১. ‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে) বলে খাওয়া শুরু করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا أكَلَ أحَدُكُمْ فَلْيَذْكُرِ اسْمَ اللهِ تَعَالَى ، فإنْ نَسِيَ أنْ يَذْكُرَ اسْمَ اللهِ تَعَالَى في أوَّلِهِ ، فَلْيَقُلْ: بسم اللهِ أوَّلَهُ وَآخِرَهُ » . (رواه أَبُو داود و الترمذي).

“তোমাদের কেউ যখন খাবার খায়, তখন সে যেন আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে নেয়; আর সে যদি শুরুতে আল্লাহ তা‘আলার নাম নিতে ভুলে যায়, তাহলে যেন বলে: « بسم اللهِ أوَّلَهُ وَآخِرَهُ » (প্রথমে ও শেষে আল্লাহর নামে)।”[1]

২. আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করার মাধ্যমে অর্থাৎ ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে খাওয়া শেষ করা। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ أكَلَ طَعَامَاً ، فَقال : الحَمْدُ للهِ الَّذِي أطْعَمَنِي هَذَا ، وَرَزَقنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوَّةٍ ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ » . (رواه أَبُو داود و الترمذي).

“যে ব্যক্তি খাবার খেয়ে শেষ করার পর বলবে: « الحَمْدُ للهِ الَّذِي أطْعَمَنِي هَذَا ، وَرَزَقنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوَّةٍ » (অর্থাৎ সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এ খাবার খাওয়ালেন এবং আমাকে রিযিক দিলেন আমার কোনরূপ চেষ্টা ও শক্তি ছাড়াই), তার পেছনের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”[2]

৩. ডান হাত দ্বারা খাবার গ্রহণ করা, ছোট ছোট লোকমা দেওয়া এবং ভালোভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া; আর পাত্রের মাঝখান থেকে না খেয়ে নিজের সামনে থেকে খাওয়া; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ইবন আবি সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

« يَا غُلامُ ، سَمِّ اللهَ تَعَالَى ، وَكُلْ بِيَمينِكَ ، وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ » . (متفقٌ عَلَيْهِ).

“হে বেটা! আল্লাহ তা‘আলার নাম লও (অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহ’ বল); ডান হাতে খাও এবং নিজের সামনে থেকে খাও।”[3] তিনি আরও বলেন:

« البَرَكَةُ تَنْزِلُ وَسَطَ الطعَامِ ؛ فَكُلُوا مِنْ حَافَتَيْهِ ، وَلاَ تَأكُلُوا مِنْ وَسَطِهِ » . (رواه أَبُو داود و الترمذي).

“বরকত খাবারের মধ্যখানে অবতীর্ণ হয়; কাজেই তোমরা তার পাশ থেকে খাও; তার মাঝখান থেকে খেয়ো না।”[4]

৪. খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া; আর খাবারের পাত্র চেটে খাওয়া এবং রুমাল বা টিসু দিয়ে স্বীয় আঙুলসমূহ মুছে ফেলার পূর্বে বা পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলার পূর্বে সেগুলো চেটে খাওয়া। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا أكَلَ أَحَدُكُمْ طَعَاماً ، فَلاَ يَمْسَحْ أَصَابِعَهُ حَتَّى يَلْعَقَهَا أَوْ يُلْعِقَها » . (متفقٌ عَلَيْهِ).

“তোমাদের কেউ যখন খাবার খায়, তখন সে যেন তার আঙুলসমূহ মুছে না ফেলে, যতক্ষণ না সে তা চেটে খায় অথবা কাউকে দিয়ে চাটিয়ে নেয়।”[5] তাছাড়া জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« إنَّ رَسُول الله صلى الله عليه وسلم أَمَرَ بِلَعْقِ الأَصَابِعِ وَالصَّحْفَةِ ، وقال : إنَّكُمْ لاَ تَدْرُونَ في أيِّ طَعَامِكُمُ البَرَكَةُ » . (رواه مسلم).

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঙুল ও খাওয়ার পাত্র চেটে খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন: ‘তোমাদের জানা নেই, তোমাদের কোন্ খাবারের মধ্যে বরকত রয়েছে।”[6]

৫. খাবার গ্রহণ করার সময় তার থেকে কিছু পড়ে গেলে তার থেকে ময়লা দূর করে তা খেয়ে ফেলবে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيَأخُذْهَا ، وَلْيُمِط عنها الأَذى وليَأكُلْها ، وَلاَ يَدَعْها لِلشَّيْطان » . (رواه مسلم).

“যখন তোমাদের কারও লোকমা পড়ে যায়, তখন সে যেন তা তুলে নেয়; আর তার থেকে ময়লা দূর করে নিয়ে যেন তা খেয়ে ফেলে এবং তা যেন শয়তানের জন্য রেখে না দেয়।”[7]

৬. গরম খাবারে (ঠাণ্ডা করার জন্য) ফুঁ না দেওয়া এবং তা ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত না খাওয়া; আর পানি পান করা অবস্থায় পানির মধ্যে ফুঁ না দেওয়া এবং উচিৎ হলো পানপাত্রের বাইরে তিনবার শ্বাস নেয়া; কেননা, আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন:

« إنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم كَانَ يَتَنَفَّسُ في الشَّرابِ ثَلاثاً » . (متفقٌ عَلَيْهِ)

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি পান করতে তিনবার শ্বাস নিতেন।”[8] আর আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« إنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم نَهَى عَن النَّفْخ في الشَّرَاب » . (رواه الترمذي)

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানীয় বস্তুর মধ্যে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।”[9] তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

« إنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم نَهَى أن يُتَنَفَّسَ في الإناءِ أَوْ يُنْفَخَ فِيهِ » . (رواه الترمذي)

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানির পাত্রে শ্বাস নিতে অথবা তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।”[10]

৭. অতি ভোজন থেকে বিরত থাকা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَا مَلأَ آدَمِيٌّ وِعَاء شَرّاً مِنْ بَطْنٍ ، بِحَسْبِ ابنِ آدَمَ لُقَيْمَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ ، فإنْ لَمْ يَفْعَلْ فثُلُثٌ لِطَعَامِهِ ، وَثُلُثٌ لِشَرابِهِ ، وَثُلُثٌ لِنَفَسه » . (رواه أحمد و ابن ماجه و الترمذي و الحاكم).

“মানুষের ভরা পেটের চেয়ে খারাপ পাত্র আর নেই। আদম সন্তানের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমাই তো যথেষ্ট; সুতরাং সে যদি তাতে তুষ্ট না হতে পারে, তাহলে (পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে নেবে) এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং অপর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঠিক করে নেবে।”[11]

৮. অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিকে প্রথমে খাবার বা পানীয় পরিবেশন করা; অতঃপর ডান দিক থেকে একজন একজন করে খাবার পরিবেশন করতে থাকা; আর খাবার বা পানীয় পরিবেশনকারী হবে কাওমের মাঝে সর্বশেষ খাবার বা পানীয় গ্রহণকারী ব্যক্তি। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: « كَبِّرْ كَبِّرْ » অর্থাৎ উপবিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে বয়োজ্যেষ্ঠকে দিয়ে শুরু কর; তাছাড়া “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র কাছে তার বাম পাশে বসা বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে পানীয় পরিবেশনের ব্যাপারে অনুমতি নিয়েছেন, যখন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা ছিলেন তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ডানপাশে এবং বয়স্ক ব্যক্তিগণ ছিলেন তাঁর বামপাশে। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তার কাছে অনুমতি চাওয়াই প্রমাণ করে যে, ডানপাশে বসা ব্যক্তিই প্রথমে পানীয় পাওয়ার ব্যাপারে বেশি হকদার।”[12] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: « الأيمن فالأيمن » (অর্থাৎ ডানপাশ থেকে পরপর খাবার প্রদান কর)।[13] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« إنَّ سَاقِيَ الْقَوْمِ آخِرُهُمْ شُرْبًا » . (رواه مسلم و أبو داود و ابن ماجه).

“কাওমের মধ্যে যে সাকী (পানীয় সরবরাহকারী) হবে, পান করার দিক থেকে সে সবার শেষে থাকবে।”[14]

৯. যে মাজলিসে বয়সের দিক থেকে বড়, অথবা মর্যাদার দিক থেকে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি আছে, সেখানে প্রথমে খাবার বা পানীয় গ্রহণ না করা। কেননা, তা শিষ্টাচার পরিপন্থি এবং এমন ব্যক্তিকে নিন্দিত লোভী বলে চিত্রিত করা হয়। কেউ কেউ ছন্দাকারে বলেন:

وإنْ مُدَّتِ الأيدي إلى الزادِ لم أكنْ

بِأعجلِهم ، إذْ أَجْشَعُ القومِ أعْجَلُ

(আর যদি খাবারের দিকে হাতগুলো প্রসারিত হয়েই যায়, তখন হব না আমি

তাদের সকলের অগ্রগামী; কারণ, কাওমের মাঝে সেই সবচেয়ে লোভী, যে তড়িৎ প্রিয় বেশি)।[15]

১০. তার বন্ধু বা মেযবান কর্তৃক যেন তাকে বলতে না হয়: ‘তুমি খাও’ এবং যাতে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে না হয়, বরং তার জন্য উচিৎ হল কোনো প্রকার লাজ্জাবোধ না করে প্রয়োজন মত খাবার খেয়ে নেওয়া; কেননা, এর মধ্যে তার বন্ধু বা মেযবানের জন্য অসুবিধা আছে, যেমনিভাবে তাতে রয়েছে এক ধরনের লৌকিকতা; আর ইসলামে লৌকিকতা বা প্রদর্শনী করা হারাম।

১১. খাওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুর প্রতি সদয় হওয়া; সুতরাং সে তার থেকে বেশি খাওয়ার চেষ্টা করবে না, বিশেষ করে যখন খাবারের পরিমাণ কম হয়; কেননা, এ ক্ষেত্রে সে অন্যের হক ভক্ষণকারী বলে গণ্য হবে।

১২. খাওয়ার মাঝখানে সাথীদের দিকে না তাকানো এবং তাদেরকে পর্যবেক্ষণ না করা; কেননা, এ রকম করলে তারা লজ্জা পাবে, বরং তার জন্য উচিৎ হলো তার চারি পাশের খাবার গ্রহণকারীদের থেকে তার দৃষ্টিকে অবনমিত করে রাখা এবং তাদেরকে অবলোকন না করা; কেননা, এটা তাদেরকে কষ্ট দিবে; যেমনিভাবে এ কারণে সে কখনও কখনও তাদের কারো কারো ঘৃণার পাত্র হবে; ফলে এ কারণে সে গুনাহগার হবে।

১৩. এমন কাজ না করা, যাকে মানুষ স্বভাবগতভাবে অপছন্দ করে; সুতরাং সে পাত্রের মধ্যে তার হাতকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিবে না এবং খাবার গ্রহণের সময় তার মাথাকে পাত্রের নিকটবর্তী করবে না, যাতে তার মুখ থেকে কোনো কিছু তাতে না পড়ে; যেমন— সে যখন রুটি থেকে তার দাঁত দ্বারা কিছু অংশ গ্রহণ করে, তখন পাত্রের মধ্যে তার বাকি অংশ ডুবিয়ে দিবে না; ঠিক অনুরূপভাবে তার কর্তব্য হল এমন শব্দ চয়নে কথা না বলা, যা ময়লা ও আবর্জনার কথা মনে করিয়ে দেয়; কারণ, কোনো কোনো সময় এর দ্বারা সাথীদের কেউ কেউ কষ্ট অনুভব করে; আর মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেয়া হারাম।

১৪. ফকীরের সাথে তার খাওয়া হবে পরার্থপরতা বা প্রেম-ভালবাসার ভিত্তিতে, ভাই-বন্ধুদের সাথে খাওয়া হবে আনন্দ ও নির্মল রসিকতার ভিত্তিতে এবং পদস্থ ও মর্যাদাবান ব্যক্তিবর্গের সাথে খাওয়া হবে আদব-লেহাজ ও শ্রদ্ধার সাথে।

[1] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
[2] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[3] বুখারী ও মুসলিম।
[4] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন।
[5] বুখারী, হাদিস নং- ৫১৪০; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৪১৫
[6] মুসলিম, হাদিস নং- ৫৪২০
[7] মুসলিম, হাদিস নং- ৫৪২১ ও ৫৪২৬
[8] বুখারী, হাদিস নং- ৫৩০৮; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৪০৬
[9] তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।
[10] তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।
[11] আহমাদ, ইবনু মাজাহ, তিরমিযী ও হাকেম এবং হাদিসটি ‘হাসান’।
[12] বুখারী (হাদিস নং- ২২২৪) ও মুসলিম।
[13] বুখারী (হাদিস নং- ২২২৫) ও মুসলিম।
[14] মুসলিম, হাদিস নং- ১৫৯৪; আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৩৭২৭ ; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৩৪৩৪ এবং আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
[15] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১৬৮