অলঙ্কার দু’প্রকার:

প্রথম প্রকার: দু’টি নগদ মুদ্রা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপা। স্বর্ণ ও রূপার যাকাত সম্পর্কে আহলে ইলমগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দেখতে হবে: স্বর্ণ-রূপা সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার জন্য, না সঞ্চয় করে রাখার জন্য, না ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজের জন্য। অধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যে উদ্দেশ্যেই তা সংগ্রহ করুক। কারণ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দলীল সবপ্রকার স্বর্ণ-রূপাকে শামিল করে, কোনো প্রকার স্বর্ণ-রূপা যাকাত থেকে বাদ দেওয়া হয় নি। তাই বলে যারা বলেন ব্যবহার করার স্বর্ণ-রূপার ওপর যাকাত ফরয নয়, তাদের কথাকে মূল্যহীন জ্ঞান করছি না, যেহেতু এটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ মাসআলা, তাতে দ্বিমত করার সুযোগ আছে।

জ্ঞাতব্য: নারীর মালিকানাধীন স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি তার নিকট যাকাত দেওয়ার অর্থ না থাকে, যাকাত পরিমাণ অলঙ্কার বিক্রি যাকাত দিবে। কেউ যদি তাকে যাকাতের ক্ষেত্রে সাহায্য করে, যেমন স্বামী বা নিকট আত্মীয় তবে তাতে কোনোও সমস্যা নেই।

দ্বিতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রূপা ব্যতীত অন্যান্য বস্তু যেমন হীরা, মুক্তা, ইয়াকুত, মোতি, মুক্তোদানা, গোমেদ-পীতবর্ণ মণিবিশেষ ইত্যাদি বস্তুর ভেতর যাকাত ওয়াজিব হয় না; তার মূল্য যাই হোক, তবে ব্যবসার জন্য হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে।

স্বর্ণের নিসাব: স্বর্ণের নিসাব বিশ দিরহাম স্বর্ণ, যা ওজন করলে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ হয়। কারও মালিকানাধীন যদি ৮৫ গ্রাম বা ততোধিক স্বর্ণ থাকে, ক্যারেট যাই হোক, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যাকাতের পরিমাণ এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট স্বর্ণের ২.৫ পার্সেন্ট।

যাকাত দেওয়ার নিয়ম: ব্যক্তির মালিকানায় যে ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে সেই ক্যারেটের একগ্রাম স্বর্ণের বাজার দর জানবে প্রথম। যদি একাধিক ক্যারেটের স্বর্ণ থাকে, যে ক্যারেট স্বর্ণ বেশি আছে তার বাজার দর জানবে, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে তার নিকট যে ক’গ্রাম স্বর্ণ রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে পূরণ দিবে। এভাবে স্বর্ণের গ্রামকে মুদ্রায় পরিণত করবে, অতঃপর ক্যালকুলেটর দিয়ে মোট মূল্য থেকে ২.৫% বের করবে, যে অংক আসবে তাই স্বর্ণের যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ২১ ক্যারেট ১০০ গ্রাম স্বর্ণের মালিক, সে তার যাকাত বের করার জন্য প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে, যদি একগ্রাম স্বর্ণের দাম হয় ১০,০০০ টাকা, যাকাতের হিসেব হবে নিম্নরূপ: ১০০ (গ্রাম-স্বর্ণ)* ১০,০০০ (টাকা, যা একগ্রাম স্বর্ণের মূল্য)* ২.৫% (যাকাত) অর্থাৎ ১০০* ১০,০০০* ২.৫%=২৫০০০ টাকা।

রূপার নিসাব: ২০০ দিরহাম রূপা, যা ওজন করলে ৫৯৫ গ্রাম হয়। কারও মালিকানায় যদি ২০০ দিরহাম বা তার চেয়ে বেশি রূপা থাকে এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তবেই তাতে যাকাত ফরয হবে। যাকাতের পরিমাণ: এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট রূপার ২.৫%।

যাকাত বের করার নিয়ম: যে ক্যারেট রূপা তার কাছে রয়েছে, প্রথম তার বাজার দর জানবে, আর যদি একাধিক ক্যারেটের রূপা থাকে, যে ক্যারেট রূপা বেশি রয়েছে তার বাজার দর জানবে। অতঃপর যত গ্রাম রূপা তার মালিকানায় রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে একগ্রাম রূপার বাজার দরকে গুণ দিবে, গুণফল থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে, যে অংক বের হবে সেটি ৫৯৫ গ্রাম রূপার যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ৬০০ গ্রাম রূপার মালিক, সে যখন তার যাকাত বের করার ইচ্ছা করবে প্রথম একগ্রাম ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। যদি মনে করি একগ্রাম রূপার মূল্য ১০০ টাকা, নিম্নের নিয়মে যাকাত বের করবে: ৬০০ (গ্রাম-রূপা)* ১০০ (টাকা, যা একগ্রাম-রূপার মূল্য)* ২.৫% = ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ একগ্রাম রূপার মূল্য যদি হয় ১০০ টাকা, ৬০০ গ্রাম রূপার যাকাত আসবে ১৫০০ টাকা।

জ্ঞাতব্য: স্বর্ণ-রূপা দ্বারা উদ্দেশ্য খালিস স্বর্ণ-রূপা, সেটি মুদ্রা হতে পারে, যেমন স্বর্ণের জুনাই বা পরিশোধিত স্বর্ণও হতে পারে, যা দিয়ে এখনো গহনা তৈরি করা হয় নি। অনুরূপ আকরিক অর্থাৎ অশোধিত স্বর্ণ-রূপার বিধান।

মাসআলা: কেউ স্বর্ণ-রূপা দু’টি বস্তুর মালিক, একটিও নিসাব বরাবর নয়, সে কি স্বর্ণ-রূপা জমা করবে? অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপার বাজার দর যোগ করে যদি দেখে শুধু স্বর্ণ বা শুধু রূপার নিসাব বরাবর হয়, তার কি যাকাত দেওয়া ওয়াজিব?

আহলে ইলমদের বিশুদ্ধ মত মোতাবেক এই অবস্থায় স্বর্ণের সাথে রূপা যোগ করা জরুরি নয়, স্বর্ণ বা রূপা কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না স্বতন্ত্রভাবে স্বর্ণ বা রূপা যাকাতের নিসাব বরাবর হবে। কেননা বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, স্বর্ণ ও রূপা স্বতন্ত্র দু’টি বস্তু, একটির সাথে অপরটি যোগ করে নিসাব পূর্ণ করার কোনও দলীল নেই।

এ কথা নগদ অর্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অর্থাৎ কেউ যদি নগদ অর্থের মালিক হয়, যাকাতের নিসাব পূর্ণ করার জন্য স্বর্ণ বা রূপা বা ব্যবসায়ী পণ্যের সাথে নগদ অর্থ যোগ করা জরুরি। কারণ, যাকাতের সম্পদ বলতে যা বুঝানো হয়, অলঙ্কার, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্য তার অন্তর্ভুক্ত। এ কথার অর্থ স্বর্ণের যাকাত টাকা দিয়ে, টাকার যাকাত স্বর্ণ দিয়ে আদায় করা বৈধ। কারণ, একটি অপরটির প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব, কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও স্বর্ণ থাকে, একটির সাথে অপরটি যোগ করা জরুরি। অর্থাৎ স্বর্ণকে টাকার অংকে নিয়ে আসবে, অতঃপর নগদ অর্থ ও স্বর্ণের মূল্য হিসেব করবে, যদি নিসাব পরিমাণ হয় উভয়ের যাকাত দিবে, অর্থাৎ যৌথভাবে স্বর্ণ ও নগদ অর্থের যাকাত দিবে, যদি তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়। অনুরূপ কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও রূপা থাকে অথবা নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রূপা থাকে, সে স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ যোগ করে যাকাত দিবে, তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখবে যে, এক বস্তু থেকে একই বছর দু’বার যাকাত গ্রহণ করা যাবে না।

ব্যাংক নোট যেমন ডলার, জুনাই, রিয়াল ও অন্যান্য মুদ্রা, যা নগদ অর্থ হিসেবে পরিচিত। অনুরূপ অর্থের বিভিন্ন দলীল, যেমন চেক, বিল, বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র, যার বৈষয়িক মূল্য রয়েছে।

জ্ঞাতব্য যে, ব্যাংক নোট ও চেক মূলত তার মূল্যের দলীলস্বরূপ, অতএব, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। প্রতি হাজারে পঁচিশ টাকা যাকাত আসবে।

আরেকটি জিজ্ঞাসা, টাকার নিসাবের মানদণ্ড কি, স্বর্ণ, না-রূপার মূল্য?

উত্তর: রূপার নিসাবের মূল্যকে টাকার নিসাবের মানদণ্ড করাই উত্তম, অর্থাৎ ব্যাংক নোট, চেক ও অন্যান্য ডকুমেন্টের মূল্য যদি ৫৯৫ গ্রাম রূপার মূল্য বরাবর হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এভাবে যাকাত দেওয়া উত্তম কয়েকটি কারণে:

প্রথমত: এতে রয়েছে সতর্কতা ও দায়-মুক্তি, কেননা হতে পারে আল্লাহর নিকট রূপার মূল্যের ভিত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। কারণ, নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্য নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অপেক্ষা অনেক কম।

দ্বিতীয়ত: নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্যকে টাকার যাকাতের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে গরীবদের উপকার হয়। কারণ স্বর্ণ অপেক্ষা রূপার মূল্য কম। তাই রূপার নিসাবে যে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, স্বর্ণের নিসাবে সে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয় না। অতএব, রূপার নিসাবে যাকাত দানকারীর সংখ্যা বাড়বে, ফলে গরীবরা উপকৃত হবে। তবুও আমরা তাদেরকে তিরস্কার করি না, যারা দ্বিতীয় মতকে গ্রহণ করে স্বর্ণের মূল্য হিসেব করে যাকাত দিবেন। কারণ, মাসআলাটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ।

অতএব, মালিক যদি রূপার নিসাবের ভিত্তিতে যাকাত দেয়, প্রথম রূপার বাজার দর জানবে। উদাহরণত ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। কারণ, ৮০ ক্যারেট রূপা মানুষের মাঝে প্রচলিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর এক গ্রাম রূপার মূল্যকে ৫৯৫ দিয়ে গুণ দিবে, যে অংক আসবে সেটি রূপার নিসাবের মূল্য। এবার দেখবে রূপার নিসাবের মূল্য ও যাকাত দানকারীর স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ বরাবর কি না, যদি বরাবর বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ প্রত্যেক হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যা যাকাত দানকারীর মোট সম্পদের ২.৫%। উদাহরণত কেউ ১০০০০০ এক লক্ষ টাকার মালিক, তার যাকাত হবে: ১০০০০০* ২.৫%= ২৫০০ টাকা। যদি রূপার মূল্যকে মানদণ্ড মানা হয়।

আর যদি স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থের যাকাত বের করার সময় দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেক স্বর্ণের মূল্যকে যাকাতের মানদণ্ড মানা হয়, প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে। কারণ, এই ক্যারেট স্বর্ণ সবার নিকট পরিচিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে ৮৫ দিয়ে গুণ দিবে, গুণফল ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের বাজার মূল্য, যা স্বর্ণের নিসাব। যদি কারও স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ এই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেকও যাকাত ওয়াজিব হবে, অর্থাৎ প্রতি হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যেমন পূর্বে বলেছি।

আলিমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন যে, মানুষের নিকট যার যাকাতের নিসাব পরিমাণ ঋণ বা পাওনা আছে এবং সে ঋণের ওপর হিজরী এক বছরও পূর্ণ হয়েছে, তার যাকাত বের করা কি ওয়াজিব?

আলিমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ঋণের ওপর যাকাত নেই, ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত বা অনিশ্চিত যাই হোক। ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ স্বীকার করে, ভবিষ্যতে অস্বীকার করবে না এবং তার থেকে উসুল করাও সম্ভব। ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ অস্বীকার করে অথবা গরীব-ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য তার নেই অথবা ঋণ নিয়ে টালবাহানাকারী। এসব ক্ষেত্রে যাকাত নেই। কারণ, ঋণ তার পূর্ণ আয়ত্তে নেই, সে তাতে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে না, যেহেতু তার কাছে নেই, তবুও যারা বলেন, ঋণের ওপর যাকাত ফরয তাদের মতকে মূল্যহীন বলি না।

কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

১. মানুষের নিকট যাদের বকেয়া রয়েছে, সেই বকেয়ার সাথে যুক্ত হবে বকেয়া মাহর। অর্থাৎ বকেয়া মাহর স্বামীর ওপর স্ত্রীর ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপ ঋণ গণ্য হবে কাস্টমারের নিকট থাকা দোকানির অবশিষ্ট কিস্তি। এতদ ভিন্ন অন্যান্য ঋণের ওপরও যাকাত নেই, যতক্ষণ না মালিক তা হস্তগত করবে। হাতে পাওয়ার পর থেকে যখন এক বছর পূর্ণ হবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ মত। অনুরূপ কারও যদি সম্পদ থাকে, আর সে সম্পদ চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ, তার ওপর মালিকের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেই, যদি সম্পদ ফেরত পায় তবুও তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ওপর এক বছর পূর্ণ হবে। এটিই বিশুদ্ধ মত, যেমন ঋণ ফেরত পাওয়ার মাসআলায় বলেছি।

২. ঋণী ব্যক্তির মাসআলা: অর্থাৎ যার নিকট মানুষের ঋণ আছে, তার ঋণের ওপর যদি এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত দিবে কি না? উত্তর: হ্যাঁ, যাকাত দিবে, তবে ঋণের সম্পদ তার আয়ত্তে ও কর্তৃত্বে থাকা শর্ত।

৩. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর যদি যাকাত ফরয হয়, যেমন সে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রূপা অথবা ব্যবসায়ী পণ্যের মালিক, সে যাকাত দিবে, ঋণের কারণে তার যাকাত মওকুফ হবে না। এটি আলিমদের বিশুদ্ধতম মত। সে তার নিজের সম্পদের সাথে (যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে), ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ করবে, অতঃপর সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে। কারণ, তার আয়ত্তে থাকা সকল সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব, যার অন্তর্ভুক্ত ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থও।

৪. যদি যাকাত বের করার সময় ঋণ পরিশোধ করার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে আসে, আগে ঋণ পরিশোধ করবে। ঋণ পরিশোধ করার পর যদি যাকাতের নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপর যাকাত নেই, কারণ নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। অনুরূপ কারও ওপর মান্নত ওয়াজিব অথবা কাফফারা ওয়াজিব, যেমন যিহার বা কসমের কাফফারা। যদি কাফফারা আদায় বা মান্নত পুরো করার পর নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপরও যাকাত নেই, যদিও তার ওপর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। পুনরায় যখন নিসাব পরিমাণ হবে সঙ্গে-সঙ্গে যাকাত দিবে, হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করবে না। কারণ, আগেই তাতে বছর পূর্ণ হয়েছে। আহলে ইলমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৫. একটি প্রশ্ন: কোনও ফকিরের নিকট কারও পাওনা আছে, সে পাওনা মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে কি?

আলিমগণ এ মাসআলায় দু’টি মত পোষণ করেছেন:

এক. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে না।

দুই. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ অভিমত। হাসান বসরি রহ. এতে একটি শর্ত দিয়েছেন: “যে ঋণ সে মওকুফ করবে, তার থেকে কর্জ নেওয়া ঋণ হতে হবে”। দ্বিতীয়ত ঋণী ব্যক্তির যাকাতের হকদার হওয়া জরুরি। যাকাতের হকদার কারা সামনে তার বর্ণনা আসছে। অতএব, ব্যবসায়ী যদি কাস্টমারের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করে তবে তাতে যাকাত আদায় হবে না।

৬. যদি পাওনাদার ঋণগ্রস্ত ফকীরকে এই শর্তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা দিয়ে সে তার পাওনা পরিশোধ করবে, তাহলে কারও মতেই যাকাত আদায় হবে না। কারণ সে ফেরত বা রিটার্ন করার শর্তারোপ করেছে। যদি ঋণগ্রস্ত নিয়ত করে যাকাতের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ দিবে, আর যাকাত দানকারী এই নিয়তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা নিয়ে সে আমার ঋণ পরিশোধ করবে, তবে কেউ মুখে প্রকাশ করেনি, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে এবং ঋণগ্রস্ত ফকীরও ঋণ থেকে মুক্ত হবে, যদি ঋণ পরিশোধ করে।

৭. যদি বাড়ি নির্মাণ অথবা হজ অথবা বিবাহ অথবা কোনও উদ্দেশ্যে টাকা জমা করে, যা নিসাব পরিমাণ এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।

৮. ‘ঋণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কারও নিকট সাব্যস্ত পাওনা, যেমন কর্জ করা ঋণ, আসবাব-পত্র ক্রয় করার কিস্তি, বকেয়া ভাড়া, স্বামীর জিম্মায় স্ত্রীর মাহর ও স্ত্রীর জিম্মায় স্বামী থেকে খোলা করার বিনিময় (অর্থ বা কোনও কিছুর বিনিময়ে স্বামী থেকে স্ত্রীর বিচ্ছেদ গ্রহণকে খোলা বলা হয়)। এসব ক্ষেত্রে পাওনাদারের ওপর যাকাত নেই। আলিমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৯. যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, মালিক এখনো যার যাকাত আদায় করেনি, ইতোমধ্যে যদি নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, যেমন চুরি বা ধ্বংস হয় অথবা পুড়ে যায় অথবা পশু মরে নিসাব থেকে কমে যায় অথবা যে জন্যই হোক নিসাব থেকে সম্পদ হ্রাস হয়, এই অবস্থায় যাকাত দিতে হবে কিনা আহলে ইলমগণ দ্বিমত করেছেন। কেউ বলেছেন: যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কেউ বলেছেন: সম্পদ হ্রাসের ক্ষেত্রে যদি মালিকের সীমালঙ্ঘন অথবা অবহেলা দায়ী না হয় যাকাত দেওয়া ওয়াজিব নয়।

দু’টি মত থেকে প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ, সম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে মালিক দায়ী হোক বা না-হোক, যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কারণ, যাকাত আল্লাহর হক ও একটি ঋণ, নিসাবের ওপর এক বছর পূর্ণ হওয়ার সাথেই মালিকের ওপর আল্লাহর হক সাব্যস্ত হয়ে গেছে, যা আদায় করা ব্যতীত মওকুফ হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«فدَيْن اللهِ أحَقُّ أنْ يُقضَى».

“আল্লাহর ঋণ আদায় করার দাবি বেশি”।[1]

১০. যদি কেউ এক প্রকার সম্পদ একই শ্রেণির দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ দ্বারা বিনিময় করে, যেমন ২১ ক্যারেট স্বর্ণ ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দ্বারা বিনিময় করে অথবা টাকাকে ডলার করে অথবা পণ্য দিয়ে স্বর্ণ কিনে কিংবা স্বর্ণ দিয়ে পণ্য কিনে, এই অবস্থায় আগের পণ্য বা স্বর্ণের হিজরী বছর অব্যাহত থাকবে, বিনিময় করার কারণে বছর ভাঙ্গবে না। আর যদি এক শ্রেণির সম্পদ আরেক শ্রেণির সম্পদ দিয়ে বিনিময় করে, তাহলে আগের সম্পদের বছর অব্যাহত থাকবে না, নতুন সম্পদের জন্য নতুন বছর শুরু হবে। যেমন, কেউ মেষ বা বকরির মালিক, সে যদি এক জাতের মেষ বা বকরি দিয়ে আরেক জাতের মেষ বা বকরি বিনিময় করে, যার মূল্য নিসাব বরাবর বা তার চেয়ে বেশি, তাহলে পূর্বের বছর চলমান থাকবে। আর যদি বকরি বা মেষ দ্বারা গরু বা মহিষ বিনিময় করে, তখন পূর্বের বছর অব্যাহত থাকবে না, বরং গরু বা মহিষ থেকে নতুন বছর শুরু হবে।

এই নীতি থেকে ব্যবসায়ী পণ্য বাদ যাবে, সামনে তার আলোচনা আসছে। ব্যবসার এক পণ্য অপর পণ্য দিয়ে বিনিময় করলে বছর অব্যাহত থাকবে। যদি পূর্বের পণ্যের ব্যবসা ত্যাগ করে নতুন পণ্যের ব্যবসা আরম্ভ করে, তবুও বিশুদ্ধ মত মোতাবেক বছর অব্যাহত থাকবে। কারণ, ব্যবসার উদ্দেশ্য পণ্য বিনিময় করে সম্পদ বৃদ্ধি করা নির্দিষ্ট পণ্য মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।

আরেকটি জ্ঞাতব্য, স্বর্ণ ও রূপা দু’জাতের দু’টি মুদ্রা গণ্য করা হয়। আলিমদের বিশুদ্ধ মত এটি। অতএব, বছরের মাঝে কেউ যদি স্বর্ণ দিয়ে রূপা খরিদ করে অথবা রূপা দিয়ে স্বর্ণ খরিদ করে বছর ভেঙ্গে যাবে এবং বিনিময় করার পর থেকে নতুন বছর শুরু করবে।এক পণ্য দিয়ে অপর পণ্য বিনিময় করার উদ্দেশ্য যদি হয় যাকাত থেকে অব্যাহতি ও যাকাত ফাঁকি দেওয়া, তবে সে পাপী ও শাস্তির উপযুক্ত হবে।

[1] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

অর্থাৎ যেসব বস্তু দিয়ে ব্যবসা করা হয়, যেমন ব্যবসার নানা পণ্য, জমি, গাড়ি ও ব্যবসার অন্যান্য সামগ্রী। অধিকাংশ আলিম বলেন: ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব। এটিই বিশুদ্ধ মত।

ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ:

ক. মালিকানা পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া, যেমন ক্রয় বা হেবা বা মিরাস বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া। এটিই বিশুদ্ধ মত। অতএব, কেউ যদি ব্যবসায়ী পণ্যের আমানতদার বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা জিম্মাদার হয় তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।

খ. ব্যবসায়ী পণ্যের উদ্দেশ্য ব্যবসা হওয়া, যদি জমা ও ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে সম্পদের মালিক হয়, ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না।

গ. ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য স্বর্ণ বা রূপার নিসাব সমপরিমাণ হওয়া, অর্থাৎ সে যদি যাকাতের জন্য স্বর্ণের নিসাবকে গ্রহণ করে, তাহলে দেখবে তার ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য স্বর্ণের নিসাবের মূল্য বরাবর কি-না। আর যদি রূপার হিসেব আমলে নেয়, তাহলে দেখবে তার ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য রূপার নিসাবের মূল্য বরাবর কি-না।

ঘ. ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া।

কয়েকটি জরুরি বিষয়:

১. উদাহরণত কেউ যদি গাড়ি অথবা নিজের ব্যবহারের জন্য জমি অথবা বাড়ি নির্মাণ করার জন্য খরিদ করে, যা দিয়ে তার ব্যবসার নিয়ত ছিল না, অতঃপর প্রয়োজন না থাকায় অথবা অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সেটি বিক্রি করে দেয়, এতে উক্ত গাড়ি ও জমি ব্যবসায়ী পণ্য হবে না। কারণ, এগুলো ব্যবসার জন্য খরিদ করা হয় নি। অতএব, তাতে যাকাত নেই। আর যদি নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য কোনও বস্তু খরিদ করে অতঃপর সেটি দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যখন থেকে ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিবে তখন থেকে ব্যবসায়ী পণ্য হবে। তার নিসাব পরিমাণ মূল্যের ওপর যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত ওয়াজিব হবে।

২. ব্যবসায়ী পণ্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, প্রতি হিজরী বছর তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন, এটিই বিশুদ্ধ।

৩. যদি ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব হয়, নিম্নের নিয়মে যাকাত বের করবে:

প্রথমত: হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে ব্যবসার পণ্য পৃথক করবে, যেমন যাকাত দানকারীর নিকট যত মাল আছে সব মালের বর্তমান পাইকারি দর জানবে, অর্থাৎ যে মূল্য দিয়ে কিনেছে বা যে দামে বিক্রি করবে সেই দাম নয়, বরং বর্তমান দাম হিসেব করবে।

দ্বিতীয়ত: যাকাতের জন্য নিজের তরলমানি বা নগদ-ক্যাশ হিসেব করবে। যেমন, স্বর্ণ, রূপ ও নগদ অর্থ, তবে যার যাকাত দিয়েছে একই বছর তার ওপর দ্বিতীয়বার যাকাত ওয়াজিব হবে না। অতঃপর তার সাথে ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করবে, উদাহরণস্বরূপ যদি স্বর্ণ, রূপা ও নগদ অর্থ থাকে, স্বর্ণ ও রূপার মূল্য হিসেব করবে নিম্নের পদ্ধতিতে: একগ্রাম স্বর্ণের বাজার দরকে তার নিকট যত গ্রাম স্বর্ণ রয়েছে, সেই সংখ্যা দিয়ে পূরণ দিবে; একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে রূপার ক্ষেত্রে, অতঃপর স্বর্ণ ও রূপার মূল্যের সাথে যোগ করবে নগদ অর্থ, অতঃপর স্বর্ণ-রূপার মূল্য, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করবে। এভাবে পুরো সম্পদের যাকাত বের করবে, এক হাজার টাকা থেকে ২৫ টাকা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপার মূল্য, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য থেকে ২.৫ পার্সেন্ট যাকাত দিবে।

কেউ যদি স্বর্ণ ও রূপার ব্যবসা করে, সে স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিবে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে, যদি তার শর্ত পূরণ হয়। এ মাসআলায় ব্যবহারের অলঙ্কার যোগ হবে না, কারণ সেটি ব্যবসায়ী পণ্য নয়, অতএব, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

ক. যদি কারও নিকট ঋণ থাকে তার ওপর যাকাত নেই। এটি বিশুদ্ধ মত।

খ. কেউ যদি ঋণগ্রস্ত হয়, আর বছর শেষে ঋণ পরিশোধ করার সময় হয়, তবে আগে ঋণ দিবে, ঋণের যাকাত তার ওপর নেই। যদি ঋণ পরিশোধ করার সময় না হয়, তাহলে ঋণ এবং ঋণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করে যাকাত দিবে, কারণ তার মালিকানায় থাকা সকল সম্পদের যাকাত দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব।

গ. চলতি বছর ট্যাক্স, কাস্টমস, কর্মচারীদের বেতন, ঘর ভাড়া, ব্যক্তিগত ও সংসার খরচ বাবদ যা ব্যয় হয়েছে তার ওপর যাকাত নেই।

৪. জ্ঞাতব্য যে, ব্যবহারের আসবাব-পত্রে যাকাত নেই, অর্থাৎ যে ঘরে ব্যবসায়ী পণ্য রাখা হয় সে ঘরের যাকাত নেই। কারণ যাকাত ওয়াজিব হয় ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর। হ্যাঁ, কেউ যদি ঘরের ব্যবসা করে এবং এক বা একাধিক ঘরের মূল্য যাকাতের নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে, যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়।

অনুরূপ যেসব আসবাব-পত্র মূলধন, যেমন উৎপাদন যন্ত্র, মেশিন ও পরিবহন গাড়ি ইত্যাদির ওপর যাকাত নেই। অনুরূপ ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সির ওপর যাকাত নেই, তবে তার মুনাফায় যাকাত ওয়াজিব, যদি তার নিসাব পরিমাণ মুনাফার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়।

৫. কেউ এক পণ্যের ব্যবসা করে, অতঃপর যদি দ্বিতীয় পণ্যের ব্যবসা শুরু করে, কোন পণ্য থেকে বছর গুনবে?

এ মাসআলায় বিশুদ্ধ মত ও উত্তম পন্থা হচ্ছে প্রথম পণ্য থেকে বছর গণনা করা। কারণ, ব্যবসার ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যই আসল, পণ্য আসল নয়।

৬. ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত ব্যবসায়ী পণ্য দিয়ে দেওয়া বৈধ, অনুরূপ তার মূল্য দিয়ে দেওয়াও বৈধ।

৭. দু’জন ব্যক্তি এক পণ্যের ব্যবসা করে, তাদের কারও অংশই নিসাব পরিমাণ নয়, কিন্তু দু’জনের অংশ যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, এমতাবস্থায় তাদের কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না তাদের প্রত্যেকের অংশ যাকাতের নিসাব সমপরিমাণ হবে। হ্যাঁ, দু’জন থেকে যার অংশ নিসাব পরিমাণ হবে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, অপরের ওপর নয়।

বছরের মধ্যবর্তী উপার্জিত অর্থের হুকুম

আমরা পূর্বে জেনেছি যে, যার সম্পদ যাকাত পরিমাণ নয়, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, তবে যদি সম্পদ বৃদ্ধি পায়, যেমন ব্যবসায় মুনাফা হল বা পশু বাচ্চা জন্ম দিল ইত্যাদি, যা পূর্বের সম্পদের সাথে যোগ করলে নিসাব পরিমাণ হয়, ইতোপূর্বে যা নিসাব পরিমাণ ছিল না, তবে নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর থেকে হিজরী বছর গণনা শুরু করবে, যদি বছর শেষ হয় ও সম্পদ না কমে তবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

আর যদি বছরের মধ্যবর্তী বৃদ্ধি পাওয়া সম্পদ ছাড়াই শুরু থেকে নিসাব পরিমাণ থাকে, অতঃপর বছরের মাঝে মুনাফা হয় বা পশু বাচ্চা দেয়, তবে এই বর্ধিত সম্পদের যাকাত কীভাবে দিবে এ ব্যাপারে আহলে ইলমগণ মতভেদ করেছেন। অধিকাংশ আলিম বলেছেন, (তাদের কথাই বিশুদ্ধ) বর্ধিত সম্পদকে তিন ভাগ করবে:

১. বর্ধিত সম্পদ হয় মূল সম্পদ থেকে উৎপন্ন হবে, যেমন ব্যবসায়ী পণ্যের মুনাফা বা বছরের মাঝখানে পশুর জন্ম দেওয়া বাচ্চা ইত্যাদি। এ জাতীয় সম্পদ মূল সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং বছর শেষে সকল সম্পদের যাকাত দিবে। অর্থাৎ মূল সম্পদ এবং তার থেকে অর্জিত মুনাফার যাকাত দিবে, বছরের মাঝখানে অর্জিত সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়, যে দিন বর্ধিত হবে সে দিন থেকে মূল সম্পদের সাথে যুক্ত হবে এবং মূল সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়াই যথেষ্ট।

২. অথবা বর্ধিত সম্পদ অন্য খাত থেকে হাসিল হবে, যে খাত আগে তার মালিকানায় ছিল না। যেমন, সে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণের মালিক ছিল, অতঃপর বছরের মাঝে রূপার মালিক হয়েছে, এই রূপা স্বর্ণের সাথে যোগ করবে না, কারণ স্বর্ণ ও রূপা পৃথক দু’টি মুদ্রা। এটিই বিশুদ্ধ মত। যদি এই রূপা শুরু থেকে নিসাব পরিমাণ হয়, তার জন্য পৃথক বছর গণনা করবে, আর যদি নিসাব পরিমাণ না হয় তার ওপর যাকাত নেই।

৩. অথবা কেউ ৪০টি বকরির মালিক, যার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়েছে, অতঃপর সে আরও এক শো বকরি খরিদ করল বা কেউ তাকে হেবা করল, তবে হেবা বা ক্রয় করা বকরির ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে। অর্থাৎ চল্লিশটি বকরির ওপর বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিবে, ক্রয় বা হেবা সূত্রে মালিক হওয়া বকরির জন্য পৃথক বছর হিসেব করবে এবং সে হিসেবে তার যাকাত দিবে। এটি হাম্বলী ও শাফেঈ মতাবলম্বীদের অভিমত। আবু হানিফা বলেন: ক্রয় বা হেবা সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ পূর্বের সম্পদের সাথে যোগ করবে, অতঃপর সব সম্পদের যাকাত দিবে, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি।

বর্ধিত সম্পদের উদাহরণ:

১. যদি কারও নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, আর বছরের মাঝে স্বর্ণের ওপর ব্যবসায়ী পণ্য কিনে, তাহলে পণ্য মুনাফার অন্তর্ভুক্ত হবে, অর্থাৎ যখন স্বর্ণের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে, তখন স্বর্ণ ও ব্যবসায়ী পণ্য উভয় থেকে যাকাত বের করবে। প্রতি বছরই এরূপ করবে। অনুরূপভাবে কারও নিকট যদি নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, অতঃপর বছরের মাঝে নগদ অর্থ হাসিল করে, তবে স্বর্ণ ও নগদ অর্থের যাকাত দিবে। পূর্বের হালতসমূহে অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ যাই থাক, যার বছর পূর্ণ হবে, তার যাকাত বের করবে এবং মাঝখানে উপার্জন করা পণ্যকে তার মুনাফা জ্ঞান করবে।

২. যদি দু’জন ব্যক্তি মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসায় শরীক হয়, যেমন একজন নিসাব পরিমাণ সম্পদ দিল এই শর্তে যে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তা দিয়ে প্রথম ব্যক্তির স্বার্থে ব্যবসা করবে, অতঃপর উভয়ে ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করে। যখন মূলধনের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে, মূলধনের মালিক বা প্রথম পক্ষের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, সে মূলধন ও মুনাফার যাকাত দিবে, কারণ নিসাব পরিমাণ মূলধনের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়েছে, তার মুনাফার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়, তাই মূলধনের সাথে মুনাফা যোগ করে মুনাফার যাকাত দিবে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে প্রথম ব্যক্তির সম্পদ দিয়ে মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করছে, তার মুনাফার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যদি তাতে যাকাতের নিসাব পরিমাণ না হয়।

প্রথমত: গুপ্তধনের সংজ্ঞা: অধিকাংশ আলিম বলেছেন, ­—আর তাদের সংজ্ঞাটিই বিশুদ্ধ: গুপ্তধন বলতে জমিনে পুতে রাখা সকল সম্পদকে বুঝানো হয়, যেমন প্রত্নতত্ত্ব, স্বর্ণ, রূপা, সীসা, পিতল, বাসন-কোসন ও অন্যান্য আসবাব-পত্র, তবে জাহিলি যুগের হওয়া শর্ত, অর্থাৎ নিশ্চিত হতে হবে যে, গুপ্তধন ইসলামের পূর্বযুগে মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে, (গুপ্তধনের গায়ের তারিখ ও অন্যান্য নিদর্শন দেখে যা বুঝা যায়) অতঃপর কেউ নিজের জমি খনন করতে গিয়ে তার সন্ধান পায়। যেমন, ঘরের খুঁটি অথবা কুপ অথবা কোনও খনন কাজে বেরিয়ে আসে। আর যদি গুপ্তধন বের করতে টাকা-পয়সা ব্যয় হয় তখন সেটি গুপ্তধন থাকবে না, যাকাতের সম্পদের ন্যায় সাধারণ সম্পদ গণ্য হবে, যেমন পূর্বে বলেছি।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যদি এই জমি, (যেখানে গুপ্তধন পাওয়া গেছে) কারও থেকে ক্রয় করা হয়, আর গুপ্তধনে প্রমাণ থাকে যে, যার থেকে জমি ক্রয় করা হয়েছে তারই এই সম্পদ, তখন বিক্রেতাকে সম্পদ ফেরত দেওয়া জরুরি, আর তখন সে ব্যক্তিই তার যাকাত দিবে। অনুরূপ জমি যদি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন হয়, আর রাষ্ট্র কাউকে লিজ বা ভাড়া দেয়, তাহলে রাষ্ট্রকে গুপ্তধন ফেরত দেওয়া জরুরি, রাষ্ট্র তার যাকাত দিবে।

আর যদি জানা যায় গুপ্তধন ইসলাম বিকাশ লাভ করার পর মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে, তাহলে এই প্রাপ্তধন গুপ্তধন হবে না, বরং কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদ হবে, অর্থাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদের ন্যায় গণমাধ্যমে তার এক বছর ঘোষণা দিবে, (অমুক সম্পদ অমুক জায়গায় পাওয়া গেছে) যেন মালিক পর্যন্ত ঘোষণা পৌঁছে যায়, যদি নিদর্শন দ্বারা মালিকের পরিচয় পাওয়া যায় তবে তাকে ফেরত দেওয়া ওয়াজিব, অন্যথায় সে নিজেই তার মালিক হবে এবং নিসাব বরাবর হলে তার যাকাত দিবে, কারণ এটি জাহিলি যুগের গুপ্তধন নয়।[1]

দ্বিতীয়ত: গুপ্তধন থেকে যাকাত দেওয়ার পরিমাণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: وفي الرِّكَاز: الخُمس “গুপ্তধনের যাকাত এক পঞ্চমাংশ”।[2] অর্থাৎ যে গুপ্তধন পাবে সে গুপ্তধন থেকে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিবে। অধিকাংশ আলিম বলেছেন: যে গুপ্তধন পাবে তার দায়িত্ব এক পঞ্চমাংশ যাকাত বের করা, সে মুসলিম হোক বা মুসলিম দেশে বসবাসকারী যিম্মি হোক। গুপ্তধন প্রাপককে মুসলিম শাসক বাধ্য করবেন, যেন রাষ্ট্রের নিকট এক পঞ্চমাংশ যাকাত হস্তান্তর করে, সে ছোট, বড়, সুস্থ বা পাগল যাই হোক। এটি বিশুদ্ধ মত, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী وفي الرِّكَاز: الخُمس ব্যাপক: ছোট-বড়-সুস্থ-পাগল সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে। আরেকটি বিষয় জানা প্রয়োজন যে, হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় পাঁচভাগ থেকে অবশিষ্ট চার ভাগ প্রাপকের হক।

তৃতীয়ত: গুপ্তধনের নিসাব: হাদীসের বাহ্যিক অর্থ বলে, গুপ্তধনে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নিসাব শর্ত নয়। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন। অতএব, যে জাহিলি যুগের গুপ্তধন পাবে, সে তার এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিবে, তার পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক।

চতুর্থত: এক পঞ্চমাংশ গুপ্তধনের হকদার: গুপ্তধনের খাত হাদীসে নির্ণয় করা হয়নি, তাই ফকিহগণ ইখতিলাফ করেছেন: গুপ্তধন থেকে এক পঞ্চমাংশ যাকাতের আট খাতে ব্যয় করবে, না গণিমতের ন্যায় জনস্বার্থে ব্যয় করবে?

বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, এক পঞ্চমাংশ জনস্বার্থে ব্যয় করবে, অর্থাৎ মুসলিম শাসক তার খাত নির্ণয় করবে, যেখানে স্বার্থ দেখবে সেখানে ব্যয় করবে।[3]পঞ্চমত: গুপ্তধন থেকে এক পঞ্চমাংশ বের করার সময়: হাদীসের বাহ্যিক অর্থ বলছে যে, গুপ্তধন থেকে এক পঞ্চমাংশ বের করার জন্য বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়, বরং যখন পাবে তখন তার এক পঞ্চমাংশ যাকাত দিবে, এতে কারও দ্বিমত নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:وفي الرِّكَاز: الخُمس গুপ্তধনে এক-পঞ্চমাংশ ওয়াজিব। এতে তিনি বছর পূর্ণ হওয়ার শর্তারোপ করেন নি।

>
[1] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/৯৬-৯৭)।

[2] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

[3] তামামুল মিন্নাহ ফিত-তালিক আলা ফিকহিস-সুন্নাহ: (পৃ. ২৭৮)।

এ অধ্যায় দ্বারা উদ্দেশ্য উট, গরু ও বকরির যাকাত। কারণ, এসব প্রাণী ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীর যাকাতের কথা হাদীসে উল্লেখ নেই। অতএব, সাধারণ পাখি, মুরগি, ঘোড়া, গাধা, খরগোশ ও অন্যান্য প্রাণীতে যাকাত নেই, তার সংখ্যা যত বেশি হোক, তবে কোনও প্রাণী ব্যবসার জন্য নির্ধারিত হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। চতুষ্পদ প্রাণীর যাকাতের জন্য শর্তসমূহ:

১. নিসাব পরিমাণ হওয়া, যার ব্যাখ্যা সামনে আসছে।

২. হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া।

৩. যাকাতের পশু সায়েমা হওয়া। (সায়েমার সংজ্ঞা নিম্নের প্যারাতে আসছে)

পশু যদি মালিকের কেটে আনা ঘাস খায়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, অধিকাংশ আলেমের মত এটি। আর যদি ব্যবসার জন্য পশু লালন-পালন করা হয় ব্যবসার পণ্য হবে, তাদের লালন-পালন যেভাবেই হোক না কেন। তবে লক্ষণীয় যে, কেউ যদি নিজের জমি চাষ করার জন্য পশু পালন করে তাতে যাকাত নেই, কারণ এগুলো সায়েমা নয়, গৃহপালিত পশুও ব্যবহারের আসবাব-পত্রের ন্যায়। আলিমদের বিশুদ্ধ মত এটি। কারণ সায়েমা পশুর ওপর যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ যেসব পশু মাঠে-জঙ্গলে ও পাহাড়ে চরে বেড়ায় এবং বছরের অধিকাংশ দিন প্রাকৃতিক ঘাস ও তৃণলতা খায় সেসব পশুই কেবল ‘সায়েমা’।

নিম্নে উট, গরু ও বকরির যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ দেওয়া হল:

ক. সায়েমা উটে যাকাতের নিসাব ও তার পরিমাণ শরী‘আত নির্ধারণ করে দিয়েছে, নীচের চার্টে দেখুন:

ক্র.

উটের সংখ্যা

যাকাতের পরিমাণ

১.

১-৪

যাকাত নেই, চাইলে নফল সদকা করবে।

২.

৫-৯

একটি বকরি: ছাগল বা মেষ

৩.

১০-১৪

দু’টি বকরি

৪.

১৫-১৯

তিনটি বকরি

৫.

২০-২৪

চারটি বকরি, মালিকের সুবিধা হলে চারটি বকরির স্থানে একটি উট দিবে।

৬.

২৫-৩৫

বিনতু মাখাধ মাদী: দ্বিতীয় বছরের উটনী।

৭.

৩৬-৪৫

বিনতু লাবুন মাদী: তৃতীয় বছরের উটনী।

৮.

৪৬-৬০

একটি হিক্কাহ: চতুর্থ বছরের উটনী।

৯.

৬১-৭৫

একটি জিয‘আহ: পঞ্চম বছরের উটনী।

১০.

৭৬-৯০

দু’টি বিনতু লাবুন।

১১.

৯১-১২০

দু’টি হিককাহ।

জ্ঞাতব্য: উটের সংখ্যা যদি (১২০) থেকে বেশি হয়, তখন প্রত্যেক ৪০ অংকের জন্য একটি বিনতু লাবুন এবং প্রত্যেক পঞ্চাশ অংকের জন্য একটি হিক্কাহ যাকাত দিবে। উট যত বেশি হোক এভাবে (৪০ ও ৫০) দু’টি সংখ্যায় ভাগ করবে, যেমন:

উট সংখ্যা

৪০ ও ৫০ সংখ্যা

যাকাতের পরিমাণ

১৩০

১৩০=(২*৪০)+(৫০)=

২ বিনতু লাবুন ও ১ হিককাহ

১৪০

১৪০=(২*৫০)+(৪০)=

২ হিককাহ ও ১ বিনতু লাবুন

১৫০

১৫০=(৩*৫০)=

৩ হিককাহ

১৬০

১৬০=(৪*৪০)=

৪ বিনতু লাবুন

১৭০

১৭০=(৩*৪০)+(৫০)=

৩ বিনতু লাবুন ও ১ হিককাহ

১৮০

১৮০=(২*৫০)+(২*৪০)=

২ হিককাহ ও ২ বিনতু লাবুন

১৯০

১৯০=(৩*৫০)+(৪০)=

৩ হিককাহ ও ১ বিনতু লাবুন

২০০

২০০=(৪*৫০)= অথবা

২০০=(৫*৪০)=

৪ হিককাহ অথবা

৫ বিনতু লাবুন

২. যদি নির্দিষ্ট বছরের উট মালিকের ওপর ওয়াজিব হয়, যেমন চার্টে আমরা স্পষ্ট করেছি, আর সে বয়সের উট না থাকে, বরং কম বয়সের উট থাকে, যেমন একটি জিয‘আহ (চার বছরের উট) যাকাত ওয়াজিব হয়েছে কিন্তু তার নিকট জিয‘আহ নেই, আছে বিনতু লাবুন অর্থাৎ দুই বছরের উট, অথবা কারও ওপর দুই বছরের বিনতু লাবুন ওয়াজিব, কিন্তু তার নিকট বিনতু লাবুন নেই, আছে বিনতু মাখাধ অর্থাৎ এক বছরের উট, এই অবস্থায় তার থেকে কম বয়সের উট এবং তার সাথে দু’টি বকরি অথবা দু’টি বকরির বাজার দর গ্রহণ করা হবে, যে কোনো একটি গ্রহণ করলে সমস্যা নেই।[1] এটাকে বলা হয় (جُبرَان) অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ।

৩. উপরের অবস্থার বিপরীত, মালিকের ওপর কম বয়সের উট ওয়াজিব, কিন্তু সেই বয়সের উট নেই, তার চেয়ে বেশি বয়সের উট আছে, যেমন বিনতু মাখাধ ওয়াজিব, কিন্তু বিনতু মাখাধ নেই, বিনতু লাবুন আছে। অথবা বিনতু লাবুন ওয়াজিব, কিন্তু বিনতু লাবুন নেই, তার চেয়ে বেশি বয়সের হিককাহ আছে। অথবা হিককাহ ওয়াজিব, কিন্তু হিককাহ নেই, তার চেয়ে বেশি বয়সের জিয‘আহ আছে। এসব অবস্থায় বেশি বয়সের উট গ্রহণ করবে, আর বেশির বিনিময় যাকাত উসুলকারী থেকে মালিক দু’টি বকরি অথবা তার মূল্য গ্রহণ করবে, যাকাত উসুলকারী যা-ই দিবে গ্রহণ করবে। যাকাত উসুলকারী বর্তমান যুগে অনেকটা ট্যাক্স উসুলকারীর ন্যায়।

৪. যে প্রকার উট যাকাত দাতার ওপর ওয়াজিব, যদি সে প্রকার থেকে সরাসরি নিচের স্তর অথবা সরাসরি তার উপরের স্তরের উট পাওয়া না যায়, বরং এক স্তর থেকে নীচের উট অথবা এক স্তর থেকে উপরের উট পাওয়া যায়, তাহলে মালিককে নির্দিষ্ট প্রকার উট হাযির করতে বাধ্য করা হবে। যেমন কারও ওপর জিয‘আহ ওয়াজিব, কিন্তু জিয‘আহ নেই এবং সরাসরি তার নীচের স্তরের উট, অর্থাৎ হিককাহও নেই, তবে এক স্তর থেকে নীচের উট অর্থাৎ বিনতু লাবুন আছে। এই অবস্থায় মালিক থেকে বিনতু লাবুন গ্রহণ করা হবে না, বরং নির্ধারিত উট হাযির করতে তাকে বাধ্য করবে। অনুরূপ কারও ওপর বিনতু মাখাধ ওয়াজিব, কিন্তু বিনতু মাখাধ নেই এবং সরাসরি তার উপরের স্তরের উট, অর্থাৎ বিনতু লাবুনও নেই, তবে এক স্তর থেকে উপরের উট, অর্থাৎ হিককাহ বা জিয‘আহ আছে। এই অবস্থায় তার থেকে উট গ্রহণ করা হবে না, বরং নির্দিষ্ট প্রকার উট হাজির করতে তাকে বাধ্য করা হবে, তবে মালিক যদি নিজের ইচ্ছায় এক স্তর থেকে উপরের উট প্রদান করে, তখন তা গ্রহণ করতে সমস্যা নেই।

৫. যাকাত হিসেবে যার ওপর উট ওয়াজিব, সে উপরের বর্ণনা মোতাবেক উট দিবে, উটের মূল্য পরিশোধ করা যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে যা ওয়াজিব হয় তার পরিবর্তে অন্য বস্তু প্রদান করা যথেষ্ট নয়, যেমন উটের পরিবর্তে গরু দেওয়া যথেষ্ট নয়।

ইবন তাইমিয়াহ রহ. মনে করেন, মুসলিমদের উপকার ও প্রয়োজন হলে মূল্য দিয়ে যাকাত দেওয়া বৈধ। যেমন, কারও ওপর উটের যাকাত বকরি ওয়াজিব, তার নিকট বকরি নেই, সে তার মূল্য দিলে যথেষ্ট হবে। বকরি ক্রয় করার জন্য তাকে সফর করতে বাধ্য করবে না অথবা তার ঘনিষ্ঠ কেউ যাকাতের হকদার, সে পশুর যাকাতের মূল্য চায়, মূল্যই তার জন্য উপকারী, এমন হলে তাকে মূল্য দেওয়া বৈধ।[2]

শাইখ আদিল আয্যাযী বলেন: “ইখতিলাফ থেকে বাচার জন্য শিথিলতা ত্যাগ করে নির্দিষ্ট বস্তু দিয়ে যাকাত দেওয়াই উত্তম”। অনুরূপ ফসলের যাকাত, প্রয়োজন ব্যতীত মূল্য দিয়ে পরিশোধ না করাই শ্রেয়।

খ. বকরির যাকাত: বকরির নিসাব নর বা মাদী ৪০টি বকরি। বকরি মেষকেও শামিল করে। অতএব, বকরি ও মেষের যাকাত নিম্নরূপ:

ক্র.

বকরি / মেষের সংখ্যা

যাকাতের পরিমাণ

১.

১-৩৯

যাকাত নেই, চাইলে সদকা করবে।

২.

৪০-১২০

১ বকরি।

১২১-২০০

২ বকরি।

২০১-৩০০

৩ বকরি।

বকরি যদি ৩০০ থেকে অধিক হয়, প্রতি একশো থেকে একটি বকরি যাকাত দিবে। অর্থাৎ বকরি ৪০০ হওয়ার আগে চারটি বকরি ওয়াজিব হবে না, অতএব, ৩৯৯টি বকরি পর্যন্ত তিনটি বকরি ওয়াজিব হবে, বকরির সংখ্যা যখন ৪০০ হবে ৪টি বকরি ওয়াজিব হবে ৪৯৯টি পর্যন্ত। এভাবে উপরের দিকে অগ্রসর হবে।

লক্ষণীয় যে, সায়েমা বা স্বাধীনভাবে বিচরণকারী পশুর ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ফরয হয়। আরেকটি বিষয়, ইতোপূর্বে বকরির যে নিসাব বলেছি সে নিসাব বরাবর হলে যাকাত ফরয হবে। পালের সব বকরি হোক, বা পালের সব মেষ হোক, বা পালের কতক বকরি ও কতক মেষ যেভাবে নিসাব পূর্ণ হবে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

যাকাত হিসেবে যে বকরি ওয়াজিব হয়, তার অবশ্যই দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করা জরুরি। এক বছর পূর্ণ হয়নি এরূপ মেষকে ‘জিয‘আহ’ বলা হয়, আবার কেউ ছয় মাস বা কেউ আট মাসের মেষকে জিয‘আহ বলেছেন।

আরেকটি জরুরি বিষয়, যাকাত হিসেবে যা ওয়াজিব হয় সেটি মেষ বা বকরি আবার নর বা মাদী যাই পরিশোধ করা হোক কোনো সমস্যা নেই। যাকাতের বকরি নিজের পাল বা অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করে দেওয়ার অনুমতি আছে, সেটি খরিদ বা ঋণ করে যেভাবে হোক। অধিক বয়স্ক অথবা ত্রুটিযুক্ত অথবা পাঠা যাকাত হিসেবে দিবে না, তবে যাকাত উসুলকারী চাইলে সেটি গ্রহণ করতে সমস্যা নেই।

যাকাত উসুলকারী সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর পশু উসুল করবে না, যেমন বেশি বাচ্চাদানকারী অথবা বেশি মোটা-তাজা অথবা গর্ভবতী পশু। অনুরূপ নর-ছাগল নিবে না, তবে মালিক দিতে চাইলে গ্রহণ করতে সমস্যা নেই। যাকাত হিসেবে দু’বছরের বকরি অথবা আট-নয় মাসের মেষ উসুল করবে।

গ. গরুর যাকাত: গরুর যাকাতের নিসাব ৩০টি গরু। নর-মাদী উভয় প্রকার কিংবা শুধু মাদী বা শুধু নর যাই হোক ৩০টি গরু হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। নিসাব পরিমাণ গরুর ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে একটি তাবি বা তাবি‘আহ অর্থাৎ এক বছরের নর বা মাদী গরু যাকাত দিবে। তারপর প্রতি ৪০টি গরু থেকে একটি মুসিন্নাহ অর্থাৎ দুই বছরের গরু যাকাত দিবে। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন। গরু যত বেশি হোক ৩০ ও ৪০ দু’টি সংখ্যায় অর্থাৎ তিন দশক ও চার দশক করে ভাগ করবে:

ক্র.

গরুর সংখ্যা

যাকাতের পরিমাণ

১.

১-২৯

যাকাত নেই

২.

৩০-৩৯

১টি তাবি বা তাবিআহ (১ বছরের গরু)

৩.

৪০-৫৯

১টি মুসিন্নাহ (২-বছরের গরু)

৪.

৬০

৬০=(৩০*২)= দু’টি তাবি/তাবিআহ (নর-মাদী)

৫.

৭০

৭০=(৩০+৪০)= ১টি তাবিআহ ও ১টি মুসিন্নাহ

৬.

১০০

১০০=(৩০*২)+৪০= ২টি তাবিআহ ও ১টি মুসিন্নাহ

আরেকটি মাসআলা জানা জরুরি যে, যদি মনে করি কারও ৬৫ টি গরু আছে, সে ৬০টি গরুর যাকাত দিবে, পূর্বে বলেছি, ষাটের অতিরিক্ত ৫টি গরুর যাকাত নেই।

কয়েকটি জরুরি জ্ঞাতব্য:

১. গরুর ক্ষেত্রে সায়েমাহ হওয়া শর্ত কি না, আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিশুদ্ধ মতে অন্যান্য পশুর মত গরুরও সায়েমাহ হওয়া জরুরি।

২. উটের ন্যায় গরুর ক্ষেত্রে جُبران তথা ক্ষতিপূরণ নেই, যে গরু ওয়াজিব যদি সেটি তার কাছে না থাকে, ক্রয় করে বা ঋণ করে যেভাবে হোক হাজির করবে, কম বা বেশি বয়সী গরু গ্রহণ করা হবে না, তবে মালিক বেশি বয়সের গরু স্বেচ্ছায় দিলে যাকাত উসুলকারীর তা নিতে সমস্যা নেই।

৩. তাবি‘ অর্থাৎ এক বছরের গরু অথবা মুসিন্নাহ অর্থাৎ দু’বছরের গরু নর-মাদী উভয় গ্রহণ করা বৈধ।

৪. লক্ষণীয় যে, মহিষও এক প্রকার গরু। যদি গরু ও মহিষের মালিক হয় গণনার সময় একটির সাথে অপরটি যোগ করবে, যেমনটি বকরি ও মেষের ক্ষেত্রে যোগ করা হয়, অতঃপর হিজরী এক বছর হলে যাকাত দিবে।

৫. বাছুর ও উটের বাচ্চার দু’টি অবস্থা:

ক. কেউ যদি নিসাব পরিমাণ উট বা গরু বা বকরির মালিক হয়, অতঃপর হিজরী বছরের মাঝে কতিপয় পশু বাচ্চা দেয়, অধিকাংশ আলিম বলেন: বাচ্চা তাদের মায়ের সাথে গণনা করা হবে, তবে যাকাত ছোট বাচ্চা দিয়ে দিবে না, বড় পশু দিয়েই দিবে।

খ. যদি ছোট পশু নিসাব পরিমাণ থাকে এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, একদল আলিম বলেন: এতে যাকাত নেই, কিন্তু অধিকাংশ আলিম বলেন: তাতে যাকাত ওয়াজিব, তবে ছোট পশু দিয়েই যাকাত দিবে। এটিই বিশুদ্ধ মত।

ইবন তাইমিয়াহ রহ. এসব অভিমত উল্লেখ করে বলেন: “... যদি সবপশু ছোট হয়, কেউ বলেছেন: ছোট পশু দিবে। আর কেউ বলেছেন: বড় পশু কিনে দিবে”।[3]

৬. আলিমদের প্রসিদ্ধ মতে, যৌথ মালিকানা পশুর যাকাতে ভূমিকা রাখে, অর্থাৎ যৌথ মালিকানার কারণে পশুর যাকাত হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, যেমন তিন জন প্রতিবেশী প্রত্যেকে ৪০টি করে বকরির মালিক, সবাই একটি করে বকরি যাকাত দিবে এটিই স্বাভাবিক, অর্থাৎ তিনজন তিনটি বকরি যাকাত দিবে। কিন্তু যাকাত উসুলকারী আসার পর যদি তিনজনের বকরি এক জায়গায় করে পেশ করে ১২০টি বকরি হয়, যার যাকাত মাত্র একটি বকরি। বকরির যাকাতের চার্ট দেখুন। অথবা দু’জন শরীক যৌথভাবে ৪০টি বকরির মালিক, কিন্তু যাকাত উসুলকারী আসার পর যদি তারা ভাগ করে নেয়, একজন ২০টি করে পায়, ফলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হয় না, অথচ তাদের ওপর একটি বকরি ওয়াজিব, যেমন চার্টে বলেছি। যাকাত থেকে নিষ্কৃতির জন্য এরূপ বাহানা করা হারাম। অতএব, পশু যোগ বা ভাগ করার উদ্দেশ্য যদি হয় যাকাত হ্রাস বা রহিত করা, তাহলে এরূপ করা হারাম এবং অভিযুক্তরা শাস্তির উপযুক্ত।

কয়েকটি জরুরি বিষয়:

১. শাইখ ইবন উসাইমীন রহ. বলেন: পশু ব্যতীত অন্যান্য সম্পদ যোগ করলে যাকাতে প্রভাব পড়ে না। অতঃপর তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন: দু’জন ব্যক্তি ফসলি জমি অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, উভয়ের সম্পদ যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ, কিন্তু পৃথকভাবে প্রত্যেকের সম্পদ নিসাব পরিমাণ নয়। অতএব, তাদের ওপর যাকাত নেই।[4]

২. জ্ঞাতব্য, পশুর যাকাত পশুর স্থান থেকে গ্রহণ করবে, যেমন যাকাত উসুলকারী পশুর জায়গায় চলে যাবে, মালিককে উসুলকারীর জায়গায় পশু হাজির করতে বাধ্য করবে না।

>
[1] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/৬০)।

[2] দেখুন: আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যাহ: (পৃ. ১৮৪)।

[3] দেখুন: আল-ফাতাওয়া: (২৫/৩৭)।

[4] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/৭০)।

১. কোন কোন ফসলের ওপর যাকাত ওয়াজিব?

হাদীসে যেসব ফসলের নাম উল্লেখ করে যাকাত নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো চার প্রকার: ক. الحِنطة বা গম, খ. الشعير বা যব, গ. التمر বা খেজুর, ও ঘ. الزبيب বা কিশমিশ।

জ্ঞাতব্য যে, এই চার প্রকার ব্যতীত অন্যান্য ফল ও ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে কি না আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন, বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, (আল্লাহ ভালো জানেন) যেসব ফল ও ফসল খাদ্য ও সঞ্চয় করার উপযুক্ত তাতে যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করলে নষ্ট হয় না, যেমন ভুট্টা, চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য। অতএব, শাক-সবজি, জয়তুন ও ফলের ভেতর যাকাত নেই, কাঁচা খেজুর ব্যতীত [কারণ তা সঞ্চয় করা যায়], অনুরূপ আঙ্গুর ব্যতীত। কারণ, আঙ্গুর সঞ্চয় [করা যায়, তা সঞ্চয়] করলে কিশমিশ হয়।

ফল ও ফসলের যাকাতের নিসাব: অধিকাংশ আলিম বলেছেন: ফল ও ফসলের নিসাব পাঁচ ওসাক[1], যা সাধারণত ৬৪৭ কেজি হয়। লক্ষণীয় যে, এই পরিমাপ করবে শস্য খোসা থেকে পরিস্কার করার পর। অনুরূপ ফল শুকানোর পর। উদাহরণত কারও ১০ ওসাক আঙ্গুর আছে, শুকানোর পর যদি পাঁচ ওসাক থেকে কম হয়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, কারণ নিসাব পর্যন্ত পৌঁছেনি, অর্থাৎ পাঁচ ওসাক।[2]

যদি ফল ও ফসল খোসাসহ গুদামজাত করা হয়, বিশুদ্ধ মতে অভিজ্ঞগণ চিন্তা করে বলবেন খোসা থেকে পরিস্কার করা হলে কি পরিমাণ ফসল টিকবে, যদি পাঁচ ওসাক বা তার চেয়ে বেশি টিকে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।[3]

ফসলে যাকাতের পরিমাণ: দশ ভাগের একভাগ ফসল যাকাত দেওয়া ওয়াজিব, অর্থাৎ মোট ফল ও ফসলের ১০% যাকাত দিবে, যদি প্রাকৃতিক সেচ দিয়ে বিনা খরচে ফসল উৎপন্ন হয়, যেমন নদী-খাল ও বৃষ্টির পানির ফসল। অনুরূপ যে গাছগাছালি লম্বা শিকড় দিয়ে দূর থেকে পানি চুষে নেয়, সেচ করার প্রয়োজন হয় না তার হুকুমও এক, যেমন খেজুর গাছ। আর যদি ফল ও ফসলের জমি টাকা খরচ করে সেচ করা হয়, যেমন মেশিন দিয়ে সেচ করা হয়, তার ৫% অর্থাৎ এক দশমাংশের অর্ধেক বা বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিবে। চার ইমামের মাযহাব এটি, এতে কেউ দ্বিমত করেন নি।

ফল ও ফসলের যাকাত দেওয়ার সময়: বিশুদ্ধ মতে, ফল যখন ব্যবহার উপযোগী হয় ও পেকে যায়, যেমন ফলের আঁটি শক্ত বা খেজুর লাল হয়, তখন তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, তবে যখন ফসল খোসা থেকে পরিস্কার করবে বা তাতে মেশিন লাগাবে, তখন আদায় করবে, অনুরূপ খেজুর শুকানোর পর তার যাকাত দিবে।

জ্ঞাতব্য যে, ফসল নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর মালিক যেভাবে ইচ্ছা তাতে কর্তৃত্ব করতে পারবে, যেমন বেচা ও হেবা করা ইত্যাদি। যদি ফল উপযুক্ত হওয়ার পর মালিক সেখান থেকে বেচে বা কাউকে হেবা করে, বিশুদ্ধ মতে তার যাকাত মালিকের ওপর ওয়াজিব হবে, অর্থাৎ বিক্রেতার ওপর। কারণ, যখন সে ফল/ফসলের মালিক ছিল, তখন যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। এখন চাইলে ফসল কিনে যাকাত দিবে বা সহজতার জন্য টাকাও দিতে পারবে। আর যদি ফল উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে বেচে দেয় কিংবা হেবা করে, অতঃপর ক্রেতা কিংবা দান গ্রহীতার কাছে ফল বা ফসল উপযুক্ত হয়, ক্রেতা বা দান গ্রহীতার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি যাকাত পরিমাণ হয়।[4]জ্ঞাতব্য যে, মালিকের হস্তক্ষেপ বা সীমালঙ্ঘন ছাড়া যদি ফল বা ফসল ধ্বংস হয় তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর মালিক নিজে ধ্বংস করে, তবে তার ওপর থেকে যাকাত মওকুফ হবে না। যদি সে দাবি করে সীমালঙ্ঘন ছাড়া নষ্ট হয়েছে, বিশুদ্ধ মতে তার কথা গ্রহণযোগ্য হবে, কসম নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইমাম আহমদ বলেছেন: সদকার জন্য কসম গ্রহণ করা যাবে না।

>
[1] এক ওসাক ৬০ ‘সা’, তাই ৫ ওসাক ৩০০ ‘সা’ হয়, অথবা অধিকাংশ আলেমের দৃষ্টিতে ৩০০ ‘সা’ ৬৫৩ কেজি, যদি এক ‘সা’-কে ২১৭৫ গ্রাম ধরা হয়। কেউ এক ‘সা’-র পরিমাণ করেছেন ২.৫ কেজি, বা ২৫০০ গ্রাম। সে হিসেবে ৩০০ ‘সা’ ৭৫০ কেজি হয়, অর্থাৎ ১৮ মন ৩০ কেজি। এক ‘সা’ এর প্রকৃত হিসেবে আমরা ০০ নং পৃষ্ঠায় করে এসেছি, অর্থাৎ মাঝারি সাইজের মানুষের দুই হাতের চার খাবরি/আঁজলা/অঞ্জলি হচ্ছে এক ‘সা’। এই হিসেবে বিভিন্ন শস্যের এক ‘সা’ এর ওজন কম-বেশী হয়। কারণ চার খাবরি চাউল ও ভুট্টার ওজন এক নয়। কেউ যদি নিজের ফসলের যথাযথ পাঁচ ওসাক দিতে চায়, সে সংশ্লিষ্ট ফসল থেকে চার খাবরি নিয়ে আগে এক ‘সা’ নির্ণয় করবে, যেই ওজন হবে তার ষাট গুণ এক ওসাক, এভাবে পাঁচ ওসাক হলে যাকাত দিবে। এই নীতি মনে রাখলে ফল ও ফসলের যাকাতের জন্য কারও দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হবে না, এবং পরিমাপ নিয়ে সংশয়ও থাকবে না। -অনুবাদক।

[2] দেখুন: আল-মুগনি: (২/৬৯৬)।

[3] দেখুন: আল-মুগনি: (২/৬৯৬)।

[4] দেখুন: আল-মুগনি: (২/৭০৪)।
ফল ও ফসলের যাকাত সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসআলা:

১. ফসলের মালিকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, চাষি জমির মালিক হোক বা বৈধ চুক্তিতে অপরের জমি চাষ করুক, যেমন ভাড়া বা হেবা অথবা অবৈধভাবে তাতে চাষ করুক যেমন জবরদখল। যদি জমির মালিক ও চাষির মাঝে চাষবাসের চুক্তি হয়, যেমন চুক্তি করল: জমির মালিক জমি দিবে, চাষি চাষ করার যাবতীয় খরচ বহন করবে, যেমন চাষ করা, পানি দেওয়া, কাঁটা ও সংগ্রহ করা ইত্যাদি, তারপর চুক্তি মোতাবেক উভয় ফসল ভাগ করবে। যদি বণ্টন শেষে দু’জনের অংশ যাকাতের নিসাব পরিমাণ না হয় যাকাত ওয়াজিব হবে না, কারণ ফসলের যাকাতে যৌথ মালিকানার প্রভাব নেই, পশুর বিষয়টি ব্যতিক্রম, যেমন পূর্বে বলেছি, এটিই বিশুদ্ধ মত।

২. যে ফল ও ফসলে যাকাত ওয়াজিব হয়, সেই ফল ও ফসল যদি পাঁচ ওসাক হয় যাকাত ওয়াজিব হবে। পাঁচ ওসাক পূর্ণ করার জন্য এক ফসল অপর ফসলের সাথে যোগ করবে না। অতএব, খেজুরের সাথে কিশমিশ কিংবা যবের সাথে গম যোগ করবে না। যখন যেই প্রকার নিসাব পরিমাণ হবে তখন সেই প্রকারের যাকাত দিবে। যদি একই প্রকার ফসল বিভিন্ন জাতের হয়, তখন এক জাত অপর জাতের যোগ করবে, যেমন কাঁচা, আধা পাকা ও পাকা খেজুর, একটি অপরটির সাথে যোগ করে হিসেব করবে।

৩. এক প্রকার ফসল পাঁচ ওসাক হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যদি মালিক একজন হয় এক বা একাধিক ক্ষেতের ফসল যোগ করবে, ক্ষেতের মধ্যবর্তী দূরত্ব যাই হোক, যদি পাঁচ ওসাক হয় যাকাত দিবে। অনুরূপ কেউ গ্রীষ্মকালে ফসল করেছে, যা নিসাব পরিমাণ হয় নি, আবার বসন্তকালে একই ফসল করেছে, উভয় মৌসুমের ফসল যদি যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ হয় এক-দশমাংশ যাকাত দিবে, কারণ বছর এক।

৪. জমি চাষ করতে যে অর্থ ব্যয় হয়, যেমন চাষ করা, ফসল কাটা, সংগ্রহ করা, মেশিন লাগানো, পানির কুপ খনন ও প্রণালি তৈরি করা ইত্যাদি যাকাত থেকে নিবে কি না?

আহলে ইলমদের বিশুদ্ধ মাযহাব, -অধিকাংশ আলিমও বলেছেন- যদি চাষি চাষ করার জন্য ঋণ করে, তাহলে ঋণের পরিমাণ যাকাত থেকে পরিশোধ করবে। চাষি যদি নিজ থেকে খরচ করে এবং সে ঋণগ্রস্ত নয়, চাষের খরচ যাকাত থেকে নিবে না। এটি একটি বিষয়।

ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেছেন: “চাষি যদি নির্দিষ্ট খরচ দিয়ে কুপ খনন ও নালা-প্রণালা তৈরি করে, অতঃপর তা নষ্ট হয় ও পানি কমে যায় এবং পুনরায় নতুন খরচে কুপ খনন করা জরুরি হয়, তবে চাষি এক-দশমাংশের অর্ধেক অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিবে। এটি মালিকের প্রতি এক প্রকার সহানুভূতি।[1]

৫. ফসল সংগ্রহ ও মাপার সময় চাষি, চাষির পরিবার ও চতুষ্পদ জন্তু যা খায় বা দুর্বলরা নেয় বা কাটার সময় সদকা করে সেগুলো চাষির থেকে গুনবে না।

৬. ইবন কুদামাহ রহ. বলেছেন: যদি টাকার বিনিময়ে সেচ করে বছরের প্রথম অর্ধেকে একটি ফসল তুলে, যা নিসাব পরিমাণ নয়। অতঃপর বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিনা খরচে একই ফসল করে এবং দুই বারের ফসল যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যাকাতের পরিমাণ: এক-দশমাংশের তিন চতুর্থাংশ।[2] অর্থাৎ মোট ফসলের ৭.৫% যাকাত দিবে।[3]

৭. কারও দু’টি বাগান একটি অর্থ দিয়ে অপরটি অর্থ ছাড়া সেচ করে, নিসাব হিসেব করার সময় দুই বাগানের ফসল যোগ করবে, অতঃপর যে বাগান বিনা অর্থে সেচ করে তার এক-দশমাংশ যাকাত দিবে, অর্থাৎ ফসলের ১০%, আর যে বাগান অর্থ দিয়ে সেচ করে তার এক দশমাংশের অর্ধেক অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিবে, যা মোট ফসলের ৫%।

৮. এক ফসলে যখন একবার উশর তথা এক-দশমাংশ যাকাত ওয়াজিব হয়, সেই ফসলে দ্বিতীয়বার উশর ওয়াজিব হবে না, তার ওপর দিয়ে যত বছর অতিক্রম করুক, তার উদাহরণ: জনৈক চাষির এক বছর থেকেও অধিক সময় ধরে একটি ফসল আছে, যার যাকাত সে একবার দিয়েছে, কিন্তু তার নিসাব কমে নি, দ্বিতীয়বার এই ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে না, তবে ফসলের কোনো অংশ যদি ব্যবসার জন্য নির্ধারিত করে, সে অংশ ব্যবসায়ী পণ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার ওপর বছর পূর্ণ হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে যাকাত দিবে, যেমন পূর্বে আলোচনা করেছি।[4]

৯. ইবন উসাইমীন রহ. বলেন: “কাউকে বলা হল, এই ক্ষেতের ফসল তুলো, বিনিময়ে তুমি এক তৃতীয়াংশ নিবে, আর তোমার মালিক নিবে দুই-তৃতীয়াংশ। যদি এই শর্তে সে ফসল তোলে তার এক-তৃতীয়াংশে যাকাত ওয়াজিব হবে না, যদিও তা পাঁচ ওসাক অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ হয়। কারণ, যখন যাকাত ওয়াজিব হয়েছে তখন সে ফসলের মালিক ছিল না, মালিক হয়েছে ফসল তোলার পর।[5]

>
[1] মাআলিমুস সুনান: (২/৭০২)।

[2] একশ‘ কেজির একদশমাংস ১০ কেজি, এই ১০ কেজির তিন চতুর্থাংশ ৭.৫ কেজি। অতএব এরূপ ফসল থেকে একশ‘ কেজি থেকে ৭.৫ কেজি যাকাত দিবে। -অনুবাদক।

[3] আল-মুগনি: (২/৬৯৯)।

[4] আল-মুগনি: (২/৭০২)।

[5] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/৭৯)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »