بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ৬/ আল-আন'আম | Al-An'am | سورة الأنعام আয়াতঃ ১৬৫ মাক্কী
৬ : ৬১ وَ هُوَ الۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهٖ وَ یُرۡسِلُ عَلَیۡكُمۡ حَفَظَۃً ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءَ اَحَدَكُمُ الۡمَوۡتُ تَوَفَّتۡهُ رُسُلُنَا وَ هُمۡ لَا یُفَرِّطُوۡنَ ﴿۶۱﴾
و هو القاهر فوق عبادهٖ و یرسل علیكم حفظۃ حتی اذا جآء احدكم الموت توفته رسلنا و هم لا یفرطون ﴿۶۱﴾
• আর তিনিই নিজ বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান এবং তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হিফাযতকারীদেরকে। অবশেষে যখন তোমাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে, আমার প্রেরিত দূতগণ তার মৃত্যু ঘটায়। আর তারা কোন ত্রুটি করে না।

-আল-বায়ান

• তিনি তাঁর বান্দাহ্দের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশীল, আর তিনি তোমাদের উপর রক্ষক নিযুক্ত করেন। অতঃপর তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে আমার প্রেরিতগণ (ফেরেশতারা) তার মৃত্যু ঘটায়। নিজেদের কর্তব্য পালনে তারা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না।

-তাইসিরুল

• আর আল্লাহই স্বীয় বান্দাদের উপর প্রতাপশালী, তিনি তোমাদের উপর রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠিয়ে থাকেন, এমনকি যখন তোমাদের কারও মৃত্যু সময় সমুপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিত দূতগণ তার প্রাণ হরণ করে নেয়, এ ব্যাপারে তারা বিন্দুমাত্র ক্রটি করেনা।

-মুজিবুর রহমান

• And He is the subjugator over His servants, and He sends over you guardian-angels until, when death comes to one of you, Our messengers take him, and they do not fail [in their duties].

-Sahih International

৬১. আর তিনি তাঁর বান্দাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকারী এবং তিনি তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হেফাযতকারীদেরকে। অবশেষে তোমাদের কারও যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমাদের রাসূল (ফিরিশতা) গণ তার মৃত্যু ঘটায় এবং তারা কোন ক্রটি করে না।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬১) তিনিই স্বীয় দাসগণের উপর পরাক্রমশালী এবং তিনিই তোমাদের রক্ষক প্রেরণ করেন। অবশেষে যখন তোমাদের কারো মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়, তখন আমার প্রেরিত দূতগণ তার মৃত্যু ঘটায় এবং (কর্তব্যে) তারা ত্রুটি করে না। [1]

[1] অর্থাৎ, তাঁদেরকে সোপর্দ করা এই কাজে এবং আত্মাকে হেফাযত করার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করেন না। বরং এই ফিরিশতা মৃত্যুবরণকারী যদি নেক হয়, তাহলে তার আত্মাকে ‘ইল্লিয়্যীন’-এ এবং সে যদি পাপী হয়, তাহলে তার আত্মাকে ‘সিজ্জীন’-এ পাঠিয়ে দেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬২ ثُمَّ رُدُّوۡۤا اِلَی اللّٰهِ مَوۡلٰىهُمُ الۡحَقِّ ؕ اَلَا لَهُ الۡحُكۡمُ ۟ وَ هُوَ اَسۡرَعُ الۡحٰسِبِیۡنَ ﴿۶۲﴾
ثم ردوا الی الله مولىهم الحق الا له الحكم و هو اسرع الحسبین ﴿۶۲﴾
• তারপর তাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হয় তাদের সত্য মাওলা আল্লাহর কাছে। সাবধান! হুকুম প্রাদানের ক্ষমতা তাঁরই। আর তিনি হচ্ছেন খুব দ্রুত হিসাবকারী।

-আল-বায়ান

• অতঃপর তাদেরকে তাদের প্রকৃত প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। সাবধান! কর্তৃত্ব তাঁরই, আর তিনি হিসাব গ্রহণে সর্বাপেক্ষা ত্বরিতগতি।

-তাইসিরুল

• তারপর সকলকে তাদের সত্যিকার অভিভাবক আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত করানো হয়। তোমরা জেনে রেখ যে, ঐ দিন একমাত্র আল্লাহই রায় প্রদানকারী হবেন, আর তিনি খুবই ত্বরিৎ হিসাব গ্রহণকারী।

-মুজিবুর রহমান

• Then they His servants are returned to Allah, their true Lord. Unquestionably, His is the judgement, and He is the swiftest of accountants.

-Sahih International

৬২. তারপর তাদেরকে প্রকৃত রব আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে। জেনে রাখুন, হুকুম তো তারই এবং তিনি সবচেয়ে দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬২) অতঃপর তাদের আসল প্রভুর দিকে তারা আনীত হয়।[1] জেনে রাখ, ফায়সালা তো তাঁরই এবং হিসাব গ্রহণে তিনিই সর্বাপেক্ষা তৎপর।

[1] আয়াতে رُدُّوا (প্রত্যাবর্তিত বা আনীত হয়)এর কর্তা ‘তারা’ বলতে কারা? কেউ কেউ ফিরিশতাদেরকে গণ্য করেছেন। অর্থাৎ, আত্মাকে কবয করার পর ফিরিশতাগণ আল্লাহর কাছে ফিরে যান। আবার কেউ কেউ এর দ্বারা সকল (মৃত) মানুষকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, সমস্ত মানুষ পুনরুত্থানের পর হাশরের ময়দানে আল্লাহর সমীপে আনীত হবে। (তাদেরকে পেশ করা হবে।) এবং তিনি সকলের ফায়সালা করবেন। আয়াতে আত্মাকবযকারী ফিরিশতাদের জন্য رُسُل (দূতগণ তথা বহুবচন শব্দ) ব্যবহার করা হয়েছে। যার দ্বারা বাহ্যতঃ এটাই মনে হচ্ছে যে, আত্মাকবযকারী ফিরিশতা একজন নন, বরং একাধিক। এর ব্যাখ্যা মুফাসসিরগণ এইভাবে করেছেন যে, কুরআনে আত্মা কবয করার সম্পর্ক আল্লাহর সাথেও করা হয়েছে।{اللهُ تَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا} ‘‘আল্লাহ মানুষের মৃত্যুর সময় তাদের আত্মাসমূহ কবয করে নেন।’’ (সূরা যুমার ৪২) অনুরূপ এর সম্পর্ক একটি ফিরিশতা (মালাকুল মাউত)এর সাথেও করা হয়েছে।{قُلْ يَتَوَفَّاكُمْ مَلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ} ‘‘বলে দাও, তোমাদের আত্মাসমূহ সেই ফিরিশতা কবয করেন, যাঁকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে।’’ (সূরা সাজদাহ ১১) এইভাবে এর সম্পর্ক একাধিক ফিরিশতার সাথেও করা হয়েছে। যেমন, এখানে এবং সূরা নিসার ৯৭নং আয়াতে ও সূরা আনআমের ৯৩নং আয়াতেও করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর সাথে এর সম্পর্ক এই জন্য যে, তিনিই প্রকৃত নির্দেশদাতা বরং তিনিই আসল কর্তা (মৃত্যু সংঘটনকারী)।


আর একাধিক ফিরিশতাদের সাথে এর সম্পর্ক করার অর্থ হল, তাঁরা হলেন ‘মালাকুল মাউত’ ফিরিশতার সহযোগী। তাঁরা ধমনী, শিরা-উপশিরা তথা দেহের ভিতর থেকে আত্মাকে বের করার এবং দেহের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কাজ করেন। আর ‘মালাকুল মাউত’এর সাথে সম্পর্ক এইভাবে যে, পরিশেষে তিনিই আত্মাকে কবয করে আসমানের দিকে নিয়ে যান। (তাফসীর রূহুল মাআনী ৫/১২৫) (কিন্তু হাদীসে আছে, ফিরিশতাগণ মরণোন্মুখ ব্যক্তির নিকট হতে দৃষ্টি-সীমার দূরে বসেন। অতঃপর মালাকুল মাউত তার নিকটে আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসে বলেনঃ ‘হে --- রূহ (আত্মা)! বের হয়ে এস আল্লাহর --- দিকে।’ তখন তার রূহ বের হয়ে আসে। অতঃপর মালাকুল মাউত তা গ্রহণ করেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না বরং ঐ সকল অপেক্ষমাণ ফিরিশতা এসে তা গ্রহণ করেন এবং তা নিয়ে উপরে উঠতে থাকেন। -সম্পাদক)

হাফেয ইবনে কাসীর, ইমাম শাওকানী এবং অন্যান্য অধিকাংশ আলেমদের উক্তি হল, ‘মালাকুল মাউত’ একজনই। যেমন, সূরা সাজদার আয়াত এবং মুসনাদ আহমাদ (৪/২৮৭)এ বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা জানা যায়। আর যেখানে বহুবচন শব্দে তাঁদের কথা উল্লিখিত হয়েছে, তাঁরা হলেন, মালাকুল মাউত ফিরিশতার সহযোগী। কোন কোন আসারে (সাহাবীদের উক্তিতে) ‘মালাকুল মাউত’ ফিরিশতার নাম ‘আযরাঈল’ বলা হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর) আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৩ قُلۡ مَنۡ یُّنَجِّیۡكُمۡ مِّنۡ ظُلُمٰتِ الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ تَدۡعُوۡنَهٗ تَضَرُّعًا وَّ خُفۡیَۃً ۚ لَئِنۡ اَنۡجٰىنَا مِنۡ هٰذِهٖ لَنَكُوۡنَنَّ مِنَ الشّٰكِرِیۡنَ ﴿۶۳﴾
قل من ینجیكم من ظلمت البر و البحر تدعونهٗ تضرعا و خفیۃ لئن انجىنا من هذهٖ لنكونن من الشكرین ﴿۶۳﴾
• বল, ‘কে তোমাদেরকে নাজাত দেন স্থল ও সমুদ্রের যাবতীয় অন্ধকার থেকে? তোমরা তাকে ডাক অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে যে, যদি তিনি আমাদেরকে এ থেকে নাজাত দেন, আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব’।

-আল-বায়ান

• বল, বিনীতভাবে আর সংগোপনে যখন তাঁকে ডাক তখন জল-স্থলের অন্ধকার হতে কে তোমাদেরকে রক্ষা করে। (বিপদে পড়লে বলতে থাক) এত্থেকে তুমি যদি আমাদেরকে রক্ষা কর তাহলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।

-তাইসিরুল

• তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করঃ স্থলভাগ ও পানিস্থিত অন্ধকার (বিপদ) থেকে তোমাদেরকে কে পরিত্রাণ দিয়ে থাকেন, যখন কাতর কন্ঠে বিনীতভাবে এবং চুপে চুপে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে থাক, আর বলতে থাকঃ তিনি যদি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দেন তাহলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।

-মুজিবুর রহমান

• Say, "Who rescues you from the darknesses of the land and sea [when] you call upon Him imploring [aloud] and privately, 'If He should save us from this [crisis], we will surely be among the thankful.' "

-Sahih International

৬৩. বলুন, কে তোমাদেরকে নাজাত দেন স্থলভাগের ও সাগরের অন্ধকার থেকে? যখন তোমরা কাতরভাবে এবং গোপনে তাকে ডাক যে, আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৩) বল, কে তোমাদেরকে পরিত্রাণ দিয়ে থাকে, যখন তোমরা স্থলভাগের ও সমুদ্রের বিপদে কাতরভাবে এবং গোপনে তাঁকে আহবান করে (বলে) থাক, ‘আমাদেরকে এ হতে পরিত্রাণ দিলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৪ قُلِ اللّٰهُ یُنَجِّیۡكُمۡ مِّنۡهَا وَ مِنۡ كُلِّ كَرۡبٍ ثُمَّ اَنۡتُمۡ تُشۡرِكُوۡنَ ﴿۶۴﴾
قل الله ینجیكم منها و من كل كرب ثم انتم تشركون ﴿۶۴﴾
• বল, ‘আল্লাহ তা থেকে তোমাদেরকে নাজাত দেন এবং প্রত্যেক বিপদ থেকে। তারপর তোমরা শিরক কর’।

-আল-বায়ান

• বল, আল্লাহই তোমাদেরকে এথেকে আর সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন, অতঃপর তোমরা তাঁর অংশী স্থির কর।

-তাইসিরুল

• তুমি বলে দাওঃ আল্লাহই তোমাদেরকে ঐ বিপদ এবং অন্যান্য প্রতিটি বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন, কিন্তু এরপরও তোমরা শিরক কর।

-মুজিবুর রহমান

• Say, "It is Allah who saves you from it and from every distress; then you [still] associate others with Him."

-Sahih International

৬৪. বলুন, আল্লাহই তোমাদেরকে তা থেকে এবং সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে নাজাত দেন। এরপরও তোমরা শির্ক কর।(১)

(১) এখানে ৬৩ ও ৬৪ নং আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা'আলা মুশরিকদেরকে হুশিয়ার ও তাদের ভ্রান্ত কর্ম সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দিয়ে বলছেন যে, আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, স্থল ও সামুদ্রিক ভ্রমণে যখনই বিপদের সম্মুখীন হও এবং সব আরাধ্য দেব-দেবীকে ভুলে গিয়ে একমাত্র আল্লাহকে আহবান কর, কখনো প্রকাশ্যে বিনীতভাবে এবং কখনো মনে মনে স্বীকার কর যে, এ বিপদ থেকে আল্লাহ ছাড়া কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। এর সাথে সাথে তোমরা এরূপ ওয়াদাও কর যে, আল্লাহ তা'আলা যদি আমাদেরকে  এ বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, তবে আমরা তার কৃতজ্ঞতা অবলম্বন করব, তাকেই কার্যনিবাহী মনে করব, তার সাথে কাউকে অংশীদার করব না।

কেননা বিপদেই যখন কাজে আসে না, তখন তাদের পূজাপাট আমরা কেন করবো? তাই আপনি জিজ্ঞেস করুন যে, এমতাবস্থায় কে তোমাদেরকে বিপদ ও ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করে? উত্তর নির্দিষ্ট ও জানা। কেননা, তারা এ স্বতঃসিদ্ধতা অস্বীকার করতে পারে না যে, আল্লাহ ছাড়া কোন দেব-দেবী, পীর, ফকীর, ওলী প্রভৃতি এ অবস্থায় তাদের কাজে আসেনি। তাই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আদেশ দিয়েছেন যে, আপনিই বলে দিন, একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই তোমাদেরকে এ বিপদ থেকে মুক্তি দেবেন, বরং অন্যান্য সব কষ্ট-বিপদ থেকে তিনি উদ্ধার করবেন। কিন্তু এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন সত্বেও যখন তোমরা বিপদমুক্ত হয়ে যাও, তখন আবার শির্কে লিপ্ত হয়ে পড়। এটা কেমন বিশ্বাসঘাতকতা ও মূর্খতা!  

সারকথা, কুরআন বর্ণিত প্রতিকারের প্রতি মানুষের দৃষ্টিপাত করা দরকার যে, বিপদাপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে স্রষ্টার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং বস্তুগত কলা-কৌশলকেও তার প্রদত্ত নেয়ামত হিসেবে ব্যবহার করা। এছাড়া নিরাপত্তার আর কোন বিকল্প পথ নেই। প্রত্যেক মানুষের বিপদাপদ একমাত্র তিনিই দূর করতে পারেন এবং বিপদের মুহুর্তে যে তাকে আহবান করে, সে তার সাহায্য স্বচক্ষে দেখতে পায়। কেননা, সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর তার শক্তি-সামর্থ্য পরিপূর্ণ এবং সৃষ্টির প্রতি তার দয়াও অসাধারণ। তিনি ছাড়া অন্য কারো এরূপ শক্তি-সামর্থ্য নেই এবং সমগ্র সৃষ্টির প্রতিও এরূপ দয়া-মমতা নেই।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৪) বল, ‘আল্লাহই তোমাদেরকে তা থেকে এবং সমস্ত দুঃখকষ্ট থেকে পরিত্রাণ দান করেন। তা সত্ত্বেও তোমরা তাঁর অংশী স্থাপন করে থাক।’

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৫ قُلۡ هُوَ الۡقَادِرُ عَلٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَ عَلَیۡكُمۡ عَذَابًا مِّنۡ فَوۡقِكُمۡ اَوۡ مِنۡ تَحۡتِ اَرۡجُلِكُمۡ اَوۡ یَلۡبِسَكُمۡ شِیَعًا وَّ یُذِیۡقَ بَعۡضَكُمۡ بَاۡسَ بَعۡضٍ ؕ اُنۡظُرۡ كَیۡفَ نُصَرِّفُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّهُمۡ یَفۡقَهُوۡنَ ﴿۶۵﴾
قل هو القادر علی ان یبعث علیكم عذابا من فوقكم او من تحت ارجلكم او یلبسكم شیعا و یذیق بعضكم باس بعض انظر كیف نصرف الایت لعلهم یفقهون ﴿۶۵﴾
• বল, ‘তিনি তো সক্ষম তোমাদের উপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করতে, অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন সন্দেহপূর্ণ দলে বিভক্ত করতে এবং তোমাদের একদলকে অন্য দলের ভীতি আস্বাদন করাতে’। দেখ, কীভাবে আমি আয়াতসমূহ নানাভাবে বর্ণনা করি, যাতে তারা ভালভাবে বুঝতে পারে।

-আল-বায়ান

• বল, তিনি তোমাদের উপর থেকে অথবা পদতল থেকে ‘আযাব পাঠাতে (সক্ষম) অথবা তোমাদেরকে দলে দলে বিভক্ত করার মাধ্যমে একদলকে অন্যদলের সংঘাত সংঘর্ষ ও হিংসা হানাহানির আস্বাদ গ্রহণ করাতে সক্ষম। লক্ষ্য কর, আমি নিদর্শনাবলী কেমন বিস্তারিত বর্ণনা করছি যাতে তারা উপলব্ধি করতে পারে।

-তাইসিরুল

• তুমি বলে দাওঃ আল্লাহ তোমাদের ঊর্ধ্বলোক হতে এবং তোমাদের পায়ের তলদেশ হতে শাস্তি প্রেরণ করতে যথেষ্ট ক্ষমতাবান, অথবা তোমাদেরকে দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে এক দলের দ্বারা অপর দলের শক্তির স্বাদ গ্রহণ করাবেন; লক্ষ্য কর! আমি বার বার বিভিন্ন উপায়ে আমার নিদর্শন ও যুক্তি প্রমাণ বর্ণনা করছি - উদ্দেশ্য হল, যেন বিষয়টিকে তারা পূর্ণ রূপে জ্ঞানায়ত্ব ও হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পারে।

-মুজিবুর রহমান

• Say, "He is the [one] Able to send upon you affliction from above you or from beneath your feet or to confuse you [so you become] sects and make you taste the violence of one another." Look how We diversify the signs that they might understand.

-Sahih International

৬৫. বলুন(১) তোমাদের উপর(২) বা নীচ থেকে শাস্তি পাঠাতে(৩), বা তোমাদেরকে বিভিন্ন সন্দেহপূর্ণ দলে বিভক্ত করতে বা এক দলকে অন্য দলের সংঘর্ষের আস্বাদ গ্রহণ করাতে(৪) তিনি (আল্লাহ) সক্ষম। দেখুন, আমরা কিরূপে বিভিন্নভাবে আয়াতসমূহ বিবৃত করি যাতে তারা ভালভাবে বুঝতে পারে।

(১) এখানে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা যেকোন আযাব ও যেকোন বিপদ দূর করতে যেমন সক্ষম, তেমনিভাবে তিনি যখন কোন ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায়কে অবাধ্যতার শাস্তি দিতে চান, তখন যেকোন শাস্তি দেয়াও তার পক্ষে সহজ। কোন অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য দুনিয়ার শাসনকর্তাদের ন্যায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী দরকার হয় না এবং কোন সাহায্যকারীরও প্রয়োজন হয় না। বলা হচ্ছে, আল্লাহ্ তাআলা এ বিষয়েও শক্তিমান যে, তোমাদের প্রতি উপরদিক থেকে কিংবা পদতল থেকে কোন শাস্তি পাঠিয়ে দেবেন কিংবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করে পরস্পরের মুখোমুখি করে দেবেন এবং এক কে অপরের হাতে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দেবেন। মূলত: আল্লাহর শাস্তি তিন প্রকারঃ (১) যা উপর দিক থেকে আসে, (২) যা নিচের দিক থেকে আসে এবং (৩) যা নিজেদের মধ্যে মতানৈক্যের আকারে সৃষ্টি হয়। এ সব প্রকার আযাব দিতে আল্লাহ্ তা'আলা সক্ষম।

(২) মুফাসসিরগণ বলেন, উপর দিক থেকে আযাব আসার দৃষ্টান্ত বিগত উম্মতসমূহের মধ্যে অনেক রয়েছে। যেমন, নূহ আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের উপর প্লাবণাকারে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল, আদ জাতির উপর ঝড়-ঝঞ্চ্বা চড়াও হয়েছিল, লুত আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের উপর প্রস্তর বর্ষিত হয়েছিল এবং ইসরাঈল বংশধরদের উপর রক্ত, ব্যাঙ ইত্যাদি বর্ষণ করা হয়েছিল। আবরাহার হস্তীবাহিনী যখন মক্কার উপর চড়াও হয়, তখন পক্ষীকুল দ্বারা তাদের উপর কঙ্কর বর্ষণ করা হয়। ফলে সবাই চর্বিত ভূষির ন্যায় হয়ে যায়। [বাগভী]

(৩) এমনিভাবে বিগত উম্মতসমূহের মধ্যে নীচের দিক থেকে আযাব আসারও বিভিন্ন প্রকার অতিবাহিত হয়েছে। নূহ আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের প্রতি উপরের আযাব বৃষ্টির আকারে এবং নীচের আযাব ভূতল থেকে পানি স্ফীত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। তারা একই সময়ে উভয় প্রকার আযাবে পতিত হয়েছিল। ফিরআউনের সম্প্রদায়কে পদতলের আযাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারুণ স্বীয় ধন-ভাণ্ডারসহ এ আযাবে পতিত হয়ে মৃত্তিকার অভ্যন্তরে প্রোথিত হয়েছিল। [বাগভী] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ প্রমূখ মুফাসসিরগণ বলেন, উপরের আযাবের অর্থ অত্যাচারী বাদশাহ ও নির্দয় শাসকবর্গ এবং নীচের আযাবের অর্থ নিজ চাকর, নোকর ও অধীনস্ত কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতক, কর্তব্যে অবহেলাকারী ও আত্মসাৎকারী হওয়া। [ফাতহুল কাদীর]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন আল্লাহ্ তা'আলা কোন প্রশাসক বা শাসনকর্তার মঙ্গল চান, তখন তাকে উত্তম সহকারী দান করেন, যাতে প্রশাসক আল্লাহর কোন বিধান ভুলে গেলে সে তা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর যদি প্রশাসক আল্লাহর বিধান স্মরণ করে তখন সে তা বাস্তবায়নে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে যখন কোন প্রশাসক বা শাসনকর্তার অমঙ্গলের ইচ্ছা করেন, তখন মন্দ লোকদেরকে তার পরামর্শদাতা নিযুক্ত করা হয়; ফলে সে যখন আল্লাহর কোন বিধান ভুলে যায় তখন তারা তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর যদি সে প্রশাসক নিজেই স্মরণ করে তখন তারা তাকে তা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করে না। [আবু দাউদ: ২৯৩২; নাসায়ী: ৪২০৪]

এসব হাদীস ও আলোচ্য আয়াতের উল্লেখিত তাফসীরের সারমর্ম এই যে, জনগণ শাসকবর্গের হাতে যেসব কষ্ট ও বিপদাপদ ভোগ করে, তা উপর দিককার আযাব এবং যেসব কষ্ট অধীন কর্মচারীদের দ্বারা ভোগ করতে হয়, সেগুলো নীচের দিককার আযাব! এগুলো কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, বরং আল্লাহর আইন অনুসারে মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি। সুফিয়ান সওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন আমি কোন গোনাহ করে ফেলি, তখন এর ক্রিয়া স্বীয় চাকর, আরোহণের ঘোড়া ও বোঝা বহনের গাধার মেজাজেও অনুভব করি। এরা সবাই আমার অবাধ্যতা করতে থাকে।

(৪) আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় প্রকার আযাব হচ্ছে, বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া এবং একদল অন্য দলের জন্য আযাব হওয়া। তাই আয়াতের অনুবাদ এরূপ হবে, এক প্রকার আযাব এই যে, জাতি বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে যাবে। এ কারণেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদেরকে সম্বোধন করে বললেন, সাবধান! তোমরা আমার পরে পুনরায় কাফের হয়ে যেয়ো না যে, একে অন্যের গর্দান মারতে শুরু করবে। [বুখারীঃ ১২১]

সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস বলেন, ‘একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে চলতে চলতে বনী মুয়াবিয়ার মাসজিদে প্রবেশ করে দুরাকাআত সালাত আদায় করলাম। তিনি তার রবের কাছে অনেকক্ষণ দুআ করার পর বললেনঃ আমি রব-এর নিকট তিনটি বিষয় প্রার্থনা করেছি- তিনি আমাকে দুটি বিষয় দিয়েছেন, আর একটি থেকে নিষেধ করেছেন। আমি প্রার্থনা করেছি যে, (এক) আমার উম্মতকে যেন দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা দ্বারা ধ্বংস করা না হয়, আল্লাহ্ তা'আলা এ দু'আ কবুল করেছেন। (দুই) আমার উম্মতকে যেন নিমজ্জিত করে ধ্বংস করা না হয়। আল্লাহ্ তা'আলা এ দু'আও কবুল করেছেন। (তিন) আমার উম্মত যেন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দ্বারা ধ্বংস না হয়। আমাকে তা প্রদান করতে নিষেধ করেছেন। [মুসলিমঃ ২৮৯০]

এসব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর বিগত উম্মতদের ন্যায় আকাশ কিংবা ভূতল থেকে কোন ব্যাপক আযাব আগমন করবে না; কিন্তু একটি আযাব দুনিয়াতে তাদের উপরও আসতে থাকবে। এ আযাব হচ্ছে পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং দলীয় সংঘর্ষ। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত জোর সহকারে উম্মতকে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি প্রতি ক্ষেত্রেই হুশিয়ার করেছেন যে, দুনিয়াতে যদি তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে, তবে তা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমেই আসবে।
অন্য আয়াতে এ বিষয়টি পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রে আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, “তার সর্বদা পরস্পরে মতবিরোধ করতেই থাকবে, তবে যাদের প্রতি আল্লাহ্‌র রহমত রয়েছে, তারা এর ব্যতিক্রম।” [সূরা হুদ: ১১৮-১১৯]

এতে বুঝা গেল যে, যারা পরস্পর (শরীআতসম্মত কারণ ছাড়া) মতবিরোধ করে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত কিংবা দূরবর্তী। তাই আয়াতে বলা হয়েছে, যারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং মতবিরোধ করেছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না। কেননা যারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে তারা আল্লাহর রহমত হতে দূরে সরে এসেছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৫) বল, ‘তোমাদের ঊর্ধ্বদেশ[1] অথবা পদতল[2] হতে শাস্তি প্রেরণ করতে, তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে এবং এক দলকে অপর দলের নিপীড়নের আস্বাদ গ্রহণ করাতে তিনিই সক্ষম।’[3] দেখ, কিরূপ বিভিন্ন প্রকারে আয়াতসমূহ বিবৃত করি; যাতে তারা অনুধাবন করে।

[1] অর্থাৎ, আসমান হতে। যেমন, অতি বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, শিলাবৃষ্টি, বজ্রাঘাত দ্বারা আযাব কিংবা (উচ্চশ্রেণী) শাসকদের পক্ষ হতে যুলুম-অত্যাচার।

[2] যেমন, ভূমি ধস, বান-বন্যা; যাতে সব কিছুই ডুবে যায়। অথবা অর্থ হল, (নিম্নশ্রেণী) ক্রীতদাস ও ভৃত্য-চাকরদের তরফ হতে আযাব। তাদের আন্তরিকতাহীন ও বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাওয়া।

[3] يَلْبِسَكُمْ أَي: يَخْلُطَ أَمْرَكُمْ অর্থাৎ, তোমাদের যাবতীয় কার্যকলাপকে এমন গোলমেলে ও সন্দিগ্ধ করে দেবেন যে, তার কারণে তোমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। وَيُذِيْقُ، أَي: يَقْتُلُ بَعْضُكُمْ بَعْضًا فَتُذِيْقَ كُلُّ طَائِفَةٍ الأخرَى أَلَمَ الْحَرْبِ অর্থাৎ, তোমাদের একজন অপরজনকে হত্যা করবে। এইভাবে প্রত্যেক দল অপর দলকে যুদ্ধের স্বাদ আস্বাদন করাবে। (আয়সারুত্ তাফাসীর) হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, ‘‘আমি আল্লাহ তাআলার কাছে তিনটি দু’আ করি। (ক) আমার উম্মতকে ডুবিয়ে যেন ধ্বংস না করা হয়। (খ) ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দ্বারা তাদের বিনাশ সাধন যেন না হয়। (গ) তাদের আপোসে যেন লড়াই-ঝগড়া (গৃহযুদ্ধ) না হয়। মহান আল্লাহ প্রথম দু’টি দু’আ কবুল করলেন এবং তৃতীয় দু’আ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন।’’ (সহীহ মুসলিম ২২১৬নং) অর্থাৎ, আল্লাহর জ্ঞানে এ কথা ছিল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে অনৈক্য ও বিরোধ সংঘটিত হবে। আর তার কারণ হবে আল্লাহর অবাধ্যতা এবং কুরআন ও হাদীস থেকে বিমুখতা। ফলে এই ধরনের আযাব থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মত সুরক্ষিত থাকতে পারবে না। অর্থাৎ, এর সম্পর্ক আল্লাহর সেই চিরন্তন বিধানের সাথে যা সমূহ জাতির আখলাক-চরিত্র এবং তাদের আচার-আচরণ অনুযায়ী সর্বযুগে থেকেছে; যাতে কোন প্রকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। {فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَبْدِيلًا وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَحْوِيلًا} ‘‘তুমি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর রীতি-নীতিতে কোন রকম বিচ্যুতিও পাবে না।’’ (সূরা ফাত্বির ৪৩)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৬ وَ كَذَّبَ بِهٖ قَوۡمُكَ وَ هُوَ الۡحَقُّ ؕ قُلۡ لَّسۡتُ عَلَیۡكُمۡ بِوَكِیۡلٍ ﴿ؕ۶۶﴾
و كذب بهٖ قومك و هو الحق قل لست علیكم بوكیل ﴿۶۶﴾
• আর তোমার কওম তা অস্বীকার করেছে, অথচ তা সত্য। বল, ‘আমি তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নই’।

-আল-বায়ান

• তোমার কওম তা (অর্থাৎ ‘আযাবকে) মিথ্যে মনে করছে কিন্তু তা প্রকৃত সত্য। বল, আমি তোমাদের কর্মবিধায়ক নই।

-তাইসিরুল

• তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা ওকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে, অথচ ওটা প্রমানিত সত্য। তুমি বলে দাওঃ আমি তোমাদের উকিল হয়ে আসিনি।

-মুজিবুর রহমান

• But your people have denied it while it is the truth. Say, "I am not over you a manager."

-Sahih International

৬৬. আর আপনার সম্প্রদায় তো ওটাকে মিথ্যা বলেছে অথচ ওটা সত্য। বলুন, আমি তোমাদের কার্যনির্বাহক নই।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৬) তোমার সম্প্রদায় তো ওটাকে[1] মিথ্যা বলেছে অথচ তা সত্য। বল, ‘আমি তোমাদের উকীল (কার্যনির্বাহক) নই।’ [2]

[1] بِهِ এর ‘মারজা’ বা পূর্বপদ (‘ওটা’ বলতে উদ্দেশ্য) হল কুরআন কিংবা আযাব। (ফাতহুল ক্বাদীর)

[2] অর্থাৎ, আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি যে, আমি তোমাদেরকে হিদায়াতের পথে এনেই ছাড়ব। বরং আমার কাজ কেবল দাওয়াত ও তবলীগ করা। {فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ}  সুতরাং যার ইচ্ছা সে বিশ্বাসী হোক, আর যার ইচ্ছা সে অবিশ্বাসী হোক। (সূরা কাহ্ফ ২৯)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৭ لِكُلِّ نَبَاٍ مُّسۡتَقَرٌّ ۫ وَّ سَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۷﴾
لكل نبا مستقر و سوف تعلمون ﴿۶۷﴾
• প্রত্যেক সংবাদের নির্ধারিত সময় রয়েছে এবং অচিরেই তোমরা জানবে।

-আল-বায়ান

• প্রত্যেক (ভবিষ্যৎ) বাণীর (সত্যরূপে প্রকাশিত হওয়ার) জন্য একটা সময় নির্ধারিত করা আছে আর তা তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে।

-তাইসিরুল

• প্রত্যেকটি সংবাদ প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে এবং অচিরেই তোমরা তা জানতে পারবে।

-মুজিবুর রহমান

• For every happening is a finality; and you are going to know.

-Sahih International

৬৭. প্রত্যেক বার্তার জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে এবং অচিরেই তোমরা জানতে পারবে।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৭) প্রত্যেক বার্তার জন্য নির্ধারিত কাল রয়েছে এবং শীঘ্রই তোমরা অবহিত হবে।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৮ وَ اِذَا رَاَیۡتَ الَّذِیۡنَ یَخُوۡضُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِنَا فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ حَتّٰی یَخُوۡضُوۡا فِیۡ حَدِیۡثٍ غَیۡرِهٖ ؕ وَ اِمَّا یُنۡسِیَنَّكَ الشَّیۡطٰنُ فَلَا تَقۡعُدۡ بَعۡدَ الذِّكۡرٰی مَعَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۶۸﴾
و اذا رایت الذین یخوضون فی ایتنا فاعرض عنهم حتی یخوضوا فی حدیث غیرهٖ و اما ینسینك الشیطن فلا تقعد بعد الذكری مع القوم الظلمین ﴿۶۸﴾
• আর যখন তুমি তাদেরকে দেখ, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক সমালোচনায় রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসো না।

-আল-বায়ান

• যখন তুমি দেখ আমার আয়াত নিয়ে তারা উপহাসপূর্ণ আলোচনা করছে তখন তাদের থেকে সরে পড় যে পর্যন্ত তারা অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়। আর যখন শয়ত্বান তোমাকে (আল্লাহর এই নাসীহাত) ভুলিয়ে দেয় তখন স্মরণ হয়ে গেলেই যালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর বসবে না।

-তাইসিরুল

• যখন তুমি দেখবে যে, লোকেরা আমার আয়াতসমূহে দোষ-ক্রটি অনুসন্ধান করছে তখন তুমি তাদের নিকট হতে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য কোন প্রসঙ্গে নিমগ্ন হয়। শাইতান যদি তোমাকে এটা বিস্মৃত করে তাহলে স্মরণ হওয়ার পর আর ঐ যালিম লোকদের সাথে তুমি বসবেনা।

-মুজিবুর রহমান

• And when you see those who engage in [offensive] discourse concerning Our verses, then turn away from them until they enter into another conversation. And if Satan should cause you to forget, then do not remain after the reminder with the wrongdoing people.

-Sahih International

৬৮. আর আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, যারা আমাদের আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসংগ শুরু করে(১)। আর শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবেন না(২)।

(১) আয়াতে বলা হয়েছে, আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, যারা আল্লাহ তা'আলার নিদর্শনাবলীতে শুধু ক্রীড়া-কৌতুক ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের জন্য করে এবং ছিদ্রান্বেষণ করে, তখন আপনি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। এ আয়াতে প্রত্যেক সম্বোধনযোগ্য ব্যক্তিকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে মুসলিমদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যে কাজ নিজে করা গোনাহ, সেই কাজ যারা করে, তাদের মজলিসে যোগদান করাও গোনাহ। এ থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

(২) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, যদি শয়তান আপনাকে বিস্মৃত করিয়ে দেয় অর্থাৎ ভুলক্রমে তাদের মজলিশে যোগদান করে ফেলেন-নিষেধাজ্ঞা স্মরণ না থাকার কারণে হোক কিংবা তারা যে স্বীয় মজলিশে আল্লাহর আয়াত ও রাসূলের বিপক্ষে আলোচনা করে, তা আপনার স্মরণ ছিল না, তাই যোগদান করেছেন। উভয় অবস্থাতেই যখন স্মরণ হয় তখনই মজলিশ ত্যাগ করা উচিত। স্মরণ হওয়ার পর সেখানে বসে থাকা গোনাহ। অন্য এক আয়াতেও এ বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে এবং শেষ ভাগে বলা হয়েছে যে, যদি আপনি সেখানে বসে থাকেন, তবে আপনিও তাদের মধ্যে গণ্য হবেন। [সূরা আন-নিসাঃ ১৪০]

আয়াতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, গোনাহর মজলিশ ও মজলিশের লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। এর উত্তম পন্থা হচ্ছে মজলিশ ত্যাগ করে চলে যাওয়া। কিন্তু মজলিশ ত্যাগ করার মধ্যে যদি জান, মাল কিংবা ইজ্জতের ক্ষতির আশংকা থাকে, তবে সর্বসাধারণের পক্ষে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অন্য পন্থা অবলম্বন করাও জায়েয। উদাহরণতঃ অন্য কাজে ব্যাপৃত হওয়া এবং তাদের প্রতি ভ্রক্ষেপ না করা। কিন্তু বিশিষ্ট লোক, দ্বীনী ক্ষেত্রে যাদের অনুকরণ করা হয় তাদের পক্ষে সর্বাবস্থায় সেখান থেকে উঠে যাওয়াই সমীচীন।

মোটকথা, আয়াত থেকে জানা গেল যে, কেউ ভুলক্রমে কোন ভ্রান্ত কাজে জড়িত হয়ে পড়লে তা মাফ করা হবে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মতকে ভুলভ্রান্তি ও বিস্মৃতির গোনাহ এবং যে কাজ অন্য কেউ জোর-যবরদস্তির সাথে করায়, সেই কাজের গোনাহ থেকে অব্যাহতি দান করেছেন। [ইবনে মাজাহঃ ২০৪০, ২০৪৩]

এ আয়াত দ্বারা আরও বুঝা যায় যে, যে মজলিশে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল কিংবা শরীআতের বিপক্ষে কথাবার্তা হয় তা বন্ধ করা, করানো কিংবা কমপক্ষে সত্য কথা প্রকাশ করতে সাধ্য না থাকে, তবে এরূপ প্রত্যেকটি মজলিশ বর্জন করা মুসলিমদের উচিত। হ্যাঁ, সংশোধনের নিয়তে এরূপ মজলিশে যোগদান করলে এবং হক কথা প্রকাশ করলে তাতে কোন দোষ নেই। আয়াতের শেষে বলা হয়েছেঃ স্মরণ হওয়ার পর অত্যাচারী সম্প্রদায়ের সাথে উপবেশন করো না। এ থেকে বুঝা যায় যে, এরূপ অত্যাচারী, অধাৰ্মিক ও উদ্ধত লোকদের মজলিশে যোগদান করা সর্বাবস্থায় গোনাহ; তারা তখন কোন অবৈধ আলোচনায় লিপ্ত হোক বা না হোক। কারণ, বাজে আলোচনা শুরু করতে তাদের বেশী দেরী লাগে না। কেননা, আয়াতে সর্বাবস্থায় যালিমদের সাথে বসতে নিষেধ করা হয়েছে। তারা তখনো যুলুমে ব্যাপৃত থাকবে এরূপ কোন শর্ত আয়াতে নেই। কুরআনুল কারীমের অন্য এক আয়াতেও এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে, “অত্যাচারীদের সাথে মেলামেশা ও উঠাবসা করো না। নতুবা তোমাদেরকেও জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে।” [সূরা হুদঃ ১১৩]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৮) তুমি যখন দেখ, তারা আমার নিদর্শন সম্বন্ধে ব্যঙ্গ আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন তুমি দূরে সরে পড়; যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় এবং শয়তান যদি তোমাকে ভ্রমে ফেলে, তাহলে স্মরণ হওয়ার পরে তুমি অত্যাচারী সম্প্রদায়ের সাথে বসবে না। [1]

[1] আয়াতে সম্বোধন নবী করীম (সাঃ)-কে করা হলেও এই সম্বোধন প্রকৃতপক্ষে সকল মুসলিম উম্মতকে। আর এটা মহান আল্লাহর এমন এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ, যেটাকে কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা নিসার ১৪০নং আয়াতেও এ বিষয়টা উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে লক্ষ্য এমন সব মজলিস, যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধি-বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়। অথবা কার্যতঃ যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ)-কে তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। কিংবা যেখানে বিদআতীরা অপব্যাখ্যা ও অসঙ্গত কূটার্থ নির্ণয়ের মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতসমূহের হেরফের করে। এই ধরনের মজলিসে অন্যায় কথার প্রতিবাদ করার এবং সত্যকে তুলে ধরার জন্য অংশ গ্রহণ করা তো বৈধ, অন্যথা সে মজলিসে অংশ গ্রহণ করা মহাপাপ এবং আল্লাহর ক্রোধের কারণও।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৬৯ وَ مَا عَلَی الَّذِیۡنَ یَتَّقُوۡنَ مِنۡ حِسَابِهِمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ وَّ لٰكِنۡ ذِكۡرٰی لَعَلَّهُمۡ یَتَّقُوۡنَ ﴿۶۹﴾
و ما علی الذین یتقون من حسابهم من شیء و لكن ذكری لعلهم یتقون ﴿۶۹﴾
• আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যালিমদের কোন হিসেব তাদের উপর নেই। কিন্তু (তাদের কর্তব্য হচ্ছে) উপদেশ দেয়া, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।

-আল-বায়ান

• তাদের কোন কাজের হিসেব দেয়ার দায়-দায়িত্ব মুত্তাকীদের উপর নেই। কিন্তু উপদেশ দেয়া কর্তব্য যাতে ওরাও তাকওয়া অবলম্বন করে।

-তাইসিরুল

• ওদের যখন বিচার হবে তখন মুত্তাকীদের উপর এর কোন প্রভাব পরবেনা, কিন্তু ওদেরকে উপদেশ প্রদানের জন্য তাদের উপর দায়িত্ব রয়েছে, হয়তো বা উপদেশের ফলে ওরা পাপাচার হতে বেঁচে থাকতে পারবে।

-মুজিবুর রহমান

• And those who fear Allah are not held accountable for the disbelievers at all, but [only for] a reminder - that perhaps they will fear Him.

-Sahih International

৬৯. আর তাদের(১) কাজের জবাবদিহির দায়িত্ব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের নয়। তবে উপদেশ দেয়া তাদের কর্তব্য, যাতে তারাও তাকওয়া অবলম্বন করে।

(১) অর্থাৎ পূর্বোক্ত আয়াতে বর্ণিত লোকেরা যালিম কিন্তু তাদের হিসাব-নিকাশ ও তাদের শাস্তি বিধান করা সাধারণ মুমিন মুত্তাকীদের কাজ নয়। তারা তাদেরকে কেবল নসীহত ও হক কথা জানিয়ে দেয়ার কাজই করবে। যাতে তারা বাতিল পথ পরিহার করে এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে। [মুয়াসসার] কিন্তু যদি তাদেরকে নসীহত করলে ক্ষতির পরিমাণ বেশী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন তাও পরিত্যাগ করতে হবে। [সা'দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬৯) ওদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তাদের নয়, যারা সাবধানতা অবলম্বন করে।[1] তবে উপদেশ দেওয়া তাদের কর্তব্য, যাতে ওরাও সাবধান হতে পারে। [2]

[1] مِنْ حِسَابِهِمْ এর সম্পর্ক আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের সাথে। অর্থাৎ, যারা এই ধরনের মজলিসে শরীক হওয়া থেকে দূরে থাকবে, আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে উপহাস করার যে পাপ উপহাসকারীদের হবে, সে পাপ থেকে তারা সুরক্ষিত থাকবে।

[2] অর্থাৎ, (তাদের থেকে) দূরে ও পৃথক থাকার সাথে সাথে সাধ্যানুযায়ী ওয়ায-নসীহত এবং ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ প্রদানের দায়িত্ব পালন করবে। হতে পারে তারাও তাদের ঐ আচরণ থেকে ফিরে আসবে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৬ : ৭০ وَ ذَرِ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا دِیۡنَهُمۡ لَعِبًا وَّ لَهۡوًا وَّ غَرَّتۡهُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا وَ ذَكِّرۡ بِهٖۤ اَنۡ تُبۡسَلَ نَفۡسٌۢ بِمَا كَسَبَتۡ ٭ۖ لَیۡسَ لَهَا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَلِیٌّ وَّ لَا شَفِیۡعٌ ۚ وَ اِنۡ تَعۡدِلۡ كُلَّ عَدۡلٍ لَّا یُؤۡخَذۡ مِنۡهَا ؕ اُولٰٓئِكَ الَّذِیۡنَ اُبۡسِلُوۡا بِمَا كَسَبُوۡا ۚ لَهُمۡ شَرَابٌ مِّنۡ حَمِیۡمٍ وَّ عَذَابٌ اَلِیۡمٌۢ بِمَا كَانُوۡا یَكۡفُرُوۡنَ ﴿۷۰﴾
و ذر الذین اتخذوا دینهم لعبا و لهوا و غرتهم الحیوۃ الدنیا و ذكر بهٖ ان تبسل نفس بما كسبت ٭ لیس لها من دون الله ولی و لا شفیع و ان تعدل كل عدل لا یؤخذ منها اولٓئك الذین ابسلوا بما كسبوا لهم شراب من حمیم و عذاب الیم بما كانوا یكفرون ﴿۷۰﴾
• আর তুমি পরিত্যাগ কর তাদেরকে, যারা নিজদের দীনকে গ্রহণ করেছে খেল-তামাশা রূপে এবং প্রতারিত করেছে যাদেরকে দুনিয়ার জীবন। আর তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও, যাতে কোন ব্যক্তি তার কৃতকর্মের দরুন ধ্বংসের শিকার না হয়, তার জন্য আল্লাহ ছাড়া নেই কোন অভিভাবক এবং নেই কোন সুপারিশকারী। আর যদি সে সব ধরণের মুক্তিপণও দেয়, তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা, যারা ধ্বংসের শিকার হয়েছে তাদের কৃতকর্মের দরুন। তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানীয় এবং বেদনাদায়ক আযাব, যেহেতু তারা কুফরী করত।

-আল-বায়ান

• যারা তাদের দ্বীনকে খেলা তামাশা বানিয়ে নিয়েছে আর পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছে তুমি তাদেরকে বর্জন কর। আর তা (অর্থাৎ কুরআন) দিয়ে তাদেরকে উপদেশ দাও যাতে কেউ স্বীয় কৃতকর্মের কারণে ধ্বংস না হয়, আল্লাহ ছাড়া তার কোন অভিভাবক নেই এবং কোন সুপারিশকারী নেই, (মুক্তির) বিনিময়ে সব কিছু দিতে চাইলেও তা তার থেকে গ্রহণ করা হবে না, ওরাই তারা যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস হবে, তাদের জন্য আছে ফুটন্ত গরম পানীয় আর মহা শাস্তি, যেহেতু তারা কুফরীতে লিপ্ত ছিল।

-তাইসিরুল

• যারা নিজেদের দীনকে খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছে তুমি তাদেরকে বর্জন করে চলবে, পার্থিব জীবন যাদেরকে সম্মোহিত করে ধোঁকায় নিপতিত করেছে, কুরআন দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দিতে থাক, যাতে কোন ব্যক্তি স্বীয় কাজ দোষে ধ্বংস হয়ে না যায়। আল্লাহ ছাড়া তার কোন বন্ধু, সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না, আর যেন এই অবস্থার সম্মুখীন না হয় যে, দুনিয়ার সমস্ত কিছুর বিনিময় দিয়েও মুক্তি পেতে চাইলে সেই বিনিময় গ্রহণ করা হবেনা। তারা এমনই লোক যারা নিজেদের কর্মদোষে আটকা পড়ে গেছে; তাদের কুফরী করার কারণে তাদের জন্য ফুটন্ত গরম পানীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

-মুজিবুর রহমান

• And leave those who take their religion as amusement and diversion and whom the worldly life has deluded. But remind with the Qur'an, lest a soul be given up to destruction for what it earned; it will have other than Allah no protector and no intercessor. And if it should offer every compensation, it would not be taken from it. Those are the ones who are given to destruction for what they have earned. For them will be a drink of scalding water and a painful punishment because they used to disbelieve.

-Sahih International

৭০. আর যারা তাদের দ্বীনকে খেল- তামাশারূপে গ্রহণ করে(১) এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে আপনি তাদের পরিত্যাগ করুন। আর আপনি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দিন(২), যাতে কেউ নিজ কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস না হয়, যখন আল্লাহ ছাড়া তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না এবং বিনিময়ে সবকিছু দিলেও তা গ্রহণ করা হবে না।(৩) এরাই নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস হয়েছে; কুফরীর কারণে এদের জন্য রয়েছে অতি উষ্ণ পানীয় ও কষ্টদায়ক শাস্তি।(৪)

(১) আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আপনি তাদেরকে পরিত্যাগ করুন, যারা দ্বীনকে ক্রীড়া ও কৌতুক করে রেখেছে। এর দুটি অর্থ হতে পারেঃ (এক) তাদের জন্য সত্য দ্বীন ইসলাম প্রেরিত হয়েছে; কিন্তু একে তারা ক্রীড়া ও কৌতুকের বস্তুতে পরিণত করেছে এবং একে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। (দুই) তারা আসল দ্বীন পরিত্যাগ করে ক্রীড়া ও কৌতুককেই দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করেছে। উভয় অর্থেরই সারমর্ম প্রায় এক।

(২) এখানে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। এটিই তাদের ব্যাধির আসল কারণ। অর্থাৎ তাদের যাবতীয় লম্ফঝম্ফ ও ঔদ্ধত্যের আসল কারণই হচ্ছে, তারা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন দ্বারা প্রলোভিত এবং আখেরাত বিস্মৃত। আখেরাত ও কেয়ামতের বিশ্বাস থাকলে তারা কখনো এরূপ কাণ্ড করতে না। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাধারণ মুসলিমদেরকে দুটি নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ (এক) উল্লেখিত বাক্যে বর্ণিত লোকদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়াই যথেষ্ট নয়, বরং ইতিবাচকভাবে তাদেরকে কুরআন দ্বারা উপদেশ দান করা এবং (দুই) আল্লাহ্ তা'আলার আযাবের ভয় প্রদর্শন করা।

(৩) আয়াতের শেষে আযাবের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, তাদের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে তারা স্বয়ং কুকর্মের জালে আবদ্ধ হয়ে যাবে। আয়াতে (أَنْ تُبْسَلَ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ আবদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং জড়িত হয়ে পড়া। কোন ভুল কিংবা কারো প্রতি অত্যাচার করে বসলে তার সম্ভাব্য শাস্তির কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ দুনিয়াতে তিন প্রকার উপায় অবলম্বন করতে অভ্যস্ত। স্বীয় দলবল ব্যবহার করে অত্যাচারের প্রতিশোধ থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হলে প্রভাবশালীদের সুপারিশ কাজে লাগায়। এতেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলে শাস্তির কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতে বলেছেন যে, আল্লাহ অপরাধীকে যখন শাস্তি দেবেন, তখন সে শাস্তির কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য কোন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এগিয়ে আসবে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো সুপারিশ কার্যকর হবে না এবং কোন অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করা হবে না। যদি কেউ সারা বিশ্বের অর্থ-সম্পদের অধিকারী হয় এবং শাস্তির কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য তা বিনিময়স্বরূপ দিতে চায়, তবুও এ বিনিময় গ্রহণ করা হবে না।

(৪) বলা হচ্ছে, এরা ঐ সব লোক, যাদেরকে কুকর্মের শাস্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে জাহান্নামের ফুটন্ত পানি পান করার জন্য দেয়া হবে। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, “এ পানি তাদের নাড়িভূড়িকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে।” [সূরা মুহাম্মাদ: ১৫] এ পানি ছাড়াও অন্যান্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হবে, তাদের কুফর ও অবিশ্বাসের কারণে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৭০) যারা তাদের ধর্মকে ক্রীড়াকৌতুকরূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে, তুমি তাদের সঙ্গ বর্জন কর এবং এ (কুরআন) দ্বারা তাদের উপদেশ দাও, যাতে কেউ নিজ কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস না হয়[1] যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না এবং বিনিময়ে সব কিছু দিলেও তা গৃহীত হবে না।[2] এরাই নিজ কৃতকার্যের জন্য ধ্বংস হবে। তাদের অবিশ্বাস হেতু তাদের জন্য রয়েছে উত্তপ্ত পানীয় ও মর্মন্তুদ শাস্তি।

[1] تُبْسَلَ أَي: لِئَلاَّ تُبْسَلَ بَسَلٌ এর প্রকৃত অর্থ হলঃ বাধা, বারণ। আর এ থেকেই বলা হয়, شُجَاعٌ بَاسِلٌ (দুর্দম বীর)। তবে এখানে এর কয়েকটি অর্থ করা হয়েছে। (ক) تُسَلَّم (সমর্পিত না হয়)। (খ) تُفْضَح (লাঞ্ছিত না হয়)। (গ) تُؤَاخَذ (পাকড়াও না করা হয়)। (ঘ) تُجَازَى (প্রতিফল না দেওয়া হয়)। (অনুরূপ ফেঁসে না যায়, ধ্বংস না হয় ইত্যাদি) ইমাম ইবনে কাসীর বলেন, সবগুলোর অর্থ প্রায় একই। সার কথা হল, তাদেরকে এই কুরআনের মাধ্যমে নসীহত কর। এ রকম যেন না হয় যে, মানুষকে তার কৃতকর্মের কারণে ধ্বংসের হাতে সমর্পণ করে দেওয়া হয় অথবা লাঞ্ছনাই তার ভাগ্যে জুটে কিংবা তাকে পাকড়াও করে প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়।

[2] দুনিয়াতে সাধারণতঃ মানুষ তার কোন বন্ধুর সাহায্যে অথবা কারো সুপারিশের কারণে কিংবা টাকা-পয়সার বিনিময়ে মুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু আখেরাতে এই তিনটি মাধ্যমই কোন কাজে আসবে না। সেখানে কাফেরদের এমন কোন বন্ধু হবে না, যে তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচিয়ে নেবে, আর না এমন কোন সুপারিশকারী হবে, যে তাকে আল্লাহর আযাব থেকে নিষ্কৃতি দেবে, আর না কারো কাছে বিনিময় দেওয়ার মত কিছু থাকবে। আর থাকলেও তা তার নিকট থেকে গ্রহণই করা হবে না যে, তা দিয়ে সে বেঁচে যাবে। এই বিষয়টা কুরআন মাজীদের আরো বহু স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ৬১ থেকে ৭০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৬৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 7 8 · · · 14 15 16 17 পরের পাতা »