৭ : ১৫১
قَالَ رَبِّ اغۡفِرۡ لِیۡ وَ لِاَخِیۡ وَ اَدۡخِلۡنَا فِیۡ رَحۡمَتِكَ ۫ۖ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ ﴿۱۵۱﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫১. মূসা বললেন, হে আমার রব! আমাকে ও আমার ভাইকে ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আপনার রহমতের মধ্যে প্রবিষ্ট করুন। আর আপনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫১) মূসা বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ও আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাদেরকে তোমার করুণায় আশ্রয় দান কর। আর তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫২
اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوا الۡعِجۡلَ سَیَنَالُهُمۡ غَضَبٌ مِّنۡ رَّبِّهِمۡ وَ ذِلَّۃٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ؕ وَ كَذٰلِكَ نَجۡزِی الۡمُفۡتَرِیۡنَ ﴿۱۵۲﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫২. নিশ্চয় যারা গো-বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্ৰহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদের উপর তাদের রবের ক্রোধ ও লাঞ্ছনা আপতিত হবেই(১)। আর এভাবেই আমরা মিথ্যা রটনাকারীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি(২)।
(১) আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, কোন কোন পাপের শাস্তি পার্থিব জীবনেই পাওয়া যায়, যেমনটি হয়েছিল সামের ও তার সঙ্গীদের বেলায়, কারণ গোবৎস উপাসনা থেকে যখন তারা যথার্থভাবে তাওবাহ করল না, তখন আল্লাহ তা'আলা সামেরীকে এ পৃথিবীতে অপমান-অপদস্থ করে ছেড়েছেন। তাকে মূসা আলাইহিস সালাম নির্দেশ দিয়ে দিলেন, সে যেন সকলের কাছ থেকে পৃথক থাকে; সেও যাতে কাউকে না ছোয় এবং তাকেও যেন কেউ না ছোয়। সুতরাং সারাজীবন এমনিভাবে জীবজন্তুর সাথে বসবাস করতে থাকে; কোন মানুষ তার সংস্পর্শে আসত না। কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা তার উপর এমন আযাব চাপিয়ে দিয়েছিলেন যে, যখনই সে কাউকে স্পর্শ করত কিংবা তাকে কেউ স্পর্শ করত, তখন সঙ্গে সঙ্গে উভয়েরই গায়ে জ্বর এসে যেত। [কুরতুবী]
(২) অর্থাৎ “যারা আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তাদেরকে এমনি শাস্তি দিয়ে থাকি।” সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ যারা দ্বীনী ব্যাপারে বিদ'আত অবলম্বন করে (অর্থাৎ দ্বীনে কোন প্রকার কুসংস্কার সৃষ্টি অথবা গ্রহণ করে) তারাও আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপের অপরাধে অপরাধী হয়ে সে শাস্তিরই যোগ্য হয়ে পড়ে। ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, দ্বীনী ব্যাপারে যারা নিজেদের পক্ষ থেকে কোন বিদ’আত বা কুসংস্কার আবিস্কার করে তাদের শাস্তি এই যে, তারা আখেরাতে আল্লাহর রোষানলে পতিত হবে এবং পার্থিব জীবনে অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করবে। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫২) (আল্লাহ বললেন,) নিশ্চয় যারা গোবৎসকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছে অচিরেই পার্থিব জীবনে তাদের উপর তাদের প্রতিপালকের ক্রোধ ও লাঞ্ছনা আসবে।[1] আর এভাবে আমি অপবাদ রচনাকারীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। [2]
[1] আল্লাহর গযব (ক্রোধ) এই ছিল যে, তাদের তওবার জন্য হত্যা আবশ্যিক করা হল। আর এর পূর্বে তারা যতদিন জীবিত থাকল লাঞ্ছনা ও অপমানের উপযুক্ত বলে গণ্য হল।
[2] এই শাস্তি শুধুমাত্র তাদের জন্য নয়; বরং যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রচনা করে, আমি তাদেরকে এই শাস্তিই দিয়ে থাকি।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৩
وَ الَّذِیۡنَ عَمِلُوا السَّیِّاٰتِ ثُمَّ تَابُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِهَا وَ اٰمَنُوۡۤا ۫ اِنَّ رَبَّكَ مِنۡۢ بَعۡدِهَا لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۵۳﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৩. আর যারা অসৎকাজ করে, তারা পরে তওবা করলে ও ঈমান আনলে আপনার রব তো এরপরও পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(১)
(১) এ আয়াতে সেসব লোকের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা মূসা আলাইহিস্ সালামের সতর্কীকরণের পর নিজেদের এই অপরাধের জন্য তাওবাহ করে নিয়েছে এবং তাওবাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কঠোরতর শর্ত আরোপ করা হয়েছিল যে, তাদেরই একজন অপরজনকে হত্যা করতে থাকলেই তাওবাহ কবুল হবে- তারা সে শর্তও পালন করল, তখন মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলা নির্দেশক্রমে তাদেরকে বললেনঃ তোমাদের সবার তাওবাহই কবুল হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞে যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তারা শহীদ হয়েছে আর যারা বেঁচে রয়েছে, তারা এখন ক্ষমাপ্রাপ্ত। [তাবারী]
এ আয়াতে বলা হয়েছে, যেসব লোক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তা সে কাজ যত বড় পাপই হোক, কুফরীও যদি হয়, তবুও পরবর্তীতে তাওবাহ করে নিলে এবং ঈমান ঠিক করে ঈমানের দাবী অনুযায়ী নিজের আমল বা কর্ম সংশোধন করে নিলে, আল্লাহ তাকে নিজ রহমতে ক্ষমা করে দেবেন। কাজেই কারো দ্বারা কোন পাপ হয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে তাওবাহ করে নেয়া একান্ত কর্তব্য।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৩) পক্ষান্তরে যারা অসৎকাজ করে, অতঃপর তারা পরে তওবা করে ও ঈমান আনে (তাদের জন্য) এসব কিছুর পরেও তোমার প্রতিপালক নিশ্চয়ই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[1]
[1] হ্যাঁ, যারা তওবা করে, আল্লাহ তাদের জন্য চরম ক্ষমাশীল পরম দয়াবান। জানা গেল যে, তওবার কারণে সকল গোনাহ মাফ হয়ে যায়। তবে শর্ত এই যে, তওবা বিশুদ্ধ হতে হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৪
وَ لَمَّا سَكَتَ عَنۡ مُّوۡسَی الۡغَضَبُ اَخَذَ الۡاَلۡوَاحَ ۚۖ وَ فِیۡ نُسۡخَتِهَا هُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلَّذِیۡنَ هُمۡ لِرَبِّهِمۡ یَرۡهَبُوۡنَ ﴿۱۵۴﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৪. আর মূসার রাগ যখন প্রশমিত হল, তখন তিনি ফলকগুলো তুলে নিলেন। যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের জন্য সে কপিগুলোতে(১) যা লিখিত ছিল তাতে ছিল হিদায়াত ও রহমত।
(১) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মূসা আলাইহিস সালামের রাগ যখন প্রশমিত হয়,তখন তাড়াতাড়ি ফেলে রাখা তাওরাতের তখতিগুলি আবার তুলে নিলেন। نسخة বা সংকলন বলা হয় সে লেখাকে যা কোন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, মূসা আলাইহিস সালাম ক্রোধবশত যখন তাওরাতের তখতিগুলি মাথা থেকে তাড়াহুড়া করে নামিয়ে রাখেন, তখন সেগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিল। আল্লাহ্ তাআলা পরে অন্য কোন কিছুতে লিখে তাওরাত দিয়েছিলেন, একেই নোসখা বলা হয়। [কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৪) মূসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হল, তখন সে ফলকগুলি তুলে নিল। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য ওর প্রতিলিপিতে[1] ছিল পথ-নির্দেশ ও করুণা। [2]
[1] نُسخَة শব্দটি فُعلَة এর ওজনে منسوخ এর অর্থে (কপি, প্রতিলিপি)। আসল ও নকল উভয় কপিকেই نسخة বলা হয়। এখানে আসল ফলককে বুঝানো হয়েছে, যাতে তাওরাত লিখিত ছিল। অথবা নকলকৃত কপিকে বুঝানো হয়েছে, যা ফলকগুলিকে সজোরে ফেলে দেওয়ার ফলে ভেঙ্গে যাওয়ার পর নকল করা হয়েছিল। তবে প্রথমটিই সঠিক বলে মনে হয়। কেননা পরবর্তিতে বলা হচ্ছে যে, মূসা (আঃ) উক্ত ফলকগুলি তুলে নেন। যাতে বুঝা যায় যে, ফলকগুলি ভেঙ্গে যায়নি। যাই হোক, এখানে উদ্দেশ্য তার বিষয়-বস্তু।
[2] তাওরাতকেও কুরআনের মত ঐসকল লোকেদের জন্য পথনির্দেশ ও করুণা বলে গণ্য করা হয়েছে, যারা আল্লাহকে ভয় করে। কারণ আসমানী কিতাব থেকে উপকৃত এই শ্রেণীর লোকেরাই হয়ে থাকে। আর অন্যরা যেহেতু সত্য শোনা থেকে নিজেদের কানকে ও সত্য দেখা হতে নিজেদের চোখকে বন্ধ রাখে, সেহেতু তারা সাধারণতঃ এর উপকার হতে বঞ্চিত থাকে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৫
وَ اخۡتَارَ مُوۡسٰی قَوۡمَهٗ سَبۡعِیۡنَ رَجُلًا لِّمِیۡقَاتِنَا ۚ فَلَمَّاۤ اَخَذَتۡهُمُ الرَّجۡفَۃُ قَالَ رَبِّ لَوۡ شِئۡتَ اَهۡلَكۡتَهُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ وَ اِیَّایَ ؕ اَتُهۡلِكُنَا بِمَا فَعَلَ السُّفَهَآءُ مِنَّا ۚ اِنۡ هِیَ اِلَّا فِتۡنَتُكَ ؕ تُضِلُّ بِهَا مَنۡ تَشَآءُ وَ تَهۡدِیۡ مَنۡ تَشَآءُ ؕ اَنۡتَ وَلِیُّنَا فَاغۡفِرۡ لَنَا وَ ارۡحَمۡنَا وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الۡغٰفِرِیۡنَ ﴿۱۵۵﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৫. আর মূসা তার সম্প্রদায় থেকে সত্তর জন লোককে আমাদের নির্ধারিত স্থানে একত্র হওয়ার জন্য মনোনীত করলেন। অত:পর তারা যখন ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল, তখন মূসা বললেন, হে আমার রব। আপনি ইচ্ছে করলে আগেই তো এদেরকে এবং আমাকেও ধ্বংস করতে পারতেন! আমাদের মধ্যে যারা নির্বোধ, তারা যা করেছে সে জন্য কি আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন? এটা তো শুধু আপনার পরীক্ষা, যা দ্বারা আপনি যাকে ইচ্ছে বিপথগামী করেন এবং যাকে ইচ্ছে সৎপথে পরিচালিত করেন। আপনিই তো আমাদের অভিভাবক; কাজেই আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আর ক্ষমাশীলদের মধ্যে আপনিই তো শ্রেষ্ঠ।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৫) আর মূসা আপন সম্প্রদায় হতে সত্তর জন লোককে আমার প্রতিশ্রুতির সময়ে সমবেত হওয়ার জন্য মনোনীত করল। তারা যখন ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল[1] তখন মূসা বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি ইচ্ছা করলে পূর্বেই তো এদেরকে এবং আমাকেও ধ্বংস করতে পারতে। আমাদের মধ্যে যারা নির্বোধ তাদের কর্মদোষে কি তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করবে? এতো শুধু তোমার পরীক্ষা, যা দিয়ে তুমি যাকে ইচ্ছা বিপথগামী কর এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত কর। তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা কর ও আমাদের প্রতি দয়া কর এবং তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল। [2]
[1] ঐ সত্তরজন ব্যক্তির বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী টীকায় হবে। এখানে এটা বলা হচ্ছে যে, মূসা (আঃ) নিজ জাতির সত্তরজন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলেন এবং তাদেরকে ত্বূর পাহাড়ে নিয়ে গেলেন; যেখানে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হল। যার কারণে মূসা (আঃ) বললেন,----।
[2] বানী ইস্রাঈলের এই সত্তরজন ব্যক্তি কারা ছিল? এ সম্পর্কে মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একটি মত হল যে, যখন মূসা (আঃ) তাদেরকে তাওরাতের আহকাম শুনালেন, তারা বলল, ‘আমরা কেমন করে বিশ্বাস করব যে, এই কিতাব সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে? যতক্ষণ আমরা আল্লাহকে স্বয়ং কথা বলতে না শুনব, ততক্ষণ এটাকে মানব না।’ সুতরাং তিনি সত্তরজন ব্যক্তিকে বেছে নিলেন এবং তাদেরকে ত্বূর পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর সাথে কথোপকথন করলেন, যা তারাও শুনল। কিন্তু তারা একটি নতুন দাবী করে বসল যে, যতক্ষণ আমরা নিজ চোখে আল্লাহকে না দেখব, ঈমান আনব না। দ্বিতীয় মত হল, এই সত্তরজন ব্যক্তি হল তারা, যাদেরকে পূর্ণ জাতির তরফ হতে বাছুর-পূজার মহাপাপ থেকে তওবা করার জন্য ত্বূর পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর সেখানে গিয়ে তারা আল্লাহকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। তৃতীয় মত হল, এই সত্তরজন ব্যক্তি বানী ইস্রাঈলকে বাছূর-পূজা করতে দেখেছিল, কিন্তু তারা তাদেরকে নিষেধ করেনি। চতুর্থ মত হল, এই সত্তরজন ব্যক্তি যাদেরকে মহান আল্লাহর আদেশে নির্বাচন করে ত্বূর পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তারা আল্লাহর নিকট দু’আ করে। যার মধ্যে একটি দু’আ ছিল ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন কিছু দান কর, যা এর পূর্বে কাউকে দান করা হয়নি। আর না পরবর্তীতে কাউকে দান করা হবে।’ মহান আল্লাহর এই দু’আ পছন্দ হল না। যার কারণে তাদেরকে ভূমিকম্প দ্বারা ধ্বংস করা হল। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ দ্বিতীয় মতকে গ্রহণ করেছেন এবং ঐ ঘটনাকে সেই ঘটনা বলে নির্ধারিত করেছেন, যা সূরা বাক্বারার ৫৫নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে তাদের উপর বিদ্যুৎ (বজ্র) রূপে মৃত্যু নেমে এসেছিল। আর এখানে ভূমিকম্পন দ্বারা মৃত্যুর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, হতে পারে দুই আযাবই তাদের উপর এসেছিল; আকাশ হতে বজ্র ও পৃথিবী হতে ভূমিকম্প। যাই হোক, মূসা (আঃ) দু’আ ও দরখাস্ত করে বললেন, তাদের জন্য যদি ধ্বংসই অবধারিত ছিল, তাহলে এর পূর্বে যখন তারা বাছুর-পূজায় নিমগ্ন ছিল, তখনই ধ্বংস করতেন।---’ সুতরাং তার ফলে মহান আল্লাহ তাদেরকে পুনর্জীবন দান করলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৬
وَ اكۡتُبۡ لَنَا فِیۡ هٰذِهِ الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ اِنَّا هُدۡنَاۤ اِلَیۡكَ ؕ قَالَ عَذَابِیۡۤ اُصِیۡبُ بِهٖ مَنۡ اَشَآءُ ۚ وَ رَحۡمَتِیۡ وَسِعَتۡ كُلَّ شَیۡءٍ ؕ فَسَاَكۡتُبُهَا لِلَّذِیۡنَ یَتَّقُوۡنَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّكٰوۃَ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ بِاٰیٰتِنَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۵۶﴾ۚ
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৬. আর আপনি আমাদের জন্য এ দুনিয়াতে কল্যাণ লিখে দিন এবং আখেরাতেও। নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে ফিরে এসেছি।(১) আল্লাহ বললেন, ‘আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছে দিয়ে থাকি আর আমার দয়া- তা তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে(২)। কাজেই আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, ঈমান আনে।
(১) কুরআনের শব্দ هُدْنَا অর্থ আমরা ফিরে এসেছি অথবা তাওবাহ করেছি। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এই শব্দ থেকে তাদের নামকরণ করা হয়েছে ‘ইয়াহুদ’। [ইবন কাসীর]
(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়েই অহংকার করল। জাহান্নাম বলল, হে রব! আমার কাছে প্রবেশ করে প্রতাপান্বিত অত্যাচারী, অহংকারী, রাজা-বাদশা ও নেতাগোছের লোকেরা। আর জান্নাত বলল, হে রব! আমার কাছে প্রবেশ করে দূর্বল, ফকীর, মিসকীনরা। তখন আল্লাহ্ তাআলা জাহান্নামকে বললেন, তুমি আমার শাস্তি। তোমার দ্বারা যাকে ইচ্ছা আমি তাকে তা পৌছাই। আর জান্নাতকে বললনে, তুমি আমার রহমত, যা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। আর তোমাদের প্রত্যেককেই পূর্ণ করা আমার দায়িত্ব। তখন জাহান্নামে তার বাসিন্দাদের নিক্ষেপ করা হবে ...” [মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩; ৭৮]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা একশত রহমত সৃষ্টি করেছেন। তা থেকে মাত্র একটি রহমত তিনি সৃষ্টিকুলকে দিয়েছেন। প্রতিটি রহমত আসমান ও যমীনের চেয়েও প্রকাণ্ড। এর কারণেই মা তার সন্তানকে দয়া করে, এর কারণেই পাখি ও জীব-জন্তু পানি পান করে। অতঃপর যখন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, তখন তিনি সমস্ত সৃষ্টিকুল থেকে এ রহমতটি নিয়ে নিবেন এবং এটি ও বাকী ৯৯টির সবগুলিই তিনি মুত্তাকীদের জন্য নির্দিষ্ট করবেন। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর এ আয়াত, “কাজেই আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে” এর মর্ম।” [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ ১৩/১৮২]
কাতাদা ও হাসান বলেন, দুনিয়াতে তিনি নেককার ও বদকার সবার জন্যই রহমত লিখেছেন তবে আখেরাতে তা শুধু মুত্তাকীদের জন্য। [আত-তাফসীরুস সহীহ] ইবন আব্বাস বলেন, এখানে তাকওয়া অর্থ শির্ক থেকে বেঁচে থাকা। [তাবারী] কাতাদা বলেন, যাবতীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৬) এবং আমাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নির্ধারণ কর, আমরা তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি।’[1] আল্লাহ বললেন, আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছা দিয়ে থাকি, আর আমার দয়া তা তো প্রত্যেক বস্তুতে পরিব্যাপ্ত।[2] সুতরাং আমি তা (দয়া) তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা সাবধান হয়, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে।
[1] অর্থাৎ, তওবা করছি।
[2] এটি মহান আল্লাহর করুণার পরিব্যাপ্তিই বটে যে, পৃথিবীতে সৎ-অসৎ মু’মিন-কাফের সবাই আল্লাহর করুণা হতে উপকৃত হচ্ছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘আল্লাহর করুণার একশত অংশ আছে। তার মধ্যে একটি অংশ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। যার কারণে সৃষ্টি এক অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে থাকে; এমনকি পশুরাও নিজ নিজ বাচ্চার উপর মায়া করে নিজেদের পা তুলে নেয়। আর তিনি করুণার ৯৯ ভাগ অংশ নিজের কাছে রেখেছেন।’’ (মুসলিম ২১০৮, ইবনে মাজাহ ৪২৯৩নং)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৭
اَلَّذِیۡنَ یَتَّبِعُوۡنَ الرَّسُوۡلَ النَّبِیَّ الۡاُمِّیَّ الَّذِیۡ یَجِدُوۡنَهٗ مَكۡتُوۡبًا عِنۡدَهُمۡ فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ ۫ یَاۡمُرُهُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهٰهُمۡ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَ یُحِلُّ لَهُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیۡهِمُ الۡخَبٰٓئِثَ وَ یَضَعُ عَنۡهُمۡ اِصۡرَهُمۡ وَ الۡاَغۡلٰلَ الَّتِیۡ كَانَتۡ عَلَیۡهِمۡ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِهٖ وَ عَزَّرُوۡهُ وَ نَصَرُوۡهُ وَ اتَّبَعُوا النُّوۡرَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ مَعَهٗۤ ۙ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۵۷﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৭. যারা অনুসরণ করে রাসূলের, উম্মী(১) নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিপিবদ্ধ পায়(২), যিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন। এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন(৩)। আর তাদেরকে তাদের গুরুভাব ও শৃংখল হতে মুক্ত করেন যা তাদের উপর ছিল(৪)। কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম।(৫)
(১) আলোচ্য আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটি পদবী ‘রাসূল’ ও ‘নবী’ এবং এর সাথে সাথে তৃতীয় একটি বৈশিষ্ট্য ‘উম্মী’-এরও উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন আব্বাস বলেন, أمّي ‘উম্মী’ শব্দের অর্থ হল নিরক্ষর। যে লেখা-পড়া কোনটাই জানে না। [বাগভী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বলেছেন, “আমরা নিরক্ষর জাতি। লিখা জানি না, হিসাব জানি না।” [বুখারী: ১০৮০]
সাধারণ আরবদেরকে এ কারণেই কুরআন أمِّيِّنَ বা নিরক্ষর জাতি বলে অভিহিত করেছে যে, তাদের মধ্যে লেখা-পড়ার প্রচলন খুবই কম ছিল। কারও কারও মতে উম্মী শব্দটি ‘উম্ম’ শব্দের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বলা হয়েছে। আর উম্ম অর্থ, মা। অর্থাৎ সে তার মা তাকে যেভাবে প্রসব করেছে সেভাবে রয়ে গেছে। কারও কারও মতে শব্দটি ‘উম্মত’ শব্দের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বলা হয়েছে। পরে সম্পর্ক করার নিয়মানুসারে ‘তা’ বর্ণটি পড়ে গেছে। তখন অর্থ হবে, উম্মতওয়ালা নবী। কারও কারও মতে, শব্দটি ‘উম্মুল কুরা’ যা মক্কার এক নাম, সেদিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মক্কাবাসী। [বাগভী]
তবে বিখ্যাত মত হচ্ছে যে, উম্মী অর্থ নিরক্ষর। যদিও নিরক্ষর হওয়াটা কোন মানুষের জন্য প্রশংসনীয় গুণ নয়; বরং ক্রটি হিসাবেই গণ্য। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান-গরিমা, তত্ত্ব ও তথ্য অবগতি এবং অন্যান্য গুণবৈশিষ্ট্য ও পরাকাষ্ঠা সত্বেও উম্মী হওয়া তার পক্ষে বিরাট গুণ ও পরিপূর্ণতায় পরিণত হয়েছে। কারণ, শিক্ষাগত, কার্যগত ও নৈতিক পরাকাষ্ঠী যদি কোন লেখাপড়া জানা মানুষের দ্বারা প্রকাশ পায়, তাহলে তা হয়ে থাকে তার সে লেখাপড়ারই ফলশ্রুতি, কিন্তু কোন একান্ত নিরক্ষর ব্যক্তির দ্বারা এমন অসাধারণ, অভূতপূর্ব ও অনন্য তত্ত্ব-তথ্য ও সূক্ষ্ম বিষয় প্রকাশ পেলে, তা তার প্রকৃষ্ট মু'জিযা ছাড়া আর কি হতে পারে?
(২) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব গুণবৈশিষ্ট্য তাওরাত ও ইঞ্জলে লিপিবদ্ধ ছিল সেগুলোর কিছু আলোচনা তাওরাত ও ইঞ্জীলের উদ্ধৃতি সাপেক্ষে কুরআনুল কারীমেও করা হয়েছে। আর কিছু সে সমস্ত মনীষীবৃন্দের উদ্ধৃতিতে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের আসল সংকলন স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা নিজে পড়েই মুসলিম হয়েছেন। যেমন, কোন এক ইয়াহুদী বালক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করত। হঠাৎ সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অবস্থা জানার জন্য সেখানে গেলেন। তিনি দেখলেন, তার পিতা তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তাওরাত তিলাওয়াত করছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে ইয়াহুদী, আমি তোমাকে কসম দিচ্ছি সে মহান সত্তার যিনি মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি তাওরাত নাযিল করেছেন, তুমি কি তাওরাতে আমার অবস্থা ও গুণবৈশিষ্ট্য এবং আবির্ভাব সম্পর্কে কোন বর্ণনা পেয়েছ? সে অস্বীকার করল। তখন তার ছেলে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! তিনি (অর্থাৎ এই ছেলের পিতা) ভুল বলছেন। তাওরাতে আমরা আপনার আলোচনা এবং আপনার গুণবৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন হক মা'বূদ নাই এবং আপনি তার প্রেরিত রাসূল।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিলেন যে, এখন এ বালক মুসলিম। তার মৃত্যুর পর তার কাফন-দাফন মুসলিমরা করবে। তার পিতার হাতে দেয়া হবে না। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪১১] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এক ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে সবগুণ বর্ণনা করেছে যা সে তাওরাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে দেখেছে। তিনি বলেন, আমি আপনার সম্পর্কে তাওরাতে এ কথাগুলো পড়েছি- “মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ, তার জন্ম হবে মক্কায়, তিনি হিজরত করবেন তাইবার দিকে; আর তার দেশ হবে সিরিয়া। তিনি কঠোর মেজাজের হবেন না, কঠোর ভাষায় তিনি কথাও বলবেন না, হাটে-বাজারে তিনি হট্টগোলও করবেন না। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা থেকে তিনি দূরে থাকবেন।” [মুস্তাদরাকঃ ২/৬৭৮ হাদীসঃ ৪২৪২]
কাআবে আহবার বলেছেনঃ তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে লেখা রয়েছেঃ “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ও নির্বাচিত বান্দা। তিনি না কঠোর মেজাজের লোক, না বাজে বক্তা। না-ইবা তিনি হাটে-বাজারে হট্টগোল করার লোক। তিনি মন্দের প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা গ্রহণ করেন না; বরং ক্ষমা করে দেন এবং ছেড়ে দেন। তার জন্ম হবে মক্কায়, আর হিজরত হবে তাইবায়। তার দেশ হবে শাম (সিরিয়া)।
আর তার উম্মাত হবে ’হাম্মদীন’ অর্থাৎ আনন্দবেদনা উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। তারা যে কোন উর্ধ্বারোহণকালে তাকবীর বলবে। তারা সূর্যের ছায়ার প্রতি লক্ষ্য রাখবে, যাতে সময় নির্ণয় করে যথাসময়ে সালাত আদায় করতে পারে। তিনি তার শরীরের নিম্নাংশে লুঙ্গি পরবেন এবং হস্ত-পদাদি ওযুর মাধ্যমে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখবেন। তাদের আযানদাতা আকাশে সুউচ্চ স্বরে আহবান করবেন। জিহাদের ময়দানে তাদের সারিগুলো এমন হবে যেমন সালাতে হয়ে থাকে। রাতের বেলায় তাদের তিলাওয়াত ও যিকরের শব্দ এমনভাবে উঠতে থাকবে, যেন মধুমক্ষিকার শব্দ।” [সুনান দারামীঃ ৫, ৮, ৯]
ইবন সা’আদ রাহিমাহুল্লাহ সাহাল মওলা খাইসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সনদ সহকারে উদ্ধৃত করেছেন যে, সাহাল বলেনঃ আমি নিজে ইঞ্জীলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ পড়েছি যে- তিনি খুব বেঁটেও হবেন না আবার খুব লম্বাও হবেন না। উজ্জ্বল বর্ণ ও দুটি কেশ-গুচ্ছধারী হবেন। তার দু’কাঁধের মধ্যস্থলে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। তিনি সদকা গ্রহণ করবেন না। গাধা ও উটের উপর সওয়ারী করবেন। ছাগলের দুধ নিজে দুইয়ে নেবেন। তিনি ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর হবেন। তার নাম হবে আহমাদ। [তাবাকাত ইবন সা’আদঃ ১/৩৬৩]
আতা ইবন ইয়াসার বলেনঃ আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কে বললাম, আমাকে তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাগুণ কেমন এসেছে তা বর্ণনা করুন, তিনি বললেনঃ তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছেঃ হে নবী, আমি আপনাকে সমস্ত উম্মতের জন্য সাক্ষী, সৎকর্মশীলদের জন্য সুসংবাদদাতা, অসৎকর্মীদের জন্য ভীতি প্রদর্শনকারী এবং উম্মিয়ীন অর্থাৎ আরবদের জন্য রক্ষণা-বেক্ষণকারী বানিয়ে পাঠিয়েছি।
আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল রেখেছি। আপনি কঠোর মেজাজও নন, দাঙ্গাবাজও নন। হাটে-বাজারে হট্টগোলকারীও নন। মন্দের প্রতিশোধ মন্দের দ্বারা গ্রহণ করেন না; বরং ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা'আলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মৃত্যু দেবেন না; যতক্ষণ না তার মাধ্যমে বাকা জাতিকে সোজা করে নেবেন। এমনকি যতক্ষণ না তারা لاَ إلٰهَ إلاَّ اللهُ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা'বূদ নেই -এ কালেমার স্বীকৃতিদানকারী হয়ে যাবে, যতক্ষণ না অন্ধ চোখ খুলে দেবেন, বধির কান যতক্ষণ না শোনার যোগ্য বানাবেন এবং বদ্ধ হৃদয় যতক্ষণ না খুলে দেবেন। [বুখারী : ২১২৫; ৪৮৩৮]
তাওরাত ও ইঞ্জীল বর্ণিত শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মাতের গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং নিদর্শনসমূহের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে বহু স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়েছে। রহমতুল্লাহ কীরানভী মুহাজেরে মক্কী রাহিমাহুল্লাহ তার গ্রন্থ ‘ইযহারুল-হক’-এ বিষয়টিকে অত্যন্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও গবেষণাসহ লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমান যুগের তাওরাত ও ইঞ্জলযাতে সীমাহীন বিকৃতি সাধিত হয়েছে-তাতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাওরাত ও ইনজীলের নিম্নোক্ত স্থানগুলো দেখুন- এসব স্থানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন, দ্বিতীয় বিবরণ-১৮: ১৫-১৯, মথি-২১: ৩৩-৪৬, যোহন-১: ১৯-২১, ১৪: ১৫-১৭, ২৫-৩০, ১৫: ২৫-২৬, ১৬৪ ৭-১৫।
(৩) দ্বিতীয় গুণটি এই বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির জন্য পবিত্র ও পছন্দনীয় বস্তু-সামগ্রী হালাল করবেন; আর পঙ্কিল বস্তুসামগ্রীকে হারাম করবেন। অর্থাৎ অনেক সাধারণ পছন্দনীয় বস্তুসামগ্রী যা শাস্তি স্বরূপ বনী-ইসরাঈলের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোর উপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেবেন। উদাহরণতঃ পশুর চর্বি বা মেদ প্রভৃতি যা বনী-ইসরাঈলের অসদাচরণের শাস্তি হিসাবে হারাম করে দেয়া হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোকে হালাল সাব্যস্ত করেছেন। আর নোংরা ও পঙ্কিল বস্তু-সামগ্রীর মধ্যে শুকরের মাংস, সুদ এবং যে সমস্ত খাবার আল্লাহ হারাম করেছেন অথচ তারা সেগুলোকে হালাল বলে চলিয়েছিল। [তাবারী] অনুরূপভাবে, রক্ত, মৃত পশু, মদ ও অন্যান্য হারাম জন্তু এর অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ হারাম উপায়ে আয় যথা- সুদ, ঘুষ, জুয়া প্রভৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত।
(৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৃতীয় গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের উপর চেপে থাকা বোঝা ও প্রতিবন্ধকতাও সরিয়ে দেবেন। إصر ‘ইসর’ শব্দের অর্থ এমন ভারী বোঝা যা নিয়ে মানুষ চলাফেরা করতে অক্ষম। আর أغلال আগলাল غل এর বহুবচন। ‘গাল্লুন’ সে হাতকড়াকে বলা হয় যা দ্বারা অপরাধীর হাত তার ঘাড়ের সাথে বেঁধে দেয়া হয় এবং সে একেবারেই নিরুপায় হয়ে পড়ে। إصر ‘ইসর’ ও أغلال ‘আগলাল’ অর্থাৎ অসহনীয় চাপ ও আবদ্ধতা বলতে এ আয়াতে সে সমস্ত কঠিন ও সাধ্যাতীত কর্তব্যের বিধি-বিধানকে বুঝানো হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের উপর একান্ত শাস্তি হিসাবে আরোপ করা হয়েছিল।
যেমন, বিধর্মী কাফেরদের সাথে জিহাদ করে গনীমতের যে মাল পাওয়া যেত, তা বনী ইসরাঈলদের জন্য হালাল ছিল না; বরং আকাশ থেকে একটি আগুন নেমে এসে সেগুলোকে জ্বলিয়ে দিত। শনিবার দিন শিকার করাও তাদের জন্য বৈধ ছিল না। এ সমস্ত কঠিন ও জটিল বিধানসমূহ যা বনী-ইসরাঈলদের উপর আরোপিত ছিল, কুরআনে সেগুলোকে ‘ইসর’ ও ‘আগলাল’ বলা হয়েছে এবং সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কঠিন বিধি-বিধানের পরিবর্তন অর্থাৎ এগুলোকে রহিত করে তদস্থলে সহজ বিধি-বিধান প্রবর্তন করবেন। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দ্বীন সহজ। [বুখারীঃ ৩৯] কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছেঃ (وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ) “আল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ৭৮]
(৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ ও পরিপূর্ণ গুণ-বৈশিষ্ট্যের আলোচনার পর বলা হয়েছেঃ তাওরাত ও ইঞ্জীলে আখেরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃষ্ট গুণ-বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণাদি বাতলে দেয়ার পরিণতি এই যে, যারা আপনার প্রতি ঈমান আনবে এবং আপনার সহায়তা করবে আর সেই নূরের অনুসরণ করবে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে -অর্থাৎ যারা কুরআনের অনুসরণ করবে, তারাই হল কল্যাণপ্রাপ্ত। এখানে কল্যাণ লাভের জন্য চারটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনা, দ্বিতীয়তঃ তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করা, তৃতীয়তঃ তার সাহায্য ও সহায়তা করা এবং চতুর্থতঃ কুরআন অনুযায়ী চলা। শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন বুঝাবার জন্য (وَعَزَّرُوهُ) ‘আযযারূহু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা تعزير থেকে উদ্ভুত। তাষীর অর্থ সস্নেহে বারণ করা ও রক্ষা করা।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু (وَعَزَّرُوهُ) “আযযারূহু” এর অর্থ করেছেন শ্রদ্ধা ও সম্মান করা। অর্থাৎ রাসূল হিসাবে তার প্রতি ঈমান আনতে হবে, নির্দেশদাতা হিসাবে তার প্রতিটি নির্দেশের অনুসরণ করতে হবে, প্রিয়জন হিসাবে তার সাথে গভীরতম ভালবাসা রাখতে হবে এবং নবুওয়তের ক্ষেত্রে যেহেতু তিনি পরিপূর্ণ, তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। অপর এক আয়াতেও বলা হয়েছে (وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ) অর্থাৎ “তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর এবং তাকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দান কর”। [সূরা আল-ফাতহঃ ৯] এছাড়া আরো কয়েকটি আয়াতে এই হেদায়াত দেয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর উপস্থিতিতে এত উচ্চস্বরে কথা বলো না, যা তার স্বর থেকে বেড়ে যেতে পারে। [দেখুন, সূরা হুজুরাতঃ ২]
অন্য এক জায়গায় বলে হয়েছেঃ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ) অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ্ ও তার রাসূল থেকে এগিয়ে যেয়ো না”। অর্থাৎ যদি মজলিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত থাকেন এবং তাতে কোন বিষয় উপস্থাপিত হয়, তাহলে তোমরা তার আগে কোন কথা বলো না। এ আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে কোন কোন সাহাবী বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে কেউ কথা বলবে না এবং তিনি যখন কোন কথা বলেন, তখন সবাই তা নিশ্চুপ বসে শুনবে। অনুরূপভাবে কুরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডাকার সময় আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখবে; এমনভাবে ডাকবে না; নিজেদের মধ্যে একে অপরকে যেভাবে ডেকে থাক। [দেখুন, সূরা হুজুরাতঃ ২]
এ আয়াতে শেষে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, এ নির্দেশের খেলাফ কোন অসম্মানজনক কাজ করা হলে সমস্ত সৎকর্ম ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে। এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যদিও সর্বক্ষণ-সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মসঙ্গী ছিলেন এবং এমতাবস্থায় সম্মান ও আদবের প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ্য রাখা বড়ই কঠিন হয়ে থাকে; তবুও তাদের অবস্থা এই ছিল যে, এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, যিনি আপনার উপর কিতাব নাযিল করেছেন তার শপথ করে বলছি, মৃত্যু পর্যন্ত আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলব যেন কোন ভাইয়ের কাছে কেউ গোপন বিষয়ে বলে। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৪৬২]
এমনি অবস্থা ছিল উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুরও দেখুন- [বুখারীঃ ৪৮৪৫] আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা আমার কোন প্রিয় ব্যক্তি সারা বিশ্বে ছিল না। আর আমার এ অবস্থা ছিল যে, আমি তার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেও পারতাম না। আমার কাছে যদি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকার-অবয়ব সম্পর্কে কেউ জানতে চায়, তাহলে তা বলতে আমি এজন্য অপারগ যে, আমি কখনো তার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েও দেখিনি। [মুসলিমঃ ১২১]
উরওয়া ইবন মাসউদকে মক্কাবাসীরা গুপ্তচর বানিয়ে মুসলিমদের অবস্থা জানার জন্য মদীনায় পাঠাল। সে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন নিবেদিত প্রাণ দেখতে পেল যে, ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দিল যে, আমি কিসরা ও কায়সারের দরবারও দেখেছি এবং সম্রাট নাজ্জাশীর সাথেও সাক্ষাত করেছি, এমনটি আর কোথাও দেখিনি। আমার ধারণা, তোমরা কষ্মিনকালেও তাদের মোকাবেলায় জয়ী হতে পারবে না। সহীহ [ইবনে হিব্বানঃ ১১/২১৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৭) যারা নিরক্ষর রসূল ও নবীর অনুসরণ করে, যার উল্লেখ তওরাত ও ইঞ্জীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়,[1] যে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে,[2] যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহকে বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তুসমূহকে অবৈধ করে এবং যে তাদের ভার ও বন্ধন[3] যা তাদের উপর ছিল (তা হতে) তাদেরকে মুক্ত করে। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে আলো তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার অনুসরণ করে তারাই হবে সফলকাম। [4]
[1] এই আয়াত ঐ বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য একটি অকাট্য প্রমাণ যে, মুহাম্মাদী রিসালতের উপর ঈমান আনা ছাড়া পরকালে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। আর ঐ ঈমানই ঈমান বলে গণ্য, যা বিস্তারিতভাবে মুহাম্মাদ (সাঃ) বর্ণনা করেছেন। এই আয়াত থেকে ‘সব ধর্ম সমান’ ধারণা সমূলে উৎপাটিত হয়।
[2] সৎকর্ম তাই, যাকে শরীয়ত সৎ বলেছে এবং অসৎকর্ম তাই, যাকে শরীয়ত অসৎ বলে গণ্য করেছে।
[3] এই বোঝা ও বন্ধন যা পূর্বের শরীয়তে বিদ্যমান ছিল। যেমন, প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ হত্যা আবশ্যিক ছিল। (রক্তপণ বা ক্ষমার কোন পথ ছিল না।) কাপড়ে অপবিত্রতা লেগে গেলে তা কেটে ফেলা জরুরী ছিল। ইসলাম শুধুমাত্র ধোয়ার আদেশ দিয়েছে। যেমন, প্রাণ হত্যার অপরাধে রক্তপণ ও ক্ষমা করার অনুমতিও রয়েছে ইত্যাদি। নবী (সাঃ)-ও ইরশাদ করেছেন যে, আমি সহজ একনিষ্ঠ ধর্ম দিয়ে প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদে আহমাদ) কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, এই জাতি নিজ থেকে অনেক আচার ও প্রথার বোঝা নিজেদের উপর চাপিয়ে নিয়েছে এবং জাহেলিয়াতের বন্ধন নিজেদের গলায় বেঁধে নিয়েছে, যার ফলে বিবাহ ও মৃত্যু উভয়ই আমাদের জন্য আযাব বনে গেছে। আল্লাহ এ জাতিকে হিদায়াত করুন। আমীন।
[4] এর শেষের শব্দগুলো থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, সাফল্য তারাই লাভ করবে যারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁর অনুসরণ করবে। আর যারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনবে না, তারা সফলতা লাভ করবে না, বরং তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও অসফল হবে। সাফল্য বলতে পরকালের সাফল্যকে বুঝানো হয়েছে। এটা সম্ভব যে, কোন জাতি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বিশ্বাস করে না, তা সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর সম্পদ ও ভোগবিলাস লাভে বড় সফল। যেমন বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য, ইউরোপ ও অন্যান্য জাতির অবস্থা। তারা খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী ও কাফের-মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বড় উন্নত। কিন্তু তাদের পার্থিব এ উন্নতি সাময়িকভাবে তাদের পরীক্ষার জন্য। ওটি তাদের পরকালের সাফল্যের মাপকাঠি নয়। অনুরূপ واتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَه (এবং যে আলো তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করে) থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, সূরা মাইদার ১৫নং আয়াতে ‘নূর’ জ্যোতি বা আলো বলতে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। (যেমন সেখানেও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। কারণ যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে তা কুরআন মাজীদ। সেই জন্য এই ‘নূর’ হতে নবী (সাঃ)-এর সত্তা অর্থ হতে পারে না। হ্যাঁ, এ কথা স্বতন্ত্র যে, তাঁর গুণাবলীর মধ্যে একটি গুণ নূর, যার দ্বারা কুফর ও শিরকের অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। কিন্তু ‘নূর’ তাঁর গুণ বলে তিনি ‘আল্লাহর নূর’ হতে পারেন না; যেমন বিদআতীরা (জাল হাদীস দ্বারা) প্রমাণ করতে চায়। (বিস্তারিত দেখুন সূরা মাইদার ১৫নং আয়াতের টীকা)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৮
قُلۡ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنِّیۡ رَسُوۡلُ اللّٰهِ اِلَیۡكُمۡ جَمِیۡعَۨا الَّذِیۡ لَهٗ مُلۡكُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۪ فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهِ النَّبِیِّ الۡاُمِّیِّ الَّذِیۡ یُؤۡمِنُ بِاللّٰهِ وَ كَلِمٰتِهٖ وَ اتَّبِعُوۡهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ ﴿۱۵۸﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৮. বলুন, হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল(১), যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই; তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূল উম্মী নবীর প্রতি যিনি আল্লাহ ও তার বাণীসমূহে ঈমান রাখেন। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।
(১) এ আয়াতে ইসলামের মূলনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোর মধ্য থেকে রিসালাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত সমগ্র দুনিয়ার সমস্ত জিন ও মানবজাতি তথা কেয়ামত পর্যন্ত আগত তাদের বংশধরদের জন্য ব্যাপক। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাধারণভাবে ঘোষণা করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনি মানুষকে বলে দিনঃ “আমি তোমাদের সবার প্রতি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি”।
আমার নবুওয়ত লাভ ও রিসালাতপ্রাপ্তি বিগত নবীগণের মত কোন বিশেষ জাতি কিংবা বিশেষ ভূখণ্ড অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং সমগ্র বিশ্ব মানবের জন্য, বিশ্বের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি দেশ ও রাষ্ট্র এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য কেয়ামতকাল পর্যন্ত তা পরিব্যাপ্ত। অন্য আয়াতেও এসেছে, “আর আমরা তো আপনাকে কেবল সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” [সূরা সাবা: ২৮] অনুরূপভাবে সূরা আলে ইমরান ২০; সূরা আল-আনআম: ৯০; সূরা হুদ: ১৭; সূরা ইউসুফ: ১০৪; সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭; সূরা আল-ফুরকান: ১; সূরা ছোয়াদ: ৮৭; সূরা আল-কালাম: ৫২; সূরা আত-তাকওয়ীর ২৭।
হাফেজ ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন যে, এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাতামুন্নাবিয়্যীন বা শেষ নবী হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব ও রিসালাত যখন কেয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত বংশধরদের জন্য এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য ব্যাপক, তখন আর অন্য কোন নতুন রাসূলের প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট থাকেই না। [ইবন কাসীর]
হাদীসে এসেছে, আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যে কোন এক বিষয়ে মতবিরোধ হয়। তাতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নারায হয়ে চলে যান। তা দেখে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাকে মানাবার জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কিছুতেই রাযী হলেন না। এমনকি নিজের ঘরে পৌছে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে হাযির হন। এদিকে কিছুক্ষণ পরেই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের এহেন আচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়ে নিজের ঘটনা বিবৃত করেন।
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন লক্ষ্য করলেন যে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি ভৎসনা করা হচ্ছে, তখন নিবেদন করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, দোষ আমারই বেশী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমার একজন সহচরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকাটাও কি তোমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তোমরা কি জান না যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে আমি যখন বললামঃ হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের সমস্ত লোকের জন্য আল্লাহ রাসূল। তখন তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলে। শুধু এই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুই ছিলেন, যিনি সর্বপ্রথম আমাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। [বুখারীঃ ৪৬৪০]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের ভয় হচ্ছিল যে, শক্ররা না এ অবস্থায় আক্রমণ করে বসে। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারদিকে সমবেত হয়ে গেলেন। রাসূল সালাত শেষ করে বললেনঃ আজকের রাতে আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে আর কোন নবী-রাসূলকে দেয়া হয়নি। তার একটি হল এই যে, আমার রিসালাত ও নবুওয়াতকে সমগ্র দুনিয়ার জাতিসমূহের জন্য ব্যাপক করা হয়েছে। আর আমার পূর্বে যত নবী-রাসূলই এসেছেন, তাদের দাওয়াত ও আবির্ভাব নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। দ্বিতীয়তঃ আমাকে আমার শক্রর মোকাবেলায় এমন প্রভাব দান করা হয়েছে যাতে তারা যদি আমার কাছ থেকে এক মাসের দূরত্বেও থাকে, তবুও তাদের উপর আমার প্রভাব ছেয়ে যাবে।
তৃতীয়তঃ কাফেরদের সাথে যুদ্ধে প্রাপ্ত মালে-গনীমত আমার জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। অথচ পূর্ববতী উম্মতদের জন্য তা হালাল ছিল না। বরং এসব মালের ব্যবহার মহাপাপ বলে মনে করা হত। তাদের গনীমতের মাল ব্যয়ের একমাত্র স্থান ছিল এই যে, আকাশ থেকে বিদ্যুৎ এসে সে সমস্তকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিয়ে যাবে। চতুর্থতঃ আমার জন্য সমগ্র ভূমণ্ডলকে মসজিদ করে দেয়া হয়েছে এবং পবিত্র করার উপকরণ বানিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আমাদের সালাত যমীনের যে কোন অংশে, যে কোন জায়গায় শুদ্ধ হয়, কোন বিশেষ মসজিদে সীমাবদ্ধ না হয়। পক্ষান্তরে পূর্ববতী উম্মতদের ইবাদাত শুধু তাদের উপাসনালয়েই হত, অন্য কোথাও নয়। নিজেদের ঘরে কিংবা মাঠে-ময়দানে তাদের সালাত বা ইবাদাত হত না।
তাছাড়া পানি ব্যবহারের যখন সামর্থ্য না থাকে, তা পানি না পাওয়ার জন্য হোক কিংবা কোন রোগ-শোকের কারণে, তখন মাটির দ্বারা তায়াম্মুম করে নেয়াই পবিত্রতা ও অযুর পরিবর্তে যথেষ্ট হয়ে যায়। পূর্ববতী উম্মতদের জন্য এ সুবিধা ছিল না। অতঃপর বললেনঃ আর পঞ্চমটি এই যে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রত্যেক রাসূলকে একটি দোআ কবুল হওয়ার এমন নিশ্চয়তা দান করেছেন, যার কোন ব্যতিক্রম হতে পারে না। আর প্রত্যেক নবী-রাসূলই তাদের নিজ নিজ দো’আকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে নিয়েছেন এবং সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয়েছে। আমাকে তাই বলা হল যে, আপনি কোন একটা দোআ করুন। আমি আমার দো’আকে আখেরাতের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছি। সে দো'আ তোমাদের জন্য এবং কেয়ামত পর্যন্ত لا اله الا الله ‘আল্লাহ ছাড়া কোন হক মা’বুদ নেই’ কালেমার সাক্ষ্য দানকারী যেসব লোকের জন্ম হবে, তাদের কাজে লাগবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/২২২]
আবু মূসা আশ’আর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে উদ্ধৃত বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লোক আমার আবির্ভাব সম্পর্কে শুনবে, তা সে আমার উম্মতদের মধ্যে হোক কিংবা ইয়াহুদী নাসারা হোক, যদি সে আমার উপর ঈমান না আনে, তাহলে জাহান্নামে যাবে’। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩৫০]
সারমর্ম এই যে, এ আয়াতের দ্বারা বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য, প্রত্যেক দেশ ও ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জন্য এবং প্রত্যেকটি জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপকভাবে রাসূল হওয়া প্রমাণিত হয়েছে। সাথে সাথে একথাও সাব্যস্ত হয়ে গেছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর যে লোক তার প্রতি ঈমান আনবে না, সে লোক কোন সাবেক শরীআত ও কিতাবের কিংবা অন্য কোন ধর্ম ও মতের পরিপূর্ণ আনুগত্য একান্ত নিষ্ঠাপরায়ণভাবে করতে থাকা সত্বেও কস্মিনকালেও মুক্তি পাবে না।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৮) বল, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য সেই আল্লাহর (প্রেরিত) রসূল; যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তিনি ব্যতীত অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই, তিনিই জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান। সুতরাং আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূল নিরক্ষর নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর; যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে বিশ্বাস করে, এবং তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা পথ পাও।’ [1]
[1] এই আয়াতও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রিসালাত সার্বজনীন রিসালাত প্রমাণিত হওয়ার জন্য স্পষ্ট। এতে মহান আল্লাহ নবী (সাঃ)-কে আদেশ করেছেন, যেন তিনি ঘোষণা করে দেন যে, ‘হে বিশ্বের মানুষ! আমি তোমাদের সকলের প্রতি রসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ এভাবে তিনি বিশ্বের সকল মানব জাতির জন্য ত্রাণকর্তা ও রসূল। এখন পরিত্রাণ ও সুপথ না খ্রিষ্টধর্মে আছে, আর না ইয়াহুদী বা অন্য কোন ধর্মে। পরিত্রাণ ও সুপথ যদি থাকে, তাহলে কেবল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা ও তাকে নিজ দ্বীন বলে স্বীকার করার মাঝে আছে। এই আয়াতে এবং এর পূর্বের আয়াতেও নবী (সাঃ)-কে নিরক্ষর বলা হয়েছে। এটি তাঁর একটি বিশেষ গুণ। যার অর্থ (তিনি লিখাপড়া জানতেন না, তাঁর অক্ষরজ্ঞান ছিল না) তিনি কোন গুরুর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি। কোন শিক্ষকের নিকট হতে কোন শিক্ষাও তিনি অর্জন করেননি। তা সত্ত্বেও তিনি এমন এক কুরআন পেশ করলেন যে, তার অলৌকিকতা ও সাহিত্য-অলংকারের সামনে পৃথিবীর সকল সাহিত্যিক ও পন্ডিত তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অক্ষম রয়ে গেল। আর তিনি যে শিক্ষা পেশ করলেন, যার সত্যতা ও যথার্থতা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বীকৃত। আর তা এ কথারই প্রমাণ যে, তিনি সত্যিই আল্লাহর রসূল। তাছাড়া একজন নিরক্ষর, না এ রকম গ্রন্থ পেশ করতে পারে, আর না এমন শিক্ষার বর্ণনা দিতে পারে, যা ন্যায় ও ইনসাফের এক সুন্দর নমুনা এবং বিশ্ব-মানবতার পরিত্রাণ ও সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। এ শিক্ষা গ্রহণ বিনা পৃথিবীর মানুষ সত্যিকার সুখ-শান্তি পেতে পারে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৫৯
وَ مِنۡ قَوۡمِ مُوۡسٰۤی اُمَّۃٌ یَّهۡدُوۡنَ بِالۡحَقِّ وَ بِهٖ یَعۡدِلُوۡنَ ﴿۱۵۹﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৯. আর মূসার সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন দল রয়েছে যারা অন্যকে ন্যায়ভাবে পথ দেখায় ও সে অনুযায়ীই (বিচারে) ইনসাফ করে।(১)
(১) এ আয়াতে সত্যনিষ্ঠ দল বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে, এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে-
এক. অধিকাংশ অনুবাদক এ আয়াতের অনুবাদ এভাবে করেছেন- “মূসার জাতির মধ্যে এমন একটি দল আছে যারা সত্য অনুযায়ী পথনির্দেশ দেয় এবং ইনসাফ করে”। অর্থাৎ তাদের মতে কুরআন নাযিল হবার সময় বনী-ইসরাঈলীদের যে নৈতিক ও মানসিক অবস্থা বিরাজমান ছিল তারই কথা এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ বিগত আয়াতসমূহে মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের অসদাচরণ, কুটতর্ক এবং গোমরাহীর বর্ণনা ছিল। কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, গোটা জাতিটাই এমন নয়; বরং তাদের মধ্যে কিছু লোক ভালও রয়েছে যারা সত্যানুসরণ করে এবং ন্যায়ভিত্তিক মীমাংসা করে।
এরা হল সেসব লোক, যারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের যুগে সেগুলোর হেদায়াত অনুযায়ী আমল করত এবং যখন খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়, তখন তাওরাত ও ইঞ্জীলের সুসংবাদ অনুসারে তার উপর ঈমান আনে এবং তার যথাযথ অনুসরণও করে। বনী-ইসরাঈলদের এই সত্যনিষ্ঠ দলটির উল্লেখও কুরআনুল কারীমে বারংবার করা হয়েছে। যেমন, সূরা আলে-ইমরানঃ ১১৩, ১৯৯, সূরা আল-বাকারাহঃ ১২১, সূরা আল-ইসরাঃ ১০৭–১০৯, সূরা আল-কাসাসঃ ৫২–৫৪। [ইবন কাসীর]
দুই. পূর্বাপর আলোচনা বিশ্লেষণ করে কোন কোন মুফাসসির এ মত দিয়েছেন যে, এখানে মূসার সময় তথা বনী-ইসরাঈলীদের যে অবস্থা ছিল তারই কথা বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে এ বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ জাতির মধ্যে যখন বাছুর পূজার অপরাধ অনুষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তার উপর পাকড়াও করা হয় তখন সমগ্র জাতি গোমরাহ ছিল না; বরং তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তখনো সৎ ছিল। [তাবারী; ইবন কাসীর]
মোটকথা, আয়াতের মৰ্ম দাঁড়াল এই যে, মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি দল রয়েছে যারা সব সময়ই সত্যে সুদৃঢ় ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের সংবাদ শুনে যারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল তারাই হোক অথবা মূসার যুগে যারা হকপন্থী ছিল তারা। যারা গো-বাছুর পূজা করেনি বা নবীদেরকে হত্যা করেনি।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৯) মূসার সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন একদল রয়েছে যারা (অন্যকে) ন্যায় পথ দেখায় ও ন্যায় বিচার করে। [1]
[1] এই দল থেকে ঐ কয়েকজন মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যাঁরা মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন, আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) প্রমুখ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৭ : ১৬০
وَ قَطَّعۡنٰهُمُ اثۡنَتَیۡ عَشۡرَۃَ اَسۡبَاطًا اُمَمًا ؕ وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی اِذِ اسۡتَسۡقٰىهُ قَوۡمُهٗۤ اَنِ اضۡرِبۡ بِّعَصَاكَ الۡحَجَرَ ۚ فَانۡۢبَجَسَتۡ مِنۡهُ اثۡنَتَا عَشۡرَۃَ عَیۡنًا ؕ قَدۡ عَلِمَ كُلُّ اُنَاسٍ مَّشۡرَبَهُمۡ ؕ وَ ظَلَّلۡنَا عَلَیۡهِمُ الۡغَمَامَ وَ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡهِمُ الۡمَنَّ وَ السَّلۡوٰی ؕ كُلُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰكُمۡ ؕ وَ مَا ظَلَمُوۡنَا وَ لٰكِنۡ كَانُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ ﴿۱۶۰﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* মান্না’ এক ধরণের সুস্বাদু খাবার, যা শিশিরের মত গাছের পাতায় ও ঘাসের উপর জমে থাকত। আল¬াহ বিশেষভাবে তা বনী ইসরাঈলের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
১৬০. আর তাদেরকে আমরা বারটি গোত্রে বিভক্ত করেছি। আর মূসার সম্প্রদায় যখন তার কাছে পানি চাইল, তখন আমরা তার প্রতি ওহী পাঠালাম, আপনার লাঠির দ্বারা পাথুরে আঘাত করুন; ফলে তা থেকে বারটি ঝর্ণা ধারা উৎসারিত হল। প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ পানস্থান চিনে নিল। আর আমরা মেঘ দ্বারা তাদের উপর ছায়া দান করেছিলাম এবং তাদের উপর আমরা মান্না ও সালওয়া নাযিল করেছিলাম। (বলেছিলাম) তোমাদের যে রিযক দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু খাও। আর তারা আমাদের প্রতি কোন যুলম করেনি, বরং তারা নিজদের উপরই যুলুম করত।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬০) আর তাদেরকে আমি বারটি গোত্রে তথা দলে বিভক্ত করেছিলাম।[1] মূসার সম্প্রদায় যখন তার নিকট পানি প্রার্থনা করল, তখন তার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত কর।’ ফলে তা থেকে বারটি প্রস্রবণ উৎসারিত হল, প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ পানস্থান চিনে নিল। এবং মেঘ দ্বারা তাদের উপর ছায়া বিস্তার করলাম, তাদের নিকট ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ পাঠালাম; (বললাম,) ‘তোমাদের যা পবিত্র রুযী দিয়েছি তা আহার কর।’ (কিন্তু তারা নির্দেশ অমান্য করল। আর তাতে) তারা আমার প্রতি কোন অত্যাচার করেনি; আসলে তারা নিজেদের প্রতিই অত্যাচার করেছিল।
[1] أسباط শব্দটি سِبط এর বহুবচন, অর্থ পৌত্র। এখানে গোত্রের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, ইয়াক্বূব (আঃ)-এর ১২টি সন্তান থেকে ১২টি গোত্র আবির্ভূত হল। মহান আল্লাহ প্রত্যেক গোত্রের জন্য এক একটি দলপতি (পর্যবেক্ষক) নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন। আল্লাহর বাণী ‘‘আমি তাদেরই মধ্য হতে ১২ জন নেতা প্রেরণ করেছিলাম।’’ (সূরা মাইদাহ ১২ আয়াত) ঐ ১২টি গোত্রের কোন কোন গুণে একটি অপরটির তুলনায় উৎকৃষ্ট হওয়ার কারণে পৃথক পৃথক দল হওয়াকে এক অনুগ্রহ বলে বর্ণনা করেছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান