৩ : ১৫১
سَنُلۡقِیۡ فِیۡ قُلُوۡبِ الَّذِیۡنَ كَفَرُوا الرُّعۡبَ بِمَاۤ اَشۡرَكُوۡا بِاللّٰهِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِهٖ سُلۡطٰنًا ۚ وَ مَاۡوٰىهُمُ النَّارُ ؕ وَ بِئۡسَ مَثۡوَی الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۱۵۱﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫১. অচিরেই আমরা কাফেরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব(১), যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, যার সপক্ষে আল্লাহ কোন সনদ পাঠাননি। আর জাহান্নাম তাদের আবাস এবং কত নিকৃষ্ট আবাস যালেমদের।
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমাকে একমাসে অতিক্রম করার মত রাস্তার দূরত্ব থেকে কাফেরদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।” [বুখারীঃ ৩৩৫, মুসলিমঃ ৫২১, ৫২৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫১) যারা অবিশ্বাস করে, তাদের হৃদয়ে আমি ভীতির সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করেছে; যার স্বপক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। [1] জাহান্নাম হবে তাদের নিবাস। আর অনাচারীদের আবাসস্থল অতি নিকৃষ্ট!
[1] মুসলিমদের পরাজয় দেখে কোন কোন কাফেরের অন্তরে এই খেয়াল জন্মালো যে, মুসলিমদেরকে একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়ার এটা অতি উত্তম সুযোগ। ঠিক এই মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে মুসলিমদের ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে তারা নিজেদের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সাহস করতে পারেনি। (ফাতহুল ক্বাদীর) বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমাকে পাঁচটি এমন জিনিস দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। তার মধ্যে একটি হল, এক মাসের দূরত্বে অবস্থিত শত্রুর অন্তরে আমার ত্রাস (ভয়) ঢুকিয়ে দিয়ে আমার সাহায্য করা হয়েছে।’’ এই হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, রসূল (সাঃ)-এর ভয় স্থায়ীভাবে শত্রুর অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল। আর এই আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, রসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর উম্মত অর্থাৎ, মুসলিমদের ভয়ও মুশরিকদের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছে এবং তার কারণ হল, তাদের শিরক। অর্থাৎ, শিরককারীদের অন্তর সব সময় অন্যের ত্রাস ও ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। আর সম্ভবতঃ এই কারণেই মুসলিমদের এক বিরাট সংখ্যা শিরকী আকীদা ও আমলে জড়িয়ে পড়ার ফলে শত্রুরা তাদেরকে ভয় করে না, বরং তারাই শত্রুদের ভয় ও ত্রাসে ভীত-সন্ত্রস্ত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫২
وَ لَقَدۡ صَدَقَكُمُ اللّٰهُ وَعۡدَهٗۤ اِذۡ تَحُسُّوۡنَهُمۡ بِاِذۡنِهٖ ۚ حَتّٰۤی اِذَا فَشِلۡتُمۡ وَ تَنَازَعۡتُمۡ فِی الۡاَمۡرِ وَ عَصَیۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَاۤ اَرٰىكُمۡ مَّا تُحِبُّوۡنَ ؕ مِنۡكُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الدُّنۡیَا وَ مِنۡكُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ۚ ثُمَّ صَرَفَكُمۡ عَنۡهُمۡ لِیَبۡتَلِیَكُمۡ ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا عَنۡكُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۵۲﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫২. অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের সাথে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকে দেখাবার পর তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের কিছু সংখ্যক দুনিয়া চাচ্ছিল(১) এবং কিছু সংখ্যক চাচ্ছিল আখেরাত। তারপর তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তাদের (তোমাদের শক্ৰদের) থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন(২)। অবশ্য তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।
(১) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আয়াতের এ অংশ নাযিল হবার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের মধ্যে কেউ দুনিয়া চায়, এটি আমার ধারনাও আসে নি। [মুসনাদে আহমাদ ১/৪৬৩]
(২) বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের যুদ্ধে পঞ্চাশ জনের এক দল সাহাবীকে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে দিয়ে বললেনঃ যদি তোমরা দেখ যে, পাখি আমাদেরকে ছুঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে তাতেও তোমরা তোমাদের স্থান ত্যাগ করে যাবে না। যতক্ষন না আমি তোমাদেরকে ডেকে পাঠাই। অনুরূপভাবে যদি তোমরা দেখ যে, আমরা শক্রদের পর্যুদস্ত করে দিয়েছি তাতেও তোমরা স্থান ত্যাগ করবে না যতক্ষণ আমি তোমাদের ডেকে না পাঠাই। তারপর মুসলিমগণ কাফেরদের পরাজিত করল। বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি মহিলাদের চুড়ি, পায়ের গোড়ালি ইত্যাদিও দেখছিলাম, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের সাথীগণ বলতে আরম্ভ করলঃ গনীমতের মাল এসে পড়েছে, তোমাদের সাথীরা কাফেরদের উপর জয়লাভ করেছে, সুতরাং তোমরা কিসের অপেক্ষা করছ?
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাদেরকে বললেনঃ তোমরা কি রাসূলের নির্দেশ ভুলে গেছ? তারা বললঃ আমরা মানুষের কাছে গিয়ে গনীমতের মাল জমা করব। একথা বলে তারা স্থান ত্যাগ করতে আরম্ভ করল। আর এতেই যুদ্ধের পট পরিবর্তিত হয়ে জয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সবাই পালাতে আরম্ভ করল। রাসূলের সাথে মাত্র বার জন লোক ছিল। রাসূল তাদেরকে ডাকতে থাকলেন। এভাবে মুসলিমদের সত্তর জন লোক শহীদ হয়ে গেল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীরা বদরের দিন একশত চল্লিশ জন কাফেরকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিলেন, তাদের সত্তর জন মারা যায় আর বাকী সত্তর জন আহত হয়ে বন্দী হয়। তখন আবু সুফিয়ান তিন বার বললঃ এখানে কি মুহাম্মাদ আছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামকে উত্তর দিতে নিষেধ করলেন। তারপর আবু সুফিয়ান তিন বার বললঃ এখানে কি ইবনে আবি কুহাফা আছে? তারপর আবু সুফিয়ান তিনবার বললঃ এখানে কি ইবনুল খাত্তাব আছে? তারপর সে তার সাথীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললঃ এরা সবাই মারা পড়েছে। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। তিনি বলে বসলেনঃ হে আল্লাহর দুশমন! তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি যাদের কথা বলেছ তারা সবাই জীবিত। আর তোমার যাতে খারাপ লাগে তা অবশ্যই বাকী আছে।
তখন আবু সুফিয়ান বলে বসলঃ বদরের দিনের বদলে একটি দিন হলে আজ। আর যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। তুমি তোমাদের মৃতদের মাঝে কিছু বিকৃত লাশ দেখতে পাবে। আমি বিকৃত করার নির্দেশ দেইনি। কিন্তু আমার খারাপও লাগেনি। তারপর সে আবৃতি করতে লাগলঃ হুবলের জয় হোক, হুবলের জয় হোক। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি তার জবাব দিবে না? সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ আমরা কি বলব? তিনি বললেনঃ ‘তোমরা বলঃ আল্লাহ মহান ও সর্বোচ্চ। তখন আবু সুফিয়ান বললঃ আমাদের উযযা আছে তোমাদের উযযা নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা জবাব দিবে না? সাহাবগণ বললেনঃ কি জবাব দেব? তিনি বললেনঃ বল যে, আল্লাহ্ আমাদের অভিভাবক-সাহায্যকারী, তোমাদের কোন অভিভাবক-সাহায্যকারী নেই। [বুখারীঃ ৩০৩৯, ৩৯৮৬, ৪০৪৩, ৪০৬৭, ৪৫৬১]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫২) আর আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন, যখন তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশক্রমে হত্যা করছিলে। [1] অবশেষে যখন তোমরা সাহস হারিয়েছিলে এবং (রসূলের) নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করেছিলে এবং যা তোমরা পছন্দ কর, তা[2] (বিজয়) তোমাদেরকে দেখানোর পরে তোমরা অবাধ্য হয়েছিলে[3] (তখন বিজয় রহিত হল)। তোমাদের কতক লোক ইহকাল কামনা করেছিল[4] এবং কতক লোক পরকাল কামনা করেছিল। [5] অতঃপর তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তিনি তোমাদেরকে তাদের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন।[6] তবুও (কিন্তু) তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহশীল। [7]
[1] এই প্রতিশ্রুতির অর্থ কোন কোন মুফাসসিরের মতে তিন হাজার এবং চার হাজার ফিরিশতার অবতরণ। কিন্তু এই মত একেবারে ভুল। কারণ ফিরিশতাদের অবতরণ তো বদর যুদ্ধের সাথে নির্দিষ্ট। সুতরাং এই আয়াতে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতির অর্থ হল, বিজয় ও সাহায্যের সেই সাধারণ প্রতিশ্রুতি, যা মুসলিমদের সাথে রসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে করা হয়েছিল। এমন কি কিছু আয়াত তো পূর্বে মক্কাতেই নাযিল হয়েছিল। আর এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী (উহুদ) যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমরা জয়যুক্তই ছিলেন। [اِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ باِذْنِهِ] (যখন তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশক্রমে হত্যা করছিলে।) এই আয়াতে তারই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
[2] এর অর্থঃ সেই বিজয়, যা প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমরা অর্জন করেছিলেন।
[3] মতভেদ সৃষ্টি করেছিলে এবং অবাধ্য হয়েছিলে বলতে, ৫০ জন তীরন্দাজের মধ্যে আপোসে মতভেদ সৃষ্টি হওয়াকে বুঝানো হয়েছে; যাতে তাঁরা সফলতা ও বিজয় দেখার পর লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর এরই কারণে কাফেররা পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিল।
[4] অর্থাৎ, গনীমতের মাল (যুদ্ধ-ময়দানে শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া সম্পদ)। এরই কারণে তাঁরা পাহাড়ের সেই ঘাঁটি ছেড়ে চলে এসেছিলেন, যেখান থেকে নড়তে তাঁদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।
[5] সেই লোক, যাঁরা ঘাঁটি ছাড়তে নিষেধ করেন এবং নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ মত সেখানে অনড় থাকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
[6] অর্থাৎ, বিজয় দান করার পর পুনরায় পরাজয় দিয়ে তোমাদেরকে ঐ কাফেরদের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন কেবল তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য।
[7] সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের কর্মে ত্রুটি ও অবহেলা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁদেরকে যে মর্যাদা-সম্মান দান করেছেন, সে কথাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে আর ভুল না করেন। তাই মহান আল্লাহ তাঁদের ভুলের কথা উল্লেখ করে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন। যাতে মন্দ অন্তরের লোকেরা তাঁদের ব্যাপারে কোন কটূক্তি না করতে পারে। কারণ, মহান আল্লাহই যখন কুরআনে কারীমে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তখন অন্যের কি এ ব্যাপারে আর কোন নিন্দাপূর্ণ বাক্য ব্যবহার ও কটূক্তি করার অবকাশ থাকে? সহীহ বুখারীতে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে যে, কোন এক হজ্জের সময় এক ব্যক্তি উষমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করল। যেমন, তিনি বদর যুদ্ধে এবং বায়আতে রিযওয়ানে শরীক হননি এবং উহুদের যুদ্ধে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইবনে উমার (রাঃ) (এই অভিযোগ খন্ডন করে) বললেন, বদর যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী (রসূল (সাঃ)-এর কন্যা) অসুস্থ ছিলেন। বায়আতে রিযওয়ানে তিনি রসূল (সাঃ)-এর দূত হয়ে মক্কায় গিয়েছিলেন এবং উহুদের দিনে পালিয়ে যাওয়াকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (বুখারী, উহুদের যুদ্ধ পরিচ্ছেদ)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৩
اِذۡ تُصۡعِدُوۡنَ وَ لَا تَلۡوٗنَ عَلٰۤی اَحَدٍ وَّ الرَّسُوۡلُ یَدۡعُوۡكُمۡ فِیۡۤ اُخۡرٰىكُمۡ فَاَثَابَكُمۡ غَمًّۢا بِغَمٍّ لِّكَیۡلَا تَحۡزَنُوۡا عَلٰی مَا فَاتَكُمۡ وَ لَا مَاۤ اَصَابَكُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۵۳﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৩. স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের (পাহাড়ের) দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলে না, আর রাসূল তোমাদেরকে পিছন দিক ডাকছিলেন। ফলে তিনি তোমাদেরকে বিপদের উপর বিপদ দিলেন(১), যাতে তোমরা যা হারিয়েছ এবং যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছে তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(১) কাতাদা বলেন, প্রথম বিপদ হচ্ছে, আহত-নিহত হওয়া। আর দ্বিতীয় বিপদ হচ্ছে, যখন তাদের কাছে খবর পৌছল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহত হয়েছেন। তখন তারা নিজেদের আহত-নিহত হওয়ার চেয়েও বেশী চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়লেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৩) (স্মরণ কর) তোমরা যখন (পাহাড়ের) উপরে চড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে[1] এবং পিছনে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলে না; অথচ রসূল তোমাদেরকে পিছন থেকে আহবান করছিল।[2] ফলে তিনি তোমাদেরকে দুঃখের উপর দুঃখ দিলেন;[3] যাতে তোমরা যা হারিয়েছ অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছে, তার জন্য তোমার দুঃখিত না হও।[4] আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
[1] কাফেরদের একাধারে হঠাৎ আক্রমণের ফলে মুসলিমদের মধ্যে যে ছত্রভঙ্গ অবস্থা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং তাঁদের অনেকেই যে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান, এখানে সেই চিত্রই তুলে ধরা হচ্ছে। تُصْعِدُوْنَ ক্রিয়াপদ إِصْعَادٌ ক্রিয়ামূল থেকে গঠিত। যার অর্থ হল, উপত্যকা বেয়ে (পাহাড়ে) চড়া কিংবা পালিয়ে যাওয়া।
[2] নবী করীম (সাঃ) তাঁর কিছু সাথী সহ পিছনে ছিলেন। তিনি তাঁদেরকে ডাক দিয়ে বলছিলেন, ‘‘আল্লাহর বান্দারা! আমার দিকে ফিরে এসো। আল্লাহর বান্দারা! আমার দিকে ফিরে এসো।’’ কিন্তু সেই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে তাঁর এই ডাক কে শোনে?
[3] সামান্য ত্রুটির কারণে তোমাদের উপর নেমে এল দুঃখের উপর দুঃখ। ইবনে জারীর এবং ইবনে কাসীরের নিকট প্রাধান্য প্রাপ্ত উক্তি অনুযায়ী প্রথম ‘গাম্ম’ (দুঃখ)এর অর্থ, গনীমতের মাল এবং কাফেরদের উপর বিজয় লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ‘গাম্ম’ (দুঃখ)। আর দ্বিতীয় ‘গাম্ম’ (দুঃখ)এর অর্থ, মুসলিমদের শহীদ ও আহত হওয়ার ‘গাম্ম’ (দুঃখ) এবং নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশের বিরোধিতা ও তাঁর শহীদ হওয়ার মিথ্যা খবর থেকে সৃষ্ট দুঃখ।
[4] অর্থাৎ, তোমাদের উপর দুঃখের উপর দুঃখ আপতিত হওয়ার কারণ হল, যাতে তোমাদের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার শক্তি এবং দৃঢ়সংকল্প ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৪
ثُمَّ اَنۡزَلَ عَلَیۡكُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ الۡغَمِّ اَمَنَۃً نُّعَاسًا یَّغۡشٰی طَآئِفَۃً مِّنۡكُمۡ ۙ وَ طَآئِفَۃٌ قَدۡ اَهَمَّتۡهُمۡ اَنۡفُسُهُمۡ یَظُنُّوۡنَ بِاللّٰهِ غَیۡرَ الۡحَقِّ ظَنَّ الۡجَاهِلِیَّۃِ ؕ یَقُوۡلُوۡنَ هَلۡ لَّنَا مِنَ الۡاَمۡرِ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ قُلۡ اِنَّ الۡاَمۡرَ كُلَّهٗ لِلّٰهِ ؕ یُخۡفُوۡنَ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ مَّا لَا یُبۡدُوۡنَ لَكَ ؕ یَقُوۡلُوۡنَ لَوۡ كَانَ لَنَا مِنَ الۡاَمۡرِ شَیۡءٌ مَّا قُتِلۡنَا هٰهُنَا ؕ قُلۡ لَّوۡ كُنۡتُمۡ فِیۡ بُیُوۡتِكُمۡ لَبَرَزَ الَّذِیۡنَ كُتِبَ عَلَیۡهِمُ الۡقَتۡلُ اِلٰی مَضَاجِعِهِمۡ ۚ وَ لِیَبۡتَلِیَ اللّٰهُ مَا فِیۡ صُدُوۡرِكُمۡ وَ لِیُمَحِّصَ مَا فِیۡ قُلُوۡبِكُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۱۵۴﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৪. তারপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল(১) এবং একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ্ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, আমাদের কি কোন কিছু করার আছে? বলুন, সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে। যা তারা আপনার কাছে প্রকাশ করে না, তারা তাদের অন্তরে সেগুলো গোপন রাখে। তারা বলে, এ ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না(২)। বলুন, যদি তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করতে তবুও নিহত হওয়া যাদের জন্য অবধারিত ছিল তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হত। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধন করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত।
(১) অর্থাৎ এ কঠিন বিপদের সময় তাদের উপর তন্দ্রা নেমে এসে তাদেরকে প্রশান্ত করে দিচ্ছিল। আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা ওহুদের দিন কাতারবন্দী অবস্থাতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। এমনকি আমাদের হাত থেকে তরবারী পড়ে যাচ্ছিল আর আমি বারবার তা উঠিয়ে নিচ্ছিলাম। [বুখারী ৪৫৬২] আর এটাই আল্লাহর বাণী “তারপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে প্রদান করলেন তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল, এবং একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল” এর তাৎপর্য। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যুদ্ধের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর সালাতের মধ্যে শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। [ইবন আবী হাতেম আত-তাফসীরুস সহীহ]
(২) এখানে আরেক দল বলে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তারা সবচেয়ে ভীতু ও কাপুরুষ ও হকের বিপরীতে অবস্থানকারী সম্প্রদায় ছিল। [তাবারী] আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ উহুদের যুদ্ধের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, আল্লাহ আমাদের উপর ঘুম পাঠালেন, আমাদের প্রত্যেকের থুতনি বুকে লেগে যাচ্ছিল। আল্লাহর শপথ আমি যেন মু'আত্তাব ইবনে কুসাইরের কথা স্বপ্নের মাঝে শুনছিলাম। সে বলছিলঃ ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ এ ব্যাপারেই আল্লাহর উপরোক্ত বাণী নাযিল হয়। [আল-আহাদিসুল মুখতারাহঃ ৩/৬০, ৮৬৪]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৪) অতঃপর তিনি তোমাদেরকে দুঃখের পর তন্দ্রারূপে নিরাপত্তা (ও শান্তি) প্রদান করলেন, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল। [1] আর একদল ছিল যারা নিজেদের জান নিয়েই ব্যস্ত ছিল। [2] প্রাগ্-ইসলামী অজ্ঞদের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে কুধারণা পোষণ করেছিল। [3] তারা বলেছিল যে, ‘এ বিষয়ে আমাদের কি কোন এখতিয়ার আছে?’[4] বল, ‘সমস্ত বিষয় আল্লাহরই এখতিয়ারভুক্ত।’[5] তারা তাদের অন্তরে এমন কিছু গোপন রাখে, যা তোমার নিকট প্রকাশ করে না।[6] তারা বলে, ‘যদি এ ব্যাপারে আমাদের কোন এখতিয়ার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।’[7] বল, ‘যদি তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান করতে তবুও নিহত হওয়া যাদের ভাগ্যে অবধারিত ছিল, তারা নিজেদের বধ্যভূমিতে এসে উপস্থিত হত।’[8] তা এ জন্য যে, যাতে আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা পরীক্ষা করেন ও তোমাদের হৃদয়ে যা (কালিমা) আছে, তা পরিশুদ্ধ করেন।[9] আর অন্তরে যা আছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।[10]
[1] উল্লিখিত চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির পর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের উপর পুনরায় অনুগ্রহ করলেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধের ময়দানে অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁদের উপর তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি করে দিলেন। আর এই তন্দ্রা (ঢুল) ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রশান্তি এবং সাহায্যের দলীল। আবূ ত্বালহা (রাঃ) বলেন, আমিও তাঁদের একজন, যাঁদের উপর উহুদের দিন তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এমন কি আমার তরবারি কয়েকবার আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, আর আমি ধরে নিয়েছিলাম। (সহীহ বুখারী) نُعَاسًا হল أَمَنَةً শব্দের বদল (পরিবর্ত শব্দ)। طَائِفَةٌ একবচন এবং বহুবচন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[2] এ থেকে মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে তারা কেবল নিজেদের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিল।
[3] যেমন ভাবত যে, নবী করীম (সাঃ)-এর সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি যে দ্বীনের প্রতি আহবান করেন, তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাজনক। তিনি তো আল্লাহর সহযোগিতা থেকেই বঞ্চিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
[4] অর্থাৎ, আমাদের জন্য কি আল্লাহর পক্ষ হতে আর কোন বিজয় ও সহযোগিতার সম্ভাবনা আছে? অথবা আমাদের কি কোন কথা চলতে পারে এবং মেনে নেওয়া যেতে পারে?
[5] তোমাদের কিংবা শত্রুদের এখতিয়ারে কিছুই নেই। সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর পক্ষ থেকেই আসবে, সফলতা তিনিই দান করবেন এবং আদেশ-নিষেধ কেবল তাঁরই চলবে।
[6] নিজেদের অন্তরে মুনাফিক্বী গোপন রেখে ভাব এমন দেখাত যে, তারা পথ নির্দেশের মুখাপেক্ষী।
[7] এটা তারা আপোসে বলাবলি করত অথবা মনে মনে বলত।
[8] মহান আল্লাহ বললেন, এই ধরনের কথার লাভ কি? যেভাবেই হোক না কেন, মৃত্যু তো আসবেই এবং তা সেই স্থানেই আসবে, যেখানে আল্লাহর পক্ষ হতে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি তোমরা নিজেদের বাড়িতে অবস্থান কর, আর তোমাদের মৃত্যু কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা থাকে, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক এই ফায়সালা তোমাদেরকে সেখানেই টেনে নিয়ে যাবে।
[9] (যুদ্ধের ময়দানে) যা কিছু ঘটেছে তার পিছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, তোমাদের অন্তরে বিদ্যমান ঈমানকে পরীক্ষা করা (যাতে মুনাফিকরা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যায়) এবং তোমাদের অন্তঃকরণকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র করা।
[10] অর্থাৎ, খাঁটি মুসলিম কে এবং মুনাফিক হয়ে বাহ্যিকভাবে ইসলামের পোশাক কে পরে আছে, তা তো তিনি জানেন। জিহাদের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে এটাও একটি কৌশল যে, এতে মু’মিন ও মুনাফিকের প্রকৃত রূপ বিকশিত হয়ে সামনে চলে আসে; ফলে সাধারণ মানুষও তাদেরকে দেখে ও চিনে নিতে পারে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৫
اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا مِنۡكُمۡ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ ۙ اِنَّمَا اسۡتَزَلَّهُمُ الشَّیۡطٰنُ بِبَعۡضِ مَا كَسَبُوۡا ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا اللّٰهُ عَنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ حَلِیۡمٌ ﴿۱۵۵﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৫. যেদিন দু’ দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল সেদিন তোমাদের মধ্য থেকে যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তাদের কোন কৃতকর্মের ফলে শয়তানই তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন।(১) নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাপরায়ণ ও পরম সহনশীল।
(১) সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ও বিশ্বাস এই যে, যদিও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নিস্পাপ নন, তাদের দ্বারা বড় কোন পাপ সংঘটিত হয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা সত্বেও উম্মতের জন্য তাদের কোন দোষচর্চা কিংবা দোষ আরোপ করা জায়েয নয়। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের এত বড় পদস্খলন ও অপরাধ মার্জনা করে তাদের প্রতি দয়া ও করুণাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন এবং তাদের (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ) অর্থাৎ “তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০, সূরা আল-মুজাদালাহঃ ২২]-এ মহাসম্মানজনক মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, তখন তাদেরকে কোন প্রকার অশালীন উক্তিতে স্মরণ করার কোন অধিকার অপর কারো পক্ষে কেমন করে থাকতে পারে? সে জন্যই এক সময় কোন এক সাহাবী যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী সম্পর্কে ওহুদ যুদ্ধের এই ঘটনার আলোচনায় বলেছেন যে, এরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বললেনঃ আল্লাহ নিজে যে বিষয়ের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে সমালোচনা করার কোন অধিকার কারো নেই। [দেখুন, বুখারী ৪০৬৬]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের আকীদা হলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেসব মতবিরোধ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, সে সম্পর্কে কারো প্রতি কোন আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা। কারণ, ইতিহাসে যেসব বর্ণনায় তাদের ক্রটি-বিচূতিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মিথ্যা ও ভ্রান্ত; যা শক্ররা রটিয়েছে। আর কোন কোন ব্যাপার রয়েছে যে গুলোতে কম-বেশী করা হয়েছে এবং যেগুলো প্রকৃতই শুদ্ধ সেগুলোও একান্তই সাহাবীগণের স্ব স্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় তাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা সমীচীন নয়। বস্তুতঃ ঘটনা বিশেষের মধ্যে যদি তারা সীমালজান করেও থাকেন, তবুও আল্লাহ তা'আলার রীতি হলো (إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ) সৎকাজের মাধ্যমে অসৎ কর্মের কাফফারা হয়ে যায়। বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরামের সৎকর্মের সমান অন্য কারো কর্মই হতে পারে না। কাজেই তারা আল্লাহ্ তা'আলার ক্ষমার যতটুকু যোগ্য, তেমন অন্য কেউ নয়। সে জন্যই তাদের আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাদের ব্যাপারে কটুক্তি বা অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও অন্য কারো নেই। [আল-আকিদাতুল ওয়াসেতিয়্যা]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৫) যেদিন দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তাদের কোন কৃতকর্মের জন্য শয়তানই তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। [1] নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন।[2] আল্লাহ অবশ্যই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] অর্থাৎ, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি ঘটেছিল, তার কারণ ছিল তাঁদের পূর্বের কিছু দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে শয়তান এই দিন তাদের পদস্খলন ঘটাতে সফলকাম হয়েছিল। যেমন কোন কোন সলফের উক্তি হল, ‘নেকীর প্রতিদান এটাও যে, তারপর আরো নেকী করার তাওফীক লাভ হয় এবং পাপের প্রতিফল এটাও যে, তারপর আরো পাপের পথ খুলে যায় এবং সুগম হয়।’
[2] আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের ভুল-ত্রুটি এবং তার পরিণাম ও কৌশলগত দিক উল্লেখ করে নিজের পক্ষ হতে তাঁদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করছেন। এ থেকে প্রথমতঃ প্রমাণ হয় যে, তাঁরা আল্লাহর অতিশয় প্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ সাধারণ মু’মিনদের সতর্ক করা হচ্ছে যে, সত্যবাদী সেই মু’মিনদেরকে যখন স্বয়ং আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, তখন আর কারো জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে তাঁদেরকে তিরস্কার করবে অথবা তাঁদের ব্যাপারে কোন অন্যায় মন্তব্য বা কটূক্তি করবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৬
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَكُوۡنُوۡا كَالَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا وَ قَالُوۡا لِاِخۡوَانِهِمۡ اِذَا ضَرَبُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَوۡ كَانُوۡا غُزًّی لَّوۡ كَانُوۡا عِنۡدَنَا مَا مَاتُوۡا وَ مَا قُتِلُوۡا ۚ لِیَجۡعَلَ اللّٰهُ ذٰلِكَ حَسۡرَۃً فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۱۵۶﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৬. হে মুমিনগণ! তোমরা তাদের মত হয়ে না যারা কুফরী করে এবং তাদের ভাইয়েরা যখন দেশে দেশে সফর করে(১) বা যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন তাদের সম্পর্কে বলে, তারা যদি আমাদের কাছে থাকত তবে তারা মরতো না এবং নিহত হত না। ফলে আল্লাহ এটাকেই তাদের মনে দুঃখ ও চিন্তা সৃষ্টির কারণে পরিণত করেন; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, আর তোমরা যা কর আল্লাহ সেসবের সম্যক দ্রষ্টা।
(১) সুদ্দী বলেন, এখানে দেশে দেশে সফর করা বলে, ব্যবসা করা উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন আবী হাতেম] অর্থাৎ মুনাফিকদের যখন কোন লোক মারা যেত, তখন তারা বলত: যদি আমাদের কথা শুনতো এবং যুদ্ধে বের না হতো তবে তারা মারা যেতো না। বস্তুত মুনাফিকরা যুদ্ধের আগেই তাদের ভাইদেরকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিত। অন্য আয়াতে এসেছে, “যারা ঘরে বসে রইল এবং তাদের ভাইদেরকে বলল যে, তারা তাদের কথামত চললে নিহত হত না” [সূরা আলে ইমরান: ১৬৮] আরও এসেছে, “যারা পিছনে রয়ে গেল তারা আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে বসে থাকতেই আনন্দ বোধ করল এবং তাদের ধনসম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপছন্দ করল এবং তারা বলল, গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না [সূরা আত-তাওবাহ ৮১] আরও এসেছে, “আল্লাহ অবশ্যই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা বাধাদানকারী এবং কারা তাদের ভাইদেরকে বলে, আমাদের দিকে চলে এসো। তারা অল্পই যুদ্ধে যোগদান করে।” [সূরা আল-আহযাব: ১৮] আরও এসেছে, “তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে গড়িমসি করবেই। তোমাদের কোন মুসীবত হলে সে বলবে, তাদের সংগে না থাকায় আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” [সূরা আন-নিসা: ৭২]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৬) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা অবিশ্বাস করে এবং যখন তাদের ভ্রাতাগণ পৃথিবীতে বিচরণ করে অথবা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তারা তাদের সম্পর্কে বলে, ‘তারা যদি আমাদের কাছে থাকত, তাহলে তারা মরত না এবং নিহত হত না।’[1] তা এ জন্য যে, যাতে আল্লাহ এটাকে তাদের মনস্তাপে পরিণত করেন।[2] বস্তুতঃ আল্লাহই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
[1] ঈমানদারদেরকে সেই বিভ্রান্তিকর আকীদা থেকে বিরত রাখা হচ্ছে, যা কাফের ও মুনাফিকরা পোষণ করত। কারণ, এই বিশ্বাসই হল ভীরুতার মূল কারণ। পক্ষান্তরে যখন এই বিশ্বাস জান্মাবে যে, জীবন ও মরণ আল্লাহর হাতে এবং মৃত্যুর একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, তখন মানুষের মধ্যে সাহসিকতা এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার উৎসাহ সৃষ্টি হবে।
[2] যদি তারা যুদ্ধের ময়দানে না গিয়ে বাড়িতেই বসে থাকত, তাহলে মৃত্যুর কবলে পড়া থেকে বেঁচে যেত --এ রকম ভ্রান্ত আকীদা আন্তরিক অনুতাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, মৃত্যু তো সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরেও আসে। মহান আল্লাহ বলেন, [أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ] ‘‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরে অবস্থান কর তবুও।’’ (সূরা নিসা ৭৮ আয়াত) কাজেই এই অনুতাপ থেকে মুসলিমরাই রক্ষা পেতে পারে। কারণ, তাদের আকীদা সঠিক ও শুদ্ধ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৭
وَ لَئِنۡ قُتِلۡتُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَوۡ مُتُّمۡ لَمَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَحۡمَۃٌ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ ﴿۱۵۷﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৭. তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হলে অথবা তোমাদের মৃত্যু হলে, যা তারা জমা করে, আল্লাহর ক্ষমা এবং দয়া অবশ্যই তার চেয়ে উত্তম।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৭) যদি তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হও অথবা মৃত্যুবরণ কর, তাহলে তারা যা সঞ্চয় করে, তা থেকে উত্তম আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া। [1]
[1] যে কোনভাবেই হোক না কেন মৃত্যু তো আসবেই, তাই এমন মৃত্যু যদি ভাগ্যে জুটে, যে মৃত্যুর পর মানুষ আল্লাহর ক্ষমা ও তাঁর দয়া লাভের যোগ্য হয়ে যায়, তবে এটা হবে তার জন্য পার্থিব সেই সমূহ ধন-সম্পদ থেকেও উত্তম, যা মানুষ সারা জীবন উপার্জন করে থাকে। কাজেই আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকে পিছপা না হয়ে সেদিকে বড়ই উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অগ্রসর হতে হবে। আর নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার উৎসাহ থাকলে তাঁর ক্ষমা ও দয়া সুনিশ্চিত হয়ে যাবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৮
وَ لَئِنۡ مُّتُّمۡ اَوۡ قُتِلۡتُمۡ لَاِالَی اللّٰهِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۱۵۸﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৮. আর তোমাদের মৃত্যু হলে অথবা তোমরা নিহত হলে আল্লাহরই কাছে তোমাদেরকে একত্র করা হবে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৮) আর তোমাদের মৃত্যু হলে অথবা তোমরা নিহত হলে, তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটেই একত্রিত করা হবে।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৫৯
فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰهِ لِنۡتَ لَهُمۡ ۚ وَ لَوۡ كُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِكَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡهُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَ شَاوِرۡهُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُتَوَكِّلِیۡنَ ﴿۱۵۹﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৯. আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন(১) যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন(২), তারপর আপনি কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করবেন(৩); নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন।
(১) আবু উমামা আল বাহেলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেনঃ হে আবু উমামা! মুমিনদের মাঝে কারো কারো জন্য আমার অন্তর নরম হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২১৭]
(২) অর্থাৎ ইতোপূর্বে যেমন কাজে-কর্মে এবং কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাদের সাথে পরামর্শ করতেন, তেমনিভাবে এখনও তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তাদের মনে প্রশান্তি আসতে পারে। এতে হেদায়াত দেয়া হয়েছে যে, কল্যাণ কামনার যে অনুরাগ তাদের অন্তরে বিদ্যমান, তা তাদেরকে পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, “যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদার”। [ইবন মাজাহ ৩৭৪৫] অর্থাৎ সে আমানতের সাথে পরামর্শ দিবে, ভুল পথে চালাবে না এবং আমানত হিসেবেই সেটা তার কাছে রাখবে।
এই আয়াতে সমাজ সংস্কারক ও দ্বীন-প্রচারকদের জন্য কয়েকটি বিষয়কে অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমতঃ আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তায় রূঢ়তা পরিহার করা। দ্বিতীয়তঃ সাধারণ লোকদের দ্বারা কোন ভুলভ্রান্তি হয়ে গেলে কিংবা কষ্টদায়ক কোন বিষয় সংঘটিত হলে সে জন্য প্রতিশোধমুলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ক্ষমা প্রদর্শন করা এবং সদয় ব্যবহার করা। তৃতীয়তঃ তাদের পদস্খলন ও ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত না থাকা। তাদের জন্য দোআ-প্রার্থনা করতে থাকা এবং বাহ্যিক আচার আচরণে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার পরিহার না করা। উল্লেখিত আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমে তো সাহাবীদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারপর আচরণ-পদ্ধতি সম্পর্কে হেদায়াত দেয়া হয়েছে।
পরামর্শ গ্রহণ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা কুরআনের দু’জায়গায় সরাসরি নির্দেশ দান করেছেন। একটি হলো এই আয়াতে এবং দ্বিতীয়টি হলো সূরা আশ-শূরার সে আয়াতে যাতে সত্যিকার মুসলিমদের গুণবৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি গুণ এই বলা হয়েছে যে, “(যারা সত্যিকার মুসলিম) তাদের প্রতিটি কাজ হবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে”। এতদুভয় আয়াতে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পরামর্শের অপরিহার্যতা প্রতীয়মান হয়, তেমনিভাবে এতে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিধান সংক্রান্ত কয়েকটি মূলনীতিও সামনে এসে যায়। তা হলো এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র হলো পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র যাতে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে থাকে। এমনকি আলোচনা ও পরামর্শ করাকে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি মৌলিক বিষয় হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
(৩) উল্লেখিত আয়াতে লক্ষণীয় যে, এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়ার পর বলা হয়েছে “পরামর্শ করার পর আপনি যখন কোন একটি দিক সাব্যস্ত করে নিয়ে সেমতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন”। এতে নির্দেশ বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্প হওয়াকে শুধুমাত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিই সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আযামতুম’ বলা হয়নি, যাতে সংকল্প ও তা বাস্তবায়নে সাহাবায়ে কেরামের সংযুক্ততাও বুঝা যেতে পারত। এই ইঙ্গিতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পরামর্শ করে নেয়ার পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমীর যা করবেন তাই হবে গ্রহণযোগ্য। কোন কোন সময় উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে যদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের অভিমত বেশী শক্তিশালী হত, তখন সেমতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন।
অথচ পরামর্শ সভায় অধিকাংশ সময়এমন সবমনীষী উপস্থিত থাকতেন, যারা ইবন আব্বাসের তুলনায় বয়স, জ্ঞান ও সংখ্যার দিক দিয়ে ছিলেন গরিষ্ঠ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামও অনেক সময় শায়খাইন অর্থাৎ আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবীদের মতের উপর প্রধান্য দান করেছেন। এমন কি এমন ধারণাও করা হতে লাগল যে, উল্লেখিত আয়াতটি এতদুভয়ের সাথে পরামর্শ করার জন্যই নাযিল হয়ে থাকবে। মোটকথা: সর্বাবস্থায় সংখ্যাগরিষ্টের মতই গ্রহণ করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। বরং এখানে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার কাছাকাছি যা হবে তা-ই হবে গ্রহণযোগ্য।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৯) আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি হয়েছিলে কোমল-হৃদয়; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ হতে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।[1] আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।[2] অতঃপর তুমি কোন সংকল্প গ্রহণ করলে আল্লাহর প্রতি নির্ভর কর। [3] নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর উপর) নির্ভরশীলদের ভালবাসেন।
[1] মহান নৈতিকতার অধিকারী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর কৃত অনুগ্রহসমূহের একটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, তোমার মধ্যে যে কোমলতা ও নম্রতা তা আল্লাহর রহমতেরই ফল। আর দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য তো এই কোমলতার প্রয়োজন অনেক। তুমি যদি কোমল ও নরম না হয়ে কঠিন হৃদয়ের মালিক হতে, তাহলে মানুষ তোমার কাছে না এসে আরো দূরে সরে যেত। কাজেই তুমি মানুষের সাথে ব্যবহারে ক্ষমা ব্যবহার করতে থাক।
[2] অর্থাৎ, মুসলিমদের মনস্তষ্টির জন্য পরামর্শ করে নিবেন। এই আয়াত দ্বারা পরামর্শ করার গুরুত্ব, তার উপকারিতা এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা প্রমাণিত হয়। পরামর্শ করার এই নির্দেশ কারো নিকট ওয়াজিব এবং কারো নিকট মুস্তাহাব। (ইবনে কাসীর) ইমাম শওকানী লিখেছেন যে, ‘শাসকদের জন্য অত্যাবশ্যক হল, তাঁরা এমন সব ব্যাপারে উলামাদের সাথে পরামর্শ করবেন, যে সব ব্যাপারে তাঁদের জ্ঞান নেই অথবা যে ব্যাপারে তাঁরা সমস্যায় পড়েন। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে সৈন্য সংক্রান্ত বিষয়ে, জনগণের দায়িত্বে নিয়োজিত নেতাদের সাথে জনসাধারণের কল্যাণ প্রসঙ্গে এবং অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত সরকারী দায়িত্বশীলদের সাথে সেই অঞ্চলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরামর্শ করবেন।’ ইবনে আত্বিয়্যাহ বলেন, ‘এমন শাসকদের বরখাস্ত করার ব্যাপারে কোনই দ্বিমত নেই, যাঁরা আলেম ও দ্বীনদারদের সাথে কোন পরামর্শ করেন না।’ আর এই পরামর্শ সেই সব বিষয়ের মধ্যেই সীমিত থাকবে, যে সব ব্যাপারে শরীয়ত নীরব (যে সম্বন্ধে শরীয়তের সুস্পষ্ট কোন সমাধান নেই) অথবা যার সম্পর্ক হল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সাথে। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[3] অর্থাৎ, পরামর্শ করার পর যে মতের উপর তোমার সংকল্প সৃষ্টি হবে, আল্লাহর উপর ভরসা করে তা কার্যকরী করবে। এ থেকে প্রথমতঃ জানা গেল যে, পরামর্শ করার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ হবে শাসকের, পরামর্শদাতাদের অথবা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেদের হবে না, যেমন সাধারণতন্ত্র রাষ্টে হয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ সম্পূর্ণ ভরসা ও নির্ভর করতে হবে মহান আল্লাহর উপরে, পরামর্শদাতাদের জ্ঞান-বুদ্ধির উপরে নয়। পরের আয়াতেও আল্লাহর উপর ভরসা করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান৩ : ১৬০
اِنۡ یَّنۡصُرۡكُمُ اللّٰهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمۡ ۚ وَ اِنۡ یَّخۡذُلۡكُمۡ فَمَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَنۡصُرُكُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِهٖ ؕ وَ عَلَی اللّٰهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۱۶۰﴾
-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৬০. আল্লাহ্ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের উপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? সুতরাং মুমিনগণ আল্লাহর উপরই নির্ভর করুক।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬০) আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে কেউই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। আর তিনি তোমাদের সাহায্য না করলে তিনি ছাড়া আর কে আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? এবং বিশ্বাসিগণের উচিত, কেবল আল্লাহরই উপর নির্ভর করা।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান