-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯১. তোমরা আরো কিছু লোক অবশ্যই পাবে যারা তোমাদের সাথে ও তাদের সম্প্রদায়ের সাথে শান্তি চাইবে। যখনই তাদেরকে ফিতনার দিকে মনোনিবেশ করানো হয় তখনই এ ব্যাপারে তারা তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। যদি তারা তোমাদের কাছ থেকে চলে না যায়, তোমাদের কাছে শান্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হস্ত সংবরণ না করে তবে তাদেরকে যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে ও হত্যা করবে। আর আমরা তোমাদেরকে এদের বিরুদ্ধাচারণের স্পষ্ট অধিকার দিয়েছি।(১)
(১) উপরোক্ত ৮৮ থেকে ৯১ আয়াতসমূহে তিনটি দলের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে দু’টি বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এসব দলের ঘটনাবলী নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যাবে।
প্রথম বর্ণনাঃ তাফসীরকার মুজাহিদ বলেন, একবার কতিপয় মুশরিক মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে এবং প্রকাশ করে যে, তারা মুসলিম; হিজরত করে মদীনায় এসেছে। কিছুদিন পর তারা দ্বীনত্যাগী হয়ে যায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পণ্যদ্রব্য আনার অজুহাত পেশ করে পুনরায় মক্কা চলে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। এদের সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। কেউ কেউ বলল এরা কাফের, আর কেউ কেউ বলল এরা মুমিন। আল্লাহ্ তা'আলা ৮৮ ও ৮৯ নং আয়াতে এদের কাফের হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং এদেরকে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন। [তাবারী] কাতাদা থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এরা ছিল তিহামার একটি গোত্র, তারা রাসূলকে বলল যে, আমরা আপনার সাথে যুদ্ধ করব না, আমাদের কাওমের সাথেও যুদ্ধ করব না। তারা রাসূল ও তাদের কাওমের যুগপৎ নিরাপত্তা চাচ্ছিল। তাদের অবস্থা বুঝে আল্লাহ তা'আলা তা মানতে অস্বীকার করেন। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]
দ্বিতীয় বর্ণনাঃ হাসান বসরী বর্ণনা করেন যে, বদর ও ওহুদ যুদ্ধের পর সুরাকা ইবন মালেক মুদলাজী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা জানালো, আমাদের গোত্র বনী-মুদলাজের সাথে সন্ধি স্থাপন করুন। তিনি খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সন্ধি সম্পন্ন করার জন্য সেখানে পাঠালেন। সন্ধির বিষয়বস্তু ছিল এইঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করবো না। কুরাইশরা মুসলিম হয়ে গেলে আমরাও মুসলিম হয়ে যাবো। যেসব গোত্র আমাদের সাথে একতাবদ্ধ হবে, তারাও এ চুক্তিতে আমাদের অংশীদার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ নং আয়াত নাযিল হয়।
তৃতীয় বর্ণনাঃ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে যে, ৯১ নং আয়াতে আসাদ ও গাতফান গোত্রদ্বয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা মদীনায় এসে বাহ্যতঃ নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করতো এবং স্বগোত্রের কাছে বলতো আমরা তো বানর ও বিচ্ছদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তারাই আবার মুসলিমদের কাছে বলত, আমরা তোমাদের দ্বীনে আছি।
মোটকথা, এখানে তিন দল লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছেঃ এক. মুসলিম হওয়ার জন্য যে সময় হিজরত করা শর্ত সাব্যস্ত হয়, সে সময় সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা হিজরত না করে কিংবা হিজরত করার পর দারুল ইসলাম ত্যাগ করে দারুল হারবে চলে যায়। দুই. যারা স্বয়ং মুসলিমদের সাথে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি করে কিংবা এরূপ চুক্তিকারীদের সাথে চুক্তি করে। তিন. যারা সাময়িকভাবে বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তিচুক্তি করে অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানানো হলে তাতে অংশগ্রহণ করে এবং চুক্তিতে কায়েম না থাকে।
প্রথম দল সাধারণ কাফেরদের মত। দ্বিতীয় দল হত্যা ও ধরপাকড়ের আওতা বহির্ভূত এবং তৃতীয় দল প্রথম দলের অনুরূপ শাস্তির যোগ্য। এসব আয়াতে মোট দুটি বিধান উল্লেখিত হয়েছে; অর্থাৎ সন্ধিচুক্তি না থাকা কালে যুদ্ধ এবং সন্ধিচুক্তি থাকাকালে যুদ্ধ নয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯১) অচিরেই তোমরা কিছু অন্য লোক পাবে যারা (বাহ্যতঃ) তোমাদের কাছে ও তাদের স্বজাতির কাছে নিরাপত্তা কামনা করে। [1] যখনই তাদেরকে ফিতনার দিকে আহবান করা হয়, [2] তখনই তারা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে (পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়)। যদি তারা তোমাদের নিকট হতে পৃথক না হয় (যুদ্ধ না করে), তোমাদের নিকট সন্ধি প্রার্থনা না করে এবং তাদের হস্ত সংবরণ না করে, [3] তাহলে তাদেরকে যেখানে পাও, সেখানেই গ্রেফতার করে হত্যা কর। আর এই সকল লোকের বিরুদ্ধেই আমি তোমাদেরকে স্পষ্ট প্রমাণ দান করেছি। [4]
[1] এরা হল তৃতীয় আর একটি দল, যারা ছিল মুনাফিক। এরা মুসলিমদের কাছে এসে ইসলামের প্রকাশ করত, যাতে তাদের (মুসলিমদের) হাত হতে নিরাপদে থাকে। আর যখন স্বীয় জাতির নিকট যেত, তখন তাদের সাথে শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত হত, যাতে তারা এদেরকে নিজেদেরই দলভুক্ত মনে করে। এইভাবে তারা উভয় থেকেই স্বার্থ লাভ করত।
[2] الفِتْنَة (ফিতনা)এর অর্থ শিরকও হতে পারে। أُرْكِسُوا فِيْهَا এই শিরকের মধ্যেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথবা ‘ফিৎনা’র অর্থ যুদ্ধ। অর্থাৎ, যখন তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ফিরানো হত, তখন তারা সেদিকে আগ্রহের সাথে অগ্রসর হত।
[3]يُلْقُوا এবং يَكُفُّوا এদের সংযোগ হল, يَعْتَزِلُوكُمْ এর সাথে। অর্থাৎ, সবই নেতিবাচক অর্থে। সবের সাথে لَم যোগ হবে।
[4] এই কথার উপর যে, বাস্তবিকই তাদের হৃদয় মুনাফিক্বীতে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসায় পরিপূর্ণ। তাই তো তারা সামান্য প্রচেষ্টায় পুনরায় ফিৎনায় (শিরক অথবা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে) লিপ্ত হয়ে পড়ে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯২. কোন মুমিনকে হত্যা করা কোন মুমিনের কাজ নয়(১), তবে ভুলবশত করলে সেটা স্বতন্ত্র; এবং কেউ কোন মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করলে এক দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা কর্তব্য, যদি না তারা ক্ষমা করে। যদি সে তোমাদের শক্র পক্ষের লোক হয় এবং মুমিন হয় তবে এক মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যদি সে এমন সম্প্রদায়ভুক্ত হয় যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় এবং মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যে সঙ্গতিহীন সে একাদিক্ৰমে দু’ মাস সিয়াম পালন করবে।(২) তাওবাহর জন্য এগুলো আল্লাহর ব্যবস্থা এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
(১) হত্যা সর্বমোট আট প্রকার। কেননা, নিহত ব্যক্তি হয়তো মুসলিম, কিংবা যিম্মী, অথবা চুক্তিবদ্ধ ও অভয়প্রাপ্ত, নতুবা দারুল হারবের কাফের হবে। এ চার অবস্থার কোন না কোন একটি হবেই। হত্যাকারী দু'প্রকারঃ হয় ইচ্ছাকৃত, না হয় ভুলবশতঃ। অতএব, মোট প্রকার হল আটটিঃ (এক) মুসলিমকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (দুই) মুসলিমকে ভুলবশতঃ হত্যা, (তিন) যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (চার) যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যা, (পাঁচ) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (ছয়) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ভুলবশতঃ হত্যা (সাত) হারবী কাফেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং (আট) হারবী কাফেরকে ভুলবশতঃ হত্যা। প্রথম প্রকারের পার্থিব বিধান হচ্ছে, কিসাস ওয়াজিব হওয়া। যা সূরা বাকারায় উল্লেখ করা হয়েছে [সূরা আল-বাকারাহ ১৭৮]
আর আখেরাতে এর পরিণতি সূরা আন-নিসা এর ৯৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ ভুলবশতঃ মুমিনকে হত্যার বর্ণনা আলোচ্য সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতে এসেছে। অর্থাৎ দিয়াত দিতে হবে। তৃতীয় প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যার হুকুম কি তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চতুর্থ প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যার শাস্তি সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতের শেষে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সেটারও দিয়াত দিতে হবে। পঞ্চম প্রকার অর্থাৎ চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে ইচ্ছাকৃত হত্যা। এর হুকুম সূরা আন-নিসার ৯০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ তাদের এবং যিম্মীদের হুকুম একই। কেননা, ৯০ নং আয়াতে উল্লেখিত مِيثَاقٌ তথা চুক্তি অস্থায়ী ও স্থায়ী উভয় প্রকারই হতে পারে। অতএব, যিম্মী ও অভয়প্রাপ্ত কাফের এর অন্তর্ভুক্ত। সপ্তম ও অষ্টম প্রকারের বিধান স্বয়ং জিহাদ আইনসিদ্ধ হওয়ার মাসআলা থেকে জানা গেছে। কেননা, জিহাদে দারুল হারবের কাফেরদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যা করা হয়। অতএব, ভুলবশতঃ হত্যার বৈধতা আরো সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হবে।
(২) কিসাস ও দিয়াতের বিধান সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে হত্যা কয়েক প্রকারঃ প্রথম প্রকার عَمَدٌ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যা। এমন অস্ত্র দ্বারা, যা দ্বারা হত্যা করা যায়। এ ধরনের হত্যার শাস্তি হচ্ছে কিসাস। দ্বিতীয় প্রকার شِبْهِ عَمدٍ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যার সাথে যা সাদৃশ্যপূর্ণ। এর সংজ্ঞা এইঃ ইচ্ছা করেই হত্যা করা, কিন্তু এমন অস্ত্র দ্বারা নয়, যা দ্বারা অঙ্গচ্ছেদ হতে পারে। তৃতীয় প্রকার خطأ অর্থাৎ ভুলবশতঃ হত্যা। ইচ্ছা ও ধারণায় ভুল হওয়া। যেমন দূর থেকে মানুষকে শিকার জন্তু কিংবা দারুল-হারবের কাফের মনে করে লক্ষ্য স্থির করতঃ গুলী করে ফেলা কিংবা লক্ষ্যচ্যুতি ঘটা। যেমন, জন্তুকে লক্ষ্য করেই তীর অথবা গুলী ছোড়া; কিন্তু তা কোন মানুষের গায়ে লেগে যাওয়া। এগুলো সব ভুলবশতঃ হত্যার অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভুল বলে ‘ইচ্ছা নয়’ বোঝানো হয়েছে। অতএব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় উভয় প্রকার হত্যাই এর অন্তর্ভুক্ত। উভয় প্রকারের মধ্যে গোনাহ ও রক্ত-বিনিময় বিভিন্ন রকম। দ্বিতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময় হচ্ছে একশ’ উট। উটগুলো চার প্রকারের হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে পাঁচটি করে উট থাকবে।
তৃতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময়ও একশ উট। কিন্তু উটগুলো হবে পাঁচ প্রকারের। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে বিশটি করে উট থাকবে। তবে রক্ত-বিনিময় মুদ্রার মাধ্যমে দিলে উভয় প্রকারে দশ হাজার দিরহাম অথবা এক হাজার দীনার দিতে হবে। ইচ্ছার কারণে দ্বিতীয় প্রকারের গোনাহ বেশী এবং তৃতীয় প্রকারের গোনাহ কম। অর্থাৎ শুধু অসাবধানতার গোনাহ হবে। কাফফারা অর্থাৎ ক্রীতদাস মুক্ত করা কিংবা রোযা রাখা স্বয়ং হত্যাকারীর করণীয় এবং রক্ত-বিনিময় হত্যাকারীর স্বজনদের যিম্মায় ওয়াজিব। শরীআতের পরিভাষায় তাদেরকে ‘আকেলাহ’ বলা হয়। এখানে প্রশ্ন করা উচিত হবে না যে, হত্যাকারীর অপরাধের বোঝা তার স্বজনদের উপর কেন চাপানো হয়? তারা তো নিরপরাধ। এর কারণ এই যে, হত্যাকারীর স্বজনরাও দোষী। তারা তাকে এ ধরণের উচ্ছৃংখল কাজ-কর্মে বাধা দেয়নি। রক্ত-বিনিময়ের ভয়ে ভবিষ্যতে তারা তার দেখাশোনা করতে ক্রটি করবে না। এর বাইরে অন্য এক প্রকার হত্যা রয়েছে। যাকে কোন কোন ফকীহ ভুলের পর্যায়ভুক্ত বলেছেন। যেমন, কেউ কূপ এমন স্থানে খনন করলো যে, একজন তাতে পড়ে মারা গেল। এর বিধান অবস্থাভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯২) কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করা কোন বিশ্বাসীর জন্য সংগত নয়, [1] তবে ভুলবশতঃ হত্যা করে ফেললে সে কথা স্বতন্ত্র। [2] কেউ কোন বিশ্বাসীকে ভুলবশতঃ হত্যা করলে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা এবং তার (নিহতের) পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা বিধেয়। [3] তবে যদি তারা সাদাকা (ক্ষমা) করে দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা।[4] কিন্তু যদি সে তোমাদের শত্রু পক্ষের লোক হয় এবং বিশ্বাসী হয়, তবে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়।[5] আর যদি সে এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, যার সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ, তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়। [6] কেউ যদি (উক্ত দাস) না পায় (বা মুক্ত করার সামর্থ্য না রাখে), তাহলে সে একাদিক্রমে দু’মাস রোযা রাখবে।[7] তওবার (সংশোধনের) জন্য এ আল্লাহর বিধান। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
[1] এখানে নেতিবাচক বাক্য নিষেধাজ্ঞার অর্থে ব্যবহার হয়েছে, যা হারাম প্রতিপাদন করে। অর্থাৎ, একজন মু’মিনের অপর মু’মিনকে হত্যা করা নিষেধ ও হারাম। যেমন, [وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللهِ ] "আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য সঙ্গত নয়।" (আহযাবঃ ৫৩) অর্থাৎ, কষ্ট দেওয়া হারাম।
[2] ভুলের কারণ অনেক ধরনের হতে পারে। উদ্দেশ্য হল, নিয়ত ও ইচ্ছা হত্যা করার না হয়; অনিচ্ছায় ভুলক্রমে যদি হয়ে যায়, তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র।
[3] এখানে ভুলক্রমে হত্যা হয়ে গেলে তার জরিমানা কি, তা বলা হচ্ছে। দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে, কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) ও ক্ষমা স্বরূপ। আর তা হল, একজন মুসলিম ক্রীতদাস স্বাধীন করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দাদের অধিকার স্বরূপ। আর তা হল, ‘দিয়াত’ রক্তপণ আদায় করা। নিহত ব্যক্তির রক্তের বিনিময় স্বরূপ যে জিনিস তার (নিহতের) উত্তরাধিকারীদেরকে দেওয়া হয়, তাকে ‘দিয়াত’ (রক্তপণ) বলা হয়। এর পরিমাণ হাদীস অনুযায়ী ১০০টি উট অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য সোনা, রূপা বা দেশে প্রচলিত মুদ্রা।
দ্রষ্টব্যঃ স্মরণ থাকে যে, ইচ্ছাকৃত হত্যায় ‘কি·সাস’ অথবা ‘দিয়াত মুগাল্লাযা’ হবে। আর ‘দিয়াত মুগাল্লাযা’র পরিমাণ ১০০টি উট যা বয়স ও তার (ভালো-মন্দ)গুণ অনুযায়ী তিন প্রকারের বা তিন মানের হবে। কিন্তু ভুলক্রমে হত্যায় কেবল ‘দিয়াত’ আছে, ‘কি·সাস’ (রক্তের বিনিময়ে রক্ত) নেই। এই ‘দিয়াত’এর পরিমাণ ১০০টি উট যাতে কোন কড়া শর্ত নেই। তাছাড়া এই ‘দিয়াত’এর মূল্য সুনানে আবূ দাউদের হাদীসে ৮০০ দীনার অথবা ৮ হাজার দিরহাম এবং তিরমিযীর বর্ণনায় ১২ হাজার দিরহাম বলা হয়েছে। অনুরূপ উমার (রাঃ) তাঁর খেলাফত কালে ‘দিয়াত’এর মূল্যে কম-বেশী এবং বিভিন্ন মুদ্রা অনুযায়ী তা বিভিন্ন প্রকারের নির্দিষ্ট করেছিলেন। (ইরওয়াউল গালীল ৮ম খন্ড) যার অর্থ হল, ১০০টি উটের মূল দিয়াতের ভিত্তিতে তার মূল্য প্রত্যেক যুগ অনুসারে নির্ধারিত হবে। (বিস্তারিত জনার জন্য দ্রষ্টব্যঃ হাদীসের ভাষ্য ও ফিক্বাহ গ্রন্থাদি)
[4] ক্ষমা করে দেওয়াকে সাদাকা বলে আখ্যায়িত করার উদ্দেশ্য হল, ক্ষমা করার প্রতি উৎসাহিত করা।
[5] অর্থাৎ, এই অবস্থায় দিয়াত লাগবে না। এর কারণ কেউ কেউ এই বলেছেন যে, যেহেতু এর ওয়ারেস একজন কাফের যোদ্ধা, তাই সে মুসলিমের দিয়াতের অধিকারী হবে না। কেউ কেউ এর কারণ বলেছেন, এই মুসলিম ইসলাম গ্রহণ করার পর যেহেতু হিজরত করেনি, যার প্রতি সে সময় বড়ই তাকীদ করা হয়েছিল। সে এ ব্যাপারে গড়িমসি করেছে, তাই তার রক্তের মান অনেক কম। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[6] এটা আর এক তৃতীয় অবস্থা। পূর্বের অবস্থার ন্যায় এতেও কাফফারা এবং দিয়াত আছে। কেউ কেউ বলেছেন, যদি নিহত ব্যক্তি ‘মুআহিদ’ (চুক্তিবদ্ধ কাফির) হয়, তবে তার দিয়াত মুসলিমের দিয়াতের অর্ধেক হবে। কেননা, হাদীসে কাফেরের দিয়াত মুসলিমের দিয়াতের অর্ধেক বলা হয়েছে। কিন্তু অধিক সঠিক এটাই মনে হচ্ছে যে, এই তৃতীয় অবস্থাতেও মুসলিম নিহত ব্যক্তিরই বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে।
[7] অর্থাৎ, ক্রীতদাস স্বাধীন করার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে প্রথম এবং শেষের অবস্থায় দিয়াত আদায় করার সাথে সাথে ধারাবাহিকতার সাথে (কোন বিরতি ছাড়াই) একটানা দুই মাস রোযা রাখতে হবে। যদি তারই মাঝে কোন দিন রোযা ছেড়ে দেয়, তবে পুনরায় প্রথম থেকে আরম্ভ করা জরুরী হবে। তবে যদি কোন শরয়ী কারণে রোযা ছেড়ে থাকে, তাহলে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করার প্রয়োজন হবে না। যেমন, মাসিক, নিফাস অথবা এমন কঠিন রোগ যা রোযা রাখার জন্য বাধা হয়। (নিষিদ্ধ দিনসমূহ, যাতে রোযা রাখা নিষেধ আছে।) সফর শরয়ী ওজর কি না, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। (ইবনে কাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৩. আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা'নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।(১)
(১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যখন সূরা আল-ফুরকানের এ আয়াত নাযিল হল “আর তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে।” [আয়াতঃ ৬৮] তখন মক্কার মুশরিকরা বলতে লাগল, আমরা তো আল্লাহর হারাম করা আত্মাকে হত্যা করেছি, আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহকেও ডেকেছি এবং ব্যভিচারও করেছি। ফলে আল্লাহ তা'আলা নাযিল করলেন “তারা নয়, যারা তাওবা করে, ঈমান আনে” সুতরাং এই আয়াতটুকু ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যাদের কথা পূর্বে এসেছে।
কিন্তু সূরা আন-নিসার আয়াত “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা'নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।” এখানে ঐ লোককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে ইসলামকে ভালভাবে জানল, শরীআতকে বুঝল, তারপর কোন মুমিনকে হত্যা করল- তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। [বুখারীঃ ৩৮৫৫, ৪৭৬৪–৪৭৬৬, মুসলিমঃ ৩০২৩] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা আরো বলেনঃ এটি সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একে কোন কিছু রহিত করেনি। [বুখারীঃ ৪৫৯০, মুসলিমঃ ৩০২৩] এতে বুঝা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মত হল, যদি কেউ কোন মুমিনকে জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, তবে তার শাস্তি জাহান্নাম অবধারিত।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম বলেছেনঃ একজন মুমিন ব্যক্তি তার দ্বীনের ব্যাপারে মুক্তির সুযোগের মধ্যে থাকে যতক্ষন সে কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা না করে। [বুখারীঃ ৬৮৬২] অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 'আল্লাহ তা'আলা মুমিনের হত্যাকারীর জন্য তাওবাহ কবুল করতে আমার নিকট অস্বীকার করেছেন। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ৬/১৬৩, নং ২১৬৪] অন্য হাদীসে এসেছে, আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন দু মুসলিম তাদের অস্ত্র নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ব্যক্তি ও হত্যাকৃত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী।
আবু বাকরাহ বলেন, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট, কিন্তু হত্যাকৃত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি জবাব দিলেন যে, সে তার সাথীকে হত্যা করার লালস করছিল। [বুখারীঃ ৬৮৭৫, মুসলিমঃ ২৮৮৮]
হাদীসে আরো এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন প্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে মানুষের রক্তক্ষরণ তথা হত্যার ব্যাপারে। [বুখারীঃ ৬৮৬৪, মুসলিমঃ ১৬৭৮] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হত্যাকারী কিয়ামতের দিন এমনভাবে উপস্থিত হবে যে, হত্যাকৃত ব্যক্তি হত্যাকারীর মাথা ধরে রাখবে এবং বলবেঃ হে রব! আপনি একে প্রশ্ন করুন, কেন আমাকে হত্যা করেছে? [ইবন মাজাহঃ ২৬২১, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৪০]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৩) আর যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, [1] তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন। [2]
[1] এটা ইচ্ছাকৃত হত্যা করার শাস্তি। হত্যা তিন প্রকারেরঃ (ক) ভুলক্রমে হত্যা (যা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ হয়েছে)। (খ) প্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা; (এমন জিনিস দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা, যা দিয়ে সাধারণতঃ হত্যা করা যায় না।) যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা। অর্থাৎ, হত্যা করার ইচ্ছা ও নিয়ত করে হত্যা করা এবং এর জন্য সেই অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে বাস্তবিকই হত্যা করা হয়। যেমন, তরবারী, খঞ্জর ইত্যাদি। আয়াতে মু’মিনকে হত্যা করার অতীব কঠিন শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, তার শাস্তি হল সেই জাহান্নাম, যাতে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। অনুরূপ সে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবে এবং তাঁর অভিসম্পাত ও মহা শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে। একই সাথে এতগুলো কঠিন শাস্তির কথা অন্য কোন পাপের ব্যাপারে বর্ণিত হয়নি। এ থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একজন মু’মিনকে হত্যা করা কত বড় অপরাধ। হাদীসসমূহেও এ কাজের কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে এবং এর কঠোর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।
[2] মু’মিনের হত্যাকারীর তওবা কবুল হবে, নাকি হবে না? কোন কোন আলেম উল্লিখিত কঠোর শাস্তিগুলোর ভিত্তিতে তার তওবা কবুল না হওয়ার কথাই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে আলোচিত উক্তির আলোকে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, নিষ্ঠার সাথে তওবা করলে প্রত্যেক পাপই মাফ হতে পারে। [إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا ] (الفرقان: 70) অন্যান্য তওবার আয়াতসমূহও ব্যাপক। প্রত্যেক গুনাহ, ছোট হোক, বড় হোক অথবা অতি বড় যা-ই হোক না কেন, নিষ্ঠার সাথে তওবা করলে সবই মাফ হওয়া সম্ভব। এখানে তার শাস্তি জাহান্নামের কথা যে বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ হল, সে যদি তওবা না করে, তাহলে তার শাস্তি এটাই হবে, যা মহান আল্লাহ তার অপরাধের দরুন তাকে দিতে পারেন। অনুরূপ তওবা না করা অবস্থায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার অর্থ হল, তাতে সুদীর্ঘ কাল অবস্থান করতে হবে। কারণ, কাফের ও মুশরিকরাই কেবল জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। তাছাড়া হত্যার সম্পর্ক যদিও বান্দার অধিকারের সাথে, যা থেকে তওবার মাধ্যমেও দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায় না, তবুও আল্লাহ তাআলা স্বীয় কৃপা ও অনুগ্রহে তার এমনভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন যে, নিহিত ব্যক্তিও প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং হত্যাকারীরও মাফ হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৪. হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন যাচাই-বাছাই করে নেবে(১) এবং কেউ তোমাদেরকে সালাম করলে ইহ জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলো না, তুমি মুমিন নও(২), কারণ আল্লাহর কাছে অনায়াসলভ্য সম্পদ প্রচুর রয়েছে। তোমরা তো আগে এরূপই ছিলো(৩), তারপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন; কাজেই তোমরা যাচাই-বাছাই করে নেবে। নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।
(১) আয়াতের এ বাক্যে একটি সাধারণ নির্দেশ রয়েছে যে, মুসলিমরা কোন কাজ সত্যাসত্য যাচাই না করে শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে করবে না। বলা হচ্ছে- তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর কর, তখন সত্যাসত্য অনুসন্ধান করে সব কাজ করো। শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করলে প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিমরূপে পরিচয় দেয়, কালেমা পাঠ করে কিংবা অন্য কোন ইসলামী বৈশিষ্ট্য যথা আযান, সালাত ইত্যাদিতে যোগদান করে, তাকে মুসলিম মনে করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। তার সাথে মুসলিমদের মতই ব্যবহার করতে হবে এবং সে আন্তরিকভাবে মুসলিম হয়েছে না কোন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, একথা প্রমাণ করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ও স্মরণযোগ্য যে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে, কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী তাকে কাফের বলা বা মনে করা বৈধ নয়।
এর সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, কুফরের নিশ্চিত লক্ষণ, এরূপ কোন কথা বা কাজ যতক্ষণ তার দ্বারা সংঘটিত না হবে, ততক্ষণ তার ইসলামী স্বীকারোক্তিকে বিশুদ্ধ মনে করা হবে এবং তাকে মুসলিমই বলা হবে। তার সাথে মুসলিমের মতই ব্যবহার করা হবে এবং তার আন্তরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার অধিকার কারো থাকবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি ইসলাম ও ঈমান প্রকাশ করার সাথে সাথে কিছু কুফর কালেমাও উচ্চারণ করে, অথবা প্রতিমাকে প্রণাম করে কিংবা ইসলামের কোন অকাট্য ও স্বতঃসিদ্ধ নির্দেশ অস্বীকার করে কিংবা কাফেরদের কোন ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করে; যেমন গলায় পৈতা পরা ইত্যাদি, তাকে সন্দেহাতীতভাবে কুফর কাজকর্মের কারণে কাফের আখ্যা দেয়া হবে। তবে তাকে এ ব্যাপারে শরীআতের জ্ঞান দিতে হবে এবং তার যদি এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে, সে সন্দেহ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে হবে।
তারপরই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে। নতুবা ইয়াহুদী ও খৃষ্টান সবাই নিজেকে মুমিন-মুসলিম বলতো। মুসায়লামা কাযযাব শুধু কালেমার স্বীকারোক্তিই নয়, ইসলামী বৈশিষ্ট্য যথা আযান, সালাত ইত্যাদিরও অনুগামী ছিল। আযানে ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাথে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’-ও উচ্চারণ করতো। কিন্তু সাথে সাথে সে নিজেকেও নবী-রাসূল ও ওহীর অধিকারী বলে দাবী করতো, যা কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ। এ কারণেই তাকে দ্বীনত্যাগী সাব্যস্ত করা হয় এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা সর্বসম্মতিক্রমে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করে তাকে হত্যা করা হয়। তবে শর্ত এই যে, ঐ লোকের কাজটি যে ঈমান বিরোধী, তা অকাট্য ও নিশ্চিত হতে হবে। আর তাকে সেটা জানাতে হবে এবং তার সন্দেহ থাকলে তা শরীআতের দৃষ্টিতে অপনোদন করতে হবে।
(২) এ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, কেউ মুসলিম বলে নিজেকে পরিচয় দিলে অনুসন্ধান ব্যতিরেকে তার উক্তিকে কপটতা মনে করা কোন মুসলিমের জন্যই বৈধ নয়। এ ব্যাপারে কোন কোন সাহাবী থেকে ভুল সংঘটিত হওয়ার কারণে আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, বনী-সুলাইমের এক ব্যক্তি একদিন ছাগলের পাল চরানো অবস্থায় একদল মুজাহিদ সাহাবীর সম্মুখে পতিত হয়। সে মুজাহিদ দলকে সালাম করল। তার পক্ষ থেকে এ বিষয়ের কার্যতঃ অভিব্যক্তি ছিল যে, সে একজন মুসলিম। কিন্তু মুজাহিদরা মনে করলো যে সে শুধু জীবন ও ছাগলের পাল রক্ষা করার জন্যই এ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
এ সন্দেহে তারা লোকটিকে হত্যা করে তার ছাগলের পাল অধিকার করে নিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত করলেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। এতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ইসলামী পদ্ধতিতে তোমাকে সালাম করে, তার সম্পর্কে এরূপ সন্দেহ করো না যে, সে প্রতারণাপূর্বক নিজেকে মুসলিম বলে প্রকাশ করেছে। তার অর্থ-সম্পদ যুদ্ধলব্ধ মাল মনে করে অধিকারে নিওনা। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/২৩৫, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২২৯, ২৭২, ৩২৪, তিরমিযীঃ ৩০৩০] আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে এ দু’টি ঘটনা ছাড়া আরো দু’টি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, কিন্তু সুবিজ্ঞ তাফসীরবিদগণ বলেছেন, এসব রেওয়ায়েতের মাঝে কোন বিরোধ নেই। সমষ্টিগতভাবে কয়েকটি ঘটনাও আয়াতটি নাযিলের কারণ হতে পারে।
(৩) অর্থাৎ তোমাদেরও আগে এমন এক সময় ছিল যখন তোমরা কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলে। যুলুম নির্যাতনের ভয়ে ইসলামের কথা বাধ্য হয়ে গোপন রাখতে। ঈমানের মৌখিক অঙ্গীকার ছাড়া তোমাদের কাছে তার আর কোন প্রমাণ ছিল না। এখন আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা সামাজিক জীবন-যাপনের সুবিধা ভোগ করছ। কাফেরদের মুকাবেলায় ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার যোগ্যতা লাভ করেছ। কাজেই যেসব মুসলিম এখনো প্রথম অবস্থায় আছে তাদের ব্যাপারে কোমল ব্যবহার ও সুবিধা দানের নীতি অবলম্বন না করলে তোমাদেরকে যে অনুগ্রহ করা হয়েছে, তার প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে না।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৪) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে বের হবে, তখন তদন্ত করে নাও। আর কেউ তোমাদেরকে সালাম জানালে তাকে বলো না যে, তুমি বিশ্বাসী নও। [1] ইহজীবনের সম্পদ চাইলে আল্লাহর কাছে গনীমত (অনায়াসলভ্য সম্পদ) প্রচুর রয়েছে। [2] তোমরা তো পূর্বে এরূপই ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং তোমরা পরীক্ষা করে নাও। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।
[1] হাদীসসমূহে এসেছে যে, কিছু সাহাবী কোন অঞ্চলে গিয়েছিলেন। সেখানে এক রাখাল ছাগল চরাচ্ছিল। মুসলিমদেরকে দেখে রাখাল সালাম করল। সাহাবাদের কেউ কেউ মনে করলেন যে, (সে একজন কাফের শত্রু।) সে স্বীয় প্রাণের ভয়ে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিচ্ছে। সুতরাং তাঁরা সত্যতা যাচাই না করেই তাকে হত্যা করে দেন এবং তার ছাগলগুলো (গনীমতের মাল স্বরূপ) নিয়ে রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী, তিরমিযী তাফসীর সূরাতুননিসা) কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (সাঃ) তাঁদেরকে এ কথাও বলেন যে, পূর্বে তোমরাও মক্কায় এই রাখালের মত নিজেদের ঈমানকে গোপন করতে বাধ্য ছিলে। (সহীহ বুখারী, দিয়াত অধ্যায়ঃ)
[2] অর্থাৎ, কিছু ছাগল এই নিহত ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়ে গেলে। এ তো কিছুই না, আল্লাহর কাছে এর চেয়েও অনেক উত্তম গনীমত (অনায়াসলব্ধ সম্পদ) রয়েছে, যা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করলে দুনিয়াতেও তোমরা পেতে পার এবং আখেরাতে এর পাওয়া তো সুনিশ্চিত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৫. মুমিনদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়।(১) যারা স্বীয় ধন-প্ৰাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে, যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন(২); তাদের প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহাপুরস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।
(১) বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যখন নাযিল হল “মুমিনদের মধ্যে যারা ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়” তখন আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো অন্ধ। তখন নাযিল হল “যারা অক্ষম নয়”-এ অংশটুকু। [বুখারীঃ ২৮৩১, ৪৫৯৩, মুসলিমঃ ১৮৯৮]
(২) আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু সাঈদ! যে আল্লাহকে রব হিসাবে মেনে সন্তুষ্ট, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসাবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট তার জন্য জান্নাত অবধারিত। আবু সাঈদ এটা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আবার বলুন। রাসূল তাই করলেন। তারপর বললেনঃ “আরো কিছু কাজ রয়েছে, যার দ্বারা জান্নাতে বান্দার মর্যাদা উন্নত করা হয়, দু’স্তরের মাঝখানের দূরত্ব আসমান ও যমীনের মাঝখানের দূরত্বের মত। তিনি বললেন, সেটা কি? হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। [মুসলিমঃ ১৮৮৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 'জান্নাতের একশত স্তর রয়েছে, দু’স্তরের মাঝখানের দূরত্ব শত বৎসরের। [তিরমিযীঃ ২৫২৯]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৫) বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে তারা এবং যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে, তারা সমান নয়। [1] যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে, আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।[2] আর যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর, যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহা পুরস্কার দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
[1] যখন এই আয়াত নাযিল হল যে, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে তারা এবং যারা বাড়ীতে অবস্থান করে তারা পরস্পর সমান নয়’, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) (অন্ধ সাহাবী) প্রভৃতিরা অভিযোগ করলেন যে, আমরা তো অক্ষম, যার কারণে আমরা জিহাদে অংশ গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত। উদ্দেশ্য ছিল, ঘরে অবস্থান করার কারণে জিহাদে অংশ গ্রহণকারীদের সমান আমরা নেকী ও সওয়াব অর্জন করতে পারব না, অথচ আমাদের ঘরে অবস্থান স্বেচ্ছায় এবং জান বাঁচানোর জন্য নয়, বরং শরয়ী কারণেই। তাই মহান আল্লাহ [غَيْرُ اُولى الضَّرَرِ] (যারা অক্ষম নয়) কথাটি নাযিল করলেন। অর্থাৎ, যারা সঙ্গত ওজরের কারণে বাড়ীতে অবস্থান করে, তারাও মুজাহিদদের মত নেকীতে সমান সমান শরীক থাকবে। কারণ, (حَبَسَهُمُ العُذْرُ) ‘‘ওজরই তাদের পথে বাধা হয়েছে।’’ (সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়ঃ)
[2] অর্থাৎ, জান ও মাল সহ জিহাদে অংশ গ্রহণকারীরা বৈশিষ্ট্য লাভের অধিকারী হবে। আর জিহাদে যারা অংশগ্রহণ করতে পারে না, তারা এই বৈশিষ্ট্য লাভ থেকে বঞ্চিত হলেও মহান আল্লাহ উভয়কেই উত্তম প্রতিদান দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এটাকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করে উলামারা বলেছেন যে, সাধারণ অবস্থায় জিহাদ ‘ফারযে আ’ইন’(যা করা সকলের উপর ফরয) নয়, বরং ‘ফারযে কিফায়াহ’ (যা উম্মতের যথেষ্ট পরিমাণ লোক করলেই হয়)। অর্থাৎ, যে পরিমাণ লোকের প্রয়োজন সে পরিমাণ লোক জিহাদে অংশ গ্রহণ করলেই মনে করে নেওয়া হবে যে, সেই অঞ্চলের অন্য লোকদের পক্ষ হতে এই ফরয আদায় হয়ে গেছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৬. এসব তার কাছ থেকে মর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৬) এ তাঁর (আল্লাহর) তরফ হতে মর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া। বস্তুতঃ আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৭. তাদের প্রাণগ্রহণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম: তারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে(১)? এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস!(২)
(১) হিজরত সম্পর্কিত আয়াতসমূহে তিন রকমের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। (এক) হিজরতের ফযীলত, (দুই) হিজরতের দুনিয়া ও আখেরাতের বরকত ও (তিন) সামর্থ্য থাকা সত্বেও দারুল-কুফর থেকে হিজরত না করার কারণে শাস্তিবাণী।
হিজরতের ফযীলতঃ এ বিষয়ে সূরা বাকারার এক আয়াতে রয়েছে- (إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ) অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ তা'আলারঅনুগ্রহ-প্রার্থী আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুণাময় [সূরা আল-বাকারাহঃ ২১৮] অনুরূপভাবে আছে- (الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ) অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে মাল ও জান দ্বারা জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ্র কাছে বিরাট পদমর্যাদার অধিকারী এবং তারাই সফলকাম”। [সূরা আত-তাওবাহঃ ২০] অন্যত্র এসেছে: (وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রাসূলের নিয়তে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পথেই মৃত্যুবরণ করে তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায় সাব্যস্ত হয়ে যায়”। [সূরা আন-নিসাঃ ১০০]
মোটকথা, উপরোক্ত তিনটি আয়াতে দারুল-কুফর থেকে হিজরতে উৎসাহ দান এবং এর বিরাট ফযীলত সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হিজরত পূর্বকৃত সব গোনাহকে নিঃশেষ করে দেয়। [মুসলিম: ১২১; সহীহ ইবন খুযাইমাহ ২৫১৫]
হিজরতের বরকতঃ হিজরতের বরকত সম্পর্কে সূরা নাহলের ৪১ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যারা আল্লাহর জন্য হিজরত করে নির্যাতিত হওয়ার পর, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে উত্তম ঠিকানা দান করবো এবং আখেরাতের বিরাট সওয়াব তো রয়েছেই, যদি তারা বুঝে সূরা নিসার উল্লেখিত চার আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে অনেক জায়গা ও সুযোগসুবিধা পাবে”।
(২) আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কিছু মুসলিম কাফেরদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাসত্বেও অংশগ্রহণ করত। এতেকরে কাফেরদের পাল্লা ভারী হত। কিন্তু যুদ্ধের সময় কোন কোন তীর এসে তাদেরকে হত্যা করত। তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করে তাদেরকে এ অবস্থায় থাকা থেকে নিষেধ করেছেন ৷ [বুখারীঃ ৪৫৯৬, ৭০৮৫]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৭) যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করে, তাদের প্রাণ-হরণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?’ [1] তারা বলে, ‘দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’ [2] তারা বলে, ‘তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর দুনিয়া কি এমন প্রশস্ত ছিল না?’ এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাস!
[1] এই আয়াত এমন সব লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যারা মক্কায় ও তার আশেপাশে বসবাস করত। তারা মুসলিম তো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অঞ্চল ও গোত্র ছেড়ে হিজরত করেনি। অথচ মুসলিম শক্তিকে একই স্থানে কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে হিজরত করার উপর মুসলিমদের জন্য অতিশয় তাকীদী নির্দেশ জারী করা হয়েছিল। কাজেই যারা হিজরত করার নির্দেশের উপর আমল করেনি, তাদেরকে এখানে অত্যাচারী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম বলা হয়েছে। এ থেকে প্রথমতঃ জানা যায় যে, অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামের কোন কোন আমল (ত্যাগ করা) কুফরী পর্যায়ে পৌঁছে যায় অথবা (পালন করলে) ইসলাম গণ্য হয়। যেমন, এই সময়ে হিজরত করাই ইসলাম গণ্য হয়েছে এবং তা ত্যাগ করা প্রায় কুফরীর আওতাভুক্ত গণ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ জানা যায় যে, এমন কাফের দেশ থেকে হিজরত করা ফরয, যেখানে ইসলামের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আমল করা কঠিন হয় এবং যেখানে থাকা কুফরী ও কাফেরদের উৎসাহ লাভের কারণ হয়।
[2] আয়াত নাযিল হওয়ার কারণের দিক দিয়ে এখানে ‘আরয’(দুনিয়া) বলতে মক্কা ও তার পার্শবস্থ অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে এবং এর পরের ‘আরয’(দুনিয়া) বলতে মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। তবে নির্দেশের দিক দিয়ে সাধারণ। অর্থাৎ, প্রথম ‘আরয’ (দুনিয়া) বলতে কাফেরদের দুনিয়া বা দেশ যেখানে ইসলাম অনুযায়ী আমল করা কঠিন হয় এবং ‘আরযুল্লাহ’ (আল্লাহর দুনিয়া) বলতে এমন সব জায়গা বা দেশ, যেখানে মানুষ আল্লাহর দ্বীনের উপর আমল করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে যায়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৮. যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন পথও পায় না।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৮) তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন পথও পায় না (তাদের কথা ভিন্ন)। [1]
[1] এখানে হিজরতের নির্দেশ থেকে সেই সব পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদেরকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে, যারা ছিল হিজরতের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত এবং পথের ব্যাপারে অজ্ঞ। শিশুরা যদিও শরীয়তের বিধি-বিধানের ভার থেকে মুক্ত, তবুও এখানে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে হিজরতের গুরুত্বকে আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার জন্য অথবা এখানে শিশু বলতে সাবালকত্বের কাছাকাছি কিশোরদের বুঝানো হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯৯. আল্লাহ অচিরেই তাদের পাপ মোচন করবেন, কারণ আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৯) আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং আল্লাহ মার্জনাকারী, পরম ক্ষমাশীল।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১০০. আর কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করলে সে দুনিয়ায় বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য লাভ করবে। আর কেউ আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে নিজ ঘর থেকে মুহাজির হয়ে বের হবার পর তার মৃত্যু ঘটলে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহ্র উপর; আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(১)
(১) বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, হিজরত বাধ্যতামূলক হওয়ার সংবাদ পেয়ে অনেক সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করতে বের হওয়ার পর পথিমধ্যেই বিভিন্ন কারণে মারা যান। এতে কাফেররা তাদেরকে বিভিন্নভাবে উপহাস করতে আরম্ভ করল। তখন আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করেন, যাতে বলা হয়েছে যে, কেউ খাঁটি নিয়তে আল্লাহর পথে হিজরত করতে বের হলেই তার পক্ষ থেকে হিজরত ধরে নেয়া হবে। [দেখুন- মুসনাদে আবি ইয়া'লাঃ ২৬৭৯] আবার কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, খালেদ ইবন হিযাম আবিসিনিয়ায় হিজরতকালে পথিমধ্যে সপ-দংশনে মারা যান। তখন লোকেরা তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকায় এ আয়াত নাযিল হয়। [তাবাকাতে ইবন সা'দ]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০০) আর যে কেউ আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করবে, সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয়স্থল ও প্রাচুর্য লাভ করবে[1] এবং যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হয়ে বের হলে অতঃপর (সে অবস্থায়) তার মৃত্যু ঘটলে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহর উপর।[2] বস্তুতঃ আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] এই আয়াতে হিজরতের প্রতি প্রেরণা এবং মুশরিকদের থেকে পৃথকভাবে বসবাস করার শিক্ষা রয়েছে। مُرَاغَمًا এর অর্থ স্থান, বাসস্থান অথবা আশ্রয়স্থল। আর سَعَةٌ এর অর্থ রুযীর প্রাচুর্য অথবা স্থান ও পৃথিবী ও দেশসমূহের প্রশস্ততা।
[2] এখানে নেক-নিয়ত অনুযায়ী নেকী ও প্রতিদান পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে, যদিও কেউ মৃত্যু হয়ে যাওয়ার কারণে নেক আমলকে পূর্ণ করতে না পারে। যেমন, অতীত উম্মতের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তির ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ১০০ জন মানুষ খুন করেছিল। অতঃপর তওবা করার জন্য পুণ্যবানদের একটি গ্রামে যাচ্ছিল। পথিমধ্যেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। মহান আল্লাহ পুণ্যবানদের গ্রামকে অন্য গ্রামের তুলনায় নিকটতর করে দিলেন। যার ফলে রহমতের ফিরিশতাগণ তাকে তাঁদের সাথে নিয়ে গেলেন। (বুখারী ৩৪৭০, মুসলিম ২৬৭৭নং) অনুরূপ যে ব্যক্তি হিজরতের নিয়তে ঘর থেকে বের হল, তার যদি পথিমধ্যেই মৃত্যু এসে যায়, সে আল্লাহর পক্ষ হতে হিজরতের সওয়াব অবশ্যই পাবে, যদিও সে হিজরতের কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়নি। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, (إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ) আমলসমূহ নির্ভর করে নিয়তের উপর। (وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِىءٍمَا نَوَى) আর মানুষ তা-ই পায়, যার সে নিয়ত করে। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া অর্জনের জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত তারই জন্য হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছে।’’ (বুখারী ১, মুসলিম ১৯০৭নং) এটি একটি এমন ব্যাপক বিধান, যা দ্বীনের প্রত্যেক বিষয়কেই শামিল। অর্থাৎ, কাজ করার সময় যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ উদ্দেশ্য হয়, তবে তা গ্রহণীয় হবে, অন্যথা তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান