জবাবে সে-সব লোকদের কর্মের অবস্থা বর্ণনা করতেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা এ-সব কিছুই অবগত হতে পারেন না, সে-জন্যে তাঁরা সেদিন বলবেন, প্রভু ! এ-সবতো অদৃশ্যের ব্যাপার। কাজেই তা কেবল আপনারই জানার কথা। আমাদের পক্ষে তা জানার বা শুনার কোনই উপায় নেই। রাসূলগণ যদি মৃত্যুর পর তাঁদের উম্মতদের কর্ম সম্পর্কে কিছুই শুনতে ও জানতে না পারেন, তা হলে অবশিষ্ট ওলি ও সাধারণ মানুষেরা যে কিছুই শুনতে ও জানতে পারবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা যুমার:৩০।

[2]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান: ১৪৪।

[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবু ফাযাইলিস সাহাবাহ, বাব নং-৫, হাদীস নং ৩৪৬৭), ৩/১৩৪১;বায়হাক্বী, আহমদ ইবনে হুসাইন, আস্সুনানুল কুবরা; (মক্কা: মাকতাবাতু দারুল বায, সম্পাদনা: মুহাম্মদ আব্দুল কাদির আত্বা, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯৪ খ্রি.), ৮/১৪২;ইবনে কাছীর, তাফসীরুল রুরআনিল আজীম; ১/৪১০।

[4].আল্লামা ইবনু আবিল ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪৫৩, ৪৫৪।

[5].শেখ আব্দুর রহমান আল-জাযাইরী, ‘আক্বীদাতুল মু’মিন; পৃ.৪১৮।

[6]. ইবনু কাইয়্যিম, কিতাবুর রূহ; পৃ.২৬।

[7]. আল-কুরআন, সূরা রূম:৫২।

[8]. আল-কুরআন, সূরা ফাতির:২২।

[9]. নু’মান ইবন মুহমূদ, প্রাগুক্ত;পৃ. ২৭-২৮।

[10]. আল-কুরআন, সূরা মা-ইদাহ :১০৯।
দেহে প্রাণ থাকলেই কেবল সকল জীব শ্রবণ করতে পারে

উপর্যুক্ত আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, মানুষসহ সকল জীবের দেহের সাথে যতক্ষণ তাদের রূহের স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে, ততক্ষণ তাদের দেহ জীবিত থাকে এবং ততক্ষণ পর্যন্তই সকল জীব শুনতে পারে। অন্যথায় নয়। দেহ মরে যাওয়ার পর রূহ মরে না গেলেও রূহের শ্রবণ করার মত নিজস্ব কোনো যোগ্যতা অবশিষ্ট থাকে না। আর সে-জন্যই রাসূলগণ আখেরাতে উপর্যুক্ত জবাব দেবেন। পক্ষান্তরে মুশরিকরা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যে সকল ফেরেশ্তাদের উপাসনা করতো তারা জীবিত থাকার কারণে তাদেরকে কেন্দ্র করে মুশরিকরা যা কিছু করতো আখেরাতে তারা আল্লাহ তা‘আলার এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে রাসূলগণের ন্যায় জবাব না দিয়ে বলবেন:ওরা আমাদের উপাসনা করেনি, ওরা বরং জিনের তথা শয়তানের উপাসনা করতো। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١ ﴾ [سبا: ٤٠، ٤١]

‘‘আর যেদিন তিনি সবাইকে একত্রিত করবেন, অতঃপর ফেরেশ্তাদের বলবেন: এরা কি তোমাদেরই উপাসনা করতো? তারা বলবে:আপনি পূত পবিত্র, আপনিই আমাদের অভিভাবক, ওরা নয়। বরং তারা জিনেরই উপাসনা করতো এবং তাদের অধিকাংশরাই এদের উপর ঈমান আনয়ন করতো।’’[1] এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যে ফেরেশ্তাদেরকে কেন্দ্র করে শির্ক কর্ম করতো, সে ফেরেশ্তারা জীবিত থাকায় তারা সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। আর সে-জন্যই আল্লাহর উপর্যুক্ত প্রশ্নের জবাবে রাসূলগণের ন্যায় তাদের অজ্ঞতার কথা না বলে তাঁরা বলবেন:ওরা আমাদের উপাসনা করেনি, বরং তারা জিন তথা শয়তানের উপাসনা করেছে।

অনুরূপভাবে দেখা যায় আল্লাহ তা‘আলা আখেরাতে যখন ঈসা u কে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ত্ববাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, তখন তিনিও সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকার কারণে বলবেন:

﴿ مَا قُلۡتُ لَهُمۡ إِلَّا مَآ أَمَرۡتَنِي بِهِۦٓ أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمۡۚ وَكُنتُ عَلَيۡهِمۡ شَهِيدٗا مَّا دُمۡتُ فِيهِمۡۖ فَلَمَّا تَوَفَّيۡتَنِي كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِيبَ عَلَيۡهِمۡۚ﴾ [المائ‍دة: ١١٧]

‘‘আপনি আমাকে যা বলতে আদেশ করেছিলেন আমি তাদেরকে কেবল তাই বলেছি যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা, আমি যতদিন তাদের মাঝে ছিলাম, ততদিন তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন...’’।[2] ঈসা আলাইহিস সালামের উক্ত জবাব থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ দুনিয়াবী পরিবেশে জীবিত না থাকলে কারো পক্ষে এ দুনিয়ার মানুষেরা কি করছে, তা নিজ থেকে জানার বা শ্রবণ করার কোনই উপায় নেই।

অনুরূপভাবে দেখা যায়, আরবের মুশরিকরা ওয়াদ, সুয়া‘, ইয়াগুছ ও অন্যান্য যে-সব মূর্তিসমূহকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো, সে-সব মূর্তিসমূহের সবাই তাদের আহ্বান না শুনলেও অন্তত ওয়াদ, সুয়া‘...ইত্যাদি মূর্তিগুলো সৎ মানুষদেরকে কেন্দ্র করে তৈরী হওয়ার কারণে তাঁদের পক্ষে তা শ্রবণ করার কথা। কিন্তু আল্লাহর কথানুযায়ী প্র্র্রমাণিত হয় যে, তারাও মুশরিকদের সে-সব আহ্বান সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর রয়েছেন।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ ﴾ [الاحقاف: ٥]

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ব্যতীত এমন কাউকে আহ্বান করে যে কেয়ামত পর্যন্ত তার আহবানে সাড়া দেবে না, সে ব্যক্তির চেয়ে পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে ? তাঁরা তো তাদের আহ্বান সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর।’’[3] উক্ত এ-সব আয়াতসমূহ দ্বারা এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, কোনো মানুষ মরে যাওয়া বা ইন্তেকাল করার পর- তিনি কোনো ওলি হোন আর না-ই হোন না কেন-তিনি নিজ থেকে জীবিতদের কর্মকাণ্ডের কোনো খোঁজ-খবর রাখতে পারেন না। আল্লাহ যদি কাফের ও মু’মিন নির্বিশেষে তাদেরকে বিশেষ কোনো মুহূর্তে কিছু শুনাতে চান, কেবল তা ব্যতীত তারা নিজ থেকে কারো কোনো কথা বা আহ্বান শ্রবণ করতে পারেন না।

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা সাবা: ৪১।

[2]. আল-কুরআন, সূরা মা-ইদাঃ ১১৮।

[3]. আল-কুরআন, সূরা আহক্বাফ: ৫-৬।

মৃতরা নিজ থেকে কিছুই শ্রবণ করতে পারে না, এটি হচ্ছে কুরআনের মূল কথা। তবে হাদীস দ্বারা বিশেষ একটি সময়ে তাদের শ্রবণের কথা প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ الْمَيِّتَ إِذَا وُضِعَ فِيْ قَبْرِه إِنَّه لَيَسْمَعُ خَفْقَ نِعَالِهِمْ إِذَا انْصَرَفُوْا»

‘‘মৃত ব্যক্তিকে যখন কবরে রাখা হয় তখন তাকে দাফনকারীরা ফিরে যাওয়ার সময় সে তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়’’।[1]

আল্লামা ইবনে আবিদীন এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন:‘‘এ হাদীসে মৃতের শ্রবণের বিষয়টি মৃত ব্যক্তির কবরে রাখার সময়ে সওয়াল-জাওয়াবের প্রারম্ভে^র সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই এ হাদীসের সাথে কুরআনের কোনো সংঘর্ষ নেই’’।[2]

শায়খ আলবানী বলেন:‘‘এ হাদীসটি মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখা এবং তাকে প্রশ্ন করার জন্য ফেরেশ্তাদের আগমনের সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং মৃতের শ্রবণের ক্ষেত্রে এ হাদীসকে সাধারণ অর্থে গ্রহণের কোনো উপায় নেই’’।[3]

আল্লামা নু‘মান ইবন মাহমূদ আলূসী এ প্রসঙ্গে হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেমদের উক্তিসমূহ মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃত করার পর বলেন:

‘‘ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (রহ.) এবং মাযহাবের অন্যান্য মনীষীদের ফতোয়া দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রূহ বের হয়ে যাওয়ার পর মৃত ব্যক্তি শ্রবণ করে না, যেমনটি মত প্রকাশ করেছেন উম্মুল মু’মিনীন আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা। হানাফীগণ মাযহাবের কোনো আলেমদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রকার মতবিরোধের বর্ণনা করেন নি...’’।[4]

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন:‘‘মৃত ব্যক্তির শ্রবণ না করার ব্যাপারে হানাফী ও তাদের মতের সমর্থনকারীদের বক্তব্যকে এ বিষয়টিও সমর্থন করে যে, মৃত ব্যক্তি যদি সাধারণভাবেই শ্রবণ করে থাকবে, ‘তা হলে তাকে প্রশ্ন করার সময় তার নিকট রূহ ফিরে আসা, অতঃপর তা চলে যাওয়া’ এ মর্মে হাদীস বর্ণিত হতো না’’।[5]

অতঃপর মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেন:

"والعجب من بعض من لا فهم له من ينتسب إلى مذهب الإمام إبي حنيفة يشيع عند العوام أن السماع مجمع عليه، و أنه أيضا مذهب ذلك الإمام الأعظم و أصحابه ممن أخر و تقدم، و لم يعلم أن الحنفية قد تمسكوا كعائشة و غيرها بالآيتين ، وأولوا ما ورد بعد معرفتهم الحديثين".


‘‘ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মাযহাবের অনুসারী বলে দাবীদার কিছু অজ্ঞ লোকদের ব্যাপারে আশ্চর্য হতে হয় যে, তারা জনগণের মাঝে এ তথ্য প্রচার করে যে, মৃতদের শ্রবণের বিষয়টি নাকি বিজ্ঞজনদের ঐকমত্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং এটাই নাকি ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর অগ্র-পশ্চাতের অনুসারীগণের মাযহাব। অথচ তারা জানতেও পারেনি যে, হানাফীগণ এ বিষয়ে আয়েশা (রা.) ও অন্যান্যদের ন্যায়

وَمَآ أَنتَ بِمُسۡمِعٖ مَّن فِي ٱلۡقُبُورِ ﴾ [فاطر: ٢٢]﴿ এবং إِنَّكَ لَا تُسۡمِعُ ٱلۡمَوۡتَىٰ﴾ [النمل: ٨٠]﴿ এ আয়াত দু’টি গ্রহণ করেছেন এবং মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কিত হাদীস দু’টি অবগতির পর (যার একটি উপরে বর্ণিত হয়েছে এবং অপরটি নিম্নে বর্ণিত হবে) এ-দু’টির তা’বীল করেছেন’’।[6]

মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কিত দ্বিতীয় হাদীস:

মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কে সামান্য একটু সম্ভাবনা প্রমাণিত হয় নিম্নে বর্ণিত হাদীস থেকে। বদরের যুদ্ধের পরে মুশরিকদের লাশগুলো যখন নিকটস্থ একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়, তখন সেখান থেকে প্রস্থানের পূর্ব মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-সে কূপের নিকটে যেয়ে মুশরিকদের লাশগুলোকে সম্বোধন করে কিছু কথা বলেন। তা দেখে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

«يَا رَسُوْلَ اللهِ!مَا تُكَلِّمُ مِنْ أَجْسَادٍ لاَ رُوْحَ فِيْهَا؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِه مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُوْلُ مِنْهُمْ»

‘‘হে আল্লাহর রাসূল! রূহ বিহীন লাশের সাথে আপনি কথা বলছেন ? রাসুলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন: যাঁর হাতের মধ্যে মুহাম্মদের আত্মা তাঁর শপথ করে বলছি: আমি তাদের লক্ষ্য করে যা বলেছি তা তাদের চেয়ে তোমরা বেশী শ্রবণ করোনি’’।[7] এ হাদীস দ্বারা কোনো কোন মনীষী মৃতদের শ্রবণের কথা প্রমাণ করতে চান। তবে অধিকাংশ বিদ্বানদের মতে এ হাদীস দ্বারা তা আদৌ প্রমাণ করা যায়না। পাঠকদের সুবিধার্থে এ হাদীস সম্পর্কে প্রখ্যাত মনীষীগণ কী বলেছেন, তা নিম্নে বর্ণনা করা হল:

এ হাদীস সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের মতামত:

  • মৃতদের শ্রবণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা নু‘মান ইবনে মাহমূদ আল-আলূসী বলেন:

" لم أر فيها من صرح بأن الميت يسمع سماعا مطلقا عاما، كما كان شأنه في حياته ، و لا أظن عالما يقول به ، و إنما رأيت بعضهم يستدل بأدلة يثبت بها سماعا في الجملة."

‘‘আমি এ বিষয়ে কোনো আলেমকে এ-কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে দেখিনি যে, মৃত মানুষেরা দুনিয়ায় জীবিত থাকার ন্যায় মৃত্যুর পরেও সাধারণভাবে শ্রবণ করতে পারেন। কোনো জ্ঞানী এ ধরনের কথা বলতে পারেন বলেও আমি মনে করি না। আমি তাদের কাউকে কোনো কোন দলীল দ্বারা মৃতদের মোটের উপর কিছু শ্রবণের কথা প্রমাণ করতে দেখেছি’’।[8]

  • উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ হাদীসটি কুরআনুল কারীমে বর্ণিত {وَمَا أنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِيْ الْقُبُوْر} ‘‘কবরবাসীদেরকে তুমি শুনাতে পারবে না’’[9] এ আয়াতের মর্মের বিপরীত হওয়ায় তিনি এ হাদীসটি অগ্রাহ্য করেছেন।[10]
  • এ হাদীসকে কুরআনের উক্ত আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক মনে না করলেও এ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ করা যায়না। কেননা, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ উক্তিটি আসলে কাফেরদেরকে উপদেশ প্রদানের জন্য বলেছিলেন, তাদের বুঝাবার জন্য বলেন নি।[11]
  • আল্লামা ইবনে নুজাইম আল-মিশরী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন:এটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি মু‘জিযা বিশেষ।[12] যা অন্য কোনো মৃতদের বেলায় প্রযোজ্য নয়।
  • বিশিষ্ট তাবেঈ ক্বাতাদাঃ (রহ.) উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন:

[أَحْيَاهُمُ اللهُ حَتَّى أَسْمَعَهُمْ قَوْلَه تَوْبِيْخًا وَتَصْغِيْرًا وَنِقْمَةً وَحَسْرَةً]

  • ‘‘আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদেরকে ধমকি প্রদান ও হেয় প্রতিপন্ন করা এবং বদলা গ্রহণ ও হতাশাগ্রস্ত করানোর জন্যে জীবিত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা শ্রবণ করিয়েছিলেন।’’[13]
  • ইমাম কুরত্ববী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: ‘‘কাফেরদের শ্রবণ করানোর ব্যাপারটি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অনুভূতি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যার কারণে তারা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা শ্রবণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শ্রবণ করার কথা আমাদেরকে না বললে তাঁর এ-কথাগুলোকে আমরা অবশিষ্ট কাফেরদের জন্য ধমকি স্বরূপ এবং মু’মিনদের মনের প্রশান্তি স্বরূপ বলার অর্থে গ্রহণ করতাম’’।[14]
  • আল্লামা ইবনে আবিদীন বলেন: ‘‘এ শ্রবণ করার বিষয়টি কাফেরদের আফসোসকে বৃদ্ধি করার জন্য তাদের সাথেই বিশেষভাবে সম্পর্কিত ছিল এবং এটি ছিল রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য একটি বিশেষ মু‘জিজা’’।[15]
  • এ প্রসঙ্গে শায়খ আলবানী বলেন:‘‘এ ঘটনার বর্ণনায় ইবনে ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীস রয়েছে, তাতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন:

«هَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا ؟ ثُمَّ قَالَ:إِنَّهُمْ اَلآنَ يَسْمَعُوْنَ مَا أَقُوْلُ»

‘‘তোমাদের রব যে ওয়াদা করেছিলেন তোমরা কি তা সঠিকভাবে পেয়েছ? অতঃপর রাসূলুল্লাহr বলেন:নিশ্চয় (কাফেররা) এখন আমি যা বলছি তারা তা শ্রবণ করছে’’।[16] অর্থাৎ তাদেরকে সম্বোধন করার সময় তারা তা শুনছিল। মৃতরা সব সময় শুনতে পায়, সে-জন্যই তারা তা শুনতে পেয়েছে, বিষয়টি এমনটি নয়।

  • মাহমূদ আলূসী বলেন: ‘‘এ হাদীসে এ-কথার শক্তিশালী ইঙ্গিত রয়েছে যে, মৃতরা শ্রবণ করেন না’’।[17]
  • ইমাম ইবনুত তীন বলেন: ‘‘ইবনে ‘উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস এবং {إِنَّكَ َلا تُسْمِعُ الْمَوْتٰى} এ আয়াতের মধ্যে আসলে কোনো বৈপরিত্ব নেই। কেননা, মৃতরা শ্রবণ করেন না, এ-কথায় কোনই সন্দেহ নেই, তবে যাদের শ্রবণ করার কথা নয়, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শ্রবণ করাতে পারেন’’।[18]

কুরআন, হাদীস ও মনীষীদের মতামতের আলোকে এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, মৃত মানুষ সে যে-ই হোক কেন, জীবিতদের কথা ও কর্ম সম্পর্কে তাদের কিছু শুনা ও জানার নিজস্ব কোনো যোগ্যতা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ ব্যবস্থায় তাদেরকে কিছু শুনাতে চাইলে তারা কেবল তা-ই শুনতে পারেন। সে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাদেরকে কেউ সালাম করলে বা তাদের মাগফেরাতের জন্য কেউ দো‘আ করলে তাদেরকে তা অবগত করানো হয়। কিন্তু তাদের কবরকে কেন্দ্র করে এর বাইরে শরী‘আত বিরোধী যে-সব শির্কী কাজকর্ম হয়, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জানানো বা শ্রবণ করানোর কোনো ব্যবস্থা করেননি, তারা নিজ থেকেও তা জানতে বা শ্রবণ করতে পারেন না।

তারা যদি তা জানতে পারতেন এবং জীবিতদেরকে কোনো উপদেশ দেবার মত কোনো মাধ্যম তাদের কাছে থাকতো, তা হলে অলিগণের কবরকে কেন্দ্র করে যে-সব শির্কী কর্ম করা হয়, তা পরিত্যাগ করার জন্য তারা সাধারণ জনগণকে উপদেশ দিতেন। কিন্তু এ-সবই তাদের নাগালের বাইরে থাকার কারণে যুগ যুগ ধরে অলিগণের কবর ও কবরকে কেন্দ্র করে অহরহ শির্কী কর্মকাণ্ড হয়েই চলেছে। যেহেতু এ-সব কর্ম শয়তানের প্ররোচনায়ই সেখানে হয়ে চলেছে, তাই মানুষেরা যাতে সর্বদা তা করে যায়, সে-জন্য শয়তান নিজেই অলিগণের কবরে নিরাপদ আস্তানা গেড়ে বসে রয়েছে। নানা উপায়ে সেখানে সে তার বিভিন্ন তেলেশমাতি প্রকাশ করে চলেছে। আর ধর্মীয় জ্ঞানে মিসকীন সাধারণ মানুষ তা দেখে ভাবছে-এ-সব কবরস্থ অলিরই কারামত ও ফয়েয। সাধারণ মানুষ এবং আল্লাহর মাঝে তাঁরা ওসীলা হওয়ার কারণেই কবরে থেকেও তাঁরা এভাবে সাধারণ মানুষের উপকার করে চলেছেন! والعياذ بالله.

>
[1].মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল জান্নাতি..., বাব নং ১৭, হাদীস নং ২৮৭০), ৪/২২০১;মুহাম্মদ ইবনে হিববান আল-বুস্তী, সহীহ ইবনে হিববান; (বৈরুত: মুআছছাছাতুর রিছালাঃ, ২য় সংস্করণ, ১৯৯২ খ্রি.), ৭/৪৪২।

[2]. ইবনে আবিদীন, প্রাগুক্ত; ৩/১৮০।

[3]. নু’মান ইবনে মাহমূদ আল-আলূসী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৫১।

[4]. তদেব; পৃ. ১৯।

[5]. তদেব;৩৫।

[6]. তদেব।

[7]. বুখারী, প্রগুক্ত; (কিতাবুল মাগাযী, বাব নং ৩, হাদীস নং ৩৭৫৬), ৩/৩/১৮৫-১৮৬।

[8].আল-আলূসী, নু‘মান ইবন মাহমুদ, আল-আ-য়াত আল-বায়্যিনাত ফী আদামি সেমাইল আমওয়াত আলা মাজহাবিল হানাফিয়্যাতিত সা-দাত; সম্পাদনা: আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী, (হালব: মাত্ববা‘আতু অফিসত, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯হি:), পৃ.৫১।

[9]. আল-কুরআন, সূরা ফাত্বির: ২২।

[10]. আল-আলূসী, নু‘মান ইবন মাহমূদ, প্রাগুক্ত; পৃ.৫১।

[11]. তদেব; প্র. ৯।

[12]. তদেব;পৃ. ৮।

[13]. তদেব;পৃ. ৬; আহমদ, প্রাগুক্ত; ৪/২৯।

[14]. আল-ক্বুরত্ববী, প্রাগুক্ত;১৩/৩৩২।

[15] . নু‘মান ইবন আলূসী, প্রাগুক্ত;পৃ.১০।

[16]. ইবনে হাজার, ফাতহুলবারী; ২/২৪২।

[17]. মাহমূদ আলূসী, প্রাগুক্ত; ৬/৪৫৫।

[18]. ইবনে হাজার , ফাতহুলবারী;৩/১৪২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে