অনুরূপভাবে আরও একটি বড় ধরনের ফিতনা হলো, দলাদলি, মতবিরোধ, বিভক্তি ও বিভাজন। বিভিন্ন দল উপদলে উম্মতের বিভক্তি, ফিরকা-বন্দী, দলাদলি ইত্যাদি বড় ধরনের একটি ফিতনা। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সংবাদ দিয়েছেন এবং অধিক সতর্ক করেছেন। ইরবাদ্ব ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এ বিষয়ে বিস্তারিত দিক নির্দেশনাও রয়েছে। ঐ হাদীসে বর্ণিত যে, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের মাঝে ওয়াজ করেন, সে ওয়াজের বর্ণনায় সাহাবী ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “তিনি আমাদের এমন ভাষণ দিলেন যাতে আমাদের অন্তর বিগলিত এবং চক্ষু অশ্রূসজল হলো। আমরা ভাষণ শুনে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়ী ভাষণ, আপনি আমাদের উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, أوصيكم بتقوى الله، والسمع والطاعة “আমি তোমাদের অসীয়ত করি- তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, মুসলিম আমীরের আনুগত্য কর এবং তার কথা শোন”। কারণ, এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে শত্রুদের বিরুদ্ধে উম্মতের ঐক্য, শক্তি ও শৌর্যবীর্য। মুসলিম জাতি যখন আমীরের নেতৃত্ব মেনে নেবে এবং তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকবে, তখন মুসলিম জাতির ঐক্য অটুট থাকবে, তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তখন আর কেউ তাদের পরাভূত করতে পারবে না। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, وإن تأمر عليكم عبد “যদিও তোমাদের ওপর একজন গোলামকেও আমীর বানানো হয়”। তার কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর। তাকে খাট করে দেখবে না, হেয় করবে না। বরং যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহর আনুগত্য ও তার রাসূলের অনুকরণ করার নির্দেশ দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তার আনুগত্য করবে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বলে ভবিষ্যতবাণী করেন যে, فإنه من يعش منكم فسيرى اختلافاً كثيراً “তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে উম্মতে মুসলিমার মধ্যে অধিকহারে মতবিরোধ, বিভক্তি ও মত পার্থক্য দেখতে পাবে”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের থেকে কিছুই বলেন নি, তিনি যা বলেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেছেন। যে সম্পর্কে খবর দিয়েছেন কিয়ামতের পূর্বে তা অবশ্যই জমীনে বাস্তবায়িত হবে। তারপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মতবিরোধের পরিণতি থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কেও দিক নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন,

«فعليكم بسنتي، وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي، تمسكوا بها وعَضُّوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور؛ فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة».

“তখন তোমরা আমার সুন্নতকে এবং আমার পর হিদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধর। সুন্নততে খুব মজবুত করে ধর এবং তার ওপর তোমরা অবিচল থাক। আর তোমরা নব আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ -বিদআত- হতে বেঁচে থাক। কারণ, প্রতিটি নব আবিষ্কৃত বস্তুই বিদ‘আত আর প্রত্যেক বিদআতই হলো গোমরাহী”।[1]

এ ভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মতের পার্থক্য, বিভেদ-বিভাজন, বিভিন্ন ফিরকা বন্দী ও দলাদলি সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেন। আল্লাহর রাসূল সা. এ ধরনের ফিতনার সময় করণীয় সম্পর্কে আমাদের এ বলে নির্দেশ দেন, তোমরা তখন আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে আঁকড়ে ধরবে। কারণ, তখন এটাই ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নত এবং এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ হতে হাত ঘুটিয়ে নেবে, সে অবশ্যই এ সব ফিরকা-বাজদের সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতিটি ভাষণ ও আলোচনায় উম্মতকে ফিতনা ও বিদ‘আত সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং ফিতনা হতে মুক্তির উপায় ও মাধ্যমগুলো- আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর রাসূলের সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে আঁকড়ে ধরা- বলে দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

»إن خير الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم، وشر الأمور محدثاتها».

“সর্ব উত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব এবং উত্তম আদর্শ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় নব আবিষ্কৃত বিষয়াবলী”।[2]

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, وعليكم بالجماعة “তোমরা মুসলিম জামা‘আতের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাক”।[3]

এটিও নাজাতের একটি অন্যতম পথ। যখন দলাদলি, গ্রুপিং ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়, তখন একজন মুসলিমের জন্য করনীয় হলো, সে মুসলিম জামা‘আতের সাথে থাকবে। যে জামা‘আত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতের ওপর চলে, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। মুতাকাল্লিমীন তথা কালামশাস্ত্রবিদ, বিদ‘আতী ও গোমরাহদের সাথে থাকবে না। যদিও তারা তাদেরকে হক বলে দাবী করে। ঈমানদারগণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উপদেশ দিয়েছে তাই পালন করবে। তাতেই তারা নাজাত পাবে। উম্মতের বিভক্তি বিষয়ে অপর একটি হাদীস- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী- এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«افترقت اليهود على إحدى وسبعين فرقة، وافترقت النصارى على اثنتين وسبعين فرقة، وستفترق هذه الأمة على ثلاث وسبعين فرقة، كلها في النار إلا واحدة قيل: من هي يارسول الله؟ قال من كان على مثل ما أنا عليه اليوم وأصحابي».

“ইয়াহূদীরা একাত্তর দলে বিভক্ত। আর খৃষ্টানরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত। আর এ উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। এক দল ছাড়া বাকী সবাই জাহান্নামী হবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হলো, যারা বর্তমানে আমি যার ওপর আছি এবং আমার সাহাবায়ে কিরাম যার ওপর আছেন তার ওপর অটল থাকবেন”।[4]

এ কথাটিই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, وعليكم بالجماعة، فإن يد الله على الجماعة “তোমরা মুসলিম জামা‘আতের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাক। কারণ, আল্লাহর সাহায্য জামা‘আতের ওপরই থাকে”।[5] আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণের আদর্শের ওপর যারা থাকবে তাদেরই কেবল জামা‘আত বলা হয়। যদিও সংখ্যায় তারা কম। জামা‘আত হওয়ার জন্য সংখ্যায় বেশি হওয়া শর্ত নয়, হকের ওপর থাকা শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّن يُصۡرَفۡ عَنۡهُ يَوۡمَئِذٖ فَقَدۡ رَحِمَهُۥۚ وَذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡمُبِينُ ١٦﴾ [الانعام: ١٦]

“সেদিন যার থেকে আযাব সরিয়ে নেওয়া হবে তাকেই তিনি অনুগ্রহ করবেন, আর এটিই প্রকাশ্য সফলতা”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬]

মনে রাখবে, যারা ধারণার বশবর্তী হয়, তারা আল্লাহর পথ -সত্য থেকে দূরে সরে যায়। যদিও তাদের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তারা কোটি কোটি মানুষ। তারা সেই জামা‘আত নয় যাদের সাথে থাকার জন্য হাদীসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা হকের ওপর থাকে তাদেরকেই জামা‘আত বলা হয়, তারাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল, সাহায্যপ্রাপ্ত দল। যদিও তাদের সংখ্যা একজন বা খুব নগণ্য হয়। তারাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لا تزال طائفة من أمتي على الحق ظاهرين، لا يضرهم من خذلهم ولا من خالفهم، حتى يأتي أمر الله تبارك وتعالى».

“আমার উম্মতের মধ্যে একটি জামা‘আত সব সময় হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যারা তাদের অপমান-অপদস্থ ও বিরোধিতা করবে, তারা আল্লাহর নির্দেশ (কিয়ামত) না আসা পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না”।[6]

তবে এর জন্য প্রয়োজন কঠিন ধৈর্য। কারণ, শেষ জামানায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের ওপর অবিচল থাকা এবং মুসলিম জামা‘আতের সাথে থাকা খুবই কঠিন কাজ। তখন যারা আল্লাহর রাসূলের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে এবং মুসলিম জামা‘আতের সাথে থাকবে, তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের মুসিবত নেমে আসবে। তারা অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের মুসিবতের সম্মুখীন হবে। যেমন, হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন -

«أنه يحصل في آخر الزمان فتن، يكون القابض على دينه كالقابض على الجمر، أو على خبط الشوك».

“শেষ জামানায় বিভিন্ন ধরনের ফিতনা প্রকাশ পাবে। দীনের ওপর অবিচল থাকা জ্বলন্ত কয়লা হাতে রাখা অথবা লোহার কাঁটার ওপর দণ্ডায়মান থাকার ন্যায় কঠিন হবে”।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«المتمسك بسنتي, عند فساد أمتي، له أجر خمسين، قالوا: منا أو منهم يارسول الله؟ قال: بل منكم»

“আমার উম্মতের গোমরাহীর সময় যে আমার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে তার জন্য পঞ্চাশ জন লোকের সাওয়াব মিলবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের থেকে পঞ্চাশ নাকি তাদের থেকে? তিনি বললেন, বরং তোমাদের থেকে”।

সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় রাসূলের সাথে ছিলেন। রাসূল তাদের সহযোগী ছিল। (তাই তাদের জন্য সুন্নতের ওপর অবিচল-অটুট থাকা সহজ) কিন্তু শেষ জামানা এবং ফিতনার সময় সুন্নতের ওপর যারা অবিচল থাকবেন তাদের কোন সহযোগী নেই; বরং অধিকাংশ মানুষই তখন তাদের প্রতিপক্ষ। এমনকি যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করবেন তারাও তাদের বিরোধী হবে, তারা তাদের বিভিন্নভাবে অপমান-অপদস্থ করবে, কলঙ্কিত ও হেয় প্রতিপন্ন করবে। তখন অবশ্যই তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। এ সময় যারা ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মহা বিনিময় দান করবে। কারণ, তারা ফিতনা ফ্যাসাদের সময় আল্লাহর দীনের ওপর অবিচল রয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীসে তাদের গুরাবা বলে আখ্যায়িত করে বলেন, طوبى للغرباء “সু-সংবাদ গুরাবাদের জন্যই” জিজ্ঞাসা করা হলো, গুরাবা কারা হে আল্লাহর রাসূল? উত্তরে বললেন, الذين يُصْلِحُون إذا فسد الناس “যারা মানুষকে সংশোধন করেন যখন মানুষ গোমরাহীতে পতিত হয়”।

অপর বর্ণনায় বর্ণিত তিনি বলেন,

يُصْلِحُون ما أفسد الناس

এ হাদীসগুলোর মাধ্যমে শেষ জামানায় সংঘটিত হবে, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের করণীয় হলো, আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের হকের ওপর অবিচল রাখেন এবং মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দান করেন। তা ছাড়াও আমাদের করণীয় হলো, আমরা যেন হক ও হক পন্থীদের জানতে চেষ্টা করি এবং বাতিল ও বাতিল পন্থীদের থেকে সতর্ক থাকি। যাতে হক ও হক পন্থীদের সাথে আমরা থাকতে পারি এবং বাতিল ও বাতিল পন্থীদের থেকে আমরা বাঁচতে পারি। আর এর জন্য প্রয়োজন দীনের জ্ঞান। দীনের জ্ঞান ছাড়া হক ও বাতিল জানা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। মূর্খ থেকে এটি আশা করা যায় না। এটি ঐ ব্যক্তি থেকে আশা করা যায় যাকে আল্লাহ তা‘আলা দীনের জ্ঞান দিয়েছেন। উপকারী ইলম দ্বারা দূরদর্শিতা দিয়েছেন যা দ্বারা সে হিদায়াত ও গোমরাহীর মধ্যে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম।

এ ধরনের ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। বর্তমানে তোমরা দেখতে পাচ্ছ, পুরো দুনিয়াটা বড় বড় ফিতনার সাগরে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। একটি বড় ধরনের ফিতনা হলো, বর্তমানে পৃথিবীটা মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ফলে পৃথিবী এক প্রান্তে কি ঘটছে, তা অপর প্রান্তের লোকেরা মুহূর্তেই জেনে ফেলছে। নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে যন্ত্রের মাধ্যমে খুব দ্রুত মানুষের কাছে সব খবর পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকি গ্রাম, গঞ্জ ও ঘরের ভিতরে বেড রুমের খবরও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ এমন ভাবে খবরগুলো দেখতে পাচ্ছে যেন তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত। এটি মুসলিম জাতির জন্য বড় পরীক্ষা। বর্তমান দুনিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ফিতনায় আক্রান্ত। অবৈধ যৌনাচার এক প্রকার মহামারির আকার ধারণ করছে। নাস্তিক্যবাদের ফিতনা, মুরতাদদের ফিতনা, ইসলামের ওপর বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক ও অবান্তর দোষ চাপানোর প্রবণতা ইত্যাদি যেন মুসলিম উম্মাহর লেজ টেনে ধরছে। এ ধরনের ঘটনা একের পর সংঘটিত হয়েই চলছে। কোন ক্রমেই এগুলো পিছু ছাড়ছে না। তারপর এ ঘটনাগুলো সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সারা দুনিয়ার মানুষ আজ আক্রান্ত। তবে যাকে আল্লাহ তা‘আলা দয়া করেছেন। এ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা। এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা। যাদের দূরদর্শিতা না থাকে, দীনের জ্ঞান না থাকে এবং সত্যিকার ইলম না থাকে, তারা অনেক সময় এ ধরনের প্রযুক্তিকে মনে করবে এটি তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। আবার কেউ কেউ মনে করবে এ সব আল্লাহর নি‘আমত, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। সে বুঝতেই পারবে না যে এ সবের কারণে তার কি ক্ষতি হচ্ছে এবং তাকে কত খারাবী বহন করতে হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, বিষয়টি খুবই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মানুষের সামনে হাজারো ফিতনা তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তা অনুধাবন করতে পারছে না। যেমনটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন

«تعرض الفتن على القلوب عوداً عوداً، فأي قلب أشربها نكتت فيه نكتة سوداء, حتى يصبح قلباً مجخياً, لا يعرف معروفاً ولا ينكر منكراً، إلا ما وافق هواه أو وما أشرب من هواه، وأي قلب أنكرها نكت فيه نكتة بيضاء، فهو قلب لا تضره فتنة مادامت السماوات والأرض».

“মানুষের অন্তর অবশ্যই এ সব ফিতনার সম্মুখীন হয়। যখন কোনো অন্তর তা চুষে নেয় তখন সে অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়, এমনকি সে অন্তর হয়ে যায় বদ্ধ। তখন সে অন্তর কোনো সৎকে চিনতে পারে না, অসৎকে অস্বীকার করতে সক্ষম হয় না। সেটাই কেবল গ্রহণ করে যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী হয়, অথবা প্রবৃত্তি যা চুষে নিয়েছে তা অনুযায়ী হয়। অপরপক্ষে যে অন্তর ফিতনাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে সে অন্তরে একটি সাদা-শুভ্র দাগ পড়ে, ফলে সে অন্তর হয়ে যায় এমন যাতে কোনো ফিতনাই আর কাজ করতে পারে না, যতক্ষণ আসমান ও যমীন আছে ততক্ষণ তা অনুরূপই থাকে”।

[1] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬০৭

[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৬৭

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ২১৬৫

[4] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৯৯২

[5] নাসাঈ, হাদীস নং ৪০২০

[6] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৩৭

কোন অন্তর ফিতনাকে উপেক্ষা করে? ঐ অন্তরই ফিতনাকে উপেক্ষা করে যার অন্তরে আল্লাহর কিতাবের ইলম রয়েছে এবং যে ব্যক্তি এ ধরনের পেক্ষাপটে করনীয় সম্পর্কে জানে। আর যে মূর্খ সে ফিতনা বিষয়ে নমনীয় থাকে। আবার অনেক সময় তাতে সে আনন্দও পায় এবং এ সব ফিতনাকে সে উন্নতি, অগ্রগতি ও সভ্যতা মনে করে। আর তা হতে দূরে থাকাকে পশ্চাৎপদ ও প্রগতির পরিপন্থী মনে করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরণের ফিতনা হতে বাঁচার কোনো উপায় নেই একমাত্র আল্লাহ যে বস্তুকে উপায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তা ছাড়া। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ صِرَٰطِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ ١﴾ [ابراهيم: ١]

“আলিফ-লাম-রা। এ কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্ব প্রশংসিতের পথের দিকে”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১]

﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الاعراف: ٣]

“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩]

﴿إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي هِيَ أَقۡوَمُ وَيُبَشِّرُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ أَجۡرٗا كَبِيرٗا ٩ وَأَنَّ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡأٓخِرَةِ أَعۡتَدۡنَا لَهُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا ١٠﴾ [الاسراء: ٩ ، ١٠]

“নিশ্চয় এ কুরআন এমন একটি পথ দেখায় যা সবচেয়ে সরল এবং যে মুমিনগণ নেক আমল করে তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। আর যারা আখিরাতে ঈমান রাখে না আমি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯-১০]

﴿الٓمٓ ١ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣ وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ ٤ أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٥﴾ [البقرة: ١، ٥]

“আলিফ-লাম-মীম। এই সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে। তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১-৫]

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের এ সূরার শুরুতেই উল্লেখ করেছেন যে, এ কুরআন বিশেষ করে মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত। তারপর তিনি মুত্তাকী কারা তাদের পরিচয় তুলে ধরেন। অর্থাৎ মুত্তাকী হলো তারা যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেন তারা কামিয়াব ও সফলকাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ কাফেরদের বর্ণনা দেন। তারপর তৃতীয় শ্রেণির মানুষ অর্থাৎ, মুনাফিকদের বর্ণনা দেন।

আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নিকট মানবজাতি তিন প্রকারে বিভক্ত।

প্রথম প্রকার:

যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে এ কুরআনের প্রতি বিশ্বাস করে তারা হলেন মুমিন-মুত্তাকীন। উল্লেখিত আয়াতসমূহে তাদের গুণাগুণ তুলে ধরা হয়েছে।

দ্বিতীয় প্রকার:

যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে। তারা কাফের, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ ءَأَنذَرۡتَهُمۡ أَمۡ لَمۡ تُنذِرۡهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٦ خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَعَلَىٰ سَمۡعِهِمۡۖ وَعَلَىٰٓ أَبۡصَٰرِهِمۡ غِشَٰوَةٞۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٧﴾ [البقرة: ٦، ٧]

“নিশ্চয় যারা কুফুরি করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক কর কিংবা না কর, উভয়ই তাদের জন্য বরাবর, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৬-৭]

এরা প্রকাশ্যে ও গোপনে কুরআনকে অস্বীকার করার ফলে শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেন। ফলে তাদের অবস্থা এমন, তারপর থেকে তারা আর কখনো হককে গ্রহণ করবে না, ঈমান আনবে না।

তৃতীয় প্রকার:

যারা বাহ্যিক ভাবে কুরআনকে বিশ্বাস করে কিন্তু গোপনে তারা কুরআনকে অস্বীকার করে। এ শ্রেণির লোক মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা তাদের পরিচয় তুলে ধরার জন্য একাধিক আয়াত নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلۡمُفۡسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشۡعُرُونَ ١٢ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ ١٣ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ إِلَىٰ شَيَٰطِينِهِمۡ قَالُوٓاْ إِنَّا مَعَكُمۡ إِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُونَ ١٤ ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلۡهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَٰرَتُهُمۡ وَمَا كَانُواْ مُهۡتَدِينَ ١٦ مَثَلُهُمۡ كَمَثَلِ ٱلَّذِي ٱسۡتَوۡقَدَ نَارٗا فَلَمَّآ أَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمۡ وَتَرَكَهُمۡ فِي ظُلُمَٰتٖ لَّا يُبۡصِرُونَ ١٧ صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَرۡجِعُونَ ١٨ أَوۡ كَصَيِّبٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فِيهِ ظُلُمَٰتٞ وَرَعۡدٞ وَبَرۡقٞ يَجۡعَلُونَ أَصَٰبِعَهُمۡ فِيٓ ءَاذَانِهِم مِّنَ ٱلصَّوَٰعِقِ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِۚ وَٱللَّهُ مُحِيطُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ ١٩ يَكَادُ ٱلۡبَرۡقُ يَخۡطَفُ أَبۡصَٰرَهُمۡۖ كُلَّمَآ أَضَآءَ لَهُم مَّشَوۡاْ فِيهِ وَإِذَآ أَظۡلَمَ عَلَيۡهِمۡ قَامُواْۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَأَبۡصَٰرِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٠﴾ [البقرة: ٨، ٢٠]

“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজদেরকেই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। সুতরাং আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা মিথ্যা বলত। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা জমীনে ফ্যাসাদ করো না’, তারা বলে, ‘আমরা তো কেবল সংশোধনকারী’। জেনে রাখ, নিশ্চয় তারা ফাসাদকারী; কিন্তু তারা বুঝে না। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনব যেমন নির্বোধরা ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না। আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন। এরাই তারা, যারা হিদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টটা ক্রয় করেছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয় নি এবং তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না। তাদের উপমা ঐ ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন আগুন তার চারপাশ আলোকিত করল, আল্লাহ তাদের আলো কেড়ে নিলেন এবং তাদেরকে ছেড়ে দিলেন এমন অন্ধকারে যে, তারা দেখছে না। তারা বধির-মূক-অন্ধ। তাই তারা ফিরে আসবে না। কিংবা আকাশের বর্ষণমুখর মেঘের ন্যায়, যাতে রয়েছে ঘন অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। বজ্রের গর্জনে তারা মৃত্যুর ভয়ে তাদের কানে আঙুল দিয়ে রাখে। আর আল্লাহ কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন। বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার উপক্রম হয়। যখনই তা তাদের জন্য আলো দেয়, তারা তাতে চলতে থাকে। আর যখন তা তাদের ওপর অন্ধকার করে দেয়, তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তাদের শ্রবণ ও চোখসমূহ নিয়ে নিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮-২০]

মোটকথা, আল্লাহর কিতাবে রয়েছে নূর ও হিদায়েত। আল্লাহর কিতাবে চিন্তা-ফিকির করা গবেষণা করা খুবই জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩﴾ [ص : ٢٩]

“আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯]

যে ব্যক্তি এ ধরনের ফিতনা হতে বাঁচতে চায়, তাকে অবশ্যই আল্লাহর কিতাবকে আঁকড়ে ধরতে হবে। আল্লাহর কিতাব দিয়ে কি করবে? নিজের কাছে একটি কুরআন বাজার থেকে কিনে নিজের কাছে সংরক্ষণ করবে!!? না তার দায়িত্ব হলো কুরআন পড়বে এবং কুরআন অনুযায়ী জীবন যাপন করবে। এ কুরআনই হলো দুনিয়াতে আখিরাতের যাবতীয় অনিষ্ঠটা ও খারাবী হতে মুক্তি লাভ ও হিদায়াত লাভের প্রথম সোপান। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নত। কারণ, সুন্নত হলো কুরআনের ব্যাখ্যা, বর্ণনা ও তাফসীর। আল্লাহ তা‘আলা বাণী তার প্রমাণ,

﴿وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤﴾ [النجم : ٣، ٤]

“আর সে মনগড়া কথা বলে না। তাতো কেবল অহী, যা তার প্রতি অহী-রূপে প্রেরণ করা হয়”। [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩-৪]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إني تارك فيكم ما إن تمسكتم به لن تضلوا بعدي: كتاب الله, وسنتي»

“আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। তোমরা যদি এ দু’টিকে মজবুত করে ধর, তবে তোমরা আমার পরে গোমরাহ হবে না। আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নত”।[7]

ফিতনা থেকে এ ধরনের নিরাপত্তা ও দায়িত্বগ্রহণ তার জন্য যে উভয়টিকে আঁকড়ে ধরবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীসে ফিতনার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। যেমন, তিনি আরও বলেছেন- অচিরেই গভীর অন্ধকার-আমবশ্যার রাতের মতো ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। তখন মানুষ সকালে মুমিন হিসেবে সকাল করবে সন্ধ্যায় কাফেরে পরিণত হবে। আবার মুমিন হিসেবে সন্ধ্যা অতিবাহিত করবে কিন্তু সকালে কাফেরে পরিণত হবে। সামান্য পার্থিব লাভের বিনিময়ে দীন কে বিক্রি করেবে। দুনিয়াকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দেবে। ফলে মানুষ দুনিয়াদারিতে নিজেকে বিলীন করে দেবে। সালাত ছেড়ে দেবে, যাকাত আদায় করবে না আল্লাহ ও তার রাসূলের নাফরমানী করবে, শয়তান ও শয়তানের সহযোগীদের অনুসরণ করবে। এমন মহান ফিতনা থেকে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করি। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে আমাদের সংবাদ দেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,

«إنها ستكون فتن كقطع الليل المظلم، يصبح الرجل فيها مؤمناً ويمسي كافراً، ويمسي مؤمناً ويصبح كافراً، يبيع دينه بِعَرَض من الدنيا».

“শেষ জামানায় আমবশ্যার রাতের মতো ফিতনা মানুষকে ঘ্রাস করবে। তখন একজন মানুষ সকালে মুমিন আর বিকালে কাফির এবং বিকালে মুমিন সকালে কাফির। সে দুনিয়ার বিনিময়ে তার দীনকে বিক্রি করবে”।[8] দীন কে দুনিয়ার নগণ্য সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে বিক্রি করে দেবে। আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে মানুষ দুনিয়ার সাথে বিলীন হয়ে পড়বে। তখন সে সালাত আদায় করবে না, যাকাত দেবে না আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নাফরমানী করে এবং শয়তান ও তার দোসরদের অনুসরণ করবে। আমরা আল্লাহর নিকট এ ধরনের ফিতনা হতে আশ্রয় চাই।সময় যত পার হবে ফিতনার মহাপ্রলয় আরও বড় আকার ধারণ করবে। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত একটির পর একটি করে বড় বড় ফিতনা ধারাবাহিক ভাবে আসতে থাকবে। কিয়ামত কাছাকাছি হওয়া এবং পৃথিবী ধ্বংসের ধার প্রান্তে পৌছার কারণে বিশেষ করে আখেরি জামানার মানুষ সর্বাধিক বেশি ফিতনার সম্মুখীন হবে। মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফিতনার মধ্যে জীবন-যাপন ও বসবাস করবে। কখনো তার পরিণতি ভালো হবে আবার কখনো তার পরিণতি খারাপ হতে পারে।

[7] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৭৮৮

[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৮
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে