১৩ : ২১
وَ الَّذِیۡنَ یَصِلُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ وَ یَخَافُوۡنَ سُوۡٓءَ الۡحِسَابِ ﴿ؕ۲۱﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২১. আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুন্ন রাখে, ভয় করে তাদের রবকে এবং ভয় করে হিসাবকে,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(২১) আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ´ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ´ রাখে[1] এবং ভয় করে তাদের প্রতিপালককে ও ভয় করে কঠোর হিসাবকে।
[1] অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন নষ্ট করে না; বরং সম্পর্ক গড়ে এবং আত্মীয়তা বন্ধন রক্ষা করে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২২
وَ الَّذِیۡنَ صَبَرُوا ابۡتِغَآءَ وَجۡهِ رَبِّهِمۡ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡفَقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ سِرًّا وَّ عَلَانِیَۃً وَّ یَدۡرَءُوۡنَ بِالۡحَسَنَۃِ السَّیِّئَۃَ اُولٰٓئِكَ لَهُمۡ عُقۡبَی الدَّارِ ﴿ۙ۲۲﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২২. আর যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্য ধারণ করে এবং সালাত কায়েম করে, আর আমরা তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভাল কাজের দ্বারা মন্দ কাজকে প্রতিহত করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের শুভ পরিণাম।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(২২) আর যারা তাদের প্রতিপালকের মুখমন্ডল (দর্শন বা সন্তুষ্টি) লাভের জন্য ধৈর্য ধারণ করে,[1] নামায সুপ্রতিষ্ঠিত করে,[2] আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে[3] এবং যারা ভাল দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে[4] তাদের জন্য শুভ পরিণাম (পরকালের গৃহ); [5]
[1] আল্লাহর অবাধ্যতা এবং পাপ থেকে বেঁচে থাকে। এটা এক প্রকার ধৈর্য। দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে। এটা ধৈর্যের দ্বিতীয় প্রকার। জ্ঞানীরা উভয় প্রকার ধৈর্য অবলম্বন করে।
[2] তার সময়-সীমা বহাল রেখে, বিনয়-নম্রতার সাথে এবং ধীর-স্থির চিত্তে, বিশুদ্ধ-চিত্তে, রসূল (সাঃ)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী; নিজের মন মত পদ্ধতিতে নয়।
[3] যখন যেখানে ব্যয় করার প্রয়োজন হয়, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মাঝে প্রকাশ্যে ও গোপনে ব্যয় করে থাকে।
[4] অর্থাৎ তাদের সাথে কেউ অসঙ্গত ব্যবহার করলে তারা তার জবাব উত্তম পদ্ধতিতে দিয়ে থাকে, অথবা ক্ষমা করে দিয়ে ধৈর্য ধারণ করে নেয়। যেমন মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন: ﴿ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ﴾ অর্থাৎ, মন্দের জবাব উত্তম পদ্ধতিতে দাও, (যদি তোমরা এমনটি কর) তাহলে যে ব্যক্তি তোমার শত্রু, সে এমন হয়ে যাবে যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। (সূরা হা-মীম সাজদাহ: ৩৪)
[5] অর্থাৎ যে এই উন্নত চরিত্রের অধিকারী হবে এবং উল্লিখিত গুণাবলীতে গুণান্বিত হবে, তার জন্য রয়েছে শুভ পরিণামের গৃহ (বেহেশত)।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৩
جَنّٰتُ عَدۡنٍ یَّدۡخُلُوۡنَهَا وَ مَنۡ صَلَحَ مِنۡ اٰبَآئِهِمۡ وَ اَزۡوَاجِهِمۡ وَ ذُرِّیّٰتِهِمۡ وَ الۡمَلٰٓئِكَۃُ یَدۡخُلُوۡنَ عَلَیۡهِمۡ مِّنۡ كُلِّ بَابٍ ﴿ۚ۲۳﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৩. স্থায়ী জান্নাত(১), তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও।(২) আর ফেরেশতাগণ তাদের কাছে উপস্থিত হবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে,
(১) পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ তা'আলা আনুগত্যশীলদের নয়টি গুণ বর্ণনা করার পর তাদের প্রতিদান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের সাফল্য। আয়াতে বর্ণিত دار শব্দের অর্থ এখানে আখেরাত। [ফাতহুল কাদীর] আর এ আয়াতের প্রথমেই আখেরাতের সাফল্য বর্ণিত হয়েছে যে, জান্নাতে আদনে তারা থাকবে। عدن শব্দের অর্থ স্থায়ী আবাস। উদ্দেশ্য এই যে, এসব জান্নাত থেকে তাদেরকে বহিস্কার করা হবে না; বরং এগুলোতে তাদের অবস্থান চিরস্থায়ী হবে। [ইবন কাসীর] কেউ কেউ বলেনঃ জান্নাতের মধ্যস্থলের নাম আদন। জান্নাতের স্থানসমূহের মধ্যে এটা উচ্চস্তরের। [ফাতহুল কাদীর] দাহহাক বলেনঃ عدن হলো জান্নাতনগরীর নাম। যাতে রাসূল, নবী, শহীদ এবং হেদায়াতের ইমামগণ থাকবে। মানুষজন থাকবে তাদের চারপাশে। আর অন্যান্য জান্নাতসমূহ এর চারপাশে থাকবে। [ইবন কাসীর]
(২) এরপর তাদের জন্য আরো একটি পুরস্কার উল্লেখ করা হয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ তা'আলার এ নেয়ামত শুধু তাদের ব্যক্তিসত্তা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং তাদের বাপ-দাদা, স্ত্রী ও সন্তানরাও এর অংশ পাবে। শর্ত এই যে, তাদেরকে এর উপযুক্ত হতে হবে। এর নূ্ন্যতম স্তর হচ্ছে মুসলিম হওয়া। [ফাতহুল কাদীর] উদ্দেশ্য এই যে, তাদের বাপ-দাদা ও স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিদের আমল যদিও এ স্তরে পৌছার যোগ্য নয়; কিন্তু আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের খাতিরে তাদেরকেও এ উচ্চস্তরে পৌছে দেয়া হবে। [কুরতুবী] অন্যত্র আল্লাহ বলেন “এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমি একটুও কমাবো না।” [সূরা আত-তূরঃ ২১]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৩) স্থায়ী জান্নাত,[1] তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতিপত্নি ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও।[2] আর ফিরিশতাগণ তাদের কাছে প্রবেশ করবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে।
[1] ‘আদন’ এর অর্থ হলো স্থায়ী অর্থাৎ চিরস্থায়ী বাগান।
[2] অর্থাৎ এমনিভাবে সৎশীল (জান্নাতী) আত্মীয়দেরকে পরস্পর একত্র করে দেবেন, যাতে একে অপরকে দেখে তাদের চক্ষু শীতল হয়। এমনকি নিম্ন শ্রেণীর জান্নাতীদের উচ্চ শ্রেণীর মর্যাদা দান করবেন, যাতে তারা সব সব আত্মীয়ের সাথে একত্রিত হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُم مِّنْ عَمَلِهِم مِّن شَيْءٍ ﴾ অর্থাৎ, যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না। (সূরা ত্বূ-র ২১) এখান থেকে যেমন এটা জানা গেল যে, মহান আল্লাহ আত্মীয়দেরকে জান্নাতে একত্র করে দেবেন, তেমন এটাও জানা গেল যে, যদি কারো কাছে ঈমান ও সৎ আমলের সম্বল না থাকে তাহলে সে জান্নাতে যাবে না, যদিও তার অন্যান্য অত্যন্ত নিকটাত্মীয় জান্নাতে চলে যায়। কেননা জান্নাতে প্রবেশ জাত-কূলের ভিত্তিতে হয় না, বরং ঈমান ও সৎ আমলের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। মহানবী (সাঃ) বলেন, "যাকে তার আমল পিছে ছেড়ে দেয়, তার বংশ তাকে সামনে বাড়াবে না।" (মুসলিম)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৪
سَلٰمٌ عَلَیۡكُمۡ بِمَا صَبَرۡتُمۡ فَنِعۡمَ عُقۡبَی الدَّارِ ﴿ؕ۲۴﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৪. এবং বলবে, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; আর আখেরাতের এ পরিণাম কতই না উত্তম!(১)
(১) এরপর তাদের আরও একটি আখেরাতের সাফল্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, ফিরিশতারা তাদেরকে সালাম করতে করতে প্রত্যেক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং বলবেঃ সবরের কারণে তোমরা যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছ। [ফাতহুল কাদীর] এটা আখেরাতের কতই না উত্তম পরিণাম। অর্থাৎ তারা তাদেরকে এ সুখবর দেবে যে, এখন তোমরা এমন জায়গায় এসেছে যেখানে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজমান। এখন তোমরা এখানে সব রকমের আপদ-বিপদ, কষ্ট, কাঠিন্য, কঠোর পরিশ্রম, শংকা ও আতংকমুক্ত। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে প্রথম যে দলটি জান্নাতে যাবে তারা হলেন দরিদ্র মুহাজিরগণ। যাদের দ্বারা সীমান্ত পাহারা দেয়া হয়। খারাপ অবস্থায় তাদের সাহায্য নেয়া হয়। তাদের অনেকেই এমনভাবে মারা যায় যে, তাদের মনে অনেক অপূর্ণ বাসনা রয়েই গেছে।
আল্লাহ্ তা'আলা ফেরেশতাদের বলবেনঃ তোমরা যাও এবং তাদেরকে সালাম-সম্ভাষণ জানাও। ফেরেশতাগণ বলবেনঃ আমরা আপনার আসমানের বাসিন্দা, আপনার শ্রেষ্ট সৃষ্টির অন্যতম তারপরও কি আপনি আমাদেরকে তাদেরকে সম্মান জানানোর জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। আল্লাহ বলবেনঃ তারা আমার এমন বান্দা ছিল যারা কেবলমাত্র আমার ইবাদত করত। আমার সাথে সামান্যও শির্ক করেনি। তাদের দ্বারা সীমান্ত পাহারা দেয়া হতো এবং বিপজ্জনক সময়ে তাদের সাহায্য নেয়া হত। তারা এমনভাবে মারা গেছে যে, তাদের মনের বাসনা মনেই রয়ে গেছে তা তারা পূরণ করতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন ফেরেশতাগণ তাদের কাছে বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাদেরকে সাদর-সম্ভাষণ জানাবে। তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এ পরিণাম। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/১৬৮]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৪) (তারা বলবে,) তোমরা ধৈর্যধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি! কতই না ভাল এই পরিণাম।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৫
وَ الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۙ اُولٰٓئِكَ لَهُمُ اللَّعۡنَۃُ وَ لَهُمۡ سُوۡٓءُ الدَّارِ ﴿۲۵﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৫. পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্যই রয়েছে লা’নত এবং তাদের জন্য রয়েছে আখেরাতের মন্দ আবাস।(১)
(১) এ আয়াতে সে সমস্ত অপরিণামদর্শী লোকদের আলোচনা করা হচ্ছে, যারা পূর্ববর্তী গুণগুলোর বিপরীত কাজ করে। তাদের জন্য কি শাস্তি রয়েছে তাও বর্ণনা করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] এ সমস্ত অবাধ্য বান্দাদের স্বভাব হলো যে, তারা আল্লাহ তা'আলার অঙ্গীকারকে পাকাপোক্ত করার পর তা ভংগ করে থাকে। হাদীসে অঙ্গীকার ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের একটি আলামত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। [ইবন কাসীর] অবাধ্য বান্দাদের দ্বিতীয় স্বভাব এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, তারা ঐসব সম্পর্ক ছিন্ন করে, যেগুলো বজায় রাখতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আত্মীয়তার সম্পর্কও আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া সমস্ত নবী-রাসূলদের উপর ঈমান আনাও এর অন্তর্ভুক্ত। [কুরতুবী]
তৃতীয় স্বভাব এই যে, তারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে। তারা কুফরি ও গোনাহ করে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে। [কুরতুবী] যারা আল্লাহ্ তা'আলা ও মানুষের অঙ্গীকারের পরওয়া করে না এবং কারো অধিকার ও সম্পর্কের প্রতি লক্ষ্য করে না, তাদের কর্মকাণ্ড যে অপরাপর লোকদের ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হবে, তা বলাই বাহুল্য। ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি-কাটাকাটির বাজার গরম হবে। এটা এক বিরাট ফাসাদ।
আবুল আলীয়া রাহেমাহুল্লাহ বলেন, মুনাফিক শ্রেণীর লোক যখন মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে তখন ছয়টি খারাপ অভ্যাস ও কর্ম করে থাকেঃ কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তার বিপরীত কাজ করে, তাদের কাছে আমানত রাখা হলে তা খেয়ানত করে, আল্লাহর নেয়া অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তা কর্তন করে এবং যমীনের মধ্যে বিপর্যয় ও ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। আর যখন তারা কর্তৃত্বে থাকে না বা অন্যরা তাদের উপর কর্তৃত্ব করে তখন তারা তিনটি কাজ করেঃ কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তার বিপরীত করে এবং আমানতের খেয়ানত করে। [ইবন কাসীর] হাদীসেও তাদের কর্মকাণ্ডের কথা বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি, যখন কথা বলবে মিথ্যা বলবে, যখন ওয়াদা করবে তার বিপরীত করবে এবং যখন আমানত রাখা হবে তখন তার খেয়ানত করবে। [বুখারীঃ ৩৩, মুসলিমঃ ৫৯] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন অঙ্গীকার করবে তা ভঙ্গ করবে, যখন ঝগড়া করবে গালি-গালাজ করবে। [বুখারীঃ ৩৪, মুসলিমঃ ৫৮]
অবাধ্য বান্দাদের এই সমস্ত স্বভাব বর্ণনা করার পর তাদের শাস্তি উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাদের জন্য লা'নত ও মন্দ আবাস রয়েছে। লানতের অর্থ আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকা এবং বঞ্ছিত হওয়া। [কুরতুবী] বলাবাহুল্য, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকাই সর্বাপেক্ষা বড় আযাব এবং সব বিপদের বড় বিপদ। পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে যেমন অনুগত বান্দাদের প্রতিদান উল্লেখ করে বলা হয়েছিল যে, তাদের স্থান হবে জান্নাতে, ফিরিশতারা তাদেরকে সালাম করে বলবে যে, এসব নেয়ামত তোমাদের সবর ও আনুগত্যের ফলশ্রুতি, তেমনিভাবে এ আয়াতে অবাধ্যদের অশুভ পরিণতি বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, তাদের উপর আল্লাহর লা'নত অর্থাৎ তারা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে এবং তাদের জন্য জাহান্নামের আবাস অবধারিত। এতে বুঝা যায় যে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এবং আত্মীয় ও স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা অভিসম্পাত ও জাহান্নামের কারণ।
তাফসীরে জাকারিয়া(২৫) যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ´ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্য আছে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস। [1]
[1] এখানে সৎকর্মশীলদের সাথে অসৎকর্মশীলদের পরিণাম বর্ণনা করেছেন, যেন মানুষ এই পরিণাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৬
اَللّٰهُ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ وَ فَرِحُوۡا بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ؕ وَ مَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا مَتَاعٌ ﴿۲۶﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৬. আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে তার জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করেন এবং সংকুচিত করেন; কিন্তু এরা দুনিয়ার জীবন নিয়েই আনন্দিত, অথচ দুনিয়ার জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র।(১)
(১) এ আয়াতের পটভূমি হচ্ছে, সাধারণ মূর্খ ও অজ্ঞদের মতো মক্কার কাফেররাও বিশ্বাস ও কর্মের সৌন্দর্য বা কদৰ্যতা দেখার পরিবর্তে ধনাঢ্যতা বা দারিদ্র্যের দৃষ্টিতে মানুষের মূল্য ও মর্যাদা নিরূপণ করতো। তাদের ধারণা ছিল, যারা দুনিয়ায় প্রচুর পরিমাণ আরাম আয়েশের সামগ্ৰী লাভ করছে তারা যতই পথভ্রষ্ট ও অসৎকর্মশীল হোক না কেন তারা আল্লাহর প্রিয়। আর অভাবী ও দারিদ্র পীড়িতরা যতই সৎ হোক না কেন তারা আল্লাহর অভিশপ্ত। এ ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করে বলা হচ্ছে, রিযিক কমবেশী হবার ব্যাপারটা আল্লাহর অন্য নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। সেখানে অন্যান্য অসংখ্য প্রয়োজন ও কল্যাণ-অকল্যাণের প্রেক্ষিতে কাউকে বেশী ও কাউকে কম দেয়া হয়।
এটা এমন কোন মানদণ্ড নয় যার ভিত্তিতে মানুষের নৈতিক ও মানসিক সৌন্দর্য ও কদর্যতার ফায়সালা করা যেতে পারে। মানুষের মধ্যে কে চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথ অবলম্বন করেছে এবং কে ভুল পথ, কে উন্নত ও সৎগুণাবলী অর্জন করেছে এবং কে অসৎগুণাবলী -এরি ভিত্তিতে তাদের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের আসল মানদণ্ড নির্ধারণ হওয়া উচিত। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি আল্লাহ্ তাআলা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, “তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্যস্বরূপ যে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তা দ্বারা তাদের জন্য সকল মংগল তুরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।” [আল-মু'মিনূনঃ ৫৫–৫৬]
আয়াতের শেষে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় সামগ্ৰী যে আখেরাতের তুলনায় কিছুই নয় তা বর্ণনা করে বলেছেন যে, “দুনিয়ার জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র।” অন্যত্র এসেছে, “বলুন, পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য আখেরাতই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” [সূরা আন-নিসাঃ ৭৭]
আরো এসেছে, “কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ আখিরাতই উৎকৃষ্ট এবং স্থায়ী।” [সূরা আল-আলাঃ ১৬–১৭] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হলো এমন যেন তোমাদের কেউ সমুদ্রে তার এই আঙ্গুল ঢুকিয়ে আনল”, তারপর তিনি নিজের তর্জনীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। [মুসলিমঃ ২৮৫৮] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক মরা কান ছোট ছাগলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি তা দেখিয়ে সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, আল্লাহর শপথ! এ ছাগলটি যেমন তার মালিকের নিকট মূল্যহীন তেমনি দুনিয়ার মূল্য আল্লাহর নিকট তার ছেয়েও সামান্য। [মুসলিমঃ ২৯৫৭]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৬) আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং সংকুচিত করেন।[1] কিন্তু তারা পার্থিব জীবন নিয়েই উল্লসিত; [2] অথচ ইহজীবন তো পরজীবনের তুলনায় নগণ্য ভোগ মাত্র। [3]
[1] যখন কাফের এবং মুশরিকদের ব্যাপারে বললেন যে, তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট স্থান, তখন মস্তিষ্কে এই প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে, তারা তো পৃথিবীতে হরেক রকমের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে থাকে। এ কথা খন্ডনের জন্য বললেন যে, পার্থিব উপায়-উপকরণ ও জীবিকার কম-বেশি হওয়ার এখতিয়ার আল্লাহর হাতে রয়েছে। তিনি নিজ হিকমত ও ইচ্ছা অনুযায়ী (যা শুধু তিনিই জানেন) কাউকে বেশি এবং কাউকে কম দিয়ে থাকেন। জীবিকার আধিক্য এ কথার প্রমাণ নয় যে, মহান আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট এবং কমতির অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর অসন্তুষ্ট।
[2] আল্লাহর অবাধ্য হওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ পার্থিব সম্পদ পায়, তাহলে তাতে আনন্দ-উল্লাসের কিছু নেই। কেননা তা আল্লাহর পক্ষ হতে অবকাশ মাত্র। কারো জানা নেই যে, অকস্মাৎ কখন এই অবকাশ সময়ের অবসান ঘটবে এবং তাঁর পাকড়াও এসে আক্রমণ করবে।
[3] হাদীসে এসেছে যে, পরকালের অপেক্ষা ইহকালের মূল্য ততটুক, যতটুক কোন ব্যক্তি তার আঙ্গুল সমুদ্রে ডুবায় অতঃপর তা বের করে দেখে যে সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আঙ্গুলে কতটুক পরিমাণ পানি এসেছে? (মুসলিমঃ কিতাবুল জান্নাহ) অন্য এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি মৃত ছাগলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তা দেখে বললেন, আল্লাহর শপথ! দুনিয়া আল্লাহর নিকট এটির চাইতেও বেশি তুচ্ছ, যতটা এই মৃত ছাগল তার মালিকদের নিকট সেই সময় তুচ্ছ ছিল, যে সময় তারা তাকে ফেলে দিয়েছিল। (মুসলিম, কিতাবুযযুহ্দি অররিক্বাক)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৭
وَ یَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا لَوۡ لَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡهِ اٰیَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ ؕ قُلۡ اِنَّ اللّٰهَ یُضِلُّ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَهۡدِیۡۤ اِلَیۡهِ مَنۡ اَنَابَ ﴿ۖۚ۲۷﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৭. আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, তার রবের কাছ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল হয় না কেন?(১) বলুন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বিভ্রান্ত করেন এবং যারা তার অভিমুখী তিনি তাদেরকে তার পথ দেখান।(২)
(১) আল্লাহ তা'আলা ইচ্ছে করলে তারা যে ধরণের নিদর্শন চাচ্ছে সেটা দিতে পারেন। [ইবন কাসীর] এমনকি হাদীসে এসেছে, যখন মক্কার কাফের কুরাইশরা চাইলো যে, আমাদের জন্য সাফা পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে দিন। আমাদের জন্য ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিন। মক্কার পাশ থেকে পাহাড়গুলো সরিয়ে নিয়ে যান। যাতে সেখানে বাগান ও নদী-নালা পূর্ণ হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের কাছে ওহী পাঠালেন যে, হে মুহাম্মাদ! আপনি চাইলে আমি তাদেরকে তা প্রদান করব।
কিন্তু তারপর যদি তারা কুফরি করে তবে তাদেরকে এমন শাস্তি দেব যা আমি সৃষ্টিকুলের কাউকে কোনদিন দেইনি। আর যদি আপনি চান যে, আমি রহমত ও তাওবার দরজা খুলে দেই তবে তা-ই করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বরং তাদের জন্য রহমত ও তাওবার দরজা খোলা হোক। [মুসনাদে আহমাদ ১/২৪২] [ইবন কাসীর] সুতরাং নিদর্শন পাওয়াই বড় কথা নয়, হিদায়াত নসীব হওয়াই বড় কথা। তাই তো আল্লাহ তাদের জন্য নিদর্শন না দিয়ে রহমত ও তাওবার রাস্তা খোলা রেখেছেন। পরবর্তীতে মক্কাবাসীদের অনেকেই সে রহমতে ধন্য হয়।
(২) অর্থাৎ যে নিজেই আল্লাহর দিকে রুজু হয় না বরং তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, হিদায়াত গ্রহণ করতে চায় না, তাকে জোর করে সত্য-সঠিক পথ দেখানো আল্লাহর রীতি নয়। যারা আল্লাহর পথের সন্ধান করে ফিরছে তারা নিদর্শন দেখতে পাচ্ছে এবং নিদর্শনসমূহ দেখেই তারা সত্য পথের সন্ধান লাভ করছে। তোমাদের কাছে যদি যাবতীয় নিদর্শনও আনা হয় তবুও তোমরা ঈমান আনবে না। [দেখুন, মুয়াসসার; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “নিদর্শনাবলী ও ভীতি প্রদর্শন অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উপকারে আসে না। [সূরা ইউনুসঃ ১০১]
অন্য আয়াতে এসেছে, “নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে আপনার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের কাছে সবগুলো নিদর্শন আসে, এমনকি তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেখতে পাবে।” [সূরা ইউনুসঃ ৯৬–৯৭] আল্লাহ আরো বলেনঃ “আমি তাদের কাছে ফিরিশতা পাঠালেও এবং মৃতেরা তাদের সাথে কথা বললেও এবং সকল বস্তুকে তাদের সামনে হাযির করলেও আল্লাহর ইচ্ছে না হলে তারা কখনো ঈমান আনবে না; কিন্তু তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। [সূরা আল-আনআমঃ ১১১]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৭) যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার নিকট কোন নিদর্শন অবতীর্ণ করা হয় না কেন?’ তুমি বল, ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং তিনি তাদেরকেই তাঁর পথ দেখান যারা তাঁর অভিমুখী;
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৮
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِكۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِكۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ ﴿ؕ۲۸﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৮. যারা ঈমান আনে(১) এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের মন প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই মন প্রশান্ত হয়(২);
(১) অর্থাৎ তারা যে নিদর্শন চাচ্ছে তেমনি কোন নিদর্শন ছাড়াই যারা ঈমান আনে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে।
(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার প্রভুর স্মরণ অর্থাৎ যিকির করে আর যে করে না তাদের উদাহরণ হলো জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির ন্যায়। [বুখারীঃ ৬৪০৭] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশতবার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পাঠ করবে, তার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনাতুল্যও হয় তবুও আল্লাহ দয়া করে তা ক্ষমা করে দিবেন।” [বুখারীঃ ৬৪০৫]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, যে ব্যক্তি দিনে একশতবার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া 'আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’ পড়ে সে ব্যক্তি দশটি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য একশটি নেকী লিখা হবে এবং তার একশটি গুণাহ মিটিয়ে দেয়া হবে। ওই দিন সন্ধা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না। তবে যে ব্যক্তি এটা তার চেয়ে বেশী পড়ে সে ব্যতিত”। [বুখারীঃ ৬৪০৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৮) যারা বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়। [1]
[1] আল্লাহর স্মরণ বা যিকরের অর্থ তাঁর তওহীদের (একত্ববাদের) বর্ণনা, যার দ্বারা মুশরিকদের অন্তর সঙ্কুচিত হয়ে যায়। অথবা যিকর অর্থঃ তাঁর ইবাদত, কুরআন তিলাঅত, নফল ইবাদত এবং দু‘আ ও মুনাজাত; যা ঈমানদারদের মনের খোরাক। অথবা তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালন করা; যা ব্যতিরেকে ঈমানদার ও পরহেযগারগণ অস্থির থাকেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ২৯
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ طُوۡبٰی لَهُمۡ وَ حُسۡنُ مَاٰبٍ ﴿۲۹﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২৯. যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, তাদেরই জন্য রয়েছে পরম আনন্দ(১) এবং সুন্দর প্রত্যাবর্তনস্থল।
(১) মূলে বলা হয়েছে, (طُوبَىٰ لَهُمْ) বা তাদের জন্য রয়েছে ‘তুবা’। এখানে তুবা শব্দ দ্বারা কি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এসেছে যে, এর অর্থঃ তাদের জন্য রয়েছে খুশী ও চক্ষু সিক্তকারী। ইকরিমা বলেন, এর অর্থঃ তাদের জন্য যা আছে তা কতইনা উত্তম! দাহহাক বলেন, এর অর্থঃ তাদের জন্য ঈর্ষান্বিত হওয়ার মত নেয়ামত। ইবরাহীম নাখায়ী বলেন, এর অর্থঃ তাদের জন্য কল্যাণ। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তুবা হলো জান্নাতের একটি গাছের নাম। [ইবন কাসীর]
তবে নিঃসন্দেহে এ সমস্তের মূল অর্থঃ জান্নাত। কারণ জান্নাত এ সবগুলোর সমষ্টি। জান্নাতের নে’আমত অগণিত, অসংখ্য। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তাআলা সর্বশেষে জান্নাতে গমনকারীকে বলবেন, তোমার যাবতীয় আকাংখা আমার কাছে ব্যক্ত কর। সে লোক চাইতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত যখন তার চাহিদা শেষ হয়ে যাবে। তার আর চাওয়ার কিছু থাকবে না তখন আল্লাহ্ তা'আলা তাকে বলবেনঃ এটা থেকে চাও, ওটা থেকে চাও, এভাবে তাকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিবেন। তারপর তিনি তাকে এসব দিয়ে বলবেন। তোমাকে এসবকিছু এবং এগুলোর দশগুণ দেয়া হলো”। [বুখারীঃ ৮০৬, ৮৪৩৭, ৮৪৩৮, মুসলিমঃ ১৮২]
আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তা'আলা বলেন, হে আমার বান্দারা! তোমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী, জিন ও মানব সবাই যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার কাছে চাইতে থাক, তারপর আমি তাদের সবাইকে তাঁর প্রার্থিত বস্তু প্রদান করি, তবে তা আমার রাজত্বের কিছুই কমাবে না। তবে এতটুকু যতটুকু সুই সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে কমাতে পারে। [মুসলিম: ২৫৭৭]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৯) যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, কল্যাণ[1] ও শুভ পরিণাম তাদেরই।’
[1] طُوْبَى এর একাধিক অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে, উদাহরণ স্বরূপঃ কল্যাণ, পুণ্য, কারামত, ঈর্ষা, জান্নাতের বিশেষ গাছ অথবা বিশেষ স্থান ইত্যাদি। সবের ভাবার্থ প্রায় একই; অর্থাৎ জান্নাতে উত্তম স্থান এবং তার সুখ-সুবিধা।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান১৩ : ৩০
كَذٰلِكَ اَرۡسَلۡنٰكَ فِیۡۤ اُمَّۃٍ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِهَاۤ اُمَمٌ لِّتَتۡلُوَا۠ عَلَیۡهِمُ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡكَ وَ هُمۡ یَكۡفُرُوۡنَ بِالرَّحۡمٰنِ ؕ قُلۡ هُوَ رَبِّیۡ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۚ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ وَ اِلَیۡهِ مَتَابِ ﴿۳۰﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩০. এভাবে আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির প্রতি যাদের আগে বহু জাতি গত হয়েছে, যাতে আমরা আপনার প্রতি যা ওহী করেছি, তা তাদের কাছে তিলাওয়াত করেন। তথাপি তারা রহমানকে অস্বীকার করে।(১) বলুন, তিনিই আমার রব; তিনি ছাড়া অন্য কোন হক্ক ইলাহ নেই। তারই উপর আমি নির্ভর করি এবং তারই কাছে আমার ফিরে যাওয়া।
(১) অর্থাৎ তাঁর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আছে। তাঁর গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে অন্যদেরকে তাঁর সাথে শরীক করছে। তাঁর দানের জন্য অন্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। তারা নতুন কিছু করছে না, তাদের পূর্বেও আমরা অনেক রাসুল প্রেরণ করেছি। তারা যেভাবে দয়াময় প্রভুকে ভুলে শাস্তির অধিকারী হয়েছে তেমনিভাবে আপনার জাতির কাফেররাও রহমান তথা দয়াময় প্রভুকে অস্বীকার করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের শাস্তি অনিবার্য। [এ সংক্রান্ত আরো আয়াত দেখুন, সূরা আন-নাহলঃ ৬৩, সূরা আল-আনআমঃ ৩৪]
আয়াতে বলা হয়েছে, যে তারা “রাহমান”কে অস্বীকার করছে। এখানে মূলতঃ তারা আল্লাহ তা'আলাকে “রাহমান” বা অত্যন্ত দয়ালু এ গুণে গুণান্বিত করতে অস্বীকার করছিল। এটা ছিল আল্লাহর নাম ও গুণের সাথে শির্ক করা। কুরআনের অন্যত্র স্পষ্টভাবে এসেছে যে, তারা এ নামটি অস্বীকার করত। যেমন, “যখনই তাদেরকে বলা হয়, সিজদাবনত হও রহমান এর প্রতি, তখন তারা বলে, রহমান আবার কে? তুমি কাউকেও সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করব? এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।” [সূরা আল-ফুরকানঃ ৬০] হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ও কাফেররা আল্লাহর এ গুণটি লিখা নিয়ে আপত্তি করেছিল এবং বলেছিলঃ আমরা রহমানকে চিনি না। [বুখারীঃ ২৭৩১-২৭৩২]
অথচ এ নামটি এমন এক নাম যে নাম একমাত্র তাঁর জন্যই ব্যবহার হতে পারে। আর কাউকে কোনভাবেই রহমান নাম বা গুণ হিসেবে ডাকা যাবে না। আর এজন্যই আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, তারা যদিও গোয়ার্তুমি করে এ নামটি অস্বীকার করছে আপনি তাদেরকে এ নামটি যে আমার তা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তুলে ধরুন এবং বলুনঃ তিনিই আমার রব; তিনি ছাড়া অন্য কোন হক্ক ইলাহ নেই। তারই উপর আমি নির্ভর করি এবং তারই কাছে আমার ফিরে যাওয়া। তোমাদের অস্বীকার তার এ নামকে তার জন্য সাব্যস্ত করতে কোন ভাবেই ব্যাহত করতে পারবে না।
অন্যত্র বলা হয়েছে, “বলুন, তোমরা আল্লাহ নামে ডাক বা রাহমান নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক সকল সুন্দর নামই তো তাঁর। তোমরা সালাতে স্বর উচ্চ করো না এবং খুব ক্ষীণও করো না; দুয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো। [সূরা আল-ইসরাঃ ১১০] আল্লাহ আরো বলেনঃ বলুন, তিনিই দয়াময়, আমরা তার প্রতি বিশ্বাস করি ও তারই উপর নির্ভর করি। [সূরা আল-মুলকঃ ২৯] আর এ নামটি সবচেয়ে বেশী মহিমান্বিত নাম হওয়াতে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন যে, “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নাম হচ্ছে 'আবদুল্লাহ ও আব্দুররাহমান।” [মুসলিমঃ ২১৩২]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩০) এইভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির প্রতি যার পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে;[1] যাতে আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তাদের নিকট তা আবৃত্তি কর। তারা পরম দয়াময়কে অস্বীকার করে।[2] তুমি বল, ‘তিনিই আমার প্রতিপালক; তিনি ছাড়া অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই।[3] তাঁরই উপর আমি নির্ভর করি এবং আমার প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে।’
[1] যেমন আমি তোমাকে আমার বার্তা পৌঁছানোর জন্য প্রেরণ করেছি, অনুরূপ তোমার পূর্ববর্তী উম্মতদের মাঝেও রসূল প্রেরণ করেছিলাম, তাদেরকেও তেমনই মিথ্যাজ্ঞান করা হয়েছিল যেমন তোমাকে করা হয়েছে এবং যেমন উক্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা মিথ্যাজ্ঞান করার কারণে আযাবগ্রস্ত হয়েছিল, এদেরও সেই পরিণাম থেকে নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নয়।
[2] মক্কার মুশরিকরা ‘রাহমান’ শব্দে চরম চকিত হত। হুদাইবিয়া সন্ধির সময় যখন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এর শব্দাবলী লেখা হয়েছিল, তখন তারা বলেছিল, ‘রাহমান রাহীম’ কি আমরা জানি না। (ইবনে কাসীর)
[3] অর্থাৎ, ‘রাহমান’ আমার সেই প্রতিপালক, যিনি ব্যতীত কোন মাবূদ নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান