بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ২/ আল-বাকারা | Al-Baqara | سورة البقرة আয়াতঃ ২৮৬ মাদানী
২ : ১৩১ اِذۡ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسۡلِمۡ ۙ قَالَ اَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۳۱﴾
اذ قال لهٗ ربهٗ اسلم قال اسلمت لرب العلمین ﴿۱۳۱﴾
• যখন তার রব তাকে বললেন, ‘তুমি আত্মসমর্পণ কর’। সে বলল, ‘আমি সকল সৃষ্টির রবের কাছে নিজকে সমর্পণ করলাম’।

-আল-বায়ান

• তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আত্মসমর্পণ কর’, উত্তরে সে বলল, ‘আমি সারা জগতের প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম’।

-তাইসিরুল

• যখন তার রাব্ব তাকে বলেছিলেনঃ তুমি আনুগত্য স্বীকার কর; সে বলেছিল: আমি বিশ্বজগতের রবের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।

-মুজিবুর রহমান

• When his Lord said to him, "Submit", he said "I have submitted [in Islam] to the Lord of the worlds."

-Sahih International

১৩১. স্মরণ করুন, যখন তার রব তাকে বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ করুন’, তিনি বলেছিলেন, আমি সৃষ্টিকুলের রব-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।(১)

(১) আল্লাহ্ তা'আলার أسْلِم আনুগত্য গ্রহণ কর’ সম্বোধনের উত্তরে সম্বোধনেরই ভঙ্গিতে أسْلَمْتُ لَكَ ‘আমি আপনার আনুগত্য গ্রহণ করলাম’ বলা যেত। কিন্তু খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম এ ভঙ্গি ত্যাগ করে বলেছেন, (أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ) অর্থাৎ আমি সৃষ্টিকুলের রবের আনুগত্য অবলম্বন করলাম। কারণ, প্রথমতঃ এতে শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহর স্থানোপযোগী গুণকীর্তনও করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, আমি আনুগত্য অবলম্বন করে কারও প্রতি অনুগ্রহ করিনি; বরং এমনটা করাই ছিল আমার প্রতি অপরিহার্য। কারণ, তিনি রাব্বুল আলামীন বা সৃষ্টিকুলের রব। তার আনুগত্য না করে বিশ্ব তথা বিশ্ববাসীর কোনই গত্যন্তর নেই। যে আনুগত্য অবলম্বন করে, সে স্বীয় কর্তব্য পালন করে লাভবান হয়। এতে আরও জানা যায় যে, মিল্লাতে ইবরাহিমীর মৌলনীতির যথার্থ স্বরূপও এক ‘ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই নিহিত- যার অর্থ আল্লাহর আনুগত্য।

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের সারমর্মও তাই। ঐসব পরীক্ষার সারমর্মও তাই, যাতে উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর এ দোস্ত মর্যাদার উচ্চতর শিখরে পৌছেছেন। ইসলাম তথা আল্লাহর আনুগত্যের খাতিরেই সমগ্র সৃষ্টি। এরই জন্য নবীগণ প্রেরিত হয়েছিলেন এবং আসমানী গ্রন্থসমূহ নাযিল করা হয়েছে। এতে আরও বোঝা যায় যে, ইসলামই সমস্ত নবীর অভিন্ন দ্বীন এবং ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। আদম 'আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত আগমনকারী সমস্ত রাসূল ইসলামের দিকেই মানুষকে আহবান করেছেন এবং তারা এরই ভিত্তিতে নিজ নিজ উম্মতকে পরিচালনা করেছেন। তবে এ ব্যাপারে মিল্লাতে ইবরাহিমীর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি তার দ্বীনের নাম ‘ইসলাম’ রেখেছিলেন এবং স্বীয় উম্মতকে ‘উম্মতে মুসলিমাহ’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

তিনি দো'আ প্রসংগে বলেছিলেনঃ “হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে (ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালাম) মুসলিম (অর্থাৎ আনুগত্যশীল) করুন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও একদলকে আনুগত্যকারী করুন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদের প্রতি অসীয়ত প্রসংগে বলেছিলেনঃ তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া অন্য কোন দ্বীনের উপর মৃত্যু বরণ করো না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পর তারই প্রস্তাবক্রমে মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত এ বিশেষ নাম লাভ করেছে। ফলে এ উম্মতের নাম হয়েছে মুসলিম। এ উম্মতের দ্বীনও ‘মিল্লাতে ইসলামিয়াহ’ নামে অভিহিত।

কুরআনে বলা হয়েছেঃ “এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীন। তিনিই ইতিপূর্বে তোমাদের ‘মুসলিম’ নামকরণ করেছেন এবং এতেও (অর্থাৎ কুরআনেও) এ নামই রাখা হয়েছে”। [সূরা আল-হাজ্বঃ ৭৮] দ্বীনের কথা বলতে গিয়ে ইয়াহুদী, নাসারা ও আরব-এর মুশরিকরাও বলে যে, তারা ইবরাহিমী দ্বীনের অনুসারী, কিন্তু এসব তাদের ভুল ধারণা অথবা মিথ্যা দাবী মাত্র। বাস্তবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত দ্বীনই ইবরাহিমী দ্বীনের অনুরূপ। মোটকথা, আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে যত রাসূল আগমন করেছেন এবং যত আসমানী গ্রন্থ ও শরীআত নাযিল হয়েছে, সে সবগুলোর প্রাণ হচ্ছে ইসলাম তথা আল্লাহর আনুগত্য।

এ আনুগত্যের সারমর্ম হলো রিপুর কামনা-বাসনার বিপরীতে আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ ত্যাগ করে হিদায়াতের অনুসরণ। পরিতাপের বিষয়, আজ ইসলামের নাম উচ্চারণকারী লক্ষ লক্ষ মুসলিম এ সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা দ্বীনের নামেও স্বীয় কামনা-বাসনারই অনুসরণ করতে চায়। কুরআন ও হাদীসের এমন ব্যাখ্যাই তাদের কাছে পছন্দ, যা তাদের কামনা-বাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা শরীআতের পরিচ্ছদকে টেনে বাহ্যদৃষ্টিতে শরীআতের অনুসরণ করছে বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কামনারই অনুসরণ। গাফেলরা জানে না যে, এসব অপকৌশল ও অপব্যাখ্যার দ্বারা সৃষ্টিকে প্রতারিত করা গেলেও স্রষ্টাকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়; তার জ্ঞান প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পরিব্যপ্ত। তিনি মনের গোপন ইচ্ছা ও ভেদ পর্যন্ত দেখেন ও জানেন। তার কাছে খাঁটি আনুগত্য ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণীয় নয়। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন]

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩১। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ কর।’ সে বলেছিল, ‘বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্ম-সমর্পণ করলাম।’ [1]

[1] এই মহত্ত্ব ও মর্যাদা তিনি লাভ করেছিলেন, যেহেতু তিনি দৃষ্টান্তহীন অনুসরণ ও আনুগত্যের নমুনা পেশ করেছিলেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩২ وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبۡرٰهٖمُ بَنِیۡهِ وَ یَعۡقُوۡبُ ؕ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰی لَكُمُ الدِّیۡنَ فَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۳۲﴾ؕ
و وصی بها ابرهٖم بنیه و یعقوب یبنی ان الله اصطفی لكم الدین فلا تموتن الا و انتم مسلمون ﴿۱۳۲﴾
• আর এরই উপদেশ দিয়েছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও (যে,) ‘হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।

-আল-বায়ান

• আর এ বিষয়ে ইবরাহীম ও ইয়া‘কূব স্বীয় পুত্রগণকে অন্তিম উপদেশ দান করে গেছে- ‘হে পুত্রগণ! আল্লাহ এ দ্বীনকে তোমাদের জন্য পছন্দ করেছেন; কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’।

-তাইসিরুল

• আর ইবরাহীম ও ইয়াকূব স্বীয় সন্তানদেরকে সদুপদেশ প্রদান করেছিলঃ হে আমার বংশধরগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য এই ধর্ম মনোনীত করেছেন, অতএব তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করনা।

-মুজিবুর রহমান

• And Abraham instructed his sons [to do the same] and [so did] Jacob, [saying], "O my sons, indeed Allah has chosen for you this religion, so do not die except while you are Muslims."

-Sahih International

১৩২. আর ইবরাহীম ও ইয়াকুব তাদের পুত্রদেরকে এরই নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে পুত্ৰগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে তোমরা মারা যেও না।(১)

(১) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মিল্লাত বা দ্বীন ইসলাম তা সমগ্র জাতি বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যই এক অনন্য নির্দেশনামা। এমতাবস্থায় আয়াতে বিশেষভাবে ইবরাহীম ও ইয়াকুব আলাইহিমুস সালাম কর্তৃক সন্তানদের সম্বোধন করার কথা বলা হয়েছে এবং উভয় মহাপুরুষ অসীয়তের মাধ্যমে স্বীয় সন্তানদেরকে যে ইসলামের উপর সুদৃঢ় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এর কারণ এই যে, সন্তানদের ভালবাসা এবং মঙ্গলচিন্তা রিসালাত এমনকি বন্ধুত্বের স্তরেরও পরিপন্থী নয়। আল্লাহর বন্ধু যিনি এক সময় তার পালনকর্তার ইংগিতে স্বীয় আদরের দুলালকে কুরবানী করতে কোমর বেধেছিলেন, তিনিই অন্য সময় সন্তানের দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গলের জন্য তার পালনকর্তার দরবারে দো'আও করেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় সন্তানকে এমন বিষয় দিয়ে যেতে চান, যা তার দৃষ্টিতে সর্ববৃহৎ নেয়ামত অর্থাৎ ইসলাম। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে নেয়ামত ও ধন-সম্পদ হচ্ছে দুনিয়ার দামী বস্তু। অথচ নবী-রাসূলগণের দৃষ্টি অনেক উর্ধ্বে।

তাদের কাছে প্রকৃত ঐশ্বর্য হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্ম তথা ইসলাম। সাধারণ মানুষ মৃত্যুর সময় সন্তানকে বৃহত্তম ধন-সম্পদ দিয়ে যেতে চায়। আজকাল একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী কামনা করে, তার সন্তান মিলফ্যাক্টরীর মালিক হোক, আমদানী ও রপ্তানীর বড় বড় লাইসেন্স লাভ করুক, লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স গড়ে তুলুক। একজন চাকুরীজীবী চায় তার সন্তান উচ্চপদ ও মোটা বেতনে চাকুরী করুক। অপরদিকে একজন শিল্পপতি মনে-প্রাণে কামনা করে, তার সন্তান শিল্পক্ষেত্রে চুড়ান্ত সাফল্য অর্জন করুক। সে সন্তানকে সারা জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ কলা-কৌশল বলে দিতে চায়। কিন্তু নবীগণ ও তাদের অনুসারী ওলীগণের সর্ববৃহৎ বাসনা থাকে, যে বস্তুকে তারা সত্যিকার চিরস্থায়ী ও অক্ষয় বলে মনে করেন, তা সন্তানরাও পুরোপুরিভাবে লাভ করুক। আর সেটা হচ্ছে দ্বীন ইসলামের উপর অটুট থাকা ও এর একনিষ্ঠ খাদেম হওয়া। এ জন্য তারা দো'আ করেন এবং চেষ্টাও করেন। অন্তিম সময়ে এরই জন্য অসীয়ত করেন। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন]

নবী-রাসূলগণের এ বিশেষ আচরণের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্যও একটি নির্দেশ রয়েছে। তা এই যে, তারা যেভাবে সন্তানদের লালন-পালন ও পার্থিব আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে, সেভাবে; বরং তার চাইতেও বেশী তাদের কার্যকলাপ ও চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার। মন্দ পথ ও মন্দ কার্যকলাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা আবশ্যক। এরই মধ্যে সন্তানদের সত্যিকারের ভালবাসা ও প্রকৃত শুভেচ্ছা নিহিত। এটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয় যে, সন্তানকে রৌদ্রের তাপ থেকে বাঁচাবার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, কিন্তু চিরস্থায়ী অগ্নি ও আযাবের কবল থেকে রক্ষা করার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না। সন্তানের দেহ থেকে কাটা বের করার জন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করবে, কিন্তু তাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করবে না। নবীদের কর্মপদ্ধতি থেকে আরও একটি মৌলিক বিষয় জানা যায় যে, সর্বপ্রথম সন্তানদের মঙ্গল চিন্তা করা এবং এরপর অন্যদিকে মনোযোগ দেয়া পিতা-মাতার কর্তব্য।

পিতা-মাতার নিকট থেকে এটাই সন্তানদের প্রাপ্য। এতে দুটি রহস্য নিহিত রয়েছে - প্রথমতঃ প্রাকৃতিক ও দৈহিক সম্পর্কের কারণে পিতা-মাতার উপদেশ সহজে ও দ্রুত গ্রহণ করবে। অতঃপর সংস্কার প্রচেষ্টায় ও সত্য প্রচারে তারা পিতা-মাতার সাহায্যকারী হতে পারবে। দ্বিতীয়তঃ এটাই সত্য প্রচারের সবচাইতে সহজ ও উপযোগী পথ যে, প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি আপন পরিবার-পরিজনের সংশোধনের কাজে মনে-প্রাণে আত্মনিয়োগ করবে। এ পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করেই কুরআন বলেঃ “হে মুমিনগণ, নিজেকে এবং পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর”। [সূরা আত-তাহরীমঃ ৬] মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সারা বিশ্বের রাসূল তার হেদায়াত কেয়ামত পর্যন্ত সবার জন্য ব্যাপক। তাকেও সর্বপ্রথম নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ “নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় প্রদর্শন করুন।” [সূরা আশ-শু’আরাঃ ২১৪]

আরও বলা হয়েছেঃ “পরিবার পরিজনকে সালাত আদায় করার নির্দেশ দিন এবং নিজেও সালাত অব্যাহত রাখুন।” [সূরা ত্বা-হাঃ ১৩২] মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদাই এ নির্দেশ পালন করেছেন। তৃতীয়তঃ আরও একটি রহস্য এই যে, কোন মতবাদ ও কর্মসূচীতে পরিবারের লোকজন ও নিকটবর্তী আতীয়-স্বজন সহযোগী ও সমমনা না হলে সে মতবাদ অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এ কারণেই প্রাথমিক যুগে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচারকার্যের জবাবে সাধারণ লোকদের উত্তর ছিল যে, প্রথমে আপনি নিজ পরিবার কোরায়শকে ঠিক করে নিন; এরপর আমাদের কাছে আসুন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারে যখন ইসলাম বিস্তার লাভ করল এবং মক্কা বিজয়ের সময় তা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করল, তখন এর প্রতিক্রিয়া কুরআনের ভাষায় এরূপ প্রকাশ পেলঃ “মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকবে”। [সূরা আন-নসরঃ ২] আজকাল দ্বীনহীনতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে, তার বড় কারণ এই যে, পিতা-মাতা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানী ও দ্বীনী হলেও সন্তানদের দ্বীনী হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করে না। সাধারণভাবে আমাদের দৃষ্টি সন্তানদের পার্থিব ও স্বল্পকালীন আরাম-আয়েশের প্রতিই নিবদ্ধ থাকে এবং আমরা এর ব্যবস্থাপনায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকি। অক্ষয় ধন-সম্পদের দিকে মনোযোগ দেই না। আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের সবাইকে তওফীক দিন, যাতে আমরা আখেরাতের চিন্তায় ব্যাপৃত হই এবং নিজের ও সন্তানদের জন্য ঈমান ও নেক আমলকে সর্ববৃহৎ পুঁজি মনে করে তা অর্জনে সচেষ্ট হই। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন]

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩২। ইব্রাহীম ও ইয়াকুব এ সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়েছিল, ‘হে পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনকে (ইসলাম ধর্মকে) মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করো না।’ [1]

[1] ইবরাহীম ও ইয়াকুব (আলাইহিমাস্ সালাম) স্বীয় সন্তানদেরকে যে দ্বীনের অসীয়ত করেছেন, তা হল ইসলাম, ইয়াহুদীধর্ম নয়। আর এই কথাটা এখানে যেরূপ পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ কুরআন কারীমের অন্যান্য স্থানেও তার আলোচনা আসবে। যেমন, {إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْأِسْلامُ} নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট দ্বীন একমাত্র ইসলাম।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৩ اَمۡ كُنۡتُمۡ شُهَدَآءَ اِذۡ حَضَرَ یَعۡقُوۡبَ الۡمَوۡتُ ۙ اِذۡ قَالَ لِبَنِیۡهِ مَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡۢ بَعۡدِیۡ ؕ قَالُوۡا نَعۡبُدُ اِلٰهَكَ وَ اِلٰـهَ اٰبَآئِكَ اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚۖ وَّ نَحۡنُ لَهٗ مُسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۳۳﴾
ام كنتم شهدآء اذ حضر یعقوب الموت اذ قال لبنیه ما تعبدون من بعدی قالوا نعبد الهك و الـه ابآئك ابرهٖم و اسمعیل و اسحق الـها واحدا و نحن لهٗ مسلمون ﴿۱۳۳﴾
• নাকি তোমরা সাক্ষী ছিলে, যখন ইয়াকূবের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল? যখন সে তার সন্তানদেরকে বলল, ‘আমার পর তোমরা কার ইবাদাত করবে’? তারা বলল, ‘আমরা ইবাদাত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের, যিনি এক ইলাহ। আর আমরা তাঁরই অনুগত’।

-আল-বায়ান

• তোমরা কি সে সময় উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু এসে পৌঁছেছিল? তখন সে তার পুত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার পরে তোমরা কার উপাসনা করবে’? পুত্রগণ উত্তর দিয়েছিল, ‘আমরা আপনার এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের উপাসনা করব, যিনি অদ্বিতীয় উপাস্য এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পিত।

-তাইসিরুল

• যখন ইয়াকূবের মৃত্যু উপস্থিত হল তখন কি তোমরা উপস্থিত ছিলে, যখন সে নিজ পুত্রদেরকে বলেছিলঃ আমার পরে তোমরা কোন্ জিনিসের ইবাদাত করবে? তারা বলেছিলঃ আমরা তোমার উপাস্যের এবং তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্য - সেই অদ্বিতীয় উপাস্যের ইবাদাত করব এবং আমরা তাঁরই অনুগত থাকব।

-মুজিবুর রহমান

• Or were you witnesses when death approached Jacob, when he said to his sons, "What will you worship after me?" They said, "We will worship your God and the God of your fathers, Abraham and Ishmael and Isaac - one God. And we are Muslims [in submission] to Him."

-Sahih International

১৩৩. ইয়াকুবের যখন মৃত্যু এসেছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? তিনি যখন সন্তানদের বলেছিলেন, “আমার পরে তোমরা কার ইবাদাত করবে? তারা বলেছিল, ‘আমরা আপনার ইলাহ(১) ও আপনার পিতৃ পুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ - সেই এক ইলাহরই ইবাদাত করবো। আর আমরা তার কাছেই আত্মসমর্পণকারী”।(২)

(১) ইলাহ শব্দটি মাসদার। যার অর্থ উপাস্য বা যার উপাসনা করা হয়। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ ইলাহ হলেন যাকে সবাই উপাসনা করে। [তাফসীরে তাবারী ১/৫৪] ইবনে আব্বাসের এই উক্তি শুধুমাত্র হক মা’বুদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেনঃ ইলাহ শব্দ দ্বারা এমন মা’বুদকে বুঝানো হয়, যিনি ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য। আর যিনি মা’বুদ হওয়ার যোগ্য তার মধ্যে এমন গুণ থাকা আবশ্যক যার কারণে তাকে সর্বোচ্চ ভালবাসা এবং সবচেয়ে বেশী বিনয় প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়।

(২) এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, নবীদের সবার দ্বীনই ছিল ইসলাম। এ জন্যই এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নবীগণ হচ্ছেন বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মাতা বিভিন্ন কিন্তু তাদের দ্বীন এক।” [বুখারী ৩৪৪৩, মুসলিম: ২৩৬৫] মাতা বিভিন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাদের শরীআত বিভিন্ন। আর দ্বীন এক হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাওহীদের মূলনীতিসমূহে তাদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৩। ইয়াকুববের নিকট যখন মৃত্যু এসেছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? [1] সে যখন নিজ পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার (মৃত্যুর) পরে তোমরা কিসের উপাসনা করবে?’ তারা তখন বলেছিল, ‘আমরা আপনার উপাস্য ও আপনার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্য, সেই অদ্বিতীয় উপাস্যের উপাসনা করব। আর আমরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী।’

[1] ইয়াহুদীদেরকে শাসানো হচ্ছে যে, তোমরা যে দাবী কর ইবরাহীম ও ইয়াকুব (আলাইহিমাস্ সালাম) নাকি তাঁদের সন্তানদেরকে ইয়াহুদীধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার অসিয়ত করে গেছেন, এই অসিয়ত করার সময় তোমরা কি উপস্থিত ছিলে নাকি? উত্তরে যদি তারা হ্যাঁ, উপস্থিত ছিলাম বলে তাহলে তা মিথ্যা ও অপবাদ হবে। আর যদি না, উপস্থিত ছিলাম না বলে তাহলে তাদের উল্লিখিত দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কারণ, তাঁরা যে দ্বীনের অসিয়ত করেছিলেন, তা ছিল ইসলাম; ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান বা মূর্তিপূজার ধর্ম নয়। সমস্ত নবীদের ধর্মই ছিল ইসলাম, যদিও শরীয়ত ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। এটাকে নবী করীম (সাঃ) তাঁর ভাষায় এইভাবে বর্ণনা করেছেন, নবীগণ একে অপরের বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মা ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু (বাপ) দ্বীন এক।

(বুখারীঃ কিতাবুল আম্বিয়া, পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর বাণীঃ আর কিতাবে মরিয়মের কথা বর্ণনা কর।)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৪ تِلۡكَ اُمَّۃٌ قَدۡ خَلَتۡ ۚ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَ لَكُمۡ مَّا كَسَبۡتُمۡ ۚ وَ لَا تُسۡـَٔلُوۡنَ عَمَّا كَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۳۴﴾
تلك امۃ قد خلت لها ما كسبت و لكم ما كسبتم و لا تسـٔلون عما كانوا یعملون ﴿۱۳۴﴾
• সেটা এমন এক উম্মত যা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।

-আল-বায়ান

• এ লোকেরা গত হয়ে গেছে, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কৃতকর্ম এবং তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে না।

-তাইসিরুল

• ওটি একটি দল ছিল, যা অতীত হয়ে গেছে; তারা যা অর্জন করেছিল তা তাদের জন্য এবং তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য এবং তারা যা করে গেছে তজ্জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবেনা।

-মুজিবুর রহমান

• That was a nation which has passed on. It will have [the consequence of] what it earned, and you will have what you have earned. And you will not be asked about what they used to do.

-Sahih International

১৩৪. তারা ছিল এমন এক জাতি, যারা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের, তোমরা যা অর্জন করেছো তা তোমাদের। আর তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না।(১)

(১) আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, বাপ-দাদার সৎকর্ম সন্তানদের উপকারে আসে না - যতক্ষণ না তারা নিজেরা সৎকর্ম সম্পাদন করবে। এমনিভাবে বাপ-দাদার কুকর্মের শাস্তিও সন্তানরা ভোগ করবে না, যদি তারা সৎকর্মশীল হয়। কুরআন এ বিষয়টি বারবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছেঃ “একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না”। [সূরা আল-আনআমঃ ১৬৪, আল-ইসরাঃ ১৫, ফাতিরঃ ১৮, আয-যুমারঃ ৭, আন-নাজমঃ ৩৮]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে বনী-হাশেম! এমন যেন না হয় যে, কেয়ামতের দিন অন্যান্য লোকজন নিজ নিজ সৎকর্ম নিয়ে আসবে আর তোমরা আসবে সৎকর্ম থেকে উদাসীন হয়ে শুধু বংশ গৌরব নিয়ে এবং আমি বলব যে, আল্লাহর আযাব থেকে আমি তোমাদের বাচাতে পারব না। [মুসলিমঃ ২৫৪৩] অন্য এক হাদীসে আছে, ‘আমল যাকে পিছনে ফেলে দেয়, বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না’। [মুসলিম: ২৬৯৯, আবু দাউদ: ১৪৫৫]

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৪। সেই উম্মত (দল) গত হয়ে গেছে; তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের; তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের। আর তারা যা করত, সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না। [1]

[1] এ কথাও ইয়াহুদীদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যারা আম্বিয়া ও সৎলোক ছিলেন, তাঁদের সাথে সম্পর্ক জুড়ে তোমাদের কোন লাভ নেই। তাঁরা যা কিছু করেছেন, তার ফল তাঁরাই পাবেন, তোমরা পাবে না। আর তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের ফল পাবে। এ থেকে জানা যায় যে, পূর্বপুরুষদের নেকীর উপর ভরসা করা ভুল। আসল জিনিস হল ঈমান ও নেক আমল। পূর্বের পুণ্যবান ব্যক্তিদের এটাই ছিল পুঁজি এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের মুক্তির একমাত্র অসীলা বা মাধ্যমও এটাই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৫ وَ قَالُوۡا كُوۡنُوۡا هُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی تَهۡتَدُوۡا ؕ قُلۡ بَلۡ مِلَّۃَ اِبۡرٰهٖمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ ﴿۱۳۵﴾
و قالوا كونوا هودا او نصری تهتدوا قل بل ملۃ ابرهٖم حنیفا و ما كان من المشركین ﴿۱۳۵﴾
• আর তারা বলে, ‘তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে’। বল, ‘বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’।

-আল-বায়ান

• ওরা বলে, ‘তোমরা ইয়াহূদী বা নাসারা হয়ে যাও তাহলে সঠিক পথ পাবে’। বল, ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্গত ছিলেন না’।

-তাইসিরুল

• এবং তারা বলে যে, তোমরা ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টান হও, তাহলেই সুপথ প্রাপ্ত হবে; তুমি বলঃ বরং আমরা ইবরাহীমের সুদৃঢ় ধর্মে আছি এবং সে অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা।

-মুজিবুর রহমান

• They say, "Be Jews or Christians [so] you will be guided." Say, "Rather, [we follow] the religion of Abraham, inclining toward truth, and he was not of the polytheists."

-Sahih International

১৩৫. আর তারা বলে, ইয়াহুদী বা নাসারা হও, সঠিক পথ পাবে। বলুন, বরং একনিষ্ঠ হয়ে আমরা ইবরাহীমের মিল্লাত অনুসরণ করব(১) এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।

(১) আয়াতের আরেকটি অনুবাদ হচ্ছে, বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করব, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং যিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। দুটো অর্থই এখানে গ্রহণযোগ্য। [তাফসীরে ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৫। তারা বলে, ‘ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান হও, সঠিক পথ পাবে।’ বল, ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে আমরা ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করব। আর সে (ইব্রাহীম) অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’ [1]

[1] ইয়াহুদী মুসলিমদেরকে ইয়াহুদীধর্মের প্রতি এবং খ্রিষ্টানরা খ্রিষ্টধর্মের প্রতি দাওয়াত দিত এবং বলত যে, এটাই হিদায়াতের পথ। মহান আল্লাহ বললেন, তাদেরকে বলে দাও, মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত হিদায়াত। তিনি ছিলেন, ‘হানীফ’ (একনিষ্ঠঃ অর্থাৎ, সমস্ত উপাস্য থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবল এক উপাস্যের ইবাদতকারী) এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। অথচ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে শিরকের মিশ্রণ রয়েছে। তবে বর্তমানে দুর্ভাগ্যবশতঃ মুসলিমদের মধ্যেও শিরক ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা যদিও -আলহামদুলিল্লাহ- কুরআন ও হাদীসে সুরক্ষিত, যাতে তাওহীদের ধারণা একেবারে নির্মল ও সুস্পষ্ট এবং যার মাধ্যমে ইয়াহুদী-খ্রিষ্ট ও বহুশ্বরবাদী ধর্ম থেকে ইসলাম যে একেবারে ভিন্ন তা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু মুসলিমদের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কার্যকলাপ ও আকীদা-বিশ্বাসে শিরকী আচরণ ও ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটার ফলে ইসলামের প্রকৃত রূপ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে অদৃশ্য হয়ে পড়েছে। কারণ, অন্য ধর্মাবলম্বি যারা তারা তো আর কুরআন ও হাদীস পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। তারা কেবল মুসলিমদের বাহ্যিক আমল দেখেই অনুমান করে যে, ইসলাম ও শিরকী ধ্যান-ধারণা-মিশ্রিত অন্যান্য ধর্মের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। পরের আয়াতে ঈমানের মান নির্ণায়ক নিক্তির কথা বলা হচ্ছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৬ قُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡنَا وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ الۡاَسۡبَاطِ وَ مَاۤ اُوۡتِیَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰی وَ مَاۤ اُوۡتِیَ النَّبِیُّوۡنَ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡهُمۡ ۫ۖ وَ نَحۡنُ لَهٗ مُسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۳۶﴾
قولوا امنا بالله و ما انزل الینا و ما انزل الی ابرهٖم و اسمعیل و اسحق و یعقوب و الاسباط و ما اوتی موسی و عیسی و ما اوتی النبیون من ربهم لا نفرق بین احد منهم و نحن لهٗ مسلمون ﴿۱۳۶﴾
• তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’।

-আল-বায়ান

• তোমরা বল, ‘আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল এবং ইসহাক ও ইয়াকূব ও বংশধরদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যা মূসা ও ‘ঈসাকে দেয়া হয়েছে আর যা অন্যান্য নাবীগণকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে দেয়া হয়েছে (এ সবের প্রতিও ঈমান এনেছি), আমরা এদের মধ্য হতে কোন একজনের ব্যাপারেও কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পিত’।

-তাইসিরুল

• তোমরা বলঃ আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তদীয় বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যা মূসা ও ঈসাকে প্রদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নাবীগণকে তাদের রাব্ব হতে যা প্রদত্ত হয়েছিল, তদসমুদয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি, তাদের মধ্যে কেহকেও আমরা প্রভেদ করিনা, এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।

-মুজিবুর রহমান

• Say, [O believers], "We have believed in Allah and what has been revealed to us and what has been revealed to Abraham and Ishmael and Isaac and Jacob and the Descendants and what was given to Moses and Jesus and what was given to the prophets from their Lord. We make no distinction between any of them, and we are Muslims [in submission] to Him."

-Sahih International

১৩৬. তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ্‌র প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা ইবরাহীম, ইসমা’ঈল, ইসহাক, ইয়া’কুব ও তার বংশধরদের প্রতি(১) নাযিল হয়েছে, এবং যা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রব এর নিকট হতে দেয়া হয়েছে(২)। আমরা তাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না(৩)। আর আমরা তারই কাছে আত্মসমর্পণকারী।

(১) কুরআন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর বংশধরকে أَسْبَاطِ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছে। এটা سبط এর বহুবচন। এর অর্থ গোত্র ও দল। তাদের سِبْط বলার কারণ এই যে, ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর ঔরসজাত পুত্রদের সংখ্যা ছিল বারজন। পরে প্রত্যেক পুত্রের সন্তানরা এক-একটি গোত্রে পরিণত হয়। আল্লাহ্ তা'আলা তার বংশে বিশেষ বরকত দান করেছিলেন। তিনি যখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর কাছে মিশরে যান, তখন সন্তান ছিল বার জন। পরে ফিরআউনের সাথে মোকাবেলার পর মূসা আলাইহিস সালাম যখন মিশর থেকে ইসরাঈল-বংশধরকে নিয়ে বের হলেন, তখন তার সাথে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর সন্তানদের মধ্য থেকে প্রত্যেক ভাইয়ের সন্তান হাজার হাজার সদস্যের একটি গোত্র ছিল। তার বংশে আল্লাহ তা'আলা আরও একটি বরকত দান করেছেন এই যে, অনেক নবী ও রাসূল ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর বংশেই জন্মেছে। [তাফসীরে মা'আরিফুল কুরআন]

(২) আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আহলে কিতাবগণ হিব্রু ভাষায় তাওরাত পড়ত এবং মুসলিমদের জন্য আরবীতে অনুবাদ করে দিত। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমরা তাদেরকে সত্যায়নও করবে না, মিথ্যারোপ করবে না; বরং বলবে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরদের প্রতি নাযিল হয়েছে, এবং যা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রব-এর নিকট হতে দেয়া হয়েছে।” [বুখারী ৪৪৮৫]

(৩) নবীদের মধ্যে পার্থক্য না করার অর্থ হচ্ছে, কেউ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং কেউ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না অথবা কাউকে মানি এবং কাউকে মানি না - আমরা তাদের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করি না। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সকল নবীই একই চিরন্তন সত্য ও একই সরল-সোজা পথের দিকে আহবান জানিয়েছেন। কাজেই যথার্থ সত্যপ্রিয় ব্যক্তির পক্ষে সকল নবীকে সত্যপন্থী ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে ব্যক্তি এক নবীকে মানে এবং অন্য নবীকে অস্বীকার করে, সে আসলে যে নবীকে মানে তারও অনুগামী নয়। তার আসল দ্বীন হচ্ছে বর্ণবাদ, বংশবাদ ও বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ। কোন নবীর অনুসরণ তার দ্বীন নয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৬। তোমরা বল, ‘আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি এবং যা আমাদের প্রতি এবং ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যা মূসা ও ঈসাকে প্রদান করা হয়েছে এবং যা অন্যান্য নবীগণ তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রদত্ত হয়েছে, তাতেও (বিশ্বাস করি)। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁর কাছে আত্ম-সমর্পণকারী।’ [1]

[1] অর্থাৎ, ঈমান হল এই যে, সমস্ত নবীগণ আল্লাহ কর্তৃক যা কিছু পেয়েছেন বা যা কিছু তাঁদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, সে সবের উপর ঈমান আনা। কোন কিতাব ও রসূলকে অস্বীকার না করা। কোন এক কিতাব বা নবীকে মেনে নেওয়া এবং কোন নবীকে অস্বীকার করা হল নবীদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করা; যা ইসলামে বৈধ নয়। অবশ্য আমল এখন কেবল কুরআনের বিধান অনুযায়ী হবে। পূর্বের কিতাবে লিখিত কথা অনুযায়ী হবে না। কেননা, প্রথমতঃ তা (পূর্বের কিতাবগুলো) তার আসল অবস্থায় অবিকৃত নেই, দ্বিতীয়তঃ কুরআন সেগুলোকে রহিত করে দিয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৭ فَاِنۡ اٰمَنُوۡا بِمِثۡلِ مَاۤ اٰمَنۡتُمۡ بِهٖ فَقَدِ اهۡتَدَوۡا ۚ وَ اِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّمَا هُمۡ فِیۡ شِقَاقٍ ۚ فَسَیَكۡفِیۡكَهُمُ اللّٰهُ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۱۳۷﴾ؕ
فان امنوا بمثل ما امنتم بهٖ فقد اهتدوا و ان تولوا فانما هم فی شقاق فسیكفیكهم الله و هو السمیع العلیم ﴿۱۳۷﴾
• অতএব যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

-আল-বায়ান

• সুতরাং এরা যদি তেমন ঈমান আনে, যেমন তোমরা ঈমান এনেছো, তাহলে তারা সঠিক পথ পাবে আর যদি অস্বীকার করে, তবে তারা ভেদাভেদে লিপ্ত, সে অবস্থায় তোমার জন্য তাদের (অনিষ্ট হতে বাঁচার জন্য) আল্লাহ্ই যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।

-তাইসিরুল

• অনন্তর তোমরা যেরূপ বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তারাও যদি তদ্রুপ বিশ্বাস স্থাপন করে তাহলে নিশ্চয়ই তারা সুপথ প্রাপ্ত হবে; এবং যদি তারা ফিরে যায় তাহলে তারা শুধু বিরুদ্ধাচরণেই ফিরে যাবে; অতএব অচিরেই আল্লাহ তাদের প্রতিকূলে তোমাকেই যথেষ্ট করবেন এবং তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।

-মুজিবুর রহমান

• So if they believe in the same as you believe in, then they have been [rightly] guided; but if they turn away, they are only in dissension, and Allah will be sufficient for you against them. And He is the Hearing, the Knowing.

-Sahih International

১৩৭. অতঃপর তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছ তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তবে নিশ্চয় তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা বিরোধিতায় লিপ্ত সুতরাং তাদের বিপক্ষে আপনার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৭। তোমরা যাতে বিশ্বাস করেছ তারা যদি সেরূপ বিশ্বাস করে, তাহলে নিশ্চয় তারা সুপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধভাবাপন্ন। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। [1] তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

[1] সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)গণ (কুরআনে) উল্লিখিত এই নিয়মেই ঈমান এনেছিলেন। এই জন্যই তাঁদের দৃষ্টান্ত পেশ করে বলা হচ্ছে যে, তারা যদি ঐভাবেই ঈমান আনে, যেভাবে হে সাহাবাগণ! তোমরা ঈমান এনেছ, তাহলে অবশ্যই তারা হিদায়াত লাভ করবে। কিন্তু তারা যদি হঠকারিতা ও বিরোধিতার পথ অবলম্বন করে, তবে তাতে ঘাবড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই তাদের চক্রান্তসমূহ (হে নবী) তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, তাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। বলা বাহুল্য, কয়েক বছরের মধ্যেই এই অঙ্গীকার বাস্তব রূপ পেল। বানু-ক্বায়নুক্বা ও বানু-নাযীরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা এবং বানু-ক্বুরায়যাকে হত্যা করা হল। ইতিহাসের বর্ণনায় এসেছে যে, উসমান (রাঃ)-কে শহীদ করার সময় একটি কুরআন তাঁর কোলেই ছিল এবং তাতে লিখিত এই {فَسَيَكْفِيْكَهُمُ اللهُ} আয়াতে তাঁর রক্তের ছিটা পড়েছিল। বলা হয়, কুরআনের সে কপিটি আজও তুরস্কের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৮ صِبۡغَۃَ اللّٰهِ ۚ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰهِ صِبۡغَۃً ۫ وَّ نَحۡنُ لَهٗ عٰبِدُوۡنَ ﴿۱۳۸﴾
صبغۃ الله و من احسن من الله صبغۃ و نحن لهٗ عبدون ﴿۱۳۸﴾
• (বল,) আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম। আর রং এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমরা তাঁরই ইবাদাতকারী।

-আল-বায়ান

• (আমাদের দ্বীন) আল্লাহর রঙে রঞ্জিত এবং আল্লাহর রঙ অপেক্ষা আর কার রঙ উত্তম হবে? এবং আমরা তাঁরই ‘ইবাদাতকারী।

-তাইসিরুল

• আমরা আল্লাহরই রংয়ে রঞ্জিত, আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতম রঞ্জনকারী? এবং আমরা তাঁরই বান্দা।

-মুজিবুর রহমান

• [And say, "Ours is] the religion of Allah. And who is better than Allah in [ordaining] religion? And we are worshippers of Him."

-Sahih International

১৩৮. আল্লাহর রং এ রঞ্জিত হও(১)। আর রং এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে বেশী সুন্দর? আর আমরা তারই ইবাদতকারী।

(১) আল্লাহর রং বলতে অধিকাংশ মুফাসসিরীনের নিকট উদ্দেশ্য হলোঃ আল্লাহর দ্বীন বা ইসলাম। সারমর্ম হলো- যা কিছু বর্ণিত হলো, তা হলো আল্লাহর দ্বীন, তার নবী ইবরাহীমের মিল্লাত, এটা হলো সর্বোত্তম রং। আয়াতটির দুটি অনুবাদ হতে পারে। (এক) আমরা আল্লাহর রং ধারণ করেছি। (দুই) আল্লাহর রং ধারণ কর। নাসারাদের দ্বীনের আত্মপ্রকাশের পূর্বে ইয়াহুদীদের মধ্যে একটি বিশেষ রীতির প্রচলন ছিল। কেউ তাদের দ্বীন গ্রহণ করলে তাকে গোসল করানো হত। আর তাদের ওখানে গোসলের অর্থ ছিল, তার সমস্ত গোনাহ যেন ধুয়ে গেল এবং তার জীবন যেন রং ধারণ করল। পরবর্তীকালে নাসারাদের মধ্যেও এ রীতির প্রচলন হয়। তাদের ওখানে এর পরিভাষিক নাম হচ্ছে ‘ইসতিবাগ’ বা রঙ্গিন করা (ব্যাপ্টিজম)। তাদের দ্বীনে যারা প্রবেশ করে কেবল তাদেরকেই ব্যাপ্টাইজড করা হয় না, বরং নাসারা শিশুদেরকেও ব্যাপ্টাইজড করা হয়। এ ব্যাপারেই বলা হচ্ছে যে, এ লোকাচারমূলক রঞ্জিত হবার যৌক্তিকতা কোথায়? বরং আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। যা কোন পানির দ্বারা হওয়া যায় না। বরং তার বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে এ রঙে রঞ্জিত হওয়া যায়।

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৮। (আমরা গ্রহণ করলাম) আল্লাহর রঙ (আল্লাহর ধর্ম বা তাঁর প্রকৃতি)। রঙে আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর? [1] আর আমরা তাঁরই উপাসনাকারী।

[1] খ্রিষ্টানদের কাছে এক প্রকার হলুদ রঙের পানি থাকে; যা প্রত্যেক খ্রিষ্টান শিশুকে এবং প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকে পান করানো হয়; যাকে খ্রিষ্টান বানানো উদ্দেশ্য হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম তাদের নিকট ‘ব্যাপ্টিজম’ (পবিত্র বারি দ্বারা অভিসিঞ্চিত করে খ্রিষ্টধর্মের দীক্ষাদানোৎসব)। এটা তাদের নিকট অত্যধিক জরুরী ব্যাপার। এ ছাড়া তারা কাউকেও পবিত্র গণ্য করে না। মহান আল্লাহ তাদের এ বিশ্বাস খন্ডন করে বলেন, আসল রঙ তো আল্লাহর রঙ। এর চেয়ে উত্তম কোন রঙ নেই। আর আল্লাহর রঙের তাৎপর্য হল, প্রাকৃতিক ধর্ম ইসলাম, যার প্রতি প্রত্যেক নবী নিজ নিজ যুগে সব সব উম্মতকে আহবান করেছেন; যা ছিল তাওহীদের আহবান।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৩৯ قُلۡ اَتُحَآجُّوۡنَنَا فِی اللّٰهِ وَ هُوَ رَبُّنَا وَ رَبُّكُمۡ ۚ وَ لَنَاۤ اَعۡمَالُنَا وَ لَكُمۡ اَعۡمَالُكُمۡ ۚ وَ نَحۡنُ لَهٗ مُخۡلِصُوۡنَ ﴿۱۳۹﴾ۙ
قل اتحآجوننا فی الله و هو ربنا و ربكم و لنا اعمالنا و لكم اعمالكم و نحن لهٗ مخلصون ﴿۱۳۹﴾
• বল, ‘তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব? আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ।

-আল-বায়ান

• বল, ‘তোমরা কি আল্লাহর সম্বন্ধে আমাদের সাথে ঝগড়া করছ? অথচ তিনি আমাদেরও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক এবং আমাদের জন্য আমাদের কৃতকর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কৃতকর্ম এবং আমরা তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ।’

-তাইসিরুল

• তুমি বলঃ তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে বিরোধ করছ? অথচ তিনিই আমাদের রাব্ব ও তোমাদের রাব্ব, এবং আমাদের জন্য আমাদের কার্যসমূহ এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কার্যসমূহ এবং আমরা তাঁরই প্রতি বিশ্বস্ত।

-মুজিবুর রহমান

• Say, [O Muhammad], "Do you argue with us about Allah while He is our Lord and your Lord? For us are our deeds, and for you are your deeds. And we are sincere [in deed and intention] to Him."

-Sahih International

১৩৯. বলুন, 'আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা কি আমাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? অথচ তিনি আমাদের রব এবং তোমাদেরও রব! আমাদের জন্য আমাদের আমল। আর তোমাদের জন্য তোমাদের আমল(১), এবং আমরা তাঁরই প্রতি একনিষ্ঠ(২)।

(১) তোমাদের কাজের জন্য তোমরা দায়ী আর আমাদের কাজের জন্য আমরা দায়ী। তোমরা যদি তোমাদের ইবাদাতকে বিভক্ত করে থাক এবং অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করে তার ইবাদাত ও আনুগত্য কর, তাহলে তোমাদেরকে তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরিণাম তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে। আমরা বলপূর্বক তোমাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে চাই না। কিন্তু আমরা নিজেদের যাবতীয় ইবাদাত ও আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যদি তোমরা এ কথা স্বীকার করে নাও যে, আমাদেরও এ কাজ করার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, তাহলে তো ঝগড়াই মিটে যায়।

(২) এখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ব্যাপারে নিষ্ঠাবান। নিষ্ঠা বা ইখলাসের অর্থ, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার না করা এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য সৎকর্ম করা; মানুষকে দেখানোর জন্য অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জনের জন্য নয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

১৩৯। বল, ‘আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? অথচ তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য; আর আমরা তাঁর প্রতি অকপট।’ [1]

[1] তোমরা কি এই কারণেই আমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত যে, আমরা এক আল্লাহরই ইবাদত করি। তাঁরই জন্য নিষ্ঠা ও আনুগত্যের উদ্যম রাখি। তাঁর আদেশাবলী পালন করি এবং নিষেধাবলী থেকে বিরত থাকি। অথচ তিনি যে কেবল আমাদের প্রতিপালক তা নয়, বরং তিনি তোমাদেরও প্রতিপালক। তোমাদেরকেও তাঁর সাথে ঐরূপ আচরণ করা দরকার যেরূপ আমরা করি। তোমরা যদি এমনটি না কর, তবে তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম এবং আমাদের জন্য আমাদের কর্ম। আমরা তো তাঁর জন্য নিষ্ঠার সাথে আমল করার প্রতি যত্নবান।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
২ : ১৪০ اَمۡ تَقُوۡلُوۡنَ اِنَّ اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ الۡاَسۡبَاطَ كَانُوۡا هُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی ؕ قُلۡ ءَاَنۡتُمۡ اَعۡلَمُ اَمِ اللّٰهُ ؕ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ كَتَمَ شَهَادَۃً عِنۡدَهٗ مِنَ اللّٰهِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۴۰﴾
ام تقولون ان ابرهٖم و اسمعیل و اسحق و یعقوب و الاسباط كانوا هودا او نصری قل ءانتم اعلم ام الله و من اظلم ممن كتم شهادۃ عندهٗ من الله و ما الله بغافل عما تعملون ﴿۱۴۰﴾
• নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’? আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে? আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।

-আল-বায়ান

• তোমরা কি বলছ, ইবরাহীম ও ইসমাঈল এবং ইসহাক ও ইয়াকূব এবং তার বংশধর সকলেই ইয়াহূদী কিংবা নাসারা ছিল’? বল,‘ তোমরাই বেশী জান নাকি আল্লাহ’? ঐ ব্যক্তি হতে বড় যালিম আর কে হবে, যে আল্লাহর পক্ষ হতে আগত সাক্ষ্যকে গোপন করে? তোমরা যা কিছু করছ, আল্লাহ সে বিষয়ে গাফিল নন।

-তাইসিরুল

• তোমরা কি বলছ - ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তদীয় বংশধরগণ ইয়াহুদী ও খৃষ্টান ছিল? তুমি বলঃ তোমরাই সঠিক জ্ঞানী না আল্লাহ এবং আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য যে ব্যক্তি গোপন করছে সে অপেক্ষা কে বেশি অত্যাচারী? এবং তোমরা যা করছ তা হতে আল্লাহ অমনোযোগী নন।

-মুজিবুর রহমান

• Or do you say that Abraham and Ishmael and Isaac and Jacob and the Descendants were Jews or Christians? Say, "Are you more knowing or is Allah?" And who is more unjust than one who conceals a testimony he has from Allah? And Allah is not unaware of what you do.

-Sahih International

১৪০. তোমরা কি বল যে, অবশ্যই ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ ইয়াহুদী বা নাসারা ছিল? বলুন, তোমরা কি বেশী জান, না আল্লাহ? তার চেয়ে বেশী যালিম আর কে হতে পারে যে আল্লাহর কাছ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য আছে তা গোপন করে? আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল নন।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

১৪০। তোমরা কি বল যে, ‘ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান ছিল?’ বল, ‘তোমরা কি বেশী জান, না আল্লাহ?’[1] আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ যে গোপন করে, তার অপেক্ষা অধিকতর সীমালংঘনকারী আর কে হতে পারে? আর তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে আল্লাহ বেখবর নন। [2]

[1] তোমরা বলছ যে, ঐ সকল আম্বিয়া ও তাঁদের সন্তানরা ইয়াহুদী অথবা খ্রিষ্টান ছিলেন, অথচ মহান আল্লাহ তা খন্ডন করছেন। এখন তোমরাই বল যে, আল্লাহ বেশী জানেন, না তোমরা?

[2] তোমরা জানো যে, এই নবীগণ ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান ছিলেন না। অনুরূপ তোমাদের কিতাবে রসূল (সাঃ)-এর নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান, কিন্তু এই প্রমাণগুলো লোকদের কাছে গোপন করে তোমরা যে বড় যুলুম করছো তা আল্লাহর নিকট গুপ্ত নয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ১৩১ থেকে ১৪০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৮৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 11 12 13 14 15 · · · 26 27 28 29 পরের পাতা »