প্রশ্ন: কবর যিয়ারত করতে গিয়ে তাতে ফাতেহা পাঠ করা বিশেষ করে আউলিয়াদের কবরে, যেমন করে থাকে পার্শ্ববর্তী কিছু আরবীয় দেশে। তাদের মধ্যে কিছু লোক বলে থাকে যে, আমরা শির্ক করতে চাইনা কিন্তু কোনো অলির মাযার যদি যিয়ারত না করি তাহলে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে বলে দেয় যে আমাকে যিয়ারত করনি কেন? এর হুকুম কি?
আল্লাহ আপনাকে ভালো প্রতিদান দিন।

উত্তর: মুসলিম পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত করা সুন্নাত, যেমন আল্লাহ তা বৈধ করেছেন রাসূলের বাণী দ্বারা:

«زوروا القبور فإنها تذكركم الآخرة»

“তোমরা কবর যিয়ারত কর; কেননা তা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।”[1]

বুরাইদা ইবন হুসাইব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে কবর যিয়ারতের জন্য এ দো‘আ শিক্ষা দিতেন যে, তারা যেন বলে:

«السلام عليكم أهل الديار من المؤمنين والمسلمين، وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، نسأل الله لنا ولكم العافية»

“হে কবরের অধিবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ, তোমাদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক, আমরাও ইনশাআল্লাহ তোমাদের সাথে মিলিত হচ্ছি। আমরা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।”[2]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে সহীহ সনদে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কবর যিয়ারত করতেন তখন তিনি বলতেন:

السلام عليكم دار قوم مؤمنين وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، يرحم الله المستقدمين منا والمستأخرين، اللهم اغفر لأهل بقيع الغرقد

“হে কবরের অধিবাসী মুমিনগণ, তোমাদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক, আমরাও ইনশাআল্লাহ তোমাদের সাথে মিলিত হচ্ছি। আল্লাহ আমাদের পূর্বে গমনকারী এবং পরবর্তী গমনকারীদেরকে রহমত করুন। হে আল্লাহ, বাকী আল- গারকাদের অধিবাসীদেরকে ক্ষমা করুন।”

যিয়ারতের সময় তিনি সূরা ফাতেহা বা কুরআন থেকে অন্য কিছু পাঠ করেন নি, কাজেই যিয়ারতের সময় তা পাঠ করা বিদ‘আত। এমনিভাবে কুরআনের যে কোনো আয়াত পাঠ করা বিদ‘আত, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো জিনিস সৃষ্টি করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”

সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে যা আমার শরীয়ত সমর্থিত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”

এবং জুম‘আর খুৎবায় তিনি বলেছিলেন :

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো, আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত, আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো এর নব আবিষ্কৃত কাজ, এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।” দেখুন, সহীহ মুসলিম এবং সুনান নাসায়ী, তবে নাসায়ী আরো একটু বাড়িয়ে বর্ণনা করেছে, “আর প্রতিটি পথভ্রষ্টতা জাহান্নামে”। কাজেই সকল মুসলিমের উচিৎ হলো কবর যিয়ারত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শরীয়তকেই নির্ধারিত করা এবং বিদ‘আত থেকে সতর্ক থাকা।

সকল মুসলিমের কবর যিয়ারত করা বৈধ, চাই উঁচু দরজার ওলি হোক বা না হোক, প্রতিটি মুমিন নর-নারীই আল্লাহর অলি। আল্লাহ বলেন:

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ ٦٣ ﴾ [يونس: ٦٢، ٦٣]

“জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর অলিদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না, যারা ঈমান এনেছে এবং তারা আল্লাহকে ভয় করতো।” [সূরা ইউনুস/৬২-৬৩]

তিনি আরো বলেন:

﴿وَمَا كَانُوٓاْ أَوۡلِيَآءَهُۥٓۚ إِنۡ أَوۡلِيَآؤُهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٤ ﴾ [الانفال: ٣٤]

“তারা আল্লাহর অলি ছিল না, আল্লাহর অলি হচ্ছে তাকওয়ার অধিকারীগণ কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা।” [সূরা আনফাল/৩৪]

যিয়ারতকারী বা অন্য যে কারো জন্য মৃতের নিকট দো‘আ চাওয়া বা তাদের নিকট প্রার্থনা করা, তাদের জন্য মান্নত করা জায়েয নেই। তাদের নিজেদের জন্য বা কোনো রুগীর জন্য অথবা শত্রুদের উপর বিজয় লাভ বা অন্য কোনো প্রয়োজনের ব্যাপারে তাদের নৈকট্য লাভ করে তাদের সুপারিশের আশায় তাদের কবরের পার্শ্বে বা অন্য কোথাও তাদের জন্য পশু জবাই করা জায়েয নেই। কারণ এগুলো হচ্ছে ইবাদত, আর ইবাদত সবগুলোই একমাত্র আল্লাহর জন্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ﴾ [البينة: ٥]

“তাদেরকে শুধুমাত্র একনিষ্ঠতার সাথে এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশই দেওয়া হয়েছে।” [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ /৫]

তিনি আরও বলেন:

﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]

“আমি জ্বিন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমারই ইবাদত করার জন্য।” [সূরা আয-যারিয়াহ /৫৬]

তিনি আরও বলেন:

﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]

“এবং সকল মাসজিদ আল্লাহর জন্য, কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।” [সূরা জ্বিন ১৮]

তিনি আরও বলেন:

﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ﴾ [الاسراء: ٢٣]

“এবং তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা কেবলমাত্র তারই ইবাদত কর।” [সূরা ইসরা/২৩]

তিনি আরও বলেন:

﴿ فَٱدۡعُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ١٤ ﴾ [غافر: ١٤]

“তোমরা একনিষ্ঠতার সাথে তাকে ডাক, যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে।” [সূরা গাফের/১৪]

আরও বলেন:

﴿ قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢، ١٦٣]

“হে নবী, আপনি তাদের বলে দিন, আমার সালাত, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তার কোনো অংশিদার নেই, আর এ নির্দেশই আমাকে দেওয়া হয়েছে এবং আমিই সর্ব প্রথম আত্মসমর্পণকারী।” [সূরা আল-আন‘আম/১৬২-১৬৩] এ অর্থে আরও বহু আয়াত রয়েছে।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সনদে এসেছে, তিনি বলেছেন,

«فَإِنَّ حَقُّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ، وَلَا يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا»

“বান্দার উপর আল্লাহর হক্ব হচ্ছে: তারা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশিদার করবে না।” হাদীসটি মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত।[3]

এ হাদীস সকল ইবাদতকে শামিল করে তথা, সালাত, সাওম, রুকু, সিজদাহ, হজ্জ, দো‘আ, কোরবানী, মান্নত ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত এর অন্তর্ভুক্ত।

এমনিভাবে পূর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলোও সকল প্রকার ইবাদতকে শামিল করে।

সহীহ মুসলিমে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করবে তার উপর আল্লাহ লা‘নত বর্ষিত হবে।”[4]

সহীহ বুখারীতে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ، وَرَسُولُهُ»

“তোমরা আমার অত্যাধিক প্রশংসা করো না যেমন খৃষ্টানগণ ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর ব্যাপারে করেছে, বরং আমি কেবল একজন বান্দা, কাজেই তোমরা বল যে আমি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল।”[5]

এছাড়াও এক আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ এবং তার সাথে শির্ক করা এবং শির্কের অসিলা অবলম্বন করা নিষেধের বহু হাদীস রয়েছে।

আর মহিলাদের জন্য কোনো কবর যিয়ারত নেই, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لَعَنَ الله زائرات القبور»

“কবর যিয়ারতকারিনী মহিলার উপর আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন।”[6]

কেননা এদের কবর যিয়ারতের ফলে পুরুষদের পক্ষ থেকে ফেৎনার সম্মুখীন হতে পারে।

ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় সকলের জন্য কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল, অতঃপর যখন ইসলাম ও তাওহীদ ব্যপকতা লাভ করেছে তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের জন্য কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন, তারপর ফেৎনার ভয়ে শুধু মহিলাদেরকে নিষেধ করে দিয়েছেন।

আর কাফেরদের কবর যিয়ারত স্মৃতি এবং উপদেশ গ্রহণ করার জন্য হলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু তাদের জন্য দো‘আ বা ক্ষমা চাওয়া যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সনদে এসেছে যে, তিনি তাঁর মা’র জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার অনুমতি চাইলে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দেননি, তারপর তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দিলেন, কারণ তিনি জাহেলিয়া যুগে তার স্বজাতীর ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন।আল্লাহর নিকট সকল নর-নারী মুসলিম ভাইয়ের জন্য দ্বীন বুঝার এবং কথায়, কাজে ও বিশ্বাসে এর উপর কায়েম থাকার তাওফীক প্রার্থনা করছি। আমাদেরসহ সকল মুসলিমকে যেন এর পরিপন্থী বিষয়গুলো থেকে রক্ষা করেন। নিশ্চয়ই তিনি এর অভিভাবক এবং এর উপর ক্ষমতাবান। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তাঁর পরিবার পরিজন এবং তাঁর সকল সাহাবীগণের উপর।

[1] মুসলিম শরীফ; হাদীস নং ৯৭৬, ইবনে মাজাহ; হাদীস নং ১৫৬৯

[2] মুসলিম শরীফ ২/৬৭১

[3] বুখারী শরীফ; হাদীস নং ২৮৫৬, মুসলিম শরীফ; হাদীস নং ৩০

[4] হাদীস নং ১৯৭৮।

[5] হাদীস নং ৩৪৪৫।

[6] আহমাদ; হাদীস নং ২০৩১, আবু দাউদ; হাদীস নং ৩২৩৬, তিরমিযী; হাদীস নং ৩২০ এবং নাসায়ী, হাদীস নং ২০৪৩।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে