১৮ : ৫১
مَاۤ اَشۡهَدۡتُّهُمۡ خَلۡقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لَا خَلۡقَ اَنۡفُسِهِمۡ ۪ وَ مَا كُنۡتُ مُتَّخِذَ الۡمُضِلِّیۡنَ عَضُدًا ﴿۵۱﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫১. আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকালে আমি তাদেরকে সাক্ষী করিনি এবং তাদের নিজেদের সৃষ্টির সময়ও নয়, আর আমি পথভ্রষ্টকারীদেরকে সাহায্যকারীরূপে গ্ৰহণকারী নই।(১)
(১) তাদের সৃষ্টি করার সময় আমার কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়নি। যাদেরকে তোমরা আহ্বান করছ তারা সবাই তোমাদের মতই তাঁর বান্দাহ, কোন কিছুরই মালিক নয়। আসমান ও যমীন সৃষ্টি করার সময় তারা সেখানে ছিল না, তাই দেখার প্রশ্নও উঠে না। অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ “বলুন, তোমরা ডাক তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে ইলাহ মনে করতে। তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এ দুটিতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়। যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ছাড়া আল্লাহর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।” [সূরা সাবা: ২২–২৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫১) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকালে আমি তাদেরকে (উপস্থিত) সাক্ষী রাখিনি এবং তাদের সৃজনকালেও নয়।[1] আর আমি এমনও নই যে, বিভ্রান্তকারীদেরকে সহায়করূপে গ্রহণ করব। [2]
[1] অর্থাৎ, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি ও তার পরিচালনার ব্যাপারে, এমন কি এই শয়তানদের সৃষ্টি করার ব্যাপারেও আমি তাদের থেকে বা তাদের মধ্যে হতে কোন একজনের থেকেও কোন সাহায্য গ্রহণ করিনি। এদের তো তখন অস্তিত্বই ছিল না। তাহলে তোমরা এই শয়তান এবং তার বংশধরের পূজা অথবা আনুগত্য কেন কর? পক্ষান্তরে আমার ইবাদত ও আনুগত্য থেকে তোমরা বিমুখ কেন? অথচ এরা সৃষ্টি, আর আমি এদের সকলের স্রষ্টা।
[2] অসম্ভব সত্ত্বেও যদি আমি কাউকে সাহায্যকারী বানাতামও, তবে এদেরকে কেন, যারা আমার বান্দাদেরকে ভ্রষ্ট করে আমার জান্নাত ও আমার সন্তুষ্টির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫২
وَ یَوۡمَ یَقُوۡلُ نَادُوۡا شُرَكَآءِیَ الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ فَدَعَوۡهُمۡ فَلَمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَهُمۡ وَ جَعَلۡنَا بَیۡنَهُمۡ مَّوۡبِقًا ﴿۵۲﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫২. আর সেদিনের কথা স্মরণ করুন, যেদিন তিনি বলবেন, তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে ডাক।(১) তারা তখন তাদেরকে ডাকবে কিন্তু তারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে না।(২) আর আমরা তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দেব এক ধ্বংস-গহ্বর।(৩)
(১) অর্থাৎ তারা যেহেতু তাদেরকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তাদের ধারণামতে তারা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে তাদেরকে আহবান জানাতে বলা হয়েছে। নতুবা কোন শরীক হওয়া থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ পবিত্র ও মহান। [ফাতহুল কাদীর]
(২) অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর সাথে যাদের শরীক করতে তাদেরকে আহবান করে তাদের দ্বারা আল্লাহর আযাব থেকে উদ্ধার পাওয়া বা আযাবের বিপরীতে সাহায্য লাভ করো কি না দেখা। [ইবন কাসীর] তারা তাদেরকে আহবান করবে কিন্তু তাদের সে আহবান কোন কাজে আসবে না। ঐ সমস্ত উপাস্যের দল এদের ডাকে সাড়াও দিবে না, উদ্ধারও করবে না। কুরআনের অন্যত্র মহান আল্লাহ তা বর্ণনা করেছেন: “পরে কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে লাঞ্চিত করবেন এবং তিনি বলবেন, কোথায় আমার সেসব শরীক যাদের সম্বন্ধে তোমরা বিতন্ডা করতে? যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছিল তারা বলবে, ‘আজ লাঞ্ছনা ও অমংগল কাফিরদের—” [সূরা আন-নাহল: ২৭]
আরও এসেছে, “এবং সেদিন তিনি তাদেরকে ডেকে বলবেন, “তোমরা যাদেরকে আমার শরীক গণ্য করতে, তারা কোথায়?” যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে, হে আমাদের রব! এদেরকেই আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম; এদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম। যেমন আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার সমীপে আমরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি চাচ্ছি। এরা তো আমাদের ইবাদাত করত না।” তাদেরকে বলা হবে, “তোমাদের দেবতাগুলোকে ডাক” তখন তারা ওদেরকে ডাকবে। কিন্তু ওরা এদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর এরা শাস্তি দেখতে পাবে। হায়! এরা যদি সৎপথ অনুসরণ করত।” [সূরা আল-ক্কাসাস: ৬২–৬৪]।
আরও এসেছে, “যেদিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, আমার শরীকেরা কোথায়? তখন তারা বলবে, আমরা আপনার কাছে নিবেদন করি যে, এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আগে তারা যাকে ডাকত তারা উধাও হয়ে যাবে এবং অংশীবাদীরা উপলব্ধি করবে যে, তাদের নিস্কৃতির কোন উপায় নেই।” [সূরা ফুস্সিলাত: ৪৭–৪৮]। আরও বলেনঃ “এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞের মত কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না।” [সূরা ফাতের: ১৩–১৪]
অন্যত্র বলেছেনঃ “সে ব্যক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও নয়। যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্র করা হবে তখন ঐগুলো হবে তাদের শত্রু এবং ঐগুলো তাদের ‘ইবাদাত অস্বীকার করবে।” [সূরা আল-আহকাফ: ৫–৬]
(৩) এখানে “তাদের উভয়ের” বলে কাদের বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে, এক. তাদের এবং তারা যাদের ইবাদত করত সে সব বাতিল উপাস্যদের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন যে তারা একে অপরের কাছে পৌঁছতে পারবে না। তাদের মাঝখানে থাকবে ধ্বংস গহবর। [ফাতহুল কাদীর] দুই. অথবা “তাদের উভয়ের” বলে ঈমানদার ও কাফের দু’দলকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর] তখন আয়াতের অর্থ হবে, ঈমানদার ও কাফের এর মাঝে পার্থক্য করে দেয়া হবে। কাফেরদের সামনে থাকবে শুধু ধ্বংস গহবর।
এ অর্থে কুরআনের অন্যত্র এসেছে, “যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে। অতএব যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারা জান্নাতে থাকবে; এবং যারা কুফরী করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও আখিরাতের সাক্ষাত অস্বীকার করেছে, তারাই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।” [সূরা আর-রূম: ১৪–১৬]
আরও বলা হয়েছে, “আপনি সরল দ্বীনে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করুন, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দিন অনিবার্য তা উপস্থিত হওয়ার আগে, সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে। যে কুফরী করে কুফরীর শাস্তি তারই প্রাপ্য; যারা সৎকাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখশয্যা।” [সূরা আর-রূম: ৪৩–৪৪] আরও এসেছে, “আর হে অপরাধীরা! তোমরা আজ পৃথক হয়ে যাও” [সূরা ইয়াসীন: ৫৯] অন্য সূরায় এসেছে, “এবং যেদিন আমি ওদের সবাইকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান কর; আমি ওদেরকে পরস্পরের থেকে পৃথক করে দিলাম এবং ওরা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ইবাদাত করতে না।
আল্লাহ্ই আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট যে, তোমরা আমাদের ইবাদাত করতে এ বিষয়ে আমরা গাফিল ছিলাম। সেখানে তাদের প্রত্যেকে তার পূর্ব কৃতকর্ম পরীক্ষা করে নেবে এবং ওদেরকে ওদের প্রকৃত অভিভাবক আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনা হবে এবং ওদের উদ্ভাবিত মিথ্যা ওদের কাছ থেকে অন্তৰ্হিত হবে।” [সূরা ইউনুস: ২৮–৩০]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫২) আর (স্মরণ কর,) যেদিন তিনি বলবেন, ‘তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে আহবান কর!’ তারা তখন তাদেরকে আহবান করবে; কিন্তু তারা তাদের আহবানে সাড়া দেবে না এবং আমি তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দেব এক ধ্বংস-গহ্বর। [1]
[1] مَوْبِقٌ এর একটি অর্থ হল, পর্দা ও আড়। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে পর্দা ও ব্যবধান করে দেওয়া হবে। কেননা, তাদের মধ্যে আপোসে শত্রুতা হবে। অনুরূপ ব্যবধান এ জন্যও হবে যে, হাশর প্রান্তে পরস্পর সাক্ষাৎ করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেছেন, এটা (موبق) হল জাহান্নামের রক্ত ও পুঁজবিশিষ্ট একটি বিশেষ উপত্যকা। আবার কেউ কেউ এর তরজমা করেছেন, ধ্বংস-গহ্বর; যা তরজমাতে এখতিয়ার করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই মুশরিক এবং তাদের মনগড়া উপাস্যরা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না। কারণ, তাদের মাঝে সর্বনাশী সামগ্রী এবং অনেক ভয়াবহ জিনিস থাকবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৩
وَ رَاَ الۡمُجۡرِمُوۡنَ النَّارَ فَظَنُّوۡۤا اَنَّهُمۡ مُّوَاقِعُوۡهَا وَ لَمۡ یَجِدُوۡا عَنۡهَا مَصۡرِفًا ﴿۵۳﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৩. আর অপরাধীরা আগুন দেখে বুঝবে যে, তারা সেখানে পতিত হচ্ছে এবং তারা সেখান থেকে কোন পরিত্রাণস্থল পাবে না।(১)
(১) হাশরের দিন জাহান্নাম দেখার পর তারা স্পষ্ট বুঝতে ও বিশ্বাস করবে যে, তারা জাহান্নামে পতিত হচ্ছেই। তাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “হায়, আপনি যদি দেখতেন! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শুনলাম, এখন আপনি আমাদেরকে আবার পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎকাজ করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” [সূরা আস-সাজদাহ: ১২] আরও এসেছেঃ “তুমি এ দিন সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন আমি তোমার সামনে থেকে পর্দা উন্মোচন করেছি। আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর।” [সূরা ক্বাফ: ২২]
অনুরূপ এসেছে: “তারা যেদিন আমার কাছে আসবে সেদিন তারা কত স্পষ্ট শুনবে ও দেখবে! কিন্তু যালিমরা আজ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।” [সূরা মারইয়াম: ৩৮] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিনের সময় কাফেরের জন্য পঞ্চাশ হাজার বছর নির্ধারণ করা হবে। আর কাফের চল্লিশ বছরের রাস্তা থেকে জাহান্নাম দেখে নিশ্চিত হয়ে যাবে সে তাতে পতিত হচ্ছে।” [মুসনাদে আহমাদ: ৩/৭৫]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৩) অপরাধীরা জাহান্নাম দেখে বুঝবে যে, তারা সেখানে পতিত হবে এবং তারা ওটা হতে কোন পরিত্রাণ স্থল পাবে না। [1]
[1] যেমন, হাদীসে আছে যে, কাফের এমন স্থান থেকেই নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তার ঠিকানা হল জাহান্নাম, যার দূরত্ব হল চল্লিশ বছরের পথ। (আহমাদ ৩/৭৫)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৪
وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِیۡ هٰذَا الۡقُرۡاٰنِ لِلنَّاسِ مِنۡ كُلِّ مَثَلٍ ؕ وَ كَانَ الۡاِنۡسَانُ اَكۡثَرَ شَیۡءٍ جَدَلًا ﴿۵۴﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৪. আর অবশ্যই আমরা মানুষের জন্য এ কুরআনে সব ধরনের উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।(১) আর মানুষ সবচেয়ে বেশী বিতর্কপ্ৰিয়।(২)
(১) অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, আমরা কুরআনে প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট ও বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। কোন ফাঁক রাখিনি। যাতে তারা সৎপথ থেকে হারিয়ে না যায়; হেদায়াতের পথ থেকে বের না হয়ে যায়। [ইবন কাসীর] এত সুন্দরভাবে বর্ণনা করার পরও এখন সত্যকে মেনে নেবার পথে তাদের জন্য কি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? শুধুমাত্র এটিই যে তারা আযাবের অপেক্ষা করছে।
(২) সমগ্র সৃষ্টজীবের মধ্যে মানুষ সর্বাধিক তর্কপ্রিয়। এর সমর্থনে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “কেয়ামতের দিন কাফেরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে পেশ করা হবে। তাকে প্রশ্ন করা হবেঃ আমার প্রেরিত রাসূল সম্পর্কে তোমার কর্মপন্থা কেমন ছিল? সে বলবেঃ হে আমার রব! আমি তো আপনার প্রতি, আপনার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম এবং তাদের আনুগত্য করেছিলাম। আল্লাহ্ তাআলা বলবেনঃ তোমার আমলনামা সামনে রাখা রয়েছে। এতে তো এমন কিছু নেই। লোকটি বলবেঃ আমি এই আমলনামা মানি না। আমি এ আমলনামার লেখকদেরকে চিনি না এবং আমল করার সময় তাদেরকে দেখিনি।
আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ সামনে লওহে-মাহফুয রয়েছে। এতেও তোমার অবস্থা এরূপই লিখিত রয়েছে। সে বলবেঃ হে আমার রব! আপনি আমাকে যুলুম থেকে আশ্রয় দিয়েছেন কি না? আল্লাহ বলবেনঃ নিশ্চয় যুলুম থেকে তুমি আমার আশ্রয়ে রয়েছ। সে বলবেঃ হে আমার রব! যেসব সাক্ষ্য আমি দেখিনি সেগুলো কিরূপে আমি মানতে পারি? আমার নিজের পক্ষ হতে যে সাক্ষ্য হবে, আমি তাই মানতে পারি। তখন তার মুখ সীল করে দেয়া হবে এবং তার হাত-পা তার কুফর এবং শির্ক সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ [দেখুন মুসলিমঃ ৫২৭১]
অন্য এক হাদীসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আলী ও ফাতেমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তাদেরকে তিনি বললেনঃ তোমরা রাতে সালাত আদায় কর না? তারা বললেনঃ আমরা ঘুমোলে আল্লাহ আমাদের প্রাণ হরণ করে তার হাতে নিয়ে নেন। সুতরাং আমরা কিভাবে সালাত আদায় করব? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে গেলেন, তারপর তাকে শুনলাম তিনি ফেরা অবস্থায় নিজের রানে আঘাত করছেন আর বলছেন, মানুষ ভীষণ ঝগড়াটে।” [বুখারীঃ ১১২৭, ৪৭২৪, মুসলিমঃ ৭৭৫] এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার পক্ষ থেকে এ ধরনের বিতণ্ডা অপছন্দ করলেন। কারণ, এটা বাতিল তর্ক। মহান আল্লাহর আনুগত্য না করার জন্য তাকদীরের দোহাই দেয়া জায়েয নেই।
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৪) আমি অবশ্যই মানুষের জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, কিন্তু মানুষ সর্বাধিক বিতর্ক-প্রিয়। [1]
[1] অর্থাৎ, মানুষদেরকে সত্য পথ বুঝানোর জন্য কুরআনে আমি সব রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। ওয়ায-নসীহত করেছি। দৃষ্টান্ত, ঘটনাবলী এবং দলীলাদি পেশ করেছি। আর এগুলো বারংবার বিভিন্ন আকারে বর্ণনা করেছি। কিন্তু যেহেতু মানুষ কঠিন বিতর্ক-প্রিয়, তাই না ওয়ায-নসীহতের তার উপর কোন প্রভাব পড়ে, আর না দলীল-প্রমাণ তার জন্য ফলপ্রসূ হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৫
وَ مَا مَنَعَ النَّاسَ اَنۡ یُّؤۡمِنُوۡۤا اِذۡ جَآءَهُمُ الۡهُدٰی وَ یَسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّهُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ تَاۡتِیَهُمۡ سُنَّۃُ الۡاَوَّلِیۡنَ اَوۡ یَاۡتِیَهُمُ الۡعَذَابُ قُبُلًا ﴿۵۵﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৫. আর যখন তাদের কাছে পথনির্দেশ আসে তখন মানুষকে ঈমান আনা ও তাদের রব-এর কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত রাখে শুধু এ যে, তাদের কাছে পূৰ্ববতীদের বেলায় অনুসৃত রীতি আসুক অথবা আসুক তাদের কাছে সরাসরি আযাব।(১)
(১) আয়াতে ব্যবহৃত قُبُلًا শব্দের অর্থ, সামনা সামনি বা চাক্ষুষ। [ইবন কাসীর] কাফেররা সবসময় নিজের চোখে আযাব দেখতে চাইত। কুরআনের অন্যত্র এসেছে, “তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে আকাশের এক খণ্ড আমাদের উপর ফেলে দাও।” [সূরা আশ-শু'আরা: ১৮৭] অনুরূপ বলা হয়েছে, “উত্তরে তাঁর সম্প্রদায় শুধু এটাই বলল, আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন কর—তুমি যদি সত্যবাদী হও।” [সূরা আল আনকাবূত: ২৯] “স্মরণ করুন, তারা বলেছিল, “হে আল্লাহ! এগুলো যদি আপনার কাছ থেকে সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করুন কিংবা আমাদেরকে মর্মম্ভদ শাস্তি দিন৷” [সূরা আল-আনফাল: ৩২] “তারা বলে, ওহে যার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে! তুমি তো নিশ্চয় উন্মাদ। ‘তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের কাছে ফিরিশতাদেরকে উপস্থিত করছ না কেন?” [সূরা আল-হিজর: ৬, ৭]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৫) যখন মানুষের কাছে পথ-নির্দেশ আসে, তখন এই প্রতীক্ষাই তাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন হতে ও তাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা হতে বিরত রাখে যে, তাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা তাদের নিকট উপস্থিত হবে[1] অথবা উপস্থিত হবে (সরাসরি) বিবিধ শাস্তি। [2]
[1] অর্থাৎ, মিথ্যা ভাবার কারণে এদের উপরও ঐরূপ আযাব আসবে, যেমন পূর্বের লোকদের উপর এসেছে।
[2] অর্থাৎ, মক্কাবাসী ঈমান আনার জন্য এই দু’টি জিনিসের মধ্যে কোন একটির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু জ্ঞান-অন্ধদের জানা নেই যে, এর পর ঈমানের কোনই মূল্য নেই অথবা এর পর ঈমান আনার কোন সুযোগই নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৬
وَ مَا نُرۡسِلُ الۡمُرۡسَلِیۡنَ اِلَّا مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۚ وَ یُجَادِلُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا بِالۡبَاطِلِ لِیُدۡحِضُوۡا بِهِ الۡحَقَّ وَ اتَّخَذُوۡۤا اٰیٰتِیۡ وَ مَاۤ اُنۡذِرُوۡا هُزُوًا ﴿۵۶﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৬. আর আমরা শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই রাসূলদেরকে পাঠিয়ে থাকি, কিন্তু কাফেররা বাতিল দ্বারা তর্ক করে, যাতে তার মাধ্যমে সত্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে সেসবকে বিদ্ররূপের বিষয়রূপে গ্ৰহণ করে থাকে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৬) আমি শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই রসূলদেরকে পাঠিয়ে থাকি, কিন্তু সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা মিথ্যা অবলম্বনে বিতন্ডা করে; যাতে তার দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়। আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যার দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, সে সবকে বিদ্রূপের বিষয়রূপে গ্রহণ করে থাকে। [1]
[1] আল্লাহর আয়াতের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হল, তা মিথ্যাজ্ঞান করার অতীব নিকৃষ্টতম প্রকার। অনুরূপ মিথ্যা ও বাতিল দ্বারা বিতর্ক (অর্থাৎ, বাতিল তরীকা অবলম্বন) করে সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা করাও অতি ঘৃণিত আচরণ। আর এই বাতিল পন্থায় বিতর্ক করার একটি প্রকার হল, কাফেরদের এই বলে রসূলদের রিসালাতকে অস্বীকার করে দেওয়া যে, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। مَا أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا (يـس: ১৫) অতএব আমরা তোমাদেরকে রসূল কিভাবে মেনে নিতে পারি? دَحَضَ এর প্রকৃত অর্থ হল, স্খলন ঘটা, পিছল কাটা। যেমন বলা হয়, دَحَضَتْ رِجْلُهُ (তার পদস্খলন ঘটেছে)। এখান থেকেই এ শব্দটি কোন জিনিস থেকে সরে যাওয়ার এবং ব্যর্থ হওয়ার অর্থে ব্যবহার হতে লেগেছে। বলা হয় যে, دَحَضَتْ حُجَّتُهُ دُحُوْضًا أي بَطَلَتْ (তার হুজ্জত বাতিল গণ্য হয়েছে।) এই দিক দিয়ে أدْحَضَ يُدْحِضُ এর অর্থ হবে, বাতিল বা ব্যর্থ করা। (ফাতহুল কাদীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৭
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُكِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّهٖ فَاَعۡرَضَ عَنۡهَا وَ نَسِیَ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰهُ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ اَكِنَّۃً اَنۡ یَّفۡقَهُوۡهُ وَ فِیۡۤ اٰذَانِهِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِنۡ تَدۡعُهُمۡ اِلَی الۡهُدٰی فَلَنۡ یَّهۡتَدُوۡۤا اِذًا اَبَدًا ﴿۵۷﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৭. আর তার চেয়ে অধিক যালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তা থেকে বিমুখ হয়েছে(১) এবং সে ভুলে গেছে যা তার দু-হাত পেশ করেছে? নিশ্চয় আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা এঁটে দিয়েছি।(২) আর আপনি তাদেরকে সৎপথে ডাকলেও তারা কখনো সৎপথে আসবে না।
(১) এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা, দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন থাকা, দ্বীন শিক্ষা করতে ও করাতে আগ্রহী না হওয়া কুফারী। এসবগুলোই বড় কুফরীর অংশ। [দেখুন, নাওয়াকিদুল ইসলাম]
(২) অর্থাৎ তাদের গোনাহ ও অবাধ্যতার কারণে শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরের উপর আল্লাহ আবরণ দিয়েছেন। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যেমন সূরা আল বাকারাহ: ৭, সূরা আল-ইসরা: ৪৫–৪৭, সূরা মুহাম্মাদ: ২৩, সূরা হূদ: ২০।
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৭) কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে যদি তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়, তবে তার অপেক্ষা অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি; যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করেছি। তুমি তাদেরকে সৎপথে আহবান করলেও তারা কখনো সৎপথ পাবে না। [1]
[1] অর্থাৎ, প্রতিপালকের আয়াতসমূহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মত মহা অন্যায় করার এবং নিজেদের কার্যকলাপ ভুলে থাকার কারণে তাদের অন্তঃকরণের উপর পর্দা রেখে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বধিরতার বোঝা। যার ফলে কুরআন বুঝা, শোনা এবং তা থেকে হিদায়াত গ্রহণ করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। তাদেরকে যতই তুমি হিদায়াতের প্রতি আহবান কর, তারা কখনই হিদায়াতের পথ অবলম্বন করতে প্রস্তুত হবে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৮
وَ رَبُّكَ الۡغَفُوۡرُ ذُو الرَّحۡمَۃِ ؕ لَوۡ یُؤَاخِذُهُمۡ بِمَا كَسَبُوۡا لَعَجَّلَ لَهُمُ الۡعَذَابَ ؕ بَلۡ لَّهُمۡ مَّوۡعِدٌ لَّنۡ یَّجِدُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖ مَوۡئِلًا ﴿۵۸﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৮. আর আপনার রব পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান(১)৷ তাদের কৃতকর্মের জন্য যদি তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতেন, তবে তিনি অবশ্যই তাদের শাস্তি তরান্বিত করতেন; কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুত মুহুর্ত, যা থেকে তারা কখনই কোন আশ্রয়স্থল পাবে না।(২)
(১) এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর দুটি গুণ ব্যবহার করেছেন। এক. তিনি ক্ষমাশীল। দুই. তিনি রহমতের মালিক। যে রহমত সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। সুতরাং তিনি তাদেরকে তাদের অন্যায়ের কারণে দ্রুত শাস্তি দিচ্ছেন না। [ফাতহুল কাদীর]
(২) অর্থাৎ কেউ কোন দোষ করলে সংগে সংগেই তাকে পাকড়াও করে শাস্তি দিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূ-পৃষ্ঠে কোন জীব-জিন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে গেলে আল্লাহ তো আছেন তাঁর বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা ফাতের: ৪৫]
আরও বলেনঃ “মংগলের আগেই ওরা আপনাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, যদিও ওদের আগে এর বহু দৃষ্টান্ত গত হয়েছে। মানুষের সীমালংঘন সত্বেও আপনার রব তো মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং আপনার প্রতিপালক শাস্তি দানে তো কঠোর।” [সূরা রা'দ: ৬] তিনি সহিষ্ণুতা অবলম্বন করেন, গোপন রাখেন, ক্ষমা করেন, কখনও তাদের কাউকে হেদায়াতের পথেও পরিচালিত করেন। তারপরও যদি কেউ অপরাধের পথে থাকে তাহলে তার জন্য তো এমন এক দিন রয়েছে যে দিন নবজাতক বৃদ্ধ হয়ে যাবে, গর্ভধারিনী তার গর্ভ রেখে দিবে। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৮) তোমার প্রতিপালক পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান। তাদের কৃতকর্মের জন্য তিনি তাদেরকে পাকড়াও করলে তিনি তাদের শাস্তি ত্বরান্বিত করতেন; কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুত মুহূর্ত; যা হতে তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই। [1]
[1] অর্থাৎ এটা তো ক্ষমাশীল রবের দয়া যে, তিনি পাপের দরুন সত্ত্বর পাকড়াও করেন না, বরং অবকাশ দেন। যদি এ রকম না হত, তবে (বদ)আমলের কারণে প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর আযাবের শিকলে আবদ্ধ থাকত। হ্যাঁ, এ কথা বাস্তব যে, যখন অবকাশ শেষ হয়ে যায় এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ধ্বংসের সময় এসে যায়, তখন আর পলায়ন করার কোন পথ এবং নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় তাদের জন্য থাকে না। مَوْئِلٌ এর অর্থ, আশ্রয়স্থল, পলায়ন পথ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৫৯
وَ تِلۡكَ الۡقُرٰۤی اَهۡلَكۡنٰهُمۡ لَمَّا ظَلَمُوۡا وَ جَعَلۡنَا لِمَهۡلِكِهِمۡ مَّوۡعِدًا ﴿۵۹﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫৯. আর ঐসব জনপদ–তাদের অধিবাসীদেরকে আমরা ধ্বংস করেছিলাম(১), যখন তারা যুলুম করেছে এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমরা স্থির করেছিলাম নির্দিষ্ট সময়।(২)
(১) এখানে আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতির বিরাণ এলাকাগুলোর প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]
(২) অনুরূপভাবে তোমরাও নবীর বিরোধিতা করে সে ধরনের শাস্তির সম্মুখিন হতে চলেছ। তাদেরকে যেভাবে শাস্তি পেয়ে বসেছে সেভাবে তোমাদেরকেও পাকড়া করতে পারে। কেননা তোমরা সবচেয়ে মহান নবী ও সর্বোত্তম রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করছি। তোমরা আমার কাছে তাদের থেকে বেশী ক্ষমতাধর নও। সুতরাং তোমরা আমার আযাব ও ধমকিকে ভয় কর। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৯) ঐসব জনপদ; তাদের অধিবাসীবৃন্দকে আমি ধ্বংস করেছিলাম, যখন তারা সীমালংঘন করেছিল এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমি স্থির করেছিলাম এক নির্দিষ্ট ক্ষণ। [1]
[1] এ থেকে আ’দ, সামুদ এবং শুআইব ও লূত عليهما السلام প্রভৃতিদের সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে। যারা হিজাযবাসীদের সন্নিকটে এবং তাদের পথের ধারে আবাদ ছিল। তাদেরকেও তাদের যুলুমের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে ধ্বংস সাধনের পূর্বে তাদেরকে পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যখন এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাদের যুলুম ও অবাধ্যতা এমন সীমায় পৌঁছে গেছে, যে সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর হিদায়াতের সমস্ত পথ একেবারে বন্ধ এবং তাদের নিকট থেকে আর কোন কল্যাণের আশা অবর্তমান, তখন তাদের আমলের অবকাশ শেষ হয়ে গেল এবং ধ্বংস আরম্ভ হয়ে গেল। অতঃপর তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। আর এটাকে বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ গ্রহণের নমুনা বানিয়ে দিলেন। আসলে মক্কাবাসীদেরকে বুঝানো হচ্ছে যে, তোমরা আমার সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মিথ্যাবাদী মনে করছ, তা সত্ত্বেও তোমাদেরকে অবকাশ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করো না যে, তোমাদেরকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করার নেই, বরং এই অবকাশ ও ঢিল দেওয়া হল আল্লাহর একটি দস্তর। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তি, দল এবং জাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। যখন সে সময় শেষ হয়ে যাবে এবং তোমরা কুফরী ও অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসবে না, তখন তোমাদের অবস্থাও তাদের থেকে ভিন্ন হবে না, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৮ : ৬০
وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِفَتٰىهُ لَاۤ اَبۡرَحُ حَتّٰۤی اَبۡلُغَ مَجۡمَعَ الۡبَحۡرَیۡنِ اَوۡ اَمۡضِیَ حُقُبًا ﴿۶۰﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬০. আর স্মরণ করুন, যখন মূসা তার সঙ্গী যুবককে(১) বলেছিলেন, দুঃসাগরের মিলনস্থলে না পৌছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব।(২)
(১) এ ঘটনায় মূসা’ নামে প্রসিদ্ধ নবী মূসা ইবনে ইমরান আলাইহিস সালাম-কে বোঝানো হয়েছে। فتى এর শাব্দিক অর্থ যুবক। শব্দটিকে কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সম্বন্ধ করা হলে অর্থ হয় খাদেম। [ফাতহুল কাদীর] বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, এই খাদেম ছিল ইউশা ইবনে নূন। [ইবন কাসীর] (مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ) এর শাব্দিক অর্থ দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল। বলাবাহুল্য, এ ধরনের স্থান দুনিয়াতে অসংখ্য আছে। এখানে কোন জায়গা বোঝানো হয়েছে, কুরআন ও হাদীসে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তাই ইঙ্গিত ও লক্ষণাদী দৃষ্টি তাফসীরবিদদের উক্তি বিভিন্নরূপ। [ফাতহুল কাদীর]
(২) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ একদিন মূসা 'আলাইহিস সালাম বনী-ইসরাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলঃ সব মানুষের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? মূসা আলাইহিস সালাম-এর জানামতে তার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তাই বললেনঃ আমিই সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী। আল্লাহ তা'আলা তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। তাই এ জবাব তিনি পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ একথা বলে দেয়া উচিত ছিল যে, আল্লাহ তা'আলাই ভাল জানেন, কে অধিক জ্ঞানী। এ জবাবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে মূসা আলাইহিস সালাম-কে তিরস্কার করে ওহী নাযিল হল যে, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চাইতে অধিক জ্ঞানী। একথা শুনে মূসা ‘আলাইহিস সালাম প্রার্থনা জানালেন যে, তিনি অধিক জ্ঞানী হলে তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভের জন্য আমার সফর করা উচিত।
তাই বললেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাত পাবেন। মূসা 'আলাইহিস সালাম নির্দেশমত থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সাথে তার খাদেম ইউশা ইবনে নূনও ছিল। পথিমধ্যে একটি প্রস্তর খণ্ডের উপর মাথা রেখে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। (মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রে যাওয়ার সাথে সাথে আরো একটি মু'জিযা প্রকাশ পেল যে,) মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তা’আলা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। ইউশা' ইবনে নূন এই আশ্চর্যজনক ঘটনা নিরীক্ষণ করছিল।
মূসা আলাইহিস সালাম নিদ্রিত ছিলেন। যখন জাগ্রত হলেন, তখন ইউশা ইবনে নুন মাছের এই আশ্চর্যজনক ঘটনা তার কাছে বলতে ভুলে গেলেন এবং সেখান থেকে সামনে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফর করার পর সকাল বেলায় মূসা 'আলাইহিস সালাম খাদেমকে বললেনঃ আমাদের নাশ্তা আন। এই সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাশতা চাওয়ার পর ইউশা ইবনে নুনের মাছের ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে ভুলে যাওয়ার ওযর পেশ করে বললঃ শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর বললঃ মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মূসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল। (অৰ্থাৎ মাছের জীবিত হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার স্থানটিই ছিল গন্তব্যস্থল।) সে মতে তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন।
প্রস্তরখণ্ডের নিকট পৌছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছে। মূসা আলাইহিস সালাম তদাবস্থায় সালাম করলে খাদির ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ এই (জনমানবহীন) প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে এল? মূসা ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ আমি মূসা। খাদির ‘আলাইহিস সালাম প্রশ্ন করলেনঃ বনী-ইসরাঈলের মূসা? তিনি জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ, আমিই বনী-ইসরাঈলের মূসা। আমি আপনার কাছ থেকে ঐ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তা'আলা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। খাদির বললেনঃ যদি আপনি আমার সাথে থাকতে চান, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার স্বরূপ বলে দেই।
একথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এসে গেলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খাদিরকে চিনে ফেলল এবং কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে নৌকায় তুলে নিল। নৌকায় চড়েই খাদির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে মূসা আলাইহিস সালাম (স্থির থাকতে না পেরে) বললেনঃ তারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙ্গে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? এতে আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মূসা আলাইহিস সালাম ওযর পেশ করে বললেনঃ আমি ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মূসা 'আলাইহিস সালাম-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। (ইতিমধ্যে) একটি পাখি উড়ে এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চ পানি তুলে নিল। খাদির ‘আলাইহিস সালাম মূসা ‘আলাইহিস সালাম-কে বললেনঃ আমার জ্ঞান এবং আপনার জ্ঞান উভয়ের মিলে আল্লাহ তা’আলার জ্ঞানের মোকাবিলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির চঞ্চর পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানি।
অতঃপর তারা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খাদির একটি বালককে অন্যান্য বালকের সাথে খেলা করতে দেখলেন। খাদির স্বহস্তে বালকটির মস্তক তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মারা গেল। মূসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এ যে বিরাট গোনাহর কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মূসা 'আলাইহিস সালাম দেখলেন, এ ব্যাপারটি পূর্বের চাইতেও গুরুতর। তাই বললেনঃ এরপর যদি কোন প্রশ্ন করি তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওযর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
অতঃপর আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। ওরা সোজা অস্বীকার করে দিল। খাদির এই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মূসা আলাইহিস সালাম বিস্মিত হয়ে বললেনঃ আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করলো। অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খাদির বললেনঃ (هَٰذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ) অর্থাৎ এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।
এরপর খাদির উপরোক্ত ঘটনাত্ৰয়ের স্বরূপ মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে বর্ণনা করে বললেনঃ (ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا) অর্থাৎ এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ; যেগুলো আপনি দেখে ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মূসা আলাইহিস সালাম যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত ৷ [বুখারীঃ ১২২, মুসলিমঃ ২৩৮০] এই দীর্ঘ হাদীসে পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে যে, মূসা বলতে বনী-ইসরাঈলের নবী মূসা 'আলাইহিস সালাম ও তার যুবক সঙ্গীর নাম ইউশা ইবন নুন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে যে বান্দার কাছে মূসা আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন খাদির ‘আলাইহিস সালাম। [ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬০) (স্মরণ কর,) যখন মূসা তার সঙ্গীকে[1] বলেছিল, ‘দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে[2] না পৌঁছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব।’ [3]
[1] এই যুবক ছিল ইউশা’ বিন নূন (আঃ) যিনি মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন।
[2] কোন নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ স্থানকে নির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে অনুমান ও লক্ষণাদির দাবী অনুযায়ী এটা হল সিনাই মরুভূমির দক্ষিণ মাথায়, যেখানে উকবাহ উপসাগর ও সুইজ উপসাগর এক সাথে একত্রিত হয়ে লোহিত সাগরে মিশে গেছে। অন্যান্য যেসব স্থানের কথা মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেছেন তাতে مجمع البحرين (দুই সাগরের মিলনস্থল) এর যে ব্যাখ্যা হয়, তার সাথে মোটেই খাপ খায় না।
[3] حُقُبٌ এর একটি অর্থ, ৭০ অথবা ৮০ বছর। দ্বিতীয় অর্থ, অনির্দিষ্ট সময়-কাল। এই দ্বিতীয় অর্থই এখানে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যতক্ষণ না আমি مجمع البحرين (দুই সাগরের মিলনস্থল) পর্যন্ত পৌঁছব, ততক্ষণ পর্যন্ত চলতেই থাকব এবং সফর অব্যাহত রাখব। তাতে যতদিন লাগে লাগবে। মূসা (আঃ)-এর এই সফরের প্রয়োজন এই জন্য দেখা দিয়েছিল যে, তিনি একজন প্রশ্নকারীর উত্তরে বলেছিলেন, বর্তমানে আমার থেকে বড় জ্ঞানী আর কেউ নেই। তাঁর এই (গর্ব) কথা মহান আল্লাহর পছন্দ হল না। সুতরাং অহীর মাধ্যমে তাঁকে অবগত করলেন যে, আমার এক বান্দা (খায্বির) তোমার থেকেও বড় জ্ঞানী। মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহ! তাঁর সাথে সাক্ষাৎ কিভাবে হতে পারে? মহান আল্লাহ বললেন, যেখানে উভয় সাগর এক সাথে মিশে গেছে, সেখানেই আমার সেই বান্দা থাকবে। অনুরূপ এ কথাও বললেন যে, সাথে করে একটি মাছ নিও। যখন এ মাছ তোমার থলি থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে, তখন বুঝে নিও যে, এটাই তোমার গন্তব্যস্থল। (বুখারী, সূরা কাহ্ফ) এই নির্দেশ অনুযায়ী তিনি একটি মাছ নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে দিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান