আল্লাহর নামসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং সে জন্য নাম পরিবর্তন করা

আবু শুরাইহ হতে বর্ণিত আছে, এক সময় তার কুনিয়াত ছিল আবুল হাকাম বা মহা ফয়সালাকারী। রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ

«إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ فَلِمَ تُكْنَى أَبَا الْحَكَمِ» فَقَالَ إِنَّ قَوْمِى إِذَا اخْتَلَفُوا فِى شَىْءٍ أَتَوْنِى فَحَكَمْتُ بَيْنَهُمْ فَرَضِىَ كِلاَ الْفَرِيقَيْنِ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم «مَا أَحْسَنَ هَذَا فَمَا لَكَ مِنَ الْوَلَدِ» قَالَ لِى شُرَيْحٌ وَمُسْلِمٌ وَعَبْدُ اللَّهِ قَالَ « فَمَنْ أَكْبَرُهُمْ» قُلْتُ شُرَيْحٌ قَالَ « فَأَنْتَ أَبُو شُرَيْحٍ»

‘‘আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন হাকাম এবং ফয়সালা একমাত্র তাঁরই। সুতরাং তুমি আবুল হাকাম কুনিয়ত গ্রহণ করছ কেন? তখন আবু শুরাইহ বললেন, আমার গোত্রের লোকেরা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করে, তখন ফয়সালার জন্য আমার কাছে চলে আসে। তারপর আমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেই। এতে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম একথা শুনে বললেনঃ এটা কতইনা ভাল! তোমার কি সন্তানাদি আছে? আবু শুরাইহ বললেনঃ আমার শুরাইহ, মুসলিম এবং আবদুল্লাহ নামে তিনটি ছেলে আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাদের মধ্যে সবার বড় কে? আমি বললামঃ শুরাইহ। তিনি বললেন তাহলে তুমি আবু শুরাইহ।[1]

ব্যাখ্যাঃ হাদীছের রাবী হচ্ছেন আবু শুরাইহ খুওয়াইলেদ বিন আমর আলখুযাঈ। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন। তাঁর থের্কে বর্ণিত মোট হাদীছের সংখ্যা বিশটি। তা থেকে দু’টি হাদীছ ইমাম বুখারী ও মুসলিম একই শব্দে বর্ণনা করেছেন। বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন একটি। তার নিকট থেকে অনেকেই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু সাঈদ আলমাকবুরী, নাফে বিন জুবাইর এবং আরো একদল মুহাদ্দিছ। ইবনে সা’দ বলেনঃ তিনি ৬৮ হিজরীতে মদীনায় মৃত্যু বরণ করেন।

যে নামের শুরুতে أب বা أم কিংবা অনুরূপ শব্দ থাকে তাকে কুনিয়ত (উপনাম) বলা হয়। যেমন أبو محمد মুহাম্মাদের পিতা। আর উপাধি এ রকম নয়। অর্থাৎ যে নামের সাথে সম্মানবোধক কিংবা অপমানবোধক শব্দ যোগ করা হয়, তাকে লকব বা উপাধি বলা হয়। যেমন زين العابدين যাইনুল আবেদীন।

إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন হাকাম বা মহা ফয়সালাকারী এবং ফয়সালার অধিকার একমাত্র তাঁরইঃ অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের একমাত্র বিচারক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। দুনিয়াতে তিনি স্বীয় মাখলুকদের মধ্যে ঐ অহীর মাধ্যমে ফয়সালা করেন, যা তিনি তাঁর নবী-রাসূলদের উপর নাযিল করেছেন। প্রত্যেক সমস্যারই আল্লাহর পক্ষ হতে এমন একটি ফয়সালা রয়েছে, যা তিনি তাঁর নবীর উপর কিতাব ও সুন্নাতের মাধ্যমে নাযিল করেছেন। তবে মুজতাহিদের নিকট কখনো সেই ফয়সালা অস্পষ্ট থাকে। কেননা মুজতাহিদগণ যদি কোন মাসআলায় মতভেদ করেন, তাতে একজন মুজতাহিদের মতই সঠিক হবে। আল্লাহ তাআলা যাকে বুঝ শক্তি দিয়েছেন এবং আলেমদের মতভেদপূর্ণ কথা থেকে সঠিক কথাটি বুঝার যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়েছেন, তিনিই কেবল সেখান থেকে সঠিক বিষয়টি বুঝতে পারেন।

সুতরাং দুনিয়া ও আখেরাতে ফয়সালা একমাত্র আল্লাহর। যেমন আল্লাহ তাআলা সূরা শুরার ১০ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبِّي عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ

‘‘তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর, তার ফয়সালা আল্লাহ্‌র কাছেই। তিনিই আল্লাহ্, আমার প্রতিপালক। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং তাঁরই অভিমূখী হই’’। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো। তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদেরও। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ্ ও তার রাসূলের নিকট ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আললাহ্ ও কিয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’’ (সূরা নিসাঃ ৫৯)

সুতরাং হুকুম আল্লাহর নিকটেই। আল্লাহর কিতাবে এবং আল্লাহর রাসূলের নিকটই সকল বিষয়ের ফয়সালা রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন ফয়সালা ছিল তাঁর নিকটেই। তাঁর মৃত্যু বরণের পর সুন্নাতের মধ্যে তাঁর ফয়সালাসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে।

আমার গোত্রের লোকেরা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করেঃ আবু শুরাইহের ভাষ্য হচ্ছে, তার গোত্রের লোকেরা যখন কোনো বিষয়ে মতভেদ করে, তখন তারা সমাধানের জন্য আবু শুরাইহের কাছে চলে আসে। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে আবু শুরাইহ তাঁর গোত্রীয় লোকদের নিকট খুব নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তার গোত্রের লোকেরা কোনো বিষয়ে ঝগড়া ও মতবিরোধ করলে তিনিও তাদের মধ্যে ফয়সালা করার চেষ্টা করতেন। তাই তারা তার ফয়সালা ও মীমাংসা মেনে নিতেন। এখান থেকেই তারা তাঁর নাম রেখেছিল আবুল হাকাম।

মূর্খ, গ্রাম্য এবং তাদের অনুরূপ লোকেরা তাদের বাপ-দাদা ও পূর্ব পুরুষদের রসম-রেওয়াজ দ্বারা যেই ফয়সালা করে থাকে, তা এর অন্তর্ভূক্ত নয়। পূর্ব পুরুষদের তাকলীদ করে তাদের রীতি-নীতি দিয়ে ফয়সালা করা এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ফয়সালার বিরোধীতা করা হতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের’’।[2] (সূরা মায়েদাঃ ৪৪)

যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার-ফয়সালা করেনা, তাদের সংখ্যা প্রচুর। এমন বিচারক রয়েছে, যে বিবাদমান দুইজন লোকের মধ্যে নিজস্ব রায় দ্বারা বিচার করে থাকে। কেউ তার পূর্ব পুরুষদের অনুসরণ করে এবং তারা যা দিয়ে বিচার ফয়সালা করত, সেও তা দিয়েই ফয়সালা করে। বিবাদে লিপ্ত হয়ে মানুষ যার নিকট ফয়সালার জন্য গমণ করে তার অবস্থা যদি এ রকম হয় যে, সে সর্বদা পূর্ব পুরুষ কিংবা নিজস্ব মতামত দিয়ে বিচার-ফয়সালা করে এবং এটিই তার সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে এটি হবে কুফুরী।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ তোমার কি সন্তানাদি আছে? জবাবে আবু শুরাইহ বললেনঃ হ্যাঁ, আমার শুরাইহ, মুসলিম এবং আব্দুল্লাহ নামে তিনজন সন্তান আছে। এবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তাদের মধ্যে বড় কে? আবু শুরাইহ বলেনঃ আমি বললামঃ শুরাইহ। তখন তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি আবু শুরাইহ। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য বড় ছেলের নামে কুনিয়ত রাখলেন। এটিই সুন্নাত। আর তিনি তার প্রথম কুনিয়ত আবুল হাকাম বদল করে ফেললেন। কেননা আল্লাহ তাআলাই সকলের হাকাম (হুকুমকারী)। এখান থেকে শাসকদের নাম রাখা হয়েছে হুক্কাম বা হুকুমকারীগণ। এই হাদীছের দাবী হলো, কাউকে হাকাম না বলা এবং লোকদেরকে এ থেকে নিষেধ করা। কাউকে হাকাম বা হাকেম বলা লোকেরা পরবর্তীতে আবিস্কার করেছে। এ অধ্যায় থেকে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) বান্দার উচিত আল্লাহ তাআলার অতি সুন্দর নাম ও গুণাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সে জন্যই আল্লাহর নাম ও সিফাতের মত করে কারো নাম রাখা অনুচিত। যদিও উক্ত নাম রাখার সময় এর অর্থ উদ্দেশ্য না হয়।

২) আল্লাহর নাম ও সিফাতের সম্মানার্থে কতক নাম পরিবর্তন করা জরুরী।

৩) উপনামের জন্য বড় ছেলের নাম বাছাই করা উচিৎ।

[1] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ মন্দ নাম পরিবর্তন করা। ইমাম আলবানী এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন। দেখুন শাইখের তাহকীকসহ মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীছ নং- ৪৭৬৬।

[2] - আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الظَّالِمُونَ ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম।’’ (সূরা মায়েদাঃ ৪৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الفَاسِقُوْنَ ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসেক’’। (সূরা মায়েদাঃ ৪৭) যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনটি আয়াতে পরপর কাফের, জালেম এবং ফাসেক বলেছেন। তিনটি দোষই এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করল না, সে কাফের, ফাসেক এবং জালেমও বটে। কেননা আল্লাহ কাফেরদেরকে জালেম এবং ফাসেক হিসাবেও বর্ণনা করেছেন।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে