তারা আল্লাহ তাআলার যথাযথ বড়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি - ১

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ্‌র যথাযথ কদর করেনি। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা যুমারঃ ৬৭)

ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতের অর্থে একাধিক হাদীছ ও আছার বর্ণিত হয়েছে। হাফেয ইমামুদ্দীন ইবনে কাছির (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে বলেনঃ মুশরিকরা আল্লাহর যথাযথ কদর করেনি। এ কারণেই তারা আল্লাহর সাথে অন্যের এবাদত করেছে। তিনি এত বড় যে, তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান, সবকিছুর মালিক এবং সবকিছুই তার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধীন।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ তারা আল্লাহর যথাযথ মর্যাদা প্রদান করেনি। মুহাম্মাদ বিন কা’ব (রঃ) বলেনঃ মুশরিকরা যদি আল্লাহর যথাযথ কুদরত উপলব্ধি করতে পারতো, তাহলে তারা কুফরী করতোনা।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াত এবং এ বিষয়ে অন্যান্য আয়াত ও হাদীছের ব্যাপারে সালফে সালেহীনদের মাযহাব এই যে, কোনো প্রকার ধরণ বর্ণনা করা এবং কোন প্রকার পরিবর্তন ছাড়াই এগুলো যেভাবে এসেছে, সেভাবেই জারী (চালু) রাখতে হবে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

«جَاءَ حَبْرٌ مِنَ الأَحْبَارِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلمَ قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللَّهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالأَرَضِينَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلاَئِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ فَضَحِكَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ ثُمَّ قَرَأَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ»

‘‘একজন ইহুদী পন্ডিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­ামের নিকট এসে বললঃ হে মুহাম্মাদ! আমরা তাওরাত কিতাবে দেখতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা আকাশ মন্ডলীকে এক আঙ্গুলে, সমস্ত যমীনকে এক আঙ্গুলে, বৃক্ষরাজিকে এক আঙ্গুলে, পানি ও কাদাকে এক আঙ্গুলে এবং সমস্ত সৃষ্টি জগতকে এক আঙ্গুলে রেখে বলবেন, আমিই বাদশাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ইহুদী পন্ডিতের এ কথা শুনে এবং তা সত্যায়ন করে এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর দন্ত মোবারক দেখা যাচ্ছিল। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেনঃ

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ্‌র মর্যাদা ও ক্ষমতা মুতাবেক কদর করতে পারেনি। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা যুমারঃ ৬৭)[1] সহীহ মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

«وَالْجِبَالَ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ ثُمَّ يَهُزُّهُنَّ فَيَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَنَا اللَّهُ»

‘‘পাহাড়-পর্বত এবং বৃক্ষরাজি এক আঙ্গুলে থাকবে। অতঃপর এগুলোকে ঝাকুনি দিয়ে তিনি বলবেনঃ আমি রাজাধিরাজ, আমিই আল্লাহ’’।[2]

সহীহ বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় আছেঃ

«يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلاَئِقِ عَلَى إِصْبَعٍ»

‘‘আকাশ মন্ডলীকে এক আঙ্গুলে রাখবেন। পানি এবং কাদাকে এক আঙ্গুলে রাখবেন। আরেক আঙ্গুলে রাখবেন সমস্ত সৃষ্টিকে’’।[3]

ব্যাখ্যাঃ ইমাম বুখারী, মুসিলম এবং ইমাম নাসায়ী (রঃ) এভাবেই আমাশ থেকে একাধিক সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (রঃ) আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«يَقْبِضُ اللَّهُ الأَرْضَ وَيَطْوِى السَّمَوَاتِ بِيَمِينِهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ»

‘‘কিয়ামতেন দিন আল্লাহ্ তাআলা যমীনকে স্বীয় মুষ্ঠির মধ্যে রাখবেন। আর ডান হাতে রাখবেন আসমানকে ভাজ করা অবস্থায়। অতঃপর তিনি বলবেনঃ আমিই বাদশাহ। দুনিয়ার বাদশাহরা আজ কোথায়’’? ইমাম বুখারী এই শব্দে একাই বর্ণনা করেছেন।[4]

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুসলিম শরীফে বর্ণিত মারফু হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«يَطْوِى اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ السَّمَوَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُهُنَّ بِيَدِهِ الْيُمْنَى ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ ثُمَّ يَطْوِى الأَرَضِينَ بِشِمَالِهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ»

‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আকাশমন্ডলীকে ভাঁজ করবেন। অতঃপর তা ডান হাতে নিবেন। অতঃপর বলবেনঃ আমিই বাদশাহ। দুনিয়ার প্রতাপশালীরা আজ কোথায়? দুনিয়ার অহংকারীরা আজ কোথায়? অতঃপর সাত যমীনকে ভাঁজ করবেন এবং এগুলোকে বাম হাতে নিবেন। অতঃপর বলবেনঃ আমি হচ্ছি রাজাধিরাজ। দুনিয়ার অত্যাচারীরা আজ কোথায়? দুনিয়ার অংহকারীরা আজ কোথায়?[5]

ব্যাখ্যাঃ সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এভাবেই এসেছে। হুমাইদী বলেনঃ এই বর্ণনাটি অধিক পরিপূর্ণ।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ এ সমস্ত হাদীছ এবং অনুরূপ অর্থে আরো অনেক হাদীছ আল্লাহর বড়ত্ব, সকল দিক থেকে তাঁর পরিপূর্ণতা এবং তাঁর কুদরতের বিশালতার প্রমাণ বহন করে। তাতে জাহমীয়া, আশায়েরা এবং তাদের অনুরূপ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদও রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহর পূর্ণতা, বড়ত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ করে। এ সমস্ত সিফাত আরো প্রমাণ করে যে, এবাদতের কোনো প্রকারই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা জায়েয নয়। না কোন নৈকট্যশীল ফেরেশতার জন্য তা করা জায়েয, না কোনো প্রেরিত নবীর জন্য কিংবা অন্য কারো জন্য।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, রাসূলের পবিত্র সুন্নাত, সাহাবী ও তাবেয়ীদের উক্তি এবং সম্মানিত ইমামদের স্মরণীয় বাণীর মধ্যে অগণিত দলীল রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক সৃষ্টির উপরে, তিনি সমস্ত আসমানের উপরে আরশের উপর সমুন্নত। ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই কথা বলার পর কুরআন ও সুন্নাহ হতে অনেক দলীল পেশ করেছেন।

ইমাম আওযায়ী (রঃ) বলেনঃ আমরা এবং আমাদের যামানায় যেসব তাবেয়ী জীবিত ছিলেন, আমরা সকলেই বলতামঃ আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। সহীহ সুন্নাতে এ ব্যাপারে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলোর উপরই আমরা ঈমান আনয়ন করি।

আবু উমার তালমানকী (রঃ) তাঁর কিতাবুল উসূলে বলেনঃ আহলে সুন্নাত মুসলিমগণের ইজমা সংঘটিত হয়েছে যে আল্লাহ তাআলা স্বীয় সত্তায় আরশের উপরে। ইমাম যাহাবী (রঃ) কিতাবুল উলুতে এটি উল্লেখ করেছেন।

আবু উমার তালমানকী (রঃ) আরো বলেনঃ এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের লোকদের ইজমা হয়েছে যে, প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ তাআলা আরশে সমুন্নত হয়েছেন; রূপক অর্থে নয়।

অতঃপর আবু উমার উক্ত কিতাবে বলেনঃ আহলে সুন্নাতের মুসলিমগণ আল্লাহ তাআলার বাণীঃوَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَمَا كُنْتُمْ ‘‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন, তোমরা যেখানেই থাকো’’-এই আয়াত এবং অনুরূপ অন্যান্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ এখানে আল্লাহর ইল্ম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান।[6] আর আল্লাহ তাআলা স্বীয় সত্তায় আরশের উপরে। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তালমানকী স্বীয় কিতাবে এই শব্দগুলোই উল্লেখ করেছেন।

ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে, সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এই কথাকে অস্বীকার করেছে বলে জানা যাচ্ছে সে হচ্ছে জা’দ বিন দিরহাম। এভাবেই সে আল্লাহর সকল সিফাতকেই অস্বীকার করেছে। এ কারণেই ইরাকের তৎকালীন আমীর খালেদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কুসারী তাকে হত্যা করেন। তার হত্যা কান্ডের ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ।[7] জা’দ বিন দিরহাম থেকে এই মতবাদ গ্রহণ করে জাহমীয়াদের ইমাম জাহ্ম বিন সাফওয়ান। সে এই মতবাদের প্রচার শুরু করে এবং বিভিন্ন সংশয়পূর্ণ কথা দ্বারা দলীল দিতে থাকে। এটি ছিল তাবেয়ীদের যুগের শেষের দিকের ঘটনা। সেই সময়ের ইমামগণ এই মতবাদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম আওয়াঈ, ইমাম আবু হানীফা, লাইছ বিন সা’দ, সুফিয়ান ছাওরী, হাম্মাদ বিন যায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামা, ইবনুল মুবারক এবং তাদের পরে আগমণকারী হেদায়াতের অন্যান্য ইমামগণ। যেমন ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল এবং আহলে সুন্নাতের বিরাট একটি জামাআত।

ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর অনেক নাম ও সিফাত রয়েছে। কারো জন্য সেগুলো অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা জায়েয নয়। দলীল-প্রমাণ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি এর বিরোধীতা করবে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে তার কাছে দলীল না পৌঁছে থাকলে এবং দলীল-প্রমাণ নাজানার কারণে তার অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। ইমাম শাফেঈ (রঃ) আরো বলেনঃ আল্লাহ তাআলার এই সিফাতগুলো আমরা সাব্যস্ত করি এবং আল্লাহ্ তাআলার পবিত্র সত্তা হতে তাশবীহ দূর করি অর্থাৎ তাঁর সিফাতগুলোকে মানুষের সিফাতের সাথে তুলনা করিনা কিংবা এ কথা বলিনা যে, তাঁর সিফাতগুলো মানুষের সিফাতের মতই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ

‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরাঃ ১১) ফতহুলবারী থেকে উপরোক্ত কথাগুলো তুলে ধরা হলো।[8]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

«ما السموات السبع والأرضون السبع في كف الرحمن إلا كحبة خردل في كف أحدكم»

‘‘সাত আসমান ও সাত যমীন আল্লাহ তাআলার হাতের তালুতে তোমাদের কারো হাতে একটা সরিষার দানার মত।[9]

[1] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১১।

[2] - সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২৭৮২।

[3] - বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১১।

[4] - সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৪৮১২।

[5] - সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২৭৮৮।

[6] - অনেক সাহাবী, তাবেঈ এবং পরবর্তী যুগের অনেক আলেম এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। তবে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাআলা প্রকৃত পক্ষেই আমাদের সাথে এবং প্রকৃতপক্ষেই তিনি আমাদের উপরে। যেসব আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মাখলুকের সাথে তার সকল ক্ষেত্রেই তিনি সাথে থাকার ব্যাখ্যা ইলম ও কুদরত দ্বারা করাকে সমর্থন করেন নি। উপরে থাকা এবং সৃষ্টির সাথে ও নিকটে থাকাকে তিনি পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে করেন নি। তাই তিনি বলেছেন, তিনি প্রকৃতপক্ষেই আমাদের সাথে এবং প্রকৃতপক্ষেই আমাদের উপরে। সাথে থাকা ও নিকটে থাকার অর্থ এই নয় যে, তিনি কোনো সৃষ্টির মধ্যে ঢুকে আছেন কিংবা মিশে আছেন। যেমন ধারণা করে থাকে সুফী তরীকার বিভিন্ন সম্প্রদায়। এমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে মোটেই শোভনীয় নয়। উপরে থাকা ও সাথে থাকা পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কেননা স্রষ্টার সিফাতকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তুলনা করা চলেনা। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যান্য আলেমগণ সাথে থাকাকে ইলম ও কুদরত দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। আর যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের সাথে রয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে সাথে থাকা দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতা, সমর্থন ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে সাথে থাকা উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যাও প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের সাথে থাকা এবং উপরে থাকার পরিপন্থী নয়।

আরেকটি কথা বিশেষভাবে জেনে রাখতে হবে যে, স্বীয় সত্তাসহ আল্লাহ তাআলা আরশে আযীমের উপর রয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহর বহু দলীল, সালাফদের ইজমা এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা এটি সাব্যস্ত। সেই সঙ্গে আরো বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যে, সত্তাসহ সমস্ত মাখলুকের সাথে থাকা তাঁর বড়ত্ব, মর্যাদা ও পবিত্রতার জন্য অশোভনীয়। বিস্তারিত জানার জন্য শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর কিতাব আল-ওয়াসেতীয়া এবং উহার ব্যাখ্যাসমূহ পাঠ করার অনুরোধ রইল।

[7] - জা’দ বিন দিরহাম ছিল তাবেয়ীদের যুগের একজন গোমরাহ এবং বিদআতী। তার আকীদাহ ছিল, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)কে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন নি এবং মুসা (আঃ)এর সাথে কথাও বলেন নি। অর্থাৎ সে আল্লাহ তাআলার কালাম, ভালোবাসা ইত্যাদি সিফাতকে অস্বীকার করেছিল। এমনকি সেই সর্বপ্রথম আরশে আযীমে আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়াকেও অস্বীকার করেছিল এবং প্রকাশ্যে তার ঘোষণাও দিয়েছিল।

সে সময় ইরাকের আমীর ছিলেন খালেদ বিন আব্দুল্লাহ আল কুসারী। তিনি একবার ঈদুল আযহার নামায শেষে খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে লোক সকল তোমরা কুরবানী করো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের কুরবানীকে কবুল করুন। আমি জা’দ বিন দিরহামকে কুরবানী করার মাধ্যমেই আমার কুরবানী শুরু করবো। এই বলে তিনি মিম্বার থেকে নামলেন এবং সকলের সামনেই জা’দ বিন দিরহামকে হত্যা করে ফেললেন।

[8] - দেখুনঃ ফতহুলবারী, (১৩/৪০৭)

[9] - সহীহ হাদীছে يد الله (আল্লাহর হাত), كف الله (আল্লাহর হাতের তালু), كف الرحمن (রাহমানের হাতের তালু) এবং আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ই বর্ণিত হয়েছে। এ জাতিয় বিষয়ে ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ অনেক আলেম আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত হাদীছগুলো এবং দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তাআলার নেমে আসা সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সুসাব্যস্তও সুপ্রমাণিত বলেছেন। আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, কোন প্রকার ধারণা করা যাবেনা এবং এ কথা বলা যাবেনা যে, كيف؟ (তা কেমন?)। ইমাম মালেক, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রঃ) থেকে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীছগুলোর ব্যাপারে কথা হচ্ছে أمروها بلا كيف অর্থাৎ যেভাবে এসেছে, সেভাবেই ছেড়ে দাও। এ কথা বলোনা যে, কেমন-কিভাবে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের কথাও তাই।

কিন্তু জাহমীয়ারা এই বর্ণনাগুলোকে অস্বীকার করেছে। তাদের কথা হচ্ছে এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ (তুলনা) হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় আল্লাহর হাত, চোখ, শ্রবণ, দৃষ্টি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। জাহমীয়ারা এই আয়াতগুলোর তাবীল (ব্যাখ্যা) করেছে। আলেমগণ এগুলোর যেই ব্যাখ্যা করেছেন, তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে। তাদের কথা আল্লাহ তাআলা আদমকে স্বীয় হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তাদের কথা হচ্ছে হাত অর্থ কুদরত (শক্তি)!! ইসহাক বিন ইবরাহীম বলেনঃ তাশবীহ (তুলনা) তখনই হবে, যখন বলা হবে আল্লাহর হাত মাখলুকের হাতের মতই, আল্লাহর হাত বান্দার হাতের মতই। এমনি আল্লাহর শ্রবণ, আল্লাহর দৃষ্টি বান্দার দৃষ্টির মতই। এটি তাশবীহ।

আর আল্লাহ যেমন বলেছেন যখন সেভাবেই বলা হবে অর্থাৎ হাত, শ্রবণ, দৃষ্টি এবং এই প্রশ্ন করা হবেনা যে, তা কিভাবে? অথবা এটি বলা হবেনা যে, আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মতই এবং শ্রবণ শ্রবণের মতই, তখন কোন তাশবীহ হবেনা। তখন তেমনই হবে যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ

‘‘কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরাঃ ১১) {দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, (৬/২০) ঈষৎ পরিবর্তিত)}
তারা আল্লাহ তাআলার যথাযথ বড়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি - ২

ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেন, আমার কাছে বর্ণনা করেছেন ইউনুস। ইউনুস বলেনঃ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন ইবনে ওয়াহাব। ওয়াহাব বলেনঃ ইবনে যায়েদ তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনে যায়েদ বলেনঃ ‘‘আমার পিতা আমাকে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেছেনঃ

«ما السموات السبع فى الكرسى إلا كدراهم سبعة القيت فى ترس»

‘‘কুরসীর মধ্যে সাত আসমানের অবস্থান ঠিক তেমনি যেমন একটি ঢালের মধ্যে নিক্ষিপ্ত সাতটি দিরহামের অবস্থান’’। তিনি আরো বলেনঃ ‘আবু যার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামকে এ কথা বলতে শুনেছি,

«ما الكرسى فى العرش إلا كحلقة من حديد القيت بين ظهرى فلاة من الأرض»

‘‘আরশের মধ্যে কুরসীর অবস্থান ঠিক সে রকমই যেমন ভূপৃষ্ঠের কোন উন্মুক্ত ময়দানে পড়ে থাকা একটি আংটি’’।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

«ما بين السماء الدنيا والتي تليها مسيرة خمس مئة عام ومابين كل سماء مسيرة خمس مائة عام وما بين السماء السابعة والكرسي مسيرة خمس مئة عام وما بين الكرسي والماء مسيرة خمس مئة عام والعرش على الماء والله عز و جل على العرش يعلم ما أنتم عليه»

‘‘দুনিয়ার আকাশ এবং এর পরবর্তী আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এমনিভাবে সপ্তমাকাশ এবং কুরসীর মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। কুরসী এবং পানির মাঝখানে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের। আরশ হচ্ছে পানির উপরে। আর আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। তোমাদের আমলের কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়’’।

হাম্মাদ বিন সালামা হতে এই হাদীছ ইবনে মাহদী, ইবনে মাহদী বর্ণনা করেন আসেম হতে, আসেম বর্ণনা করেন যির্ হতে, তিনি বর্ণনা করেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে। অনুরূপ বর্ণনা করেন মাসউদী আসেম হতে, তিনি আবি ওয়ায়েল হতে এবং তিনি আব্দুল্ল­াহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম যাহাবী (রঃ) উপরোক্ত সনদ বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ অনেক সনদে এই বর্ণনা এসেছে।

আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম একবার জিজ্ঞাসা করলেনঃ

«هَلْ تَدْرُونَ كَمْ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ « بَيْنَهُمَا مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَمِنْ كُلِّ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَكِثَفُ كُلِّ سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَبَيْنَ السَّمَاءِ السَّابِعَةِ وَالعَرْشِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ وَاللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ وَلَيْسَ يَخْفَى عَلَيْهِ مِنْ أَعْمَالِ بَنِى آدَمَ شَىْءٌ»

‘‘তোমরা কি জানো, আসমান ও যমীনের মধ্যে দূরত্ব কত?’’ আমরা বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে অধিক জানেন। তিনি বললেন, আসমান ও যমীনের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। প্রতিটি আকাশের ঘনত্বও পাঁচশ বছরের পথ। সপ্তমাকাশ ও আরশের মধ্যখানে রয়েছে একটি সাগর। যার উপরিভাগ ও তলদেশের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান। আল্লাহ তাআলা এর উপরে রয়েছেন। আদম সন্তানের কোন কর্মকান্ডই তাঁর অজানা নয়’’। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[10]

ব্যাখ্যাঃ আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাদীছটি লেখক এখানে সংক্ষিপ্ত করে উল্লেখ করেছেন। আবু দাউদের বর্ণনাটি ঠিক এ রকম, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ

«كُنْتُ فِى الْبَطْحَاءِ فِى عِصَابَةٍ فِيهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَرَّتْ بِهِمْ سَحَابَةٌ فَنَظَرَ إِلَيْهَا فَقَالَ مَا تُسَمُّونَ هَذِهِ قَالُوا السَّحَابَ قَالَ وَالْمُزْنَ قَالُوا وَالْمُزْنَ قَالَ وَالْعَنَانَ قَالُوا وَالْعَنَانَ قَالَ أَبُو دَاوُدَ لَمْ أُتْقِنِ الْعَنَانَ جَيِّدًا قَالَ هَلْ تَدْرُونَ مَا بُعْدُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالُوا لاَ نَدْرِى قَالَ إِنَّ بُعْدَ مَا بَيْنَهُمَا إِمَّا وَاحِدَةٌ أَوِ اثْنَتَانِ أَوْ ثَلاَثٌ وَسَبْعُونَ سَنَةً ثُمَّ السَّمَاءُ فَوْقَهَا كَذَلِكَ حَتَّى عَدَّ سَبْعَ سَمَوَاتٍ ثُمَّ فَوْقَ السَّابِعَةِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ فَوْقَ ذَلِكَ ثَمَانِيَةُ أَوْعَالٍ بَيْنَ أَظْلاَفِهِمْ وَرُكَبِهِمْ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ عَلَى ظُهُورِهِمُ الْعَرْشُ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ»

‘‘আমি একদা একদল সাহাবীর সাথে খোলা ময়দানে বসা ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেখানে ছিলেন। তখন তাদের উপর দিয়ে এক খন্ড মেঘ অতিক্রম করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিকে তাকিয়ে বললেনঃ তোমরা এটিকে কী বলো? তারা বললেনঃ السحاب ‘‘এটি একটি মেঘের খন্ড’’। তিনি তখন বললেনঃ والمزن (আল-মুযন)। সাহাবী বললেনঃ আমরা এটিকে মুয্নও বলি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ والعنان (আল-আনান)। সাহাবীগণ বললেনঃ আমরা আনানও বলি। সবগুলো শব্দের অর্থ মেঘ। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ আমি আনান শব্দটি ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জান আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের দূরত্ব কতটুকু? সাহাবী বললেনঃ আমরা জানিনা। তিনি বললেনঃ উভয়ের মধ্যে রয়েছে হয় একাত্তর বছরের, না হয় বাহাত্তর বছরের না হয় তেহাত্তর বছরের দূরত্ব। এমনি প্রত্যেক আকাশ ও তার পরবর্তী আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্ব হচ্ছে একই রকম। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি আসমান গণনা করলেন। সপ্তম আকাশের উপর রয়েছে একটি সাগর। সাগরের উপর হতে নীচের দূরত্ব (গভীরতা) হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যকার দূরত্বের সমান। সাগরের উপরে রয়েছে আটটি ওয়া-ইল (বিশেষ আকৃতির আট ফেরেশতা। তাদের হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত দূরত্ব এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। তাদের পিঠে রয়েছে আল্লাহর আরশ। আরশ এত বিশাল যে, তার নীচের অংশ হতে উপরের ছাদ পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রয়েছেন আরশের উপরে’’।[11]

হাফেয যাহাবী (রঃ) বলেনঃ ইমাম আবু দাউদ হাসান সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আর তাতে রয়েছে,

«بُعْد مَا بَيْن سَمَاء إلى سَمَاء خَمْسِمِائَةِ عَامٍ»

‘‘এক আসমান হতে অন্য আসমানের মধ্যকার দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশত বছরের পথ’’।

হাফেয যাহাবী (রঃ) বলেনঃ উভয় বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ পাঁচশত বছরের দূরত্ব হবে কাফেলা তথা উটের গতি অনুপাতে এবং তেহাত্তর বছরের দূরত্ব হবে দ্রুতগামী ঘোড়ার চলার গতি অনুপাতে।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ বুখারী ও মুসলিম এবং হাদীছের অন্যান্য কিতাবে এই হাদীছের শাওয়াহেদ (সমর্থনে অন্যান্য হাদীছ) রয়েছে। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যও হাদীছের মর্মার্থকে সমর্থন করে। সুতরাং যারা এই হাদীছকে দুর্বল বলেছেন তাদের কথার কোন মূল্য নেই।[12]

সম্মানিত লেখক (রঃ) এই মহান কিতাবের শুরুতেই তাওহীদুল উলুহীয়াতের আলোচনা করেছেন। কেননা এই উম্মতের পরবর্তী যামানার অধিকাংশ লোক এই প্রকার তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তাওহীদের পরিপন্থী বিষয় তথা শির্কে লিপ্ত হয়েছে। শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রঃ) অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই প্রকার তাওহীদের বিবরণ দিয়েছেন। নবী-রাসূলগণও এই তাওহীদের দিকে মানুষকে আহবান করেছেন এবং তারা এই তাওহীদের বিপরীত যেই শির্কী কাজ-কর্মে লিপ্ত ছিল তা থেকে নিষেধ করেছেন।

তাওহীদের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া দ্বীনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। যারা এই তাওহীদকে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার তাওফীক ও ক্ষমতা দিন এবং যারা এর বিরোধীতা করে এবং তাঁর এবাদতে অন্যকে শরীক করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার শক্তি দিন! আমীন।

হে পাঠক! আপনি দেখছেন যে, লেখক এই কিতাবের অধ্যায়সমূহে তাওহীদে উলুহীয়ার মাসআলাসমূহ বর্ণনা করেছেন এবং তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাতের আলোচনার মাধ্যমে কিতাব সমাপ্ত করেছেন। কেননা অধিকাংশ লোক এই প্রকার ইলমের দিকে ভ্রুক্ষেপ করেনা। শুধু আলেমরাই এই প্রকার ইলমের মধ্যে প্রবেশ করেছে।

যে সমস্ত লোক ইলম চর্চায় ব্যস্ত হয়েছে, তারাও আবার এই প্রকার জ্ঞান অর্জন করেছে তর্কশাস্ত্রবিদদের থেকে এবং তাদের প্রতিই তারা ভালো ধারণা পোষণ করেছে। তারা মনে করেছে যে, আহলে কালামরাই সঠিক পথে রয়েছে। এটি মনে করেই এক শ্রেণীর আলেম তাদের মাযহাবকে কবুল করে নিয়েছে এবং তাদের কাছে যা কিছু পেয়েছে তাই তারা গ্রহণ করেছে। তারা জাহমীয়াদের মাযহাবকেই সহীহ বলেছে এবং তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ব্যাপারে সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। এই কারণে তারা কুরআন ও সুন্নাহর দলীল, সালফে সালেহীনদের মত এবং তাফসীর ও হাদীছের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ইমামদের বিরোধীতা করেছে।

তবে সুখবর হচ্ছে, এরপরও আহলে সুন্নাতের লোকেরা হকের ইপর কায়েম রয়েছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব কম। আল্লাহ তাআলা এই সম্মানিত ইমামকে এই প্রকার তাওহীদকে ভালোভাবে বুঝার তাওফীক দিয়েছেন। তাই তিনি কুরআন ও সুন্নাহর দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে তাওহীদুল উলুহীয়াকে সুস্পষ্টভাবে সাব্যস্ত করেছেন। সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য, যিনি সত্যের পথ দেখিয়েছেন এবং তা কবুল করার তাওফীক দিয়েছেন। বিশেষ করে যখন সঠিক ইসলাম প্রায় অপরিচিত হয়ে গিয়েছিল এবং বহু গ্রাম ও শহরের অনেক লোক সঠিক দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহই একমাত্র তাওফীক দাতা।

এই সংক্ষিপ্ত কিতাবে লেখক তিন প্রকার তাওহীদকেই একত্রিত করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) কাসীদায়ে নুনীয়ার মধ্যে এই তিন প্রকার তাওহীদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

والعلوم أقسام ثلاث ما لها + من رابع والحق ذو تبيان

علم بأوصاف الإله وفعله + وكذلك الأسماء للرحمن

والأمر والنهي الذي هو دينه + وجزاؤه يوم المعاد الثاني

ইলম মোট তিন প্রকার, এর চতুর্থ প্রকার নেই। সত্য খুবই সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল। আল্লাহর গুণাবলী এবং তাঁর কার্যাবলীর জ্ঞান। এমনি রয়েছে রাহমানের অনেক নাম। আরেক প্রকার হচ্ছে আদেশ ও নিষেধের জ্ঞান। এরই নাম হচ্ছে দ্বীন ইসলাম। এর উপর আমল করার বদলা আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন প্রদান করবেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) والارض جميعا قبضته يوم القيامة এর তাফসীর জানা গেল। কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে আল্লাহ তাআলার হাতের মুঠোয়।

২) এ অধ্যায়ে আলোচিত জ্ঞান ও এ সম্পর্কিত জ্ঞানের চর্চা তথা আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত জ্ঞান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামএর যুগের ইহুদীদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিলো। তারা এ জ্ঞানের না তাবীল করেছে এবং না অস্বীকার করেছে।

৩) ইহুদী পন্ডিত যখন কিয়ামতের দিনে আল্লাহর ক্ষমতা সংক্রান্ত কথা বলল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম তার কথাকে সত্যায়ন করলেন এবং এর সমর্থনে কুরআনের আয়াতও নাযিল হলো।

৪) ইহুদী পন্ডিত কর্তৃক আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কিত মহাজ্ঞানের কথা উল্লেখ করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামএর হাসির উদ্রেক হওয়ার রহস্য জানা গেল।

৫) আল্লাহ তাআলার দু’হস্ত মোবারকের সুস্পষ্ট উল্লেখ। আকাশ মন্ডলী তাঁর ডান হাতে, আর সমগ্র যমীন তাঁর অপর হাতে থাকবে।

৬) অপর হাতকে বাম হাত বলে নামকরণ করার সুস্পষ্ট ঘোষণা।[13]

৭) কিয়ামতের দিন অত্যাচারী এবং অহংকারীদের প্রতি আল্লাহর শাস্তির উল্লেখ।

৮) ‘‘তোমাদের কারো হাতে একটা সরিষা দানার মত’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামএর এ কথার তাৎপর্য। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহর হাতের তালুতে সাত আসমান ও সাত যমীন সেভাবেই থাকবে, যেভাবে থাকে কোনো মানুষের হাতে সরিষার একটি দানা।

৯) আকাশের তুলনায় আল্লাহর কুরসী অনেক বিশাল।

১০) কুরসীর তুলনায় আরশের বিশালতার উল্লেখ।

১১) আল্লাহর আরশ কুরসী এবং পানি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

১২) প্রতিটি আকাশের মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধানের উল্লে­খ।

১৩) সপ্তমাকাশ ও কুরসীর মধ্যে ব্যবধান।

১৪) কুরসী এবং পানির মধ্যে দূরত্ব।

১৫) আরশের অবস্থান পানির উপর।

১৬) আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে।

১৭) আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের উল্লে­খ।

১৮) প্রতিটি আকাশের ঘনত্ব পাঁচশ বছরের পথ।

১৯) আকাশ মন্ডলীর উপরে যে সমুদ্র রয়েছে তার উর্ধ্বদেশ ও তলদেশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

[10] - ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন, দেখুনঃ শরহুল আকীদুত্ তাহাবীয়া, (১/৩০৫)।

[11] - তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ, (১/২০৬)। আলেমগণ হাদীছটি সহীহ ও যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম হাদীছটি সহীহ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান গরীব। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ১২৪৭। যঈফ হওয়া সত্ত্বেও আলেমগণ আসমানের উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া প্রমাণ করতে গিয়ে হাদীছটিকে উল্লে­খ করেছেন। তবে আল্ল­াহ্ তাআলা উপরে হওয়ার বিষয়ে অনেক বিশুদ্ধ দলীল-প্রমাণ থাকার পরও এ ধরণের যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল না গ্রহণ করাই উত্তম।

এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লে­খযোগ্য। তা এই যে, أوعال (আওআল) শব্দটি وعل এর বহুবচন। এর অর্থে আলেমগণ থেকে একাধিক উক্তি পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেনঃ এরা হচ্ছেন বিশাল আকারের ফেরেশতা। কুরআনে ফেরেশতা কর্তৃক আরশ বহনের কথা সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে।

আবার কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে আল­াহর বিশেষ এমন এক সৃষ্টি, যার প্রকৃত রূপ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কেউ জানেনা। কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে বিশাল আকারের ষাঁড়। আবার কেউ বলেছেনঃ বিরাট আকৃতির শকুন। মোট কথা এগুলো পৃথিবীর পরিচিত কোনো প্রাণী নয়; ফেরেশতা। (আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[12] - মূলত বুখারী ও মুসলিমে এই দীর্ঘ হাদীছের কোন সমর্থক পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে আল্লাহ তাআলা যে আসমানের উপর- এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে রয়েছে অসংখ্যা দলীল-প্রমাণ। তা থেকে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলোঃ

আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫) এ অর্থে কুরআন মজীদে সাতটি আয়াত রয়েছে। (১) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

‘‘দয়াময় আল্লাহ্ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫)

(২) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

‘‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। (সূরা আ’রাফঃ ৫৪) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

‘‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা ইউনূসঃ ৩)

(৩) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

‘‘আল্লাহই ঊর্ধবদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন বিনা স্তম্ভে। তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা রা’দঃ ২)

(৫) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَانُ

‘‘অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। তিনি পরম দয়াময়। (সূরা ফুরকানঃ ৫৯)

(৬) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

‘‘আল্লাহই আকাশ-যমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল বস্ত্ত ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা সাজদাহঃ ৫৪)

৭) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

هُوَ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ

‘‘আল্লাহই আকাশ-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। (সূরা হাদীদঃ ৪) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

أَأَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ الأَرْضَ

‘‘তোমরা কি নিরাপত্তা পেয়ে গেছো যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধ্বসিয়ে দিবেন না?। (সূরা মুলকঃ ১৬) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ ‘‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে আছেন’’। (সূরা নাহ্লঃ ৫০) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

‘‘তাঁরই দিকে পবিত্র বাক্যসমূহ আরোহণ করে এবং সৎকর্ম তাকে উন্নীত করে’’। (সূরা ফাতিরঃ ১০) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃتَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ‘‘ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরীল) তাঁর দিকে উর্ধ্বগামী হয়’’। (সূরা মাআরেজঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

يُدَبِّرُ الأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الأَرْضِ

‘‘আল্লাহ্ তাআলা আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সকল বিষয় পরিচালনা করেন’’। (সূরা সিজদাহঃ ৫) আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ

‘‘যখন আল্লাহ বললেনঃ হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দান করব। অতঃপর তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নিবো’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৫) আল্লাহ্ তাআলা উপরে আছেন- এ মর্মে আরো অনেক দলীল রয়েছে। হাদীছেও রয়েছে অনেক দলীল। যেমনঃ

(১) সা’দ বিন মুআয যখন বনী কুরায়যার ব্যাপারে ফয়সালা দান করলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ তুমি তাদের ব্যাপারে সেই ফয়সালা করেছ, যা সাত আসমানের উপর থেকে আল্লাহ্ তাআলা করেছেন’’।[12]

(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা জনৈক দাসীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহ্ কোথায়? দাসী বললঃ আকাশে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাসীর মালিককে বললেনঃ তুমি তাকে মুক্ত করে দাও। কারণ সে মুমিন’’।

(৩) আল্লাহ্ তাআলা আকাশের উপরে। মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীছগুলো তার সুস্পষ্ট দলীল।

(৪) পালাক্রমে ফেরেশতাদের দুনিয়াতে আগমণের হাদীছেও আল্লাহ্ তাআলা আকাশের উপরে বিরাজমান হওয়ার দলীল রয়েছে। হাদীছের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ وَصَلَاةِ الْعَصْرِ ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ فَيَسْأَلُهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي فَيَقُولُونَ تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ»

‘‘তোমাদের নিকট রাতে একদল ফেরেশতা এবং দিনে একদল ফেরেশতা পালাক্রমে আগমণ করে। তারা ফজর ও আসরের নামাযের সময় একসাথে একত্রিত হয়। অতঃপর তোমাদের কাছে যে দলটি ছিল, তারা উপরে উঠে যায়। মহান আল্লাহ জানা সত্ত্বেও তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেনঃ আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তাঁরা বলেনঃ আমরা তাদেরকে নামায অবস্থায় ছেড়ে এসেছি এবং যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখন তারা নামাযেই ছিল।[12] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ

«مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلَا يَصْعَدُ إلَى اللَّهُ إِلَّا الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللَّهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ»

‘‘যে ব্যক্তি বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ হতে একটি খেজুর পরিমাণ সম্পদ দান করে, আর আল্লাহর নিকট তো পবিত্র ব্যতীত কোন কিছুই উর্ধ্বমুখী হয় না, আল্লাহ্ ঐ দান স্বীয় ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তা দানকারীর জন্য প্রতিপালন করতে থাকেন। যেভাবে তোমাদের কেউ নিজের ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঐ দান পাহাড় সমুতল্য হয়ে যায়’’।[12] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«إِذَا قَضَى اللَّهُ الأَمْرَ فِي السَّمَاءِ ضَرَبَتِ الْمَلاَئِكَةُ بِأَجْنِحَتِهَا خُضْعَانًا لِقَوْلِهِ كَالسِّلْسِلَةِ عَلَى صَفْوَانٍ»

‘‘আল্লাহ তা’আলা যখন আকাশে কোন বিষয়ে ফয়সালা করেন, তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর উক্ত ফয়সালার প্রতি অনুগত হয়ে তাদের পাখাসমূহ এমনভাবে নাড়াতে থাকেন যার ফলে শক্ত পাথরে শিকল দিয়ে প্রহার করলে যে ধরণের আওয়াজ হয় সে রকম আওয়াজ হতে থাকে’’।[12] আল্লাহ তাআলা আকাশের উপরে- জাহমীয়া ফির্কা ব্যতীত কেউ তা অস্বীকার করেনি।


[13] - পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, আল্লাহর অপর হাতকে বাম হাত বলে নামকরণ করা ঠিক নয়।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে