আমরা সলফদের মর্যাদা এবং আমলে ও দাওয়াতে তাদের অনুসরণ। করে সালাফী হওয়ার গুরুত্ব সম্বন্ধে ইতিপূর্বে জ্ঞাত হয়েছি। তবুও সংক্ষেপে আরো একবার স্মরণ করে নেওয়া উত্তম বলে মনে হয়। তাই আবারও পাঠকের প্রণিধান আকর্ষণ করছি।

১। সরল মনে তাদের অনুসরণকারিদের প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ। (তাওবাহঃ ১০০)।

২। তাঁরা ছিলেন সত্যবাদী, সত্যাশ্রয়ী। আর মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকতে বলেছেন। (ঐঃ ১১৯)

৩। মহান আল্লাহ তাদেরকে মধ্যপন্থী এবং মানুষের জন্য সাক্ষী বানিয়েছেন। (বাকারাহঃ ১৪৩)।

৪। মহান আল্লাহ তাদেরকে মনোনীত ও নির্বাচিত করে তার রসূল (সা.)-এর সহচর বানিয়েছেন। যাতে রসূল (সা.) তাদের উপর সাক্ষী হন এবং তারাও মানুষের উপর সাক্ষী হন। (হাজ্জঃ ৭৮)

৫। মহান আল্লাহ তাদের ঈমানকে হক ও বাতিল এবং সুপথ প্রাপ্তি ও বিরুদ্ধাচরণের নিক্তি বানিয়েছেন। (বাক্বারাহঃ ১৩৬-১৩৭)

৬। তাঁদের পথ ছেড়ে যারা অন্য পথ অবলম্বন করবে, তারা ভ্রষ্ট। মহান আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন। (নিসাঃ ১১৫)

বুঝা গেল, তাদের পথ অবলম্বন করা ওয়াজেব।

৭। তারা সরাসরি রাসুলুল্লাহ -এর সাহচর্যে থেকে কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানলাভে ধন্য হয়েছে। আর তাদের পরবর্তীরা শিখেছে, তাদের নিকট থেকে। সুতরাং অনুসরণে তারাই প্রাধান্য পান। (জুমআহ

৮। তারাই সুপথপ্রাপ্ত। যেহেতু মহান আল্লাহ তাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তা তাদের হৃদয়ে সুশোভিত করেছেন। আর কুফরী (অবিশ্বাস), পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। আর বলেছেন, তাঁরাই সৎপথ অবলম্বনকারী। (হুজুরাতঃ ৭)।

৯। তারাই সুপথপ্রাপ্ত, তারাই সেই সরল পথের নিয়ামতপ্রাপ্ত পথিক, যে পথ আম্বিয়া, সিদ্দীকীন, শহীদান ও সালিহীনের পথ। (ফাতিহা, নিসাঃ ৬৯)

১০। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষ্যমতে তার পর তাঁদের যুগ সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। (বুখারী ২৬৫১, মুসলিম ৬৬৩৮নং)

১১। তাদের ব্যাপারে মহানবী ঐ বলেছেন,

النجومُ أمنَةٌ للسماءِ ، فإذا ذَهَبَتِ النجومُ أتَى السماءَ ما توعَدُ ، وأنا أمنَةٌ لأصحابي ، فإذا ذهبْتُ أتى أصحابِي ما يوعدونَ ، وأصحابي أمنَةٌ لأمَّتِي ، فإذا ذهبَتْ أصحابي أتى أمتي ما يوعدونَ

“নক্ষত্রমন্ডলী আকাশের জন্য নিরাপত্তা। নক্ষত্রমন্ডলী ধংস হলে আকাশে তার প্রতিশ্রুত জিনিস এসে যাবে। আর আমি আমার সাহাবার জন্য নিরাপত্তা। আমি চলে গেলে আমার সাহাবার কাছে প্রতিশ্রুত জিনিস এসে যাবে। অনুরূপ আমার সাহাবাবর্গ আমার উম্মতের জন্য নিরাপত্তা। সুতরাং আমার সাহাবাবৰ্গ বিদায় নিলে। আমার উম্মতের মাঝে প্রতিশ্রুত জিনিস এসে পড়বে।” (আহমাদ ১৯৫৬৬, মুসলিম ৬৬২৯নং)

১২। মহানবী (সা.) মতভেদের সময় তার ও তার সাহাবা তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের পথ অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ ৪৬০৯, তিরমিযী ২৬৭৬, ইবনে মাজাহ ৪২নং)

১৩। মহানবী(সা.) সাক্ষ্য দিয়েছেন, প্রত্যেক নবীর সহযোগী ও সঙ্গী। হয়। (মুসলিম ১৮৮নং) আর তারা তার সহচর ও সহযোগী, যারা তাঁর সুন্নতের উপর আমল করতেন এবং তাঁর আদেশের অনুসরণ করতেন।

১৪। মহানবী(সা.) বলেছেন, তাঁর উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে এবং তার ও তার আদর্শ গ্রহণকারী দলকে পরিত্রাণপ্রাপ্ত একমাত্র দল বলে ঘোষণা করেছেন। (সুনান আরবাআহ, মিশকাত ১৭ ১-১৭২, সিলসিলাহ সহীহাহ ২০৩, ১৪৯২নং)।

১৫। একদা রাসুলুল্লাহ সাহাবাদের মাঝে বললেন, “অদুর ভবিষ্যতে ফিতনা হবে।” তারা বললেন, তাহলে আমাদের কী হবে হে আল্লাহর রসূল! আমরা কী করব?' তিনি বললেন, (ترجعون الى امركم الاول) “তোমরা তোমাদের প্রাথমিক বিষয়ের দিকে ফিরে যাবে।” (ত্বাবারানীর কাবীর ৩২৩৩নং, ত্বহাবীর শারহু মুশকিলিল আষার ৩/১৪০, সিঃ সহীহাহ ৩১৬৫নং)

১৬। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, 'আল্লাহ বান্দাগণের অন্তরসমূহে দৃষ্টিপাত করলেন, তাতে তিনি মুহাম্মাদের অন্তরকে বান্দাগণের অন্তরসমূহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পেলেন। সুতরাং তিনি তাকে নিজের জন্য (বন্ধু) নির্বাচন করলেন এবং তার দূত হিসাবে প্রেরণ করলেন। অতঃপর পুনরায় তিনি মুহাম্মাদ ছাড়া অন্য সকল বান্দাগণের অন্তরসমুহে দৃষ্টিপাত করলেন, তাতে তিনি মুহাম্মাদের সাহাবাদের অন্তরসমূহকে বান্দাগণের অন্তরসমূহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পেলেন। সুতরাং তিনি তাদেরকে তার নিজ নবীর মন্ত্রী বানালেন, যারা তার দ্বীনের জন্য সংগ্রাম করবেন। সুতরাং মুসলিম (সাহাবাগণ। যেটাকে ভালো মনে করেন, সেটা আল্লাহর নিকট ভালো। আর তারা। যেটা মন্দ মনে করেন, সেটা আল্লাহর নিকট মন্দ।' (আহমাদ ৩৬০০, শারহুস সুন্নাহ বাগাবী ১/২১৪-২১৫)।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) আরো বলেন, 'সাবধান! তোমাদের কেউ যেন নিজ দ্বীনের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির এমন অন্ধ অনুকরণ না করে যে, সে ঈমানের কাজ করলে সেও করবে, নচেৎ সে কুফরী করলে সেও করবে। বরং যদি তোমাদের অন্ধ অনুকরণ করা জরুরীই হয়, তাহলে তোমরা পরলোকগত মানুষের (নবী ও সাহাবাদের) অনুকরণ কর। কারণ জীবিত ব্যক্তির ব্যাপারে ফিতনার নিরাপত্তা নেই। (লালকাঈ ১/৯৩, ১৩০নং, মাজমাউয যাওয়াইদ, হাইমী ১/১৮০)।

তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে আদর্শ বানাতে চায়, সে যেন রাসুলুল্লাহ -এর সাহাবাবৃন্দকে নিজের আদর্শ বানায়। কারণ তারা অন্তরের দিক থেকে এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ। ইলমে সবচেয়ে সুগভীর ও ‘তাকাল্লফ (কষ্টকল্পনায়) অতি কম। তারা এমন এক সম্প্রদায়, যাদেরকে আল্লাহ তাঁর নবীর সাহচর্যের জন্য মনোনীত করেছিলেন। তোমরা তাদের অধিকার স্বীকার কর। কারণ তাঁরা ছিলেন সরল ও সঠিক পথের পথিক।' (রাযীন, মিশকাত ১৯৩নং, আল্লামা আলবানীর মতে এটি যয়ীফ, কিন্তু এর অর্থ সহীহ)

তিনি আরো বলেছেন, 'তোমরা অনুসরণ কর, (বিদআত) উদ্ভাবন করো না। তোমাদের জন্য যথেষ্ট। তোমরা প্রাচীন বিষয়কে অবলম্বন। কর।' (দারেমী ১/৬৯ প্রমুখ)

১৭। আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি কাউকে আদর্শ বানাতে চায়, সে যেন মৃতদেরকে নিজের আদর্শ বানায়। তারা হলেন মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবা। তারা এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ। হৃদয়ে সবচেয়ে সৎশীল, ইলমে সবচেয়ে সুগভীর ও ‘তাকাল্লফ’ (কষ্টকল্পনায়) অতি কম। তারা এমন এক সম্প্রদায়, যাদেরকে আল্লাহ তার নবীর সাহচর্যের। জন্য এবং তার দ্বীন বহনের জন্য মনোনীত করেছিলেন। সুতরাং তোমরা তাদের চরিত্র ও নিয়ম-নীতিতে সাদৃশ্য অবলম্বন কর। যেহেতু তারা মুহাম্মাদ এক-এর সহচর। তারা ছিলেন সরল সুপথের উপর। (হিয়াতুল আউলিয়া ১/৩০৫-৩০৬)

১৮। হুযাইফা বিন ইয়ামান (রাঃ) বলেছেন, এমন ইবাদত, যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবাগণ করেননি, তা তোমরা করো না।' (মাজমুউ ফাতাওয়াল আলবানী ১/৮৯)।

১৯। ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'যে জিনিস প্রাথমিক পর্যায়ের উম্মাহকে সৎশীল (বা সুযোগ্য) বানিয়েছে, সে জিনিস ছাড়া এই শেষ পর্যায়ের উম্মাহকে সৎশীল (বা সুযোগ্য) বানাতে পারে না। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ১/২৪১ প্রমুখ) পর্যায়ের উম্মাহকে সৎশীল (বা সুযোগ্য) বানিয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহকে সৎশীল (বা সুযোগ্য) বানাবে কিতাব ও সুন্নাহ; যদি তা সলফদের বুঝ অনুযায়ী হয়। ২০। ইবনুল কাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'সালাফী আষার ও সাহাবীদের দেওয়া ফতোয়া অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়া বৈধ। বরং পরবর্তীদের রায় ও ফতোয়া গ্রহণ করার চাইতে তাদের ফতোয়া গ্রহণ করা অধিক সঙ্গত।' (জাওয়াযুল ফাতওয়া বিল-আফরিস সালাফিয়্যাহ ১/২২ ১)

আমাদের প্রতিপালক তাদের প্রশংসা করেছেন এবং রসূল কি তাদের তারীফ করেছেন, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং জ্ঞানীদের কাছে কোন সন্দেহ নেই যে, সালাফী তরীকাই অবলম্বন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক।

সলফদের কোন্ কথা ও আমল আমাদের জন্য দলীল?

সলফ তথা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর কথা ও কর্ম আমভাবে দলীল নয়। বরং তাতে শর্ত রয়েছে। প্রথমতঃ তাদের বর্ণিত সে কথা বা আমলের সনদ সহীহ হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এমন নয় যে, যে কোন একজন সাহাবীর কথা বা আমলকে মেনে নিলেই হবে। যেহেতু হাদীসে এসেছে,

أصحابي كالنجوم بأيهم اقتديتم اهتديتم

“আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মতো। তাদের যার অনুসরণ করবে, সুপথ পাবে।”

কিন্তু এ হাদীস সহীহ নয়; বরং এটি জাল হাদীস। (সিঃ যয়ীফাহ ৫৮-৬২নং)

বিশেষ করে সাহাবীর কথা ও কাজ যদি কুরআন বা হাদীসের বিরোধী হয় অথবা অন্য সাহাবীর কথা বা কাজের বিপরীত হয়, তাহলে আমরা সে ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে সালাফী’ হব কীভাবে?

উদাহরণ স্বরূপ সাহাবী আবু তালহা রোযা অবস্থায় বরফ খেতেন এবং বলতেন, 'এটা বরকত; এটা খাদ্যও নয়, পানীয়ও নয়!’

মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, (আবু তালহার) এই মওকুফ হাদীসটি উক্ত (তারকারাজির মারফু) হাদীসটি বাতিল হওয়ার অন্যতম প্রমাণ। যেহেতু তা সহীহ হলে আবু তালহার অনুসরণ করে যে রমযানে (রোযা অবস্থায়) বরফ খাবে, তার রোযা নষ্ট হবে না। (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।) আর আমার বিশ্বাস, এ কথা আজ কোন মুসলিম বলবে না।' (ঐ ৬৩নং)

উলামাদের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে যে, কোন সাহাবীর উক্তি বা আমল শরয়ী দলীল কি না?

একদল উলামা মনে করেন, আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রসূল (সা.)-এর হাদীস ছাড়া অন্য কিছু শরয়ী দলীল নয়। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ

“তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন -- ওর মীমাংসা তো আল্লাহরই নিকট।” (সূরাঃ ১০)।

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ

“যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।” (নিসাঃ ৫৯)

এখানে তৃতীয় কোন এখতিয়ার (অপশন) এর কথা বলা হয়নি। সুতরাং সাহাবীর উক্তি অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের উক্তির মতোই, তা শরয়ী কোন দলীল নয়। কিন্তু উলামার অন্য দলটি বলেন, নিশ্চয় অন্যান্যের তুলনায় সাহাবাগণের অধিক মর্যাদা আছে এবং সাহাবাগণের উক্তি ও আমল পরবর্তীদের উক্তি ও আমল অপেক্ষা সঠিকতার বেশি কাছাকাছি।

তাছাড়া তৃতীয় অপশন না থাকলেও যেভাবে শরয়ী দলীল হিসাবে ইজমা-কিয়াসকে গ্রহণ করা হয়, সেইভাবে সাহাবীর উক্তি ও আমল শরয়ী দলীল বলে বিবেচিত হবে।

অবশ্য তাতে কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। যেমন সাহাবীকে ইলম ও ফিকহে সুপরিচিত হতে হবে। নচেৎ এমন বহু বেদুঈন সাহাবী আছেন, যারা ইসলাম গ্রহণের পর মরুবাসে ফিরে গেছেন এবং শরয়ী জ্ঞানের সাথে খুব একটা সম্পর্ক রাখেননি।

এ ছাড়া যেমন উল্লিখিত হয়েছে, সাহাবীর উক্তি বা আমল সহীহ সনদ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।

আমরা সংক্ষেপে এ ব্যাপারে পাঠককে অবহিত করব, যাতে সালাফী হওয়ার মৌলিক বুনিয়াদ সম্পর্কে অল্প হলেও সতর্ক থাকতে পারেন এবং মতভেদের সময় সঠিকটা বেছে নিতে পারেন। সাহাবীর উক্তি মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্তঃ

প্রথম ভাগ

এমন উক্তি, যা রায় বা ইজতিহাদ হতে পারে না। শোনা ও বর্ণনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যেমন কোন অদৃশ্য বিষয়ক (গায়বী) খবর অথবা কোন ইতিহাস।

এমন উক্তি মারফু হাদীসের মান পায়। এমন উক্তিকে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, এমন উক্তি দ্বারা কোন বাক্যের ব্যাখ্যা করা যায়। যেহেতু এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ -এর হাদীসের অর্থ নিজের ভাষায় বর্ণনা করছেন। বিশেষ করে কোন ফতোয়া বা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন ঘটতে পারে।

তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হল, যেন উক্ত সাহাবী ইসরাঈলী বর্ণনা গ্রহণে বা বর্ণনে পরিচিত না হন (যেমন সাহাবী কা’ব আল-আহবার)। (মুযাক্কিরাতু উসূলিল ফিক্হ, শানীত্বী ২৫৬পৃঃ) প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ইসরাঈলী বর্ণনার ৩ অবস্থা হতে পারেঃ

একঃ সত্য বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার সত্যায়ন বর্তমান।

দুইঃ মিথ্যা বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার মিথ্যায়ন বর্তমান। তিন ঃ যা সত্য বলে বিশ্বাস করা যাবে না এবং মিথ্যাও বলা যাবে না।

কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার সত্যায়ন বা মিথ্যায়ন কিছুই বর্তমান নেই। (আওয়াউল বায়ান ৪/২৩৮)

দ্বিতীয় ভাগ

সাহাবীর এমন উক্তি বা আমল, যা তার নিজস্ব রায় বা ইজতিহাদ হতে পারে। এমন উক্তি বা আমলের কয়েক অবস্থা হতে পারে।

একঃ যা কুরআন বা হাদীসের উক্তির বিরোধী। এক্ষেত্রে তার উক্তি বা আমল অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে।

সঙ্গে কুরবানী না থাকলে আবু বাকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) ইফরাদ হজ্জকে উত্তম মনে করতেন। পক্ষান্তরে সহীহ সুন্নাহতে তামাত্তু হজ্জ উত্তম হওয়ার ব্যাপারে বর্ণনা আছে। সেই ভিত্তিতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) তামাত্তু হজ্জ উত্তম বলে ফতোয়া দিতেন। কিন্তু কেউ কেউ আবু বাকর ও উমারের কথা বললে তিনি বলেছিলেন, “অতি সত্বর তোমাদের উপর পাথর বর্ষণ হবে। আমি বলছি, আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন। আর তোমরা বলছ, ‘আবু বাকর ও উমার বলেছেন।” (আহমাদ ১/৩৩৭, এর সনদটি দুর্বল। অবশ্য উক্ত অর্থেই সহীহ সনদে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে একটি আসার বর্ণিত হয়েছে। দেখুনঃ যাদুল মাআদ ২/১৯৫, ২০৬)।

একই ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উমারকে এক ব্যক্তি বলল, ‘আপনার আব্বা তো তামাত্তু হজ্জ করতে নিষেধ করেছেন। এ কথা শুনে তিনি তাকে বললেন, আল্লাহর রসূল (সা.)-এর আদেশ অধিক মানার যোগ্য, নাকি আমার আব্বার?’ (যাদুল মাআদ ২/১৯৫)

ক্বাতাদাহ বলেন, ইবনে সীরীন এক ব্যক্তিকে একটি হাদীস বয়ান করলেন। তা শুনে এক ব্যক্তি বলল, কিন্তু অমুক তো এই বলেন।

প্রত্যুত্তরে ইবনে সীরীন বললেন, 'আমি তোমাকে নবী (সা.)-এর হাদীস বয়ান করছি, আর তুমি বলছ, অমুক ও অমুক এই বলেছে?! আমি তোমার সাথে কোনদিন কথাই বলব না।' (দারেমী ৪৪১নং)

আবুস সায়েব বলেন, একদা আমরা অকী’র কাছে ছিলাম। তিনি তার কাছের একটি লোকের উদ্দেশ্যে বললেন, 'আল্লাহর রসূল কি (মক্কার হারামের জন্য প্রেরিত কুরবানীর উটের দেহ চিরে) চিহ্ন দিয়েছেন। আর আবু হানীফা বলেন, তা (নিষিদ্ধ) অঙ্গহানি করণের অন্তর্ভুক্ত!

ঐ লোকটি রায়-ওয়ালা ছিল। সে বলল, কিন্তু ইবরাহীম নাখয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, (ঐ ধরনের) চিহ্ন দেওয়া অঙ্গহানি করার পর্যায়ভুক্ত। এ কথা শোনার পর দেখলাম, অকী’ চরমভাবে রেগে উঠলেন। বললেন, আমি তোমাকে বলছি, আল্লাহর রসূল (সা.) করেছেন। আর তুমি বলছ, ইবরাহীম বলেছেন! তুমি এর উপযুক্ত যে, তোমাকে ততদিন পর্যন্ত জেলে বন্দী রাখা হবে; যতদিন না তুমি তোমার ঐ কথা। প্রত্যাহার করে নিয়েছ।' (তিরমিযী ৯০৬নং)

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উক্তির উপর অন্য কোন সৃষ্টির উক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।

ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আমি সেই সম্প্রদায়ের জন্য অবাক হই, যারা (হাদীসের) সনদ ও তার শুদ্ধতা জানা সত্ত্বেও সুফিয়ানের রায় গ্রহণ করে! অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনা) অথবা কঠিন শাস্তি (আযাব) তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সূরা নূর ৬৩ আয়াত)

তুমি কি জানো, ফিতনা কী? ফিতনা হল শির্ক। সম্ভবতঃ কোন ব্যক্তি রসূল (সা.)-এর কোন উক্তিকে রদ্দ করবে, ফলে তার হৃদয়ে বক্রতা পতিত হবে এবং তার কারণে সে ধ্বংস হয়ে যাবে!’ (আলইবানাতুল কুবরা, ইবনে বাত্ত্বাহ ৯৭নং)। আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। বাকী থাকল, কোন সাহাবীর উক্তি বা আমল কি কোন আম নির্দেশকে খাস করতে পারে? এ নিয়েও উলামাদের মতভেদ রয়েছে।

দুইঃ যা অন্য কোন সাহাবীর উক্তির বিরোধী।

এ অবস্থায় কারো উক্তি দলীল রূপে গণ্য হবে না। বরং প্রাধান্য দেওয়ার সঙ্গত কারণসমূহ খুঁজে দেখতে হবে। যেমন চার খলীফার কথাকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেওয়া হবে। খলীফাদের মধ্যে হলে আবূ বাকর ও উমারের কথাকে প্রাধান্য দিতে হবে ইত্যাদি। (ই’লামুল মুওয়াক্কিঈন ৪/১৫৩)

তিনঃ কোনও একজন সাহাবীর প্রসিদ্ধ উক্তি, যার বিরুদ্ধে অন্য কোন সাহাবীর আপত্তি নেই বা বিরোধিতা নেই।

এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ উলামাগণের মতে তা দলীল। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২০/১৪) অনেকে বলেছেন, এটা মৌন ইজমা (সর্বসম্মতি)। (মুযাক্কিরাতু উসূলিল ফিকুহ, শানৰ্কীত্বী ২৫৬পৃঃ)

চারঃ কোন সাহাবীর অপ্রসিদ্ধ উক্তি, যার বিরুদ্ধে অন্য কোন সাহাবীর আপত্তি নেই বা বিরোধিতাও নেই।

এ ক্ষেত্রেও অধিকাংশ উলামাগণের মতে তা দলীল। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২০/১৪)

যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কিরাম, তাদের অনুগামী তাবেঈন, তাঁদের অনুগামী তাবা-তাবেঈন ও দীনের ইমামগণের অনুসরণ করে সহীহ হাদীসের ফায়সালাকে মাথা পেতে গ্রহণ করে, তাদের বুঝে কুরআন ও হাদীস বোঝে এবং সেই অনুযায়ী আমল করে, বিশ্বাস করে, ইবাদত করে, আচরণ করে, দাওয়াত ও তরবিয়ত দেয়, সেই হল সালাফী। সেই হল সালাফী মানহাজ ও আদর্শের অনুসারী।

ভালোভাবে লক্ষণীয় যে, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কেবল একজনের অন্ধানুকরণ করে না, বরং উলামার অনুসরণ করে এবং দলীলপুষ্ট ও যুক্তিযুক্ত মতটিকে গ্রহণ করে। তাহলে সালাফী জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা কে? সালাফিয়াত কোন মতবাদ নয়, সংগঠিত দল নয়, বিচ্ছিন্ন ফির্কা নয়। বরং তা হল ইসলামের মূল স্রোতধারা। মুসলিমদের সঠিক জীবন-পদ্ধতি। সুতরাং সঠিক ইসলামের এ জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা কোন মানুষ নয়। অথবা বলা যায়, এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অবশ্য যুগে যুগে তার সংস্কারক আছে।

মহান আল্লাহর মনোনীত দ্বীনে যুগে যুগে ভেজাল প্রবিষ্ট হয়েছে। বলা বাহুল্য, পৌত্তলিকরা মুসলিম ছিল, তারা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুশরিক হয়েছে। ইয়াহুদীরা মুসলিম ছিল, তারা ইসলাম থেকে সরে এসে ইয়াহুদী হয়েছে। খ্রিস্টানরা মুসলিম ছিল, তারা ইসলামের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে খ্রিস্টান হয়েছে। সর্বশেষ নবী (সা.) এর ইসলামী শরীয়ত আসার পরেও তাতে বহু ভেজাল অনুপ্রবেশ করেছে। আর এক-একটি ফির্কা এক-একটি নাম নিয়ে স্বচ্ছ ইসলাম থেকে সরে বসেছে।

অন্যান্য সকল ফির্কার নিজ নিজ নীতি ও মানহাজ আছে, নামও আছে। প্রকৃত স্বচ্ছ ইসলামেরও নীতি ও মানহাজ আছে, যার নাম সালাফিয়াত। এ সালাফী নীতি কুরআন ও সুন্নাহকে সাহাবাগণের বুঝে বোঝে এবং আমল করে। সালাফী সকল সাহাবাগণকে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। মহানবী -এর আহলে বায়তকেও যথার্থ ভালোবাসে। কারো প্রতি অবজ্ঞা করে না অথবা বিদ্বেষ পোষণ করে না। আবার কাউকে নিয়ে অতিরঞ্জনও করে না।

সুতরাং সালাফী নীতিতে সাহাবাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য হল, আমরা তাদেরকে ভালোবাসব, শ্রদ্ধা করব, সম্মানের সাথে তাদের নাম নেব। তাদের প্রতি ভক্তিতে আমাদের মন-প্রাণ পরিপ্লত থাকবে। যেহেতু তারা আমাদের শ্রদ্ধাভাজন, ভক্তিভাজন ও মান্যবর।

আমরা তাদের উক্তি ও আমলকে দলীল মনে করব, যদি তা সহীহ প্রমাণিত হয় এবং রসূল ৯ি-এর উক্তি ও আমলের পরিপন্থী না হয়। আমরা তাদের ইজমা' (ঐক্যমত)কে মেনে নেব। আমরা তাঁদের অনুসরণ করব। সালাফীদের নিকট প্রত্যেক সাহাবীই বিশ্বস্ত ও সম্মানাই মানুষ। তার প্রত্যেক কথা বিশ্বাসযোগ্য। তার প্রত্যেক খবর নির্ভরযোগ্য। নবী প্রকি থেকে তার পৌঁছানো প্রত্যেক কথা গ্রহণযোগ্য।

সাহাবাগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। এ নির্ভরযোগ্যতা দান করেছেন খোদ মহান আল্লাহ ও তার রসূল । আল্লাহ ও তার রসূল তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তারাই শ্রেষ্ঠ আওলিয়া এবং আল্লাহর নির্বাচিত বন্ধুবর্গ। তারাই সৃষ্টির সেরা মানুষ এবং নবীর পরে এ উম্মতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুসলিম।

তারা বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্য তাদের দ্বীন ও ঈমানদারিতে, দ্বীন ও শরীয়তের বর্ণনা ও বহন করাতে। তাদের কারো কারো মাঝে যে। ইজতিহাদী ত্রুটি ছিল, আল্লাহ ও রসুলের প্রশংসায় তা বিলীন হয়ে গেছে।

দ্বীন ও শরীয়ত, কুরআন ও সুন্নাহর ধারক ও বাহক তারাই। তারা নবীর আদেশ পালন করেছেন বলেই আমরা আমাদের দ্বীন ও শরীয়ত সঠিকরূপে প্রাপ্ত হয়েছি।

তারা বড় আমানতদারির সাথে দ্বীন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বড় যত্নের সাথে নবীর সুন্নাহর হিফাযত করেছেন। দ্বীনের পতাকাকে সমুন্নত রেখে উডডীন করেছেন।

তাদের মধ্যে কেউ নেই, যাকে মিথুক ভাবা যাবে। এমন কেউ নেই, যাকে অনির্ভরযোগ্য বলে সন্দেহ করা যাবে। তাদের মধ্যে নানা ফিতনা সৃষ্টির পরেও তাদের বিশ্বস্ততা খোয়া যায়নি।

সাহাবাদের প্রতি আমাদের আরেকটি কর্তব্য হল, আমরা তাদের জন্য দুআ করব। এটা তাদের প্রাপ্য। দ্বীনের স্বার্থে যারা নিজেদের জান-মাল ব্যয় করে গেছেন, তারা কি দুআ পাওয়ার হকদার নন? অবশ্যই।

সুতরাং আমরা তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দুআ করব, তাদের প্রতি করুণা বর্ষণের আবেদন জানাব এবং তাদের প্রতি তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করব।

আমরা আমাদের হৃদয়-মনকে তাদের ব্যাপারে পরিষ্কার রাখব। আমাদের মনে তাদের প্রতি কোন প্রকারের বিদ্বেষ থাকবে না, কূট ও ঘৃণা থাকবে না। তাদের কোন প্রকার দুর্ঘটনা শুনে আমাদের মন তাদের প্রতি কোনরূপ বিরূপ ও ক্ষুব্ধ হবে না। এ কথা মহান আল্লাহর শিখানো উক্ত দুআতেই রয়েছে।

তাদের কোন ত্রুটি শুনে অথবা তাদের প্রতি কোন কুধারণা করে তাদেরকে কোন প্রকার গালাগালি করব না, তাদের কোন সমালোচনা করব না।

আমরা তাদের মাঝে ঘটিত দুর্ঘটনার কথা আলোচনা করব, কিন্তু সমালোচনা করব না। কারণ সমালোচনা এক প্রকার গালি। আর যেহেতু তারা দ্বীনের ধারক, বাহক ও প্রচারক। সুতরাং তাদের। সমালোচনা করার মানেই দ্বীনের সমালোচনা করা।

তাদের কোন ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কারো বিরুদ্ধে। কুমন্তব্য ও কটুক্তি করাই হল সমালোচনা করা। যে সমালোচনায়। তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় অথবা তাদের সম্ভ্রমে আঘাত লাগে, তা করার। মানেই তাদেরকে গালি দেওয়া। আর তা আমাদের জন্য বৈধ নয়। বৈধ নয় তাদের বিশ্বস্ততা, আমানতদারী, সততা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতায় কোন প্রকার সন্দেহ করা। বলনে বা লিখনে তাদের প্রতি কটাক্ষ করা, ব্যঙ্গোক্তি করা, তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা, একজন। সাহাবীর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অপরকে তুচ্ছ করা বৈধ নয়।

তারা সেই সম্প্রদায়, যাদের রক্ত থেকে আল্লাহ আমাদের হাতকে পবিত্র রেখেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত, আমরা আমাদের জিহ্বাকে তাদের সম্মান লুটা থেকে পবিত্র রাখব। সালাফীরা সাহাবাকে ভুলের উর্ধে ধারণা করে না। যেমন তাদের কাউকে নিয়ে বাড়াবাড়িও করে না।

সালাফীরা কেবল মহান আল্লাহর ইবাদত করে, তার ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করে না। সহীহ সুন্নাহর তরীকা ও পদ্ধতি মতে ইবাদত করে এবং প্রত্যেক বিদআতকে প্রতিহত করে। সৎকাজে আদেশ দেয় এবং মন্দকাজে বাধাদান করে।

সালাফীরা কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত সেই সমস্ত সিফাত বা গুণ, যার দ্বারা আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা তার রসূল ও তার জন্য বর্ণনা করেছেন তা বাস্তব ও প্রকৃত ভেবে, কোন প্রকারে তার অপব্যাখ্যা না করে, কোন উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত। কল্পনা না করে এবং তার প্রকৃতার্থ ‘জানি না বলে সে বিষয়ে আল্লাহকে ভারার্পণ না করে ঈমান ও প্রত্যয় রাখে।

তাওহীদুর রবুবিয়্যাহ, তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ ও তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে ও তা বাস্তবায়ন করে। আর একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, কুরআন দ্বারা মীমাংসা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীয়তের নিকটেই নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের। বিচারপ্রার্থী হওয়া, এ সব কিছু তওহীদুল ইলাহের শামীল।

সালাফীরা সদা-সর্বদা কিতাব ও সুন্নাহকে মাথার উপরে রাখে। তার ফায়সালাকেই চূড়ান্ত বলে মান্য করে। তার উপরে কারো কথা, রায়, কিয়াস, খেয়ালখুশি, বিবেক, যুক্তি বা মযহাবকে প্রাধান্য দেয় না।

সালাফীরা আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীন (মুজতাহিদ সকল ইমাম)কে শ্রদ্ধা করে। তাদের মধ্যে কোন একজনের একতরফা পক্ষপাতিত্ব করে না। বরং ফিকহ (দ্বীনের জ্ঞান) গ্রহণ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহ হতে এবং তাঁদের উক্তিসমূহ হতেও---যদি তা সহীহ হাদীসের অনুসারী হয়। আর এই নীতিই তাদের নির্দেশের অনুকূল। যেহেতু তাঁরা সকলেই নিজ নিজ অনুসারিগণকে সহীহ হাদীসের মত গ্রহণ করতে এবং এর প্রতিকুল প্রত্যেক মত ও উক্তিকে প্রত্যাখ্যান। করতে অসিয়ত করে গেছেন। সালাফীরা আল্লাহর দ্বীন তথা তাওহীদ ও আকীদায় কোন প্রকার অন্যায় ও বাতিলের সাথে আপোস করে না।

সালাফীদের মানহাজে তওহীদ হল, সকল প্রকার ইবাদত; যেমন, দুআ বা প্রার্থনা, সাহায্য ভিক্ষা, বিপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে আহ্বান, যবেহ, নযর-নিয়ায, ভরসা, আল্লাহর বিধান অনুসারে বিচার ও শাসন করা ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মানা। এটাই হল সেই বুনিয়াদ যার উপর সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র রচিত হয়।

সালাফীরা মনগড়া সমস্ত মানব রচিত আইন-কাননকে অস্বীকার করে। কারণ তা ইসলামী আইনের বিরোধী ও পরিপন্থী। আর আল্লাহর কিতাবকে জীবন ও রাষ্ট্র-সংবিধান রূপে মেনে নিতে সকলকে আহান। করে---যে কিতাবকে মহান আল্লাহ মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধির জন্য অবতীর্ণ করেছেন। আর তিনিই অধিক। জানেন, কী তাদের জন্য কল্যাণকর এবং কী অকল্যাণকর। সেই করআন অপরিবর্তনীয়। যার বিধান কোন কালেও পরিবর্তিত হবে না। এবং যুগের বিবর্তনে তার ক্রমবিকাশও ঘটবে না।

নিশ্চিতভাবে সারা বিশ্বের এবং বিশেষ করে মুসলিম-বিশ্বের দুর্গতি, বিভিন্ন কষ্ট, লাঞ্ছনা এবং অবজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার একমাত্র কারণ হল আল্লাহর কিতাব এবং তার রসুলের সুন্নাহ দ্বারা জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা ত্যাগ করা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রগতভাবে ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশের প্রতি প্রত্যাবর্তন ছাড়া মুসলিমদের কোন মর্যাদা ও শক্তি ফিরে আসতে পারে না। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপায় কী?

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তা টিকে থাকতে হবে। সুতরাং তার ইমারত গড়তে হলে তার বুনিয়াদ মজবুত করতে হবে, তার ইট পাকা হতে হবে, তার সিমেন্ট নির্ভেজাল হতে হবে। তা না হলে সে ইমারত সদ্যঃপাতী ও ভঙ্গুর হবে।

সালাফীদের মতে আকীদার পরিশুদ্ধি এবং বিশুদ্ধ আকীদার উপর জনগোষ্ঠীর তরবিয়ত ও প্রশিক্ষণ সর্বাগ্রে শুরু করা জরুরী। যাতে এমন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তৈরী হয়, যারা ইসলামী শাসনকে উন্মুক্ত ও উদার মনে গ্রহণ ও মান্য করে চলবে এবং নিপীড়িত ও বিপদগ্রস্ত হলে অকাতরে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে---যেমন পূর্ববর্তী সলফগণ সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। সালাফীরা মনে করে, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ভােটাভুটি অথবা সামরিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ বা খুনাখুনির মাধ্যমে মুসলিম দেশে। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হবে না। আর হলেও তা স্থায়ী হবে না। পরন্তু সালাফীরা দলাদলিতেও বিশ্বাসী নয়। অতএব ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ী করতে হলে রাসূলুল্লাহ কি-এর পদ্ধতি গ্রহণ ও অবলম্বন করতে হবে। আকীদার সংশুদ্ধি ও সঠিক ইসলামী তরবিয়তের মাধ্যমে মাদানী জীবন-ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।

ইসলামী জাগরণ আনয়নের যে মৌলিক পন্থা আছে, তার সঠিক প্রয়োগ চাই। সংশোধন ও তরবিয়ত। সঠিক ইলম শেখা ও শিখানোর মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করা এবং করআন ও সহীহ সন্নাহর। সঠিক তরবিয়ত দানের মাধ্যমে মানুষ তৈরি করা। যারা শাসন মান্য করবে, তারাই যদি অপ্রস্তুত থাকে, তাহলে জোর-জবরদস্তি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর শাসন চাপিয়ে দিলে তো বাঞ্ছিত শান্তির রাজ্য কায়েম হবে না। ভালো ফসল উৎপাদন করতে হলে আগে জমি প্রস্তুত করতে হবে। মজবুত অট্টালিকা গড়তে হলে ভিত্তি মজবুত করতে হবে, ইটগুলিকে পরিপক্ব করতে হবে।

সালাফীদের বক্তব্য হল, তোমাদের হৃদয়ের ভূমিতে আগে ইসলাম কায়েম কর, তবেই তোমাদের দেশের ভূমিতে ইসলাম কায়েম হবে। আগে সংশোধন, তারপর সংগঠন। জিহাদের মাধ্যমেও ইসলাম কায়েম করতে হলে তার নানা শর্ত আছে, তা পূরণ হতে হবে। তার আগে জিভ ও কলম দ্বারা জিহাদ অব্যাহত রাখতে হবে। আর সন্ত্রাস করে ইসলামের ক্ষতি বৈ কোন লাভ হবে না।

ফিরকাহ নাজিয়াহ সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করে। এই দল বিদআতী সকল নীতি এবং সর্বনাশী দলসমূহকে প্রতিহত করে---যে দলসমূহ উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে ও দ্বীনে বিদআত রচনা করে রসূল (সা.) এবং তার সাহাবার সুন্নাহ (ও নীতি) থেকে দুরে সরে আছে। বিদআতকে প্রতিহত করার জন্য এবং সহীহ আকীদা ও আমলের। দিকে মানুষকে আহবান করার পদ্ধতি হল নিম্নরূপঃ এই দাওয়াতের সর্বাগ্রে রয়েছে মৌলিক বিষয়, সহীহ ইলম। মহান আল্লাহ বলেছেন,

قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ ۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي ۖ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“তুমি বল, এটাই আমার পথ। আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করি সজ্ঞানে আমি এবং আমার অনুসারিগণও। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (ইউসুফঃ ১০৮)

অতঃপর ইলমকে পরিবর্তন, সংস্কার ও সংশোধনের কাজে ব্যবহার।

প্রথম ধাপ হলঃ তাসফিয়াহ

এর অর্থ হল দ্বীনকে প্রত্যেক সেই বিকৃতি, অপব্যাখ্যা ও উৎক্ষিপ্ত কর্দম থেকে পরিষ্কার করা, যা তার সৌন্দর্যকে মান করে দিয়েছে এবং তার ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সালাফী উলামাগণ সহীহ দ্বীন পালন ও বহন করেন এবং দ্বীনে অনুপ্রবিষ্ট ভেজালকে চিহ্নিত ও সাফাই করেন। মহানবী (সা.) বলেছেন,

يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله ينفون عنه تحريف الغالين وانتحال المبطلين

“এই ইলমকে প্রত্যেক শতাব্দীর নির্ভরযোগ্য (বিশ্বস্ত) লোকে বহন করবে। তারা তা হতে অতিরঞ্জনকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার ও মুখদের অপব্যাখ্যা দূরীভূত করবে।” (বাইহাক্বী ২১৪৩৯, মিশকাত ২৪৮নং)

এর উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারেঃ অতিরঞ্জনকারীদের বিকৃতিঃ যেমন সর্বেশ্বরবাদী সূফীদের বিকৃতি, শিয়া ও রাফেযীদের বিকৃতি; যারা আহলে বায়তের ভালোবাসায় অতিরঞ্জন করে দ্বীনে বহু বিকৃতি সাধন করেছে এবং তারাই ইসলামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও কঠিন ফিতনাবাজ। খাওয়রিজের বিকৃতি, যারা কুরআন মানতে অতিরঞ্জন করে হাদীস অস্বীকার করেছে এবং সাহাবাদেরকে কাফের বলেছে। অনুরূপ মুতাযিলা, জাহমিয়্যাহ, কাদারিয়্যাহ, জাবারিয়্যাহ, মুরজিআহ প্রভৃতি ফির্কা ও তাদের অনুগামীদের অতিরঞ্জন ও বিকৃতি প্রসিদ্ধ।

বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচারঃ যেমন ইসলামের দার্শনিকরা, যারা ইসলামের উপর আক্কেলের ঘোড়া ছুটিয়েছে এবং দ্বীনকে যুক্তিভিত্তিক করতে গিয়ে ধ্বংস করতে প্রয়াসী হয়েছে। বর্তমানেও বহু বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী পাওয়া যায়, যারা দ্বীনের মর্যাদা মলিন করতে কার্পণ্য করে না।

মূর্খদের অপব্যাখ্যাঃ যাদের জ্ঞান ও বিবেকগ্রাহ্য নয় ধারণা করে তারা দ্বীনের অপব্যাখ্যা করে অথবা তাদের মযহাব ও খেয়ালখুশির প্রতিকূল বলে তারা কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে।

আলহামদু লিল্লাহ, সালাফী উলামাগণ সে সবের খন্ডন করেছেন এবং সঠিক দ্বীনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রেখেছেন।

দাওয়াতের দ্বিতীয় ধাপ হলঃ তাজদীদ

মুমিনের হৃদয়ে ঈমান পুরনো হয়ে যায়, তাকে নবায়ন করতে হয়। মনে কালিমা ও জং পড়ে, তা দূরীভূত করতে হয়, ঝালিয়ে নিতে হয়। দ্বীনের মধ্যে কুসংস্কারের জঞ্জাল ও আবর্জনা পড়ে, তা পরিষ্কার করতে হয়, সুন্নাহ মৃত হয়ে যায়, তা পুনর্জীবিত করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

إن الله يبعث لهذه الأمة على رأس كل مائة سنة من يجدد لها دينها

“নিশ্চয় আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর মাথায় এমন ব্যক্তি প্রেরণ করবেন, যে তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে নবায়ন করবে।” (আবু দাউদ ৪২ ৯৩, হাকেম ৮৫৯২নং)

তৃতীয় ধাপ হলঃ ইসলাহ

ইসলাহ মানে সংশোধন করা, মেরামত করা, নষ্ট বা খারাপ হয়ে। যাওয়াকে ঠিক বা ভালো করা, অচলকে সচল করা ইত্যাদি।

বর্তমানে ইসলাম বিশ্বের বহু জায়গায় স্বমহিমায় বলিষ্ঠ আছে। কিন্তু প্রত্যেক পূর্ণতার লয় আছে, ক্ষয় আছে। এক সময় সারা বিশ্বে ইসলাম আসবে। আবার এক সময় ধীরে ধীরে ইসলাম শুরুর মতো দুর্বল ও প্রবাসীর মতো অসহায় হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সময়েও সালাফী ইসলাহ কায়েম থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

إن الإسلام بدا غريبا وسيعود غريبا كما بدا فطوبى للغرباء

“নিশ্চয় ইসলাম (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়ে শুরুতে আগমন করেছে এবং অনুরূপ অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়েই ভবিষ্যতে প্রত্যাগমন করবে; যেমন শুরুতে আগমন করেছিল। সুতরাং শুভসংবাদ ঐ (প্রবাসীর মতো অসহায়) অল্প সংখ্যক লোকেদের জন্য।” বলা হল, (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্প সংখ্যক লোক কারা? তিনি বললেন,

الذين يصلحون إذا فسد الناس

“যারা মানুষ অসৎ হয়ে গেলে তাদের ‘ইসলাহ’ (সংশোধন) করে।” (আহমাদ ১৬৬৯০, ত্বাবারানীর কাবীর ৭৫৫৪, আওসাত ৩০৫৬ নং)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, তারা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ খারাপ লোকেদের মাঝে অল্প সংখ্যক ভালো লোক, যাদের অনুগত লোকের চাইতে অবাধ্য লোকই বেশি থাকবে।” (আহমাদ ৬৬৫০, সহীহ তারগীব ও ১৮৮নং)

চতুর্থ ধাপঃ তারবিয়্যাহ

তরবিয়ত ও ট্রেনিং দেওয়া, অনুশীলন করানো, অভ্যাসী বানানো, রপ্ত করানো, কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে সাহাবায়ে কিরামের তরবিয়তের মতো মানুষকে তরবিয়ত দেওয়ার কাজ সালাফী মুরাব্বীরা করে থাকেন। পিতামাতা যেমন সন্তান লালন-পালন করে থাকে, ঠিক সেইভাবে সালাফী রাব্বানী উলামাগণ সহীহ তরবিয়ত দানের মাধ্যমে মানুষ তৈরি করেন। তরবিয়ত চলে নিজ ঘরে, পরিবারে, তরবিয়ত চলে মসজিদে ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। সংখ্যায় কম হলেও মানিকের খানিক ভালোর মতো মানুষ তৈরি হয়। আর মানুষের মাঝে পরিবর্তন না এলে বা আনয়ন করতে না পারলে। সার্বিক পর্যায়ে ইসলামী পরিবেশ ও শাসন কল্পনা করাও বৃথা হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“নিশ্চয় আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না; যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (রা’দঃ ১১)

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

“এ এজন্য যে, আল্লাহ কোন সম্প্রদায়কে যে সম্পদ দান করেন, তিনি তা (ধ্বংস দিয়ে) পরিবর্তন করেন না; যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর নিশ্চিত আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ” (আনফালঃ ৫৩)

সালাফী তরবিয়ত ছাড়া মানুষের মাঝে সঠিক পরিবর্তন আসবে না। আর যেমনটি ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'যে জিনিস প্রাথমিক পর্যায়ের উম্মাহর ইসলাহ করেছে, সে জিনিস ছাড়া এই শেষ পর্যায়ের উম্মাহর ইসলাহ করতে পারে না।' (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ১/২৪১ প্রমুখ)

সালাফী মুরাব্বী, সংস্কারক বা আলেম-মুআল্লিম

আমরা ইতিপূর্বে ইসলাহ ও তরবিয়তের ব্যাপারে রব্বানী আলেম বা দাঈর কথা বলছিলাম। তাকে জ্ঞানী হতে হবে। নচেৎ যার আলো নেই, তিনি আলো বিতরণ করবেন কীভাবে। হয়তো-বা তিনি গড়ার জায়গায় ভেঙ্গে ফেলবেন। নিম আলেমদের দাঈ বা মুফতী হওয়া, হাদীসের পরিভাষা, (মুসত্বালাহ, জারহ ও তাদীল, আসমাউর রিজাল) প্রভৃতি বিদ্যা অধ্যয়ন না করেই হাদীস সহীহ-যয়ীফ করতে শুরু করা, যথেষ্ট শরয়ী জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তিকে আমীর বা নেতা বানানো ইত্যাদিতে অবশ্যই ক্ষতি হবে মানহাজের।

অনুরূপ আমলের ক্ষেত্রেও রাখতে হবে খেয়াল। কেবল ইলম শিক্ষা নয়, আমলেও জোর দিতে হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সালাফী হওয়ার অবশ্যই চেষ্টা রাখতে হবে। নচেৎ বুকে হাত বাধা, রফয়ে য়্যাদাইন করা, জোরে আমীন বলা, পায়ে পা লাগানো ইত্যাদির মাধ্যমে। সালাতে এবং তালাক প্রভৃতি কয়েটি মাসআলায় আহলে হাদীস হলে যথেষ্ট নয়। আকীদায়, ইবাদতে, চেহারায়, লেবাসে-পোশাকে-পর্দায়, লেনদেন ও চরিত্র-ব্যবহারেও সালাফী হতে হবে।

দাওয়াতী ময়দানে কেবল অসালাফী ফিকাগুলোর সমালোচনার উপর জোর দিয়ে নিজেদের আত্মসমালোচনা ত্যাগ করলে ফল আশানুরূপ ভালো হতে পারে না।

সালাফী মানহাজে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। বিনা ইলমের দাওয়াতে ফিতনা বেশি হয়। পথের দিশা হারিয়ে গিয়ে পথভ্রষ্টতাই পরিণাম হয়।

মহানবী (সা.) বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ লোকদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন না; বরং উলামা সম্প্রদায়কে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নেবেন (অর্থাৎ, আলেম দুনিয়া থেকে শেষ হয়ে যাবে।) অবশেষে যখন কোন আলেম বাকি থাকবে না, তখন জনগণ মুখ অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নেতা বানিয়ে নেবে এবং তাদেরকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হবে, আর তারা না জেনে ফতোয়া দেবে, ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” (বুখারী ৭৩০৭, মুসলিম ৬৯৭ ১নং)

যিয়াদ বিন হুদাইর বলেন, একদা আমাকে উমার (রাঃ) বললেন, 'তুমি জান কি, ইসলামকে কিসে ধ্বংস করবে?' আমি বললাম, 'জী না।” তিনি বললেন,

يهدمه زلة العالم وجدال المنافق بالكتاب وحكم الأئمة المضلين

‘ইসলামকে ধ্বংস করবে আলেমের পদস্থলন, কুরআন নিয়ে মুনাফিকের বিতর্ক এবং ভ্ৰষ্টকারী শাসকদের রাষ্ট্রশাসন।' (দারেমী ২১৪নং)

সলফে সালেহীন দ্বীনের দাঈ ছিলেন, তাদের অনুসারীদেরও উচিত দাঈ হওয়া এবং তার জন্য ইলম ও আমল-ওয়ালা হওয়া। ইলম ও আমল-ওয়ালাই প্রকৃতপক্ষে যোগ্য দাঈ। যেহেতুঃ

১। প্রত্যেক নবী দ্বীনের দাঈ ছিলেন। আর উলামাগণ নবীর ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোন রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানভান্ডারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং তারাই হবেন সুযোগ্য দাঈ। যারা হবেন মানুষের আদর্শ, যাদের দাওয়াতে থাকবে হিকমত ও সুকৌশল।

২। উলামাগণ পৃথিবীর বুকে সৃষ্টির বিপক্ষে আল্লাহর হুজ্জত। আর ইম ও ফিকহ ছাড়া হুজ্জত কায়েম হয় না। সুতরাং আহলে ইলমরাই হলেন প্রকত দাঈ।

৩। উলামাগণই রাজনৈতিক প্রভাবশালী লোক। যাদের আনুগত্য করতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন। তিনি বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসুল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও।” (নিসাঃ ৫৯)।

মুজাহিদ বলেছেন, তোমাদের আহলে ইলম ও ফিকহ ব্যক্তিবর্গের অনুগত হও। উলুল আমরের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস বলেছেন, 'আহলুল ইলম। আবুল আলিয়াহ বলেছেন, 'আহলুল ইলম। সুতরাং স্পষ্ট যে, তারাই হবেন দ্বীনের দাঈ। ৪। উলামাগণই উম্মাহর বৃহত্তম স্বার্থ, সার্বিক কল্যাণ, দ্বীন ও দুনিয়া ও তার নিরাপত্তার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষ। তাই তারাই হতে পারেন দাওয়াতের জন্য নির্ভরযোগ্য।

৫। উলামাগণই রাষ্ট্রের পরামর্শদাতা ও মন্ত্রণাদাতা। দেশের রাজাপ্রজা সবাই দ্বীন ও দুনিয়ার সমস্যায় তাঁদের দিকেই রুজু করে থাকে এবং উম্মাহর ভালো-মন্দের ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং তারাই হবেন দাওয়াতের ক্ষেত্রেও পরামর্শদাতা।

৬। উলামাগণ হলেন দ্বীনের ইমাম। আর এ ইমামতির আছে সুউচ্চ মর্যাদা ও বিশাল মাহাত্ম্য। দ্বীনের একটি অঙ্গ হল দাওয়াত। দাওয়াত ছাড়া দ্বীন হয় না, দ্বীন ছাড়া দাওয়াতও হয় না। বিধায় তারাই হবেন। দাওয়াতের ইমাম। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا ۖ وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ

“ওরা যেহেতু ধৈর্যশীল ছিল, তার জন্য আমি ওদের মধ্য হতে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথপ্রদর্শন করত। ওরা ছিল আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী।” (সাজদাহঃ ২৪)।

৭। উলামাগণ হলেন আহল্য যিকর। আর যিকর হয় ইলম ও দাওয়াতের মাধ্যমে। সুতরাং তারাই আহলুদ দাওয়াহ। মহান আল্লাহ বলেছেন,

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

“তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।” (আম্বিয়াঃ ৭)।

৮। উলামাগণ হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। জনসাধারণের মাঝে আলেম হলেন তারকারাজির মাঝে পূর্ণিমার চাদের মতো। মহান আল্লাহ তাদের মর্যাদা সুউচ্চ করেছেন।

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ

“তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে বহু মর্যাদায় উন্নত করবেন।” (মুজাদালাহঃ ১১)।

আর মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষই দাঈ হওয়ার যোগ্য।

৯। উলামাগণই বেশি দ্বীনদার মানুষ এবং সবার চাইতে বেশি আল্লাহকে ভয় করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

“আল্লাহর দাসদের মধ্যে জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, বড় ক্ষমাশীল।” (ফাত্বিরঃ ২৮)

আর তা হলে তারাই দাঈ হওয়ার বেশি হকদার। তাঁরাই দাওয়াতে অগ্রগামী হবেন এটাই স্বাভাবিক।

১০। উলামাগণই ইলম ও হিকমতের সাথে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করে থাকেন। সুতরাং উলামাগণই হবেন দ্বীনের দাঈ।

১১। উলামাগণ আল্লাহর সাক্ষী, তিনি তাঁর তওহীদের উপর তাদেরকে সাক্ষী মেনেছেন এবং নিজের ও ফিরিবর্গের সাক্ষ্যের সাথে তাদের সাক্ষ্যকে আয়াতে সংযুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,

شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“আল্লাহ সাক্ষ্য দেন এবং ফিরিস্তাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণও সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই। তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই, তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (আলে ইমরান : ১৮)।

আর এতে নিশ্চয় তাদেরকে প্রশংসিত ও বিশ্বস্ত মানা হয়েছে। বিধায় তারাই দাওয়াতের জন্যও নির্বাচিত ও মনোনীত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্যই সকল উলামা সমান নন। সকলের গুণাবলী এক নয়। সে ক্ষেত্রে যার ইলম ও আমল বেশি, তিনিই দাওয়াতের জন্য উপযুক্ত বেশি। {দ্রঃ আল-উলামা হুনুদ দুজতু শায়খ নাসের আকুল কারীম আল-আকূল।

আল্লাহর ইচ্ছায় এমন উলামা যুগে যুগে থাকবেন। গণনায় কম হলেও কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। তারা তাদের ইলম ও দাওয়াতের জিহাদ নিয়ে বিজয়ী থাকবেন।

لا تزال طائفة من أمتي ظاهرين على الحق لا يضرهم من خدلهم حتى يأتي أمر الله وهم كذلك

“আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল চিরকাল হক (সত্যের) উপর বিজয়ী থাকবে, আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত) আসা পর্যন্ত, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।” (মুসলিম ৫০৫৯নং)

অন্য এক শব্দে বর্ণিত হয়েছে,

لا تزال طائفة من أمتي قوامة على أمر الله لا يضرها من خالفها

“আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল চিরকাল আল্লাহর নির্দেশ (শরীয়ত)এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। যে তাদের বিরোধিতা করবে, সে তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।” (ইবনে মাজাহ ৭নং)

অন্য এক শব্দে বর্ণিত হয়েছে,

لا يزال طائفة من أمتي ظاهرين حتى يأتيهم أمر الله وهم ظاهرون

“আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল চিরকাল বিজয়ী থাকবে, আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত) আসা পর্যন্ত, সে অবস্থায় তারা বিজয়ী থাকবে।” (বুখারী ৭৩১১, মুসলিম ১৯২ ১নং, আহমাদ ৪/২৪৪) অন্য এক শব্দে বর্ণিত হয়েছে,

لا تزال طائفة من أمتي يقاتلون على الحق ظاهرين إلى يوم القيامة

“আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল চিরকাল কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থেকে হক (সত্যের) উপর লড়াই করবে।” (মুসলিম ৫০৫৯নং)

ইমাম বুখারী উক্ত দলটির ব্যাপারে বলেছেন, তারা হলেন আহলে ইলম (উলামা)।' (বুখারী ৭৩১১নং)। তিরমিযী বলেছেন, আমি মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারীর কাছে শুনেছি, তিনি আলী বিন মাদীনীর কাছে শুনেছেন, তারা হলেন আসহাবুল হাদীস। (উমদাতুল ক্বারী ৩৫/৪২৮)

হাকেম ‘উলুমুল হাদীস গ্রন্থে সহীহ সনদে আহমাদ হতে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেছেন, তারা যদি আহলুল হাদীস না হন, তাহলে আমি জানি না যে, তারা কারা।' (ফাতহুল বারী ২০/৩৬৮)।

“তারা বিজয়ী থাকবে” অর্থাৎ, সকল মানুষের উপর তারা নিজেদের দলীল-প্রমাণ নিয়ে বিজয়ী থাকবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও বিজয়ী থাকবে। কলম ও তরবারি উভয় যুদ্ধে তাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তাদের বিরোধীরা তাদের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে না। তারা উলামা ও মুজাহিদ রূপে বিরোধীদের উপর সদা বিজয়ী থাকবে।

সালাফী উলামাগণ সদা-সর্বদা সতর্ক করেন, বিনা ইলমে দাওয়াত দিয়ো না। বিনা ইমে ফতোয়া দিয়ো না। আঙ্গুর হয়ে পাকার আগে কাঁচা থাকা অবস্থায় কিশমিশ হয়ো না। অল্প কিছু পড়াশোনা করে জায়েয-না জায়েয ও হারাম-হালাল বলায়, হাদীসকে সহীহ-যয়ীফ নির্ধারণ করায় দুঃসাহসিকতার সাথে নিজেকে লোকমাঝে প্রকাশ করায় গ্রহণযোগ্যতা নেই, উম্মাহর কোন কল্যাণ নেই, বরং ফিতনা আছে, বিভ্রান্তি আছে। সলফদের অন্যতম বড় আলেম তাবেঈ আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'আমি এই মসজিদে নববীতে) ৭০ জন সাহাবাকে পেয়েছি, তাদের কাউকে কোন মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে অথবা কোন ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কামনা করতেন। যে, তা উপস্থিত অন্য কোন আলেম সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করা হোক।

এর কারণ হল, তারা ভয় করতেন যে, তারা ভুলে পতিত হবেন, আর তার ফলে অন্যকে ভুলে পতিত করবেন। তাই তাঁদের প্রত্যেকেই এই দায়িত্ব অন্যের দিকে ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা তার বিপরীত। (আল্লামা আলবানীর দর্স হতে, মাকতাবা শামেলা) এখন তো যোগ্যতা না থাকলেও নতুন কোন ফতোয়া দিতে পারলেই এবং কোন বড় আলেমের ভুল ধরতে পারলেই কিস্তিমাত! যা সালাফী মানহাজের বিপরীত। অবশ্য সঠিকভাবে উলামাদের ফতোয়া নকল। করাতে কোন দোষ নেই।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, যারা সরাসরি কুরআন ও হাদীস পড়ে মাসআলা গ্রহণ করেন, তারা ভুল করতে পারেন। যেহেতু অনেক সময় কেবল একটি আয়াত বা একটি হাদীস পড়েই বিধান গ্রহণ করলে বিপদ হতে পারে। যেমন কেবল কুরআনের অনুবাদ পড়ে এবং তার তফসীর না পড়ে বিধান নিলে সমস্যা হতে পারে।

প্রত্যেক মুসলিমই চায় মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহর উপর আমল করতে। কিন্তু আমলের সময় চোখ বন্ধ করে আমল বাঞ্ছনীয় নয়। হাদীসে আছে বা আল্লাহর নবী বলেছেন পড়ে বা শুনেই আমল করতে লেগে যাওয়া মুসলিমের উচিত নয়। যেমন উচিত নয়, কোন হাদীস শুনে তা অবিশ্বাস করা, তা দলীল স্বরূপ পেশ করা, প্রচার বা শেয়ার করা, নিজ গ্রন্থ বা বক্তৃতায় স্থান দেওয়া। বলা বাহুল্য কোন হাদীসের উপর আমল করার সময় উচিত হলঃ

১। এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে, হাদীস হল দুটি অহীর অন্যতম।

২। হাদীসের বক্তব্যকে নির্ভুল ও নিষ্কলুষ বলে নিঃসন্দেহে মেনে নেওয়া। যেহেতু হাদীস যার তিনি হলেন নির্ভুল ও নিষ্পাপ মানুষ।

৩। সেটা সত্যপক্ষে তার হাদীস কি না, তা অনুসন্ধান করা ওয়াজেব। তা সহীহ কি না, তা জানা জরুরী।

৪। সহীহ প্রমাণিত হলে তা সর্বান্তঃকরণে মেনে নেওয়া ওয়াজেব; যদিও তা নিজ জ্ঞান ও বিবেক বহির্ভূত মনে হয় এবং তার পিছনে যুক্তি ও হিকমত না বুঝা যায়।

৫। যয়ীফ (দুর্বল), বা মওযু’ (জাল) প্রমাণিত হলে তা বর্জন করা।

৬। হাদীসের সঠিক অর্থ বুঝা। আপাতদৃষ্টিতে দুটি হাদীস পরস্পরবিরোধী মনে হলে তা সমন্বয় ও সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টা করা।

৭। হাদীসের নাসেখ-মনসূখ (রহিত-অরহিত) নির্দেশ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা।

৮। হাদীসের বক্তব্য রাসুলল্লাহ -এর জন্য খাস কি না, তা জানা।

উক্ত সকল নির্দেশ পালন না করলে হাদীসের উপর আমল ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। পক্ষান্তরে প্রামাণ্য হাদীসের সঠিক বক্তব্যের প্রতি বিশ্বাস ও আমল না করলেও পরিণাম অবশ্যই মন্দ হবে। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে এ সব কথার উল্লেখ থাকে। উল্লেখ না থাকলে সত্যানুসন্ধানী মুহাদ্দিস আলেমের নিকট সে হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে আমল করতে হবে। আর এ কাজ সচেতন মুসলিমের জন্য মোটেই কঠিন নয়।

সালাফী বা আহলে হাদীস পরিচয় দেওয়া কি শরীয়ত-বিরোধী?

না, যখন ময়দানে রয়েছে শিয়া, খারেজী, মু'তাযেলী, জাহমী, আশআরী, মাতুরীদী, দেওবান্দী, বেরেলী, সূফী, ইখওয়ানী, জামাতে ইসলামী, তবলীগী প্রভৃতি নানা ফিরকা, আর তারা সকলেই দাবিতে মুসলিম, তখন সঠিক মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিমের একটা পৃথক পরিচয় হওয়া দরকার, যাতে তাকে সকলের মাঝে চেনা সহজ হয়।

অনেকে বলেন, পরিচয়ে বলা উচিত, 'আমি সাহাবাদের বুঝে কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী।

জী! কিন্তু পরিচয়টা কি লম্বা হয়ে যায় না? উক্ত কথাটিকে যদি একটি শব্দে বলতে চাই, তাহলে কী বলা বলা যাবে? এক কথায় সালাফী বললে কি দীর্ঘ কথাটি সংক্ষিপ্ত হয় না?

বলবেন, তাতে মুসলিম উম্মাহর মাঝে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

বলব, না, মুসলিম উম্মাহর মাঝে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা তো সৃষ্টি হয়েই আছে। বলবেন, আপনাদের সে নামকরণের দলীল কী? বলব, দলীল অনেক দেখেছেন। অনেক পড়েছেন। আর এ নাম নিলে কেউ মুসলিম নাম থেকে বের হয়ে যায় না। যেমন এ ছাড়া। অন্য নাম নিলেও মুসলিম ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় না।

কেউ যদি নিজেকে ‘মিসরী’ বলে, সে কি আল্লাহর দেওয়া নাম ‘মুসলিম’ থেকে বের হয়ে যায়?

কেউ যদি নিজেকে মুহাজির’ বলে, সে কি আল্লাহর দেওয়া নাম ‘মুসলিম’ থেকে বের হয়ে যায়?

কেউ যদি নিজেকে ‘আনসারী’ বলে, সে কি আল্লাহর দেওয়া নাম ‘মসলিম’ থেকে বের হয়ে যায়?

কেউ যদি নিজেকে ‘আহলে কুরআন’ বলে, সে কি আল্লাহর দেওয়া নাম মুসলিম থেকে বের হয়ে যায়?

তাহলে কেউ যদি নিজেকে সালাফী’ বা ‘আহলে হাদীস বলে, সে আল্লাহর দেওয়া নাম ‘মুসলিম’ থেকে বের হয়ে যাবে কেন? আমি একজন ভারতীয়। এ পরিচয় ভারতের বাইরে দিতে হয়। ভারতের ভিতরে অন্য রাজ্যে ‘বাঙ্গালী’ বলে পরিচয় দিই। তাতে কি আমি ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বের হয়ে যাব?

রাজ্যের ভিতরে অন্য জেলায় বর্ধমানী’ বলে পরিচয় দিই। তাতে কি আমি ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বের হয়ে যাব? জেলার ভিতরে অন্য শহর বা গ্রামে থানার বা গ্রামের নামের সাথে সম্পর্ক জুড়ে পরিচয় দিই। তাতে কি আমি ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বের হয়ে যাব?

অনুরূপই আমি মুসলিম। কিন্তু মুসলিমরা যখন শীআহ (শিয়া) হয়ে গেল, তখন আমি আহলে সুন্নাহ। তখনও আমি মুসলিম থাকলাম। বরং আসল মুসলিম থাকলাম।

মুসলিমরা যখন খারেজী (খাওয়ারিজ) হয়ে গেল এবং আরো অনেক খেয়ালখুশির পূজারী ও বিদআতী দলে বিভক্ত হল, তখন আমি আহলে সুন্নাহ ওয়াল-জামাআহ। তার মানে আমি খেয়াল-খুশির পূজারী বা বিদআতী নই, আহলে সুন্নাহ। এবং খারেজী নই, আহলে জামাআহ, তখনও আমি মুসলিম থাকলাম বরং আসল মুসলিম থাকলাম।

আবার আহলে সুন্নাহ ওয়াল-জামাআহ যখন সহীহ হাদীস ও আষারের ফায়সালা ব্যতিরেকে রায় ও ফিকহের ফায়সালা গ্রহণ শুরু করল, তখন আমি আহলে হাদীস বা আহলে আষার হলাম। তখনও আমি মুসলিম থাকলাম। বরং আসল মুসলিম থাকলাম। অনেকে বলেন, 'তোমরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস কেন বল? আমরা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে ‘মুহাম্মাদী’ বা মহামেডান’ বলি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে নিজেদেরকে পৃথক করার জন্য। কিন্তু মহামেডানদের মধ্যে অনেক বিদআতীও আছে। তাই বিদআতী সম্প্রদায় থেকে নিজেদেরকে পৃথক করার জন্য বলে থাকি, ‘আহলে সুন্নাহ।

আর মহানবী (সা.)-এর ‘সুন্নাহ’ জানা যায় তাঁর হাদীস থেকে, তার সুন্নাহ গ্রহণ করে সহীহ হাদীস থেকে। তাই আহলে হাদীস নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস বলে।

আহলে হাদীস রায় ও কিয়াসের উপর সহীহ হাদীস’কে প্রাধান্য দেয়, তাই আহলে হাদীস নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে।

কোন ব্যক্তি বিশেষের অন্ধানুকরণ না করে তার কথার উপর সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দেয়, তাই আহলে হাদীস নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে।

হাদীসের কোন কথা আপাতদৃষ্টিতে জ্ঞানের বাইরে মনে হলেও জ্ঞানের উপর সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দেয়, তাই আহলে হাদীস নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে।

মতবিরোধপূর্ণ ফিক্বহী মাসায়েলে ফুকাহাদের মতামতের উপরে মুহাদ্দিসীনদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, তাই আহলে হাদীস নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে।

অনেকে বলে থাকেন, হাদীসে নবী (সা.)-এর সুন্নত অবলম্বন করতে বলা হয়েছে, হাদীস নয়। অতএব ‘আহলে সুন্নত না বলে আহলে হাদীস’ বলা সঠিক নয়।

আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন, “তোমরা আমার সুন্নতকে মজবুত করে ধর।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)

“যে আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” (বুখারী-মুসলিম)

“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নত।” (হাকেম, সহীহ তারগীব ৩৬নং)

মহানবী (সা.)-এর বাণীকে হাদীস বলা হয়।

এ বাণী আবার দুই প্রকারঃ যে বাণী আল্লাহর অহী-ভিত্তিক, তার উপর আমল করা ওয়াজেব। আর যা অহী-ভিত্তিক নয় (সাংসারিক), তা মান্য করা জরুরী নয়।

তার কর্ম ও মৌন-সম্মতিকেও হাদীস বলা হয়। কিছু কিছু হাদীস আছে, যা উম্মতের জন্য পালন করা বৈধ নয়। সে আমলের হাদীস কেবল মহানবী ঐs-ই করে গেছেন। যেমন একই সাথে নয়টি স্ত্রী রাখার হাদীস। তা কোন উম্মতী করতে পারে না, তা হাদীসে থাকলেও উম্মতীর জন্য পালনীয় সুন্নত নয়। এই জন্য ‘হাদীস’ কথাটি আম। আর ‘সুন্নাহ’ কথাটি খাস। আর সুন্নাহর বিশেষ অর্থ হল তরীকা বা আদর্শ। তাই হাদীসে বলা হয়েছে, 'তোমরা আমার সুন্নাহ, সুন্নত, তরীকা বা আদর্শকে শক্তভাবে ধারণ কর।” “হাদীসকে ধারণ কর’ বলা হয়নি। যেহেতু তা বলা হলে সকল হাদীসের উপর আমল করা ওয়াজেব হয়ে যেত। আর তা সম্ভব ছিল না।

পক্ষান্তরে তার সুন্নত ও আদর্শ জানার মাধ্যম হল হাদীস। আর হাদীসই বলতে পারে, তার কোন বাণী ও কর্ম আমাদের জন্য সুন্নত বা আদর্শ। হাদীসই হল কুরআনের ব্যাখ্যা। তাই আহলে হাদীস’ বলা ভুল নয়। কোন সমস্যার সমাধানের সময় মযহাবী উলামাগণ নিজ নিজ ফিকাহ-গ্রন্থ থেকে সমাধান খোজেন, কিন্তু আহলে হাদীস উলামাগণ। সহীহ হাদীস থেকে তার সমাধান খোঁজেন। তাই আহলে ফিক্বহের মোকাবেলায় আহলে হাদীস’ নাম ভুল নয়। মযহাবীগণ নিজেদের ফিকহের মযহাব ও সমাধানকে বহাল রাখতে তার দলীল পেশ করেন হাদীস থেকে। সেটা যয়ীফ বা জাল হলেও মযহাব ও সমাধান পরিবর্তন করতে পারেন না। কিন্তু আহলে হাদীস কোন হাদীস যয়ীফ বা জাল হলে সমাধান পরিবর্তন করে এবং কেবল সহীহ হাদীসের উপর আমল করে। সকল আয়েম্মার নীতি ছিল অনুরূপ। তাই আহলে মযহাবের মোকাবেলায় আহলে হাদীস’ নাম। ভুল নয়। আহলে হাদীস মানে তারা কুরআন মানে না, তা নয়। কারণ হাদীসেই কুরআন মানতে বলা হয়েছে। আর কুরআনের বাণীও এক অর্থে হাদীস। সুতরাং যে হাদীস মানবে, সে কুরআন অবশ্যই মানবে। কুরআন ও সহীহ হাদীস মানতে গিয়ে আহলে হাদীস’ বলে পরিচয় দেওয়া ভুল নয়।

আহলে হাদীস এ কথা জানে যে, ফিক্বহের অধিকাংশ মাসায়েলে দলীল আছে। কিন্তু সে দলীল যয়ীফ হলে এবং তার মোকাবেলায় সহীহ হাদীস থাকলে, আহলে হাদীস সহীহ হাদীস গ্রহণ করে। দলীলে কোন সাহাবার উক্তি বা আমল থাকলে এবং তার মোকাবেলায় রসূল। ই-এর সরাসরি কোন উক্তি বা কর্ম থাকলে, আহলে হাদীস সাহাবার আষারের মোকাবেলায় রসূল ৫-এর হাদীসকে প্রাধান্য দেয়। এই হিসাবেও ‘আহলে হাদীস’ নাম ভুল নয়।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, 'আমি তো আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) তার অপেক্ষা কথায় উত্তম আর কোন ব্যক্তি? (হা-মীম সাজদাহঃ ৩৩)।

إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ رَبَّ هَٰذِهِ الْبَلْدَةِ الَّذِي حَرَّمَهَا وَلَهُ كُلُّ شَيْءٍ ۖ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ

অর্থাৎ, আমি তো এ নগরীর প্রতিপালকের উপাসনা করতে আদিষ্ট হয়েছি, যিনি একে সম্মানিত করেছেন। সমস্ত কিছু তারই। আমি আরও আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)দের একজন হই। (নামলঃ ৯১)।

وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ ۚ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ ۚ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ ۚ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِن قَبْلُ وَفِي هَٰذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ ۚ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ ۖ فَنِعْمَ الْمَوْلَىٰ وَنِعْمَ النَّصِيرُ

অর্থাৎ, সংগ্রাম কর আল্লাহর পথে যেভাবে সংগ্রাম করা উচিত; তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠিনতা আরোপ করেননি; এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ); তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম এবং এই গ্রন্থেও; যাতে রসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ হয় এবং তোমরা সাক্ষী স্বরূপ হও মানব জাতির জন্য। সুতরাং তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে অবলম্বন কর; তিনিই তোমাদের অভিভাবক, কত উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী তিনি! (হাজ্জঃ ৭৮)

মহানবী (সা.) বলেছেন,

وأنا آمركم بخمس الله أمرني بهن بالجماعة والسمع والطاعة والهجرة والجهاد في سبيل الله فإنه من خرج من الجماعة قيد شبر فقد خلع ربقة الاسلام من عنقه الا ان يرجع ومن ومن دعا يدعوی الجاهلية فهو من جثاء جهنم

-(-২ “আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের আদেশ করছি, যা আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন। রাষ্ট্রনেতার কথা শুনবে, তার আনুগত্য করবে, জিহাদ করবে, হিজরত করবে এবং একই রাষ্ট্রনেতার নেতৃত্বে) জামাআতবদ্ধভাবে বসবাস করবে। যেহেতু যে ব্যক্তি বিঘত পরিমাণ জামাআত থেকে দুরে সরে যায়, সে আসলে ফিরে না আসা পর্যন্ত ইসলামের রশিকে নিজ গলা থেকে খুলে ফেলে দেয়। আর যে ব্যক্তি জাহেলী যুগের ডাক ডাকে, সে আসলে জাহান্নামীদের দলভুক্ত।”

এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! যদিও সে নামায পড়ে ও রোযা রাখে? তিনি বললেন,

وإن صام وإن صلى وزعم أنه مسلم فادعوا المسلمين بأسمائهم بما سماهم الله عز وجل المسلمين الممؤمنين عباد الله عز وجل

“যদিও সে নামায পড়ে ও রোযা রাখে। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা আল্লাহর (নামে) ডাকে ডাকো, যিনি তোমাদের নাম দিয়েছেন মুসলিম, মু’মিন।” (আহমাদ ১৭ ১৭০, তিরমিযী ২৮৬৩, ত্বাবারানী ৩৩৫০, আবু য়্যা’লা ১৫৭১, ইবনে হিব্বান ৬২৩৩নং) কিন্তু তিনি এ কথাও বলেছেন,

من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا فعليكم بسنی وستة الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ وإياكم ومحدثات الأمور فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة

---তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ (পথ ও আদর্শ) এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ অবলম্বন করো। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, দাতে কামড়ে ধরো। আর দ্বীনে। নবরচিত কর্ম থেকে সাবধান থেকো। কারণ প্রত্যেক নবরচিত (দ্বীনী) কর্মই হল 'বিদআত'। আর প্রত্যেক বিদআতই হল ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ ১৭ ১৪৪, আবু দাউদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৮ ১৫ নং, ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১৬৫নং)

افترقت اليهود على إحدى وسبعين فرقة وافترقت النصارى على اثنتين وسبعين فرقة وستفترق أمتي على ثلاث وسبعين فرقة كلها في النار إلا واحدة قالوا من هي يا رسول الله؟ قال الجماعة وفى رواية ما أنا عليه واصحابى

“ইয়াহুদী একাত্তর দলে এবং খ্রিষ্টান বাহাত্তর দলে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। আর এই উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার মধ্যে একটি ছাড়া বাকী সব ক’টি জাহান্নামে যাবে।” অতঃপর ঐ একটি দল প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, “তারা হল জামাআত।” অন্য এক বর্ণনায় আছে, “আমি ও আমার সাহাবা যে মতাদর্শের উপর আছি তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (সুনান আরবাআহ মিশকাত ১৭১১৭২, সিলসিলাহ সহীহাহ ২০৩, ১৪৯২নং)

تفترق أمتي على بضع وسبعين فرقة أعظمها فتنة على أمتي قوم يقيسون الأمور برأيهم فيحلون الحرام ويحرمون الحلال

“আমার উম্মত সত্তরাধিক (তিয়াত্তর) ফিকায় বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা (ও ক্ষতির কারণ হবে একটি এমন সম্প্রদায়, যারা নিজ রায় দ্বারা সকল ব্যাপারকে ‘কিয়াস’ (অনুমান) করবে; আর এর ফলে তারা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করবে।” (আল-ইবানাহ ইবনে বাত্ত্বাহ ১/৩৭৪ হাকেম ৪/৪৩০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১১৭৯)

আর সে ভবিষ্যদ্বাণী সত্যরূপে প্রকাশও পেয়েছে। পরবর্তী যুগে ‘মুসলিম নাম নিয়ে জাতির মধ্যে অনেক অমুসলিম’ বা ‘নামধারী মুসলিম’-দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কেবল মুসলিম’ বললে নকল ও ভেজালমার্কা মুসলিমদের মধ্য থেকে প্রকৃত মুসলিমকে পার্থক্য করা যেত না। পরবর্তীতে ফির্কাবন্দির জালে ইসলাম বন্দী হয়ে পড়লে মূল। ইসলামের অনুসারীদেরকে (শিয়া প্রভৃতি) আহলে বিদআর মোকাবেলায় আহলে সুন্নাহ’ নাম নিতে হয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী খাওয়ারিজদের মোকাবেলায় আহলে সুন্নাহ অল-জামাআহ’ বলে পরিচয় দিতে হয়েছে। তেমনি পরবর্তীতে হাদীসের উপর ব্যক্তির আক্কেল, রায়, কিয়াস, যুক্তি, জাল ও যয়ীফ হাদীস প্রাধান্য পাওয়ার যুগে সহীহ হাদীসের উপর আমলকারীদেরকে ‘আহলে হাদীস’ নাম নিতে হয়েছে।

অবশ্যই সালাফী বা আহলে হাদীস মানে প্রকৃত সালাফী ও আহলে হাদীস। যার আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র, ব্যবহার ইত্যাদি জীবনের সকল ক্ষেত্রে সালাফী বা আহলে হাদীস। সকল ক্ষেত্রে সে কুরআন ও হাদীসকে সলফে সালেহীনের বুঝ অনুসারে বুঝে তাদের মতো সাধ্যমতো আমল করে।

সালাফী বা আহলে হাদীসদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও ভুল ধারণা এবং তার নিরসন

১। সালাফীরা শাফেয়ী বা শাফেয়ীদের মতো।

আসলে অনেক মাসআলায় শাফেয়ীদের সাথে সালাফীদের মিল দেখে কোন কোন অর্বাচীন এমন কথা বলে থাকে।

২। সালাফীরা মযহাব মানে না। ইমাম মানে না।

হ্যাঁ, সালাফীরা বানাওয়াট মযহাব মানে না। কারণ প্রসিদ্ধ মযহাবের চার ইমাম কখনোই বলে যাননি যে, তোমরা আমাদের অন্ধানুকরণ কর। বরং তারা বলে গেছেন, কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করতে। আর কুরআন-হাদীসে মযহাব মানার কথা বলা হয়নি।

সালাফীরাই সকল ইমামকে মান্য করে থাকেন। যেহেতু সকল ইমাম সালাফীই ছিলেন। তাঁদের কোন নির্দিষ্ট মযহাব ছিল না। পরন্তু সবাই বলে গেছেন, হাদীস সহীহ হলে, সেটাই আমার মযহাব। সুতরাং তাদের এই নির্দেশ মান্য করে সালাফীরাই ১০০% হানাফী, ১০০% মালেকী, ১০০% শাফেয়ী এবং ১০০% হাম্বলী।

৩। সালাফীরা দরূদ পড়ে না।

হ্যাঁ, তারা কোন নকল দরূদ পড়ে না এবং কোন বানাওয়াটি পদ্ধতিতে দরূদ পড়ে না। যেহেতু তা বিদআত।

৪। সালাফীরা আওলিয়াদের সম্মান করে না।

এটা ভুল ধারণা। অবশ্য তারা তাদেরকে সিজদা করে না, প্রণাম করে না এবং মরণের পর তাদের কবরের উপর মাযার তৈরি করে না। যেহেতু এ সকল কর্ম সম্মানে বাড়াবাড়ি ও শরীয়ত-বিরোধী।

৫। সালাফীরা আহলে বায়তের সম্মান করে না, তাদেরকে ভালোবাসে না।

এটাও পূর্বানুরূপ ভুল ধারণা। তবে তারা তাদের জন্ম-মৃত্যদিন। পালন করে না। মাতম করে না, তাজিয়া করে না---এ কথা ঠিক। কারণ তা শরীয়ত-পরিপন্থী।

৬। আহলে হাদীস আয়েম্মা ও ফুক্বাহা (রাহিমাহুমুল্লাহ)দেরকে গালাগালি দেয়।

সত্যপক্ষে আহলে হাদীস যারা, তারা কোন দিনই তাদেরকে গালি দিতে পারে না। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক দলেই এক শ্রেণীর গোড়া মানুষ থাকে, তারাই পরস্পরকে গালাগালি করে। তাছাড়া আহলে হাদীসের আক্বীদা হল, সকল ইমামই আহলে সুন্নাহ বা হাদীস ছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুসরণকে তাঁরা ওয়াজেব জানতেন এবং সবাই এতে একমত ছিলেন। তারা এ কথাও জানতেন যে, রসূলের কথা ছাড়া বাকী অন্য কোন সাহাবী, তাবেয়ী ইমাম বা আলেমের কথা মান্যও হতে পারে এবং অমান্যও। কিন্তু তাঁরা মাসুম ছিলেন না, মুজতাহিদ ছিলেন। তাদের কোন ফায়সালা ভুল হলে একটি এবং ঠিক হলে দু’টি নেকীর তারা হকদার হন। সুতরাং যারা নেকীর হকদার, তাদেরকে গালি দেওয়ার কোন প্রসঙ্গই আসে না।

তাছাড়া মহানবী কি বলেছেন, “মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী (আল্লাহর অবাধ্যাচরণ) এবং তার সাথে লড়াই ঝগড়া করা কুফরী।” (বুখারী ৪৮, মুসলিম ২৩০নং)

৭। আহলে হাদীসদের অনেক মাসায়েল কুরআন-হাদীস বিরোধী।

আসলে আহলে হাদীসদের মাসায়েল কুরআন-হাদীস বিরোধী নয়, বরং মযহাবীদের মযহাব বিরোধী অথবা যয়ীফ বা জাল হাদীসবিরোধী। অথবা পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের অপ্রাধান্যপ্রাপ্ত হাদীস বিরোধী। যারা সহীহ হাদীস মেনে চলার শতভাগ চেষ্টা করে, তারা কি কুরআন-হাদীসের বিরোধী সমাধান দিতে পারে?

৮। আহলে হাদীস বুখারীর মুক্বাল্লিদ, আলবানীর মুকাল্লিদ.... ।

আসলে তাকলীদের মৌলিক অর্থ এবং অন্ধ অনুকরণ ও ইত্তিবা বা অনুসরণের অর্থ না বুঝে অনেকে এই শ্রেণীর মন্তব্য করে থাকে। বলা। বাহুল্য, গায়র মুকাল্লিদ নির্দিষ্ট কারো মুকাল্লিদ নয়। গায়র মক্কাল্লিদ কুরআন-হাদীস বুঝতে ও মানতে নির্দিষ্ট কারো তাকলীদ করে না। বরং আহলে হাদীস সে ব্যাপারে সাহাবা, তাবেঈন, আয়িম্মা ও ফুক্বাহার অনুসরণ করে। অতঃপর যেটি সহীহ দলীলের অধিক নিকটবর্তী পায়, তার অনুসরণ করে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَن يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ * الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, যারা তাগুতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অনুরাগী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার দাসদেরকে---যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা উত্তম তার অনুসরণ করে। ওই তারা, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং ওরাই বুদ্ধিমান। (যুমারঃ ১৭-১৮)

আহলে হাদীস যে ইমাম বুখারীর মুক্বাল্লিদ নয়, সে কথা স্বীকার করে খোদ মযহাবীরাই উদাহরণ দিয়ে থাকেন।

অনেকে এ কথাও উল্লেখ করে থাকেন যে, আহলে হাদীস আল্লামা আলবানীর অন্ধানুকরণ করে না। যেহেতু বহু মাসায়েলে তারা তার ফতোয়ার বিপরীত মত অনুসরণ করে থাকে।

৯। 'আসহাবুল হাদীস’ মানে কেবল মুহাদ্দিসীনকে বুঝানো হয়। তথাকথিত আহলে হাদীসকে নয়।

অর্থাৎ, যাদের কাছে হাদীসের ইলম আছে কেবল তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত দল, কেবল তারাই ফিকাহ নাজিয়াহ। আশা করি, জ্ঞানিগণ মানবেন যে, যারা তাদের অনুসরণ করে সহীহ হাদীস ভিত্তিক আমল করে, তারাও তাদেরই দলভুক্ত। আম জনসাধারণ মুহাদ্দিসীন না হলেও তারা তাদের আদর্শ অনুসারে চলে। তাই তারাও ‘আহলে হাদীস’। যেমন আহলে কিতাব (ইয়াহুদী-খ্রিস্টান) বলতে তাদের উলামা ও আম জনসাধারণ উভয় শ্রেণীর মানুষকে বুঝানো হয়।

১০। সালাফীরা ইজমা মানে না।

ভুল ধারণা। ইজমা সঠিক হলে অবশ্যই মানে। আর সঠিক ইজমা কুরআন ও সহীহ হাদীস-বিরোধী হয় না। কোন ভুলের উপর উম্মাহর ইজমা হতে পারে না। আর কোন বিষয়ে সঠিক ইজমা ও সর্ববাদিসম্মতি হওয়া বিশাল কঠিন ব্যাপার।

১১। আহলে হাদীস কিয়াস মানে না।

যে সমস্যার সমাধানে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট উক্তি নেই, অনেক অনভিজ্ঞ ব্যক্তি উক্ত কথা বলে, সে সমস্যার কথা উল্লেখ করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে হাদীস পেশ করতে বলে। অথচ অভিজ্ঞ মযহাবীরাও জানেন যে, আহলে হাদীসরাও কিয়াস মানে। তবে সহীহ হাদীসের ওপর কিয়াসকে প্রাধান্য দেয় না। পানি না পাওয়া গেলে ওযুর জায়গায় তায়াম্মুম ব্যবহার করে, কিন্তু পানি সামনে এলে তায়াম্মুম বাতিল মনে করে।

১২। আহলে হাদীস নফসের ইত্তিবা করে!

এটিও একটি গায়ের ঝাল-ঝাড়া অপবাদ। আহলে হাদীস নির্দিষ্ট কোন মযহাবের তাক্বলীদ করে না বলে, তারা সুবিধাবাদী নফসের পূজারী নয়। একই বিষয়ে উলামাগণের বহুমত থাকলে সেই মতকেই তারা গ্রহণ করে, যা সহীহ দলীল ভিত্তিক এবং বলিষ্ঠ। কক্ষনোই সে মত গ্রহণ করে, যা নিজেদের মনঃপুত ও যাতে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা রক্ষা হয়। কার মত গ্রহণ করা হবে, তা নিয়েও তারা নিজেদের বিবেক-বিবেচনাকে কাজে লাগায়। কোন আলেম ইলম ও আমলে বড়, তা নির্বাচন করে সুস্থ। মন-মস্তিষ্কের মাপকাঠিতে। যেহেতু মহানবী (সা.) বলেন,

استفت نفسك وان افتاك المفتون

“তুমি তোমার হৃদয়ের কাছে ফতোয়া নাও, যদিও মুফতীরা তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে।” (আহমাদ ১৮০০৬, দারেমী ২৫৩৩ বুখারীর তারীখ, সহীহুল জামে ৯৪৮, ২৮৮ ১নং)

১৩। আহলে হাদীস উলামাদের মাঝে নানা মতভেদ কেন?

এমন মতভেদ অস্বাভাবিক নয়। একটি মযহাবের ভিতরেও অনেক মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। জেনে রাখা ভালো যে,

১। আহলে হাদীস কোন ব্যক্তি বিশেষের অন্ধানুকরণের জামাআত নয়। কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীস-ভিত্তিক একটি মতাদর্শের নাম, যা ইসলামের মূল স্রোতধারা ও রাজপথ।

২। তার মানে হাদীস সহীহ হলে সেটাই আহলে হাদীসের মযহাব হয়। যেমন সকল মুহাদ্দিসীন ও আয়েম্মায়ে কিরাম (রাহিমাহুমুল্লাহ)গণের মযহাব তাই ছিল। তারা সকলেই আহলে হাদীস ছিলেন।

৩। এতত্সত্ত্বেও মতভেদের কারণ কী? কারণ পরস্পর-বিরোধী বর্ণিত হাদীস।

আহলে হাদীস তাহকীক করে যে হাদীসটি সহীহ পর্যায়ের, কেবল সেই হাদীসটির উপর আমল করে এবং দুর্বল হাদীস বর্জন করে।

পরস্পর-বিরোধী উভয় হাদীস সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে নাসেখ-মনসুখ নির্ণয় করে। তা সম্ভব না হলে উভয় হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন। করে আমল করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মাসআলাই তাদের মযহাব হয়। তারা কোন নির্ধারিত ব্যক্তির অন্ধানুকরণ করে তারই মযহাবকে (সবার চেয়ে সঠিক) প্রমাণ করার মানসে যয়ীফ হাদীসকে সহীহ করার পায়তারা করে না অথবা কোন সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা বা তাবীল করে না।

তাছাড়া কোন হাদীসের সহীহ-যয়ীফ নিয়ে অথবা কুরআনের হাদীসের বক্তব্য বোঝা নিয়ে মতভেদ স্বাভাবিক।

১৪। সালাফীরা রাজনীতি করে না, ইসলামে কি রাজনীতি নেই?

হ্যাঁ, সালাফীরা রাজনীতি করে, আর তাদের রাজনীতি হল রাজনীতি না করা। আর ইসলামে আছে ইসলামী রাজনীতি, পাশ্চাত্যের রাজনীতি নয়।

১৫। আহলে হাদীস বুখারী ছাড়া অন্য হাদীস মানে না।

এ মন্তব্যও কোন অর্বাচীন ব্যক্তি বিশেষের। সবচেয়ে বেশি শুদ্ধ ও সহীহ হাদীসগ্রন্থ বুখারী। তা বলে তা আহলে হাদীসের একমাত্র হাদীসগ্রন্থ নয়। বরং অন্য গ্রন্থের হাদীস সহীহ সনদে পেলে তা গ্রহণ করে এবং বুখারীতে তার বিপরীত থাকলে পরস্পর-বিরোধী হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন করে আমল করে।

হাদীসটির সনদ সহীহ, নাকি যয়ীফ---তা নিয়ে মতভেদ থাকার ফলে যেমন ইসলামে বিভিন্ন মযহাব সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আহলে। হাদীস উলামাগণের মাঝেও একই মাসআলায় ভিন্ন ভিন্ন মত বর্তমান। থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেমন একই মযহাবের ভিতরে একাধিক মত বা বিভিন্ন উপ-মহাব সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সুতরাং মতভেদ থাকতে পারে, থাকবে। কিন্তু তা নিয়ে কলহ-দ্বন্দ্ব বা কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি করা মোটেই উচিত নয়।

উদার মানুষ যেটাকে সবচেয়ে সঠিক বলে বিশ্বাস করবে, সেটার অনুসরণ করবে এবং কোন ব্যক্তি বিশেষের অন্ধানুকরণ করবে না। এটাই তো হিদায়াতের পথ। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَن يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ * الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, যারা তাগুতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অনুরাগী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাগণকে---যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা উত্তম তার অনুসরণ করে। ওরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং ওরাই বুদ্ধিমান। (সুরা যুমার ১৭- ১৮ আয়াত)

وصلى الله وسلم وبارك على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، والحمد لله رب العالمين

সমাপ্ত

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৯ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে