-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬১. আর তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে আপনিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবেন(১) এবং আল্লাহর উপর নির্ভর করুন(২); নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
(১) এ আয়াতে সন্ধির হুকুম বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি কাফেররা কোন সময় সন্ধির প্রতি আগ্রহী হয়, তবে আপনারও তাই করা উচিত। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, নিরাপত্তা সবসময়ই কাঙ্খিত বিষয়। সুতরাং যদি তারা সন্ধিতে আগ্রহী হয়, তবে আপনার উচিত তাদের সাথে সন্ধি করা। তাছাড়া এর মাধ্যমে মুসলিমদের শক্তি সঞ্চিত থাকবে, পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। অনুরূপভাবে সন্ধির অন্য সুবিধা হচ্ছে, মানুষ যখন নিরাপদ হবে, ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন ইসলামের পাল্লা ভারী হবে, কারণ, যার বিবেক আছে সে বিবেক খরচ করলেই বুঝতে পারবে যে, ইসলামই সত্য। [সা'দী]
(২) অর্থাৎ যদি শক্রদের পক্ষ থেকে সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ পেলে আপনি তাদের সাথে সন্ধি করবেন। তাতে যদি এমন কোন সম্ভাবনা থাকে যে, তারা মুসলিমদেরকে ধোঁকা দিবে বা শৈথিল্যে ফেলে হঠাৎ আক্রমণ করে বসবে, সে সম্ভাবনার বিপরীতে আপনি আল্লাহ্ তা'আলার উপর ভরসা করুন। কারণ, তিনিই যথার্থ শ্রবণকারী, পরিজ্ঞাত। তিনি তাদের কথাবার্তাও শোনেন এবং তাদের মনের গোপন ইচ্ছাও জানেন। তিনি আপনার সাহায্যের জন্য যথেষ্ট। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ফল তাদের উপরই এসে যাবে। [সা'দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬১) আর যদি তারা সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সন্ধির জন্য আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। [1] নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
[1] অর্থাৎ, যদি যুদ্ধের পরিবর্তে আপোসে সন্ধি অধিক ফলপ্রসূ ও যুক্তিসঙ্গত হয় এবং শত্রুরাও তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। পক্ষান্তরে যদি সন্ধি থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্য ধোঁকা ও প্রতারণা হয়, তবুও ঘাবড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। নিশ্চয় তিনি তোমাকে শত্রুর চক্রান্ত হতে নিরাপদে রাখবেন। আর তিনি একাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবেন। কিন্তু সন্ধির এই অনুমতি এমন চূড়ান্ত অবস্থায় হবে, যখন মুসলিমরা দুর্বল হবে এবং সন্ধিতেই ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণ নিহিত থাকবে। পরন্তু অবস্থা যদি এর বিপরীত হয়; অর্থাৎ, মুসলিমরা শক্তিশালী ও যুদ্ধ উপকরণের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয় এবং কাফেরদল দুর্বল ও পরাজেয় বলে বুঝা যায়, তাহলে এই অবস্থাতে সন্ধির পরিবর্তে কাফেরদের শক্তি ও প্রতাপ ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলা জরুরী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না। তোমরাই প্রবল; আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো নষ্ট করবেন না।’’ (সূরা মুহাম্মাদ ৩৫ আয়াত) আরো এক জায়গায় তিনি বলেন, ‘‘এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যতক্ষণ না ফিৎনা দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।’’ (সূরা আনফাল ৩৯ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬২. আর যদি তারা আপনাকে প্রতারিত করতে চায় তবে আপনার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, নিশ্চয় তিনি আপনাকে নিজের সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন,(১)
(১) এ আয়াতে সন্ধির বিষয়টিকে আরো কিছুটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এ সম্ভাবনাই যদি বাস্তবায়িত হয়ে যায়, সন্ধি করতে গিয়ে তাদের নিয়ত যদি খারাপ থাকে এবং আপনাকে যদি এভাবে ধোঁকা দিতে চায়, তবুও আপনি কোন পরোয়া করবেন না। আল্লাহ্ তা'আলাই আপনার জন্য যথেষ্ট। পূর্বেও আল্লাহর সাহায্য-সমর্থনেই আপনার ও মুমিনদের কার্যসিদ্ধি হয়েছে। তিনি তার বিশেষ সাহায্যে বদরে আপনার সহায়তা করেছেন। আবার বাহ্যিকভাবে মুমিনদেরকে আপনার সাহায্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। [আইসারুত তাফসীর] সুতরাং যিনি প্রকৃত মালিক ও মহাশক্তিমান, যিনি বিজয় ও কৃতকার্যতার যাবতীয় উপকরণকে বাস্তবতায় রূপায়িত করেছেন, তিনি আজও শক্রদের ধোঁকা-প্রতারণার ব্যাপারে আপনার সাহায্য করবেন।
তাফসীরে জাকারিয়া(৬২) পক্ষান্তরে যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও বিশ্বাসিগণ দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৩. আর তিনি তাদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি(১) স্থাপন করেছেন যমীনের যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও আপনি তাদের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করতে পারতেন না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন; নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(২)
(১) এখানে সে ভ্রাতৃত্বভাব ও বন্ধুত্বের কথা বলা হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা'আলা ঈমানদার আরববাসীদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করে তাদেরকে এক মজবুত বাহিনী বানিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ এ বাহিনীর লোকেরা শতাব্দী কাল ধরে শক্রতা ও যুদ্ধবিগ্ৰহ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষভাবে আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের ব্যাপারে আল্লাহর এ রহমত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রকট। তারা পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য গত একশত বিশ বছর লিপ্ত ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর এরূপ কঠিন শক্রতাকে মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও অপূর্ব অকৃত্রিম ভালবাসায় পরিণত করা এবং পরস্পর ঘৃণিত ব্যক্তিদের জুড়িয়ে এক অক্ষয় দূর্ভেদ্য প্রাচীর রচনা করা নিঃসন্দেহে একমাত্র আল্লাহরই কৃপায় সম্ভব হয়েছিল। নিছক বৈষয়িক সামগ্রী দ্বারা এ রূপ বিরাট কীর্তি সম্পাদন ছিল সত্যই অসম্ভব। [আইসারুত তাফসীর]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের যুদ্ধে যখন মক্কার নওমুসলিমদেরকে অধিক হারে গণীমতের মাল দিলেন অথচ আনসারদেরকে কিছুই দিলেন না, তখন আনসারদের মনে কিছুটা কষ্ট অনুভব হতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ “হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট পাইনি? তারপর আল্লাহ্ আমার দ্বারা তোমাদেরকে হেদায়াত করেছেন। আর তোমরা ছিলে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত, আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি করেছেন। তোমরা ছিলে দরিদ্র, আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদেরকে সম্পদশালী করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর রাসূলের ডাকে সাড়া দিতে কেন কুন্ঠাবোধ করছ? তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, লোকেরা ছাগল আর উট নিয়ে যাবে অপরদিকে তোমরা আল্লাহর রাসূলকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে?’ [বুখারীঃ ৪৩৩০]
(২) এতে বোঝা যাচ্ছে যে, মানুষের অন্তরে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি হওয়া আল্লাহ তা'আলার দান। তাছাড়া এতে একথাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আল্লাহ্ তা'আলার না-ফরমানীর মাধ্যমে তার দান অর্জন করা সম্ভব নয়; বরং তার দান লাভের জন্য তার আনুগত্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা একান্ত শর্ত। কুরআনুল হাকীম এই বাস্তবতার প্রতিই কয়েকটি আয়াতে ইঙ্গিত করেছে। এক জায়গায় বলা হয়েছে “আর তোমরা সকলে আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে না।” [আলে ইমরানঃ ১০৩]
এই আয়াতে মতবিরোধ ও অনৈক্য থেকে বাঁচার পন্থা নির্দেশ করা হয়েছে যে, সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জ্বকে অর্থাৎ কুরআন তথা ইসলামী শরীআতকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। তাহলে সবাই আপনা থেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে এবং পারস্পরিক যেসব বিরোধ রয়েছে, তা মিটে যাবে। ঝগড়া-বিবাদ তখনই হয়, যখন শরীআত নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘিত হয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৩) এবং তিনি ওদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন, পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না, কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। [1] নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[1] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ) এবং মু’মিনদের উপর যে অনুগ্রহ করেছেন তার মধ্যে একটি অনুগ্রহ উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হল এই যে, তিনি মু’মিনদের দ্বারা নবী (সাঃ)-এর সাহায্য করলেন; তাঁরা নবীর হাত, বাহু, পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী হয়ে গেলেন। আর মু’মিনদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছেন যে, তাঁদের মাঝে প্রথম দিকে যে শত্রুতা ছিল তিনি তাকে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যে পরিণত করে দিলেন। প্রথম দিকে তাঁরা একে অপরের রক্তপিপাসু ছিলেন। কিন্তু এখন একে অপরের জন্য প্রাণ কুরবানী দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। প্রথম দিকে তাঁরা একে অপরের প্রাণের শত্রু ছিলেন, এখন তাঁরা একে অন্যের জন্য দয়া ও স্নেহশীল হয়ে গেলেন। বহু যুগের আপোসের পুরাতন শত্রুতাকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে তাদের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেওয়া আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী এবং তাঁর কুদরত ও ইচ্ছাশক্তির প্রকৃষ্ট নমুনা ছিল। নতুবা এ এমন একটা কাজ ছিল যে, তার জন্য পৃথিবীর সমপরিমাণ ধনভান্ডার ব্যয় করলেও এই অভীষ্ট রত্ন লাভ হতো না। আল্লাহ তাআলা উক্ত অনুগ্রহের কথা সূরা আলে ইমরান ১০৩নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন ‘‘তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে।’’ আর নবী (সাঃ)ও হুনাইনের যুদ্ধে গনীমতের মাল বণ্টনের সময় আনসারদেরকে লক্ষ্য করে দেওয়া এক ভাষণে বললেন, ‘‘হে আনসারদল! এ কথা কি সত্য নয় যে, তোমরা ভ্রষ্ট ছিলে, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে হিদায়াত দান করলেন। তোমরা অভাবী ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিলেন। আর তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দিলেন?’’ নবী (সাঃ)-এর প্রত্যেক কথার উত্তরে আনসারগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসূল অধিক অনুগ্রহশীল।’
(বুখারীঃ মাগাযী অধ্যায়, তায়েফ যুদ্ধ পরিচ্ছেদ, মুসলিমঃ যাকাত অধ্যায়)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৪. হে নবী! আপনার জন্য ও আপনার অনুসারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৪) হে নবী! তোমার জন্য ও তোমার অনুসারী বিশ্বাসিগণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৫. হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন; তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে এক’শ জন থাকলে এক হাজার কাফিরের উপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৫) হে নবী! বিশ্বাসীদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ কর,[1] তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন থাকলে এক হাজার অবিশ্বাসীর উপর বিজয়ী হবে। [2] কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।
[1] تحريض শব্দের অর্থ হল উদ্বুদ্ধকরণে অতিরঞ্জন করা। অর্থাৎ, খুব বেশী উদ্বুদ্ধ করা, আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি করা। কেননা, এই নির্দেশ মোতাবেক নবী (সাঃ) যুদ্ধের পূর্বে সাহাবাদেরকে জিহাদের জন্য অতিশয় উদ্বুদ্ধ করতেন এবং তার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করতেন। যেমন, বদর যুদ্ধের সময় যখন মুশরিকরা নিজেদের ভারী সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ যুদ্ধসামগ্রীসহ ময়দানে উপস্থিত হল, তখন নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘এমন জান্নাতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও, যার প্রস্থ আকাশ-পৃথিবী সমান।’’ এক সাহাবী উমাইর বিন হুমাম (রাঃ) বললেন, ‘জান্নাতের প্রস্থ আকাশ-পৃথিবী সমান? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ!’’ তা শুনে তিনি ‘ওহো’ বললেন। অর্থাৎ, খুশী প্রকাশ করলেন এবং এই আশা ব্যক্ত করলেন যে, ‘আমিও জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি তাদের একজন হবে।’’ অতএব তিনি নিজের তরবারির খাপকে ভেঙ্গে ফেললেন এবং কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। খেতে খেতে অবশিষ্ট খেজুর তিনি মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এগুলি খাবার জন্য জীবিত থাকলে সে জীবন তো বড় দীর্ঘ জীবন!’ অতঃপর তিনি জিহাদ করার জন্য বীরত্বের সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। পরিশেষে তিনি কাফেরদের সাথে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। (মুসলিমঃ ইমারাহ অধ্যায়)
[2] এটা মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ যে, তোমাদের মধ্যে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধকারী ২০ জন যোদ্ধা ২০০ জন কাফের সৈন্যের বিরুদ্ধে এবং ১০০ জন যোদ্ধা তাদের এক হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট হয়ে বিজয়ী থাকবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৬. আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন এবং তিনি তো অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে, কাজেই তোমাদের মধ্যে একশ জন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের মধ্যে এক হাজার থাকলে আল্লাহর অনুজ্ঞাক্রমে তারা দু’হাজারের উপর বিজয়ী হবে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।(১)
(১) আয়াতে সাধারণ নীতি আকারে বলা হয়েছে (وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ) অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা ধৈর্যশীল লোকদের সাথে রয়েছেন। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়তা অবলম্বনকারীও অন্তর্ভুক্ত এবং শরীআতের সাধারণ হুকুম-আহকামের অনুবর্তিতায় দৃঢ়তা অবলম্বনকারীরাও শামিল। তাদের সবার জন্যই আল্লাহ্ তা'আলার সাহায্য ও সহযোগিতার এ প্রতিশ্রুতি। আর এটাই প্রকৃতপক্ষে তাদের কৃতকার্যতা ও বিজয়ের মূল রহস্য। কারণ, যে ব্যক্তি একক ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সাহায্য ও সহযোগিতা লাভে সমর্থ হবে, তাকে সারা বিশ্বের সমবেত শক্তিও নিজের জায়গা থেকে এক বিন্দু নাড়াতে পারে না। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে থাকার সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না।
কোন আল্লাহওয়ালা লোক বলেছেন, সবরকারীগণ দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। কেননা, তারা আল্লাহর সাথে থাকার গৌরব অর্জন করেছে। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি তাদের হিফাযত করবেন, তত্ত্বাবধান করবেন, সংরক্ষণ করবেন। অন্যত্র তিনি সবরকারীদেরকে তিনটি বস্তুর ওয়াদা করেছেন, যার প্রতিটি দুনিয়া ও তাতে যা আছে তা থেকে উত্তম। তিনি তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে স্মরণ, রহমত এবং হিদায়াতপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের রব-এর কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর তারাই সৎপথে পরিচালিত।” [সূরা আল-বাকারাহ ১৫৭] [ইবনুল কাইয়্যেম, উদ্দাতুস সাবেরীন: ৯২]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৬) আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন। তিনি অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের মধ্যে এক হাজার থাকলে আল্লাহর অনুজ্ঞাক্রমে তারা দু’ হাজারের উপর বিজয়ী হবে। [1] বস্তুতঃ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। [2]
[1] পূর্বের হুকুম সাহাবাদের উপর ভারী মনে হল। কেননা, এর অর্থ ছিল ১ জন মুসলিম ১০ জন কাফের, ২০ জন মুসলিম ২০০ কাফের এবং ১০০ জন মুসলিম ১০০০ জন কাফেরের মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। আর তার মানেই হল কাফেরদের তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যা অনুরূপ (১০ গুণ কম) হলে জিহাদ করা ফরয এবং তা ত্যাগ করা কোন প্রকারে বৈধ নয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা এই সংখ্যাকে হালকা করে ১/১০ থেকে কম করে ১/২ (অর্থাৎ আধা-আধি) সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিলেন। (বুখারীঃ তফসীর সূরা আনফাল) এখন এই তুলনামূলক উক্ত সংখ্যা হলে জিহাদ ফরয; তার থেকে কম হলে ফরয নয়।
[2] এই বলে সবর ও অবিচলতার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর মদদ লাভ করার জন্য উভয়ের প্রতি যত্ন নেওয়া জরুরী।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৭. কোন নবীর জন্য সংগত নয় যে(১) তার নিকট যুদ্ধবন্দী থাকবে, যতক্ষণ না তিনি যমীনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন।(২) তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ(৩) এবং আল্লাহ্ চান আখেরাত; আর আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(১) আয়াতটি বদরের যুদ্ধে বিশেষ এক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বিধায় এগুলোর তাফসীর করার ব্যাপারে বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য রেওয়ায়েত ও হাদীসের মাধ্যমে ঘটনাটি বিবৃত করা বাঞ্ছনীয়। ঘটনাটি হল এই যে, বদর যুদ্ধটি ছিল ইসলামের প্রথম জিহাদ। তখনো জিহাদ সংক্রান্ত হুকুম-আহকামের কোন বিস্তারিত বিবরণ কুরআনে নাযিল হয়নি। যেমন, জিহাদ করতে গিয়ে গনীমতের মাল হস্তগত হলে তা কি করতে হবে, শক্রসৈন্য নিজেদের আয়ত্বে এসে গেলে তাকে বন্দী করা জায়েয হবে কিনা এবং বন্দী করে ফেললে তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে প্রভৃতি। হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে অন্য কোন নবীকে দেয়া হয়নি। সেগুলোর মাঝে এও একটি যে, কাফেরদের সাথে প্রাপ্ত গনীমতের মালামাল কারো জন্য হালাল ছিল না, কিন্তু আমার উম্মতের জন্য তা হালাল করে দেয়া হয়েছে।” [দেখুন- বুখারীঃ ৩৩৫, মুসলিমঃ ৫২১]
গনীমতের মাল বিশেষভাবে এ উম্মতের জন্য হালাল হওয়ার বিষয়টির ব্যাপারে বদর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোন ওহী নাযিল হয়নি। অথচ বদর যুদ্ধে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, আল্লাহ তা'আলা মুসলিমগণকে ধারণা-কল্পনার বাইরে অসাধারণ বিজয় দান করেন। শত্রুরা বহু মালামালও ফেলে যায়, যা গনীমত হিসেবে মুসলিমদের হস্তগত হয় এবং তাদের বড় বড় সত্তর জন সর্দারও মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়ে আসে। কিন্তু এতদুভয় বিষয়ের বৈধতা সম্পর্কে কোন ওহী তখনো আসেনি।
সে কারণেই সাহাবায়ে কেরামের প্রতি এহেন তড়িৎ পদক্ষেপের দরুন ভর্ৎসনা নাযিল হয়। এই ভর্ৎসনা ও অসন্তুষ্টিই এই ওহীর মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে যাতে যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে বাহ্যতঃ দুটি অধিকার মুসলিমগণকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরই মাঝে এই ইঙ্গিতও করা হয়েছিল যে, বিষয়টির দুটি দিকের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার নিকট একটি পছন্দনীয় এবং অপরটি অপছন্দনীয়। সাহাবায়ে কেরামের সামনে এ দু’টি বিষয় যখন ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পেশ করা হল যে, এদেরকে যদি মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, তবে হয়ত এরা সবাই অথবা এদের কেউ কেউ কোন সময় মুসলিম হয়ে যাবে। আর প্রকৃতপক্ষে এটাই হল জিহাদের উদ্দেশ্য ও মূল উপকারিতা।
দ্বিতীয়তঃ এমনও ধারণা করা হয়েছিল যে, এ সময় মুসলিমগণ যখন নিদারুণ দৈন্যাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন সত্তর জনের আর্থিক মুক্তিপণ অর্জিত হলে এ কষ্টও কিছুটা লাঘব হতে পারে এবং তা ভবিষ্যতে জিহাদের প্রস্তুতির জন্যও কিছুটা সহায়ক হতে পারে। এসব ধারণার প্রেক্ষিতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এ মতই প্রদান করলেন যে, বন্দীগণকে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেয়া হোক। শুধুমাত্র উমর ইবনুল খাত্তাব ও সা’দ ইবন মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহুমা প্রমূখ কয়েকজন সাহাবী এ মতের বিরোধিতা করলেন এবং বন্দীদের সবাইকে হত্যা করার পক্ষে মত দান করলেন। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, একান্ত সৌভাগ্যক্রমে ইসলামের মোকাবেলায় শক্তি ও সামর্থের বলে যোগদানকারী সমস্ত কুরাইশ সর্দার এখন মুসলিমদের হস্তগত হলেও পরে তাদের ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি একান্তই কল্পনানির্ভর।
কিন্তু ফিরে গিয়ে এরা যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অধিকতর তৎপরতা প্রদর্শন করবে সে ধারণাই প্রবল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন হয়ে আগমন করেছিলেন, তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে দু'টি মত লক্ষ্য করে সে মতটিই গ্রহণ করে নিলেন, যাতে বন্দীদের ব্যাপারে রহমত ও করুণা প্রকাশ পাচ্ছিল এবং বন্দীদের জন্যও ছিল সহজ। অর্থাৎ মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া। [দেখুন, সীরাতে ইবন হিশাম, বাগভী; কুরতুবী; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া]
(২) এ আয়াতে (حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ) বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। إثخان এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কারো শক্তি ও দম্ভকে ভেঙ্গে দিতে গিয়ে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া। [তাবারী; কাশশাফ; ফাতহুল কাদীর] এর সারার্থ হল এই যে, শক্রর দম্ভকে ধুলিস্মাৎ করে দেন। যাতে বেশীরভাগ স্থানেই মুসলিমদের বিজয় সূচিত হয়। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
(৩) আয়াতে সে সমস্ত সাহাবাকে সম্বোধন করা হয়েছে, যারা মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এতে বলা হয়েছে যে, এ ব্যাপারে রাসূলের কোন দোষ নেই। তোমরাই আমার রাসূলকে এ পরামর্শ দান করছে। কারণ, শক্রদের বশে পাওয়ার পরেও তাদের শক্তি ও দম্ভকে চূর্ণ করে না দিয়ে অনিষ্টকর শত্রুকে ছেড়ে দিয়ে মুসলিমদের জন্য স্থায়ী বিপদ দাঁড় করিয়ে দেয়া কোন নবীর পক্ষেই শোভন নয়। যেসব সাহাবী মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীদের ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের সে মতে যদিও নির্ভেজাল একটি দ্বীনী প্রেরণাও বিদ্যমান ছিল- অর্থাৎ মুক্তি পাবার পর তাদের মুসলিম হয়ে যাবার আশা, কিন্তু সেই সাথে আত্মস্বার্থজনিত অপর একটি দিকও ছিল যে, এতে করে তাদের হাতে কিছু অর্থসম্পদ এসে যাবে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৭) দেশে সম্পূর্ণভাবে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। [1] আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[1] বদর যুদ্ধে ৭০ জন কাফের মারা পড়ল এবং ৭০ জন বন্দী হল। এটা কাফের ও মুসলিমদের প্রথম যুদ্ধ ছিল। এই জন্য যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কি ধরনের আচরণ করা যেতে পারে এ ব্যাপারে পূর্ণরূপে কোন বিধান স্পষ্ট ছিল না। সুতরাং নবী (সাঃ) সেই ৭০ জন বন্দীদের ব্যাপারে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে, কি করা যাবে? তাদেরকে হত্যা করা হবে, না কিছু মুক্তিপণ (বিনিময়) নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে? বৈধতা হিসাবে এই দু’টি রায়ই সঠিক ছিল। সেই জন্য উক্ত দু’টি রায় নিয়ে বিবেক-বিবেচনা ও চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। কিন্তু কখনো কখনো বৈধতা ও অবৈধতা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কাল-পাত্র ও পরিস্থিতি বুঝে অধিকতর উত্তম পন্থা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এখানেও অধিকতর কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বৈধতাকে সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত কমতর কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করা হল। যে ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলার তরফ হতে ভৎর্সনাস্বরূপ আয়াত অবতীর্ণ হল। উমার (রাঃ) প্রভৃতিগণ নবী (সাঃ)-কে এই পরামর্শ দিলেন যে, কুফরের শক্তি ও প্রতাপকে ভেঙ্গে ফেলা দরকার আছে। এই জন্য বন্দীদেরকে হত্যা করা হোক। কেননা, এরা হল কুফর ও কাফেরদের প্রধান ও সম্মানিত ব্যক্তি। এরা মুক্তি পেলে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অধিকরূপে চক্রান্ত চালাবে। পক্ষান্তরে আবু বাকর (রাঃ) প্রভৃতিগণ উমার (রাঃ)-এর রায়ের বিপরীত রায় পেশ করলেন যে, তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ (বিনিময়) নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হোক। আর ঐ মাল দ্বারা আগামী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হোক। নবী (সাঃ) এই রায়কে প্রাধান্য দিলেন। তখন এ ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হল, {حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْض}। এর মতলব হল যদি দেশে কুফরের আধিপত্য হয় (যেমন, সেই সময় আরবে কুফরের আধিপত্য ছিল), তাহলে এ অবস্থায় বন্দী কাফেরদেরকে হত্যা করে তাদের শক্তির মাথাকে চূর্ণ করে ফেলা আবশ্যক। সুতরাং তোমরা এই সূক্ষ্ম নীতিকে দৃষ্টিচ্যুত করে যে মুক্তিপণ (বিনিময়) গ্রহণ করলে, তার মানে হল অধিকতর উত্তম পন্থা বর্জন করে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পন্থা অবলম্বন করলে; যা তোমাদের ভুল এখতিয়ার। পরবর্তীতে যখন কুফরের প্রভাব কম হয়ে গেল, তখন বন্দীদের ব্যাপার সেই সমসাময়িক রাষ্ট্রনেতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হল। তিনি চাইলে তাদেরকে হত্যা করবেন, নতুবা মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেবেন। কিম্বা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করবেন। অথবা চাইলে তাদেরকে দাস বানিয়ে রাখবেন। অবস্থা ও পরিস্থিতি সমীক্ষা করে উক্ত কোন একটি পন্থা অবলম্বন করা বৈধ হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৮. আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকলে(১) তোমরা যা গ্রহণ করেছ সে জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।
(১) এখানে পূর্ব বিধান বলতে বুঝানো হয়েছে যে, পূর্ব থেকে এ উম্মাতের জন্য গণীমতের মাল ও ফিদিয়া গ্রহণ করা হালাল হওয়ার কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত ও ফয়সালা অর্থাৎ ‘কাদ্বা’ ও ‘কাদর’ হিসাবে লিখা না হত তবে তোমাদের উপর আযাব আসত। এ ব্যাখ্যা অনুসারে এখানে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে ক্ষমা করার কারণ হিসাবে তার পূর্ব সিদ্ধান্ত ও ফয়সালাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। [সা’দী, ইবন কাসীর]
কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে ‘কিতাব' বলে বুঝানো হয়েছে যে, যদি আল্লাহর কাছে বদরে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমার ব্যাপারটি আগে নির্ধারিত না থাকত, তবে অবশ্যই তোমাদের উপর শাস্তি আপতিত হত। অথবা যদি এটা পূর্বেই লিখিত না থাকত যে, আপনি তাদের মাঝে থাকাকালীন আমি তাদেরকে শাস্তি দেব না, তবে অবশ্যই তাদেরকে শাস্তি পেয়ে বসত। অথবা যদি না জানা অপরাধের কারণে পাকড়াও করবে না এটা লিখা না থাকত, তবে অবশ্যই তাদের উপর শাস্তি আসত। অথবা যদি আমি এ উম্মতের কবীরা গোনাহ তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা করব এটা লিখা না থাকত তবে অবশ্যই তাদের উপর শাস্তি আসত। [ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৮) আল্লাহর পূর্ব বিধান (লিপিবদ্ধ) না থাকলে[1] তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তার জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।
[1] এ ব্যাপারে তাফসীরবিদদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে যে, এই লিপিবদ্ধ বিধান কি ছিল? কেউ বলেন, তাতে গনীমতের মাল হালাল হওয়ার কথা লেখা ছিল। অর্থাৎ, যেহেতু লিপিবদ্ধ তকদীর এই ছিল যে, মুসলিমদের জন্য গনীমতের মাল হালাল হবে। এই জন্য তোমরা মুক্তিপণ নিয়ে এক বৈধ কাজ করেছ। যদি এমন না হত তাহলে মুক্তিপণ নেওয়ার কারণে তোমাদের উপর বড় ধরনের আযাব আসত। কেউ কেউ বলেছেন, তাতে বদর যুদ্ধে মুজাহিদদের জন্য ক্ষমা ঘোষণার কথা লিপিবদ্ধ ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, রসূল (সাঃ)-এর বর্তমানে আযাব না আসার কথা লিপিবদ্ধ ছিল ইত্যাদি।
(এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য ফাতহুল ক্বাদীর দ্রষ্টব্য)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬৯. সুতরাং তোমরা যে গনীমত লাভ করেছ তা বৈধ ও উত্তম বলে ভোগ কর এবং আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৯) যুদ্ধে তোমরা যা কিছু (গনীমত) লাভ করেছ, তা বৈধ ও পবিত্ররূপে ভোগ কর। [1] আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] এখানে গনীমতের মাল হালাল ও পবিত্র হওয়ার কথা উল্লেখ করে মুক্তিপণ গ্রহণ করার বৈধতা ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে এ কথার সমর্থন হয় যে, ‘লিপিবদ্ধ’ বিধানে সম্ভবতঃ গনীমতের মাল হালাল হওয়ার কথাই ছিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭০. হে নবী! তোমাদের করায়ত্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে বলুন, আল্লাহ্ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভাল কিছু দেখেন তবে তোমাদের কাছ থেকে যা নেয়া হয়েছে তা থেকে উত্তম কিছু তিনি তোমাদেরকে দান করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(১)
(১) বদর যুদ্ধের বন্দীদিগকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ইসলাম ও মুসলিমদের সে শক্র যা তাদেরকে কষ্ট দিতে, মারতে এবং হত্যা করতে কখনোই কোন ক্রটি করেনি; যখনই কোন রকম সুযোগ পেয়েছে একান্ত নির্দয়ভাবে অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছে, মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়ে আসার পর এহেন শক্রদেরকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়াটা সাধারণ ব্যাপার ছিল না; এটা ছিল তাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি এবং অসাধারণ দয়া ও করুণা। পক্ষান্তরে মুক্তিপণ হিসেবে তাদের কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল, তাও ছিল অতি সাধারণ।
এটা আল্লাহর একান্ত দয়া ও মেহেরবাণী যে, এই সাধারণ অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের যে কষ্ট হয়, তাও তিনি কি চমৎকারভাবে দূর করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, যদি আল্লাহ তোমাদের মন-মানসিকতায় কোন রকম কল্যাণ দেখতে পান, তবে তোমাদের কাছ থেকে যা কিছু নেয়া হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম বস্তু তোমাদের দিয়ে দেবেন। তদুপরি তোমাদের অতীত পাপও তিনি ক্ষমা করে দেবেন। এখানে خير অর্থ ঈমান ও নিষ্ঠা। [ফাতহুল কাদীর]
অর্থাৎ মুক্তি লাভের পর সেসব বন্দীদের মধ্যে যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ করবে, তারা যে মুক্তিপণ দিয়েছে, তার চাইতে অধিক ও উত্তম বস্তু পেয়ে যাবে। বন্দীদেরকে মুক্ত করে দেয়ার সাথে সাথে তাদেরকে এমনভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, তারা যেন মুক্তি লাভের পর নিজেদের লাভ-ক্ষতির ব্যাপারে মনোনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করে। সুতরাং বাস্তব ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, তাদের মধ্যে যারা মুসলিম হয়েছিলেন, আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে ক্ষমা এবং জান্নাতে সুউচ্চ স্থান দান করা ছাড়াও পার্থিব জীবনে এত অধিক পরিমাণ ধন-সম্পদ দান করেছিলেন, যা তাদের দেয়া মুক্তিপণ অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম ও অধিক ছিল।
অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন যে, এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। কারণ, তিনিও বদরের যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তার কাছ থেকেও মুক্তিপণ নেয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে তার বৈশিষ্ট ছিল এই যে, মক্কা থেকে তিনি যখন বদর যুদ্ধে যাত্রা করেন, তখন কাফের সৈন্যদের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশ্যে বিশ ওকিয়া (স্বর্ণমূদ্রা) সাথে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যয় করার পূর্বেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। যখন মুক্তিপণ দেয়ার সময় আসে, তখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমি তো মুসলিম ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনার ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন।
যদি আপনার কথা সত্য হয় তবে আল্লাহ আপনাকে এর প্রতিফল দিবেন। আমরা তো শুধু প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের উপর হুকুম দেব। সুতরাং আপনি আপনার নিজের এবং দুই ভাতিজা আকীল ইবন আবী তালেব ও নওফেল ইবন হারেসের মুক্তিপণও পরিশোধ করবেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আবেদন করলেন, আমার এত টাকা কোত্থেকে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কেন, আপনার নিকট কি সে সম্পদগুলো নেই, যা আপনি মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময়ে আপনার স্ত্রী উম্মুল ফযলের নিকট রেখে এসেছেন? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ আপনি সে কথা কেমন করে জানলেন? আমি যে রাত্রের অন্ধকারে একান্ত গোপনে সেগুলো আমার স্ত্রীর নিকট অর্পণ করেছিলাম এবং এ ব্যাপারে তৃতীয় কোন লোকই অবগত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সে ব্যাপারে আমার রব আমাকে বিস্তারিত অবহিত করেছেন।
তখন আব্বাস বললেন, আমার কাছে যে স্বর্ণ ছিল, সেগুলোকেই আমার মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য করা হোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যে সম্পদ আপনি কুফরীর সাহায্যের উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছিলেন, তা তো মুসলিমদের গনীমতের মালে পরিণত হয়ে গেছে, ফিদইয়া বা মুক্তিপণ হতে হবে সেগুলো বাদে। তারপর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নিজের ও দুই ভাতিজার ফিদইয়া দিলেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [সীরাতে ইবন হিশাম; ইবন কাসীর] আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম প্রকাশের পর প্রায়ই বলে থাকতেন, আমি তো সে ওয়াদার বিকাশ-বাস্তবতা স্বচক্ষেই প্রত্যক্ষ করছি। কারণ আমার নিকট থেকে মুক্তিপণ বাবদ বিশ উকিয়া সোনা নেয়া হয়েছিল। অথচ এখন আমার বিশটি গোলাম (ক্রীতদাস) বিভিন্ন স্থানে আমার ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে এবং তাদের কারো ব্যবসায়ই বিশ হাজার দিরহামের কম নয়। [দেখুন, মুস্তাদরাকে হাকিম: ৩/৩২৪]
তদুপরি হজের সময় হাজীদের পানি খাওয়ানোর খেদমতটিও আমাকেই অর্পণ করা হয়েছে যা আমার নিকট এমন এক অমূল্য বিষয় যে, সমগ্র মক্কাবাসীর যাবতীয় ধন-সম্পদও এর তুলনায় তুচ্ছ বলে মনে হয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(৭০) হে নবী! তোমাদের করায়ত্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভাল কিছু[1] দেখেন, তাহলে তোমাদের নিকট হতে (মুক্তিপণ হিসাবে) যা নেওয়া হয়েছে, তা অপেক্ষা উত্তম কিছু তিনি তোমাদেরকে দান করবেন[2] এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
[1] অর্থাৎ, ঈমান ও ইসলাম আনয়নের সংকল্প এবং তা গ্রহণ করার আগ্রহ।
[2] অর্থাৎ, যে মুক্তিপণ তোমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এ থেকে উত্তম জিনিস তোমাদের ইসলাম আনয়ন করার পর আল্লাহ তোমাদেরকে দান করবেন। সুতরাং পরবর্তীতে এমনটিই ঘটেছিল। আব্বাস (রাঃ) এবং আরো অন্যান্য জন যাঁরা সেই বন্দীদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাঁরা মুসলমান হয়ে গেলেন। মহান আল্লাহ তাঁদেরকে পার্থিব জীবনে মাল-ধনের প্রাচুর্য দান করলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান