বরকতময় সে সত্তা যিনি আসমানে সৃষ্টি করেছেন বিশালকায় গ্রহসমূহ। আর তাতে প্রদীপ ও আলো বিকিরণকারী চাঁদ সৃষ্টি করেছেন। আল-বায়ান
কতই না কল্যাণময় তিনি যিনি আসমানে নক্ষত্ররাজির সমাবেশ ঘটিয়েছেন আর তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ আর আলো বিকিরণকারী চন্দ্র। তাইসিরুল
কত মহান তিনি, যিনি নভোমন্ডলে সৃষ্টি করেছেন তারকারাজি এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চাঁদ! মুজিবুর রহমান
Blessed is He who has placed in the sky great stars and placed therein a [burning] lamp and luminous moon. Sahih International
৬১. কত বরকতময় তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করেছেন বিশাল তারকাপুঞ্জ এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্ৰদীপ(১) ও আলো বিকিরণকারী চাঁদ।
(১) অর্থাৎ সূর্য। [বাগভী] যেমন সূরা নূহে পরিষ্কার করে বলা হয়েছেঃ “আর সূর্যকে প্ৰদীপ বানিয়েছেন”। [সূরা নূহ: ১৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬১) কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন[1] এবং ওতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ (সূর্য) ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।[2]
[1] بُرُوج শব্দটি بُرْج শব্দের বহুবচন। (এর আসল অর্থ হল প্রকাশ। রাশিচক্র নক্ষত্রমালার প্রাসাদ ও অট্টালিকার মত। আর তা আকাশে প্রকাশ ও স্পষ্ট হওয়ার কারণে ‘বুরুজ’ বলা হয়।) সালাফদের তফসীরে بُرُوج বলতে বড় বড় গ্রহ-নক্ষত্রকে বুঝানো হয়েছে। আর এই তফসীরে আয়াতের বাগধারায় অর্থ দাঁড়ায় যে, বরকতময় সেই সত্তা, যিনি আকাশে বড় বড় গ্রহ-নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তী যুগের তফসীরকারগণ জ্যোতিষীদের পরিভাষার (কল্পিত) রাশিচক্র অর্থ নিয়েছেন। যার সংখ্যা হল বারটি; মেষরাশি, বৃষরাশি, মিথুনরাশি, কর্কটরাশি, সিংহরাশি, কন্যারাশি, তুলারাশি, বৃশ্চিকরাশি, ধনুঃরাশি, মকররাশি, কুম্ভরাশি ও মীনরাশি। আর এই বারটি রাশি সাতটি বড় বড় গ্রহের কক্ষপথ; যাদের নামঃ মঙ্গল, শুক্র, বুধ, চন্দ্র, সূর্য, বৃহস্পতি ও শনি। এই সমস্ত গ্রহ উক্ত রাশিতে এমনভাবে অবস্থান করে যে, ওগুলো যেন তাদের জন্য সুবিশাল প্রাসাদস্বরূপ। (আইসারুত তাফাসীর)
[2]( সূরা ইউনুসের ৫নং আয়াতের মত এ আয়াতেও প্রমাণ হয় যে, চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সুতরাং বিজ্ঞানের এ কথা বহু পূর্বেই কুরআনে প্রমাণিত হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর তিনি দিবা-রাত্রিকে পরস্পরের অনুগামী করেছেন। যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্য। আল-বায়ান
আর তিনিই রাত আর দিনকে করেছেন পরস্পরের অনুগামী তাদের জন্য যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায়, অথবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়। তাইসিরুল
এবং যারা উপদেশ গ্রহণ করতে ও কৃতজ্ঞ হতে চায় তাদের জন্য তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত এবং দিনকে পরস্পরের অনুগামী রূপে। মুজিবুর রহমান
And it is He who has made the night and the day in succession for whoever desires to remember or desires gratitude. Sahih International
৬২. আর তিনিই করেছেন রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামীরূপে তার জন্য—যে উপদেশ গ্রহণ করতে বা কৃতজ্ঞ হতে চায়।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬২) এবং যারা উপদেশ গ্রহণ ও কৃতজ্ঞতা করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য রাত এবং দিনকে সৃষ্টি করেছেন পরস্পরের অনুগামীরূপে। [1]
[1] অর্থাৎ, রাত্রি যায় দিন আসে, আর দিন যায় রাত্রি আসে। দিবারাত্রি একত্রিত হয় না। দিন-রাত্রির উপকারিতার কথা বিশদ বিবরণের অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ خِلْفَة এর অর্থ এক অপরের বিপরীত বলেছেন। অর্থাৎ, রাত্রি অন্ধকার এবং দিন উজ্জ্বল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আল-বায়ান
আর রহমানের বান্দা তারাই যারা যমীনে নম্রভাবে চলাফেরা করে আর অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করলে তারা বলে- ‘শান্তি’, (আমরা বিতর্কে লিপ্ত হতে চায় না)। তাইসিরুল
‘রাহমান’ এর বান্দা তারাই যারা নম্রভাবে চলাফিরা করে পৃথিবীতে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ লোকেরা সম্বোধন করে তখন তারা বলেঃ সালাম। মুজিবুর রহমান
And the servants of the Most Merciful are those who walk upon the earth easily, and when the ignorant address them [harshly], they say [words of] peace, Sahih International
৬৩. আর রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা যমীনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে(১) এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, সালাম(২);
(১) অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে নম্রতা সহকারে চলাফেরা করে। هون শব্দের অর্থ এখানে স্থিরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় অর্থাৎ গর্বভরে না চলা, অহংকারীর ন্যায় পা না ফেলা। অহংকারের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে না। গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে নিজের শক্তি প্ৰকাশ করার চেষ্টা না করা। বরং তাদের চালচলন। হয় একজন ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মতো। খুব ধীরে চলা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, বিনা প্রয়োজনে ধীরে চলা সুন্নাত বিরোধী। হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ধীরে চলতেন না; বরং কিছুটা দ্রুত গতিতে চলতেন। হাদীসের ভাষা এরূপ, كَأنَّهَا الأرْضُ تُطْوَى لَهُ অর্থাৎ “চলার সময় পথ যেন তার জন্য সংকুচিত হত।” [ইবনে হিব্বানঃ ৬৩০৯] এ কারণেই পূর্ববর্তী মনীষীগণ ইচ্ছাকৃতভাবেই রোগীদের ন্যায় ধীরে চলাকে অহংকার ও কৃত্রিমতার আলামত হওয়ার কারণে মাকরূহ সাব্যস্ত করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু জনৈক যুবককে খুব ধীরে চলতে দেখে জিজ্ঞেস করেনঃ তুমি কি অসুস্থ? সে বললঃ না। তিনি তার প্রতি চাবুক উঠালেন এবং শক্তি সহকারে চলার আদেশ দিলেন। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাদাইউত তাফসির]
হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ (يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا) আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ খাঁটি মুমিনদের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চক্ষু, কৰ্ণ, হাত, পা, আল্লাহর সামনে হীন ও অক্ষম হয়ে থাকে। অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে দেখে অপারগ ও পঙ্গু মনে করে, অথচ তারা রুগ্নও নয় এবং পঙ্গুও নয়; বরং সুস্থ ও সবল। তবে তাদের উপর আল্লাহভীতি প্রবল, যা অন্যদের উপর নেই। তাদেরকে পার্থিব কাজকর্ম থেকে আখেরাতের চিন্তা নিবৃত্ত রাখে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে না এবং তার সমস্ত চিন্তা দুনিয়ার কাজেই ব্যাপৃত, সে সর্বদা দুঃখই ভোগ করে। কারণ, সে তো দুনিয়া পুরোপুরি পায় না এবং আখেরাতের কাজেও অংশগ্রহণ করে না। যে ব্যক্তি পানাহারের বস্তুর মধ্যেই আল্লাহর নেয়ামত সীমিত মনে করে এবং উত্তম চরিত্রের প্ৰতি লক্ষ্য করে না, তার জ্ঞান খুবই অল্প এবং তার জন্য শাস্তি তৈরী রয়েছে। [ইবন কাসীর]
(২) অর্থাৎ যখন জাহেল ব্যক্তিরা তাদের সাথে কথা বলে, তখন তারা বলে- ‘সালাম’। এখানে جَاهِلُون শব্দের অর্থ বিদ্যাহীন ব্যক্তি নয়; বরং যারা মূর্খতার কাজ ও মূর্খতাপ্রসূত কথাবার্তা বলে, যদিও বাস্তবে বিদ্বানও বটে। মূর্খ মানে অশিক্ষিত বা লেখাপড়া না জানা লোক নয় বরং এমন লোক যারা জাহেলী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার উদ্যোগ নিয়েছে এবং কোন ভদ্রলোকের সাথে অশালীন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। রহমানের বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। [দেখুন-ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী, বাদাইউত তাফসির]। যেমন কুরআনের অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ “আর যখন তারা কোন বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায়। বলে, আমাদের কাজের ফল আমরা পাবো এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সাথে কথা বলি না।” [সূরা আল-কাসাসঃ ৫৫]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৩) তারাই পরম দয়াময়ের দাস, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’। [1]
[1] ‘সালাম’ বলার অর্থ মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ও তর্ক-বিতর্ক ছেড়ে দেওয়া। অর্থাৎ, ঈমানদাররা জাহেল ও মুর্খ লোকদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে না। বরং তারা এমতাবস্থায় এড়িয়ে চলার পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং ফালতু বিতন্ডা বর্জন করে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দন্ডায়মান হয়ে রাত্রি যাপন করে। আল-বায়ান
আর তারা রাত কাটায় তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশে সাজদায় অবনত ও দন্ডায়মান অবস্থায়। তাইসিরুল
এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রবের উদ্দেশে সাজদাহবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে। মুজিবুর রহমান
And those who spend [part of] the night to their Lord prostrating and standing [in prayer] Sahih International
৬৪. এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের রব-এর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে(১);
(১) অর্থাৎ তারা রাত্রি যাপন করে তাদের পালনকর্তার সামনে সিজদারত অবস্থায় ও দণ্ডায়মান অবস্থায়। ইবাদাতে রাত্রি জাগরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, এই সময়টি নিদ্রা ও আরামের। এতে সালাত ও ইবাদাতের জন্য দণ্ডায়মান হওয়া যেমন বিশেষ কষ্টকর, তেমনি এতে লোকদেখানো ও নাম যশোর আশংকাও নেই। উদ্দেশ্য এই যে, তারা দিবারাত্রি আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের জীবনের এ দিকগুলো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন অন্য সূরায় বলা হয়েছেঃ “তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, নিজেদের রবকে ডাকতে থাকে আশায় ও আশংকায়।” [সূরা আস-সাজদাহঃ ১৬] অন্যত্র আরো বলা হয়েছেঃ “এ সকল জান্নাতবাসী ছিল এমন সব লোক যারা রাতে সামান্যই ঘুমাতো এবং ভোর রাতে মাগফিরাতের দোআ করতো।” [সূরা আয-যারিয়াতঃ ১৭–১৮]
আরো বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি হয় আল্লাহর হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের প্রত্যাশা করে তার পরিণাম কি মুশরিকের মতো হতে পারে?” [সূরা আয-যুমারঃ ৯] হাদীসে সালাতুত তাহাজ্জুদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় কর, কেননা, এটা তোমাদের পূর্ববর্তী সকল নেককারদের অভ্যাস ছিল। এটা তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা'আলার নৈকট্য দানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং গোনাহ থেকে নিবৃত্তকারী।” [সহীহ ইবনে খুযাইমাহঃ ১১৩৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামাআতে আদায় করে, সে যেন অর্ধারাত্রি ইবাদাতে অতিবাহিত করে এবং যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে, তাকে অবশিষ্ট অর্ধারাত্ৰিও ইবাদাতে অতিবাহিত্যকারী হিসেবে গণ্য করা হবে।” [মুসলিমঃ ৬৫৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৪) এবং যারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় এর আযাব হল অবিচ্ছিন্ন’। আল-বায়ান
আর তারা বলে : ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি দূর কর, তার শাস্তি তো ভয়াবহ বিপদ।’ তাইসিরুল
এবং তারা বলেঃ হে আমাদের রাব্ব! আমাদের হতে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত করুন; ওর শাস্তিতো নিশ্চিত বিনাশ। মুজিবুর রহমান
And those who say, "Our Lord, avert from us the punishment of Hell. Indeed, its punishment is ever adhering; Sahih International
৬৫. এবং তারা বলে, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি হটিয়ে নিন, তার শাস্তি তো অবিচ্ছিন্ন।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৫) এবং যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি নিবৃত্ত কর; জাহান্নামের শাস্তি তো নিশ্চিতভাবে ধ্বংসাত্মক; [1]
[1] এখান হতে বুঝা যাচ্ছে যে, রহমানের বান্দা ওরাই যারা একদিকে রাত্রে আল্লাহর ইবাদত করে, আবার অন্য দিকে ভয়ও করে যে, কোন ভুল বা আলস্যের কারণে আল্লাহ ধরে না বসেন। সেই জন্য তারা জাহান্নামের আযাব হতে আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে। অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত তথা আজ্ঞা পালন করা সত্ত্বেও আল্লাহর আযাব ও তাঁর পাকড়াও হতে নির্ভয় হওয়া ও নিজ ইবাদতের উপর গর্ব করা উচিত নয়। এই অর্থ অন্য জায়গায় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, {وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوا وَّقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ} অর্থাৎ, আর যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করবার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে। (সূরা মু’মিনূন ৬০ আয়াত) ভয় শুধু এই কারণে নয় যে, তাদেরকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে; বরং তাদের ভয় হয় যে, তাদের দান খয়রাত গ্রহণ হচ্ছে কি না? হাদীসে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘এই আয়াতে কি ঐ সব লোকেদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা মদ পান ও চুরি করে?’ তিনি বললেন, ‘‘না, হে আবূ বাকরের বেটী! বরং তারা ঐ সব লোক, যারা রোযা রাখে, নামায পড়ে, দান করে। তা সত্ত্বেও তারা ভয় করে যে, তাদের এইসব সৎকর্মগুলো যেন আল্লাহর দরবারে অগ্রহণীয় না হয়ে যায়।’’ (তিরমিযী, কিতাবুততাফসীর সূরাতুল মু’মিনূন)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান‘নিশ্চয় তা অবস্থানস্থল ও আবাসস্থল হিসেবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট’। আল-বায়ান
তা আবাসস্থল আর অবস্থান নেয়ার জায়গা হিসেবে কতই না নিকৃষ্ট! তাইসিরুল
নিশ্চয়ই আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে ওটা কত নিকৃষ্ট! মুজিবুর রহমান
Indeed, it is evil as a settlement and residence." Sahih International
৬৬. নিশ্চয় সেটা বসবাস ও অবস্থানস্থল হিসেবে খুব নিকৃষ্ট।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৬) নিশ্চয় তা আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে অতীব নিকৃষ্ট!’
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। আল-বায়ান
আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, আর কৃপণতাও করে না; এ দু’য়ের মধ্যবর্তী পন্থা গ্রহণ করে। তাইসিরুল
আর যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করেনা এবং কার্পন্যও করেনা; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। মুজিবুর রহমান
And [they are] those who, when they spend, do so not excessively or sparingly but are ever, between that, [justly] moderate Sahih International
৬৭. এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কৃপনতাও করে না, আর তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।(১)
(১) অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অপব্যয় করে না এবং কৃপণতাও করে না; বরং উভয়ের মধ্যবর্তী সমতা বজায় রাখে। আয়াতে أسْرَافٌ এবং এর বিপরীতে إقْتَارٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। أسْرَافٌ এর অর্থ সীমা অতিক্রম করা। শরীয়তের পরিভাষায় ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদাহ, ইবনে জুবায়েরের মতে আল্লাহ্র অবাধ্যতার কাজে ব্যয় করা أسْرَافٌ তথা অপব্যয়; যদিও তা এক পয়সাও হয়। কেউ কেউ বলেন, বৈধ এবং অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করাও অপব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, تَبْذِيْرٌ তথা অনর্থক ব্যয় কুরআনের আয়াত দ্বারা হারাম ও গোনাহ্। আল্লাহ বলেনঃ (إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ) [সূরা আল-ইসরাঃ ২৭]
إقْتَارٌ শব্দের অর্থব্যয়ে ত্রুটি ও কৃপণতা করা। শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ যেসব কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যয় করার আদেশ দেন, তাতে ব্যয় না করা বা কম করা। এই তাফসীরও ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ প্রমুখ হতে বর্ণিত আছে। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ এই যে, তারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে অপব্যয় ও ত্রুটির মাঝখানে সততা ও মিতব্যয়ীতার পথ অনুসরণ করে। দেখুন। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী]
(৬৭) এবং যারা ব্যয় করলে অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা এ দুয়ের মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে। [1]
[1] আল্লাহর অবাধ্যতায় (পাপকাজে) খরচ করা অপব্যয় এবং আল্লাহর পথে খরচ না করা কৃপণতা। আর আল্লাহর নির্দেশানুসারে ও তাঁর আনুগত্যের পথে খরচ করা হল মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। (ফাতহুল কাদীর) অনুরূপ আবশ্যকীয় খরচে ও বৈধ খরচেও সীমা অতিক্রম করা অপব্যয় বলে গণ্য। অতএব সে ক্ষেত্রেও সাবধানতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করা একান্ত জরুরী।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নাফসকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। আল-বায়ান
তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না। আর যথার্থতা ব্যতীত কোন প্রাণ হত্যা করে না যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন আর তারা ব্যভিচার করে না। আর যে এগুলো করে সে শাস্তির সাক্ষাৎ লাভ করবে। তাইসিরুল
এবং তারা আল্লাহর সাথে কোন উপাস্যকে ডাকেনা; আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে তারা হত্যা করেনা এবং ব্যভিচার করেনা; যে এগুলি করে সে শাস্তি ভোগ করবে। মুজিবুর রহমান
And those who do not invoke with Allah another deity or kill the soul which Allah has forbidden [to be killed], except by right, and do not commit unlawful sexual intercourse. And whoever should do that will meet a penalty. Sahih International
৬৮. এবং তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না(১)। আর আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না(২)। আর তারা ব্যভিচার করে না(৩); যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে।
(১) পূর্ববর্তী ছয়টি গুণের মধ্যে আনুগত্যের মূলনীতি এসে গেছে। এখন গোনাহ ও অবাধ্যতার প্রধান প্রধান মূলনীতি বর্ণিত হচ্ছে। তন্মধ্যে প্রথম মূলনীতি বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ তারা ইবাদাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না। [ফাতহুল কাদীর]
(২) এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “একজন মুমিন ঐ পর্যন্ত পরিত্রাণের আশা করতে পারে যতক্ষণ সে কোন হারামকৃত রক্ত প্রবাহিত না করে’৷ [বুখারী: ৬৮৬২]
(৩) রহমানের বান্দারা কোন ব্যভিচার করে না। ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয় না। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সবচেয়ে বড় গুণাহ কি? তিনি বললেনঃ “তুমি যদি কাউকে (প্ৰভুত্ব, নাম-গুণে এবং ইবাদতে) আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করাও”। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর? তিনি বললেনঃ “তুমি যদি তোমার সন্তানকে হত্যা কর এই ভয়ে যে, সে তোমার সাথে আহারে অংশ নেবে”। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর? তিনি বললেনঃ “তুমি যদি তোমার পড়াশীর স্ত্রীর সাথে যিনা কর”। [বুখারীঃ ৬৮৬১, মুসলিমঃ ৮৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৮) এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করে না, আল্লাহ যাকে যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে হত্যা নিষেধ করেছেন, তাকে হত্যা করে না[1] এবং ব্যভিচার করে না। [2] আর যারা এগুলি করে, তারা শাস্তি ভোগ করবে ।
[1] যথার্থ কারণের তিনটি অবস্থা হতে পারে। যেমন, মুসলিম হওয়ার পর যদি কেউ মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যায়, বিবাহের পর ব্যভিচারে লিপ্ত হয় অথবা কাউকে হত্যা করে, তাহলে এই তিন অবস্থাতেই তাকে হত্যা করা হবে।
[2] হাদীসে এসেছে, রসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘সব থেকে বড় পাপ কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’ বলা হল, ‘তারপর কোন্ পাপ?’ তিনি বললেন, ‘‘সন্তানকে খেতে দেওয়ার ভয়ে হত্যা করা।’’ বলা হল, ‘তারপর কোন্ পাপ?’ তিনি বললেন, ‘‘প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা।’’ তারপর তিনি বললেন, ‘‘উক্ত কথাগুলোর সত্যতা এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়।’’ তারপর তিনি উক্ত আয়াত পাঠ করলেন।
(বুখারী সূরা বাক্বারার তাফসীর, মুসলিম ঈমান অধ্যায়)
তাফসীরে আহসানুল বায়ানকিয়ামতের দিন তার আযাব বর্ধিত করা হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে। আল-বায়ান
ক্বিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে আর সে সেখানে লাঞ্ছিত হয়ে চিরবাস করবে। তাইসিরুল
কিয়ামাত দিবসে তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। মুজিবুর রহমান
Multiplied for him is the punishment on the Day of Resurrection, and he will abide therein humiliated - Sahih International
৬৯. কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বর্ধিতভাবে প্ৰদান করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়;
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৯) কিয়ামতের দিন ওদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে তারা হীন অবস্থায় স্থায়ী হবে।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে। পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল-বায়ান
তবে তারা নয় যারা তাওবাহ করবে, ঈমান আনবে, আর সৎ কাজ করবে। আল্লাহ এদের পাপগুলোকে পুণ্যে পরিবর্তিত করে দেবেন; আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। তাইসিরুল
তারা নয় - যারা তাওবাহ করে, ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে; আল্লাহ তাদের পাপ পরিবর্তন করে দিবেন উত্তম আমলের দ্বারা; আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। মুজিবুর রহমান
Except for those who repent, believe and do righteous work. For them Allah will replace their evil deeds with good. And ever is Allah Forgiving and Merciful. Sahih International
৭০. তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের গুণাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৭০) তবে যারা তওবা করে, বিশ্বাস ও সৎকাজ করে[1] আল্লাহ তাদের পাপকর্মগুলিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।[2] আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] এখান হতে বুঝা যায় যে, বিশুদ্ধ তওবা দ্বারা পৃথিবীতে সমস্ত পাপ মোচন হতে পারে; তাতে তা যত বড়ই হোক না কেন। আর সূরা নিসার ৯৩ আয়াতে মু’মিন হত্যার শাস্তি যে জাহান্নাম বলা হয়েছে, তা ঐ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, যখন সে তওবা করবে না; বরং বিনা তওবায় মৃত্যু বরণ করবে। কারণ হাদীসে আছে যে, একশত লোক হত্যাকারীকেও তওবার কারণে মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (মুসলিম তাওবা অধ্যায়)
[2] এর একটা অর্থ এই যে, মহান আল্লাহ তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। ইসলাম গ্রহণের আগে সে পাপাচার করত, এখন সে সৎকর্ম করে, আগে শিরক করত এখন শুধুমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করে। আগে কাফেরদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ত। আর এখন সে মুসলিমদের দলভুক্ত হয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইত্যাদি। এর অন্য একটি অর্থঃ তার পাপগুলো নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়।। এর প্রমাণ হাদীসেও পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমি ঐ ব্যক্তিকে জানি যে, সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে ও সর্বশেষে জাহান্নাম হতে বের হবে। সে হবে ঐ ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে যার ছোট ছোট পাপগুলো তুলে ধরা হবে আর বড় বড় পাপগুলি একদিকে রেখে দেওয়া হবে। তাকে বলা হবে, ‘তুমি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক পাপ করেছিলে?’ সে স্বীকৃতিবাচক জবাব দেবে এবং অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা তার থাকবে না। তাছাড়া সে এই ব্যাপারেও ভয় পাবে যে, এক্ষনি তার বড় বড় পাপগুলি তুলে ধরা হবে। এমতাবস্থায় বলা হবে, ‘যাও! তোমার প্রত্যেক পাপের বদলে এক একটি নেকী।’ আল্লাহর এই দয়া দেখে সে বলবে, ‘এখনও তো আমি আমার অনেক আমল দেখছি না।’’ এই কথা বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেসে ফেললেন, এমনকি তার দাঁত দেখা গেল। (মুসলিমঃ ঈমান অধ্যায়)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান