শির্ক কী ও কেন? পঞ্চম পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ২ টি
ইসলাম পূর্ব যুগসমূহের মানুষের শির্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ

মানব সমাজে শির্ক সংঘটিত হওয়ার সূচনা লগ্ন থেকে নিয়ে ইসলাম পূর্ব যুগ পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ের মানুষের শির্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য নিম্নেবর্ণিত কারণসমূহকে দায়ী করা যেতে পারে :

প্রথম কারণ : সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন :

জ্ঞানী, গুণী ও মর্যাদাবানদের প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শন করা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ কখনও এ প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের অবদান ও উপকারকে স্মরণ করে তাদের কৃতজ্ঞ হতে পারে না, সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞ হতে পারে না। মানুষ স্বীয় চরিত্র ও কর্মগুণে সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও সম্মান পেতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোনো মানুষ কখনও আল্লাহর সম প্রশংসা ও সম্মান পাবার যোগ্য হতে পারে না। সে জন্য কারো প্রশংসা ও সম্মান করে তাঁকে রব ও ইলাহের স্তরে পৌঁছে দেয়া যাবে না।

তাই কোন মানুষের তা‘যীম ও সম্মান করতে হলে অবশ্যই তা শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত সীমারেখার মধ্যে থেকেই করতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, শয়তান মানব জাতিকে প্রথম থেকেই তাদের গুরুজনের সম্মান প্রদর্শনের বৈধ পন্থা থেকে বিচ্যুত করেছে। তাদের বুদ্ধি ও বিবেককে নিয়ে শুরু থেকেই সে তামাশায় লিপ্ত হয়েছে। পরিণতিতে তাদেরকে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত করেছে। শীছ আলাইহিস সালাম-এর সন্তানদেরকে আদম আলাইহিস সালাম-এর কবরের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফে লিপ্ত করেছে[1]।

ওয়াদ্দ, সুয়া‘, য়াগুছ, য়া‘উক ও নছর এর অনুসারীদেরকে দিয়ে তাঁদের সম্মান, স্মরণ ও আল্লাহর উপাসনায় আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষের আকৃতিতে হাজির হয়ে তাঁদের মূর্তি নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং মূর্তি নির্মাণ করে দিয়েছে। অতঃপর তিন প্রজন্ম যেতে না যেতেই জনগণকে আল্লাহর নিকট সে পাঁচ জনের শাফা‘আত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় আকাঙ্ক্ষিত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তাদেরকে সে পাঁচ জনের উপাসনায় লিপ্ত করেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, নবী ও সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করেই মানুষেরা প্রারম্ভে শির্কের মধ্যে পতিত হয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এ প্রসঙ্গে বলেন:

‘‘এটিই হচ্ছে সাধারণ মানুষদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ কারণ। আর বিশেষ লোকদের শির্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ হলো: তারা সে সব তারকার কাল্পনিক মূর্তি নির্মাণ করেছিল যাদের এ পৃথিবী পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রভাব রয়েছে বলে তারা ধারণা করেছিল এবং এ সকল মূর্তির জন্য গৃহ নির্মাণ করেছিল, এর জন্য খাদেম ও রক্ষী নিয়োগ করেছিল, এর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হজ্জ ও কুরবানীর প্রচলন করেছিল। প্রাচীন ও আধুনিক কালের মানুষের মাঝে এর প্রচলন যথারীতি বর্তমান রয়েছে।’’[2]

আদম সন্তানদের সাথে শয়তানের খেলা এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায় নি; বরং সে সকল দিক থেকেই তাদেরকে তার বেড়াজালে আবদ্ধ করেছে। অবশেষে সে তাদেরকে কা‘বা শরীফের আঙ্গিণায় ছড়িয়ে থাকা পাথরের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করতে শিখিয়েছে। তাই তারা মক্কার বাইরে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় তাদের সাথে কা‘বা শরীফের আঙ্গিণার একটি পাথর বহন করেছে এবং বসবাসের স্থানের এক পার্শ্বে সে পাথরটি যত্নের সাথে রেখে কা‘বা শরীফের ন্যায় এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করেছে।

সাথে পাথর নিয়ে না গেলে অবতরণ স্থলের একটি সুন্দর পাথর বেছে নিয়ে এক স্থানে তা যত্নের সাথে রেখে দিয়ে এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করেছে। এমনকি উপত্যকায় পাথর না পেলে মাটি বা বালু একত্রিত করে এর উপর ছাগলের দুগ্ধ দোহন করে তা শুকিয়ে জমাট বেঁধে শক্ত হওয়ার পরে এর চার পার্শ্বেও ত্বওয়াফ করেছে। শয়তান তাদেরকে এ ধারণা দিয়েছে যে, এভাবে পাথর বা বালুর পার্শ্ব দিয়ে প্রদক্ষিণ করলে তারা কা‘বা শরীফের পার্শ্বে ত্বাওয়াফ করার ন্যায় পুণ্য লাভে ধন্য হবে। এটিই ছিল দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদারদের ধর্মীয় অবস্থা।

একইভাবে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ইতিহাসও নবী ও সালেহীনদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িতে পরিপূর্ণ ছিল। শয়তান তাদেরকে নবী ও সালেহীনদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এতই বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত করেছিল যে, তারা নবীগণের সাথে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনাদি অন্বেষণ করে সে-গুলোকে ছোট ও বড় গির্জায় রূপান্তরিত করেছিল। উম্মুল মু’মিনীন আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইথিওপিয়ায় দেখা একটি গির্জা এবং তাতে চিত্রাকারে যে সব ভাস্কর্য রয়েছে সেগুলোর কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন। তিনি তা শুনে বলেন :

«أُولٰئِكَ إِذَا مَاتَ فِيْهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ أَوْ الْعَبْدُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلٰى قَبْرِه مَسْجِداً وَصَوَّرُوْا فِيْهِ تِلْكَ الصُّوَرَ،أُولئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ»

‘‘ঐ সকল খ্রিষ্টানরা তাদের মধ্যকার কোন সৎ মানুষ মারা গেলে সে লোকের কবরের উপর মসজিদ (গির্জা) নির্মাণ করতো এবং সে মসজিদের দেয়ালে তাঁদের ছবি অঙ্কন করতো, আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা সব চেয়ে নিকৃষ্ট জাতি।’’[3]

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা মতে সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এ ধরনের অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করাই হচ্ছে অতীতের বিভিন্ন জনপদের শির্কে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ। উম্মতে মুহাম্মদী যাতে এ ধরনের কর্মে লিপ্ত না হয়, সে জন্য তিনি তাঁর উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন :

«إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ، فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ»

‘‘সকল ক্ষেত্রে শরী‘আত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করা থেকে তোমরা নিজেদেরকে বিরত রাখবে কারণ; এ সীমা অতিক্রম করাই তোমাদের পূর্বেকার জনপদের ধ্বংস করেছে।’’[4]

দ্বিতীয় কারণ : পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ :

নবী-রাসূল ও সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করে শির্ক করার পাশাপাশি মানুষের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার অপর কারণ হচ্ছে- বাপ-দাদা ও চৌদ্দপুরুষের অন্ধ অনুসরণ। এর ফলে তারা পূর্বপুরুষদেরকে যে সকল কর্মকাণ্ড করতে দেখেছে সেটাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে। পূর্ব পুরুষদের কাজগুলো সুস্থ বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না, মুহূর্তের জন্যেও তারা তা ভেবে দেখতে রাজি হয় নি। উদাহরণস্বরূপ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর জাতির লোকদের কথাই বলা যায়, তিনি যখন তাদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে একটু ভাবতে বললেন, আরো বললেন : তোমরা যে সকল মূর্তির পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনের সময় আহ্বান করে যাদের উপাসনা করছো, তারা কি তোমাদের ডাক শুনতে পায়, অথবা তারা কি তোমাদের কোন কল্যাণ বা ক্ষতি করতে পারে? তখন তারা এ বিষয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই এক বাক্যে বলেছিল :

﴿بَلۡ وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا كَذَٰلِكَ يَفۡعَلُونَ﴾ [الشعراء: ٧٤]

‘‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এমনটি করতে পেয়েছি।’’[5]

তাদের এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে : তারা যা করছে তা সঠিক কি না, এ নিয়ে তাদের ভাববার কোনো অবকাশ নেই। তাদের দেব-দেবীগুলো তাদের ডাক শ্রবণ করে কি না বা এরা বাস্তবে তাদের কোনো লাভ বা ক্ষতি করতে পারে কী না, তাও খতিয়ে দেখার তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা বংশ পরম্পরায় এদের উপাসনার বিষয়টি পেয়ে এসেছে। আর এ পাওয়াটুকুই তাদের নিকট এদের উপাসনা করা সঠিক বলে প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই তাদের অনুসরণ করা থেকে তারা বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নয়!

অনুরূপভাবে মূসা আলাইহিস সালাম-এর জাতির দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তিনি তাঁর জাতির লোকদেরকে যখন তাদের দেবতাদের পূজা করা ছেড়ে দিতে বলেন, তখন তারাও বলেছিল:

﴿أَجِئۡتَنَا لِتَلۡفِتَنَا عَمَّا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَا﴾ [يونس: ٧٨]

‘‘তুমি কি আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে আমরা যা করতে পেয়েছি তাত্থেকে আমাদেরকে বিমুখ করার জন্য আগমন করেছ।’’[6]

বিবেকের বিচারে তাদের কর্মের সঠিকতা যাচাই করা ছাড়াই এরাও একইভাবে নিজেদের পিতৃপুরুষদের অন্ধ অনুকরণে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছে।

একইভাবে আমরা যখন মক্কার মুশরিকদের দিকে লক্ষ্য করি, তখনও দেখতে পাই যে, এরাও কা‘বা শরীফ ও অন্যান্য স্থানে রাখা মূর্তিসমূহের উপাসনা করার ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করেছে। এরাও অতীত জাতির লোকদের ন্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছে :

﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ ﴾ [لقمان: ٢١]

‘‘যখন তাদের বলা হয় : আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তা অনুসরণ করো, জবাবে তারা বলে : আমরা বরং তারই অনুসরণ করবো যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি।’’[7]

এদের ব্যাপারে আল্লাহ অন্যত্র বলেন :

﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ قَالُواْ حَسۡبُنَا مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ ﴾ [المائ‍دة: ١٠٤]

‘‘যখন তাদের বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে দিকে ও রাসূলের দিকে তোমরা এসো, তখন তারা বলে: আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে আমরা যা করতে পেয়েছি, তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’’[8]

মূর্তি পূজার কারণ :

মূর্তি পূজার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, অতীতের সাধারণ এবং বিশেষ লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়েছিল। সাধারণ ধার্মিক লোকেরা মৃত সৎ লোকদের সম্মান করতে যেয়ে তাঁদের মূর্তি তৈরী করেছিল, আর বিশেষ অধার্মিক লোকেরা এ জগতের তারকারাজির প্রভাবে বিশ্বাসী হয়ে সে সব তারকার কাল্পনিক মূর্তি তৈরী করে এগুলোর সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন:

‘‘সাধারণ মানুষদেরকে যে কারণটি মূর্তি পূজা করতে উৎসাহিত করেছে তা হলো, মৃতদের সম্মান প্রদর্শন (تعظيم الموتى) করা। কারণ; মূলত এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা মৃত ব্যক্তিদের আকৃতিতে মূর্তি নির্মাণ করেছিল। আর যে বিষয়টি বিশেষ লোকদেরকে নক্ষত্রের মূর্তি তৈরী করে এর উপাসনা করতে উৎসাহিত করেছিল, তা হলো : নক্ষত্রসমূহের সম্মান প্রদর্শন (تعظيم الكواكب) করা। উদাহরণস্বরূপ সূর্য দেবতার পূজারীদের কথাই বলা যায়, তারা সূর্যের ব্যাপারে এ-ধারণা করে যে, এটি হচ্ছে আকাশের রাজা এবং এটি একটি ফেরেশতা। তার রয়েছে আত্মা, বুদ্ধি ও বিবেক। এটিই হচ্ছে সকল নক্ষত্রপুঞ্জ ও চাঁদের আলো প্রদানের মূল উৎস ...কাজেই এর সম্মান পাওয়ার মত যোগ্যতা রয়েছে। এ কারণেই সূর্য পূজারীরা সূর্যোদয়, দ্বিপ্রহর ও তা অস্ত যাওয়ার সময় তাকে সেজদা করে থাকে।’’[9]

আমার মতে প্রচীনকালের লোকদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য মৃত সৎ মানুষ ও নক্ষত্র সমূহের মূর্তির সম্মান প্রদর্শন করাকে কারণ হিসেবে দায়ী করা গেলেও পরবর্তী লোকদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য শুধু সে কারণই দায়ী নয়, বরং এর সাথে তাদের বিশ্বাসগত আরো নানাবিধ কারণ সংযুক্ত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে :

তৃতীয় কারণ : দেব-দেবীরা কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা :

তারা তাদের দেব-দেবীদেরকে মানুষের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ব্যাপারে সামর্থ্যবান বলে মনে করতো। এ ধারণার ভিত্তিতেই তারা তাদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো। বৃষ্টি না হলে তারা এদের কাছে বৃষ্টি কামনা করতো এবং বৃষ্টি হলে তা এদেরই দান বলে মনে করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেব-দেবীদের সমালোচনা করেন বলে তাঁকে যে কোনো সময় দেব-দেবীদের অনিষ্টের শিকার হওয়ার ব্যাপারেও তারা ভয় প্রদর্শন করতো। দেব-দেবীদের অকল্যাণের ভয়ে তাদের নামে মিথ্যা শপথ করা থেকে বিরত থাকতো... ইত্যাদি।

চতুর্থ কারণ : দেব-দেবীদের আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাধ্যম বলে মনে করা :

তারা অলি ও ফেরেশতাদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করতো। তাদের মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট থেকে পার্থিব কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণ কামনা করতো। এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো।

পঞ্চম কারণ : দেব-দেবীদেরকে শাফা‘আতকারী বলে মনে করা

তারা তাদের দেব-দেবীদেরকে সাধারণ মানুষদের জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী বলে মনে করতো। এদের শাফা‘অতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে পার্থিব কল্যাণ প্রাপ্তির জন্য এদের কাছে তাদের প্রয়োজনের কথা জানাতো। এছাড়াও আরো কতিপয় কারণ রয়েছে যা নিয়ে সুক্ষ্ণভাবে চিন্তা করলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর প্রেরিত ধর্মে বিশ্বাসীদের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার জন্য উপর্যুক্ত কারণসমূহই বিশেষভাবে দায়ী। আর যারা আল্লাহর প্রেরিত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল না, তারা চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রকে তাদের জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে উপকারী মনে করার কারণে এদের সম্মান করতে যেয়ে বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোর উপাসনা করেছে।

>
[1] যদিও এ ঘটনাটি কোনো সঠিক বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত হয় নি। [সম্পাদক]

[2]. ইবন কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লাহফান; ২/১৭৪।

[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাত, বাব নং ১৪, হাদীস নং ৪১৭; ১/১৬৪; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মাসাজিদ, বাব নং ৩, হাদীস নং ৫২৮; ১/৪৫০; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/৪৭।

[4].নাসাই, প্রাগুক্ত; বিতাবুল মানাসিক, বাব : বয়ানু ইলতেকাতিল হাসা; ৩/২১৮; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/২১৫।

[5].আল-কুরআন, সূরা শু‘আরা : ৭২।

[6]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ৭৮।

[7]. আল-কুরআন, সূরা লুকমান : ২১।

[8]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্‌ : ১০৪।

[9]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লাহফান; ২/১৭৪, ১৭৫।

শির্ক অপরাধটি সকল অপরাধের মধ্যে একটি নিকৃষ্ট অপরাধ। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। কারণ, তা যদি শির্কে আকবার এর অন্তর্গত হয়, তাহলে এটি তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণভাবে বহিস্কার করে দিবে। আর তা যদি শির্কে আসগার এর অন্তর্গত হয়, তবে এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিস্কার না করলেও এত্থেকে সতর্কতা অবলম্বন না করলে এটিও মানুষের পরকালীন মহা বিপদের কারণ হতে পারে।

পৃথিবীর আদি মানুষেরা প্রারম্ভে তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল; কিন্তু তাদের চির শত্রু শয়তানই তাদেরকে এক্ষেত্রে মতবিরোধে লিপ্ত করেছে। ফলে তাদের কিছু সংখ্যক লোক তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অবশিষ্টরা বিবিধ কারণে মুশরিক এবং নাস্তিকে পরিণত হয়েছে।

মানুষের মাঝে তাওহীদী চিন্তাধারা পুনরায় চালু করার জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু যখনই মানুষেরা তাঁদের শিক্ষা থেকে দূরে চলে গেছে তখনই তারা পুনরায় শির্কে নিমজ্জিত হয়েছে।

প্রারম্ভে যখন নবী ও অলিদের সম্মান প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে শির্ক সংঘটিত হয়, তখন তা ইবাদত তথা আল্লাহর উলূহিয়্যাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল;কিন্তু কালের পরিক্রমায় তা জ্ঞান (علم), পরিচালনা (تصرف) ও অভ্যাস (عادات) তথা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আরব জনপদে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন, তখন তাঁর জাতির শির্ক আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে সমভাবে বিরাজমান ছিল। তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যে তাদের দেব-দেবীদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিল।

তাদের কোনো কোনো দেবতা ছিল অতীতের সৎ মানুষের মূর্তি বিশেষ। তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো। আল্লাহর সাথে ফেরেশ্তাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে মনে করে লাত, ‘উয্যা ও মানাত নামে মনগড়া তিনজন ফেরেশ্তাকে উদ্দেশ্য করে তিনটি দেবী গ্রহণ করেছিল। সেগুলোকে তারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম হিসেবে মনে করতো। অনুরূপভাবে সেগুলোকে তাদের পার্থিব কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী বলেও মনে করতো। এ দু’টি ধারণাকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্নভাবে এদের উপাসনাও করতো; যদিও লাত নামের পাথর সর্বস্ব দেবীটি একজন সৎ ইয়াহূদী ব্যক্তির বসার স্থানের উপর নির্মিত হয়েছিল। আর ‘উয্যা’ নামের দেবীটি তিনটি ছোট-বড় আকারের বাবলা গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল; যার মধ্যে একটি জিন-পরী বাস করতো এবং এ-জিনই সাধারণ জনগণকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করতো। অনুরূপভাবে বিভিন্ন স্থানে তাদের আরো কতিপয় গৃহ ছিল, যেগুলোকে তারা কা‘বা শরীফের ন্যায় মর্যাদার অধিকারী ও পবিত্র বলে জ্ঞান করতো।

আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাদের ও সকল বিশ্ববাসীর জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন এবং তিনি তাদেরকে সকল দেব-দেবী ও প্রতিমা পূজা পরিত্যাগ করতে বলেন, তখন তারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল এ দলীলের ভিত্তিতে যে, তারা ইব্রাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের অনুসারী এবং আল্লাহর গৃহের রক্ষক এবং তারাই রয়েছে সঠিক দ্বীন ও সত্য ধর্মের উপর। কারণ, তারা কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ করে, হজ্জ ও ‘উমরা করে, হাজীদের পানি পান করায় ও তাদের সেবা করে। আর মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করবে না এ কারণে যে, তারা তাদের পূর্ব পুরুষদেরকে এ সব দেব-দেবীদের পূজা করতে দেখেছে। তাই এদের পূজা করাও দ্বীনে ইব্রাহীমেরই অংশ।

মহান আল্লাহ তাদের এ জাতীয় বক্তব্যের জবাবে পরিষ্কার ভাষায় তাদেরকে জানিয়ে দিলেন- তারা তাদের দেব-দেবীদের আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী হওয়ার ধারণার ভিত্তিতে এদেরকে কেন্দ্র করে যে সব কর্ম করে থাকে, সে সব কর্মের কারণে তারা তাঁর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে শির্কে লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে তারা দ্বীনে ইব্রাহীম থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে গেছে। তারা কাফির ও মুশরিকে পরিণত হয়েছে। তারা তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে সব উপাসনা ও সৎকর্ম করছে, তাঁর কাছে সেগুলোর আদৌ কোনো মূল্য নেই। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে মুশরিকদের মিথ্যা দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে তাওহীদ ও শির্ক পরিচয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দলীল প্রমাণাদি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে তাদেরকে সুস্পষ্ট দ্বীন এবং সরল ও সঠিক রাস্তার উপর রেখে গেছেন। কেবল ধ্বংস প্রাপ্ত লোকজন ব্যতীত আর কেউই এ পথ থেকে ভ্রষ্ট হতে পারে না।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে