কাফের ও ফাসেকদের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মুগ্ধ হয়ে, রেডিও, টিভি, ফিল্ম, পত্র-পত্রিকা। ও বই-পুস্তকের নানা অপপ্রচারের প্যাচে পড়ে যুবক তার ধর্ম-বিশ্বাসে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। উঁচু মানের চরিত্র থেকে নিচে নেমে নোংরামির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। যদি যুবকের নিকট এমন কোন সুগভীর দ্বীনী-সভ্যতার মজবুত ঢাল এবং প্রদীপ্ত চিন্তাশক্তি না থাকে যার দ্বারা সে হক ও বাতিল এবং উপকারী ও অপকারীর মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে, তাহলে সে কুফরী, ফাসেকী ও অশ্লীলতায় পতিত হতে বাধ্য। নাস্তিক ও বিধর্মীয় প্রচারমাধ্যমে মুগ্ধ হয়ে যুবক সম্পূর্ণ বিপরীতমুখে পশ্চাদগামী হয়ে চলতে শুরু করে। যেহেতু তাদের কথা-কৌশলের বীজ বিনা বাধায় যুবকের মন ও মগজে উর্বর জমি পায়। অতঃপর তা তাতে বদ্ধমূল হয়ে কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা শক্ত হয়ে গজিয়ে ওঠে এবং নাস্তিক্যবাদের ঐ ধাধায় যুবক তার জ্ঞান ও জীবনের দর্পণে সবকিছুকে উল্টা দেখে থাকে।

এই রোগের প্রতিবিধানার্থে যুবকের উচিত, পূর্ব থেকেই ঈমানী শিক্ষার প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা, ঐ সকল দ্বীন ও চরিত্র-বিনাশী প্রচারমাধ্যম থেকে দূরে থাকা এবং এমন প্রচারমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া যা হৃদয়ে আল্লাহ ও তদীয় রসুলের প্রতি মহব্বতের বীজ বপণ করে, ঈমান ও সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করে। আর এমন প্রচারমাধ্যম নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে দ্বীন ও নৈতিকতা বিরোধী সমস্ত রকমের প্রচারমাধ্যমকে বর্জন করার উপর ধৈর্য ধারণ করা জরুরী। কারণ, মানুষের মন তো। মন হয়তো অনেক সময় ঐ অপকারী পত্র-পত্রিকা ও শ্রাব্য-দৃশ্য বিভিন্ন প্রোগামের প্রতি ঢলতে চাইবে এবং উপকারী পত্র-পত্রিকাদি পড়তে ও কল্যাণকর কিছু শুনতে ও দেখতে বিরক্তিবোধ করবে, এ সবে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হবে। সে ও তার মনের মাঝে যুদ্ধ হবে। সে আল্লাহর অনুগত হতে চাইলেও মন চাইবে খেল-তামাশা, অসারতা ও নোংরামিতে মত্ত থাকতে। কারণ, মানুষের মন অধিকাংশে মন্দ-প্রবণ।

ঈমান সজীব ও তাজা রাখতে যুবককে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান পুস্তকাদি পড়তে হয় তার মধ্যে (অনুবাদ সহ) আল-কুরআনের বিশুদ্ধ তফসীর, সঠিক বঙ্গানুবাদ হাদীসগ্রন্থ। এবং কিতাব ও সহীহ সুন্নাহকে ভিত্তি করে লিখিত বিভিন্ন সত্যানুসারী উলামাগণের বইপুস্তক। আমাদের দেশে রেডিও টিভিতে তো সঠিকভাবে ঈমানের আলো পাওয়া তো অবাস্তব কল্পনা। বরং তাতে যা কিছু প্রচার হয়ে থাকে তার সিংহভাগই হল ঈমান ও ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম।

শায়খ সালেহ আল-ফাওযান বলেন, বর্তমানে যুব-সমাজ বিপজ্জনক স্রোতের সম্মুখীন। যা যুব-সমস্যার মহাসমস্যাবলীর অন্যতম। যদি তাদেরকে ঐ স্রোতের মুখে ভাসতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে তাদের চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। আচরণ বিশৃঙ্খলগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আকীদা ও দ্বীনী বিশ্বাস বিনষ্ট ও বিলীন হয়ে যাবে। এ ধরনের বহু প্রকার বহুমুখী স্রোত, যার বহু উৎসমুখ রয়েছে। কিছু স্রোত যা বিভিন্ন প্রচার-তরঙ্গে প্রবাহিত। যেমন, রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা চরিত্র-বিধ্বংসী বই-পুস্তক ইত্যাদি যা (মিঠা অথচ) তীব্র হলাহল। যুব-সমাজ অথবা তার কিছু তরুণদল, যারা অপকারী থেকে উপকারী নির্বাচন করতে পারে না, তারা তা হাত পেতে গ্রহণ করে নিয়েছে।

যদি পাঠ্য, দৃশ্য ও শ্রাব্যের এই প্রবাহধারাগুলিকে যুবসমাজকে কবলিত করতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর পরিণাম হবে চরম ভয়ানক প্রতিকুল। যেহেতু আজকের যুবকদলের অনেকের চরিত্র বিগড়ে গেছে এবং তারা প্রাচ্য অথবা প্রতীচ্যের পরিচ্ছদ, চিন্তাধারা ও আচরণ-বিধির ঠিক তেমন অন্ধানুকরণ করতে লেগেছে; যেমন তারা শুনছে, দেখছে ও পড়ছে। যা ঐ সমস্ত প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের নিকট এনে পৌছে দিচ্ছে। যার অধিকতর পরিস্থিতি এই যে, তাতে যুবসমাজকে (চরিত্রগত দিক দিয়ে) ধংস (ও তাদেরকে পদানত) করার গুপ্ত ষড়যন্ত্রই বেশী। বরং এর চেয়ে গুরুতর আপদ এই যে, যুবকের আকীদা ও ধর্মবিশ্বাসকে পরিবর্তন করার বড় অভিসন্ধি থাকে। তাই তো সত্যসত্যই কতক (বরং অধিকাংশ) যুবক মুসলিম নাম নিয়েও নাস্তিক্য, কমিউনিজম ইত্যাদি সর্বনাশী মতবাদের বিশ্বাসীতে পরিণত হয়ে গেছে। যেহেতু সে যখন এই সমস্ত প্রচার-আহ্বানের বিষয়ের প্রতি আগ্রহী থাকে; যা তার জন্য অতি ধীরে ধীরে ও অনায়াসে নিবেদন করা হয় এবং যখন তার মন ও মস্তিষ্ক প্রত্যেক মতবাদ থেকে শূন্য থাকে, আবার তার নিকট এমন কোন প্রতিরক্ষার হাতিয়ার আর না-ই কোন এমন ইলম থাকে; যার দ্বারা সে এই সন্দিগ্ধ অভিসন্ধি অথবা এই অষ্টকারী প্রচারাদিকে বুঝতে সক্ষম হয় তখন তার নিকট যা আসে তাই সাদরে গ্রহণ করে নেয়।

অতএব যে যুবক এই প্রচার-আহ্বানকে সত্বর বরণ করে এবং যার মস্তিষ্ক প্রত্যেক উপকারী ইন্ম থেকে খালি থাকে, তার মস্তিষ্কে তা যে বদ্ধমূল হয়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য তা তার মন-মগজ থেকে ছিড়ে ফেলা বড় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এটা হল আধুনিক অন্যতম যুবসমস্যা। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ১৫-১৬পৃঃ)

কচি-কাঁচা মন নিয়ে যুবক যৌবনে পদার্পণ করে। খোলা ও উদার মন তখনও পঙ্কিল ও আবর্জনাময় থাকে না। নিরীশ্বরবাদ, নাস্তিক্যবাদ, বহুশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্মহীনতা) বাদ, ইয়াহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ, মির্জাবাদ, সূফীবাদ, জরায়ু-স্বাধীনতাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন মতবাদ, সংগঠন ও প্রভাবশীল মিশনারির প্রলোভন ও খপ্পরে যখনই কোন মুসলিমমন সর্বপ্রথম ফেঁসে যায়, তখনই মুশকিল বাধে তার সঠিক পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে। আরবীতে একটি কবিতা আছে,

أتاني هواها قبل أن أعرف الهوى ٭ فصادف قلبا خاليا فتمكنا

এর ভাবার্থ হল, কে না চায় তার জীবন-সঙ্গিনী প্রেমিকা সুন্দরী হোক, ধনবতী হোক, উচ্চবংশীয়া তথা মর্যাদাসম্পন্না হোক। কিন্তু তবুও দেখা যায় বহু যুবক নীচ-বংশীয়া কুৎসিত নারীর প্রেম-জালে ফেঁসে তার দায়ে জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়। আর তার কারণ হল এই যে, উদার ও উন্মুক্ত মনে প্রথমে যার প্রেম এসে বাসা বেঁধে নেয়, সুন্দরীর সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার আগে আকৃষ্যমান মনে অসুন্দরীই বিশ্বসুন্দরীরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে সমস্ত বাধা উল্লংঘন করে তাকেই তুলে নেয় জীবন-তরীতে। অথচ ঐ অবসরে যুবক নিজে অথবা তার অভিভাবক যদি সুন্দর-অসুন্দরের মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে, সুন্দর লাভের সুফল ও অসুন্দর লাভের কুফল যুবকের মনে বদ্ধমূল করে দিতে পারে, সত্যের রূপরেখা তার মানসপটে প্রদীপ্ত রাখতে পারে এবং অসত্যের বাহ্যিক ও কৃত্রিম রূপের ভুয়ো বাহারে যাতে ধোকা না খায় সে বিষয়ে চেষ্টা রাখে, তাহলে অবশ্য এমন দুর্ঘটনা ঘটে না।

রেডিও, টিভি যাই বল না কেন, এ সবে প্রচারিত অধিকাংশ বিষয়-বস্তুই হল চিত্তবিনোদন। এতে যা লাভ হয় তার চাইতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক গুণ বেশী। মুসলিম জাতি-গঠনমূলক তো কোন বিষয়ই নেই বললেই চলে। বরং ইসলামের আদর্শ মান হয় এ সবে, কলঙ্কিত হয় মুসলিমের চরিত্র। কোন কোন প্রোগামে ইসলাম নাম থাকলেও আসলে তা প্রকৃত ইসলামবিরোধী। অমুসলিম স্টুডিওতে ইসলামের নামে কথা বলে কোন কাদিয়ানী অথবা বাহায়ী অথবা ভ্ৰষ্ট কোন দলনেতা। তাদের মুখে বিকৃত হয় ইসলামের আসল ভাবমূর্তি। মুসলিম স্টুডিওতেও জোরে-শোরে প্রদর্শিত হয় গান-বাজনা সহ ঈদ-মীলাদুন্নাবী, মুহারর্ম, শবেবরাত প্রভৃতি বিদআতী পর্বের প্রোগাম। তাছাড়া বহুলাংশে পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতার এ্যাডভার্টাইজম্যান্ট’ চলে।

কিছুতে থাকে ইসলাম-বিরোধী প্রকাশ্য ও সরাসরি আক্রমণ এবং কিছুতে থাকে সময়বিনাশী রঙ-তামাশা ও যৌন-অনুভূতি জাগরণকারী সুড়সুড়ি। মান। করা হয় চরিত্রবাণদের চরিত্র। আর অম্লান ও প্রশংসিত হয় লম্পট ও বেশ্যাদের চরিত্র। বেশ্যাদেরকে যৌনকর্মী বলে সমাজকল্যাণমূলক কর্মতালিকায় নাম চড়িয়ে তাদেরকে সমাজের বন্ধুরূপে মর্যাদা দিতে ধৃষ্টতা প্রকাশ করে। আর এতে সহায়তা করে শুড়ির সাক্ষী মাতালরা, লম্পট ও বেশ্যা, যোনী ও যৌন-স্বাধীনতাবাদী কুপ্রবৃত্তির তাবেদাররা। সিনেমা থেকে যুবক কি লাভ করে? যে সিনেমার কোন ফিল্মই অবৈধ প্রেমমুক্ত নয়। অপসংস্কৃতি ও যৌনপ্রবৃত্তির সহজ প্রচার-কেন্দ্র এই প্রেক্ষাগৃহ। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়স্কা। ২৫২ জন তরুণীকে নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ তরুণী সিনেমা দেখার ফলে অবৈধ যৌন-মিলনে লিপ্ত হয়েছে। আর এদের মধ্যে শতকরা ৩৮ ভাগ।

তরুণী অবৈধ পথে পা না বাড়ালেও তারা বিভিন্ন কুচিন্তা ও মানসিক অশান্তির মাঝে কালাতিপাত করে থাকে। (আল-ইফফাহ ৫৫পৃঃ)

এরপর রয়েছে নোংরা পত্র-পত্রিকার ভূমিকা। টাইম পাশ করার জন্য বহু যুবকই এর সাহারা নিয়ে থাকে। এদের হাতে থাকে প্রচুর সময়। এমনি বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই উপন্যাস পড়ে, পড়ে বিভিন্ন প্রেম ও যৌন-নিবেদনমুলক কাল্পনিক কাহিনী। কিন্তু এর মাঝে তার ঈমানী হৃদয় কতরূপে ঝাঝরা হয়ে যায়, তা হয়তো অনেকে টেরও পায় না।

আসল কথা বলতে কি? আজ মুসলিম বিশ্ব ও বিশেষ করে তার যুবশক্তি মিডিয়া আগ্রাসনের শিকার। ‘আধিপত্য বিস্তারে যুদ্ধ জয় এক সময় অপরিহার্য ছিল। যুদ্ধ জয় অপরিহার্য ছিল মূলতঃ তিনটি কারণে। (এক), বিজিত দেশে অর্থনৈতিক লুটপাট, বাজার দখল ও রাজস্ব আয়। (দুই), রাজনৈতিক প্রভুত্ব। (তিন), শত্রুর চেতনায় পঙ্গুত্বসাধন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নৈতিক বিপর্যয়সাধন ও এভাবে শত্রুর পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা রোধ। কিন্তু এখন যুদ্ধ জয় ছাড়াও এসব সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে প্রচারের সামর্থ্য এখন প্রচুর, কোন দেশের সীমানাই আজ আর অগম্য বা দুর্গম্য নয়। সুউচ্চ পর্বত বা বিস্তৃত মহাসাগর কোন কিছুই প্রচারের কাছে অনতিক্রম্য নয়। বিশ্বের ঘরে ঘরে যা কিছু বলার তা এখন অনায়াসেই বলা যায়, বাহিরের কথা ঘরে প্রবেশের এখন আর কোনই বাধা নেই। কিন্তু মুসলমানদের সমস্যা হল, এ কাজে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য, এর কোনটিই তাদের নেই।

শত্রুরা যখন এ ময়দানে বীরদর্পে খেলছে, সেখানে তারা প্রায় নীরব দর্শক হয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রচারমাধ্যমের প্রায় সবই এখন অমুসলিমদের দখলে। ফলে মুসলমানেরা কি শুনবে বা দেখবে সেটিও এখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে। চিন্তার প্রভাব প্রতিফলনে প্রচার-যন্ত্রের চেয়ে সফল মাধ্যম আর নেই। নিরেট মিথ্যাও সত্যরূপে প্রতিষ্ঠা পায় প্রচারের ফলে। প্রযুক্তির বদৌলতে শত্রুর মাইক্রোফোন এখন ঘরে ঘরে, এমনকি বেডরুমেও অনাকাঙ্খিত শত্রু হাজির ও সোচ্চার। ফলে সংকট বেড়েছে মুসলমানদের, এমনকি মুসলমান থাকা নিয়েও। শত্রুর প্রচারের বানে ভেসে গেছে অনেক মুসলমানই, এমনকি বিনষ্ট তো হয়েছে অনেকেই। ইসলামের প্রতি তাদের নেই ন্যুনতম ঈমান-আকীদা, যা মুসলিম পরিচিতির জন্য অপরিহার্য। প্রায় দুই শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের যাতাকলে মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে, প্রচারের প্রভাবে তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হয়েছে বিগত তিরিশ বা চল্লিশ বছরে। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৮ পৃঃ)

প্রায় সকল প্রকার শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম হল পাশ্চাত্যের হাতে। জাতিসংঘের হিসাব মত দেখা গেছে যে, আমেরিকা শুধু ইউরোপের জন্য বাৎসরিক ২২ লক্ষ ঘন্টা টিভি সম্প্রচার করে থাকে। ইউনিস্কোর এক জরিপে বলা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে যে টেলিভিশন প্রোগ্রাম চলছে, তার মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই হল আমেরিকার উৎপাদন। তাছাড়া ইন্টারনেট জগতের ৮৮% বিষয়বস্তু হল ইংরেজী ভাষায়। আসলে টিভি যোগে পৃথিবীটা এখন চারিপাশে আয়না বসানো সেলুনের মত হয়ে গেছে। অন্য কথায় গোটা বিশ্বটাই এখন এক রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়ে পড়েছে। যাতে রয়েছে সকল প্রকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধংস ও বিলীন করে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে একাকার হওয়ার প্রতি আহ্বান। আমেরিকা আজ সারা বিশ্বের মাটি দখল না করলেও সারা বিশ্বের মানুষের মন-মানসিকতা ও নৈতিকতা দখল করতে চলেছে। দুর্নিবার গতিতে তাদের সেই অপসংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ড এই ‘গ্লোবোলাইজেশন’-এর যুগে সারা বিশ্বমনে উঁকিয়ে বসতে চলেছে।

বর্তমানের শিশু জন্মের পরে সামান্য জ্ঞান লাভ করার পর হতেই টিভির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে, কচি-কাচা শিশুমনে অনুকরণের মাত্রা রয়েছে খুব উচ্চ। শিশুরা দেখা ছবির নায়ক-নায়িকার প্রায় ৬৭% অনুকরণ করে থাকে। (আল-ইফফাহ ৫৪পৃঃ)।

আজকাল প্রায় ঘরে ঘরে টিভি। কারো ঘরে না থাকলে পাশের ঘরে গিয়ে দেখে আসতে শিশুদেরকে বাধা দেওয়া বড় শক্ত। একটা শিশুর জীবনে বর্তমানে টিভির চিয়ে অধিক প্রিয় খেলনা বা খেলার সাথী আর অন্য কিছু নেই। ফলে এই সাথীর সম্পূর্ণ প্রভাব যে তার কাঁচা মনে পড়েই থাকে, তা বলাই বাহুল্য। সাথীর অনুকরণে নিজেকেও গড়ে তুলতে চায় এক হিরো বা হিরোইন রূপে। তার স্বভাব ও আচরণ হয় প্রায় নায়ক-নায়িকার মত। আর প্রায় ছবিতেই নায়ক-নায়িকার অভিনয় ও চরিত্র হল, অপরাধ, যৌনতা, প্রেম-ভালোবাসা, অপরাধ-রহস্য, যুদ্ধ, শৈশব, ইতিহাস, ভ্রমণ, কমেডি অথবা সামাজিক প্রোপাগান্ডা নিয়ে। এর মধ্যে পনের শ’ ছবির তিন চতুর্থাংশই নির্মিত হয়েছে অপরাধ, যৌনতা ও প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। ফলে এসব ছবি দেখার কারণেই অঙ্কুর থাকতেই উক্ত শিশুদের নৈতিক চরিত্র বিনষ্ট হতে শুরু করে।

এরা পড়াশোনা করতে চায় না। পড়তে মন পায় না। সহপাঠী ও খেলার সাথীদের সঙ্গে মারামারি করে জিততে চায়। খেলাধুলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল আঁচড়ানোর। ধরন ও কথাবার্তার রীতি পাল্টে যায়। পর্দায় যা দেখে, শিশুমন তার সবটারই অনুকরণ করার চেষ্টা করে। শিক্ষক ও মা-বাপ যা শিক্ষা দিতে পারেন না, সিনেমা তা পারে। শিশুর মনে ছবির নায়কনায়িকাদের অঙ্গ-ভঙ্গি, তাদের রুচিহীন আলাপন, ক্রোধ ও অপরাধ সংঘটনে কৌশল সবই দাগ কাটে। তখন শিশু আর শিশু থাকে না। ইচর-পাকা হয়ে তার মধ্যে ফুটে ওঠে বয়স্ক অপরাধীর ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি। ছবির নায়কের মত সে কোমরে হোলষ্টার বাধে অথবা পকেটে পিস্তল রেখে হঠাৎ তার প্রতিপক্ষকে গুলি করতে চায়। চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত একটি শিশুর আচরণ থেকে ফুলের পাপড়ির মত ঝরে পড়তে থাকে সুকুমার বৃত্তিগুলো। শৈশবেই সে পা বাড়ায় অপরাধ জগতের অন্ধকার গলিতে। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৬পৃঃ)।

যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির এক অনন্য উপহার হল এই টিভি। যন্ত্রের এই যাদুকাঠির মাধ্যমে মানুষ যেন পুরো বিশ্বটাকে শোবার ঘরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সকল দেওয়াল, দরজা ও প্রহরীর বাধা উল্লংঘন করে যেমন শিশু-কিশোরদের মন কেড়ে নিতে পেরেছে, তেমনি সকল সতর্কতা ও পর্দা সত্ত্বেও অন্তঃপুরের মহিলাদেরকে ‘চোখ মারতে এবং সতী-সাধ্বীদের সতীত্ব হনন করতে প্রয়াস পেয়েছে। এমনকি স্যাটালাইটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচারিত এই যন্ত্র-মন্ত্র যে মু’মিনের ঈমানও ছিনিয়ে নিতে চলেছে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমার চাইতেও অধিক শক্তিশালী অস্ত্র এই টেলিভিশনকেই পশ্চিমা-বিশ্ব ব্যবহার করছে। বিশ্ব-জনমতে

প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইসলাম ও মুসলিমদের খামাখা বদনাম করার সুযোগ। প্রয়োগ করছে এরই মাধ্যমে। ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিভিন্ন অপবাদকে এক শ্রেণীর মানুষ ঘরের ভিতরে নরম বিছানায় শুয়ে শুয়ে লুফে নিচ্ছে! পশ্চিমা-সভ্যতার নৈতিকতাবিবর্জিত চরিত্রহারী বিভিন্ন রঙ-তামাশায় চমৎকৃত হয়ে ভাবতে শুরু করেছে, তারাই হল উন্নত ও সভ্য মানুষ। আর বিবেক যখন মেরে ফেলা হয়, তখন সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য, সভ্যতাকে বর্বরতা এবং বর্বরতাকে সভ্যতারপে বিবেচনা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিবেক ধ্বংস করার মত যত মাধ্যম আছে, তার মধ্যে টেলিভিশন হল সবচাইতে বেশী বিপজ্জনক। ইউনিস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার ৯০% জ্ঞান লাভ করে থাকে দর্শন-শক্তির মাধ্যমে। আর ৮% লাভ করে শ্রবণ-শক্তির মাধ্যমে। বিভিন্ন আকারআকৃতি ও ভাব-ভঙ্গিমা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে জ্ঞান দান করে কোন ভাষা বা বা শব্দ তা পারে না। (আল-ইফফাহ ৫১পৃঃ) সুতরাং এই যন্ত্র যে ছয়কে নয় এবং নয়কে ছয় করার কাজে কত বেশী উপযোগী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।