হক-নাহক বা ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-অসত্যের দ্বন্দ্ব অতি পুরাতন। হক’ যেখানেই মাথা তুলে দাড়িয়ে সোচ্চার হয় নাহক’ সেখানেই তাকে পরাভূত করার উদ্দেশ্যে অধিক শক্তিশালীরূপে তৎপর হয়। যখনই সত্যের সূর্য বিশ্বজগৎকে আলোকমন্ডিত করতে চায় তখনই অসত্যের মেঘমালা তাকে আড়াল করার জন্য বিশ্বব্যাপী ঝড়-তুফান সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিকভাবে এটাই চির সত্য।

মুসলমানরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পিছিয়ে আছে একথা ঠিক, কিন্তু চারিত্রিক সম্পদে আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে পাশ্চাত্যে ভোগ-বিলাসের জোয়ার বইলেও নৈতিকতার মানদন্ডে তারা পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। পশুর কাছে মনুষ্যত্ব যেমন অকাম্য, তেমনি ভোগবাদী ও জড়বাদী পাশ্চাত্যের কাছে তাওহীদবাদী মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বও অসহ্য। যুদ্ধ করে অথবা অস্ত্র দিয়ে কারো চরিত্র ধ্বংস করা যায় না। চরিত্র ধ্বংসের জন্য হানা দিতে হয় মানুষের মনোজগতে। এজন্য প্রয়োগ করতে হয় মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র। আর প্রচারমাধ্যমই হচ্ছে সেই অস্ত্র, যা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অত্যন্ত কার্যকরভাবে প্রয়োগ করছে মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে।

যে ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের পূর্বপুরুষকে দিয়েছে গোলামীর জিঞ্জির এবং তাদের দিয়েছে ব্লু-ফিল্ম ও হেরোইন উপহার, সেই পাশ্চাত্যের শক্তির বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই। আশীর্বাদকে তারা অভিশাপ আর অভিশাপকে তারা আশীর্বাদ মনে করছে কেন? সঙ্গত কারণেই অনুসন্ধিৎসু মনে এসব প্রশ্নের উদয় হতে পারে। এসব প্রশ্নের জবাব দেয়াও কোন কঠিন কাজ নয়, মুসলিম তরুণ-তরুণীদের জীবন থেকে ইসলামী পরিচয় মুছে দিতে যে। প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে দায়ী করা যায়, তা হচ্ছে পাশ্চাত্য পরিচালিত প্রচারমাধ্যম। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৪পৃঃ) ‘প্রচার-যন্ত্রের উপর মুসলিম-মালিকানা যে নেই, তা নয়। তবে ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার তুলনায় পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমকে সূর্য বললে মুসলিম প্রচারমাধ্যমকে মোমবাতির চেয়ে বেশী কিছু বলা যায় না। প্রচার-যন্ত্রের প্রায় সব ক’টি আবিষ্কৃত হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। ধনকুবের, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদেরও অভাব নেই সেখানে। এ মৌলিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য জগৎ মুসলিম বিশ্বসহ বাদবাকি পৃথিবীতে আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছে। ঔপনিবেশিকতার যুগ শেষ হয়ে গেলেও প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে শুরু হয়েছে এক নয়া ঔপনিবেশিকতার যুগ। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসনকে চোখে দেখা যেত, কিন্তু বর্তমান।

ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে দেখা যায় না। মুসলিম দেশগুলোর প্রশাসনিক পদগুলোয় দেশীয় মুসলমানরাই রয়েছে। তবে এসব দেশের আত্মার শাসক পাশ্চাত্য। এটা এমন এক মানসিক দাসত্ব, যা অন্যের নজরে আসে না এবং যে তার শিকার, সে নিজেও বোঝে না। ঔপনিবেশিক শাসনের কুফলস্বরূপ মুসলিম দেশগুলোয় এ মানসিক দাসত্ব বিস্তার লাভ করছে। স্বাধীনতা লাভ করেও আমরা নিজেদের ভাষায় কথা বলি না, নিজেদের পোশাক পরিধান করি না, নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসি না। ঘরে থেকেও আমরা যেন বিলেতী। ইংরেজীতে কথা না বললে অভিজাত হওয়া যায় না। মাকে ম্যাম্মি, বাবাকে ড্যাডি, চাচাকে আংকেল, চাচীকে আন্টি বলে না ডাকলে জাতে উঠা যায় না। আমাদের এ মানসিক বৈকল্যের জন্য কে দায়ী? দায়ী আমরাই। চিত্তবিনোদন ও জ্ঞানার্জনের জন্য যেসব মাধ্যমকে আমরা মোক্ষম বলে মনে করি, সেগুলোর স্বরূপ কি আমরা কখনো তলিয়ে দেখেছি?

এ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ফুল থেকে যেমন মধু আহরণ করা যায়, তেমনি বিষও আহরণ করা যায়। আমরা মধুর পরিবর্তে যেন বিষ আহরণ করছি। সে জন্য পুঁজিবাদীরা আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছে চোখ ধাধানো উপকরণ। টিভি, রেডিও, সিনেমা, উপগ্রহ, ডিশ এ্যান্টিনা, ভিসিআর, ব্লু-ফিল্ম, পর্নো পুস্তক-পত্রিকা ইত্যাদি। এগুলো আধুনিক জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বাহ্যত আমাদের জীবনকে করেছে সুন্দর ও সহজ, একথা যেমন সত্য, তেমনি এসব উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতেছে, একথাও সমান সত্য।' (ঐ১৩৩পৃঃ)

কিন্তু কেন তারা এ পথ বেছে নেয়? প্রথম কথা হল, নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনে। তারা মনে করে, শত্রুর উন্নত মাথা অবনত করার জন্য এ অস্ত্রের চেয়ে অধিকতর মারাত্মক অস্ত্র আর কিছু হতে পারে না। সম্মুখসমরে যেতে হয় না, কৌশলে কর্ম সারা যায়। ধরা পড়ার ভয় থাকে না। কাটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় অনায়াসে। সবচেয়ে বড় দুশমনকে কাবু করার জন্য তারা এই শক্তিকেই পারমাণবিক বোমার চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী মনে করে। মুসলমানই তাদের প্রধান শত্রু। তারা জানে, মুসলমানদের হাতে শক্তিশালী কোন মিডিয়া নেই এবং তাদের ‘ইনট্রিগ্রিটি অব কারেক্টারও নেই। তাই মিডিয়া সন্ত্রাসের অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের দুর্বল করে রাখলে কখনো আর তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যদি তারা অতীতের মত আর একবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তাহলে দুনিয়ার বাদশাহী আবার তাদের হাতে চলে যাবে। তাই তারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী অস্ত্র এই মিডিয়ার সম্রাট হয়ে গোটা বিশ্বকে বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়াকে পঙ্গু করে রেখেছে। প্রধানতঃ এই উদ্দেশ্যেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছে।' (তথ্য সন্ত্রাস)

অবশ্য মুসলিম ছাড়া অমুসলিমরা যে উক্ত যন্ত্রের ক্ষতির থাবাতে পরিণত হয় না, তা নয়। তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক মাথাব্যথা ততটা না থাকলেও সাংসারিক জীবনে সুখ কে না চায়?

১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে ২০ হাজার লোকের উপর চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে যে, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী সুখী দম্পতির সংখ্যা ৪৪% থেকে ৩২% এ নেমে গেছে। এর কারণ স্বরূপ যা বলা হয়েছে তা হল দু’টি প্রথমতঃ বহু যুবতীর চাকরী-প্রবণতা এবং দ্বিতীয়তঃ স্বামী-স্ত্রীর চরিত্র-ব্যবহারে টিভি ও সিনেমা তথা চলচ্চিত্র জগতের বিপুল প্রভাব। কারণ, এ জগৎ থেকেই পাওয়া যায় স্বামীর অধীনে থেকেও স্বাধীন হয়ে চলার শিক্ষা। স্ত্রী থাকতেও গার্লফ্রেন্ড’ রাখার আধুনিক ফ্যাশন!

তদনুরূপ অপরাধ জগতেও চলচ্চিত্রের অবদান বড়। স্পেনের এক জরিপ মতে দেখা গেছে যে, ৩৯% অপরাধ (খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদি) অপরাধীরা সিনেমা ও টিভির বিভিন্ন সিরিজ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সম্পন্ন করেছে। (আল-ইফফাহ ৫২ পৃঃ) ব্যাপক হারে গুপ্ত হত্যা, বিমান ছিন্তাই, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সাম্প্রদায়িকতার পশ্চাতেও রয়েছে এই সর্বনাশীর সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একশ’ ভাগ অপরাধ-প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ১৯৬৮ সালে সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিরোধের উপায় নির্ধারণে এক নির্বাহী আদেশে প্রেসিডেন্ট জনসন একটি জাতীয় কমিশন গঠন করেন। কমিশন তদন্ত করে দেখতে পায় যে, এবিসি, এনবিসি ও সিবিএস টেলিভিশন নেটওয়ার্কে প্রচারিত অপরাধ-বিষয়ক অনুষ্ঠানই এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য দায়ী।

ঐ মার্কিন মুলুকের হাল অবস্থা এই যে, সে দেশে প্রতি ৭ মিনিটে একটি করে নারী ধর্ষণ এবং প্রতি ২৪ মিনিটে একটি করে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। প্রতি দু’টো বিয়ের একটি এক বছরের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। সে দেশে ১৪ বছরের কুমারী মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশটি যে সব কারণে এত কলঙ্কিত হয়েছে তা আমাদের দেশে চালান দিয়ে আমাদের তাই বানাতে চায়। ভাবখানা এই যে, আমরা তো মরেছি, এবার তোমরাও মর। আমরাও দু’বাহু বাড়িয়ে তা বরণ করে নিয়েছি। এই আগ্রাসী কালচার’ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। এটা করা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে।

রেডিও-টিভি বিশেষ কায়দায় সে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কারণ, ওখানে বসে যারা কলকাঠি নাড়েন, তাদের অনেকেই ডিস্কো চরিত্রের। নানাভাবে গণমাধ্যমগুলো তরুণদের জীবন-বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি চর্চায় অনুপ্রাণিত করছে, কখনো বিজ্ঞাপনের আবরণে, কখনো সংগীতের আবহে, কখনো বিদেশী চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে, কখনোও সরাসরি এই কাজটি করে যাচ্ছে। (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ১৭পৃঃ) সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন মার্কিন মহিলা ধর্ষিতা হয়। এ হিসেবে বছরে সাড়ে ৩৯ লাখ মহিলা ধর্ষিতা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ২৬ কোটি। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৮ কোটির কাছাকাছি। বছরে যদি সাড়ে ৩৯ লাখ মহিলা ধর্ষিতা হয়, তাহলে এ পর্যন্ত তাদের মহিলার শতকরা কত ভগ্নাংশ মহিলা ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায়। সেটাই প্রশ্ন। হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে এসে এখানকার নির্যাতিত মহিলাদের জন্য চোখের পানি ফেলেছেন।

চোখের পানি তো ফেলার কথা তার জন্য আমাদের। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগে, হিলারীদের কত জন ধর্ষণের হাত থেকে অক্ষত থাকতে পারছেন? কাউকে পোড়াতে গেলে নিজেই পুড়ে মরতে হয়। মুসলমানদের বিনাশের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ তথ্য-প্রবাহের নামে বিকৃত প্রচার-যন্ত্রগুলোর মুখ উন্মুক্ত করে দিয়েছে, সে যুক্তরাষ্ট্রে কারো শান্তি নেই। ঘুম হয় না; ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাতে হয়। অনেকের বাড়িতেও কাজ হয় না।

গায়ের জোরে মুসলিম দেশগুলোকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র বলে গালি দেয়া হচ্ছে। অথচ পৃথিবীতে সন্ত্রাসের আদি জন্মদাতাই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ। সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ডিশ এ্যান্টিনার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের টিভি নেটওয়ার্কগুলো। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পাশ্চাত্যের টিভি নেটওয়ার্কগুলো কিভাবে এড়াবে? স্টার টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার ৯০ শতাংশই অপরাধ বিষয়ক। এসব ছবিতে আছে র্যাম্বো

স্টাইলে ফাইটিং, মারদাংগা, মারামারি। শিল্পকলা হচ্ছে জীবনের প্রতিচ্ছবি। অথচ পাশ্চাত্য ছবিতে মানুষের জীবনে মারামারি, গোলাগুলি ছাড়া আর কিছু নেই। এদের টিভি অনুষ্ঠানমালায় জীবনের সুকুমারবৃত্তির প্রতিফলন নেই, নৈতিক উন্নয়নের উপযোগী শিক্ষণীয় কিছু নেই। এটা কেন? প্রচারণার জোরে নাৎসীবাদ যেমন টিকে থাকতে পারেনি, তেমনি পাশ্চাত্যের ঘৃণিত পুঁজিবাদও প্রচারণা চালিয়ে টিকে থাকতে পারবে না। সত্যকে কিছুদিনের জন্য আড়াল করে রাখা যায়, চিরদিনের জন্য নয়। ইতিহাসের অমোঘ বিধানে ভেসে গেছে হিটলার মুসোলিনী। একই পথে হারিয়ে যাবে ইংগ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বের অগণিত মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে জেগে থাকবে সত্যের আলো। (শাহাদাত হোসেন খান, তথ্যসন্ত্রাস ১৩৭পৃঃ)

চলচ্চিত্র জগতের যে সব সিরিজ আমরা নিয়মিত দর্শন করে চলেছি তা আসলে আমাদের। শত্রুরা সরবরাহ করে থাকে, সে কথা হয়তো আমার বহু যুবক বন্ধু জানে না। সিনেমা বা ভিডিও হলের টিকিট কেটে অথবা টিভির পর্দায় চোখ ফেলে রেখে ছেলে-মেয়ে নিয়ে অথবা গুরুজনদের পাশে বসে যে ছবি দর্শন করে তৃপ্তি লাভ করা হয়, তা আসলে আমাদের কত বড় ক্ষতি করছে এবং সারা দুনিয়াকে কোন পথে নিয়ে যাচেছু ঐ শত্রুপক্ষ, তা হয়তো অনেকে তলিয়ে দেখতেও চায়না। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইহুদীরা সারা দুনিয়াতে সন্ত্রাস এবং চরিত্রবিধ্বংসী বিষ ছড়াচ্ছে। চলচ্চিত্র জগতে ‘হলিউড’ই হলো বিশ্বের এক নম্বর প্রধান শহর, সেখানকার চলচ্চিত্র সারা দুনিয়াতে সরবরাহ হয়ে থাকে। হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রধান অংশ ইহুদী।

হলিউড হতে প্রচুর অশ্লীল ছবি নির্মিত হয়ে পুরো বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে অবশ্য টিভি সিরিজের নিমাতারাও অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ করে থাকে। অত্যন্ত বড় মাপের পাঁচটি টিভি কোম্পানী ছাড়াও আরো ২টি আমেরিকান টিভি কোম্পানী রয়েছে, যেগুলোর নাম হলো কেনিন এবং ইটিভি। এরা বিভিন্ন অশ্লীল সিরিজ নির্মাণ করে এবং পুরো দুনিয়ায় সাপ্লাই করে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই এদের ৪২টি শাখা রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আমেরিকা, লন্ডন ও ফ্রান্সে তৈরী ব্লু ফিল্মও তারা ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। এ হল আমেরিকার মিডিয়া জগতের মোটামুটি চিত্র। আমেরিকান মিডিয়ার পুরোটাই

ইহুদীদের দখলে এবং সেই মিডিয়ার মাধ্যমে ইহুদীরা আমেরিকার ছত্রছায়ায় সংঘাত, দাঙ্গাহাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে পুরো বিশ্বেই যেন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩১পৃঃ)। আমাদেরকে মুসলিম হিসাবে একটা কথা খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই সব প্রচার-অভিযানের বিরাট একটা অংশের পশ্চাতে রয়েছে ইসলামী পুনর্জাগরণের। আন্দোলনসমূহকে বানচাল করার আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা। পৃথিবীর সকল ইসলাম-বিদ্বেষী শক্তি নিজেদের যাবতীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও ইসলামী পুনর্জাগরণের বিশ্বময় আন্দোলনসমূহকে বানচাল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ ও একমত। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ওরা এক দিকে যেমন মুসলিম-বিশ্বের পুতুল সরকারগুলোকে সুকৌশলে ব্যবহার করছে, অপর দিকে বিষাক্ত অপপ্রচারণার মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে শ্রেণী বিরোধকে। উৎসাহিত করছে এবং উস্কানি দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। (ঐ ১১০পৃঃ)।

ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য জাতিকে উত্তেজিত করে লেলিয়ে দিয়ে মুসলিমদের আসল পরিচয় বিকৃত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে সকল জাতির নিকটে ‘হিংস্র-জীব’ রূপে তাদের পরিচয় প্রচার করা হচ্ছে! বিশ্বজুড়ে রাজনীতির চাবিকাঠি হাতে নেওয়ার যে ইয়াহুদী পরিকল্পনা কাজ করছে তা তাদের প্রটোকল’-এ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে। তাদের কর্মসূচিতে রয়েছে যে, আমরা ইহুদীরা দুনিয়ার সকল আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো সংবাদ-সংস্থাসমূহের মাধ্যমে কন্ট্রোল করব; যাতে করে দুনিয়াবাসীকে আমরা যে চিত্র দেখাতে চাই সে চিত্রই দেখবে।

অপরাধ-জগতের খবরগুলো আমরা এমন সূক্ষভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরব, যাতে পাঠকদের ব্রেন ওয়াশ হয়ে উল্টো অপরাধীদের প্রতিই তারা সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ইহুদীরা তাদের জন্য ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিডিয়ার সাহায্যে প্রথমতঃ তারা নিজেদের প্রকৃত চরিত্র তথা সন্ত্রাসী তৎপরতা, দাঙ্গাবাজি, অসভ্যতার লোভ-লালসা, লাঞ্ছনা, হৃদয়ের কঠোরতা, হৃদয়হীনতা এবং মানবতা-বিরোধী জঘন্য চরিত্র ঢেকে রেখে ইহুদী জাতিকে মজলুম জাতি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। ইহুদী মিডিয়া তাদের শ্বেতী চেহারাকে প্লাস্টিক সার্জারীর মাধ্যমে মেকআপ দ্বারা সুন্দর করে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে।

ইসলামের ফজর থেকেই ইয়াহুদী-চক্রান্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সমভাবে কাজ করে আসছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ হয়েছে সুদী ইত্যাদি কারবারে অর্থনৈতিক ময়দানে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করার পর। অর্থ যেখানে, স্বার্থ ও সাফল্য সেখানে৷ অবশেষে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এক ইয়াহুদী রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হল। বিভিন্ন মুসলিম দেশ জয় করে নীলনদ থেকে ফোরাতের অববাহিকা পর্যন্ত প্রায় গোটা আরব-বিশ্বকে গ্রাস করে একটি বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা আজও কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক নেতা দাজ্জাল আসা পর্যন্ত করতেই থাকবে।

এরা জানে, তাদের এ কাজে বিশেষ সহায়ক হবে প্রচারমাধ্যম। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা গড়ে তুলেছে। তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার সাংবাদিক ও রিপোর্টার। যাদের প্রধান দায়িত্ব হল, বিশ্বের সকল স্থান হতে সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রচার-সংস্থাগুলোর কাছে পৌছে দেওয়া এবং তাদের অনুমোদন নিয়ে তা প্রচার করা। বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংবাদ সংস্থা হল রয়টার। দুনিয়ার এমন কোন সংবাদপত্র, রেডিও সেন্টার ও টিভি সেন্টার নেই, যারা রয়টার থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে না। বর্তমান বিশ্বের প্রধান দু’টো প্রচারমাধ্যম বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা প্রায় ৯০% সংবাদ রয়টার থেকে সংগ্রহ করে। এ রয়টার ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত সাংবাদিকতা যেন অচল। রয়টার হচ্ছে। আকাশ সংবাদ-সংস্থার মহারাজাধিরাজ। আর তা হল ইয়াহুদীদের নিয়ন্ত্রণে।

এ ছাড়া এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), ইউনাইটেড প্রেস (ইউপি), এজেন্সী ফ্রাস্ প্রেস (এ এফ পি) -এ সবই ইয়াহুদীদের। বর্তমান বিশ্বে সব চাইতে প্রসিদ্ধ সংবাদ প্রচারমাধ্যম হল বিবিসি। এখান হতে ৪৩টি ভাষায় সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে এবং এর খবরকে অধিকাংশ লোকে ‘অহী’ বলে ধারণা ও বিশ্বাস করে। মনে করে, এই প্রচার কেন্দ্রের খবর হল নির্ভুল সত্য এবং নিরপেক্ষও। অথচ তারা যে দ্বীনদার মুসলিমদের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি রাখে না, তা হয়তো দ্বীনদাররাই বোঝেন এবং পাশাপাশি আরবী, উর্দু, হিন্দী ও বাংলা অনুষ্ঠান যারা।

শোনেন তারাও একথা নিশ্চয়ই অনুধাবন করে থাকবেন। আসলে এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটিও ইয়াহুদী পরিচালিত। এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে তারাই। ওদিকে স্টার টিভি যখন থেকে। বিশ্বকে তা প্রোগ্রামের সেবাদাস বানিয়ে ফেলেছে, তখন থেকে ইহুদীদের প্রচার-প্রোপাগান্ডা আরো অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটেনের সংবাদপত্রের উপর ইহুদীদের প্রভাব প্রায় শত ভাগ। ধীরে-ধীরে তারা সবই দখল করে নিয়েছে। ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় ১৫টি দৈনিকের মালিকই তারা। (তথ্য সন্ত্রাস ১২১-১২৬পৃঃ)

ভাই যুবক! এই দীর্ঘ আলোচনায় বিরক্ত না হয়ে হয়তো বুঝতে পেরেছ যে, বিধর্মীদের অধর্ম প্রচারে যে জোর, মুসলিমদের ইসলাম প্রচারে সামান্যও সে জোর নেই। বিজাতির প্রচারমাধ্যম ও শক্তির কাছে মুসলিম প্রচারমাধ্যম ও শক্তি নেহাতই দুর্বল। তাদের সে আলো-ঝলমল সুশোভিত, সুরঞ্জিত বিভিন্ন প্রোগ্রাম ছেড়ে ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত সাদা-মাঠা প্রোগ্রাম আর কেই বা দেখে অথবা কেই বা শোনে? ঢাকের শব্দের মাঝে মোহন বাঁশীর সুর বিলীন হওয়ারই কথা। তাছাড়া ইসলামী সে প্রচারমাধ্যম আছেই বা ক'টা? থাকলেও সঠিক ও শুদ্ধ ইসলাম প্রচার হয়ই বা কোনটায়?

পক্ষান্তরে মানুষের মন হল মন্দ-প্রবণ, প্রবৃত্তিপরায়ণ। ভালো-মন্দ উভয়ই পাশাপাশি সুসজ্জিত থাকলে বেশীর ভাগ মানুষের মন মন্দের দিকেই আকৃষ্ট হতে থাকে, ধাবিত হয় ভালো ছেড়ে ঐ নোংরার দিকে। কিন্তু পূর্ব হতেই যদি প্রতিষেধক ঈমানী ও ইসলামী টিকা বা ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে, তাহলে ঐ সংক্রমণের ভয় আর থাকে না। সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে পূর্ব-সতর্কতা থাকলে তার সংস্পর্শ ও ছোয়াচ থেকে সুদুরে থাকলেও সে ব্যাধির কবল থেকে

নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আজ বর্তমান বিশ্বে আমরা শত্রুর তরফ থেকে পাতা ফাদের মাঝে বাস করছি। শত্ৰুদল আমাদেরকে নখে কাটতে পারলে আর তরবারি চায় না। তারা চায় যে,মুসলিমরা তাদের ধর্ম মত অবলম্বন করুক। নতুবা তা না করলেও অন্ততঃ পক্ষে মুসলিমরা যেন মুসলিম না থাকে বরং তারা ধর্মান্ধত্ব (?) থেকে বেড়িয়ে এসে ধর্মহীনতার আলোয় (?) আলোক-শোভিত হোক। অবশ্য বিজাতিরা একাজে বড় কৌশল ও অতি সন্তর্পণে সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করছে আমাদেরই জাত-ভাইকে। তাই ইসলামের প্রদীপ, রহমানের আলোকবর্তিকা হয়েও ইসলাম ও রহমানের উজ্জ্বল নামকে মানকে করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। রহমান ও কাদেরের বন্ধু ও দাস হয়েও তার শত্রুতা করতে মোটেই দ্বিধা করে না। আর এ ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরী করার জন্য ব্যবহার করা হয় তথাকথিক কতক মুসলিম চিন্তাবিদ ও কবি-লেখককে।