সূরাঃ ৯/ আত-তাওবা | At-Tawba | سورة التوبة আয়াতঃ ১২৯ মাদানী
৯ : ৩১ اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِكُوۡنَ ﴿۳۱﴾
اتخذوا احبارهم و رهبانهم اربابا من دون الله و المسیح ابن مریم و ما امروا الا لیعبدوا الـها واحدا لا اله الا هو سبحنهٗ عما یشركون ﴿۳۱﴾
• তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের* রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।

-আল-বায়ান

• আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের ‘আলিম আর দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে; আর মারইয়াম-পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহ ব্যতীত (অন্যের) ‘ইবাদাত করার আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, পবিত্রতা আর মহিমা তাঁরই, (বহু ঊর্ধ্বে তিনি) তারা যাদেরকে (তাঁর) অংশীদার গণ্য করে তাত্থেকে।

-তাইসিরুল

• তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পন্ডিত ও ধর্ম যাজকদেরকে রাব্ব বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মা‘বূদের ইবাদাত করবে যিনি ব্যতীত ইলাহ হওয়ার যোগ্য কেহই নয়। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র।

-মুজিবুর রহমান

• They have taken their scholars and monks as lords besides Allah, and [also] the Messiah, the son of Mary. And they were not commanded except to worship one God; there is no deity except Him. Exalted is He above whatever they associate with Him.

-Sahih International

* এ স্থলে أحبار দ্বারা ইয়াহূদীদের ধর্মপন্ডিত আর رهبان দ্বারা নাসারাদের ধর্মপন্ডিতদেরকে বুঝানো হয়েছে।

৩১. তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগিদের(১)কে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে(২) এবং মারইয়াম-পুত্র মসীহকেও। অথচ এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্ৰ।(৩)!

(১) أحبار শব্দটি حبر এর বহুবচন। ইয়াহুদীদের আলেমকে حبر বলা হয়। পক্ষান্তরে رهبان শব্দটি راهب এর বহুবচন। নাসারাদের আলেমকে راهب বলা হয়। তারা বেশীরভাগই সংসার বিরাগী হয়ে থাকে। [ফাতহুল কাদীর]

(২) এ আয়াতে বলা হয় যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ তাদের আলেম ও যাজক শ্রেণীকে আল্লাহর পরিবর্তে রব ও মাবুদ সাব্যস্ত করে রেখেছে। অনুরূপ ঈসা আলাইহিস সালামকেও মা’বুদ মনে করে। তাকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করায় তাকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার দোষে যে দোষী করা হয়, তার কারণ হল, তারা পরিষ্কার ভাষায় ওদের মা’বুদ না বললেও পূর্ণ আনুগত্যের যে হক বান্দার প্রতি আল্লাহর রয়েছে, তাকে তারা যাজক শ্রেণীর জন্যে উৎসর্গ রাখে। অর্থাৎ তারা যাজক শ্রেণীর আনুগত্য করে চলে; যতই তা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী হোক না কেন? বলাবাহুল্য পাদ্রী ও পুরোহিতগণের আল্লাহ বিরোধী উক্তি ও আমলের আনুগত্য করা তাদেরকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার নামান্তর, আর এটি হল প্রকাশ্য কুফরী ও শির্ক।

আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি গলায় একটি সোনার ক্রুশ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম। তখন তিনি বললেনঃ হে আদী, তোমার গলা থেকে এ মূর্তিটি সরিয়ে ফেল এবং তাকে সূরা আত-তাওবাহর এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে শুনলাম- “তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে।” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো তাদের ইবাদত করি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তারা তোমাদের জন্য কোন কিছু হালাল করলে তোমরা সেটাকে হালাল মনে কর আর কোন কিছুকে হারাম করলে তোমরা সেটাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। [তিরমিযীঃ ৩০৯৫]

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শরীআতের মাসায়েল সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণের পক্ষে ওলামায়ে কেরামের নির্দেশনার অনুসরণ বা ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে মুজতাহিদ ইমামগণের মতামতের অনুসরণর ততক্ষণই করতে পারবে যতক্ষণ না এর বিপরীতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে কোন কিছু প্রমাণিত হবে। যখনই কোন কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মতের বিপক্ষে হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে তখনি তা ত্যাগ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ইয়াহুদী নাসারাদের মত হয়ে যাবে। কারণ ইয়াহুদী-নাসারাগণ আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর রাসূলের আদেশ নিষেধকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করে স্বার্থপর আলেম এবং অজ্ঞ পুরোহিতদের কথা ও কর্মকে নিজেদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আয়াতে তারই নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

(৩) অর্থাৎ অথচ তাদেরকে তো শুধু এ নির্দেশই দেয়া হচ্ছিল যে, তারা এক ইলাহেরই ইবাদত করবে, যিনি কোন কিছু হারাম করলেই কেবল তা হারাম হবে, আর যিনি হালাল করলেই তা হালাল হবে। অনুরূপভাবে যিনি শরীআত প্রবর্তন করলে সেটাই মানা হবে, তিনি হুকুম দিলে সেটা বাস্তবায়িত হবে। তিনি ব্যতীত আর কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যা তাঁর সাথে শরীক করছে তা থেকে তিনি কতই না পবিত্র। তাঁর সন্ততি নেই, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] কিন্তু তারা সে নির্দেশের বিপরীত কাজ করেছে। তার সাথে শরীক করেছে। মহান আল্লাহ তাদের সে সমস্ত অপবাদ ও শরীক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার পূর্ণতার বিপরীত তার জন্য যে সমস্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ গুণ সাব্যস্ত করে তা গ্রহণযোগ্য নয়। [সা'দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩১) তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পন্ডিত-পুরোহিতদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে[1] এবং মারয়্যামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদেরকে শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র একক উপাস্যের উপাসনা করবে, তিনি ব্যতীত (সত্য) উপাস্য আর কেউই নেই, তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র।

[1] এর ব্যাখ্যা আদী বিন হাতেম (রাঃ)-এর বর্ণনাকৃত হাদীস হতে পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি নবী (সাঃ)-এর মুখে এই আয়াত শুনে আরজ করলাম যে, ইয়াহুদী-নাসারারা তো নিজেদের আলেমদের কখনো ইবাদত করেনি, তাহলে এটা কেন বলা হয়েছে যে, তারা তাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে? তিনি বললেন, এ কথা ঠিক যে, তারা তাদের ইবাদত করেনি। কিন্তু এটা তো সঠিক যে, তাদের আলেমরা যা হালাল করেছে তাকে তারা হালাল এবং যা হারাম করেছে তাকে তারা হারাম বলে মেনে নিয়েছে। আর এটাই হল তাদের ইবাদত করা। (সহীহ তিরমিযী আলবানী ২৪৭১নং) কেননা, হারাম-হালাল করার এখতিয়ার কেবলমাত্র আল্লাহর। এই এখতিয়ার ও অধিকারের কথাকে যদি কোন ব্যক্তি অন্যের আছে বলে বিশ্বাস করে নেয়, তাহলে এর মানে হবে, সে তাকে রব (প্রভু) মেনে নিয়েছে। এই আয়াতে সেই লোকদের জন্য বড় সতর্কতা রয়েছে, যারা নিজেদের ইমাম-বুযুর্গদেরকে হালাল-হারাম করার অধিকার দিয়ে রেখেছে এবং যাদের কাছে তাঁদের কথার তুলনায় কুরআন হাদীসের উক্তির কোন গুরুত্ব নেই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩২ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّطۡفِـُٔوۡا نُوۡرَ اللّٰهِ بِاَفۡوَاهِهِمۡ وَ یَاۡبَی اللّٰهُ اِلَّاۤ اَنۡ یُّتِمَّ نُوۡرَهٗ وَ لَوۡ كَرِهَ الۡكٰفِرُوۡنَ ﴿۳۲﴾
یریدون ان یطفـٔوا نور الله بافواههم و یابی الله الا ان یتم نورهٗ و لو كره الكفرون ﴿۳۲﴾
• তারা আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায় তাদের মুখের (ফুঁক) দ্বারা, কিন্তু আল্লাহ তো তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া অন্য কিছু চান না, যদিও কাফিররা অপছন্দ করে।

-আল-বায়ান

• তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তা হতে দিবেন না, তিনি তাঁর আলোকে পূর্ণ না করে ছাড়বেন না, যদিও কাফিরগণ তা অপছন্দ করে।

-তাইসিরুল

• তারা এরূপ চাচ্ছে যে, আল্লাহর নূরকে নিজেদের মুখের ফুৎকার দ্বারা নির্বাপিত করে দেয়, অথচ আল্লাহ স্বীয় নূরকে (দীন ইসলাম) পূর্ণত্বে পৌঁছানো ব্যতীত নিরস্ত হবেননা, যদিও কাফিরেরা অপ্রীতিকরই মনে করে।

-মুজিবুর রহমান

• They want to extinguish the light of Allah with their mouths, but Allah refuses except to perfect His light, although the disbelievers dislike it.

-Sahih International

৩২. তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া আর কিছু করতে অস্বীকার করছেন। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।(১)

(১) এ আয়াতে বলা হয় যে, তারা গোমরাহী করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না বরং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করারও ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। তারা দ্বীনের এ আলো, হিদায়াতের এ জ্যোতি, তাওহীদের এ আহবানকে শুধুমাত্র তাদের কথা, ঝগড়া ও মিথ্যাচার দিয়ে মিটিয়ে দিতে চায়। আয়াতে উপমা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, এরা মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ এটি তাদের জন্যে অসম্ভব, যেভাবে সূর্যের আলো বা চাঁদের আলোকে কেউ ফুৎকারে মিটিয়ে দিতে পারে না। বরং আল্লাহর অমোঘ ফয়সালা যে, তিনি নিজের নূর তথা দ্বীন ইসলামকে পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, তা কাফের ও মুশরিকদের যতই মর্মপীড়ার কারণ হোক না কেন? [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩২) তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়, অথচ আল্লাহ স্বীয় নূর (দ্বীন-ইসলাম)কে পূর্ণত্বে পৌঁছানো ব্যতীত নিরস্ত হবেন না, যদিও অবিশ্বাসীরা অপ্রীতিকর মনে করে। [1]

[1] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা রসূল (সাঃ)-কে যে সত্য দ্বীন এবং হিদায়াত দিয়ে প্রেরণ করেছেন, ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান ও মুশরিকরা চায় যে, বিতর্ক ও মিথ্যারোপের মাধ্যমে তা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আর তার উপমা হল এমন এক ব্যক্তির যে সূর্যের কিরণ অথবা চাঁদের জ্যোৎস্নাকে নিজের ফুৎকার দ্বারা নিভিয়ে ফেলতে চায়। সুতরাং এটা যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনি যে সত্য দ্বীন আল্লাহ তাআলা রসূল (সাঃ)-কে দিয়ে পাঠিয়েছেন তা দুনিয়া থেকে মুছে বা মিটিয়ে ফেলা অস‎ম্ভব। এ ধর্ম অন্যান্য সমস্ত ধর্মের উপর বিজয়ী থাকবে; যেমন পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা সে কথা উল্লেখ করেছেন। ‘কাফের’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল গোপনকারী। এই জন্য রাতকেও ‘কাফের’ বলা হয়; যেহেতু রাত নিজ অন্ধকার দ্বারা সমস্ত বস্তুকে গোপন করে নেয়। অনুরূপ কাফেররাও আল্লাহর ‘নূর’ (জ্যোতি)-কে গোপন করতে চায় অথবা নিজেদের হৃদয়ে কুফরী ও মুনাফিকববী এবং মুসলিম এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও শত্রুতা লুকিয়ে রাখে, এই জন্য তাদেরকেও ‘কাফের’ বলা হয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৩ هُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡهِرَهٗ عَلَی الدِّیۡنِ كُلِّهٖ ۙ وَ لَوۡ كَرِهَ الۡمُشۡرِكُوۡنَ ﴿۳۳﴾
هو الذی ارسل رسولهٗ بالهدی و دین الحق لیظهرهٗ علی الدین كلهٖ و لو كره المشركون ﴿۳۳﴾
• তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীন সহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দীনের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে।

-আল-বায়ান

• তিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত আর সঠিক দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যাবতীয় দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য যদিও মুশরিকগণ অপছন্দ করে।

-তাইসিরুল

• সেই আল্লাহ এমন যে, তিনি নিজ রাসূলকে হিদায়াত (কুরআন) এবং সত্য ধর্ম সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন ওকে সকল ধর্মের উপর প্রবল করে দেন, যদিও মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করে।

-মুজিবুর রহমান

• It is He who has sent His Messenger with guidance and the religion of truth to manifest it over all religion, although they who associate others with Allah dislike it.

-Sahih International

৩৩. তিনিই সে সত্তা যিনি তার রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ(১) পাঠিয়েছেন, যেন তিনি আর সব দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।(২)

(১) কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে হিদায়াত বলে সত্য সংবাদসমূহ, সহীহ ঈমান, উপকারী ইলম বোঝানো হয়েছে। আর দ্বীনে হক বলে দুনিয়া ও আখেরাতে কাজে আসবে এ রকম যাবতীয় বিশুদ্ধ আমল বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

(২) এ আয়াতের সারকথা এটাই যে, আল্লাহ আপন রাসূলকে হেদায়েতের উপকরণ কুরআন এবং সত্য দ্বীন ইসলাম সহকারে এজন্যে প্রেরণ করেছেন, যাতে অপরাপর দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় সূচিত হয়। এ মর্মে আরও কতিপয় আয়াত কুরআনে রয়েছে। যাতে সকল দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় দানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমার জন্য যমীনকে একত্রিত করে (সঙ্কোচন করে) এনে দেখিয়েছেন। তাতে আমি যমীনের পূর্ব ও পশ্চিম দেখতে পেয়েছি। আর নিশ্চয় আমার উম্মত ততটুকু করায়ত্ব করবে যতটুকু আমাকে জমা করে দেখানো হয়েছে। আর আমাকে লাল ও সাদা (স্বর্ণ ও রৌপ্য) দুটি খনি প্রদান করা হয়েছে। (সোনা ও রুপার মালিক রোম সম্রাট সিজার ও পারস্য সম্রাট খসরুর সম্পদ)।

আর আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি তিনি যেন আমার উম্মতকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষে শেষ না করে দেন এবং তাদের উপর তাদের নিজেদের ব্যতীত তাদের শক্রকে চাপিয়ে না দেন, যাতে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে বা তাদের সম্মান নষ্ট হবে। আমার রব আমাকে বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! আমি যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না। আমি আপনার উম্মতের জন্য আপনাকে এটা প্রদান করলাম যে, তাদেরকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষে ধ্বংস করব না। আর তাদের উপর তাদের নিজেদের ছাড়া শক্রদেরকে এমনভাবে চাপিয়ে দেব না, যাতে তাদের ধ্বংস হয়। যদিও তাদের বিরুদ্ধে সবস্থানের লোক একত্রিত হয় তবুও নয়। তবে তাদের একে অপরকে ধ্বংস করবে, একে অপরকে বন্দী করে রাখবে। [মুসলিম: ২৮৮৯]

অপর হাদীসে এসেছে, আদী ইবন হাতেম বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রবেশ করলাম। তিনি বললেন, হে আদী! ইসলাম গ্রহণ কর, তুমি নিরাপদ হবে। আমি বললাম, আমি একটি দ্বীনের উপর আছি। তিনি বললেন, আমি তোমার দ্বীন সম্পর্কে তোমার থেকে বেশী জানি। আমি বললাম, আপনি আমার দ্বীন সম্পর্কে আমার চেয়েও বেশী জানেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি কি (নাসারাদের) রাকূসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নও? আর তুমি কি তোমার সম্প্রদায়ের মিরবা’ বা এক চতুর্থাংশ খাও না? (জাহেলী যুগে সমাজের নেতারা অন্যদের আয়ের এক চতুর্থাংশ গ্রহণ করত) আমি বললাম, অবশ্যই হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটা তো তোমার দ্বীনে (নাসারাদের দ্বীনে) বৈধ নয়।

আদী বলেন, এটা বলার সাথে সাথে আমি বিনীত হয়ে গেলাম। তারপর তিনি বললেন, আমি জানি কোন জিনিস তোমাকে ইসলাম গ্রহণে বাঁধা দিচ্ছে। তুমি বলবে, এ দ্বীন তো দুর্বল লোকেরা গ্রহণ করেছে, যাদের কোন শক্তি-সামর্থ নেই; যাদেরকে আরবরা নিক্ষেপ করেছে। তুমি কি হীরা চেন? আমি বললাম, দেখিনি তবে শুনেছি। তিনি বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ আল্লাহ এ দ্বীনকে এমনভাবে পূর্ণ করবেন যে, হীরা থেকে কোন মহিলা সওয়ার বের হয়ে অবশেষে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে, তার সাথী কেউ থাকবে না।

আর খসরু ইবন হুরমুয এর সম্পদরাশি তোমাদের হস্তগত হবে। আমি বললাম, খসরু ইবন হুরমুয? তিনি বললেন, হ্যাঁ, খসরু ইবন হুরমুয। অচিরেই সম্পদ এমন বেশী হবে যে, অধিক পরিমানে ব্যয় হবে কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করবে না। আদী ইবন হাতেম বলেন, এই যে, মহিলা সওয়ার বের হচ্ছে, সে কারও সাহচর্য ছাড়াই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করছে। আর আমি নিজেই খসরু ইবন হুরমুযের সম্পদরাশি হস্তগত হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলাম। যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ করে বলছি, তৃতীয়টিও সংঘটিত হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি বলেছেন। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/৩৭৭]

কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ অন্যান্য দ্বীনের উপর দ্বীনে ইসলামের বিজয় লাভের সুসংবাদগুলো অধিকাংশ অবস্থা ও কালানুপাতিক। যেমনঃ মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোন কাঁচা ও পাকা ঘর দুনিয়ার বুকে থাকবে না, যেখানে ইসলামের প্রবেশ ঘটবে না। সম্মানিতদের সম্মানের সাথে এবং লাঞ্ছিতদের লাঞ্ছনার সাথে, আল্লাহ যাদের সম্মানিত করবেন তারা ইসলাম কবুল করবে এবং যাদের লাঞ্ছিত করবেন তারা ইসলাম গ্রহণে বিমুখ থাকবে কিন্তু কালেমায়ে ইসলামীর অনুগত হবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৪]

আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি অচিরেই পূর্ণ হয়। যার ফলে গোটা দুনিয়ার উপর প্রায় এক হাজার বছর যাবত ইসলামের প্রভুত্ব বিস্তৃত থাকে। কিন্তু সে পরিস্থিতি সবসময় এক থাকবে না। আবার মানুষের মধ্যে কুফরীর সয়লাব হবে। হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত লাত ও উযযা উপাসনা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাত-দিন শেষ হবে না। (কিয়ামত হবে না) আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আল্লাহ “তিনিই সে সত্তা যিনি তার রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি আর সব দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” [সূরা তাওবাহ ৩৩; সূরা আস-সাফ: ৯]

এ আয়াত নাযিল করেছিলেন, তখন আমি মনে করেছিলাম যে, এটা পরিপূর্ণ হবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয় এটা হবে, এবং যতদিন আল্লাহ চাইবেন ততদিন থাকবে। তারপর আল্লাহ এক পবিত্র বায়ু প্রেরণ করবেন, যা এমন প্রত্যেক মুমিনের প্রাণ হরণ করবে, যার মধ্যে সরিষা পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট থাকবে। এরপর যারা জীবিত থাকবে তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ থাকবে না, তারা তখন কুফরীতে ফিরে যাবে। [মুসলিম: ২৯০৭]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৩) তিনিই পথনির্দেশ (কুরআন) এবং সত্য ধর্ম সহ নিজ রসূল প্রেরণ করেছেন, যাতে তাকে সকল ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন, [1] যদিও অংশীবাদীরা অপ্রীতিকর মনে করে।

[1] দলীল ও প্রমাণের দিক দিয়ে এ বিজয় সর্বকালের জন্য। তথাপি যখনই মুসলিমরা দ্বীনের উপর আমল করেছে, তখনই তাদের পার্থিব বিজয় লাভ হয়েছে। আর এখনো যদি মুসলিমরা দ্বীনের উপর আমল করে, তাহলে তাদের বিজয়ও অবশ্য‎ম্ভাবী হবে। এই ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদাও আছে যে, আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে, তবে শর্ত হল যে, মুসলিমদেরকে আল্লাহর দলে পরিণত হতে হবে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ كَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّهۡبَانِ لَیَاۡكُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَكۡنِزُوۡنَ الذَّهَبَ وَ الۡفِضَّۃَ وَ لَا یُنۡفِقُوۡنَهَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ فَبَشِّرۡهُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿ۙ۳۴﴾
یایها الذین امنوا ان كثیرا من الاحبار و الرهبان لیاكلون اموال الناس بالباطل و یصدون عن سبیل الله و الذین یكنزون الذهب و الفضۃ و لا ینفقونها فی سبیل الله فبشرهم بعذاب الیم ﴿۳۴﴾
• হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।

-আল-বায়ান

• হে বিশ্বাসীগণ! অবশ্যই ‘আলিম ও দরবেশদের অনেকেই ভুয়ো কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষদের সম্পদ গ্রাস করে থাকে আর আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও।

-তাইসিরুল

• হে মু’মিনগণ! অধিকাংশ আহবার এবং রুহবান (ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের আলেম ও ধর্ম যাজক) মানুষের ধন-সম্পদ শারীয়াত বিরুদ্ধ উপায়ে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথ হতে বিরত রাখে, আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক এক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।

-মুজিবুর রহমান

• O you who have believed, indeed many of the scholars and the monks devour the wealth of people unjustly and avert [them] from the way of Allah. And those who hoard gold and silver and spend it not in the way of Allah - give them tidings of a painful punishment.

-Sahih International

৩৪. হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদের মধ্যে অনেকেই তো জনসাধারণের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায় এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে(১) আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না(২) আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।(৩)

(১) এ আয়াতে মুসলিমদের সম্বোধন করে ইয়াহুদী নাসারা সম্প্রদায়ের পণ্ডিত ও পাদ্রীদের কুকীর্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা লোকসমাজে গোমরাহী প্রসারের অন্যতম কারণ। ইয়াহুদী-নাসারাদের আলোচনায় মুসলিমদের হয়তো এ উদ্দেশ্যে সম্বোধন করা হয় যে, তাদের অবস্থাও যেন ওদের মত না হয়। আয়াতে ইয়াহুদী-নাসারা সম্প্রদায়ের পণ্ডিত ও পাদ্রীদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তাদের অধিকাংশই গৰ্হিত পন্থায় লোকদের মালামাল গলধঃকরণ করে চলছে এবং আল্লাহর সরল পথ থেকে মানুষকে নিবৃত রাখছে। এ বাতিল পন্থা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তারা গীর্জা ও ধর্মের নামে মানুষদের থেকে কর আদায় করত। এতে তারা মানুষদেরকে বোঝাত যে, এগুলো আল্লাহর নৈকট্যের জন্যই গ্রহণ করছে। অথচ তারা এ সম্পদগুলো কুক্ষিগত করত। [কুরতুবী]

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তারা বিচারকার্য ঘুষের উপর করত। [কুরতুবী] এভাবে তারা পয়সা নিয়ে তওরাতের শিক্ষাবিরোধী ফতোয়া দান করত। আবার কখনো তওরাতের বিধি নিষেধকে গোপন রেখে কিংবা তাতে নানা হীলা বাহানা সৃষ্টি করে নিজেরাই শুধু পথভ্রষ্ট হতোনা বরং সত্যপথ অন্বেষণকারীদের বিভ্রান্ত হওয়ারও কারণ হয়ে দাঁড়াতো। [সা’দী] কেননা, যেখানে নেতাদের এ অবস্থা, সেখানে অনুসারীদের সত্য সন্ধানের স্পৃহাও আর বাকী থাকে না। তাছাড়া তাদের বাতিল ফতোয়ার দরুন সরল জনগণ মিথ্যাকেও সত্যরূপে বিশ্বাস করে নেয়। অথবা আল্লাহর দ্বীন বলে এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] অর্থাৎ তারা নিজেরা তো পথভ্রষ্ট হয়েছেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান না এনে অর্থলোভে পড়ে আছে। অন্যদেরকেও তেমনি ইসলামে প্রবেশ করা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ থেকে বাঁধা দিচ্ছে। [কুরতুবী]

(২) ইয়াহুদী নাসারা গোষ্ঠীর আলেম সম্প্রদায়ের মিথ্যা ফতোয়া দানের ব্যাধি সৃষ্টি হয় অর্থের লোভ লালসা থেকে। এজন্যে আয়াতে অর্থলিন্সার করুণ পরিণতি ও কঠোর সাজার কথা বর্ণিত হয়। এরশাদ হয়েছেঃ “যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে, তা খরচ করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ দিন”। এখানে “আর তা খরচ করে না আল্লাহর পথে” বাক্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যারা বিধানমতে আল্লাহর ওয়াস্তে খরচ করে, তাদের পক্ষে তাদের অবশিষ্ট অর্থ সম্পদ ক্ষতিকর নয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে মালামালের যাকাত দেয়া হয়, তা জমা রাখা সঞ্চিত ধন-রত্রের শামিল নয়।” [আবু দাউদ: ১৫৬৪]। এ থেকে বোঝা যায় যে, যাকাত আদায়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা জমা রাখা গোনাহ নয়।

(৩) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, তারপর সে যে সম্পদের যাকাত দিবে না, কিয়ামতের দিন তার সম্পদ তার জন্য চক্ষুর পাশে দুটি কালো দাগবিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত হবে, তারপর সেটি তার চোয়ালের দু’পাশে আক্রমন করবে এবং বলতে থাকবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার গচ্ছিত ধন। [বুখারী: ১৪০৩]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন ব্যক্তি তাঁর উটের যাকাত দিবে না সে যেভাবে দুনিয়াতে ছিল তার থেকে উত্তমভাবে এসে তাকে পা দিয়ে মাড়াতে থাকবে, অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ছাগলের যাকাত দিবে না সে যেভাবে দুনিয়াতে ছিল তার থেকেও উত্তমভাবে এসে তাকে তার খুর ও শিং দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকবে ... আর তোমাদের কেউ যেন কিয়ামতের দিন তাঁর কাঁধে ছাগল নিয়ে উপস্থিত না হয়, যে ছাগল চিৎকার করতে থাকবে, তখন সে বলবে, হে মুহাম্মাদ! আর আমি বলব, আমি তোমার জন্য কোন কিছুরই মালিক নই, আমি তো তোমার কাছে বাণী পৌছিয়েছি। আর তোমাদের কেউ যেন তাঁর কাঁধে কোন উট নিয়ে উপস্থিত না হয়, যা শব্দ করছে। তখন সে বলবে, হে মুহাম্মাদ! আমি বলব, আমি তোমার জন্য কোন কিছুর মালিক নই, আমি তো তোমাদেরকে পৌছিয়েছি। [বুখারী: ১৪০২; মুসলিম: ৯৮৮]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৪) হে মুমিনগণ! নিশ্চয় অনেক পন্ডিত-পুরোহিত মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায় উপায়ে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে।[1] আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। [2]

[1] أحبَار শব্দটি حِبْر এর বহুবচন। এটা এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কথাকে খুব সুন্দর করে পেশ করার দক্ষতা রাখে। আর সুন্দর ও নকশাদার পোশাককেও ثَوبٌ مُحَبِّر বলা হয়ে থাকে। এখানে উদ্দেশ্য ইয়াহুদী উলামা। رُهبَان শব্দটি رَاهِب এর বহুবচন যার উৎপত্তি رهبنة শব্দ থেকে। এ থেকে উদ্দেশ্য নাসারা উলামা। কারো কারো নিকটে এ থেকে উদ্দেশ্য হল, নাসারাদের সুফীগণ। উলামার জন্য তাদের নিকট বিশেষ শব্দ قسّيسين রয়েছে। এই উভয় শ্রেণীর ধর্মধ্বজীরা এক তো আল্লাহর কালামকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করে লোকদেরকে তাদের ইচ্ছা মোতাবেক ফতোয়া ও বিধান দিত এবং এইভাবে তাদেরকে আল্লাহর পথ হতে বাধা প্রদান করত। আর দ্বিতীয়তঃ এই পন্থায় তারা তাদের নিকট হতে অর্থ উপার্জন করত; যা তাদের জন্য হারাম ও বাতিল ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বহু সংখ্যক মুসলিম উমালাদের অবস্থাও ওদের মতই। আর এ হল নবী (সাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতার প্রমাণ। যাতে তিনি বলেছিলেন لتتّبعن سنن من كان قبلكم অর্থাৎ, ‘‘তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী উম্মতদের তরীকা অনুসরণ করবে।’’ (বুখারীঃ ই’তিসাম অধ্যায়)

[2] আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন যে, এটা যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বের আদেশ। যাকাতের হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার পর যাকাত দ্বারা আল্লাহ তাআলা মাল-ধনকে পবিত্র করার মাধ্যম বানিয়েছেন। এই জন্য উলামাগণ বলেন, যে মাল থেকে যাকাত বের করা হবে সে মাল (আয়াতে নিন্দনীয়) ‘জমা করে রাখা’ মাল নয়। আর যে মাল থেকে যাকাত বের করা হবে না, সে মালই হবে ‘জমা করে রাখা’ ধনভান্ডার; যার জন্য রয়েছে এই কুরআনী ধমক। সুতরাং সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘প্রত্যেক সোনা ও চাঁদীর অধিকারী ব্যক্তি যে তার হক (যাকাত) আদায় করে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে তখন তার জন্য ঐ সমুদয় সোনা-চাঁদীকে আগুনে দিয়ে বহু পাত তৈরী করা হবে। অতঃপর সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগা হবে। যখনই সে পাত ঠান্ডা হয়ে যাবে তখনই তা পুনরায় গরম করে অনুরূপ দাগার শাস্তি সেই দিনে চলতেই থাকবে যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান; যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দাদের মাঝে বিচার-নিষ্পত্তি শেষ করা হয়েছে। অতঃপর সে তার পথ দেখতে পাবে; হয় জান্নাতের দিকে না হয় দোযখের দিকে।’’ (মুসলিম যাকাত অধ্যায়) বলাই বাহুল্য যে, পূর্বোক্ত শ্রেণীর ভ্রষ্ট উলামা ও সূফীদের পরে ভ্রষ্ট ধনবানরাই সাধারণ মানুষদের ভ্রষ্টতার জন্য অধিকাংশে দায়ী। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মন্দ থেকে হিফাযতে রাখুন। আমীন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৫ یَّوۡمَ یُحۡمٰی عَلَیۡهَا فِیۡ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوٰی بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَ جُنُوۡبُهُمۡ وَ ظُهُوۡرُهُمۡ ؕ هٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِاَنۡفُسِكُمۡ فَذُوۡقُوۡا مَا كُنۡتُمۡ تَكۡنِزُوۡنَ ﴿۳۵﴾
یوم یحمی علیها فی نار جهنم فتكوی بها جباههم و جنوبهم و ظهورهم هذا ما كنزتم لانفسكم فذوقوا ما كنتم تكنزون ﴿۳۵﴾
• যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর’।

-আল-বায়ান

• যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে আর তা দিয়ে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে, (আর তাদেরকে বলা হবে) ‘এটা হল, যা তোমরা নিজেদের জন্য স্তুপীকৃত করেছিলে, কাজেই যা জমা করছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।’

-তাইসিরুল

• সেদিন জাহান্নামের আগুনে ঐগুলিকে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর ঐগুলি দ্বারা তাদের ললাটসমূহে, পার্শ্বদেশসমূহে এবং পৃষ্ঠদেশসমূহে দাগ দেয়া হবে, আর বলা হবেঃ এটা হচ্ছে ওটাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে, সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ কর।

-মুজিবুর রহমান

• The Day when it will be heated in the fire of Hell and seared therewith will be their foreheads, their flanks, and their backs, [it will be said], "This is what you hoarded for yourselves, so taste what you used to hoard."

-Sahih International

৩৫. যেদিন জাহান্নামের আগুনে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে এবং সে সব দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে, বলা হবে, এগুলোই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। কাজেই তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তার স্বাদ ভোগ কর।(১)

(১) এ আয়াতে জমাকৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করার যে কঠোর সাজার উল্লেখ রয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তার এ সাজা তারই অর্জন করা। অর্থাৎ যে অর্থ সম্পদ অবৈধ পন্থায় জমা করা হয়, কিংবা বৈধ পন্থায় জমা করলেও তার যাকাত আদায় করা না হয়, সে সম্পদই তার জন্য আযাবের কারণ হয়। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখে তাদেরকে সেই জাহান্নামের উত্তপ্ত পাথরের ছেকার সুসংবাদ দিন, যা জাহান্নামের আগুনের দ্বারা দেয়া হবে। যা তাদের কারও স্তনের বোটার মধ্যে রাখা হবে, আর তা বের হবে দু কাঁধের উপরিভাগে। আর দু কাঁধের উপরিভাগে রাখা হবে যা স্তনের বেঁটার মধ্য দিয়ে বের হবে। [মুসলিম: ৯৯২]

অন্য হাদীসে এসেছে, যে কোন সোনার মালিক বা রুপার মালিক যাকাত প্রদান করবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলো তার জন্য আগুনের পাত হিসেবে বানিয়ে নেয়া হবে, তারপর সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দিয়ে তার কপাল, পাঁজর ও পিঠে ছেকা দেয়া হবে। যখনই সেগুলো ঠাণ্ডা হবে, আবার তা উত্তপ্ত করা হবে, এমন দিনে যার পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। যতক্ষণ না বান্দাদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করা শেষ হবে। তারপর তার স্থান জান্নাত কিংবা জাহান্নামে সেটা দেখানো হবে। [মুসলিম: ৯৮৭]

কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এ আয়াতে যে ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করার উল্লেখ এজন্যে করা হয়েছে যে, যে কৃপন ব্যক্তি আল্লাহর রাহে খরচ করতে চায় না, তার কাছে যখন কোন ভিক্ষুক কিছু চায়; কিংবা যাকাত তলব করে, তখন সে প্রথমে ভ্রুকুঞ্চন করে, তারপর পাশ কাটিয়ে তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। এতেও সে ক্ষান্ত না হলে তাকে পৃষ্ঠ দেখিয়ে চলে যায়। এজন্যে বিশেষ করে এ তিন অঙ্গে আযাব দানের উল্লেখ করা হয়েছে। [কুরতুবী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৫) যেদিন জাহান্নামের আগুনে ঐগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশ দাগা হবে, (আর বলা হবে) এ হচ্ছে তাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চিত জিনিসের স্বাদ গ্রহণ কর।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৬ اِنَّ عِدَّۃَ الشُّهُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰهِ اثۡنَا عَشَرَ شَهۡرًا فِیۡ كِتٰبِ اللّٰهِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡهَاۤ اَرۡبَعَۃٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡهِنَّ اَنۡفُسَكُمۡ وَ قَاتِلُوا الۡمُشۡرِكِیۡنَ كَآفَّۃً كَمَا یُقَاتِلُوۡنَكُمۡ كَآفَّۃً ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۳۶﴾
ان عدۃ الشهور عند الله اثنا عشر شهرا فی كتب الله یوم خلق السموت و الارض منها اربعۃ حرم ذلك الدین القیم فلا تظلموا فیهن انفسكم و قاتلوا المشركین كآفۃ كما یقاتلونكم كآفۃ و اعلموا ان الله مع المتقین ﴿۳۶﴾
• নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুলম করো না, আর তোমরা সকলে মুশরিকদের সাথে লড়াই কর যেমনিভাবে তারা সকলে তোমাদের সাথে লড়াই করে, আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।

-আল-বায়ান

• আসমান-যমীন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কিতাবে (লৌহ মাহফুজে) মাসগুলোর সংখ্যা হল বার। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটা হল সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর যুলম করো না। মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। জেনে রেখ, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।

-তাইসিরুল

• নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় বারটি। এর মধ্যে বিশেষ রূপে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। অতএব তোমরা এ মাসগুলিতে (ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করনা, আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন।

-মুজিবুর রহমান

• Indeed, the number of months with Allah is twelve [lunar] months in the register of Allah [from] the day He created the heavens and the earth; of these, four are sacred. That is the correct religion, so do not wrong yourselves during them. And fight against the disbelievers collectively as they fight against you collectively. And know that Allah is with the righteous [who fear Him].

-Sahih International

৩৬. নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির দিন থেকেই(১) আল্লাহ্‌র বিধানে(২) আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারটি(৩), তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস(৪), এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন।(৫)। কাজেই এর মধ্যে তোমর নিজেদের প্রতি যুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।

(১) এর দ্বারা এদিকে ঈঙ্গিত করা হয় যে, মাসগুলোর ধারাবহিকতা নির্ধারিত হয় আসমান ও যমীনের সৃষ্টি পরবর্তী মুহুর্তে। [সা'দী]

(২) এখানে (فِي كِتَابِ اللَّهِ) বলে স্পষ্ট করা হয় যে, বিষয়টি সৃষ্টির প্রথম দিনেই তাকদীরে সুনির্দিষ্ট করা আছে। [সা’দী] আর সে অনুসারে লওহে মাহফুযে লিখিত রয়েছে। [কুরতুবী]

(৩) অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট গণনায় মাস হল বারটি। এখানে উল্লেখিত عدة অর্থ গণনা। شهور হল شهر এর বহুবচন। আয়াতের সারমর্ম হল, আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যাটি বারটি নির্ধারিত, এতে কম বেশি করার কারো সুযোগ নেই। জাহেলিয়াতের লোকেরা বদলালেও তোমরা সেটা বদলাতে পার না। তোমাদের কাজ হবে আল্লাহর এ নির্দেশ মোতাবেক সেটাকে ঠিক করে নেয়া। [কুরতুবী]

(৪) বিদায় হজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খোতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মানিত মাসগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন: তিনটি মাস হল ধারাবাহিক— যিলকদ, যিলহজ ও মহররম, অপরটি হল রজব। [বুখারী: ৩১৯৭; মুসলিম: ১৬৭৯] আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় সময় আবার ঘুরে তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফিরে এসেছে। যে পদ্ধতিতে আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিনের মত। মাসের সংখ্যা বারটি। তন্মধ্যে চারটি হচ্ছে, হারাম মাস। তিনটি পরপর যিলকদ, যিলহজ, ও মুহাররাম। আর হচ্ছে মুদার গোত্রের রজব মাস, যা জুমাদাস সানী ও শাবান মাসের মাঝখানে থাকে। [বুখারী ৪৬৬২; মুসলিম: ১৬৭৯]

(৫) অর্থাৎ মাসগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারণ ও সম্মানিত মাসুগলোর সাথে সম্পৃক্ত হুকুম আহকামকে সৃষ্টির প্রথম পর্বের ইলাহী নিয়মের সাথে সঙ্গতিশীল রাখাই হল সঠিক দ্বীন। এতে কোন মানুষের কম-বেশী কিংবা পরিবর্তন - পরিবর্ধন করার প্রয়াস অসুস্থ বিবেক ও মন্দ স্বভাবের আলামত। এর দ্বারা আরও প্রমাণিত হয় যে, ধারাবাহিকতা এবং মাসগুলোর যে নাম ইসলামী শরীআতে প্রচলিত, তা মানবরচিত পরিভাষা নয়, বরং রাব্বুল আলামীন যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিনই মাসের তারতীব, নাম ও বিশেষ মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম আহকাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আয়াত দ্বারা আরও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরীআতের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্রমাসই নির্ভরযোগ্য। চন্দ্রমাসের হিসেব মতেই রোযা, হজ ও যাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। [কুরতুবী]

তবে কুরআন মজীদ চন্দ্রের মত সূর্যকেও সন-তারিখ ঠিক করার মানদন্ডরূপে অভিহিত করেছেন। [সূরা আল-আনআমঃ ৯৬; সূরা আর-রাহমান: ৫, সূরা ইউনুস: ৫] অতএব চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সন-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর অধিকতর পছন্দ। তাই শরীআতের আহকামকে চন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্যে চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরযে-কেফায়া, সকল উম্মত এ হিসাব ভুলে গেলে সবাই গোনাহগার হবে। চাঁদের হিসাব ঠিক রেখে অন্যান্য সূত্রের হিসাব ব্যবহার করা জায়েয আছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৬) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট নিশ্চয়ই মাসসমূহের সংখ্যা হল বারো মাস। এর মধ্যে চারটি মাস হল নিষিদ্ধ (পবিত্র)।[1] এটাই সরল বিধান।[2] অতএব তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের প্রতি যুলুম করো না।[3] আর অংশীবাদীদের সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। [4] আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ সাবধানীদের সাথে রয়েছেন।

[1] আল্লাহর বিধান ‘কিতাবুল্লাহ’ থেকে উদ্দেশ্য হল ‘লাওহে মাহফূয’। সৃষ্টির প্রারম্ভিক কাল থেকেই আল্লাহ তাআলা (বছরে) বার মাস নির্ধারিত করেছেন। তার মধ্যে চারটি মাস হল নিষিদ্ধ মাস, যাতে বিশেষ করে লড়াই-ঝগড়া নিষিদ্ধ। এই কথাকে নবী (সাঃ) এইভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘‘যামানা ঘুরে-ফিরে পুনরায় সেই অবস্থাতে এসে গেছে যে অবস্থাতে তখন ছিল, যখন আল্লাহ তাআলা আকাশ-পৃথিবী রচনা করেছেন; বার মাসে এক বছর। যার মধ্যে চারটি হল নিষিদ্ধ মাস; তিনটি মাস ক্রমান্বয়ে যুলকা’দাহ, যুলহাজ্জাহ ও মুহাররাম। আর চতুর্থ মাসটি হল রজব মুযার; যা জুমাদাল আখের ও শা’বান মাসের মধ্যস্থলে পড়ে। (বুখারঃ কিতাবুততাফসীর সূরা তাওবাহ পরিচ্ছেদ, মুসলিম ক্বাসামাহ অধ্যায়) ‘‘যামানা ঘুরে-ফিরে পুনরায় সেই অবস্থাতে এসে গেছে’’ এর অর্থ হল আরবের মুশরিকরা মাসগুলিকে নিয়ে যে আগা-পিছা করত (যার বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীতে আসছে) এ কথায় তার খন্ডন করা হয়েছে।

[2] অর্থাৎ, এই মাসগুলি এই পর্যায়ক্রমে হওয়া যেমন আল্লাহ রেখেছেন, যার মধ্যে চার মাস হল নিষিদ্ধ মাস। আর এই হিসাবই সঠিক ও সংখ্যাও পরিপূর্ণ।

[3] অর্থাৎ, এই নিষিদ্ধ ও পবিত্র মাসগুলিতে লড়াই-ঝগড়া করে তার পবিত্রতা বিনষ্ট করে এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়ে।

[4] কিন্তু এই নিষিদ্ধ মাসগুলি অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর। তবে যদি তারা যুদ্ধ করতে বাধ্য করে, তাহলে নিষিদ্ধ মাসগুলিতেও তোমাদের জন্য যুদ্ধ করা বৈধ হবে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৭ اِنَّمَا النَّسِیۡٓءُ زِیَادَۃٌ فِی الۡكُفۡرِ یُضَلُّ بِهِ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا یُحِلُّوۡنَهٗ عَامًا وَّ یُحَرِّمُوۡنَهٗ عَامًا لِّیُوَاطِـُٔوۡا عِدَّۃَ مَا حَرَّمَ اللّٰهُ فَیُحِلُّوۡا مَا حَرَّمَ اللّٰهُ ؕ زُیِّنَ لَهُمۡ سُوۡٓءُ اَعۡمَالِهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡكٰفِرِیۡنَ ﴿۳۷﴾
انما النسیٓء زیادۃ فی الكفر یضل به الذین كفروا یحلونهٗ عاما و یحرمونهٗ عاما لیواطـٔوا عدۃ ما حرم الله فیحلوا ما حرم الله زین لهم سوٓء اعمالهم و الله لا یهدی القوم الكفرین ﴿۳۷﴾
• নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফরী বৃদ্ধি করে, এর দ্বারা কাফিররা পথভ্রষ্ট হয়, তারা এটি এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে, যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা ঠিক রাখে। ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা তারা হালাল করে। তাদের মন্দ আমলসমূহ তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ কাফির কওমকে হিদায়াত দেন না।

-আল-বায়ান

• নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফরীর উপর আরেক কুফরী কাজ যা দ্বারা কাফিরদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয়। এক বছর তারা একটি মাসকে হালাল করে, আরেক বছর ঐ মাসটিকে হারাম করে যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়। এভাবে তারা আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোকে হারাম করে নেয়। তাদের খারাপ কাজগুলো তাদের কাছে আনন্দদায়ক। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না।

-তাইসিরুল

• নিশ্চয়ই এই (মাসগুলির) স্থানান্তর কুফরের মধ্যে আরও কুফরী বৃদ্ধি করা, যদ্বারা কাফিরদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয়। (তা এ রূপে যে) তারা সেই হারাম মাসকে কোন বছর হালাল করে নেয় এবং কোন বছর হারাম মনে করে, আল্লাহ যে মাসগুলিকে হারাম করেছেন, যেন তারা ওগুলির সংখ্যা পূর্ণ করে নিতে পারে, অতঃপর তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসগুলিকে হালাল করে নেয়, তাদের দুস্কর্মগুলি তাদের কাছে শোভনীয় মনে হয়, আর আল্লাহ এইরূপ কাফিরদেরকে হিদায়াত (এর তাওফীক দান) করেননা।

-মুজিবুর রহমান

• Indeed, the postponing [of restriction within sacred months] is an increase in disbelief by which those who have disbelieved are led [further] astray. They make it lawful one year and unlawful another year to correspond to the number made unlawful by Allah and [thus] make lawful what Allah has made unlawful. Made pleasing to them is the evil of their deeds; and Allah does not guide the disbelieving people.

-Sahih International

৩৭. কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া তো শুধু কুফরীতে বৃদ্ধি সাধন করা, যা দিয়ে কাফেরদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা এটাকে কোন বছর বৈধ করে এবং কোন বছর অবৈধ করে যাতে তারা আল্লাহ যেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলোর গণনা পূর্ণ করতে পারে, ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে; আর আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৭) (এই মাসগুলোর পবিত্রতাকে অন্য মাসে) পিছিয়ে দেওয়া কুফরীর মধ্যে আরো বৃদ্ধি মাত্র, [1] যা দ্বারা অবিশ্বাসীদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয় (এইরূপে) যে, তারা সেই পবিত্র মাসকে কোন বছর বৈধ মনে করে এবং কোন বছর অবৈধ মনে করে। যাতে আল্লাহ যে মাসগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, তারা যেন সেগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করে নিতে পারে,[2] অতঃপর আল্লাহ যা অবৈধ করেছেন তা বৈধ করে নেয়। তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের কাছে শোভনীয় করা হয়েছে। আর আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।

[1] نَسِيء অর্থ হল পিছিয়ে দেওয়া। আরবেও নিষিদ্ধ মাসে লড়াই-ঝগড়া এবং লুটতরাজ করাকে খুবই অপছন্দ করা হত। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তিন মাসের পবিত্রতাকে খেয়াল রেখে যুদ্ধ ও লুট-হত্যা করা থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য বড় সমস্যার বিষয় ছিল। এই জন্য এর সমাধান তারা এই বের করেছিল যে, যে নিষিদ্ধ মাসে তারা যুদ্ধ ও লুটমার করতে চাইত, তাতে তারা করে ফেলত এবং ঘোষণা করে দিত যে, এর পরিবর্তে অমুক মাস নিষিদ্ধ ও পবিত্র। উদাহরণ স্বরূপ মুহাররাম মাসের পবিত্রতাকে নষ্ট করে তার জায়গাতে সফর মাসকে পবিত্র মাস বলে নির্ধারিত করত। আর এইভাবে নিষিদ্ধ ও পবিত্র মাসগুলিতে আগে-পিছে ও রদ-বদল করতেই থাকত। এ কাজকে বলা হত نَسِيء। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে বললেন, এটা হল কুফরীতে বাড়াবাড়ি। কেননা, এই পরিবর্তন ঘটানোর পশ্চাতে তাদের লড়াই-ঝগড়া ও পার্থিব স্বার্থলাভ করা ছাড়া অন্য কিছু উদ্দেশ্য নয়। আর নবী (সাঃ)ও এর সমাপ্তি ঘোষণা এই বলে করেছেন যে, যামানা ঘুরে-ফিরে নিজ অবস্থায় এসে গেছে। অর্থাৎ, এখন হতে আগামী মাসগুলির পর্যায়ক্রম তেমনিই থাকবে, যেমন বিশ্ব-সৃষ্টির শুরু থেকে চলে আসছে।

[2] অর্থাৎ, এক মাসের পবিত্রতাকে নষ্ট করে তার জায়গাতে অন্য মাসকে হারাম নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য এই হত যে, আল্লাহ তাআলা যে চারটি মাসকে পবিত্র করেছেন তার গণনা যেন পূর্ণ থাকে। গণনা পূর্ণ করায় আল্লাহর মতে একমত ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে এই মাসগুলিতে লড়াই-ঝগড়া ও লুটতরাজ নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন তার তারা কোন পরোয়া করত না। বরং উক্ত প্রকার অন্যায়-অত্যাচার করার জন্য এই পরিবর্তন ঘটাত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَا لَكُمۡ اِذَا قِیۡلَ لَكُمُ انۡفِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اثَّاقَلۡتُمۡ اِلَی الۡاَرۡضِ ؕ اَرَضِیۡتُمۡ بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا قَلِیۡلٌ ﴿۳۸﴾
یایها الذین امنوا ما لكم اذا قیل لكم انفروا فی سبیل الله اثاقلتم الی الارض ارضیتم بالحیوۃ الدنیا من الاخرۃ فما متاع الحیوۃ الدنیا فی الاخرۃ الا قلیل ﴿۳۸﴾
• হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধে) বের হও, তখন তোমরা যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

-আল-বায়ান

• হে ঈমানদারগণ! তোমাদের হয়েছে কী যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় তখন তোমরা আরো জোরে মাটি কামড়ে ধর। তোমরা কি আখেরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ কর? আখেরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী তো অতি সামান্য।

-তাইসিরুল

• হে মু’মিনগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন তোমাদেরকে বলা হয়, বের হও আল্লাহর পথে, তখন তোমরা মাটিতে লেগে থাক (অলসভাবে বসে থাক)। তাহলে কি তোমরা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনের উপর পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? বস্তুতঃ পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসতো আখিরাতের তুলনায় কিছুই নয়, অতি সামান্য।

-মুজিবুর রহমান

• O you who have believed, what is [the matter] with you that, when you are told to go forth in the cause of Allah, you adhere heavily to the earth? Are you satisfied with the life of this world rather than the Hereafter? But what is the enjoyment of worldly life compared to the Hereafter except a [very] little.

-Sahih International

৩৮. হে ঈমানদারগগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যমীনে ঝুঁকে পড়? তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়েছ? আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের ভোগের উপকরণ তো নগণ্য।(১)

(১) অলসতার যে কারণ ও প্রতিকারের উপায় এখানে বর্ণিত হয়েছে, তা এক বিশেষ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, দ্বীনের ব্যাপারে সকল আলস্য, নিস্ক্রিয়তা ও সকল অপরাধ এবং গোনাহের মূলে রয়েছে দুনিয়া প্রীতি ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা। সেজন্য আয়াতে বলা হয়ঃ “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হল, আল্লাহর পথে বের হওয়ার জন্য বলা হলে তোমরা মাটি জড়িয়ে ধর। আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবন নিয়েই কি পরিতুষ্ট হয়ে গেলে?” হাদীসে এসেছে, “বৃদ্ধ মানুষের মনও দুটি ব্যাপারে যুবক থেকে যায়, একটি হচ্ছে দুনিয়াপ্রীতি অপরটি বেশী বেশী আশা-আকাঙ্খা।” [বুখারী ৬৪২০]

রোগ নির্ণয়ের পর তার প্রতিকার উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, পার্থিব জিন্দেগীর ভোগের উপকরণ আখেরাতের তুলনায় অতি নগণ্য। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হচ্ছে, যেমন তোমাদের কেউ তার আঙ্গুলকে সমুদ্রের মধ্যে ডুবায়, সুতরাং সে দেখুক, সে আঙ্গুল কি নিয়ে আসে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার শাহাদাত আঙ্গুলীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। [মুসলিম: ২৮৫৮]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার কোন এক উচু স্থান দিয়ে বাজারে প্রবেশ করলেন। বাজার লোকে লোকারণ্য। তিনি একটি কানকাটা মরা ছাগলের পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি সেটির কানের বাকী অংশে ধরলেন। তারপর বললেন, কে এটিকে এক দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করতে রাজী আছ? লোকরা বলল, আমরা কেউ এটিকে কোন কিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করব না। আর আমরা এটাকে নিয়ে কি করব? তিনি বললেন, তোমরা কি চাও যে এটা তোমাদের হোক? তারা বলল, যদি জীবিতও থাকত তারপরও সেটা দোষযুক্ত ছিল; কেননা তার কান নেই। তদুপরি সেটা মৃত। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি দুনিয়া আল্লাহর কাছে এর চেয়েও বেশী মূল্যহীন। [মুসলিম: ২৯৫৭]

সারকথা হল, আখেরাতের স্থায়ী জীবনের চিন্তা-ভাবনাই মানুষের করা উচিত। বস্তুতঃ আখেরাতের চিন্তাই সকল রোগের একমাত্র প্রতিকার এবং অপরাধ দমনের সার্থক উপায়।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৮) হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের কি হলো যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে (জিহাদে) বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়। তবে কি তোমরা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন নিয়ে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? বস্তুতঃ পার্থিব জীবনের ভোগবিলাস তো পরকালের তুলনায় অতি সামান্য।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩৯ اِلَّا تَنۡفِرُوۡا یُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ۬ۙ وَّ یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَكُمۡ وَ لَا تَضُرُّوۡهُ شَیۡئًا ؕ وَ اللّٰهُ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۹﴾
الا تنفروا یعذبكم عذابا الیما و یستبدل قوما غیركم و لا تضروه شیئا و الله علی كل شیء قدیر ﴿۳۹﴾
• যদি তোমরা (যুদ্ধে) বের না হও, তিনি তোমাদের বেদনাদায়ক আযাব দেবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক কওমকে আনয়ন করবেন, আর তোমরা তাঁর কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

-আল-বায়ান

• তোমরা যদি যুদ্ধাভিযানে বের না হও, তাহলে তোমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে, আর তোমাদের স্থলে অন্য সম্প্রদায়কে আনা হবে (অথচ) তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

-তাইসিরুল

• যদি তোমরা বের না হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করবেন, আর তোমরা আল্লাহর (দীনের) কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

-মুজিবুর রহমান

• If you do not go forth, He will punish you with a painful punishment and will replace you with another people, and you will not harm Him at all. And Allah is over all things competent.

-Sahih International

৩৯. যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং অন্য জাতিকে তোমাদের পরিবর্তে আনয়ন করবেন এবং তোমরা তার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।(১)

(১) এ আয়াতে অলস ও নিস্ক্রিয় লোকদের ব্যাধি ও তার প্রতিকার উল্লেখ করে সর্বশেষ ফয়সালা জানিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরা জিহাদে বের না হলে আল্লাহ তোমাদের মৰ্মম্ভদ শাস্তি দিবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য জাতির উত্থান ঘটাবেন। আর দ্বীনের আমল থেকে বিরত হয়ে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। কেননা আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। কাতাদা বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে শামের দিকে তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বের হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি জানেন এ যুদ্ধে কত কষ্ট রয়েছে। তারপরও তিনি এ যুদ্ধে বের না হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করেছেন। [তাবারী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৯) যদি তোমরা (জিহাদে) বের না হও, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক জাতি সৃষ্টি করবেন, আর তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।[1] আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।

[1] রোমের খ্রিষ্টান বাদশাহ হিরাক্লের ব্যাপারে খবর পাওয়া গেল যে, তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন। সুতরাং নবী (সাঃ) তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে আদেশ করলেন। এটা ছিল শওয়াল মাসের ৯ হিজরীর ঘটনা। সময়টা ছিল প্রখর গ্রীষ্মের সময় আর সফরও ছিল খুব লম্বা। কোন কোন মুসলিম ও মুনাফিকবদের উপর এটা বড় কষ্টকর মনে হল; যার প্রকাশ এই আয়াতের মধ্যে করা হয়েছে এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করা ও ধমক দেওয়া হয়েছে। এটাকে তাবূক যুদ্ধ বলা হয়; যা আসলে ঘটেনি। ২০ দিন মুসলিমরা শাম দেশের নিকটবর্তী তাবূকে থেকে পুনরায় ফিরে এলেন। এ যুদ্ধের সৈন্যদেরকে ‘জাইশুল উসরাহ’ (সংকট-সৈন্য) বলা হয়। কেননা, এই দীর্ঘ সফরে সৈন্যদেরকে দীর্ঘ সময় বড় সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। اثَّاقَلتُم অর্থাৎ, অলস ভারাক্রান্ত হয়ে পিছনে থাকতে চাও। এর বহিঃপ্রকাশ কোন কোন লোকের মধ্যে হয়েছিল। কিন্তু এর সম্বন্ধ সকলের প্রতি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৪০ اِلَّا تَنۡصُرُوۡهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذۡ اَخۡرَجَهُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا ثَانِیَ اثۡنَیۡنِ اِذۡ هُمَا فِی الۡغَارِ اِذۡ یَقُوۡلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحۡزَنۡ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا ۚ فَاَنۡزَلَ اللّٰهُ سَكِیۡنَتَهٗ عَلَیۡهِ وَ اَیَّدَهٗ بِجُنُوۡدٍ لَّمۡ تَرَوۡهَا وَ جَعَلَ كَلِمَۃَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوا السُّفۡلٰی ؕ وَ كَلِمَۃُ اللّٰهِ هِیَ الۡعُلۡیَا ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَكِیۡمٌ ﴿۴۰﴾
الا تنصروه فقد نصره الله اذ اخرجه الذین كفروا ثانی اثنین اذ هما فی الغار اذ یقول لصاحبهٖ لا تحزن ان الله معنا فانزل الله سكینتهٗ علیه و ایدهٗ بجنود لم تروها و جعل كلمۃ الذین كفروا السفلی و كلمۃ الله هی العلیا و الله عزیز حكیم ﴿۴۰﴾
• যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে এমন এক সৈন্য বাহিনী দ্বারা সাহায্য করলেন যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফিরদের বাণী অতি নিচু করে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই সুউচ্চ। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।

-আল-বায়ান

• যদি তোমরা তাকে [অর্থাৎ রসূল (সা.)-কে] সাহায্য না কর (তাতে কোনই পরোয়া নেই) কারণ আল্লাহ তো তাকে সেই সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে তার সঙ্গীকে বলছিল, ‘চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’। তখন আল্লাহ তার প্রতি তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করলেন আর তাকে এমন সেনাবাহিনী দিয়ে শক্তিশালী করলেন তোমরা যা দেখতে পাওনি, আর তিনি কাফিরদের মুখের বুলিকে গভীর নীচে ফেলে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই রয়েছে সর্বোচ্চ। আল্লাহ হলেন প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী।

-তাইসিরুল

• যদি তোমরা তাকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য না কর তাহলে আল্লাহই তাকে সাহায্য করবেন যেমন তিনি তাকে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে যখন কাফিরেরা তাকে দেশান্তর করেছিল, যখন দু’জনের মধ্যে একজন ছিল সে, যে সময় উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে স্বীয় সঙ্গীকে (আবূ বাকরকে) বলেছিলঃ তুমি বিষণ্ণ হয়োনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফিরদের বাক্য নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণী সমুচ্চ রইল, আর আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল প্রজ্ঞাময়।

-মুজিবুর রহমান

• If you do not aid the Prophet - Allah has already aided him when those who disbelieved had driven him out [of Makkah] as one of two, when they were in the cave and he said to his companion, "Do not grieve; indeed Allah is with us." And Allah sent down his tranquillity upon him and supported him with angels you did not see and made the word of those who disbelieved the lowest, while the word of Allah - that is the highest. And Allah is Exalted in Might and Wise.

-Sahih International

৪০. যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিস্কার করেছিল এবং তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহর মধ্যে ছিল; তিনি তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলেন, বিষন্ন হয়ে না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তার প্রশান্তি নাযিল করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের কথা হেয় করেন। আর আল্লাহর কথাই সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(১)

(১) এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়ে দেয়া হয় যে, আল্লাহর রাসূল কোন মানুষের সাহায্য সহযোগিতার মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে গায়েব থেকে সাহায্য করতে সক্ষম। যেমন হিজরতের সময় করা হয়, যখন তার আপন গোত্র ও দেশবাসী তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সফরসঙ্গী হিসেবে একমাত্র সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া আর কেউ ছিলনা। পদব্রজী ও অশ্বারোহী শক্ররা সর্বত্র তার খোঁজ করে ফিরছে। অথচ আশ্রয়স্থল কোন মজবুত দুর্গ ছিল না। বরং তা এক গিরী গুহা, যার দ্বারপ্রান্তে পর্যন্ত পৌছেছিল তার শক্ররা। তখন গুহা সঙ্গী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চিন্তা নিজের জন্য ছিল না, বরং তিনি এই ভেবে সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন যে, হয়তো শক্ররা তার বন্ধুর জীবন নাশ করে দেবে, কিন্তু সে সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পাহাড়ের মত অনড়, অটল ও নিশ্চিত।

শুধু যে নিজের তা নয়, বরং সফর সঙ্গীকেও অভয় দিয়ে বলছিলেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (অর্থাৎ তাঁর সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে।) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি গিরী গুহায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম। তখন আমি কাফেরদের পদশব্দ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি পা উচিয়ে দেখে তবে আমাদের দেখতে পাবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে দুজনের সাথে আল্লাহ তৃতীয়জন তাদের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা? [বুখারী: ১৭৭] [তাছাড়া পুরো ঘটনাটির জন্য দেখুন, সীরাতে ইবন হিশাম]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৪০) যদি তোমরা তাকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য না কর, তাহলে আল্লাহই (তাকে সাহায্য করবেন যেমন তিনি) তাকে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে, যখন অবিশ্বাসীরা তাকে (মক্কা হতে) বহিষ্কার করে দিয়েছিল, যখন সে ছিল দুজনের মধ্যে একজন; যখন উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল। সে তখন স্বীয় সঙ্গী (আবু বাকর)কে বলেছিল, ‘তুমি বিষণ্ণ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’[1] অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্ত্বনা অবতীর্ণ করলেন এবং এমন সেনাদল দ্বারা তাকে শক্তিশালী করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি[2] এবং তিনি অবিশ্বাসীদের বাক্য নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণীই সমুচ্চ রইল।[3] আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

[1] জিহাদ থেকে যারা পিছিয়ে থাকতে অথবা গা বাঁচাতে চায়, তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, যদি তোমরা সাহায্য না কর, তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ তাআলা নিজ নবীর মদদ সেই সময়ও করেছিলেন যখন তিনি সওর গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর তাঁর সঙ্গী (আবু বকর (রাঃ))-কে বলেছিলেন, ‘‘চিন্তা করো না আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’’ এর বিস্তারিত বর্ণনা হাদীস গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। হিজরতের ঘটনায় আবু বাকর (রাঃ) বলেন, যখন আমরা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন আমি নবী (সাঃ)-কে বলেছিলাম, ‘ঐ মুশরিকরা (যারা আমাদের পিছন ধরেছে তারা) যদি নিজেদের পায়ের নিচে তাকায়, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে দেখে নেবে।’ নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘হে আবু বাকর! তোমার সেই দুই ব্যক্তি সম্বন্ধে কি ধারণা, যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ?’’ অর্থাৎ, যাদের সাথে আল্লাহর সাহায্য ও মদদ রয়েছে। (বুখারীঃ সূরা তাওবার ব্যাখ্যা)

[2] এখানে সেই দুই প্রকার সাহায্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যার দ্বারা আল্লাহ তাঁর রসূল (সাঃ)-কে সাহায্য করেছিলেন। প্রথমতঃ হল প্রশান্তি বা সান্ত্বনা এবং দ্বিতীয়তঃ হল ফিরিশতাদের সহযোগিতা।

[3] অবিশ্বাসী কাফেরদের বাক্য বলতে শিরক, আর আল্লাহর বাণী বলতে তাওহীদ উদ্দেশ্য। যেমন, এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা রসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল ‘‘একজন বীরত্বের শক্তি প্রকাশ করার জন্য যুদ্ধ করে, একজন স্বগোত্রের অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করে যুদ্ধ করে, আর অন্য একজন লোক দেখানোর জন্য যুদ্ধ করে, এদের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কার হয়? তিনি বললেন, ‘‘যে আল্লাহর কালেমা (বাণী)-কে সুউচ্চ করার জন্য যুদ্ধ করে, তার যুদ্ধ আল্লাহর রাস্তায় হয়।’’

(বুখারীঃ ইলম অধ্যায়, মুসলিমঃ ইমারা অধ্যায়)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ৩১ থেকে ৪০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১২৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 · · · 10 11 12 13 পরের পাতা »