সূরাঃ ৯/ আত-তাওবা | At-Tawba | سورة التوبة আয়াতঃ ১২৯ মাদানী
৯ : ২১ یُبَشِّرُهُمۡ رَبُّهُمۡ بِرَحۡمَۃٍ مِّنۡهُ وَ رِضۡوَانٍ وَّ جَنّٰتٍ لَّهُمۡ فِیۡهَا نَعِیۡمٌ مُّقِیۡمٌ ﴿ۙ۲۱﴾
یبشرهم ربهم برحمۃ منه و رضوان و جنت لهم فیها نعیم مقیم ﴿۲۱﴾
• তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে সুসংবাদ দিচ্ছেন রহমত ও সন্তুষ্টির এবং এমন জান্নাতসমূহের যাতে রয়েছে তাদের জন্য স্থায়ী নিআমত।

-আল-বায়ান

• তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর দয়া ও সন্তুষ্টির, আর জান্নাতের যেখানে তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ-সামগ্রী।

-তাইসিরুল

• তাদের রাব্ব তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে সুসংবাদ দিচ্ছেন রাহমাতের ও অতি সন্তুষ্টির, আর এমন জান্নাতের যার মধ্যে তাদের জন্য চিরস্থায়ী নি’আমাত থাকবে।

-মুজিবুর রহমান

• Their Lord gives them good tidings of mercy from Him and approval and of gardens for them wherein is enduring pleasure.

-Sahih International

২১. তাদের রব তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন, স্বীয় দয়া ও সন্তোষের(১) এবং এমন জান্নাতের যেখানে আছে তাদের জন্য স্থায়ী নেয়ামত।

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কেউ জান্নাতে যাবে, সে শুধু নে'আমতই প্রাপ্ত হবে, কখনও নিরাশ হবে না, তার প্রতি কঠোরতা করা হবে না। তার কাপড় কখনও পুরান হবে না, তার যৌবনও কখনও শেষ হবে না। [মুসলিম: ২৮৩৬] অন্য হাদীসে এসেছে, যখন জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাদেরকে বলবেন, আমি তোমাদেরকে এর চেয়েও শ্রেষ্ঠ জিনিস দেব। তারা বলবে, হে আমাদের রব! এর থেকেও শ্রেষ্ঠ জিনিস কি? তিনি বলবেন, আমার সন্তুষ্টি। [তাবারী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২১) তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজ দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন; যেখানে তাদের জন্য স্থায়ী সুখ-সমৃদ্ধি রয়েছে।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২২ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَاۤ اَبَدًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ عِنۡدَهٗۤ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ ﴿۲۲﴾
خلدین فیها ابدا ان الله عندهٗ اجر عظیم ﴿۲۲﴾
• তথায় তারা থাকবে চিরকাল। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।

-আল-বায়ান

• যেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহর কাছেই তো রয়েছে মহাপুরস্কার।

-তাইসিরুল

• ওর মধ্যে তারা অনন্তকাল থাকবে, নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট রয়েছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

-মুজিবুর রহমান

• [They will be] abiding therein forever. Indeed, Allah has with Him a great reward.

-Sahih International

২২. সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে আছে মহাপুরস্কার।(১)

(১) আরাম-আয়েশের স্থায়িত্বের জন্য দুটি বিষয় আবশ্যক। এক. নেয়ামতের স্থায়িত্ব। দুই. নেয়ামত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়া। তাই আল্লাহর সৎ বান্দাদের জন্যে এ আয়াতে এবং পূর্বের আয়াতে এ দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। আয়াতে আল্লাহর সৎ বান্দাদের জন্য যে উচ্চ মর্যাদা রয়েছে তার বর্ণনা রয়েছে। তন্মধ্যে রয়েছে, তাদের অন্তরে খুশীর অনুপ্রবেশ ঘটানো, তাদের সফলতার নিশ্চয়তা, আল্লাহ্‌ তা'আলা যে তাদের উপর সন্তুষ্ট সেটা জানিয়ে দেয়া, তিনি যে তাদের প্রতি দয়াশীল সেটার বর্ণনা, তিনি যে তাদের জন্য স্থায়ী নে’আমতের ব্যবস্থা করেছেন সেটার পরিচয় দেয়া। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২২) সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে আছে মহাপ্রতিদান। [1]

[1] এই সব আয়াতে সেই ঈমানদারদের ফযীলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে, যাঁরা হিজরত করেছেন এবং জান-মাল দিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। আল্লাহর নিকটে তাঁদের মর্যাদা সবার উচ্চে এবং তাঁরাই সফলকাম মানুষ। তাঁরাই আল্লাহর রহমত ও তাঁর সন্তুষ্টি এবং চিরস্থায়ী নিয়ামতের হকদার। তারা এর হকদার নয়, যারা নিজেদের মুখে সরল সাজে এবং নিজেদের বাপ-দাদাদের তরীকাকেই আল্লাহর প্রতি ঈমানের তুলনায় শ্রেয় ও প্রিয় মনে করে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৩ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡۤا اٰبَآءَكُمۡ وَ اِخۡوَانَكُمۡ اَوۡلِیَآءَ اِنِ اسۡتَحَبُّوا الۡكُفۡرَ عَلَی الۡاِیۡمَانِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡكُمۡ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۳﴾
یایها الذین امنوا لا تتخذوا ابآءكم و اخوانكم اولیآء ان استحبوا الكفر علی الایمان و من یتولهم منكم فاولٓئك هم الظلمون ﴿۲۳﴾
• হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম।

-আল-বায়ান

• হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তোমাদের পিতা আর ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীকেই বেশি ভালবাসে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম।

-তাইসিরুল

• হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের পিতাদেরকে ও ভাইদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করনা যদি তারা ঈমানের মুকাবিলায় কুফরকে প্রিয় মনে করে; আর তোমাদের মধ্য হতে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে, বস্তুতঃ ঐ সব লোকই হচ্ছে বড় অত্যাচারী।

-মুজিবুর রহমান

• O you who have believed, do not take your fathers or your brothers as allies if they have preferred disbelief over belief. And whoever does so among you - then it is those who are the wrongdoers.

-Sahih International

২৩. হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতৃবর্গ ও ভাতৃবৃন্দ যদি ঈমানের মুকাবিলায় কুফরীকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।(১)। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম।

(১) পূর্বের আয়াতসমূহে হিজরত ও জিহাদের ফযীলত বর্ণিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে দেশ, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অর্থ-সম্পদকে বিদায় জানাতে হয়। আর এটি হল মনুষ্য স্বভাবের পক্ষে বড় কঠিন কাজ। তাই সামনের আয়াতে এগুলোর সাথে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসার নিন্দা করে হিজরত ও জিহাদের জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করা হয়। বলা হয়েছেঃ “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানের বদলে কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তারাই হবে সীমালংঘনকারী।” মাতা-পিতা, ভাই-বোন এবং অপরাপর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ দিয়ে কুরআনের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে বলা হয় যে, প্রত্যেক সম্পর্কের একেকটি সীমা আছে এবং এ সকল সম্পর্ক তা মাতা-পিতা, ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন যার বেলাতেই হোক, আল্লাহ ও তার রাসূলের সম্পর্কের প্রশ্নে বাদ দেয়ার উপযুক্ত।

যেখানে এ দু’সম্পর্কের সংঘাত দেখা দেবে, সেখানে আল্লাহ ও তার রাসূলের সম্পর্ককেই বহাল রাখা আবশ্যক। আল্লাহ্ তা'আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক কতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক রাখা যাবে আর কখন রাখা যাবে না সে সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন, “আপনি পাবেন না আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধাচারিদেরকে— হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তার পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। আর তিনি এদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে এরা স্থায়ী হবে; আল্লাহ এদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং এরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট, এরাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।” [সূরা আল-মুজাদালাহ ২২]

এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে সবকিছুর উপর স্থান দিতে হবে। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ থেকে অপর কিছুকে প্রাধান্য দিবে তাদের জন্য কঠোর সাবধানবাণী দেয়া হয়েছে। আর সেটা চেনার উপায় হচ্ছে, যদি দুটি বিষয় থাকে একটি নিজের মনের বিরুদ্ধে যায়, কিন্তু তাতে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি রয়েছে। আর অপরটি নিজের মনের পক্ষে কিন্তু তাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অসন্তুষ্টি রয়েছে, এমতাবস্থায় যদি সে নিজের মনের পছন্দের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয় তবে বুঝা যাবে যে সে যালিম। তার উপর যে ওয়াজিব ছিল সেটাকে সে ত্যাগ করেছে। [সা’দী] পক্ষান্তরে যদি কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়, তবে এটা হবে প্রকৃত ত্যাগ ও কুরবানী। উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামা'আতরূপে সাহাবায়ে কেরাম যে অভিহিত, তার মূলে রয়েছে তাদের এ ত্যাগ ও কুরবানী। তারা সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সম্পর্ককেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাই আফ্রিকার বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু, রোমের সোহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু, মক্কার কুরাইশ ও মদীনার আনসারগণ গভীর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং ওহুদ ও বদর যুদ্ধে পিতা ও পুত্র এবং ভাই ও ভাইয়ের মধ্যে দাঁড়াতেও কুন্ঠা বোধ করেননি।

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৩) হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের পিতা ও ভ্রাতৃগণ যদি ঈমানের মুকাবিলায় কুফরীকে পছন্দ করে, তাহলে তাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অভিভাবক করবে, তারাই হবে অত্যাচারী। [1]

[1] এটা সেই বিষয় যে ব্যাপারে কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান ২৮, ১১৮, সূরা মায়েদাহ ৫১, সূরা মুজাদালাহ ২২নং আয়াত দ্রষ্টব্য) এখানে জিহাদ ও হিজরতের আলোচনায় আনুষঙ্গিকভাবে (যেহেতু এ বিষয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট তাই) উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, জিহাদ ও হিজরতের ব্যাপারে তোমাদের বাপ-ভাই ইত্যাদির মহব্বত যেন বাধা সৃষ্টি না করে। কেননা, তারা যদি এখনো পর্যন্ত কাফের হয়, তাহলে তারা তোমাদের ভালোবাসার পাত্র হতেই পারে না। বরং তারা তোমাদের শত্রু। আর যদি তোমরা তাদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ, তাহলে স্মরণ রেখো যে, তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৪ قُلۡ اِنۡ كَانَ اٰبَآؤُكُمۡ وَ اَبۡنَآؤُكُمۡ وَ اِخۡوَانُكُمۡ وَ اَزۡوَاجُكُمۡ وَ عَشِیۡرَتُكُمۡ وَ اَمۡوَالُۨ اقۡتَرَفۡتُمُوۡهَا وَ تِجَارَۃٌ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَ مَسٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیۡكُمۡ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیۡ سَبِیۡلِهٖ فَتَرَبَّصُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰهُ بِاَمۡرِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿۲۴﴾
قل ان كان ابآؤكم و ابنآؤكم و اخوانكم و ازواجكم و عشیرتكم و اموال اقترفتموها و تجارۃ تخشون كسادها و مسكن ترضونها احب الیكم من الله و رسولهٖ و جهاد فی سبیلهٖ فتربصوا حتی یاتی الله بامرهٖ و الله لا یهدی القوم الفسقین ﴿۲۴﴾
• বল, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

-আল-বায়ান

• বল, ‘যদি তোমাদের পিতারা, আর তোমাদের সন্তানেরা, আর তোমাদের ভাইয়েরা, আর তোমাদের স্ত্রীরা, আর তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা আর ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় কর, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস (এসব) যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে, তাহলে অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফয়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন।’ আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।

-তাইসিরুল

• (হে নাবী!) তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্রগণ, তোমাদের ভাইগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের স্বগোত্র, আর ঐ সব ধন সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ঐ ব্যবসায় যাতে তোমরা মন্দা পড়ার আশংকা করছ অথবা ঐ গৃহসমূহ যেখানে অতি আনন্দে বসবাস করছ, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে যদি (এই সব) তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হয় তাহলে তোমরা প্রতীক্ষা করতে থাক যে পর্যন্ত আল্লাহ নিজের নির্দেশ পাঠিয়ে দেন। আর আল্লাহ আদেশ অমান্যকারীদেরকে পথ প্রদশর্ন করেন না।

-মুজিবুর রহমান

• Say, [O Muhammad], "If your fathers, your sons, your brothers, your wives, your relatives, wealth which you have obtained, commerce wherein you fear decline, and dwellings with which you are pleased are more beloved to you than Allah and His Messenger and jihad in His cause, then wait until Allah executes His command. And Allah does not guide the defiantly disobedient people."

-Sahih International

২৪. বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তার রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশী প্রিয় হয়(১) তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস(২), তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্‌ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত (৩) আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।(৪)

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি তোমরা ঈনা পদ্ধতিতে বেচাকেনা কর, গাভীর লেজ ধরে থাক, ক্ষেত-খামার নিয়েই সন্তুষ্ট থাক, আর জিহাদ ছেড়ে দাও, তবে আল্লাহ তোমাদের উপর এমন অপমান চাপিয়ে দিবেন যে, যতক্ষণ তোমরা তোমাদের দ্বীনের দিকে ফিরে না আসবে, ততক্ষণ সে অপমান তোমাদের থেকে তিনি সরাবেন না। [আবু দাউদ: ৩৪৬২]

(২) এখানে সরাসরি সম্বোধন রয়েছে তাদের প্রতি, যারা হিজরত ফরয হওয়াকালে পার্থিব সম্পর্কের মোহে হিজরত করেনি। তবে আয়াতটির সংশ্লিষ্ট শব্দের ব্যাপক অর্থে সকল মুসলিমের প্রতি এ আদেশ রয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তর অন্য কারো ভালবাসা অতিক্রম করবে না। এ ব্যাপারে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কোন ব্যক্তি ততক্ষণ মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য সকল লোক থেকে অধিক প্রিয় হই। [বুখারীঃ ১৪, মুসলিমঃ ৪৪]

আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কারো সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে শুধু আল্লাহর জন্য, শক্রতা রেখেছে শুধু আল্লাহর জন্য, অর্থ ব্যয় করে আল্লাহর জন্য এবং অর্থ ব্যয় থেকে বিরত রয়েছে আল্লাহর জন্য, সে নিজের ঈমানকে পরিপূর্ণ করেছে। [আবু দাউদ: ৪৬৮১; অনুরূপ তিরমিযী: ২৫২১]

হাদীসের এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসাকে অপরাপর ভালবাসার উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং শক্ৰতা ও মিত্রতায় আল্লাহ ও তার রাসূলের হুকুমের অনুগত থাকা পূর্ণতর ঈমান লাভের পূর্বশর্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত ও শরীআতের হেফাযত এবং এতে ছিদ্র সৃষ্টিকারী লোকদের প্রতিরোধ আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসার স্পষ্ট প্রমাণ।

(৩) সূরা আত-তাওবাহর এ আয়াতটি নাযিল হয় মূলতঃ তাদের ব্যাপারে যারা হিজরত ফরয হওয়াকালে মক্কা থেকে হিজরত করেনি। মাতা-পিতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিবার ও অর্থ সম্পদের মায়া হিজরতের ফরয আদায়ে এদের বিরত রাখে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেন যে, আপনি তাদেরকে বলে দিনঃ “যদি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যাকে তোমরা পছন্দ কর, আল্লাহ ও তার রাসূল এবং তার রাহে জিহাদ করা থেকে তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আল্লাহ নাফরমানদিগকে কৃতকার্য করেন না।

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার বিধান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার যে কথা আছে, তৎসম্পর্কে তাফসীরশাস্ত্রের ইমাম মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এখানে ‘বিধান’ অর্থে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মক্কা জয়ের আদেশ [তাবারী] বাক্যের মর্ম হল, যারা দুনিয়াবী সম্পর্কের জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্পর্ককে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, তাদের করুণ পরিণতির দিন সমাগত। মক্কা যখন বিজিত হবে আর এ সকল নাফরমানেরা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে, তখন দুনিয়াবী সম্পর্ক তাদের কোন কাজে আসবে না। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এখানে বিধান অর্থ আল্লাহর আযাবের বিধান। যা থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। [কুরতুবী; সা’দী] অর্থাৎ আখেরাতের সম্পর্কের উপর যারা দুনিয়াবী সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে হিজরত থেকে বিরত রয়েছে, আল্লাহর আযাব অতি শীঘ্র তাদের গ্রাস করবে। দুনিয়ার মধ্যেই এ আযাব আসতে পারে।

অন্যথায় আখেরাতের আযাব তো আছেই। হাদীসে এসেছে, শয়তান বনী আদমের তিন স্থানে বসে পড়ে তাকে এগোতে দেয় না। সে তার ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে বলতে থাকে তুমি কি তোমার পিতা-পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করবে? তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে ইসলাম গ্রহণ করে, তখন সে তার হিজরতের পথে বাঁধ সাধে। সে বলতে থাকে, তুমি কি তোমার সম্পদ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করবে? তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে হিজরত করে, তখন সে তার জিহাদের পথে বাঁধ সাধে। সে বলতে থাকে, তুমি কি জিহাদ করবে এবং নিহত হবে? তখন তোমার স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে, তোমার সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবে, তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে জিহাদ করে। এমতাবস্থায় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর হক হয়ে যায়। [নাসায়ী: ৩১৩৪]

(৪) অর্থাৎ যারা হিজরতের আদেশ আসা সত্বেও আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করেছে, উপরোক্ত বস্তুগুলোকে বেশী ভালবেসেছে, দুনিয়াবী সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে আত্মীয়স্বজন এবং অর্থ-সম্পদকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে, আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় স্বগৃহে আরাম-আয়েশ ও ভোগের আশা পোষণ করে আছে, জিহাদের আহবান আসার পরও সহায়-সম্পত্তির লোভ করে বসে আছে, তারা ফাসেক ও নাফরমান। আর আল্লাহর রীতি হল, তিনি নাফরমান লোকদের উদ্দেশ্য পূরণ করেন না। তাদেরকে হিদায়াত করেন না। তাদেরকে সফলতা ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করেন না। [সা’দী; আইসারুত তাফাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৪) বল, ‘তোমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, স্ত্রী ও আত্মীয়গণ, অর্জিত ধনরাশি এবং সেই ব্যবসা-বাণিজ্য তোমরা যার অচল হওয়ার ভয় কর এবং প্রিয় বাসস্থানসমূহ যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রসূল ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। বস্তুতঃ আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ [1]

[1] এই আয়াতেও উপরোক্ত বিষয়কে বড় তাকীদের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। عَشِيرَة শব্দটি বহুবচনমূলক বিশেষ্য, এর অর্থঃ সেই নিকটতম আত্মীয়-স্বজন যাদের সাথে দিন-রাত বাস করে মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়। অর্থাৎ, স্ববংশ ও স্বগোত্রের লোকজন। اقتراف অর্থ হল উপার্জন করা। تجارة লাভের উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা)-কে বলা হয়। كساد অচল হওয়াকে বলা হয়; অর্থাৎ, পণ্য মজুদ থাকে, কিন্তু ক্রয়-বিক্রয় হয় না। কিংবা পণ্যের প্রয়োজন সময় পার হয়ে গেছে, যার কারণে লোকের কাছে তার চাহিদা থাকে না। مَسَاكن থেকে উদ্দেশ্য হল সেই বাসস্থান বা ঘর-বাড়ি, যা মানুষ শীত-গ্রীষ্ম ও ঝড়-বৃষ্টির কষ্ট, শত্রু ও হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ হতে বাঁচা ও আশ্রয় নেওয়ার জন্য, ইজ্জত রক্ষা করে বসবাস করা এবং নিজ সন্তান-সন্ততির হিফাযতের জন্য তৈরী করে থাকে। এই সমস্ত জিনিস স্ব-স্ব স্থানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ সবের গুরুত্ব ও উপকারিতাও অনস্বীকার্য। মানুষের হৃদয়ে এ সবের ভালোবাসাও প্রকৃতিগত ভালোবাসা এবং যা নিন্দনীয় নয়। কিন্তু এ সবের ভালোবাসা যদি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ভালোবাসা থেকে অধিক হয় এবং তা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বাধা সৃষ্টি হয়, তাহলে এ কথা আল্লাহর নিকট কঠিনভাবে অপছন্দনীয় এবং তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ। আর এ কাজ এমন অবাধ্যতা যার কারণে মানুষ আল্লাহর হিদায়াত হতে বঞ্চিত হতে পারে; যেমন আয়াতের শেষাংশে হুমকিমূলক শব্দ থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে। হাদীসের মধ্যে নবী (সাঃ)ও এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। যেমন, একদা উমার (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমার জান ছাড়া সমস্ত বস্তু থেকে অধিক প্রিয়।’ তিনি বললেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি কারো নিকট তার জান থেকে প্রিয় না হয়েছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সে মু’মিন হতে পারে না।’’ উমার (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার জান থেকেও প্রিয়।’ তিনি বললেন, ‘‘হে উমার! এখন (তুমি পূর্ণ মু’মিন)।’’ (বুখারীঃ কসম ও নযর অধ্যায়) এক দ্বিতীয় বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তাঁর কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার নিকট তার পিতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয়তম হয়েছি।’’ (বুখারীঃ ঈমান অধ্যায়, মুসলিমঃ ঈমান অধ্যায়) এক অন্য হাদীসে জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘যখন তোমরা ‘ঈনাহ’ (কোন জিনিসকে কিছু দিনের জন্য ধারে বিক্রয় করে পুনরায় সেই জিনিসকে কম দামে ক্রয় করে নেওয়ার) ব্যবসা করবে এবং গরুর লেজ ধরে কেবল চাষ-বাস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে আর জিহাদ ত্যাগ করে বসবে, তখন আল্লাহ তোমাদের উপর এমন হীনতা চাপিয়ে দেবেন; যা তোমাদের হৃদয় থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত দূর করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের দ্বীনের প্রতি প্রত্যাবর্তন করেছ।’’

(আহমাদ ২/২৮,৪২, ৮৪, আবু দাঊদ ৩৪৬২নং, বাইহাকী ৫/৩১৬)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৫ لَقَدۡ نَصَرَكُمُ اللّٰهُ فِیۡ مَوَاطِنَ كَثِیۡرَۃٍ ۙ وَّ یَوۡمَ حُنَیۡنٍ ۙ اِذۡ اَعۡجَبَتۡكُمۡ كَثۡرَتُكُمۡ فَلَمۡ تُغۡنِ عَنۡكُمۡ شَیۡئًا وَّ ضَاقَتۡ عَلَیۡكُمُ الۡاَرۡضُ بِمَا رَحُبَتۡ ثُمَّ وَلَّیۡتُمۡ مُّدۡبِرِیۡنَ ﴿ۚ۲۵﴾
لقد نصركم الله فی مواطن كثیرۃ و یوم حنین اذ اعجبتكم كثرتكم فلم تغن عنكم شیئا و ضاقت علیكم الارض بما رحبت ثم ولیتم مدبرین ﴿۲۵﴾
• অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু জায়গায় এবং হুনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল, অথচ তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি। আর যমীন প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের উপর সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে।

-আল-বায়ান

• বস্তুতঃ আল্লাহ তোমাদেরকে বহু যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন আর হুনায়নের যুদ্ধের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি, যমীন সুপ্রশস্ত হওয়া সত্বেও তা তোমাদের নিকট সংকীর্ণই হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে।

-তাইসিরুল

• অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে (যুদ্ধে) বহু ক্ষেত্রে বিজয়ী করেছেন এবং হুনাইনের দিনেও। যখন তোমাদেরকে তোমাদের সংখ্যাধিক্য গর্বে উম্মত্ত করেছিল, অতঃপর সেই সংখ্যাধিক্য তোমাদের কোনই কাজে আসেনি, আর ভূ-পৃষ্ঠ প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও তা তোমাদের উপর সংকীর্ণ হয়ে গেল, অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন পূর্বক পলায়ন করলে।

-মুজিবুর রহমান

• Allah has already given you victory in many regions and [even] on the day of Hunayn, when your great number pleased you, but it did not avail you at all, and the earth was confining for you with its vastness; then you turned back, fleeing.

-Sahih International

২৫. অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং হুনায়নের যুদ্ধের দিনে(১) যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল তোমাদের সংখ্যাধিক্য হওয়া; কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্বেও যমীন তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। তারপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়েছিলে।(২)

(১) এ আয়াতের শুরুতে আল্লাহর সেই দয়া ও দানের উল্লেখ রয়েছে যা প্রতি ক্ষেত্রে মুসলিমরা লাভ করে। বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে” এরপর বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় হুনাইন যুদ্ধের কথা। কারণ, সে যুদ্ধেএমন সবধারণাতীত অদ্ভুত ঘটনার প্রকাশ ঘটেছে, যেগুলো নিয়ে চিন্তা করলে মানুষের ঈমানী শক্তি প্রবল ও কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি পায়।

‘হুনাইন’ মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম। যা মক্কা শরীফ থেকে পূর্ব দিকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি অনেকটা আরাফার দিকে। বর্তমানে এ স্থানকে ‘আশ-শারায়ে’ বলা হয়। [আতেক গাইস আল-বিলাদী, মুজামুল মা'আলিমিল জুগরাফিয়্যাহ ১০৭] অষ্টম হিজরীর রমযান মাসে যখন মক্কা বিজিত হয় আর মক্কার কুরাইশগণ অস্ত্র সমর্পণ করে, তখন আরবের বিখ্যাত ধনী ও যুদ্ধবাজ হাওয়াযেন গোত্র-যার একটি শাখা তায়েফের বনূ-সকীফ নামে পরিচিত, তাদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে তারা একত্রিত হয়ে আশংকা প্রকাশ করতে থাকে যে, মক্কা বিজয়ের পর মুসলিমদের বিপুল শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তখন পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য হবে তায়েফ। তাই তাদের আগে আমাদের আক্রমণ পরিচালনা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

পরামর্শ মত এ উদ্দেশ্যে হাওয়াযেন গোত্র মক্কা থেকে তায়েফ পর্যন্ত বিস্তৃত শাখা-গোত্রগুলোকে একত্রিত করে। আর বিশাল সে গোত্রের প্রায় সবাই যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়।

এ অভিযানের নেতা ছিলেন মালেক ইবন আউফ। অবশ্য পরে তিনি মুসলিম হয়ে ইসলামের অন্যতম ঝাণ্ডাবাহী হন। তবে প্রথমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার তীব্র প্রেরণা ছিল তার মনে। তাই স্বগোত্রের সংখ্যাগুরু অংশ তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করে। কিন্তু এ গোত্রের অপর দুটি ছোট শাখা- বনু-কা’ব ও বনু-কেলাব মতানৈক্য প্রকাশ করে। আল্লাহ তাদের কিছু দিব্যদৃষ্টি দান করেছিলেন। তারা বলতে থাকে, পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়াও যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়, তথাপি তিনি সকলের উপর জয়ী হবেন, আমরা আল্লাহর শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে পারব না।

এই দুই গোত্র ছাড়া বাকী সবাই যুদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সেনানায়ক মালেক ইবন আউফ পূর্ণ শক্তির সাথে রণাঙ্গনে তাদের সুদৃঢ় রাখার জন্য এ কৌশল অবলম্বন করেন যে, যুদ্ধেক্ষেত্রে সকলের পরিবার-পরিজনও উপস্থিত থাকবে এবং প্রত্যেকের জীবিকার প্রধান সহায় পশুপালও সাথে রাখতে হবে। উদ্দেশ্য, কেউ যেন পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের টানে রণক্ষেত্র ত্যাগ না করে। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। হাফেযুল-হাদীস আল্লামা ইবন হাজার রাহিমাহুল্লাহ চব্বিশ বা আটাশ হাজারের সংখ্যাকে সঠিক মনে করেন। আর কেউ কেউ বলেনঃ এদের সংখ্যা চার হাজার ছিল। তবে এও হতে পারে যে, পরিবার-পরিজনসহ ছিল তারা চব্বিশ বা আটাশ হাজার, আর যোদ্ধা ছিল চার হাজার।

মোটকথা, এদের দূরভিসন্ধি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফেই অবহিত হন এবং তিনিও এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প নেন। মক্কায় আত্তাব ইবন আসাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আমীর নিয়োগ করেন এবং মুআয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লোকদের ইসলামী তা’লীম দানের জন্য তার সাথে রাখেন। তারপর মক্কার কুরাইশদের থেকে অস্ত্র-শস্ত্র ধারস্বরূপ সংগ্রহ করেন। ইমাম যুহরীর বর্ণনামতে চৌদ্দ হাজার মুসলিম সেনা নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এতে ছিলেন মদীনার বার হাজার আনসার যারা মক্কা বিজয়ের জন্য তার সাথে এসেছিলেন। বাকী দু'হাজার ছিলেন আশপাশের অধিবাসী, যারা মক্কা বিজয়ের দিন মুসলিম হয়েছিলেন এবং যাদের বলা হত ‘তোলাকা’ অর্থাৎ সাধারণ ক্ষমায় মুক্তিপ্রাপ্ত। ৮ম হিজরীর ৬ই শাওয়াল শুক্রবার রাসূলের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাদলের যুদ্ধযাত্রা শুরু হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ইনশাআল্লাহ, আগামীকাল আমাদের অবস্থান হবে খায়ফে বনী-কেনানার সে স্থানে, যেখানে মক্কার কুরাইশগণ ইতিপূর্বে মুসলিমদের সাথে সামাজিক বয়কটের চুক্তিপত্র সই করেছিল।

চৌদ্দ হাজারের এ বিরাট সেনাদল জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে তাদের সাথে মক্কার অসংখ্য নারী-পুরুষও যুদ্ধের দৃশ্য উপভোগের জন্যে বের হয়ে আসে। তাদের সাধারণ মনোভাব ছিল, এ যুদ্ধে মুসলিম সেনারা হেরে গেলে আমাদের পক্ষে প্রতিশোধ নেয়ার একটা ভাল সুযোগ হবে। আর যদি তারা জয়ী হয়ে যায় তা হলেও আমাদের ক্ষতি নেই। সে যা হোক, মুসলিম সেনা দল হুনাইন নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। এ সময় সুহাইল ইবন হানযালা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেনঃ জনৈক অশ্বারোহী এসে শক্রদলের সংবাদ দিয়েছে যে, তারা পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদসহ রণাঙ্গনে জমায়েত হয়েছে। স্মিতহাস্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ চিন্তা করো না, ওদের সবকিছু গনীমতের মাল হিসাবে মুসলিমদের হস্তগত হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনে অবস্থান নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবন হাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে গোয়েন্দারূপে পাঠান। তিনি দুদিন তাদের সাথে অবস্থান করে তাদের সকল যুদ্ধ প্রস্তুতি অবলোকন করেন। এক সময় শক্ৰ সেনানায়ক মালেক ইবনে আউফকে স্বীয় লোকদের একথা বলতে শোনেনঃ মুহাম্মাদ এখনো কোন সাহসী যুদ্ধবাজদের পাল্লায় পড়েনি। মক্কার নিরীহ কুরাইশদের দমন করে তিনি বেশ দাম্ভিক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারবে কার সাথে তার মোকাবেলা। আমরা তার সকল দম্ভ চূর্ণ করে দেব তোমরা কাল ভোরেই রণাঙ্গনে এরূপ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে যে, প্রত্যেকের পেছনে তার স্ত্রী-পরিজন ও মালামাল উপস্থিত থাকবে। তরবারীর কোষ ভেঙ্গে ফেলবে এবং সকলে একসাথে আক্রমণ করবে। বস্তুতঃ কাফেরদের ছিল প্রচুর যুদ্ধ অভিজ্ঞতা। তাই তারা বিভিন্ন ঘাঁটিতে কয়েকটি সেনাদল লুকায়িত রেখে দেয়।

এ হল শক্রদের রণপ্রস্তুতির একটি চিত্র। কিন্তু অন্যদিকে এক হিসাবে এটি ছিল মুসলিমদের প্রথম যুদ্ধ যাতে অংশ নিয়েছে চৌদ্দ হাজারের এক বিরাট বাহিনী। এ ছাড়া অস্ত্রশস্ত্রও ছিল আগের তুলনায় প্রচুর। তাই কারো কারো মন থেকে বের হয়ে আসেঃ আজকের জয় অনিবার্য, পরাজয় অসম্ভব। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাতেই শত্রুদল পালাতে বাধ্য হবে। কিন্তু মুসলিমরা আল্লাহর উপর ভরসা না করে জনবলের উপর তৃপ্ত থাকবে এটা আল্লাহর পছন্দ ছিল না। এটাই হুনাইনের যুদ্ধে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। হাওয়াযেন গোত্র পূর্ব পরিকল্পনা মতে মুসলিমদের প্রতি সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনা করে। একই সাথে বিভিন্ন ঘাঁটিতে লুকায়িত কাফের সেনারা চতুর্দিক থেকে মুসলিমদের ঘিরে ফেলে। এ সময় আবার ধূলি-ঝড় উঠে সর্বত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। এতে সাহাবাগণের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হলো না। ফলে তারা পিছু হটতে শুরু করেন।

কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনের দিকে বাড়তে থাকেন। তার সাথে ছিলেন অল্প সংখ্যক সাহাবী। এরাও চাচ্ছিলেন যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগ্রসর না হন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেনঃ উচ্চঃস্বরে ডাক দাও, বৃক্ষের নীচে জিহাদের বাই’আত গ্রহণকারী সাহাবীগণ কোথায়? সূরা বাকারাওয়ালারা কোথায়? জান কুরবানের প্রতিশ্রুতিদানকারী আনসারগণই বা কোথায়? সাবই ফিরে এস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানেই আছেন।

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ আওয়ায রণাঙ্গনকে প্রকম্পিত করে তোলে। পলায়নরত সাহাবীগণ ফিরে দাঁড়ান এবং প্রবল সাহসিকতার সাথে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে চলেন। ঠিক এ সময় আল্লাহ এদের সাহায্যে ফেরেশতাদল পাঠিয়ে দেন। এরপর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। কাফের সেনানায়ক মালেক ইবন আউফ পরিবার-পরিজন ও মালামালের মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে যায় এবং তায়েফ দূর্গে আত্মগোপন করে। এরপর গোটা শক্রদল পালাতে শুরু করে। যুদ্ধ শেষে মুসলিমদের হাতে আসে তাদের সকল মালামাল, ছয় হাজার যুদ্ধবন্দী, চব্বিশ হাজার উট, চব্বিশ হাজার ছাগল এবং চার হাজার উকিয়া রৌপ্য। [কুরতুবী; বাগভী; ইবন কাসীর প্রমূখ। বিস্তারিত জানার জন্য আরও দেখুন, ইবরাহীম ইবন ইবরাহীম কুরাইবী কৃত মারওয়িয়াতু গাযওয়াতি হুনাইন ওয়া হিসারুত তায়িফ]

(২) অর্থাৎ তোমরা সংখ্যাধিক্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিলে, কারণ তারা সংখ্যায় ছিল বার হাজার, মতান্তরে ষোল হাজার। [কুরতুবী] এটা নিঃসন্দেহে এক বিরাট বাহিনী। তাদের কেউ কেউ বলেও বসল যে, আমরা আজ সংখ্যায় স্বল্পতার কারণে পরাজিত হব না। কিন্তু পরাজিত তাদের হতেই হলো, সে সংখ্যাধিক্য তোমাদের কাজে আসল না। প্রশস্ত হওয়া সত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল। তারপর তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মুসলিমরা সংখ্যাধিক্যে কখনও জয়লাভ করে না। তারা জয়লাভ করে আল্লাহর সাহায্যে। [কুরতুবী]।

এরপর আল্লাহ তার রাসূল এবং তোমাদের উপর তাঁর সাকীনাহ বা প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং ফেরেশতাদের এমন সৈন্যদল প্রেরণ করেন যাদের তোমরা দেখনি। তারপর তোমাদের হাতে কাফেরদেরকে শাস্তি দিলেন।

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৫) আল্লাহ তোমাদেরকে তো বহুক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং হুনাইনের যুদ্ধের দিনেও; যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্য সঙ্কুচিত হয়েছিল, অতঃপর তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে।[1]

[1] মক্কা ও তায়েফের মধ্যস্থলে একটি উপত্যকার নাম হুনাইন। এখানে হাওয়াযিন এবং সাকীফ নামক দুই গোত্র বসবাস করত। এই উভয় গোত্রের লোকেরা তীর নিক্ষেপ কাজে বড় পটু বলে প্রসিদ্ধি ছিল। এরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে কথা রসূল (সাঃ) জানতে পারলে ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে সেই গোত্র দু’টির সাথে লড়াই করার উদ্দেশ্যে ‘হুনাইন’ উপত্যকায় উপস্থিত হলেন। এই যুদ্ধ মক্কা বিজয়ের ১৮/১৯ দিন পর শওয়াল মাসে সংঘটিত হয়। উল্লিখিত উভয় গোত্রের লোকেরা পরিপূর্ণরূপে প্রস্তুতি নিয়েই ছিল। তারা বিভিন্ন ঘাঁটিতে তীরন্দাজদেরকে মোতায়েন করে দিল। এদিকে মুসলিমদের মাঝে আত্মগর্ব সৃষ্টি হল যে, আজ আমরা কমসে কম সংখ্যা স্বল্পতার কারণে পরাজিত হব না। অর্থাৎ, আল্লাহর মদদ বিস্মৃত হয়ে নিজেদের সংখ্যাধিক্যের উপর ভরসা করে বসলেন। আল্লাহর নিকট এই গর্ব পছন্দ ছিল না। পরিণামস্বরূপ যখন হাওয়াযিনের সুদক্ষ তীরন্দাজরা বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর ধারণাতীতভাবে একই সাথে তীর বর্ষণ করতে শুরু করল, তখন মুসলিম বাহিনী বিচলিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পলায়ন শুরু করল। যুদ্ধ-ময়দানে কেবল নবী (সাঃ) ১০০ জন মত সৈন্য নিয়ে অবিচলিত থাকলেন। তিনি মুসলিমদেরকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা আমার কাছে এসো। আমি হলাম আল্লাহর রসূল।’ কখনো কখনো তিনি এই যুদ্ধ-কবিতা পড়তেন, أنا النبي لا كذب ـ أنا ابن عبد المطلب অর্থাৎ, ‘আমি হলাম নবী, এটা মিথ্যা নয়। আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান।’ পুনরায় তিনি আব্বাস (রাঃ)-কে (যাঁর গলার আওয়াজ বড় উঁচু ছিল) আদেশ করলেন যে, ‘মুসলিমদেরকে একত্রিত করার জন্য ডাক দাও।’ অতএব তাঁর আওয়াজ শুনে মুসলিমরা লজ্জিত হলেন এবং পুনরায় ময়দানে একত্রিত হলেন। অতঃপর এমন দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জয়ী করে দিলেন। আল্লাহর মদদ এমনভাবে এল যে, তাঁদের উপর সান্ত্বনা অবতীর্ণ করলেন; যার ফলে তাঁদের অন্তর থেকে কাফেরদের ভয় দূর হয়ে গেল। দ্বিতীয়তঃ ফিরিশতাদল প্রেরণ করলেন। এই যুদ্ধে মুসলিমরা (নারী ও শিশু সহ) ৬ হাজার কাফেরকে বন্দী করলেন। (যাদেরকে নবী (সাঃ) তাদের অনুরোধে ছেড়ে দিলেন।) প্রচুর পরিমাণে গনীমতের মাল হস্তগত হল। যুদ্ধের পর কাফেরদের বেশ কয়েকজন সর্দার বা নেতৃস্থানীয় লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এখানে তিনটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই ঘটনাকে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৬ ثُمَّ اَنۡزَلَ اللّٰهُ سَكِیۡنَتَهٗ عَلٰی رَسُوۡلِهٖ وَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ اَنۡزَلَ جُنُوۡدًا لَّمۡ تَرَوۡهَا وَ عَذَّبَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا ؕ وَ ذٰلِكَ جَزَآءُ الۡكٰفِرِیۡنَ ﴿۲۶﴾
ثم انزل الله سكینتهٗ علی رسولهٖ و علی المؤمنین و انزل جنودا لم تروها و عذب الذین كفروا و ذلك جزآء الكفرین ﴿۲۶﴾
• তারপর আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাযিল করলেন তাঁর রাসূলের উপর ও মুমিনদের উপর এবং নাযিল করলেন এমন সৈন্যবাহিনী যাদেরকে তোমরা দেখনি, আর কাফিরদেরকে আযাব দিলেন। আর এটা কাফিরদের কর্মফল।

-আল-বায়ান

• তারপর আল্লাহ তাঁর রসূলের উপর, আর মু’মিনদের উপর তাঁর প্রশান্তির অমিয়ধারা বর্ষণ করলেন, আর পাঠালেন এমন এক সেনাবাহিনী যা তোমরা দেখতে পাওনি, আর তিনি কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন। এভাবেই আল্লাহ কাফিরদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকেন।

-তাইসিরুল

• অতঃপর আল্লাহ নিজ রাসূলের প্রতি এবং অন্যান্য মু’মিনদের প্রতি তাঁর সাকিনা (প্রশান্তি) নাযিল করলেন এবং এমন সৈন্যদল (অর্থাৎ ফেরেশতা) নাযিল করলেন যাদেরকে তোমরা দেখনি, আর কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন; আর এটা হচ্ছে কাফিরদের কর্মফল।

-মুজিবুর রহমান

• Then Allah sent down His tranquillity upon His Messenger and upon the believers and sent down soldiers angels whom you did not see and punished those who disbelieved. And that is the recompense of the disbelievers.

-Sahih International

২৬. তারপর আল্লাহ তার নিকট হতে তাঁর রাসূলের উপর ও মুমিনদের উপর প্রশাস্তি নাযিল করেন(১) এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী নাযিল করলেন যা তোমরা দেখতে পাওনি(২)। আর তিনি কাফেরদেরকে শাস্তি দিলেন; আর এটাই কাফেরদের প্রতিফল।

(১) এ বাক্যের অর্থ হলো, হুনাইনের যুদ্ধে প্রথম আক্রমণে যে সকল সাহাবী আপন স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোবল ফিরে পাবার পর স্ব স্ব অবস্থানে ফিরে আসেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মুমিনদের ব্যাপারে প্রশান্তি লাভ করলেন। এতে বুঝা গেল যে, আল্লাহর প্রশান্তি ছিল দু'প্রকার। এক প্রকার পলায়নরত সাহাবীদের জন্য, অন্য প্রকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের। এ কথার ইঙ্গিত দানের জন্য على বা উপর শব্দটি দু'বার ব্যবহার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ “অতঃপর আল্লাহ প্রশান্তি নাযিল করলেন তাঁর রাসূলের উপর এবং মুমিনদের উপর।” সাহাবাদের প্রতি প্রশান্তি প্রেরণের অর্থ হলো, তারা ভয়-ভীতির পরে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর প্রশান্তি নাযিল হওয়ার অর্থ মুসলিমদের ব্যাপারে তার মনে প্রশান্তি নাযিল হওয়া এবং বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

(২) তারা ছিল ফেরেশতা। তাদের কাজ ছিল মুমিনদের পদযুগলে দৃঢ়তা স্থাপন আর কাফেরদের মনে ভয়-ভীতি উদ্রেককরণ। [সা’দী; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] এখানে বলা হয়েছে যে, তারা তাদেরকে দেখেনি। মূলত: এটা হলো সাধারণ লোকদের ব্যাপারে, তাই কেউ কেউ তাদেরকে মানুষের রুপে দেখেছেন বলে যে কতিপয় বর্ণনায় এসেছে, তা উপরোক্ত উক্তির বিরোধী নয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৬) তারপর আল্লাহ তাঁর নিকট হতে তাঁর রসূল ও বিশ্বাসীদের উপর সান্ত্বনা বর্ষণ করলেন; যাতে তাদের চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী অবতীর্ণ করলেন, যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি অবিশ্বাসীদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন। আর এটিই অবিশ্বাসীদের কর্মফল।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৭ ثُمَّ یَتُوۡبُ اللّٰهُ مِنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِكَ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۲۷﴾
ثم یتوب الله من بعد ذلك علی من یشآء و الله غفور رحیم ﴿۲۷﴾
• এরপর আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা তাদের তাওবা কবূল করবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

-আল-বায়ান

• এরপরও আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে করবেন তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।

-তাইসিরুল

• অতঃপর আল্লাহ (ঐ কাফিরদের মধ্য হতে) যাকে ইচ্ছা দয়া প্রদর্শন করেন, আর আল্লাহ হচ্ছেন অতি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।

-মুজিবুর রহমান

• Then Allah will accept repentance after that for whom He wills; and Allah is Forgiving and Merciful.

-Sahih International

২৭. এরপরও যার প্রতি ইচ্ছে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করবেন; আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(১)

(১) এ আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে, যারা মুসলিমদের হাতে পরাস্ত ও বিজিত হওয়ার শাস্তি পেয়েছে এবং কুফরী আদর্শের উপর অটল রয়েছে, তাদের কিছু সংখ্যক লোককে আল্লাহ ঈমানের তাওফীক দেবেন। বাস্তবেও পরাজিত হাওয়াযেন ও সকীফ গোত্রদ্বয়ের অনেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদান্যতা ও ভদ্র ব্যবহার দেখে শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে তারা তাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ফেরৎ পেয়েছিল। [সা’দী] আর আল্লাহ প্রশস্ত রহমতের অধিকারী। তাঁর রহমত সর্বব্যাপী। তাওবাহকারীদের বড় গোনাহও ক্ষমা করে দেন। আর তাদেরকে তাওবাহ করার তাওফীক দেন, তাদের অপরাধসমূহ মার্জনা করেন, সুতরাং বান্দা যত অন্যায়ই করুক না কেন তাঁর রহমত থেকে যেন সে নিরাশ না হয়। [সা'দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৭) এর পরও যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ তওবা করার তওফীক দান করেন। আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِكُوۡنَ نَجَسٌ فَلَا یَقۡرَبُوا الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هٰذَا ۚ وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ عَیۡلَۃً فَسَوۡفَ یُغۡنِیۡكُمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖۤ اِنۡ شَآءَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ حَكِیۡمٌ ﴿۲۸﴾
یایها الذین امنوا انما المشركون نجس فلا یقربوا المسجد الحرام بعد عامهم هذا و ان خفتم عیلۃ فسوف یغنیكم الله من فضلهٖ ان شآء ان الله علیم حكیم ﴿۲۸﴾
• হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা নাপাক, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর। আর যদি তোমরা দারিদ্র্যকে ভয় কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ অনুগ্রহে তোমাদের অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

-আল-বায়ান

• ওহে বিশ্বাসীগণ! মুশরিকরা হল অপবিত্র, কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মাসজিদে হারামের নিকট না আসে। তোমরা যদি দরিদ্রতার ভয় কর, তবে আল্লাহ ইচ্ছে করলে অচিরেই তাঁর অনুগ্রহের মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাব-মুক্ত করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী।

-তাইসিরুল

• হে মু’মিনগণ! মুশরিকরা হচ্ছে একেবারেই অপবিত্র, অতএব তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটেও আসতে না পারে, আর যদি তোমরা দারিদ্রতার ভয় কর তাহলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করবেন, যদি তিনি চান। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় জ্ঞানী, বড়ই হিকমাতওয়ালা।

-মুজিবুর রহমান

• O you who have believed, indeed the polytheists are unclean, so let them not approach al-Masjid al-Haram after this, their [final] year. And if you fear privation, Allah will enrich you from His bounty if He wills. Indeed, Allah is Knowing and Wise.

-Sahih International

২৮. হে ঈমানদারগণ মুশরিকরা তো অপবিত্র(১); কাজেই এ বছরের পর(২) তারা যেন মসজিদুল হারামের ধারে-কাছে না আসে।(৩) আর যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর তবে আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে তাঁর নিজ করুণায় তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করবেন।(৪) নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

(১) কোন কোন মুফাসসির বলেন, কাফেরগণ ব্যহ্যিক ও আত্মিক সর্ব দিক থেকেই অপবিত্র। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এখানে নাপাক বলতে তাদের দেহ সত্তা বুঝানো হয়নি, বরং দ্বীনী বিষয়াদিতে তাদের অপবিত্রতা বোঝানো হয়েছে। সে হিসেবে এর অর্থ, তাদের আকীদাহ-বিশ্বাস, আখলাক-চরিত্র, আমল ও কাজ, তাদের জীবন — এসবই নাপাক। [ইবন কাসীর; সা’দী] আর এ সবের নাপাকির কারণেই হারাম শরীফের চৌহদ্দির মধ্যে তাদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

(২) এ বছর বলতে অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে ৯ম হিজরী বুঝানো হয়েছে। কাতাদা বলেন, এটা ছিল সে বছর যে বছর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদের নিয়ে হজ করেছেন। তখন আলী এ বিষয়টির ঘোষণা লোকদের মধ্যে দিয়েছিলেন। তখন হিজরতের পর নবম বছর পার হচ্ছিল। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরবর্তী বছর হজ করেছিলেন। তিনি এর আগেও হজ করেননি, পরেও করেননি। [তাবারী]

(৩) এখানে “মাসজিদুল হারাম” বলতে সাধারণতঃ বুঝায় বায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকের আঙ্গিনাকে যা দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। তবে কুরআন ও সুন্নার কোন কোন স্থানে তা মক্কার পূর্ণ হারাম শরীফ অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যা কয়েক বর্গমাইল এলাকব্যাপী। যার সীমানা চিহ্নিত করেছেন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। যেমন, মে'রাজের ঘটনায় মাসজিদুল হারামের উল্লেখ রয়েছে। ইমামগণের ঐক্যমতে এখানে “মাসজিদুল হারাম” অর্থ বায়তুল্লাহর আঙ্গিনা নয়। কারণ, মে'রাজের শুরু হয় উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘর থেকে, যা বায়তুল্লাহর আঙ্গিনার বাইরে। অনুরূপ সূরা তাওবার শুরুতে ৭ নং আয়াতে যে মসজিদুল হারামের উল্লেখ রয়েছে, তার অর্থও পূর্ণ হারাম শরীফ। কারণ, এখানে উল্লেখিত সন্ধির স্থান হলো ‘হুদায়বিয়া’ যা হারাম শরীফের সীমানার বাইরে তার অতি সন্নিকটে অবস্থিত। [আল-বালাদুল হারাম: আহকাম ওয়া আদাব]

(৪) ইবনে আব্বাস বলেন, যখন আল্লাহ্‌ তা’আলা মুশরিকদের মাসজিদুল হারামে যাওয়া থেকে নিষেধ করলেন, তখন শয়তান মুমিনদের অন্তরে চিন্তার উদ্রেক ঘটাল যে, তারা কোত্থেকে খাবে? মুশরিকদেরকে তো বের করে দেয়া হয়েছে, তাদের বানিজ্য কাফেলা তো আর আসবে না। তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। যাতে তিনি তাদেরকে আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। আর এর মাধ্যমে তিনি তাদেরকে অমুখাপেক্ষী করে দিলেন। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৮) হে বিশ্বাসিগণ! অংশীবাদীরা তো অপবিত্র।[1] সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মাসজিদুল হারামের নিকট না আসে।[2] যদি তোমরা দারিদ্রে্র আশঙ্কা কর, তাহলে জেনে রাখ, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাঁর নিজ করুণায় তিনি তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। [3] নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

[1] অংশীবাদী বা মুশরিকরা অপবিত্র কথার অর্থ হল, আকীদা-বিশ্বাস ও আমল হিসাবে তারা (অভ্যন্তরীণভাবে) অপবিত্র। কারো কারো নিকটে মুশরিক বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিক উভয়ভাবে অপবিত্র। কেননা, তারা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সেইরূপ খেয়াল রাখে না, যেরূপ শরীয়ত নির্দেশ করেছে।

[2] এটা সেই হুকুম যা সন ৯ হিজরীতে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণার সাথে করা হয়েছিল। যার বিস্তারিত বর্ণনা পূর্বে (১-২নং আয়াতে) উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল মাসজিদুল হারামের জন্য। নচেৎ প্রয়োজন মোতাবেক মুশরিকরা অন্যান্য মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। যেমন নবী (সাঃ) সুমামাহ বিন উসালকে মসজিদে নববীর থামে বেঁধে রেখেছিলেন। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর হৃদয়ে ইসলাম ও নবীর মহব্বত সৃষ্টি করেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরন্তু অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এখানে ‘মাসজিদুল হারাম’ থেকে উদ্দেশ্য পূর্ণ হারাম এলাকা। অর্থাৎ, হারাম-সীমানার ভিতর মুশরিকদের প্রবেশ নিষেধ। কিছু আসার (সাহাবার উক্তি ও কর্ম) অনুসারে এই হুকুম থেকে যিম্মী ও খাদেমদেরকে পৃথক করা হয়েছে। উমার বিন আব্দুল আযীয (রঃ) আলোচ্য আয়াতের ভিত্তিতে নিজ রাজত্বকালে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদেরকেও মুসলিমদের মসজিদে প্রবেশ না করার আদেশ জারী করেছিলেন। (ইবনে কাসীর)

[3] মুশরিকদের উপর হারাম প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার কারণে কিছু মুসলিমদের মনে চিন্তা হল যে, হজ্জের মৌসুমে অধিকাধিক লোক জমা হওয়ার কারণে যে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে, তাতে প্রভাব পড়তে পারে। আল্লাহ তাআলা বললেন, দারিদ্রে্র ভয় করো না। তিনি অতিসত্বর নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে ধনবান বানিয়ে দেবেন। সুতরাং বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ফলে বহু গনীমতের মাল মুসলিমদের হস্তগত হল। অতঃপর ধীরে ধীরে সারা আরববাসী মুসলমান হয়ে গেল। পরিণামে হজ্জের মৌসুমে হাজীদের গমনাগমন ঠিক সেইরূপ হয়ে গেল যেমন পূর্বে ছিল; বরং তার থেকেও বেশী হল। আর সেই সংখ্যাবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ২৯ قَاتِلُوا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ لَا بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ لَا یُحَرِّمُوۡنَ مَا حَرَّمَ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ لَا یَدِیۡنُوۡنَ دِیۡنَ الۡحَقِّ مِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡكِتٰبَ حَتّٰی یُعۡطُوا الۡجِزۡیَۃَ عَنۡ ‌یَّدٍ وَّ هُمۡ صٰغِرُوۡنَ ﴿۲۹﴾
قاتلوا الذین لا یؤمنون بالله و لا بالیوم الاخر و لا یحرمون ما حرم الله و رسولهٗ و لا یدینون دین الحق من الذین اوتوا الكتب حتی یعطوا الجزیۃ عن ‌ید و هم صغرون ﴿۲۹﴾
• তোমরা লড়াই কর আহলে কিতাবের সে সব লোকের সাথে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দীন গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিয্য়া দেয়।

-আল-বায়ান

• যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, আর শেষ দিনের প্রতিও না, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা সহকারে স্বেচ্ছায় ট্যাক্স দেয়।

-তাইসিরুল

• যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখেনা এবং কিয়ামাত দিনের প্রতিও না, আর ঐ বস্তুগুলিকে হারাম মনে করেনা যেগুলিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হারাম বলেছেন, আর সত্য ধর্ম (অর্থাৎ ইসলাম) গ্রহণ করেনা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাক যে পর্যন্ত না তারা অধীনতা স্বীকার করে প্রজা রূপে জিযিয়া দিতে স্বীকার করে।

-মুজিবুর রহমান

• Fight those who do not believe in Allah or in the Last Day and who do not consider unlawful what Allah and His Messenger have made unlawful and who do not adopt the religion of truth from those who were given the Scripture - [fight] until they give the jizyah willingly while they are humbled.

-Sahih International

২৯. যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে(১) তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে ঈমান আনে না এবং শেষ দিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ কর(২), যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিযইয়া(৩) দেয়।(৪)

(১) যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে বলে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এসেছে তারা হলোঃ ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়। আল্লাহ তা'আলা আরবের মুশরিক সম্প্রদায়ের ওজর বন্ধ করার জন্য বলেনঃ “তোমরা হয়তো বলতে পার যে, কিতাব তো শুধু আমাদের পূর্বে দু’সমপ্রদায়ের প্রতিই নাযিল হয়েছে, আর আমরা তো এর পঠন ও পাঠন থেকে সম্পূর্ণ বেখবর ছিলাম। [আল-আনআমঃ ১৫৬]

এ আয়াতে আহলে কিতাব তথা যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে। তাবুকে আহলে কিতাবদের সাথে মুসলিমদের যে যুদ্ধ অভিযান সংঘটিত হয়েছিল, আয়াত দুটি তারই পটভূমি। [বাগভী; ইবন কাসীর] আহলে কিতাবের উল্লেখ করে এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে তাদের সাথে যে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে, তা শুধু আহলে কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ আদেশ রয়েছে সকল কাফের সম্প্রদায়ের জন্যই। কারণ, যুদ্ধ করার যে সকল হেতু বর্ণিত হয়েছে, তা সকল কাফেরদের মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান। সুতরাং এ আদেশ সকলের জন্যই প্রযোজ্য। [বাগভী; কুরতুবী; সা’দী] তবে বিশেষভাবে আহলে কিতাবের উল্লেখ করা হয়, কারণ এদের কাছে রয়েছে তাওরাত ইঞ্জীলের জ্ঞান, যে তাওরাত ও ইঞ্জীলে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী। তা সত্বেও তারা ঈমান আনছে না। [ফাতহুল কাদীর]

(২) এ আয়াতে যুদ্ধের চারটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না। দ্বিতীয়তঃ আখেরাতের প্রতিও তাদের বিশ্বাস নেই। তৃতীয়তঃ আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে তারা হারাম মনে করে না। চতুর্থতঃ সত্য দ্বীন গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক। [কুরতুবী] ইয়াহুদী-নাসারাগণ যদিও প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে না, কিন্তু পরবর্তী আয়াতের বর্ণনা মতে ইয়াহুদীগণ উযায়ের আর নাসারাগণ ঈসাকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করে প্রকারান্তরে শির্ক তথা অংশীবাদকেই সাব্যস্ত করছে। [বাগভী]

অনুরূপভাবে আখেরাতের প্রতি যে ঈমান রাখা দরকার তা আহলে কিতাবের অধিকাংশের মধ্যে নেই। তাদের অনেকের ধারণা হল, কিয়ামতে মানুষ দেহ নিয়ে উঠবে না; বরং তা হবে মানুষের এক ধরনের রূহানী জিন্দেগী। তারা এ ধারণাও পোষণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম বিশেষ কোন স্থানের নাম নয়; বরং আত্মার শান্তি হল জান্নাত আর অশান্তি হল জাহান্নাম। তাদের এ বিশ্বাস কুরআনে পেশকৃত ধ্যান ধারণার বিপরীত। সুতরাং আখেরাতের প্রতি ঈমানও তাদের যথাযোগ্য নয়। তৃতীয় কারণ বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হারাম মনে করে না। এ কথার অর্থ হল তাওরাত ও ইঞ্জীলে যে সকল বস্তুকে হারাম করে দেয়া হয়েছে, তা তারা হারাম বলে গণ্য করে না। সেটা অনুসরণ করে না। [সা’দী]

যেমন, সুদ ও কতিপয় খাদ্যদ্রব্য- যা তাওরাত ও ইঞ্জলে হারাম ছিল, তারা সেগুলোকে হারাম মনে করত না। এ থেকে এ মাস’আলা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তুকে হালাল মনে করা যে শুধু পাপ তা নয়, বরং কুফরীও বটে। অনুরূপ কোন হালাল বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করাও কুফরী। চুতর্থত: তারা সত্য দ্বীনের অনুসরণ করে না। যদিও তারা মনে করে থাকে যে, তারা একটি দ্বীনের উপর আছে। কিন্তু তাদের দ্বীন সঠিক নয়। আল্লাহ সেটা কখনো অনুমোদন করেননি। অথবা এমন শরীআত যেটা আল্লাহ রহিত করেছেন। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীআত দিয়ে সেটা পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং রহিত করার পর সেটা আঁকড়ে থাকা জায়েয নয়। [সা’দী]

(৩) জিযইয়ার শাব্দিক অর্থঃ বিনিময়ে প্রদত্ত পুরস্কার। [ফাতহুল কাদীর] শরীআতের পরিভাষায় জিযইয়া বলা হয় কাফেরদেরকে হত্যা থেকে মুক্তি এবং তাদেরকে মুসলিমদের মাঝে নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করার বিনিময়ে গৃহীত সম্পদকে। যা প্রতি বছরই গ্রহণ করা হবে। ধনী, দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত প্রত্যেকে তার অবস্থানুযায়ী সেটা প্রদান করবে। যেমনটি উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার পরবর্তী খলীফাগ গ্রহণ করেছিলেন। [সা’দী]

সঠিক মত হচ্ছে যে, দু'পক্ষের সম্মতিক্রমে জিযইয়ার যে হার ধার্য হবে তাতে শরীআতের পক্ষ থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ধার্যকৃত হারে জিযইয়া নেয়া হবে। যেমন, নাজরানের নাসারাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুক্তি হয় যে, তারা সকলের পক্ষ থেকে বার্ষিক দু'হাজার জোড়া বস্ত্র প্রদান করবে। [আস-সুনানুস সগীর লিল বাইহাকী]

প্রতি জোড়ায় থাকবে একটা লুঙ্গি ও একটা চাদর। প্রতি জোড়ার মূল্যও ধার্য হয়। অর্থাৎ এক উকিয়া রুপার সমমূল্য। চল্লিশ দিরহামে হয় এক উকিয়া। যা আমাদের দেশের প্রায় সাড়ে এগার তোলা রুপার সমপরিমাণ। অনুরূপ তাগলিব গোত্রীয় নাসারাদের সাথে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চুক্তি হয় যে, তারা যাকাতের নেসাবের দ্বিগুণ পরিমাণে জিযইয়া কর প্রদান করবে। [মুয়াত্তা, ইমাম মুহাম্মাদের বর্ণনায়] তাই মুসলিমগণ যদি কোন দেশ যুদ্ধ করে জয় করে নেয় এবং সে দেশের অধিবাসিগণকে তাদের সহায় সম্পত্তির মালিকানা স্বত্বের উপর বহাল রাখে এবং তারাও ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক হিসাবে থাকতে চায়, তবে তাদের জিযিয়ার হার তা হবে যা উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আপন শাসনকালে ধার্য করেছিলেন। তাহলো উচ্চবিত্তের জন্যে মাসিক চার দিরহাম, মধ্যবিত্তের জন্যে দু’ দিরহাম এবং স্বাস্থ্যবান শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রভৃতি নিন্মবিত্তের জন্য মাত্র এক দিরহাম। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস]

বিকলাঙ্গ, মহিলা শিশু, বৃদ্ধ এবং সংসারত্যাগী ধর্মজীযক এই জিযিরা কর থেকে অব্যাহতি পায়। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস| কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ জিযইয়া আদায়ের বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাগিদ ছিল যে, কারো সাধ্যের বাইরে যেন কোনরূপ জোর জবরদস্তি করা না হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, “যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর যুলুম চালাবে, কিয়ামতের দিন আমি যালেমের বিরুদ্ধে ঐ অমুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করব।” [আবু দাউদঃ ৩০৫২]।

উপরোক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে কতিপয় ইমাম এক মত পোষণ করেন যে, শরীআত জিযইয়ার বিশেষ কোন হার নির্দিষ্ট করে দেয়নি, বরং তা ইসলামী শাসকের সুবিবেচনার উপর নির্ভরশীল। তিনি অমুসলিমদের অবস্থা পর্যালোচনা করে যা সঙ্গত মনে হয়, ধার্য করবেন। জিযইয়া প্রদানে স্বীকৃত হলে ওদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করার যে আদেশ আয়াতে হয়েছে তা অধিকাংশ ইমামের মতে সকল অমুসলিমের বেলায় প্রযোজ্য। তারা আহলে কিতাব হোক বা অন্য কেউ। [কুরতুবী] আর এ জন্যই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মাজুসীদের থেকেও জিযইয়া নিয়েছিলেন। [দেখুন, বুখারী: ৩১৫৬]

আলোচ্য আয়াতে يد শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ নির্ধারণ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। স্বাভাবিক অর্থ হচ্ছে, নিজেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করা। কারও কারও মতে এর অর্থ, স্বহস্তে প্রদান করা। কারও কারও মতে, নগদ প্রদান করা, বাকী না করা। কারও কারও মতে, জোর করে নেয়া। কারও কারও মতে, এটা বুঝিয়ে নেয়া যে, তাদেরকে হত্যা না করে এ অর্থ নেয়ার দ্বারা তাদের উপর দয়া করা হচ্ছে। কার কারও মতে, ধিকৃত। [ফাতহুল কাদীর] তাই জিযইয়া যেন খয়রাতি চাঁদা প্রদানের মত না হয়, বরং তা হবে ইসলামের বিজয়কে মেনে নিয়ে একান্ত অনুগত নাগরিক হিসেবে।

(৪) আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যতক্ষণ না তারা বিনীত হয়ে জিযইয়া প্রদান করে”। এ বাক্য দ্বারা যুদ্ধ-বিগ্রহের একটি সীমা ঠিক করে দেয়া হয়। অর্থাৎ তাবেদার প্রজারূপে জিযইয়া কর প্রদান না করা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। [সা’দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৯) যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা নিষিদ্ধ মনে করে না এবং সত্য ধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে। [1]

[1] মুশরিকদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে যুদ্ধের আদেশের পর এই আয়াতে ইয়াহুদী-নাসারাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার আদেশ করা হচ্ছে। (যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে) তারা জিযিয়া-কর দিয়ে মুসলিমদের অধীনে বসবাস-অধিকার গ্রহণ করে নিক। জিযিয়া হল, নির্ধারিত কিছু অর্থ; যা বাৎসরিকভাবে সেই অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করা হয়, যারা কোন মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। এর বিনিময়ে তাদের জান-মাল ও মান-ইজ্জতের হিফাযতের দায়িত্ব মুসলিম রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখত, তা সত্ত্বেও তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। এ থেকে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি সেইভাবে ঈমান না রাখবে যেভাবে আল্লাহ নিজ পয়গম্বরদের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। আর এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের আল্লাহর প্রতি ঈমানকে এই জন্য সঠিক বলা হয়নি যে, ইয়াহুদী-নাসারা উযাইর এবং ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর বেটা ও উপাস্য বলে বিশ্বাস করে। যেমন পরবর্তী আয়াতে এ ব্যাপারে তাদের আকীদার কথা প্রকাশ করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯ : ৩০ وَ قَالَتِ الۡیَهُوۡدُ عُزَیۡرُۨ ابۡنُ اللّٰهِ وَ قَالَتِ النَّصٰرَی الۡمَسِیۡحُ ابۡنُ اللّٰهِ ؕ ذٰلِكَ قَوۡلُهُمۡ بِاَفۡوَاهِهِمۡ ۚ یُضَاهِـُٔوۡنَ قَوۡلَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا مِنۡ قَبۡلُ ؕ قٰتَلَهُمُ اللّٰهُ ۚ۫ اَنّٰی یُؤۡفَكُوۡنَ ﴿۳۰﴾
و قالت الیهود عزیر ابن الله و قالت النصری المسیح ابن الله ذلك قولهم بافواههم یضاهـٔون قول الذین كفروا من قبل قتلهم الله انی یؤفكون ﴿۳۰﴾
• আর ইয়াহূদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসীহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরী করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে?

-আল-বায়ান

• ইয়াহূদীরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র। আর নাসারারা বলে, ‘মাসীহ আল্লাহর পুত্র। এসব তাদের মুখের কথা। এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই অনুকরণ করে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! কেমনভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে।

-তাইসিরুল

• ইয়াহুদীরা বলেঃ উযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলেঃ মাসীহ্ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা মাত্র (বাস্তবে তা কিছুই নয়), তারাতো তাদের মতই কথা বলছে যারা তাদের পূর্বে কাফির হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে!

-মুজিবুর রহমান

• The Jews say, "Ezra is the son of Allah "; and the Christians say, "The Messiah is the son of Allah." That is their statement from their mouths; they imitate the saying of those who disbelieved [before them]. May Allah destroy them; how are they deluded?

-Sahih International

৩০. আর ইয়াহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র(১), এবং নাসারারা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র এটা তাদের মুখের কথা। আগে যারা কুফরী করেছিল তারা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন। কোন দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে!(২)

(১) আয়াতের ভাষ্য হতে বুঝা যায় যে, ইয়াহুদীদের সবাই এ কথা বলেছিল। কারও কারও মতে, এটি ইয়াহুদীদের এক গোষ্ঠী বলেছিল। সমস্ত ইয়াহুদীদের আকীদা বিশ্বাস নয়। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, সাল্লাম ইবন মিশকাম, নুমান ইবন আওফা, শাস ইবন কায়স ও মালেক ইবনুস সাইফ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমরা কিভাবে আপনার অনুসরণ করতে পারি, অথচ আপনি আমাদের কেবলা ত্যাগ করেছেন, আপনি উযায়েরকে আল্লাহর পুত্র বলে মেনে নেন না? তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। [তাবারী; সীরাতে ইবন হিশাম ১/৫৭০]

উযায়ের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ইয়াহুদীরা যখন তাওরাত হারিয়ে ফেলেছিল তখন উযায়ের সেটা তার মুখস্থ থেকে পুণরায় জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মনে হলো যে, এটা আল্লাহর পুত্র হবে, না হয় কিভাবে এটা করতে পারল। [সা’দী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] এটা নিঃসন্দেহে একটি মিথ্যা কথা যে, উযায়ের তাদেরকে মূল তাওরাত তার মুখস্থ শক্তি দিয়ে এনে দিয়েছিল। কারণ উযায়ের কোন নবী হিসেবেও আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি। এর মাধ্যমে ইয়াহুদীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তাদের দাবী মাত্র। ঐতিহাসিকভাবে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি। [দেখুন, ড. সাউদ ইবন আবদুল আযীয, দিরাসাতুন ফিল আদইয়ান- আল-ইয়াহুদিয়াহ ওয়ান নাসরানিয়্যাহ]

(২) এ আয়াতটি হলো পূর্বের আয়াতের ব্যাখ্যা। পূর্বে আয়াতে মোটামুটিভাবে বলা হয় যে, তারা আল্লাহর উপর ঈমান রাখে না। এখানে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, ইহুদীরা উযাইরকে আর নাসারারা ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করে। [ইবন কাসীর] তাই তাদের ঈমান ও তাওহীদের দাবী নিরর্থক। এরপর বলা হয়ঃ “এটি তাদের মুখের কথা”। এর অর্থ তারা মুখে যে কুফর উক্তি করে যাচ্ছে তার পেছনে না কোন দলীল আছে, না কোন যুক্তি। কত মারাত্মক সে উক্তি যা তারা করে যাচ্ছে। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা বলেছেন, “এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া বাক্য কী সাংঘাতিক। তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে।” [সূরা আল-কাহাফ: ৫]

অতঃপর বলা হয়ঃ এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে, আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন। এরা কোন উল্টা পথে চলে যাচ্ছে। [ইবন কাসীর] এর অর্থ হল ইয়াহুদী ও নাসারারা নবীগণকে আল্লাহর পুত্র বলে পুর্ববর্তী কাফের ও মুশরিকদের মতই হয়ে গেল, তারা ফেরেশতা ও লাত মানাত মূর্তিদ্বয়কে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করেছিল। [বাগভী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩০) আর ইয়াহুদীরা বলে, ‘উযাইর আল্লাহর পুত্র’ এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র।’ এটা তাদের মুখের কথা মাত্র (বাস্তবে তা কিছুই নয়)। তারা তো তাদের মতই কথা বলছে, যারা তাদের পূর্বে অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, তারা উল্টা কোন্ দিকে যাচ্ছে!

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১২৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 · · · 10 11 12 13 পরের পাতা »