-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭১. আর যারা কুফরী করেছে তাদের উদাহরণ তার মত যে, এমন কিছুকে ডাকছে যে হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই শুনে না। তারা বধির, বোবা, অন্ধ, কাজেই তারা বুঝে না।(১)
(১) এ উপমাটির দুটি দিক রয়েছে। (এক) তাদের অবস্থা সেই নিবোধ প্রাণীদের মত, যারা এক-একটি পালে বিভক্ত হয়ে নিজেদের রাখালদের পিছনে চলতে থাকে এবং না জেনে-বুঝেই তাদের হাক-ডাকের উপর চলতে-ফিরতে থাকে। (দুই) এর দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, কাফের-মুশরিকদেরকে আহবান করার ও তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের সময় মনে হতে থাকে যেন নির্বোধ জন্তু-জানোয়ারদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে, তারা কেবল আওয়াজ শুনতে পারে কিন্তু কি বলা হচ্ছে, তা কিছুই বুঝতে পারে না। [মুয়াস্সার]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭১) আর এই অমান্যকারীদের দৃষ্টান্ত হল এরূপ, যেমন কোন ব্যক্তি এমন কিছুকে (পশুকে) ডাকে, যা ডাক-হাঁক ছাড়া আর কিছুই শুনে (বুঝে) না তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। তাই তো (তারা) কিছুই বুঝতে পারে না। [1]
[1] যে কাফেররা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে অকেজো করে রেখেছে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই পশুদের মত, যাদেরকে রাখাল ডাকে ও আওয়াজ দেয় এবং তারা সেই ডাক ও আওয়াজ তো শোনে, কিন্তু বুঝে না যে, তাদেরকে কেন ডাকা ও আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে? অনুরূপ এই অন্ধ অনুকরণকারীরা বধির, তাই সত্যের ডাক শোনে না। বোবা, তাই হক কথা তাদের জবান থেকে বের হয় না। অন্ধ, তাই সত্য দেখতে তারা অক্ষম এবং জ্ঞানশূন্য, তাই সত্যের দাওয়াত এবং তাওহীদ ও সুন্নতকে তারা বুঝতে পারে না। এখানে دعاء (ডাক) অর্থ নিকটের শব্দ এবং نداء (হাঁক) অর্থ দূরের শব্দ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭২. হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমরা যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে খাও(১) এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা শুধু তারই ইবাদাত কর।
(১) আলোচ্য আয়াতে যেমন হারাম খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তার সমস্ত নবী-রাসূলগণের প্রতি হিদায়াত করেছেন যে, (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا) অর্থাৎ “হে রাসূলগন! পবিত্র খাদ্য গ্রহন করুন এবং নেক আমল করুন”। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নেক আমলের ব্যাপারে হালাল খাদ্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনুরূপ হালাল খাদ্য গ্রহণে দোআ কবুল হওয়ার আশা এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার আশংকাই থাকে বেশী। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে মানুষ! নিশ্চয় আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কোন কিছু কবুল করেন না।
তিনি মুমিনগণকে সেটার নির্দেশ দিয়েছেন যেটার নির্দেশ রাসূলগণকে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র থেকে খাও এবং সৎকাজ কর, নিশ্চয় আমি তোমরা যা কর সে ব্যাপারে সবিশেষ অবগত।” [সূরা আল-মুমিনুন: ৫১) আরও বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমাদের আমরা যে রিযিক দিয়েছি তা হতে পবিত্র বস্তু খাও।” [সূরা আল-বাকারাহ ১৭২] তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ব্যক্তির উল্লেখ করলেন, যে লম্বা সফর করেছে, ধুলি-মলিন অবস্থায় দু'হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে বলতে থাকে হে রব! হে রব! অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোষাক হারাম, সে খেয়েছেও হারাম। সুতরাং তার দোআ কিভাবে কবুল হতে পারে?” [মুসলিম: ১০১৫]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭২) হে বিশ্বাসিগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; যদি তোমরা শুধু তাঁরই উপাসনা করে থাক। [1]
[1] এই আয়াতে ঈমানদারদেরকে সেই সমস্ত পবিত্র জিনিস খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ হালাল করেছেন। আর খেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার তাকীদ করা হয়েছে। প্রথমতঃ এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ কর্তৃক হালালকৃত জিনিসগুলোই পাক-পবিত্র এবং তাঁর হারামকৃত জিনিসগুলো অপবিত্র; যদিও তা মানুষের কাছে প্রিয় ও তৃপ্তিকর। (যেমন, ইউরোপবাসীদের নিকট শুয়োরের গোশত খুবই প্রিয়)। দ্বিতীয়তঃ মূর্তিদের নামে উৎসর্গীকৃত জানোয়ার ও জিনিসাদি মুশরিকরা যে নিজেদের উপর হারাম করে নিত (যার বিস্তারিত আলোচনা সূরা আনআম ১৩৬-১৪০ আয়াতে আসবে), তাদের এ কাজ ভুল ছিল, এইভাবে কোন হালাল জিনিস হারাম হয় না। তোমরাও তাদের মত (হালালকে) হারাম করো না। (হারাম কেবল সেই জিনিসগুলো যার বর্ণনা পরের আয়াতে রয়েছে।) তৃতীয়তঃ যদি তোমরা কেবল আল্লাহরই ইবাদত সম্পাদনকারী হও, তাহলে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে যত্নবান হও।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৩. তিনি আল্লাহ তো কেবল তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু(১), রক্ত(২), শূকরের গোশত(৩) এবং যার উপর আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে(৪), কিন্তু যে নিরূপায় অথচ নাফরমান এবং সীমালংঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না(৫)। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(১) অর্থাৎ যেসব প্রাণী হালাল করার জন্য শরীআতের বিধান অনুযায়ী যবেহ্ করা জরুরী, সেসব প্রাণী যদি যবেহ ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে যেমন, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, অসুস্থ হয়ে কিংবা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়, তবে সেগুলোকে মৃত বলে গণ্য করা হবে এবং সেগুলোর গোশত খাওয়া হারাম হবে। তবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার হালাল করা হল। [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৯৬] এ আয়াতের মর্মানুযায়ী সামুদ্রিক জীব-জন্তুর বেলায় যবেহ করার শর্ত আরোপিত হয়নি। ফলে এগুলো যবেহ ছাড়াই খাওয়া হালাল। অনুরূপ এক হাদীসে মাছ এবং টিড্ডি নামক পতঙ্গকে মৃত প্রাণীর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এ দুটির মৃতকেও হালাল করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমাদের জন্য দুটি মৃত হালাল - মাছ এবং টিড্ডি (এক জাতীয় ফড়িং)। [বাগভীঃ শরহুস-সুন্নাহঃ ২৮০৩, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩২১৮]
সুতরাং বোঝা গেল যে, জীব-জন্তুর মধ্যে মাছ এবং ফড়িং মৃতের পর্যায়ভুক্ত হবে না, এ দুটি যবেহ না করেও খাওয়া যাবে। অনুরূপ যেসব জীব-জন্তু ধরে যবেহ্ করা সম্ভব নয়, সেগুলোকে বিসমিল্লাহ বলে তীর কিংবা অন্য কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে যদি মারা হয়, তবে সেগুলোও হালাল হবে, এমতাবস্থায়ও শুধু আঘাত দিয়ে মারলে চলবে না, কোন ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা শর্ত। আজকাল একরকম চোখা গুলী ব্যবহার হয়, এ ধরণের গুলী সম্পর্কে কেউ কেউ মনে করতে পারে যে, এসব ধারালো গুলীর আঘাতে মৃত জন্তুর হুকুম তীরের আঘাতে মৃতের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু আলেমগণের সম্মিলিত অভিমত অনুযায়ী বন্দুকের গুলী চোখা এবং ধারালো হলেও তা তীরের পর্যায়ভুক্ত হয় না। কেননা, তীরের আঘাত ছুরির আঘাতের ন্যায়, অপরদিকে বন্দুকের গুলী চোখা হলেও গায়ে বিদ্ধ হয়ে গায়ে বিস্ফোরণ ও দাহিকা শক্তির প্রভাবে জন্তুর মৃত্যু ঘটায়। সুতরাং এরূপ গুলী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত জানোয়ার যবেহ্ করার আগে মারা গেলে তা খাওয়া হালাল হবে না। এক্ষেত্রে গুলী দ্বারা শিকার করা হলে তা আবার যবেহ্ করতে হবে।
এখানে আরও জানা আবশ্যক যে, আয়াতে তোমাদের জন্য মৃত হারাম বলতে মৃত জানোয়ারের গোশত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে। যাবতীয় অপবিত্র বস্তু সম্পর্কে সেই একই বিধান প্রযোজ্য। অর্থাৎ মৃত জানোয়ারের গোশ্ত ব্যবহার যেমন হারাম, তেমনি এগুলো ক্রয়-বিক্রয় কিংবা অন্য কোন উপায়ে এগুলো থেকে যেকোনভাবে লাভবান হওয়াও হারাম। এমনকি মৃত জীব-জন্তুর গোশত নিজ হাতে কোন গৃহপালিত জন্তুকে খাওয়ানোও জায়েয নয়।
তাছাড়া আয়াতে ‘মৃত’ শব্দটির অন্য কোন বিশেষণ ছাড়া সাধারণভাবে ব্যবহার করাতে প্রতীয়মান হয় যে, হারামের হুকুমও ব্যাপক এবং তন্মধ্যে মৃত জন্তুর সমুদয় অংশই শামিল। কিন্তু অন্য এক আয়াতে (عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ) [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] শব্দ দ্বারা এ বিষয়টিও ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, মৃত জন্তুর শুধু সে অংশই হারাম যেটুকু খাওয়ার যোগ্য। সুতরাং মৃত জন্তুর হাড়, পশম প্রভৃতি যেসব অংশ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, সেগুলোর ব্যবহার করা হারাম নয়; সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা, কুরআনের অন্য এক আয়াতে আছে, (وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَىٰ حِينٍ) [সূরা আন-নাহলঃ ৮০] এতে হালাল জানোয়ারসমূহের পশম প্রভৃতির দ্বারা ফায়দা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এখানে যবেহ্ করার শর্ত আরোপ করা হয়নি। চামড়ার মধ্যে যেহেতু রক্ত প্রভৃতি নাপাকীর সংমিশ্রণ থাকে, সেজন্য মৃত জানোয়ারের চামড়া শুকিয়ে পাকা না করা পর্যন্ত নাপাক এবং ব্যবহার হারাম। কিন্তু পাকা করে নেয়ার পর ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েয। সহীহ হাদীসে এ সম্পর্কিত আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। অনুরূপভাবে মৃত জানোয়ারের চর্বি এবং তদ্বারা তৈরী যাবতীয় সামগ্রীই হারাম। এসবের ব্যবহার কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। এমনকি এসবের ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম। [মাআরিফুল কুরআন]
(২) আয়াতে যেসব বস্তু-সামগ্রীকে হারাম করা হয়েছে, তার দ্বিতীয়টি হচ্ছে রক্ত। এ আয়াতে শুধু রক্ত উল্লেখিত হলেও অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, (أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا) [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] অর্থাৎ ‘প্রবাহমান রক্ত’ উল্লেখিত রয়েছে। রক্তের সাথে প্রবাহমান শব্দ সংযুক্ত করার ফলে শুধু সে রক্তকেই হারাম করা হয়েছে, যা যবেহ করলে বা কেটে গেলে প্রবাহিত হয়। এ কারণেই কলিজা এবং এরূপ জমাট বাঁধা রক্তে গঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেকাহবিদগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী পাক ও হালাল। আর যেহেতু শুধুমাত্র প্রবাহমান রক্তই হারাম ও নাপাক, কাজেই যবেহ্ করা জন্তুর গোশতের সাথে রক্তের যে অংশ জমাট বেঁধে থেকে যায়, সেটুকু হালাল ও পাক৷ ফেকাহবিদ সাহাবী ও তাবেয়ীসহ সমগ্র আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একমত। এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, রক্ত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি অন্য কোন উপায়ে তা ব্যবহার করাও হারাম। অন্যান্য নাপাক রক্তের ন্যায় রক্তের ক্রয়-বিক্রয় এবং তা দ্বারা অর্জিত লাভালাভও হারাম।
(৩) আলোচ্য আয়াতে তৃতীয় যে বস্তুটি হারাম করা হয়েছে, সেটি হলো শূকরের গোশত। এখানে শূকরের সাথে লাহম’ বা গোশ্বত শব্দসংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে ইমাম কুরতুবী বলেন, এর দ্বারা শুধু গোশত হারাম এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং শূকরের সমগ্র অংশ অর্থাৎ হাড়, গোশত, চামড়া, চর্বি, রগ, পশম প্রভৃতি সর্বসম্মতিক্রমেই হারাম। তবে লাহম তথা গোশত যোগ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শূকর অন্যান্য হারাম জন্তুর ন্যায় নয়, তাই এটি যবেহ্ করলেও পাক হয় না। কেননা, গোশত খাওয়া হারাম এমন অনেক জন্তু রয়েছে যাদের যবেহ করার পর সেগুলোর হাড়, চামড়া প্রভৃতি পাক হতে পারে। কিন্তু যবেহ্ করার পরও শূকরের গোশ্ত হারাম তো বটেই, নাপাকও থেকে যায়। কেননা, এটি একাধারে যেমনি হারাম তেমনি ‘নাজাসে আইন’ বা অপবিত্র বস্তু। [মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষেপিত]
(৪) আয়াতে উল্লেখিত চতুর্থ হারাম বস্তু হচ্ছে সেসব জীব-জন্তু, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ বা উৎসর্গ করা হয়। সাধারণত এর তিনটি উপায় প্রচলিত রয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা উৎসর্গ করা হয় এবং যবেহ্ করার সময়ও সে নাম নিয়েই যবেহ করা হয়, যে নামে তা উৎসর্গিত হয়। এমতাবস্থায় যবেহকৃত জন্তু সমস্ত মত-পথের আলেম ও ফেকাহবিদগণের দৃষ্টিতেই হারাম ও নাপাক। এর কোন অংশের দ্বারাই ফায়দা গ্রহণ জায়েয হবে না। (وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ) আয়াতে যে অবস্থার কথা বোঝানো হয়েছে এ অবস্থা এর সরাসরি নমুনা, যে ব্যাপারে কারো কোন মতভেদ নেই।
দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা যবেহ্ করা হয়, তবে যবেহ্ করার সময় তা আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ্ করা হয়। যেমন অনেক অজ্ঞ মুসলিম পীর, কবরবাসী বা জীনের সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে গরু, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি মানত করে তা যবেহ করে থাকে। কিন্তু যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ করা হয়। এ সুরতটিও ফকীহগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী হারাম এবং যবেহকৃত জন্তু মৃতের শামিল। দুররে মুখতার কিতাবুয-যাবায়েহ অধ্যায়ে বলা হয়েছেঃ যদি কোন আমীরের আগমন উপলক্ষে তারই সম্মানার্থে কোন পশু যবেহ্ করা হয়, তবে যবেহকৃত সে পশুটি হারাম হয়ে যাবে। কেননা, এটাও তেমনি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে যা যবেহ্ করা হয় - এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত; যদিও যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ্ করা হয়। আল্লামা শামীও এ অভিমত সমর্থন করেছেন।
তৃতীয় সুরত হচ্ছে পশুর কান কেটে অথবা শরীরের অন্য কোথাও কোন চিহ্ন অঙ্কিত করে কোন দেব-দেবী বা পীর-ফকীরের নামে ছেড়ে দেয়া হয়। সেগুলো দ্বারা কোন কাজ নেয়া হয় না, যবেহ করাও উদ্দেশ্য থাকে না। বরং যবেহ্ করাকে হারাম মনে করে। এ শ্রেণীর পশু আলোচ্য দু’আয়াতের কোনটিরই আওতায় পড়ে না। এ শ্রেণীর পশুকে কুরআনের ভাষায় ‘বহীরা’ বা ‘সায়েবা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের পশু সম্পর্কে হুকুম হচ্ছে যে, এ ধরনের কাজ অর্থাৎ কারো নামে কোন পশু প্রভৃতি জীবন্ত উৎসর্গ করে ছেড়ে দেয়া কুরআনের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী হারাম। যেমন বলা হয়েছেঃ (مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلَا سَائِبَةٍ) “আল্লাহ তা'আলা বহীরা ও সায়েবা সম্পর্কে কোন বিধান দেননি।” (সূরা আল-মায়িদাহ ১০৩]
তবে এ ধরনের হারাম আমল কিংবা সংশ্লিষ্ট পশুটিকে হারাম মনে করার ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণেই সেটি হারাম হয়ে যাবে না। বরং হারাম মনে করাতেই তাদের একটা বাতিল মতবাদকে সমর্থন এবং শক্তি প্রদান করা হয়। তাই এরূপ উৎসর্গকৃত পশু অন্যান্য সাধারণ পশুর মতই হালাল। শরীআতের বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পশুর উপর তার মালিকের মালিকানা বিনষ্ট হয় না, যদিও সে ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরূপ মনে করে যে, এটি আমার মালিকানা থেকে বের হয়ে যে নামে উৎসর্গ করা হয়েছে তারই মালিকানায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু শরীআতের বিধানমতে যেহেতু তার সে উৎসর্গীকরণই বাতিল, সুতরাং সে পশুর উপর তারই পূর্ণ মালিকানা কায়েম থাকে। [মা'আরিফুল কুরআন]
(৫) এ ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম মরণাপন্ন অবস্থায়ও হারাম বস্তু খাওয়াকে হালাল ও বৈধ বলেনি; বলেছে, “তাতে তার কোন পাপ নেই”। এর মর্ম এই যে, এসব বস্তু তখনো যথারীতি হারামই রয়ে গেছে, কিন্তু যে লোক খাচ্ছে তার অনোন্যপায় অবস্থার প্রেক্ষিতে হারাম খাদ্য গ্রহণের পাপ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে অনোন্যপায় হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়নি। অন্য আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, “তবে কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তখন আল্লাহ নিশ্চয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-মায়েদাহ: ৩] অর্থাৎ ক্ষুধার কারণেই শুধু হারাম বস্তু গ্রহণ করা যেতে পারে।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৩) নিশ্চয় (আল্লাহ) তোমাদের জন্য শুধু মৃত জীব, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যে সব জন্তুর উপরে (যবেহ কালে) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়ে থাকে, তা তোমাদের জন্য অবৈধ করেছেন। [1] কিন্তু যে অনন্যোপায় অথচ অন্যায়কারী কিংবা সীমালংঘনকারী নয়, তার কোন পাপ হবে না। আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
[1] এই আয়াতে চারটি হারামকৃত জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এখানে إنما শব্দ দ্বারা সীমিতকরণে এই সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, হারাম কেবল এই চারটি জিনিসই। অথচ এ ছাড়াও আরো অনেক জিনিস হারাম আছে। তাই প্রথমতঃ এটা বুঝে নেওয়া উচিত যে, এই সীমিতকরণ বিশেষ কথা প্রসঙ্গে এসেছে। অর্থাৎ, মুশরিকরা হালাল জানোয়ারকেও হারাম করে নিত। তাই মহান আল্লাহ বললেন, হারাম শুধুমাত্র এইগুলো। কাজেই এই সীমিতকরণ তুলনামূলক। অর্থাৎ, এ ছাড়াও আরো হারাম জিনিস আছে যা এখানে উল্লিখিত হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ হাদীসে প্রাণীর হালাল-হারাম সংক্রান্ত দু’টি মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। সেটাকে আয়াতের সঠিক তাফসীর হিসেবে সামনে রাখা উচিত। হিংস্র পশুর মধ্যে শিকারী দাঁত বিশিষ্ট পশু এবং পাখীর মধ্যে শিকারী নখ বিশিষ্ট পাখী হারাম। তৃতীয়তঃ যেসব পশুর হারাম হওয়ার কথা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত; যেমন গাধা, কুকুর ইত্যাদি, সেগুলোও হারাম। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, হাদীসও কুরআনের মত দ্বীনের উৎস এবং শরীয়তের দলীল। দুটোকে মেনে নিলেই দ্বীন পরিপূর্ণ হবে, শুধু কুরআন মানলে ও হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করলে দ্বীন পরিপূর্ণ হবে না। ‘মৃত’ বলতে, এমন হালাল পশু যা যথানিয়মে যবেহ ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে অথবা কোন দুর্ঘটনায় (বিস্তারিত আলোচনা সূরা মায়েদাহ ৩নং আয়াতে আছে) মারা গেছে কিংবা শরীয়তের তরীকার পরিপন্থী নিয়মে যাকে যবেহ করা হয়েছে; যেমন, গলা টিপে অথবা পাথর ও লাঠির আঘাত ইত্যাদি দ্বারা মারা হয়েছে কিংবা বর্তমানের যান্ত্রিক যবেহ দ্বারা মারা হয়েছে যা আসলে আঘাত দিয়ে হত্যা করার শামিল (তা আসলে মৃত এবং হারাম)। তবে হাদীসে দু’টো মৃত প্রাণী বৈধ করা হয়েছে। আর তা হল, মাছ ও পঙ্গপাল। এ দু’টো মৃত হারাম হওয়ার বিধান থেকে স্বতন্ত্র। ‘রক্ত’ বলতে প্রবাহিত রক্ত। অর্থাৎ, যবেহ করার পর যে রক্ত বের হয়ে বয়ে যায়। গোশতের সাথে যে রক্ত লেগে থাকে, তা হালাল। এছাড়াও দু’টো রক্তকে হাদীসে বৈধ বলা হয়েছেঃ কলিজা (লিভার) এবং তিল্লী (প্লীহা)।
শুয়োর নিকৃষ্ট জানোয়ার; বিধায় আল্লাহ তাকে হারাম করেছেন। শরীয়তে এমন জানোয়ারও হারাম, যাকে গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করা হয়েছে। যেমন, আরবের মুশরিকরা লাত এবং উয্যা ইত্যাদির নামে এবং অগ্নিপূজকরা আগুনের নামে (বা উদ্দেশ্যে) যবেহ করত। আর এরই আওতাভুক্ত হল সেই পশু, যাকে অজ্ঞ মুসলিমরা মৃত ওলীদের ভালবাসায়, তাদের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে অথবা তাদের ভয়ে এবং তাদের নিকট (কোন কিছু পাওয়ার) আশায় কবর ও আস্তানাসমূহে যবেহ করে বা আস্তানার খাদেমকে ওলীর নামে দান করে আসে। (যেমন, অনেক আউলিয়ার কবরে সাইনবোর্ড লাগানো আছে যে, ‘দাতা’ সাহেবের নামে দান করার জন্য গরু-ছাগল এখানে জমা করুন।) ওলীর নামে উৎসর্গীকৃত এই পশুগুলো আল্লাহর নামে যবেহ করা হলেও তা হারাম। কারণ, এ থেকে উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ নয়, বরং কবরবাসীর সন্তুষ্টি লাভ, গায়রুল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন অথবা তার (অতিপ্রাকৃত) ভয়ে বা তার নিকট (কিছু পাওয়ার) আশা করে করা হয়; যা শিরক।
অনুরূপ পশু ছাড়াও যেসব জিনিস গায়রুল্লাহর নামে মানত ও দান করা হয়, তা সবই হারাম। যেমন, কবরে নিয়ে গিয়ে অথবা সেখান থেকেই ক্রয় করে সেখানে উপস্থিত ফকীর-মিসকীনদের মাঝে ডেগচির খয়রাতী খাবার কিংবা মিষ্টি ও টাকা-পয়সা বণ্টন কিংবা নযরানার বাট্টে মানত ও দানের টাকা-পয়সা দেওয়া অথবা উরসের সময় সেখানে দুধ ইত্যাদি খাদ্য পাঠানো; এ সমস্ত কার্যকলাপ হারাম ও অবৈধ। কেননা, এ সবই গায়রুল্লাহর নামে মানত ও দান করা বিবেচিত হয়। মানত করাও নামায-রোযা ইত্যাদি ইবাদতের মত একটি ইবাদত। আর সর্বপ্রকার ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। এ জন্যই হাদীসে এসেছে যে, ‘‘সে অভিশপ্ত, যে গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করে।’’ (সহীহুল জা’মে আলবানী ২/১০২৪) তাফসীরে নিশাপুরীর হাওয়ালায় তাফসীরে আযিযীতে উল্লেখ হয়েছে যে, (أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ لَو أَنَّ مُسْلِمًا ذَبَحَ ذَبِيْحَةً يُرِيْدُ بِذَبْحِهَا التَّقَرُّبَ إِلَى غَيْرِ اللهِ، صَارَ مُرْتَدًّا وَذَبِيْحَتُهُ ذَبِيْحَةً مُرْتَدٍّ) ‘আলেমগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, যদি কোন মুসলিম গায়রুল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ করে, তাহলে সে মুরতাদ (দ্বীন থেকে খারিজ) হয়ে যাবে এবং তার যবেহ করা পশু একজন মুর্তাদ্দের যবেহকৃত পশুর মত হবে। (তাফসীরে আযিযী ৬১১ পৃষ্ঠা আশরাফুল হাওয়াশীর বরাতে)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৪. নিশ্চয় যারা গোপন করে আল্লাহ কিতাব হতে যা নাযিল করেছেন তা এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া(১) আর কিছুই খায় না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(১) এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, যে ব্যক্তি ধন-সম্পদের লোভে শরীআতের হুকুম-আহকাম পরিবর্তিত করে এবং তার বিনিময়ে যে হারাম ধন-সম্পদ গ্রহণ করে, তা যেন সে নিজের পেটে জাহান্নামের আগুন ভরে। কারণ, এ কাজের পরিণতি তাই।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৪) আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যারা তা গোপন করে ও তার বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করে, তারা কেবল আগুন দিয়ে আপন পেট পূর্ণ করে। শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে (পাপ-পঙ্কিলতা থেকে) পবিত্রও করবেন না; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৫. তারাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে; সুতরাং আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল!
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৫) তারাই সুপথের বদলে কুপথ এবং ক্ষমার বদলে শাস্তি ক্রয় করেছে, (দোযখের) আগুনে তারা কতই না ধৈর্যশীল!
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৬. সেটা এ জন্যই যে, আল্লাহ সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছেন আর যারা কিতাব সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করেছে অবশ্যই তারা সুদূর বিবাদে লিপ্ত।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৬) এসব এ জন্য যে, আল্লাহ সত্যস্বরূপ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, বস্তুতঃ যারা (কিতাবের মধ্যে) মতভেদ এনেছে, তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধাচরণে সুদূরগামী।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৭. পূর্ব ও পশ্চিম দিকে(১) তোমাদের মুখ ফিরানোই সৎকর্ম নয়, কিন্তু সৎকর্ম হলো যে ব্যক্তি আল্লাহ্, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতসমূহ ও নবীগণের প্রতি ঈমান(২) আনবে আর সম্পদ দান করবে তাঁর(৩) ভালবাসায়(৪) আত্মীয়-স্বজন(৫), ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দিবে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করবে(৬) অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করবে(৭)। তারাই সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকী।
(১) কাতাদাহ ও আবুল আলীয়াহ বলেন, ইয়াহুদীরা ইবাদতের সময় পশ্চিম দিকে আর নাসারারা পূর্ব দিকে মুখ করে থাকে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আল্লাহ্ তাআলা তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বলেন, সালাতে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে কি পশ্চিমদিকে, এ বিষয় নির্ধারণকেই যেন তোমরা দ্বীনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছ এবং এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই তোমাদের যাবতীয় আলোচনা-সমালোচনা আবর্তিত হতে শুরু করেছে। মনে হয়, তোমাদের ধারণায় শরীআতের অন্য কোন হুকুম-আহকামই যেন আর নেই।
(২) অন্য অর্থে এ আয়াতের লক্ষ্য মুসলিম, ইয়াহুদী, নাসারা নির্বিশেষে সবাই হতে পারে। এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ দাড়াবে এই যে, প্রকৃত পুণ্য বা সওয়াব আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্যের ভেতরই নিহিত। যেদিকে মুখ করে তিনি সালাতে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন, সেটাই শুদ্ধ ও পুণ্যের কাজে পরিণত হয়ে যায়। অন্যথায়, দিক হিসাবে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের কোনই বৈশিষ্ট্য নেই। দিকবিশেষের সাথে কোন পুণ্যও সংশ্লিষ্ট নয়। পুণ্য একান্তভাবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সাথেই সম্পৃক্ত। তাই আল্লাহ তা'আলা যতদিন বায়তুল-মুকাদ্দাসের প্রতি মুখ করে সালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন, ততদিন সেদিকে মুখ করাই ছিল পুণ্য। আবার যখন মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর হুকুম হয়েছে, এখন এ হুকুমের আনুগত্য করাই পুণ্যে পরিণত হয়েছে। [মা'আরিফুল কুরআন]
(৩) এখানে দুটি অর্থ হতে পারে, এক. আল্লাহর ভালবাসায় উপরোক্ত খাতে সম্পদ ব্যয় করা। দুই. সম্পদের প্রতি নিজের অতিশয় আসক্তি ও ভালাবাসা থাকা সত্বেও সে উপরোক্ত খাতসমূহে সম্পদ ব্যয় করা। উভয় অর্থই এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে শেষোক্ত মতটিকেই অনেকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [তাফসীরে বাগভী] এ মতের সপক্ষে বিভিন্ন হাদীসে সম্পদের আসক্তি সত্বেও তা ব্যয় করার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সব চেয়ে বেশী সওয়াবের সাদাকাহ কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি সুস্থ ও আসক্তিপূর্ণ অবস্থায়, দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয়, ধনী হওয়ার আকাংখা থাকা সত্বেও সাদাকাহ করা”। [বুখারী: ১৪১৯, মুসলিম: ১০৩২]
(৪) এ আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির দ্বারাই এ তথ্যও সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, ধন-সম্পদের ফরয শুধুমাত্র যাকাত প্রদানের মাধ্যমেই পূর্ণ হয় না, যাকাত ছাড়া আরও বহু ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করা ফরয ও ওয়াজিব হয়ে থাকে। যেমন, রুযী-রোযগারে অক্ষম আত্মীয়-স্বজনের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কারো সামনে যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হয়, তবে যাকাত প্রদান করার পরেও সে দরিদ্রের জীবন রক্ষার্থে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ফরয হয়ে পড়ে। অনুরূপ যেসব স্থানে প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে মসজিদ তৈরী করা এবং দ্বীনীশিক্ষার জন্য মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করাও আর্থিক ফরযের অন্তর্গত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, যাকাতের একটা বিশেষ বিধান রয়েছে, সে বিধান অনুযায়ী যে কোন অবস্থায় যাকাত প্রদান করতে হবে, কিন্তু অন্যান্য খরচের ফরয হওয়ার বেলায় প্রয়োজন দেখা দেয়া শর্ত। [মাআরিফুল কুরআন]
(৫) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম সদকাহ হচ্ছে সেটি যা এমন আত্মীয় স্বজনের জন্য করা হয় যারা তোমার থেকে বিমুখ হয়ে আছে।” [মুসনাদে আহমাদ:৩/৪০২, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ: ৪/৭৮] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিসকীনের উপর সদকাহ করলে সেটি সদকাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে যদি আত্মীয়-স্বজনের উপর সদকাহ করা হয় তবে তা হবে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সদকাহ।” [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৮]
(৬) অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির মধ্যে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার অভ্যাস সব সময়ের জন্য থাকতে হবে, ঘটনাচক্রে কখনো কখনো অঙ্গীকার পূরণ করলে চলবে না। কেননা, এরূপ মাঝে-মধ্যে কাফের-গোনাহগাররাও ওয়াদা-অঙ্গীকার পূরণ করে থাকে। সুতরাং এটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না। তেমনিভাবে মুআমালাতের বর্ণনায় শুধুমাত্র অঙ্গীকার পূরণ করার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, ক্রয়-বিক্রয়, অংশীদারিত্ব, ভাড়া-ইজারা প্রভৃতি বৈষয়িক দিকসমূহের সুষ্ঠতা ও পবিত্রতাই অঙ্গীকার পূরণের উপর নির্ভরশীল।
(৭) আখলাক বা মন-মানসিকতার সুস্থতা বিধান সম্পর্কিত বিধি-বিধানের আলোচনায় একমাত্র ‘সবর’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, ‘সবর’-এর অর্থ হচ্ছে মন-মানসিকতা তথা নফসকে বশীভূত করে অন্যায়-অনাচার থেকে সর্বোতভাবে সুরক্ষিত রাখা। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, মানুষের হৃদয়বৃত্তিসহ আভ্যন্তরীণ যত আমল রয়েছে, সবরই সেসবের প্রাণস্বরূপ। এরই মাধ্যমে সর্বপ্রকার অন্যায় ও কদাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৭) পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে পুণ্য নেই;[1] কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফিরিশতাগণ, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণকে বিশ্বাস করলে এবং অর্থের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, (এতীম-মিসকীন) মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী (ভিক্ষুক)গণকে এবং দাস মুক্তির জন্য দান করলে, নামায যথাযথভাবে পড়লে ও যাকাত প্রদান করলে, প্রতিশ্রুতি পালন করলে এবং দুঃখ-দৈন্য, রোগ-বালা ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং ধর্মভীরু।
[1] এই আয়াত ক্বিবলা সংক্রান্ত ব্যাপারেই নাযিল হয়েছে। একদিকে ইয়াহুদীরা নিজেদের ক্বিবলার (বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পশ্চিম দিক) এবং খ্রিষ্টানরা তাদের ক্বিবলার (বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ব দিক)-কে বড়ই গুরুত্ব দিচ্ছিল এবং এ নিয়ে গর্বও করছিল, অন্য দিকে মুসলিমদের ক্বিবলার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্ন রকমের মন্তব্য করছিল। যার কারণে কোন কোন মুসলিমও অনেক সময় আন্তরিক দুঃখবোধ করত। তাই মহান আল্লাহ বললেন, আসলে পশ্চিম ও পূর্বের দিকে মুখ করাটাই স্বয়ং কোন নেকীর কাজ নয়, বরং এটা তো কেবল এককেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ করণের একটি পদ্ধতি মাত্র। প্রকৃত নেকী হল, আকীদা সম্পর্কীয় সেই সব জিনিসের উপর ঈমান আনা, যা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এবং সেই সব আমল ও নৈতিকতার প্রতি যত্ন নেওয়া, যার তিনি তাকীদ করেছেন। এর পরবর্তীতে সেই আকীদা ও আমলগুলো বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর উপর ঈমান (বিশ্বাস) হল এই যে, তাঁকে তাঁর সত্তা, উপাস্যত্ব ও গুণাবলীতে একক মনে করা, সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে তাঁকে পাক-পবিত্র মনে করা এবং কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত তাঁর যাবতীয় গুণাবলীর কোন অপব্যাখ্যা না করে বা তার কোন কিছুকে নিষ্ক্রিয়য় না মনে করে এবং তার কোন ধরন-গঠন নির্ণয় না করে তা মেনে নেওয়া। শেষ বিচার দিবস, পুনরুত্থান এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে বিশ্বাস করা। ‘কিতাব’ বলতে সমস্ত আসমানী কিতাবের সত্যতার উপর ঈমান আনা। ফিরিশতাদের অস্তিত্ব ও সকল নবীদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। এই বিশ্বাসসমূহের সাথে সাথে আয়াতে উল্লিখিত আমলগুলোর প্রতিও যত্ন নিতে হবে। عَلَى حُبِّهِ এর (ه) সর্বনাম মালের দিকে ইঙ্গিত করছে। অর্থাৎ, মালের প্রতি ভালবাসা বা আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তা ব্যয় করা। البَاْسَاءِ থেকে দারিদ্র্য এবং অতীব অভাব الضَرَّآءِ থেকে ক্ষতি ও রোগ এবং الْبَاْسِ থেকে যুদ্ধ ও তার কঠিনতাকে বুঝানো হয়েছে। এই তিনটি অবস্থায় ধৈর্য ধরা। অর্থাৎ, আল্লাহর বিধানাদি থেকে বিমুখ না হওয়া বড় কঠিন কাজ, তাই এই তিনটি অবস্থাকে বিশেষ করে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৮. হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর কিসাসের(১) বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রিতদাস, নারীর বদলে নারী। তবে তার ভাইয়ের(২) পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির(৩) অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য। এটা তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে শিথিলতা ও অনুগ্রহ। সুতরাং এর পরও যে সীমালংঘন করে(৪) তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(১) কিসাস’-এর শাব্দিক অর্থ সমপরিমাণ বা অনুরূপ। অর্থাৎ অন্যের প্রতি যতটুকু যুলুম করা হয়েছে, তার সমপরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার পক্ষে জায়েয এর চাইতে বেশী কিছু করা জায়েয নয়। এ সূরারই ১৯৪ নং আয়াতে এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অত:পর যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে। অনুরূপ সূরা আন-নাহলের ১২৬ নং আয়াতে রয়েছে, আর যদি তোমরা শাস্তি দাও তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে, এতে আলোচ্য বিষয়ই আরও বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। সে মতে শরীআতের পরিভাষায় ‘কিসাস’ বলা হয় হত্যা ও আঘাতের সে শাস্তিকে, যা সমতা ও পরিমাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিধান করা হয়। এখানে কয়েকটি বিষয় জানা বিশেষভাবে জরুরী:
এক. কিসাস কেবল ইচ্ছাকৃত হত্যার বেলায়ই প্রযোজ্য। আর ইচ্ছাকৃত হত্যা বলা হয় কোন অস্ত্র কিংবা এমন কোন কিছুর দ্বারা হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করা, যার দ্বারা রক্ত প্রবাহিত হয় অথবা হত্যা সংঘটিত হয় সুতরাং কিসাস অর্থাৎ ‘জানের বদলে জান’ এ ধরনের হত্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
দুই. এ ধরনের হত্যার অপরাধে স্ত্রীলোক হত্যার অপরাধে পুরুষকে এবং পুরুষ হত্যার অপরাধে স্ত্রীলোককেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আয়াতে স্ত্রীলোকের বদলায় স্ত্রীলোককে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার যে উল্লেখ রয়েছে, তা একটা বিশেষ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে, যে ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি নাযিল হয়।
তিন. ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে যদি হত্যাকারীকে সম্পূর্ণ মাফ করে দেয়া হয়, যেমন নিহত ব্যক্তির ওয়ারিস মাত্র দুই পুত্র, সে দুজনই যদি মাফ করে দেয়, তবে এমতাবস্থায় হত্যাকারীর উপর কোন কিছু ওয়াজিব হবে না। সে ব্যক্তি সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যদি পূর্ণ মাফ না হয়, অর্থাৎ উপরোক্ত ক্ষেত্রে এক পুত্র মাফ করে এবং অপর পুত্র তা না করে, তবে এমতাবস্থায় হত্যাকারী কেসাসের দণ্ড থেকে অব্যাহতি পাবে সত্য, কিন্তু এক পুত্রের দাবীর বদলায় অর্ধেক দিয়াত প্রদান করতে হবে। শরীআতের বিধানে হত্যার বদলায় যে দিয়াত বা অর্থদণ্ড প্রদান করতে হয়, তার পরিমাণ হচ্ছে মধ্যম আকৃতির একশ’ উট।
চার. কেসাসের আংশিক দাবী মাফ হয়ে গেলে যেমন মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হয়ে দিয়াত ওয়াজিব হয়, তেমনি উভয় পক্ষ যদি কোন নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ প্রদানের শর্তে আপোষ-নিম্পত্তি করে ফেলে, তবে সে অবস্থাতেও ‘কিসাস’ মওকুফ হয়ে অর্থ প্রদান করা ওয়াজিব হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে, যা ফেকাহর কিতাবসমূহে বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত রয়েছে।
পাঁচ. নিহত ব্যক্তির যে ক’জন ওয়ারিস থাকবে, তাদের প্রত্যেকেই মীরাস’-এর অংশ অনুপাতে ‘কিসাস’ ও ‘দিয়াত’-এর মালিক হবে এবং দিয়াত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ ‘মীরাস’-এর অংশ অনুপাতে বন্টিত হবে। তবে কিসাস যেহেতু বন্টনযোগ্য নয়, সেহেতু ওয়ারিসগণের মধ্য থেকে যে কোন একজনও যদি কেসাসের দাবী ত্যাগ করে, তবে তার উপর কিসাস ওয়াজিব হবে না; বরং দিয়াত ওয়াজিব হবে এবং প্রত্যেকেই অংশ অনুযায়ী দিয়াতের ভাগ পাবে।
ছয়. কিসাস গ্রহণ করার অধিকার যদিও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারগণের, তথাপি নিজেরা সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির বদলায় হত্যাকারীকে তারা নিজেরা হত্যা করতে পারবে না। এ অধিকার আদায় করার জন্য আইনী কর্তৃপক্ষের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। কেননা, কোন অবস্থায় কিসাস ওয়াজিব হয় এবং কোন অবস্থায় হয় না, এ সম্পর্কিত অনেক সূক্ষ্ম দিকও রয়েছে, যা সবার পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা রাগের মাথায় বাড়াবাড়িও করে ফেলতে পারে, এ জন্য আলেম ও ফেকাহবিদগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী ‘কিসাস’-এর হক আদায় করার জন্য ইসলামী আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। [মাআরিফুল কুরআন]
(২) 'ভাই' শব্দটি ব্যবহার করে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কোমল ব্যবহার করার সুপারিশও করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের ও তার মাঝে চরম শক্রতার সম্পর্ক থাকলেও আসলে সে তোমাদের মানবিক ভ্রাতৃ-সমাজেরই একজন সদস্য। তাছাড়া এখানে যে ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছাকৃত হত্যার বেলায় কিসাস না গ্রহণ করে দিয়াত গ্রহণ করা। [বুখারী: ৪৪৯৮]
(৩) এখানে কুরআনে ‘মা’রূফ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআনে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এর অর্থ হচ্ছে, এমন একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি যার সাথে সাধারণত সবাই সুপরিচিত। প্রত্যেকটি নিরপেক্ষ ব্যক্তি যার কোন স্বার্থ এর সাথে জড়িত নেই, সে প্রথম দৃষ্টিতেই যেন এর সম্পর্কে বলে উঠেঃ হ্যাঁ, এটিই ভারসাম্যপূর্ণ ও উপযোগী কর্মপদ্ধতি। প্রচলিত রীতিকেও ইসলামী পরিভাষায় উরফ ও মা’রূফ বলা হয়। যেসব ব্যাপারে শরীআত কোন বিশেষ নিয়ম নির্ধারণ করেনি,এমন সবব্যাপারেই একে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়।
(৪) ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ, যে ব্যক্তি দিয়াত গ্রহণ করার পর হত্যা করতে উদ্যত হয়। [বুখারী: ১১১, মুসলিম: ১৩৭০]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৮) হে বিশ্বাসিগণ! নরহত্যার ব্যাপারে তোমাদের জন্য ক্বিস্বাসের (প্রতিশোধ গ্রহণের বিধান) বিধিবদ্ধ করা হল; স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী।[1] কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ হতে কিছুটা ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে, প্রচলিত প্রথার অনুসরণ করা ও সদয়ভাবে তার দেয় পরিশোধ করা উচিত।[2] এ তো তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে ভার লাঘব ও অনুগ্রহ।[3] এর পরও যে সীমালংঘন করে, তার জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে।[4]
[1] জাহেলিয়াতের যুগে কোন আইন-কানুন ছিল না, তাই সবল গোত্রগুলো দুর্বল গোত্রগুলোর উপর যেভাবে চাইতো যুলুম-অত্যাচার করত। তাদের যুলুমের একটি প্রকার এ রকম ছিল যে, যদি সবল গোত্রের কোন পুরুষ হত্যা হয়ে যেত, তাহলে তারা কেবল হত্যাকারীকে হত্যা করার পরিবর্তে তার (হত্যাকারীর) পরিবারের কয়েকজনকে এমন কি কখনো কখনো পুরো গোত্রকে বিনাশ করার প্রচেষ্টা করত এবং মহিলার পরিবর্তে পুরুষকে ও ক্রীতদাসের পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করত। মহান আল্লাহ এই ভেদাভেদ উচ্ছেদ করে বললেন, যে হত্যা করবে, ক্বিসাসে (প্রতিশোধ গ্রহণে) কেবল তাকেই হত্যা করা হবে। হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তি হলে, বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই, ক্রীতদাস হলে, ঐ ক্রীতদাসকেই এবং মহিলা হলে, ঐ মহিলাকেই হত্যা করা হবে। ক্রীতদাসের পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তিকে, মহিলার পরিবর্তে পুরুষকে অথবা একজন পুরুষের পরিবর্তে কয়েকজন পুরুষকে হত্যা করা যাবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, পুরুষ যদি মহিলাকে হত্যা করে, তাহলে ক্বিস্বাসে কোন মহিলাকে হত্যা করা হবে অথবা মহিলা যদি পুরুষকে হত্যা করে, তবে ক্বিস্বাসে কোন পুরুষকে হত্যা করা হবে (যেমন শব্দের বাহ্যিক ভাবার্থ থেকে এটাই ফুটে উঠছে)। বরং শব্দগুলো আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ অনুপাতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে; যার পরিষ্কার অর্থ (লক্ষ্যার্থ) হল, ক্বিস্বাসে হত্যাকারীকেই হত্যা করা হবে। তাতে সে পুরুষ হোক অথবা মহিলা, সবল হোক কিংবা দুর্বল। হাদীসে এসেছে, সমস্ত মুসলিমের রক্ত (পুরুষ হোক বা মহিলা) সমান। (আবূ দাউদ ২৭৫১) সুতরাং, আয়াতের অর্থ হল তা-ই যা অন্য আয়াতে এসেছে, প্রাণের বদলে প্রাণ। (মাইদাহ ৪৫ আয়াত) হানাফী উলামাগণ এই আয়াত থেকে সাব্যস্ত করেছেন যে, মুসলিমকে কাফেরের ক্বিস্বাসে হত্যা করা যাবে। কিন্তু অধিকাংশ আলেমগণ এ কথার সমর্থন করেননি। কারণ, হাদীসে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, মুসলিমকে কাফেরের ক্বিস্বাসে হত্যা করা যাবে না। (বুখারী ১১১নং, ফাতহুল ক্বাদীর, আরো দেখুন সূরা মাইদার ৪৫নং আয়াতের টীকা।)
[2] ক্ষমা করে দেওয়ার দু’টি পদ্ধতি। যথাঃ (ক) মালের কোন বিনিময় গ্রহণ ছাড়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ক্ষমা করে দেওয়া। (খ) ক্বিসাসের পরিবর্তে মুক্তিপণ গ্রহণ করে নেওয়া। দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করলে মুক্তিপণের দাবীদারকে বলা হয়েছে যে, সে যেন প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করে। আর {وَاَدآءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ} এ হত্যাকারীকে বলা হচ্ছে যে, সে যেন কোন সংকীর্ণতা সৃষ্টি না করে বিনিময় ভালভাবে আদায় করে দেয়। হতের আত্মীয়রা তার প্রাণ না নিয়ে তার উপর যে অনুগ্রহ করল, তার বদলাও অনুগ্রহের সাথে হওয়া দরকার।
{هَلْ جَزَاءُ الْأِحْسَانِ إِلَّا الْأِحْسَانُ} الرحمن:(60)
[3] এই লাঘব এবং অনুগ্রহ (অর্থাৎ, ক্বিস্বাস, ক্ষমা অথবা মুক্তিপণ গ্রহণ এই তিনটি পদ্ধতিই) আল্লাহর পক্ষ থেকে খাস তোমাদের জন্যই। ইতিপূর্বে তাওরাতধারীদের জন্য কেবল ক্বিস্বাস ও ক্ষমা ছিল। মুক্তিপণ ছিল না। আর ইঞ্জীলধারীদের মাঝে কেবল ক্ষমা ছিল; ক্বিস্বাস ছিল না এবং মুক্তিপণও না। (ইবনে কাসীর)
[4] মুক্তিপণ গ্রহণ করার পর যদি আবার হত্যাকারীকে হত্যা করা হয়, তাহলে তা সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি হবে এবং এর শাস্তি তাকে দুনিয়াতেও ভোগ করতে হবে এবং আখেরাতেও।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭৯. আর হে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্নগণ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭৯) হে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমাদের জন্য ক্বিস্বাসে (প্রতিশোধ গ্রহণের বিধানে) জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।[1]
[1] যখন হত্যাকারীর এই ভয় হবে যে, আমাকেও ক্বিস্বাসে হত্যা করা হবে, তখন সে কাউকে হত্যা করতে সাহস পাবে না। যে সমাজে ক্বিস্বাসের আইন বলবৎ থাকে, সে সমাজে এ (ক্বিস্বাসে হত্যা হওয়ার) ভয় সমাজকে হত্যা ও খুনোখুনি থেকে সুরক্ষিত রাখে এবং এরই ফলে সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এর (বাস্তব) দৃশ্য আজও সৌদী আরবে লক্ষ্য করা যেতে পারে, যেখানে -আলহামদু লিল্লাহ- ইসলামী দন্ড-বিধির কার্যকারিতার বরকতসমূহ বিদ্যমান রয়েছে। যদি অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলিও ইসলামী দন্ড-বিধি কার্যকরী করে জনসাধারণের জন্য শান্তিময় জীবন-যাপনের সুব্যবস্থা করতে পারত, তাহলে কতই না ভাল হত!
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৮০. তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তবে প্রচলিত ন্যায়নীতি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের জন্য অসিয়াত করার বিধান তোমাদেরকে দেয়া হল। এটা মুত্তাকীদের উপর কর্তব্য(১)।
(১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মতে অসিয়াত সম্পর্কিত এ নির্দেশটি ‘মীরাস’-এর আয়াত দ্বারা রহিত করে দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, মীরাসের আয়াত সে সমস্ত আত্মীয়দের জন্য অসিয়াত করা রহিত করে দেয়া হয়েছে, যাদের মীরাস নির্ধারিত ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য যেসব আত্মীয়ের অংশ মীরাসের আয়াতে নির্ধারণ করা হয়নি, তাদের জন্য অসিয়াত করার হুকুম এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। তবে আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে, যেসব আত্মীয়ের জন্য মীরাসের আয়াতে কোন অংশ নির্ধারণ করা হয়নি, তাদের জন্য অসিয়াত করা মৃত্যুপথযাত্রীর পক্ষে ফরয বা জরুরী নয়। সে ফরয রহিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজনবিশেষে এটা মুস্তাহাবে পরিণত হয়েছে।
অসিয়াত সম্পর্কিত এ আয়াতের নির্দেশ একাধারে যেমন কুরআনের মীরাস সম্পর্কিত আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে, তেমনি বিদায় হজের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঘোষিত নির্দেশের মাধ্যমেও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর বর্ণিত হাদীসটি রহিত হয়ে গেছে। বিদায় হজের বিখ্যাত খোতবায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা'আলা প্রত্যেক হকদারের হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন থেকে কোন ওয়ারিসের জন্য অসিয়াত নেই”। [তিরমিযী: ২১২০, আবু দাউদ: ৩৫৬৫, ইবনে মাজাহ: ২৭১৩]। তবে আলেমগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিগণের পক্ষে এখনো তাদের মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত আসিয়াত করা জায়েয।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৮০) তোমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে যখন কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বৈধভাবে ‘অসিয়ত’ করার বিধান দেওয়া হল। [1] ধর্মভীরুদের জন্য এটা অবশ্য পালনীয়।
[1] ‘অসিয়ত’ (উইল) করার এ নির্দেশ উত্তরাধিকার বিষয়ক আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তা রহিত হয়েছে। নবী করীম (সাঃ)-এর উক্তি হল-
(إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلِّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ) অর্থাৎ, অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক অধিকারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দিয়ে দিয়েছেন (অর্থাৎ, ওয়ারেসীনদের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন)। অতএব কোন উত্তরাধিকারের জন্য অসিয়ত করা জায়েয নয়। (আবূ দাউদ ২৮৭০, তিরমিযী ২১২১, নাসায়ী ৩৫৮১, ইবনে মাজা ২৭১৩, আহমদ ১৭২১২নং) তবে এমন আত্মীয়ের জন্য অসিয়ত করা যাবে, যে ওয়ারিস নয়। অনুরূপ সৎপথে ব্যয় করার জন্য অসিয়ত করা যাবে আর তার সর্বাধিক পরিমাণ হল (মোট সম্পত্তির) এক তৃতীয়াংশ। এর বেশী অসিয়ত করা যাবে না। (সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ফারায়েয, পরিচ্ছেদঃ মীরাসুল বানাত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান