بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ২/ আল-বাকারা | Al-Baqara | سورة البقرة আয়াতঃ ২৮৬ মাদানী
২:২১ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾
یایها الناس اعبدوا ربکم الذی خلقکم و الذین من قبلکم لعلکم تتقون ۙ۲۱

হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। আল-বায়ান

হে মানুষ! ‘তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী (পরহেযগার) হতে পার’। তাইসিরুল

হে মানববৃন্দ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা ধর্মভীরু হও। মুজিবুর রহমান

O mankind, worship your Lord, who created you and those before you, that you may become righteous - Sahih International

২১. হে মানুষ(১)! তোমরা তোমাদের সেই রব-এর(২) ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববতীদেরকে সৃষ্টি করেছেন(৩), যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও(৪)।

১. আয়াতে উল্লেখিত ‘নাস’ আরবী ভাষায় সাধারণভাবে মানুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে পূর্বে আলোচিত মানব সমাজের মুমিন-কাফির ও মুনাফিক এ তিন শ্রেণীই এ আহবানের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তোমাদের রব-এর ইবাদাত কর। ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ নম্র ও অনুগত হওয়া আর শরীআতের পরিভাষায় ইবাদাত হচ্ছেঃ আল্লাহ্ তা'আলা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন এমন সব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের ব্যাপক একটি নাম। এ সমস্ত কথা ও কাজ পরিপূর্ণ ভালবাসা ও পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে আল্লাহর জন্য আদায় করলেই তা আমাদের পক্ষ থেকে ইবাদাত বলে গণ্য হবে।

সুতরাং আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত বিষয়ের ব্যাপারে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা সেসব কাজ বা কথা ভালবাসেন তার বাইরে কোন কিছুর মাধ্যমে আমরা তার ইবাদাত করতে পারব না। ইবাদাতের ভিত্তি তিনটি রুকনের উপর স্থাপিত। এক. আল্লাহ্ তা'আলার জন্য পরিপূর্ণ ভালবাসা পোষণ করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৬৫] দুই. পরিপূর্ণ আশা পোষণ করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “এবং তারা তার দয়া প্রত্যাশা করে”। [সূরা আলইসরাঃ ৫৭] তিন. আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে ভয় করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “এবং তারা তার শাস্তিকে ভয় করে”। [সূরা আল-ইসরাঃ ৫৭]

২. এ ক্ষেত্রে রব শব্দের পরিবর্তে আল্লাহ বা তার গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে অন্য যেকোন একটা ব্যবহার করা যেতে পারত, কিন্তু তা না করে রব শব্দ ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে, এখানে দাবীর সাথে দলীলও পেশ করা হয়েছে। কেননা, ইবাদাতের যোগ্য একমাত্র সে সত্তাই হতে পারে, যে সত্তা তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যিনি বিশেষ এক পালননীতির মাধ্যমে সকল গুণে গুনান্বিত করে মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করেছেন এবং পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকার সকল ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। মানুষ যত মূৰ্খই হোক এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি যতই হারিয়ে থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, পালনের সকল দায়িত্ব নেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

আর সাথে সাথে এ কথাও উপলব্ধি করতে পারবে যে মানুষকে অগণিত এ নেয়ামত না পাথর-নির্মিত কোন মূর্তি দান করেছে, না অন্য কোন শক্তি। আর তারা করবেই বা কিরূপে? তারা তো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বা বেঁচে থাকার জন্য নিজেরাই সে মহাশক্তি ও সত্তার মুখাপেক্ষী। যে নিজেই অন্যের মুখাপেক্ষী সে অন্যের অভাব কি করে দূর করবে? যদি কেউ বাহ্যিক অর্থে কারো প্রতিপালন করেও, তবে তাও প্রকৃতপ্রস্তাবে সে সত্তার ব্যবস্থাপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। এর সারমর্ম এই যে, যে সত্তার ইবাদাতের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্তা আদৌ ইবাদাতের যোগ্য নয়।

৩. এ আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম নির্দেশ, আর সে নির্দেশই হচ্ছে তাওহীদের। ইসলামের মৌলিক আকীদা তাওহীদ বিশ্বাস। যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গঠন করার একমাত্র উপায়। এটি মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, সকল সংকটে আশ্রয় দান করে এবং সকল দুঃখ-দুর্বিপাকের মর্মসাথী। তাওহীদ শব্দটি মাসদার বা মূলধাতু। যার অর্থ- কোন কিছুকে এক বলে জানা এবং ঘোষণা করা। সে অনুসারে আল্লাহর একত্ববাদ অর্থ- আল্লাহ যে এক তা ঘোষণা করা। শরীআতের পরিভাষায় তাওহীদ বলতে বুঝায় একথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহই একমাত্র মা’বুদ। তার কোন শরীক নাই। তার কোন সমকক্ষ নাই। একমাত্র তার দিকেই যাবতীয় ইবাদাতকে সুনির্দিষ্ট করা। তার যাবতীয় সুন্দর নাম ও গুণাবলী আছে বলে বিশ্বাস করা। এতে বুঝা গেল যে, তাওহীদ হলো আল্লাহকে রবুবিয়াত তথা প্রভূত্ত্বে, তার সত্তায়, নাম ও গুণে এবং ইবাদাতের ক্ষেত্রে একক সত্তা বলে স্বীকৃতি দেয়া। তাই এ তাওহীদ বিশুদ্ধ হতে হলে এর মধ্যে তিনটি অংশ অবশ্যই থাকতে হবে -

(১) আল্লাহর প্রভূত্বে ঈমান ও সে অনুসারে চলা। যা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ নামে খ্যাত।

(২) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে ঈমান আর সেগুলো তার জন্যই নির্দিষ্ট করা। যাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বলা হয়। আর

(৩) যাবতীয় ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা। যাকে তাওহীদুল উলুহিয়াহ’ও বলা হয়। এ তিন অংশের কোন অংশ বাদ পড়লে তাওহীদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা হবে না এবং দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি পাবে না।

৪. তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করলেই তাকওয়ার অধিকারী হওয়া যাবে নতুবা নয়। যাদের কর্মকাণ্ডে শির্ক রয়েছে, তারা যত পরহেযগার বা যত আমলই করুক না কেন তারা কখনো মুত্তাকী হতে পারবে না। তাই জীবনের যাবতীয় ইবাদাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেসভাবে করতে হবে। এটা জানার জন্য ইবাদাত ও শির্ক সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। যার আলোচনা সামনে আসবে।

তাফসীরে জাকারিয়া

২১। হে মানুষ সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের উপাসনা কর, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা পরহেযগার (ধর্মভীরু) হতে পার।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২২ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾
الذی جعل لکم الارض فراشا و السماء بناء و انزل من السماء ماء فاخرج بهٖ من الثمرت رزقا لکم ۚ فلا تجعلوا لله اندادا و انتم تعلمون ۲۲

যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিয্কস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। আল-বায়ান

যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ ক’রে তদ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন, কাজেই জেনে বুঝে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করো না। তাইসিরুল

যিনি তোমাদের জন্য ভূতলকে শয্যা ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্বারা তোমাদের জন্য উপজীবিকা স্বরূপ ফলপুঞ্জ উৎপাদন করেন, অতএব তোমরা আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করনা এবং তোমরা এটা অবগত আছ। মুজিবুর রহমান

[He] who made for you the earth a bed [spread out] and the sky a ceiling and sent down from the sky, rain and brought forth thereby fruits as provision for you. So do not attribute to Allah equals while you know [that there is nothing similar to Him]. Sahih International

২২. যিনি যমীনকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আসমানকে করেছেন ছাদ এবং আকাশ হতে পানি অবতীর্ণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন। কাজেই তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ(১) দাঁড় করিও না।

১. আয়াতে উল্লেখিত أنداد শব্দটি ند এর বহুবচন। যার অর্থ সমকক্ষ স্থির করা। এখানে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এ সমকক্ষ স্থির করাটাই শির্ক। আর শির্ক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গোনাহ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, অথচ তিনি সৃষ্টি করেছেন... [বুখারীঃ ৪৪৭৭]

শির্কের প্রকারভেদঃ শির্ক দু'প্রকার, যথা- বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। বড় শির্ক আবার দু'প্রকার। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বে শির্ক করা। আল্লাহর উলুহিয়াত তথা ইবাদাতে শির্ক করা।

আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রভূত্বে শির্ক দু’ভাবে হয়ে থাকে -

১) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার না করা যেমন কম্যুনিষ্ট, নাস্তিক, মুলহিদ ইত্যাদি সম্প্রদায়। আল্লাহর নাম, গুণ ও কর্মকাণ্ডকে স্বীকার না করা, যেমন- ঈসমাঈলী সম্প্রদায়, বাহাই সম্প্রদায়, বুহরা সম্প্রদায়, জাহমিয়া ও মু'তাজিলা সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে পার্থক্য না করে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক করে দেখা যেমন ওয়াহদাতুল অজুদে বিশ্বাসী সম্প্রদায়, যারা মনে করে যে, আল্লাহ কোন কিছুর সূরত ইখতিয়ার করে তাতে নিজেকে প্রকাশ করেন যেমন, হুলুলী সম্প্রদায় এবং যারা বিশ্বাস করে যে, কারো পক্ষে আল্লাহর সাথে একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব।

২) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর সত্তা, নাম, গুণাবলী ও তাঁর কর্মকাণ্ডে কাউকে সমকক্ষ নির্ধারণ করা।

ক) আল্লাহর স্বত্ত্বার সমকক্ষ কোন সত্তা নির্ধারণ করার মত কোন শির্ক বনী আদমের মধ্যে বিরল। এ ধরণের দাবী প্রথম নমরূদ করেছিল, কিন্তু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে বিতর্কে সে তার সে দাবীর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে হেরে গিয়েছিল। অনুরূপভাবে ফিরআউনও প্রকাশ্যে এ ধরণের দাবী করেছিল। আল্লাহ তাকে স্বপরিবারে দলবলসহ ধ্বংস করে তার দাবীর অসারতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

খ) আল্লাহর নামসমূহের কোন নাম অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করার মত শির্ক বিভিন্ন জাতিতে বিদ্যমান। যারাই তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহ্‌র নামের মত নাম দেয় তারাই এ ধরণের শির্কে লিপ্ত। যেমন হিন্দুগণ তাদের বিভিন্ন অবতারকে আল্লাহর নামসমূহের মত নাম দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে কোন কোন বাতেনী গ্রুপের লোকেরা যেমন, দ্রুজ সম্প্রদায়, নুসাইরী সম্প্রদায়, আগাখানী ঈসমাঈলী সম্প্রদায় তাদের ঈমামদেরকে আল্লাহর নামসমূহে অভিহিত করে।
গ) আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডকে অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডের কোন শেষ নেই। সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। আল্লাহর অপার শক্তির সাথে সম্পৃক্ত, তাঁর জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত এবং হুকুম ও শরীআতের সাথে সম্পৃক্ত।

১. আল্লাহর অপার শক্তির সাথে যারা শির্ক করে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি, মৃত্যু, জীবন, বিপদাপদ থেকে উদ্ধার, উদ্দেশ্য হাসিলকারী বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুফীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে থাকে। অনুরূপভাবে অনেকে কবরবাসী কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে জাদুকর জাতীয় লোকদের সম্পর্কেও এ ধরণের বিশ্বাস করে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে এ ধরণের বিশ্বাস করে।

২. আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুকীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে যে তারা গায়েব জানে। আবার অনেকে কবরবাসী কোন কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে গণক, জ্যোতিষ, জীন, প্রেতাত্মা, ইত্যাদীতে বিশ্বাস করে যে, তারাও গায়েব জানে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানতো।

৩. আল্লাহর শরীআত ও হুকুমের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহর মত শরীআত প্রবর্তনের অধিকার তাদের আলেম ও শাসকদের দিয়ে থাকে। যেমন, ঐ সমস্ত জাতি যারা সরকার বা পার্লামেন্টকে আল্লাহর আইন বিরোধী আইন করে তদস্থলে অন্য আইনে বিচার করা শ্রেয় বা জায়েয বা আল্লাহর আইন ও অন্যান্য আইন সমমানের মনে করে থাকে। শির্কের এ সমস্ত প্রকার আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বের সাথে সম্পৃক্ত।

আল্লাহর ইবাদাতে শির্কঃ আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক বলতে বুঝায়, আল্লাহ যা কিছু ভালবাসেন সন্তুষ্ট হন বান্দার এমন সব কথা ও কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা। যেমন আল্লাহ্ তাঁর কাছে দোআ করা ভালবাসেন, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া ভালবাসেন, তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা ভালবাসেন, তাঁর কাছে পরিপূর্ণভাবে বিনয়ী হওয়া ভালবাসেন, তাঁর জন্যই সিজদা, রুকু, সালাত, যবেহ, মানত ইত্যাদী ভালবাসেন। এর কোন কিছু যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করে তবে তা হবে আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক। অন্য কারো কাছে পরিপূর্ণ আশা করলে, অন্য কাউকে গোপন ভয় করলেও তা শির্ক হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু বান্দার ইবাদাতসমূহ বিশ্বাস, কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে, সে হিসাবে ইবাদতের মধ্যেও এ তিন ধরণের শির্ক পাওয়া যায়। অর্থাৎ কখনো কখনো ইবাদত হয় মনের ইচ্ছার মাধ্যমে, আন্তরিক আনুগত্যের মাধ্যমে, আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয় বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয়ে থাকে কথাবার্তার মাধ্যমে।

দ্বিতীয় প্রকার শির্ক হলোঃ ছোট শির্ক, কিন্তু তাও কবীরাগুনাহ হতে মারাত্মক। ছোট শির্কের উদাহরণ হলো, এ প্রকার বলা যে, কুকুর না ডাকলে চোর আসত, আপনি ও আল্লাহ যা চান, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা, সামান্য লোক দেখানোর জন্য কোন কাজ করা। ইত্যাদি। [ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়ায়িশ শাফী', শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সুলাইমান আততামীমী, আল-ওয়াজিবুল মুতাহাত্তিমাতুল মারিফাহ'; আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত]

তাফসীরে জাকারিয়া

২২। যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ সরূপ সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ ক’রে তার দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেছেন। সুতরাং জেনে শুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করো না।

হিদায়াত এবং গুমরাহীর দিক দিয়ে মানুষের তিনটি দলের কথা উল্লেখ করার পর মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর ইবাদতের প্রতি আহবান প্রত্যেক মানুষকে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যখন তোমাদের ও সারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা আল্লাহ, তোমাদের সমস্ত প্রয়োজনের ব্যবস্থাপক তিনিই, তখন তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত কেন কর? অন্যকে তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন কেন কর? যদি তোমরা আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে চাও, তাহলে তার একটাই উপায় এই যে, তোমরা আল্লাহকে একক মেনে নিয়ে কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং জেনে-শুনে শির্ক করো না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৩ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُهَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۳﴾
و ان کنتم فی ریب مما نزلنا علی عبدنا فاتوا بسورۃ من مثلهٖ و ادعوا شهداءکم من دون الله ان کنتم صدقین ۲۳

আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। আল-বায়ান

আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরাহ এনে দাও আর তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর। তাইসিরুল

এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তোমরা তাতে সন্দিহান হও তাহলে তৎসদৃশ একটি ‘‘সূরা’’ আনয়ন কর এবং তোমাদের সেই সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যারা আল্লাহ হতে পৃথক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও! মুজিবুর রহমান

And if you are in doubt about what We have sent down upon Our Servant [Muhammad], then produce a surah the like thereof and call upon your witnesses other than Allah, if you should be truthful. Sahih International

২৩. আর আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর(১) এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী সাহায্যকারীকে(২) আহবান কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও(৩)।

১. পূর্ববর্তী আয়াতে তাওহীদ প্রমাণ করা হয়েছিল। আর এ আয়াত ও পরবর্তী আয়াতে নবুওয়ত ও রিসালাতের সত্যতা সাব্যস্ত করা হচ্ছে। [ইবনে কাসীর]

২. شُهَدَاء শব্দের ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, أعْوَنُكُمْ বা সাহায্যকারীগণ। অর্থাৎ এমন সম্প্রদায় আহবান কর যারা তোমাদেরকে এ ব্যপারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে। আবু মালেক বলেন, এর অর্থ, شُرَكَاءَكُمْ তোমাদের অংশীদারদেরকে বা যাদেরকে তোমরা আমার সাথে শরীক করছ সে শরীকদেরকে আহবান করে দেখ তারা কি এর অনুরূপ কোন সূরা আনতে পারে কি না? মুজাহিদ বলেন, شُهَدَاء শব্দটি এখানে সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এমন লোকদের আহবান করে নিয়ে আস যারা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য হবে যে, আল্লাহর কালামের বিপরীতে যা নিয়ে আসবে তা আল্লাহর কালামের মত হয়েছে। ভাষাবিদদের সাক্ষ্য এর সাথে যোগ করে দাও।

পবিত্র কুরআনে এ চ্যালেঞ্জ বিভিন্ন স্থানে এসেছে। মক্কী সূরায়ও এমন চ্যালেঞ্জ এসেছিল। বলা হয়েছে, “এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সমর্থক এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। তারা কি বলে, তিনি এটা রচনা করেছেন? বলুন, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও [সূরা ইউনুস ৩৭-৩৮) তারপর মদীনায় নাযিল হওয়া সূরাসমূহেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল বাকারাহ এর আলোচ্য আয়াত। [ইবনে কাসীর]

৩. কুরআন নিয়ে যারাই গবেষণা করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, এর ভাষাগত বাহ্যিক রূপ ও মর্মগত আত্মিক স্বরূপ উভয় দিক দিয়েই এটা অতুলনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, “আলিফ-লাম-রা, এ কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের কাছ থেকে; এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত।” [সূরা হুদঃ ১] সুতরাং কুরআনের ভাষা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও তার মর্ম সূদুরপ্রসারী ও ব্যাপক। ভাব ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তা অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। সব সৃষ্টিজগত তার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তাতে একদিকে যেমন অতীতের ইতিহাস উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীও সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। ন্যায় অন্যায় ও ভালো মন্দ সম্পর্কিত সব কিছুই সুনিপুণভাবে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাই আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করলেন, “সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আন’আম: ১১৫] অর্থাৎ যে সমস্ত সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত| আর যে সমস্ত বিধান দিয়েছেন বিধানদাতা হিসেবে সেগুলোর ন্যায়পরায়ণতা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রতিটি বিষয়ই সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি ও পথের দিশারী। এতে কোন ধারণাপ্রসূত কথা, রূপকথা কিংবা কাল্পনিক গালগল্প ও মিথ্যাচার যা সাধারণত কবিদের কাব্যে পাওয়া যায়, এতে এর বিন্দুমাত্র ছোয়াও নেই।

কুরআনের মজীদের পুরোটাই হচ্ছে উচ্চাঙ্গের কথামালা। অনন্য ভাষাশৈলীতা এবং হৃদয়স্পশী উপমায় ভরপুর। আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষীরাই কেবল কুরআনের ভাষারীতি ও ভাব সম্পদের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। কুরআন যখন কোন খবর প্রকাশ করে, হোক তা বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত, আবার তা যদি একবারের জায়গায় বারবারও বলা হয়, তথাপি তার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না। যতই পাঠ করবে ততই যেন অজানা এক স্বাদে মন উত্তরোত্তর উদ্বেলিত হয়েই চলবে। তার বারবার পাঠ করলে যেমন সাধারণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। তেমনি অসাধারণ পাঠকরাও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন না।

আল-কুরআনের ভীতি প্রদর্শনমূলক আয়াত ও কঠোর সতর্কবাণী ভালো করে অনুধাবন করলে কঠিন মানুষ তো দূরের কথা পাহাড় পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকে। অনুরূপভাবে তার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণ দেখলে ও হৃদয়ঙ্গম করলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়, অবরুদ্ধ শ্রবণশক্তি প্রত্যাশার পদ-ধ্বনি শুনতে পায়। আর মৃত মন ইসলামের অমিত শরবত পানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এসব কিছু মিলে অজান্তে হৃদয়ে শান্তিধাম জান্নাতের প্রতি আগ্রহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আর মহান আল্লাহর আরশের কাছে থাকার তীব্র আকাংখা জাগ্রত হয়।

এ কুরআনের বিষয় বৈচিত্র আশ্চর্যজনক। ভাষার অলংকারের ঔজ্জ্বল্য, নসীহতের প্রাচুর্য, হাজারো যুক্তি প্রমাণ ও তত্ত্বজ্ঞানের আধিক্য কুরআনকে গ্রন্থ জগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। বিধিনিষেধের বাণীসমূহকে অত্যন্ত ন্যায়ানুগ, কল্যাণকর, আকর্ষণীয় ও প্রভাবময় করা হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ অনেক প্রাচীন মনীষী বলেছেন (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا) শোনার সাথে সাথে মনোযোগের সাথে কান পেতে পরবর্তী বক্তব্য শোন। কারণ, তারপর হয়ত কোন কল্যাণের পথে আহবান থাকবে, না হয় কোন অকল্যাণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ ঘোষিত হবে। [ইবন কাসীর]

আর যদি আল-কুরানে কিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ চিত্র, চির সুখের জান্নাতের নেয়ামতরাজি, জাহান্নামের চিরন্তন দুর্ভোগের বিবরন, নেককারদের লোভনীয় পুরস্কার আর গুনাহগারদের নানা রকম ভয়াবহ শাস্তি, দুনিয়ার সম্পদ ও সুখ সম্ভোগের অসারতা ও পারলৌকিক জীবনের সুখ সম্ভোগের অবিনশ্বরতা সংক্রান্ত আলোচনার দিকে দৃষ্টি দেয়া যায় তবে তা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ও কল্যাণমূলক আলোচনায় সমৃদ্ধ। এসব বর্ণনা মানুষকে বার বার ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করে, মনকে ভয়ে বিগলিত করে এবং শয়তানের প্ররোচণায় জমানো অন্তরের কালি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

 আল-কুরআনের এ ধরনের অবিস্মরণীয় ও আশ্চর্যজনক মু'জিযার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষের ঈমান আনার জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু'জিযা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী হচ্ছে আমার মু'জিযা। আমি আশা করি কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে।” [বুখারী ৪৯৮১, মুসলিম: ১৫২] কারণ, প্রত্যেক নবীর মু'জিযা তাদের ইন্তেকালের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কুরআনুল করীম কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় বর্তমান থাকবে। সৰ্বকালের মানুষের কাছে অবিসংবাদিত হিসেবে থাকবে। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৩। আমি আমার দাসের প্রতি (মুহাম্মাদের প্রতি) যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর, এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী (এ কাজে সহযোগী উপাস্যদের)কে আহবান কর।

তাওহীদের পর এবারে রিসালাতের প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমি আমার বান্দার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, সেটা যে আল্লাহরই পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা তোমাদের সকল সহযোগীদের সাথে নিয়ে এই ধরনের কোন একটি সূরা রচনা করে দেখিয়ে দাও! আর যদি এ রকম করতে না পার, তাহলে জেনে নিও যে, বস্ত্ততঃ এ বাণী কোন মানুষের প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর বাণী। তোমাদের উচিত, আল্লাহর কালাম এবং রসূলের রিসালাতের উপর ঈমান এনে সেই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চেষ্টা করা, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৪ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲۴﴾
فان لم تفعلوا و لن تفعلوا فاتقوا النار التی وقودها الناس و الحجارۃ ۚۖ اعدت للکفرین ۲۴

অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। আল-বায়ান

যদি তোমরা না পার এবং কক্ষনো পারবেও না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যা প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য। তাইসিরুল

অতঃপর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনও করতে পারবেনা, তাহলে তোমরা সেই জাহান্নামের ভয় কর যার খোরাক মনুষ্য ও প্রস্তর খন্ড - যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মুজিবুর রহমান

But if you do not - and you will never be able to - then fear the Fire, whose fuel is men and stones, prepared for the disbelievers. Sahih International

২৪. অতএব যদি তোমরা তা করতে না পার আর কখনই তা করতে পারবে না(১), তাহলে তোমরা সে আগুন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর(২), যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে(৩) কাফেরদের জন্য।

১. এটা কুরআনের বিশেষ মু'জিযা। একমাত্র কুরআনই নিঃসংকোচে সর্বকালের জন্য নিজ স্বীকৃত সত্তার এভাবে ঘোষণা দিতে পারে। যেভাবে রাসূলের যুগে কেউ এ কুরআনের মত আনতে পারে নি। তেমনি কুরআন এ ঘোষণাও নিঃশঙ্ক ও নিঃসংকোচে দিতে পেরেছে যে, যুগের পর যুগের জন্য, কালের পর কালের জন্য এই চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হচ্ছে যে, এ কুরআনের মত কোন কিতাব কেউ কোন দিন আনতে পারবে না। অনুরূপই ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। রাসূলের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ এ কুরআনের মত কিছু আনার দুঃসাহস দেখাতে পারে নি। আর কোনদিন পারবেও না। গোটা বিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তা তার কথার সমকক্ষ কোন কথা কি কোন সৃষ্টির পক্ষে আনা সম্ভব?

২. ইবনে কাসীর বলেন, এখানে পাথর দ্বারা কালো গন্ধক পাথর বোঝানো হয়েছে। গন্ধক দিয়ে আগুন জ্বালালে তার তাপ ভীষণ ও স্থায়ী হয়। আসমান যমীন সৃষ্টির সময়ই আল্লাহ্ তা'আলা কাফেরদের জন্য তা সৃষ্টি করে প্রথম আসমানে রেখে দিয়েছেন। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে ঐ সমস্ত পাথর উদ্দেশ্য, যেগুলোর ইবাদাত করা হয়েছে। [ইবনে কাসীর] আর জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, “তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ এক ভাগ দিয়ে শাস্তি দিলেই তো যথেষ্ট হতো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, জাহান্নামের আগুন তোমাদের আগুনের তুলনায় উনসত্তর গুণ বেশী উত্তপ্ত [বুখারী ৩২৬৫, মুসলিম: ২৪৮৩]

৩. এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা হচ্ছে, জাহান্নাম কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখানে أُعِدَّتْ এর সর্বনামটির ইঙ্গিত সুস্পষ্টতই মানুষ ও পাথর দ্বারা প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের দিকে। অবশ্য এ সর্বনামটি পাথরের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়ায়, পাথরগুলো কাফেরদের শাস্তি প্রদানের জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে অনুরূপ তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উভয় অর্থের মধ্যে বড় ধরনের কোন তফাৎ নেই। একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগুন বিহীন যেমন পাথর জ্বলে না, তেমনি পাথর বিহীন আগুনের দাহ্য ক্ষমতাও বাড়ে না। সুতরাং উভয় উপাদানই কাফেরদের কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আয়াতের এ অংশ দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ দলীল নেন যে, জাহান্নাম বর্তমানে তৈরী করা অবস্থায় আছে। জাহান্নাম যে বাস্তবিকই বর্তমানে রয়েছে তার প্রমাণ অনেক হাদীস দ্বারা পাওয়া যায়। যেমন, জাহান্নাম ও জান্নাতের বিবাদের বর্ণনা সংক্রান্ত হাদীস [বুখারী ৪৮৪৯, মুসলিম: ২৮৪৬] , জাহান্নামের প্রার্থনা মোতাবেক তাকে বছরে শীত ও গ্রীষ্মে দুই বার শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণের অনুমতি প্রদানের বর্ণনা [বুখারী ৫৩৭, মুসলিম: ৬৩৭] ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক হাদীসে আছে, “আমরা একটি বিকট শব্দ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার কারণ জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, এটা সত্তর বছর পূর্বে জাহান্নামের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত পাথর জাহান্নামে পতিত হওয়ার আওয়ায। (মুসলিম: ২৮৪৪, মুসনাদে আহমাদ ২/৪৭১] তাছাড়া সূর্যগ্রহণের সালাত এবং মিরাজের রাত্রির ঘটনাবলীও প্রমাণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টিই তৈরী করে রাখা হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৪। যদি তোমরা তা (আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, (1) তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, (2) অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে। (3)

(1) ক্বুরআন কারীমের সত্যতার এটি আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে, আরব (আরবী ভাষা-ভাষী) ও অনারব (যাদের ভাষা আরবী নয়) সকল কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ্ করা হয়েছে। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জের জওয়াব দিতে অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অপারগই থাকবে।

(2) ইবনে আববাস (রাঃ)-এর উক্তি অনুযায়ী পাথর বলতে এখানে গন্ধক জাতীয় পাথরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যদের নিকট পাথরের সেই মূর্তিগুলোও জাহান্নামের ইন্ধন হবে, দুনিয়াতে পৌত্তলিকরা যাদের পূজা করত। যেমন ক্বুরআন মাজীদে আছে,

{إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ} & তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের পূজা করো, সেগুলো দোযখের ইন্ধন। (আম্বিয়া ৯৮ আয়াত)

(3) এ থেকে প্রথমতঃ জানা গেল যে, প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম কাফের (অবিশ্বাসী) এবং মুশরিক (অংশীবাদী)-দের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়তঃ জানা গেল যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব আছে এবং এখনোও তা বিদ্যমান রয়েছে। সালফে-সালেহীনদের এটাই আক্বীদা (বিশ্বাস)। এটা কেবল উপমা বা দৃষ্টান্তমূলক কোন জিনিস নয়; যেমন অনেক আধুনিকতাবাদী ও হাদীস অস্বীকারকারীরা বোঝাতে চায়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৫ وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵﴾
و بشر الذین امنوا و عملوا الصلحت ان لهم جنت تجری من تحتها الانهر کلما رزقوا منها من ثمرۃ رزقا ۙ قالوا هذا الذی رزقنا من قبل ۙ و اتوا بهٖ متشابها و لهم فیها ازواج مطهرۃ ٭ۙ و هم فیها خلدون ۲۵

যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোন ফল খেতে দেয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটাই তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী। আল-বায়ান

যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তাদেরকে যখনই ফলমূল খেতে দেয়া হবে, তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে পূর্বে জীবিকা হিসেবে যা দেয়া হতো, এতো তারই মতো। একই রকম ফল তাদেরকে দেয়া হবে এবং সেখানে রয়েছে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিণী, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। তাইসিরুল

এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎ কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর যে, তাদের জন্য এমন জান্নাত রয়েছে যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে; যখনই সেখানে তাদেরকে খাবার হিসাবে ফলপুঞ্জ প্রদান করা হবে তখনই তারা বলবেঃ আমাদেরতো এটা পূর্বেই প্রদত্ত হয়েছিল, বস্তুতঃ তাদেরকে একই সদৃশ ফল প্রদান করা হবে, এবং তাদের জন্য তন্মধ্যে শুদ্ধা সহধর্মিনীগণ রয়েছে, এবং তন্মধ্যে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। মুজিবুর রহমান

And give good tidings to those who believe and do righteous deeds that they will have gardens [in Paradise] beneath which rivers flow. Whenever they are provided with a provision of fruit therefrom, they will say, "This is what we were provided with before." And it is given to them in likeness. And they will have therein purified spouses, and they will abide therein eternally. Sahih International

২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদেরকে শুভ সংবাদ দিন যে, তাদের জুন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত(১)। যখনই তাদেরকে ফলমূল খেতে দেয়া হবে তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে - পূর্বে জীবিকা হিসেবে যা দেয়া হত এতো তাই’। আর তাদেরকে তা দেয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করেই(২) এবং সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গিনী(৩)। আর তারা সেখানে স্থায়ী হবে।(৪)

১. 'জান্নাতের তলদেশে নদী প্রবাহিত’ বলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, এর গাছের নীচ দিয়ে ও এর কামরাসমূহের নীচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জান্নাতের নদী-নালাসমূহ মিশকের পাহাড় থেকে নির্গত। [সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭৪০৮] আনাস ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, 'জান্নাতের নহরসমূহ খাদ হয়ে প্রবাহিত হবে না। [সহীহুত তারগীব] অন্য বর্ণনায় এসেছে, হাউজে কাউসারের দুই তীর লালা-মোতির গড়া বিরাট গম্বুজ বিশিষ্ট হবে। [বুখারী: ৬৫৮১] আর তার মাটি হবে মিশকের সুগন্ধে ভরপুর। তার পথে বিছানো কাঁকরগুলো হলো লাল-জহরত, পান্না-চুন্নি সদৃশ। [ইবনে কাসীর]

২. জান্নাতবাসীদেরকে একই আকৃতি বিশিষ্ট বিভিন্ন ফলমূল পরিবেশনের উদ্দেশ্য হবে পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চার। কোন কোন তাফসীরকারের মতে ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ জান্নাতের ফলাদি আকৃতিগতভাবে ইহজগতে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপই হবে। সেগুলো যখন জান্নাতবাসীদের মধ্যে পরিবেশন করা হবে, তখন তারা বলে উঠবে, অনুরূপ ফল তো আমরা দুনিয়াতেও পেতাম। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। অপর কোন কোন তাফসীরকারকের মতে, ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ, জান্নাতে পরিবেশিত ফল-মূলাদি দেখে জান্নাতিগণ বলবে যে, এটা তো গতকালও আমাদের দেয়া হয়েছে, তখন জান্নাতের খাদেমগণ তাদের বলবে যে, দেখতে একই রকম হলেও এর স্বাদ ভিন্ন। ইবনে আব্বাস বলেন, দুনিয়ার ফলের সংগে আখেরাতের ফল-মূলের কোন তুলনাই চলবে না, শুধু নামের মিল থাকবে। [ইবনে কাসীর]

৩. মূল আরবী বাক্যে ازواج ‘আযওয়াজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর এক বচন হচ্ছে زوج ‘যওজ’, অর্থ হচ্ছে জোড়া। এ শব্দটি স্বামী বা স্ত্রী অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’! আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে আযওয়াজ অর্থাৎ জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। জান্নাতে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্ত্রী লাভের অর্থ, তারা হবে পার্থিব যাবতীয় বাহ্যিক ও গঠনগত ক্রটি-বিচূতি ও চরিত্রগত কলুষতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং প্রস্ৰাব-পায়খানা, রজঃস্রাব, প্রসবোত্তর স্রাব প্রভৃতি যাবতীয় ঘৃণ্য বিষয়ের উর্ধ্বে। অনুরূপভাবে নীতিভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ ক্রটি ও কদৰ্যতার লেশমাত্রও তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতে এসেছে যে, “তাদের সংগে থাকবে আয়তনয়না, ডাগর চোখ বিশিষ্টাগণ” [সূরা আস-সাফফাত: ৪৮]

আরও বলা হয়েছে, “তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবাল” [সূরা আর-রহমান: ৫৮] আরও এসেছে, “আর তাদের জন্য থাকবে ডাগর চক্ষুবিশিষ্টা হুর, যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা [সূরা আল-ওয়াকি'আ: ২২-২৩) অনুরূপভাবে এসেছে, “আর সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী” [সূরা আন-নাবা ৩৩] যদি দুনিয়ার কোন সৎকর্মশীল পুরুষের স্ত্রী সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ঐ সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা এবং তার স্বামী হয় অসৎ, তাহলে আখেরাতে ঐ অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন সৎ পুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সৎকর্মশীল হয়, তাহলে আখেরাতে তাদের এই সম্পর্কটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।

৪. বলা হয়েছে যে, জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহকে যেন দুনিয়ার পতনশীল ও ক্ষীয়মান উপকরণসমূহের ন্যায় মনে না করা হয় যাতে যেকোন মূহুর্তে ধ্বংস ও বিলুপ্তির আশংকা থাকে। বরং জান্নাতবাসীগণ অনন্তকাল সুখস্বাচ্ছন্দ্যের এই অফুরন্ত উপকরণসমূহ ভোগ করে বিমল আনন্দ-স্ফূর্তি ও চরম তৃপ্তি লাভ করতে থাকবেন। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৫। যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে(1) তাদেরকে শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত; যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, যখনই তাদের ফলমূল খেতে দেওয়া হবে, তখনই তারা বলবে, ‘আমাদেরকে (পৃথিবীতে অথবা জান্নাতে) পূর্বে জীবিকারূপে যা দেওয়া হত, এ তো তাই।’ তাদেরকে পরস্পর একই সদৃশ ফল(2) দান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র(3) সহধর্মিণীগণ রয়েছে, অধিকন্তু তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। (4)

(1) ক্বুরআন কারীম প্রত্যেক স্থানে বিশ্বাস তথা ঈমানের সাথে সাথে সৎকর্ম তথা নেক আমলের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, ঈমান এবং নেক আমল পরস্পর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেক আমল ব্যতীত ঈমান ফলপ্রসূ নয় এবং আল্লাহর নিকট ঈমান ছাড়া নেক আমলের কোন গুরুত্ব নেই। আর নেক আমল তখনই নেক আমল বলে গণ্য হবে, যখন তা সুন্নত (নবী (সাঃ)-এর তরীকা) অনুযায়ী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য খাঁটি নিয়তে করা হবে। সুন্নত পরিপন্থী আমল গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ খ্যাতি লাভ ও লোক দেখানোর জন্য কৃত আমলও প্রত্যাখ্যাত।

(2) مُتَشَابِهًا (সদৃশ)এর অর্থ হয়তো বা জান্নাতের সমস্ত ফলের আকার-আকৃতি এক রকম হবে অথবা তা দুনিয়ার ফলের মত দেখতে হবে। তবে এ সাদৃশ্য কেবল আকার ও নাম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। নচেৎ জান্নাতের ফলের সবাদের সাথে দুনিয়ার ফলের সবাদের কোন তুলনাই নেই। জান্নাতের নিয়ামতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, (এমন নিয়ামত) যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তার সঠিক ধারণা উদয় হয়নি। (সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরা আলিফ-লাম-মীম সাজদাহ)

(3) অর্থাৎ, মাসিক, নিফাস (প্রসবোত্তর রক্ত) এবং অন্যান্য ঘৃণিত জিনিস থেকে পবিত্রা হবে।

(4) خَالِدِين এর অর্থ চিরস্থায়ী। জান্নাতবাসীরা জান্নাতে চিরকাল থাকবে এবং তারা বড়ই প্রফুল্ল থাকবে। আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে এবং তারা বড় কষ্টে বাস করবে। হাদীসে এসেছে যে, জান্নাতীরা জান্নাতে ও জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাওয়ার পর একজন ফিরিশতা ঘোষণা দেবেন, হে জাহান্নামবাসীগণ! আর মৃত্যু নেই। আর হে জান্নাতবাসীগণ! আর মৃত্যু নেই। যে দল যে অবস্থায় আছে, সব সময় ঐ অবস্থাতেই থাকবে। (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিক্বাক্ব, মুসলিম, কিতাবুল জান্নাহ)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৬ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِهٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿ۙ۲۶﴾
ان الله لا یستحیٖ ان یضرب مثلا ما بعوضۃ فما فوقها فاما الذین امنوا فیعلمون انه الحق من ربهم ۚ و اما الذین کفروا فیقولون ما ذا اراد الله بهذا مثلا ۘ یضل بهٖ کثیرا ۙ و یهدی بهٖ کثیرا و ما یضل بهٖ الا الفسقین ۙ۲۶

নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন। আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন। আল-বায়ান

নিশ্চয় আল্লাহতো মশা অথবা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কোন বস্তুর উদাহরণ দিতে লজ্জাবোধ করেন না; অতএব যারা ঈমানদার তারা জানে যে, এ সত্য তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে, কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তারা বলে যে, আল্লাহ কী উদ্দেশ্যে এ উদাহরণ পেশ করেছেন? (আসল ব্যাপার হল) তিনি এর দ্বারা অনেককেই বিভ্রান্ত করেন, আবার অনেককেই সৎপথে পরিচালিত করেন। বস্তুতঃ তিনি ফাসিকদের ছাড়া আর কাউকেও বিভ্রান্ত করেন না। তাইসিরুল

নিশ্চয়ই আল্লাহ মশা অথবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে লজ্জাবোধ করেননা। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারাতো বিশ্বাস করবে যে, এ উপমা তাদের রবের পক্ষ হতে খুবই স্থানোপযোগী হয়েছে, আর যারা কাফির সর্বাবস্থায় তারা এটাই বলবে যে, এ সব নগণ্য বস্ত্তর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কি? তিনি এর দ্বারা অনেককে বিপথগামী করেন এবং এর দ্বারা অনেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, আর এর দ্বারা তিনি শুধু ফাসিকদেরকেই বিপথগামী করে থাকেন। মুজিবুর রহমান

Indeed, Allah is not timid to present an example - that of a mosquito or what is smaller than it. And those who have believed know that it is the truth from their Lord. But as for those who disbelieve, they say, "What did Allah intend by this as an example?" He misleads many thereby and guides many thereby. And He misleads not except the defiantly disobedient, Sahih International

২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মশা কিংবা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কোন বস্তুর উপমা দিতে সংকোচ বোধ করেন না(১)। অতঃপর যারা ঈমান এনেছে তারা জানে যে, নিশ্চয় এটা (২) তাদের রব-এর পক্ষ হতে সত্য। কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা বলে যে, আল্লাহ কি উদ্দেশ্যে এ উপমা পেশ করেছেন? এর দ্বারা অনেককেই তিনি বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে হেদায়াত করেন। আর তিনি ফাসিকদের ছাড়া আর কাউকে এর দ্বারা বিভ্রান্ত করেন না(৩)

১. কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাবে মাকড়সা ও মাছি উদাহরণ পেশ করার পর মুশরিকরা বলাবলি করল যে, মাকড়সা ও মাছি কি উল্লেখযোগ্য কিছু? তখন আল্লাহ্ তা'আলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আবুল আলীয়া বলেন, মশার উদাহরণ দেয়ার মধ্যে যৌক্তিকতা হচ্ছে, এ সমস্ত কাফের মুশরিক ও মুনাফিকদের যখন আয়ু শেষ হয়ে যায় এবং সময় নিঃশেষ হয়ে যায় তখন তারা মশার মত প্রাণীতে পরিণত হয়। কারণ, মশা পেট ভরলে মরে যায়, আর যতক্ষণ ক্ষুধা থাকে বেঁচে থাকে। অনুরূপভাবে এ সমস্ত কাফের-মুশরিক ও মুনাফিকরা যাদের জন্য উদাহরণ পেশ করা হয়েছে তারাও দুনিয়ার জীবিকা শেষ করার পর আল্লাহ শক্ত হাতে তাদের পাকড়াও করবেন এবং তাদের ধ্বংস করবেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

২.  অর্থাৎ ঈমানদাররা নিশ্চিত জানে যে, এ উপমা প্রদান করা হক্ বা যথাযথ। অথবা এর অর্থ, তারা জানে যে, এটা আল্লাহর বাণী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে হক হিসেবে তাদের কাছে এসেছে। [তাবারী]

৩. অর্থাৎ তারা ফাসেক বা অবাধ্য হওয়াতেই তাদের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছেন। কেউ খারাপ পথে চলতে চাইলে আল্লাহ তাকে সে পথে চলতে দেন।

তাফসীরে জাকারিয়া

২৬। আল্লাহ মশা কিংবা তার থেকে উচ্চ (অথবা ক্ষুদ্র) পর্যায়ের কোন বস্তুর উদাহরণ দিতে লজ্জাবোধ করেন না, (1) সুতরাং যারা মুমিন (বিশ্বাসী) তারা জানে যে, এ উদাহরণ তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সত্য; কিন্তু যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে তারা বলে যে, আল্লাহ কি অভিপ্রায়ে এমন একটি উদাহরণ দিয়েছেন? এতদ্বারা তিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করেন আবার বহু জনকে সৎপথে পরিচালিত করেন। (2) বস্তুতঃ তিনি সৎপথ পরিত্যাগীদের(3) ছাড়া আর কাউকেও বিভ্রান্ত করেন না।

(1) যখন মহান আল্লাহ অকাট্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত করে দিলেন যে, ক্বুরআন এক মুজিযা (অলৌকিক নিদর্শন), তখন কাফেররা অন্যভাবে অভিযোগ উত্থাপন করে বলল যে, যদি এটা আল্লাহর বাণী হত, তাহলে এমন মহান সত্তার অবতীর্ণ করা বাণীতে এত ছোট ছোট জিনিসের দৃষ্টান্ত থাকত না। আল্লাহ তাআলা তাদের কথার উত্তর দিয়ে বলেন যে, কথার পরিষ্কার ব্যাখ্যা দানের উদ্দেশ্যে এবং কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে দৃষ্টান্তসমূহ পেশ করাতে কোন দোষ নেই। আর এ জন্য এতে কোন লজ্জা-সংকোচও নেই। فَوقَها মশার উপরে; অর্থাৎ, তার ডানা বরাবর। অর্থ হল, এই মশার থেকেও ছোট জিনিস। কিংবা فَوق এর অর্থ হল, এই মশার চেয়েও উচ্চ। অর্থ দাঁড়াবে, মশা বা তার থেকে উচ্চ কোন কিছু। فَوقَهَا শব্দের মধ্যে উভয় অর্থেরই প্রশস্ততা রয়েছে।

(2) আল্লাহর উপস্থাপিত দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা ঈমানদারদের ঈমান বর্ধিত হয় এবং কাফেরদের কুফরী বৃদ্ধি পায়। আর এ সব কিছু আল্লাহর কুদরতী নিয়ম এবং তাঁর ইচ্ছার ভিত্তিতেই হয়। যেটাকে ক্বুরআনে (نُوَلِّهِ مَا تَوَلّى) আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে। (সূরা নিসা ১১৫ আয়াত) এবং হাদীসে كُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ অর্থাৎ, প্রত্যেকের জন্য সে জিনিস সহজ করা হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরাতুল লাইল) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

(3) فِسق আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়াকে বলে। আর এটা (আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হওয়া) সাময়িকভাবে একজন মু’মিনের দ্বারাও হতে পারে। তবে এখানে ‘ফিসক্ব’-এর অর্থ হল, আল্লাহর আনুগত্য থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, কুফরী করা ও সৎপথ পরিত্যাগ করা। আর এ কথা পরবর্তী আয়াত দ্বারা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়, যাতে মু’মিনদের মোকাবেলায় কাফেরদের গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৭ الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۲۷﴾
الذین ینقضون عهد الله منۢ بعد میثاقهٖ و یقطعون ما امر الله بهٖ ان یوصل و یفسدون فی الارض اولىک هم الخسرون ۲۷

যারা আল্লাহর দৃঢ়কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যা জোড়া লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ করে। তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। আল-বায়ান

যারা আল্লাহর সঙ্গে সুদৃঢ় অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ আল্লাহ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। তাইসিরুল

যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং ঐ সব সম্বন্ধ ছিন্ন করে যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা ভূপৃষ্ঠে বিবাদ সৃষ্টি করে তারাই পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। মুজিবুর রহমান

Who break the covenant of Allah after contracting it and sever that which Allah has ordered to be joined and cause corruption on earth. It is those who are the losers. Sahih International

২৭. যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আর যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনের উপর ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়(১), তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

১. আবুল আলীয়া বলেন, এটি মুনাফিকদের ছয়টি স্বভাবের অন্তর্গত। তারা কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে, সাথে সাথে আয়াতে বর্ণিত তিনটি কাজ, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং যমীনের উপর ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৭। যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে (1) আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। (2)

(1) মুফাসসিরীনগণ عَهد (অঙ্গীকার) শব্দের বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন, (ক) আল্লাহ তাআলার সেই অসিয়ত যা তিনি তাঁর সকল আদেশ পালন এবং নিষিদ্ধ বর্জন করার ব্যাপারে আম্বিয়া (আলাইহিমুসসালাম)-দের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলকে করেছেন। (খ) আহলে কিতাবের নিকট থেকে তাওরাতে নেওয়া অঙ্গীকার। আর তা হল, শেষ নবী (সাঃ)-এর আগমনের পর তাঁর সত্যায়ন করা এবং তাঁর নবুঅতের উপর ঈমান আনা তোমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হবে। (গ) যে অঙ্গীকার আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করার পর সকল আদম-সন্তানদের নিকট থেকে নেওয়া হয়েছে এবং যার উল্লেখ ক্বুরআন মাজীদে করা হয়েছে। {وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آَدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ} (আর যখন তোমার পালনকর্তা আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন---সূরা আ’রাফ ১৭২ আয়াত) আর অঙ্গীকার ভঙ্গের অর্থ তার কোন পরোয়া না করা। (ইবনে কাসীর)

(2) এটা তো পরিষ্কার কথা যে, ক্ষতি আল্লাহর অবাধ্যজনদেরই হবে। এতে আল্লাহর, তাঁর নবীদের এবং দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের কিছুই হবে না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৮ کَیۡفَ تَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ کُنۡتُمۡ اَمۡوَاتًا فَاَحۡیَاکُمۡ ۚ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ثُمَّ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۲۸﴾
کیف تکفرون بالله و کنتم امواتا فاحیاکم ۚ ثم یمیتکم ثم یحییکم ثم الیه ترجعون ۲۸

কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরী করছ অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। আল-বায়ান

তোমরা আল্লাহকে কীভাবে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা ছিলে মৃত, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবন্ত করেছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর আবার জীবিত করবেন, তারপর তাঁর দিকেই তোমরা ফিরে যাবে। তাইসিরুল

কিরূপে তোমরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করছ? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন? অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে সঞ্জীবিত করেছেন, পুনরায় তিনি তোমাদেরকে নির্জীব করবেন এবং পুনরায় তোমাদেরকে জীবিত করা হবে। অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে প্রত্যাগমন করতে হবে। মুজিবুর রহমান

How can you disbelieve in Allah when you were lifeless and He brought you to life; then He will cause you to die, then He will bring you [back] to life, and then to Him you will be returned. Sahih International

২৮. তোমরা কিভাবে আল্লাহর সাথে কুফরী করছ? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবিত করবেন, তারপর তারই দিকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

২৮। তোমরা কিরূপে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং পুনরায় তোমাদেরকে জীবন্ত করবেন, (1) পরিণামে তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

(1) উক্ত আয়াতে দু’টি মরণ ও দু’টি জীবনের কথা উল্লেখ হয়েছে। প্রথম মরণের অর্থ, অস্তিত্বহীনতা (কিছুই না থাকা)। আর প্রথম জীবনের অর্থ, মায়ের পেট থেকে বের হয়ে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত জীবন। অতঃপর মৃত্যু আসবে এবং তখন থেকে আখেরাতের যে জীবন শুরু হবে সেটা হবে দ্বিতীয় জীবন। কাফেরগণ এবং কিয়ামতকে অস্বীকারকারিগণ এ জীবনকে অস্বীকার ক’রে থাকে। ইমাম শাওকানী কোন কোন আলেমের অভিমত উল্লেখ করেছেন যে, (মৃত্যুর পর হতে কিয়ামত পর্যন্ত) কবরের জীবন দুনিয়ার জীবনেরই শামিল। (ফাতহুল ক্বাদীর) তবে সঠিক কথা হল, বারযাখী (কবরের) জীবন আখেরাতের জীবনের প্রারম্ভ এবং তার শিরোনাম, কাজেই তার সম্পর্ক আখেরাতের জীবনের সাথেই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:২৯ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا ٭ ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ فَسَوّٰىهُنَّ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ ؕ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۲۹﴾
هو الذی خلق لکم ما فی الارض جمیعا ٭ ثم استوی الی السماء فسوىهن سبع سموت و هو بکل شیء علیم ۲۹

তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারপর আসমানের প্রতি খেয়াল করলেন এবং তাকে সাত আসমানে সুবিন্যস্ত করলেন। আর সব কিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত। আল-বায়ান

পৃথিবীর সবকিছু তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং তা সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন, তিনি সকল বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত। তাইসিরুল

পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনঃসংযোগ করেন, অতঃপর সপ্ত আকাশ সুবিন্যস্ত করেন এবং তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। মুজিবুর রহমান

It is He who created for you all of that which is on the earth. Then He directed Himself to the heaven, [His being above all creation], and made them seven heavens, and He is Knowing of all things. Sahih International

২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারপর(১) তিনি আসমানের প্রতি মনোনিবেশ(২) করে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেছেন; আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।

১. এখানে যমীন সৃষ্টির পরে আসমান সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বর্ণিত হয়েছে। অথচ সূরা আন-নাযিআতের ৩০ নং আয়াত বাহ্যতঃ এর বিপরীত মনে হয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সূরা ফুসসিলাতের ১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এখানে শুধু এটা জানাই যথেষ্ট যে, সহীহ সনদে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ্ তা'আলা যমীনকে আসমানের আগেই সৃষ্টি করেছিলেন এবং তার মধ্যে খাবার জাতীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটাকে আসমান সৃষ্টির পূর্বে প্রসারিত ও সামঞ্জস্যবিধান করেন নি। তারপর তিনি আকাশের প্রতি মনোযোগী হয়ে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেন। তারপর তিনি যমীনকে সুন্দরভাবে প্রসারিত ও বিস্তৃত করেছেন। এটাই এ আয়াত এবং সূরা আন-নাযি’আতের ৩০ নং আয়াতের মধ্যে বাহ্যতঃ উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর। [আত-তাফসীরুস সহীহ] মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা আসমান সৃষ্টি করার আগেই যমীন সৃষ্টি করেন। যমীন সৃষ্টির পর তা থেকে এক ধোয়া বা বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর সেটাই আল্লাহর বাণীঃ “তারপর তিনি আসমান সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করলেন এমতাবস্থায় যে, সেটা ছিল ধুম্রাকার” [সূরা ফুসসিলাত: ১১] [ইবনে কাসীর]

২. পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে اسْتَوٰى শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, স্থান বিশেষে বিভিন্ন প্রকার অর্থে সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় তা তিনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে:

(১) اسْتَوٰى শব্দটি যেখানে পূর্ণ ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তার পরে على বা إلى কিছুই না আসে তখন তার অর্থ হবে, সম্পূর্ণ হওয়া বা পূর্ণতা লাভ করা। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেনঃ (وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَىٰ) অর্থাৎ আর যখন মূসা যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণতা লাভ করলেন। [সূরা আল-কাসাসঃ ১৪]

(২) اسْتَوٰى শব্দটির সাথে যদি على আসে তখন তার অর্থ হবে- উপরে উঠা, আরোহণ করা। যেমন আল্লাহ্ তা'আলা তার নিজের সম্পর্কে বলেনঃ (ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ) [আ’রাফ ৫৪, ইউনুস ৩, রা’দ ২, ফিরকান ৫৯, সাজদা ৪, হাদীদ ৪] অর্থাৎ তারপর তিনি আরশের উপর উঠলেন। অনুরূপভাবে সূরা ত্ব-হা-তে এসেছেঃ (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ) অর্থাৎ দয়াময় (রহমান) আরশের উপর উঠলেন।

اسْتَوٰى শব্দটির সাথে যদি إلى আসে তখন তার অর্থ হবে- ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, মনোনিবেশ করা। আর সে অর্থই এ আয়াতে ব্যবহৃত (ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ) এর অর্থ করা হবে- আকাশ সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন। তবে মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানেও উপরে উঠার অর্থ হবে।

শেষোক্ত দু'অবস্থায় اسْتَوَى শব্দটি যখন আল্লাহ্ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত হবে তখন তা তার একটি সিফাত বা গুণ হিসেবে গণ্য হবে। আর আল্লাহর জন্য সে সিফাত বা গুণ কোন প্রকার অপব্যাখ্যা, পরিবর্তন, সদৃশ নির্ধারণ ছাড়াই সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।

তাফসীরে জাকারিয়া

২৯। তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, (1) তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন (2) এবং তাকে (আকাশকে) সপ্তাকাশে (3) বিন্যস্ত করেন, তিনি সকল বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

(1) এ থেকে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, যমীনে সৃষ্ট প্রত্যেক জিনিস মূলতঃ হালাল, যতক্ষণ না কোন জিনিসের হারাম হওয়ার কথা দলীল দ্বারা প্রমাণিত হবে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

(2) সালাফদের কেউ কেউ এর তর্জমা করেছেন, অতঃপর আসমানের দিকে আরোহণ করেন। (সহীহ বুখারী) মহান আল্লাহর আসমানের উপর আরশে আরোহণ করা এবং বিশেষ বিশেষ সময়ে নিকটের আসমানে অবতরণ করা তাঁর গুণবিশেষ। কোন অপব্যাখ্যা ছাড়াই এর উপর ঐভাবেই ঈমান আনা আমাদের উপর ওয়াজিব, যেভাবে তা ক্বুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

(3) এ থেকে প্রথমতঃ জানা গেল যে, আসমান (আকাশ) এক অনুভূত বস্তু এবং বাস্তব জিনিস। কেবল উচ্চতা (মহাশূন্য)-কে আসমান বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ জানা গেল যে, আসমানের সংখ্যা হল সাত। আর হাদীস অনুযায়ী দুই আসমানের মধ্যেকার দূরত্ব হল পাঁচ শত বছরের পথ। আর যমীন সম্পর্কে ক্বুরআনে কারীমে এসেছে, {وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ} এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে। (ত্বালাক্ব ১২ আয়াত) এ থেকে যমীনের সংখ্যাও সাত বলে জানা যায়। নবী (সাঃ)-এর হাদীস দ্বারা এ কথা আরো বলিষ্ঠ হয়। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত যমীনও আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন সাত তবক যমীনকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী ২৯৫৯নং) উক্ত আয়াত থেকে এ কথাও জানা যায় যে, আসমানের পূর্বে যমীন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সূরা নাযিআত (৩০ আয়াতে) আসমানের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, {وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهاَ} যমীনকে এর পর বিস্তৃত করেছেন। এর ব্যাখ্যা এই করা হয়েছে যে, প্রথমে যমীনই সৃষ্টি হয়েছে, তবে পরিষ্কার ও সমতল করে বিছানো হল সৃষ্টি থেকে ভিন্ন ব্যাপার, যেটা আসমান সৃষ্টির পর সম্পাদিত হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২:৩০ وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۳۰﴾
و اذ قال ربک للملىکۃ انی جاعل فی الارض خلیفۃ قالوا اتجعل فیها من یفسد فیها و یسفک الدماء ۚ و نحن نسبح بحمدک و نقدس لک قال انی اعلم ما لا تعلمون ۳۰

আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না। আল-বায়ান

স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি যমীনে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি’; তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও পয়দা করবেন যে অশান্তি সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসামূলক তাসবীহ পাঠ ও পবিত্রতা ঘোষণা করি’। তিনি বললেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’। তাইসিরুল

এবং যখন তোমার রাব্ব মালাইকা/ফেরেশতাদের বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব; তারা বললঃ আপনি কি যমীনে এমন কেহকে সৃষ্টি করবেন যারা তন্মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? এবং আমরাইতো আপনার গুণগান করছি এবং আপনারই পবিত্রতা বর্ণনা করে থাকি। তিনি বললেনঃ তোমরা যা অবগত নও নিশ্চয়ই আমি তা জ্ঞাত আছি। মুজিবুর রহমান

And [mention, O Muhammad], when your Lord said to the angels, "Indeed, I will make upon the earth a successive authority." They said, "Will You place upon it one who causes corruption therein and sheds blood, while we declare Your praise and sanctify You?" Allah said, "Indeed, I know that which you do not know." Sahih International

৩০. আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের(১) বললেন(২), নিশ্চয় আমি যমীনে খলীফা(৩) সৃষ্টি করছি', তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে ফাসাদ ঘটাবে ও রক্তপাত করবে(৪)? আর আমরা আপনার হামদসহ তাসবীহ পাঠ করি এবং পবিত্রতা ঘোষণা করি (৫)। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি তা জানি, যা তোমরা জান না(৬)।

১. এখানে মূল আরবী শব্দ ‘মালায়িকা’ হচ্ছে বহুবচন। এক বচন মালাক। মালাক এর আসল অর্থ হচ্ছে বাণী বাহক। এরই শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে, যাকে পাঠানো হয়েছে বা ফেরেশতা। ফেরেশতা নিছক কিছু কায়াহীন, অস্তিত্বহীন শক্তির নাম নয়। বরং এরা সুস্পষ্ট কায়া ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী। আল্লাহর বিধান ও নির্দেশাবলী তারা প্রবর্তন করে থাকেন। মূর্খ লোকেরা ভুলক্রমে তাদেরকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও কাজ-কর্মে অংশীদার মনে করে। আবার কেউ কেউ তাদেরকে মনে করে আল্লাহর আত্মীয়। এজন্য দেবতা বানিয়ে তাদের পূজা করে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে তৈরী করা হয়েছে, জিনদেরকে নির্ধুম আগুন শিখা হতে।

আর আদমকে তা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে যা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে,” [মুসলিম: ২৯৯৬] অর্থাৎ আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা'আলা আদমকে এমন এক মুষ্ঠি মাটি থেকে তৈরী করেছেন। যে মাটি তিনি সমস্ত যমীন থেকে নিয়েছেন। তাই আদম সন্তানরা যমীনের মতই বৈচিত্ররূপে এসেছে। তাদের মধ্যে লাল, সাদা, কালো এবং এর মাঝামাঝি ধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায়। আর তাদের মধ্যে সহজ, পেরেশান, খারাপ ও ভাল সবরকমের সমাহার ঘটেছে।” [তিরমিযী: ২৯৫৫, আবুদাউদ: ৪৬৯৩, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৪০০, মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬১, ২৬২]

২. অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ তা'আলা যখন আদম 'আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার প্রাক্কালে এ সম্পর্কে ফেরেশতাদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য তার এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে ইংগিত ছিল যে, তারা যেন এ ব্যাপারে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন। কাজেই ফেরেশতাগণ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, মানব জাতির মাঝে এমনও অনেক লোক হবে, যারা শুধু বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে। সুতরাং এদের উপর খেলাফত ও শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব অর্পণের কারণ তাদের পুরোপুরি বোধগম্য নয়। এ দায়িত্ব পালনের জন্য ফেরেশতাগণই যোগ্যতম বলে মনে হয়। কেননা, পুণ্য ও সততা তাদের প্রকৃতিগত গুণ। তারা সদা অনুগত।

এ জগতের শাসনকার্য পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের কাজও হয়তো তারাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন। তাদের এ ধারণা যে ভুল, তা আল্লাহ শাসকোচিত ভংগীতে বর্ণনা করে বলেন যে, বিশ্ব খেলাফতের প্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তোমরা মোটেও ওয়াকিফহাল নও। তা শুধুমাত্র আমিই পূর্ণভাবে পরিজ্ঞাত। অতঃপর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ফেরেশতাদের উপর আদম 'আলাইহিস সালাম-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অনুপম মর্যাদার বর্ণনা দিয়ে দ্বিতীয় উত্তরটি দেয়া হয়েছে যে, বিশ্ব-খেলাফতের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের অন্তর্গত সৃষ্ট বস্তুসমূহের নাম, গুণাগুণ, বিস্তারিত অবস্থা ও যাবতীয় লক্ষণাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

৩. আয়াতে বর্ণিত ‘খলীফা’ শব্দের অর্থ নির্ণয়ে বিভিন্ন মত এসেছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, এর অর্থ স্থলাভিষিক্ত হওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলছেন যে, আমি তোমাদের ছাড়া এমন কিছু সৃষ্টি করতে যাচ্ছি যারা যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। ইবনে জারীর বলেন, আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমি যমীনে আমার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চাই, যে আমার সৃষ্টিকুলের মধ্যে ইনসাফের সাথে আমার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। আর এ প্রতিনিধি হচ্ছে আদম এবং যারা আল্লাহর আনুগত্য ও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে তার বিধান প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হবে।

৪. এখানে প্রশ্ন জাগে যে, ফেরেশতারা কিভাবে জানতে পারল যে, যমীনে বিপর্যয় হবে? এর উত্তর বিভিন্নভাবে এসেছে। কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এ যমীনে পূর্বে জিনরা বাস করত। তারা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। [দেখুন, অনুরূপ বর্ণনা মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৮৭] ফেরেশতারা তাদের উপর কিয়াস করে একথা বলেছিলেন। আবার কারও কারও মতে, তারা মাটি থেকে আদমের সৃষ্টি দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের মধ্যে বিপর্যয় হবে। কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদেরকে পূর্বাহ্নে জানিয়েছিলেন যে, যমীনের বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে যদি কোন সৃষ্টি রাখা হয় তবে তারা সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, রক্ত প্রবাহিত করবে।

আর এজন্যই তারা বলেছিল, আপনি কি সেখানে এমন কিছু সৃষ্টি করবেন যারা সেখানে ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে? [তাবারী] তাছাড়া বিভিন্ন সাহাবা থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে কিছু কথা উহ্য আছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন বললেন যে, আমি যমীনে খলীফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা বলল যে, হে আমাদের রব! সে কেমন খলীফা? আল্লাহ বললেন, তাদের সন্তান-সন্তুতি হবে এবং তারা ঝগড়া ফাসাদ ও হিংসা বিভেদে লিপ্ত হয়ে একে অপরকে হত্যা করবে। তখন তারা বলল, আপনি কি যমীনে এমন কিছু সৃষ্টি করবেন যারা সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আল্লাহ বললেন, আমি তা জানি যা তোমরা জান না। [ইবনে কাসীর]

ইবনে জুরাইজ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা আদম সৃষ্টির ব্যাপারে সংঘটিত সব অবস্থা বর্ণনার পর তাদেরকে আলোচনা করার অনুমতি দিলে তারা এ বক্তব্য পেশ করেন। তারা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন, হে আমাদের রব! আপনি তাদের সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্বেও কি করে তারা আপনার নাফরমান সাজবে? এমন নাফরমান জাতিকে আপনি কেন সৃষ্টি করবেন? আল্লাহ তা'আলা তখন তাদেরকে এ জবাব দিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের ব্যাপারে তোমরা কিছু কথা জেনে থাকলেও অনেক কিছুই জান না। তাদের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশী জানি। তাদের মধ্য থেকে অনেক অনুগত বান্দাও সৃষ্টি হবে। [ইবনে কাসীর] ইমাম তাবারী বলেন, ফেরেশতাগণ এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন অজানা বিষয় জানার জন্যে। তারা যেন বললেন, হে আমাদের রব! আমাদেরকে একটু অবহিত করুন। সুতরাং এর উদ্দেশ্য অস্বীকৃতি নয়; বরং উদ্দেশ্য অবগত হওয়া [তাবারী]

৫. হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, সবচেয়ে উত্তম বাক্য কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঐ বাক্য যা আল্লাহ তার ফেরেশতাদের জন্য নির্বাচন করেছেন এবং তারা যা বলেছেন, সেটা হলো: “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী” [মুসলিম: ২৭৩১]

৬. কাতাদাহ বলেন, এর অর্থ আল্লাহর জ্ঞানে ছিল যে, এই খলীফার মধ্য হতে নবী-রাসূল, সৎকর্মশীল বান্দা ও জান্নাতী লোক সৃষ্টি হবে। [ইবনে কাসীর] সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ফেরেশতাগণ বান্দার আমল নিয়ে আসমানে আল্লাহর দরবারে পৌছেন, তখন আল্লাহ্ তা'আলা -সবকিছু জানা সত্বেও- প্রশ্ন করেন, আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় রেখে এসেছ? তারা সবাই জবাবে বলেন, আমরা গিয়ে তাদেরকে সালাত আদায়রত অবস্থায় পেয়েছি এবং আসার সময় সালাত আদায়রত অবস্থায় রেখে এসেছি। [বুখারী: ৫৫৫, মুসলিম: ৬৩২] কারণ তারা একদল ফজরে আসে এবং আসরে চলে যায় এবং আরেক দল আসরে আসে এবং ফজরে চলে যায়।

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তা'আলার দরবারে রাতের আমল দিনের আগেই এবং দিনের আমল রাতের আগেই পৌছে থাকে ”[মুসলিম: ১৭৯] আল্লাহ্ তা'আলা জবাব, (إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ) এর এটাই যথার্থ তাফসীর। [ইবনে কাসীর] মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ, আল্লাহ জানতেন যে, ইবলীস অবাধ্য হবে এবং তাকে শেষ পর্যন্ত অবাধ্যতার জন্যই তৈরী করা হয়েছে [তাবারী] কোন কোন মুফাসসির বলেন, ফেরেশতাদের (أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ) এ বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তা’আলা إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ বলেছেন। কেননা পুরো বক্তব্যেই বনী আদমের স্থলে তাদের পৃথিবীতে বসবাসের ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। তাই আল্লাহ্ তা'আলা বললেন, তোমরা আকাশের উপযোগী এবং আকাশে অবস্থানই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তোমরা সেটা বুঝতে পারছ না। [ইবনে কাসীর ও তাফসীরে কাবীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

৩০। আর (স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদেরকে (1) বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি (2) সৃষ্টি করছি।’ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো আপনার সপ্রশংস মহিমা কীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি যা জানি তা তোমরা জান না।’ (3)

(1) مَلائِكة (ফিরিশতা) জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আল্লাহর এক সৃষ্টি; যাঁদের বাসস্থান আসমান। যাঁরা আল্লাহর নির্দেশ পালনে এবং তাঁর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় ব্যস্ত থাকেন। তাঁরা তাঁর কোন নির্দেশের অবাধ্যাচরণ করেন না।

(2) خَلِيفَة (খলীফা) এর অর্থ এমন জাতি যারা একে অপরের পরে আসবে। পক্ষান্তরে মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধি এ কথা বলা ভুল।

(3) ফিরিশতাদের এমন বলা হিংসা ও অভিযোগমূলক ছিল না, বরং সত্য ও যৌক্তিকতা জানার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, হে আমাদের প্রতিপালক! এই সম্প্রদায় সৃষ্টি করার যৌক্তিকতা কি? অথচ এদের মধ্যে এমন লোকও হবে যারা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি এবং খুনাখুনি করবে? যদি উদ্দেশ্য এই হয় যে, তোমার ইবাদত হোক, তাহলে এই কাজের জন্য তো আমরা রয়েছি। আর আমাদের নিকট থেকে সে বিপদের আশঙ্কাও নেই, যা নতুন সৃষ্টি থেকে হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বললেন, আমি জানি তাদের কল্যাণের দিক যেহেতু তোমাদের উল্লিখিত ফাসাদের দিক থেকেও বেশী তাই তাদেরকে সৃষ্টি করছি। আর এ কথা তোমরা জানো না। কেননা, এদের মধ্যে আম্বিয়া, শহীদ, সৎশীল এবং বড় ইবাদতকারী মানুষও হবেন। (ইবনে কাসীর)

আদম-সন্তানের ব্যাপারে ফিরিশতাগণ কিভাবে জানলেন যে তারা ফিতনা ও ফাসাদ সৃষ্টি করবে? এই অনুমান তাঁরা মানুষ সৃষ্টির পূর্বে যে (জ্বিন) সম্প্রদায় ছিল তাদের কার্যকলাপ দ্বারা অথবা অন্য কোন ভাবে করে থাকবেন। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তাআলাই বলে দিয়েছিলেন যে, তারা এ রকম এ রকম কাজও করবে। তাঁরা বলেন, বাক্যে কিছু শব্দ উহ্য আছে, আসল বাক্য হল, {إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيْفَةً يَفْعَلُ كَذَا وَكَذَا} আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিনিধি বানাবো যে এ রকম এ রকম করবে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৮৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 · · · 26 27 28 29 পরের পাতা »