-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১১. অতএব তারা যদি তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে দ্বীনের মধ্যে তারা তোমাদের ভাই(১); আর আমরা আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করি এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে।(২)
(১) মুশরিকদের উপরোক্ত ঘৃণ্য চরিত্রের প্রেক্ষিতে মুসলিমদের জন্যে তাদের সাথে চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদ করে নেয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না কুরআন যে আদর্শ ও ন্যায় নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার আলোকে মুসলিমদের হেদায়াত দেয়ঃ “তবে, তারা যদি তাওবাহ করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।” এখানে বলা হয় যে, কাফেররা যত শক্রতা করুক, যত নিপীড়ন চালাক, যখন সে মুসলিম হয়, তখন আল্লাহ যেমন তাদের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করেন, তেমনি সকল তিক্ততা ভুলে তাদের ভ্রাতৃ-বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং ভ্রাতৃত্বের সকল দাবী পূরণ করা মুসলিমদের কর্তব্য। এ শর্ত পূরণ করার ফলে তাদের উপর হাত তোলা ও তাদের জান-মাল নষ্ট করাই শুধু তোমাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে না, বরং তার অধিক ফায়েদা এই হবে যে, তারা অন্যান্য মুসলিমদের সমান হতে পারবে। কোনরূপ বৈষম্য ও পার্থক্য থাকবে না।
এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথম, কুফর ও শির্ক থেকে তাওবাহ্। দ্বিতীয় সালাত কায়েম করা, তৃতীয় যাকাত আদায় করা। [আইসারুত তাফসীর] কারণ, ঈমান ও তাওবাহ হল গোপন বিষয় এর যথার্থতা সাধারণ মুসলিমের জানার কথা নয়। তাই ঈমান ও তাওবাহর দুই প্রকাশ্য আলামতের উল্লেখ করা হয়, আর তা হল, সালাত ও যাকাত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এ আয়াত সকল কেবলানুসারী মুসলিমের রক্তকে হারাম করে দিয়েছে। [তাবারী; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ যারা নিয়মিত সালাত কায়েম ও যাকাত আদায় করে এবং ইসলামের বরখেলাফ কথা ও কর্মের প্রমাণ পাওয়া যায় না, সর্বক্ষেত্রে তারা মুসলিমরূপে গণ্য, তাদের অন্তরে সঠিক ঈমান বা মুনাফিকী যাই থাক না কেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে এ আয়াত থেকে অস্ত্ৰধারনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে সাহাবায়ে কেরামের সন্দেহ নিরসন করেছিলেন। [তাবারী]
(২) এখানে জ্ঞান সম্পন্ন লোক বলতে তাদের বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ্র নাফরমানী করার পরিণাম জানে ও বুঝে এবং তার ভয়ও তাদের মনে জাগরুক রয়েছে। তাদের জন্যই আগের কথাগুলো বলা হলো, তাদের মাধ্যমেই আয়াত ও আহকাম জানা যাবে, আর তাদের মাধ্যমেই দ্বীন ইসলাম ও শরীআত জানা যাবে। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে তাদের মধ্যে গণ্য করুন যারা জানে ও সে অনুসারে আমল করে। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১১) অতঃপর তারা যদি তওবা করে, যথাযথ নামায পড়ে ও যাকাত দেয়, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। [1] আর জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শনসমূহ স্পষ্টরূপে বিবৃত করি।
[1] নামায হল তাওহীদ ও রিসালতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করার পর ইসলামের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা আল্লাহর হক। তাতে আল্লাহর ইবাদতের বিভিন্ন দিক রয়েছে। এতে রয়েছে হাত বেঁধে কিয়াম, রুকূ ও সিজদা। এতে রয়েছে দু’আ ও মুনাজাত, আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা এবং নিজের মিনতি ও অসহায়তার প্রকাশ। ইবাদতের এই সমস্ত প্রকার ও ধরন কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। নামাযের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও ফরযকৃত রুকন হল যাকাত। যাতে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে বান্দারও হক শামিল রয়েছে। যাকাতের অর্থ দ্বারা সমাজের ও বিশেষ করে যাকাতদাতার আত্মীয় গরীব-মিসকীন ও অক্ষম লোকদের প্রয়োজন মিটে থাকে। এই জন্য হাদীসে দুই সাক্ষ্য দানের পর উক্ত দু’টি বিষয়কে পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হয়েছে। নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, লোকদের বিরুদ্ধে আমি যেন ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সাক্ষী দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। আর নামায কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে।’’ (বুখারী ঈমান অধ্যায়, মুসলিম ঈমান অধ্যায়) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যাকাত প্রদান করে না, তার নামাযও গ্রহণযোগ্য নয়।’ (ঐ)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১২. আর যদি তারা তাদের চুক্তির পর তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে কটুক্তি করে(১), তবে কুফরের নেতাদের সাথে যুদ্ধ কর(২); এরা এমন লোক যাদের কোন প্রতিশ্রুতি নেই(৩); যেন তারা নিবৃত্ত হয়।(৪)
(১) এ বাক্য থেকে আলেমগণ প্রমাণ করেন যে, মুসলিমদের ধর্মের প্রতি বিদ্রুপ করা চুক্তিভঙ্গের নামান্তর। যে ব্যক্তি ইসলাম, ইসলামের নবী বা ইসলামী শরীআতকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, তাকে চুক্তি রক্ষাকারী বলা যাবে না। শরীআত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। [ইবন কাসীর]
(২) কতিপয় মুফাসসির বলেন, এখানে কুফর-প্রধান বলতে বোঝায় মক্কার ঐ সকল কোরাইশ প্রধান যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে লোকদের উস্কানি দান ও রণ প্রস্ততিতে নিয়োজিত ছিল। বিশেষতঃ এদের সাথে যুদ্ধ করতে আদেশ এজন্যে দেয়া হয় যে, মক্কাবাসীদের শক্তির উৎস হল এরা। [তাবারী; ইবন কাসীর] কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে অঙ্গীকার অর্থ, ইসলাম ও রাষ্ট্রীয় আনুগত্য। কারণ সন্ধি-চুক্তি তো পূর্বেই প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তারপর ভবিষ্যতে তাদের সাথে নতুন করে কোন চুক্তি বা সন্ধি করার এখন কোন ইচ্ছাই ছিল না। কাজেই এখানে অঙ্গীকার ভংগ করা ও চুক্তি বিরোধী কাজ করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তা ছাড়া এ আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াতের পরেই উল্লেখিত হয়েছে।
আর পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, “তারা যদি তাওবা করে, নামাজ পড়ে ও যাকাত আদায় করে তা হলে তারা তোমাদের ভাই হবে”। এরপর “তারা যদি অঙ্গীকার ভংগ করে” বলার পরিষ্কার অর্থ এই হতে পারে যে, এর দ্বারা সে লোকদের ইসলাম কবুল ও ইসলামী রাষ্ট্রের আনুগত্যের অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করা-ই বুঝানো হয়েছে। আসলে এ আয়াতে মুর্তাদ হওয়ার ফেতনার কথাই বলা হয়েছে, যা তখনো আসেনি। যা এর দেড় বছর পর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের শুরুতে হয়েছিল। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ সময় যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিলেন তা কিছুকাল পূর্বে এ আয়াতে দেওয়া হেদায়াত অনুরূপই ছিল। [তাবারী; ইবন কাসীর]
(৩) এখানে বলা হয়েছেঃ “এদের কোন শপথ নেই”; কারণ, এরা শপথ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে অভ্যস্ত। তাই এদের শপথের কোন মূল্য মান নেই। [সা'দী]
(৪) এ থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিমদের যুদ্ধ-বিগ্রহের উদ্দেশ্য অপরাপর জাতির মত শক্ৰ নির্যাতন ও প্রতিশোধ স্পৃহা নিবারণ, কিংবা সাধারণ রাষ্ট্রনায়কগণের মত নিছক দেশ দখল না হওয়া চাই। বরং তাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য হওয়া চাই শক্রদের মঙ্গল কামনা ও সহানুভূতি এবং বিপথ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা। হয়ত তারা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে, ইসলামে অপবাদ দেয়া বাদ দিবে, অথবা ঈমান আনবে। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১২) আর তারা যদি তাদের চুক্তির পর তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ও তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে খোঁটা দেয়, তাহলে অবিশ্বাসীদের নেতৃবর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। এরা এমন লোক যাদের কোনই চুক্তি (বা কসম) নেই। [1] সম্ভবতঃ তারা নিরস্ত হতে পারে।
[1] أيمان শব্দটি يمين এর বহুবচন। যার অর্থ হল কসম। أئمة শব্দটি إمام শব্দের বহুবচন, অর্থঃ নেতা বা লিডার। উদ্দেশ্য হল, যদি এই সব লোকেরা অঙ্গীকার বা চুক্তি ভঙ্গ করে ফেলে আর দ্বীনের ব্যাপারে খোঁটা মারে, তাহলে প্রকাশ্যভাবে এরা কসম খেলেও এদের কসমের কোন মূল্য নেই। বরং কাফেরদের ঐ নেতৃবর্গের বিরুদ্ধে লড়াই কর। সম্ভবতঃ এর ফলে তারা কুফর থেকে ফিরে আসবে। এ থেকে হানাফী উলামাগণ দলীল গ্রহণ করে প্রমাণ করেন যে, যিম্মী (ইসলামী দেশে অবস্থানকারী অমুসলিম) যদি চুক্তি ভঙ্গ না করে দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে খোঁটা দেয় বা কুমন্তব্য করে, তাহলে তাদেরকে হত্যা করা হবে না। কেননা, কুরআন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দু’টি শর্ত উল্লেখ করেছে। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই দু’টি শর্ত পাওয়া যাবে তাদেরকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু ইমাম মালেক (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এবং অন্যান্য উলামাগণ দ্বীনের ব্যাপারে খোঁটা দেওয়া বা নিন্দা গাওয়াকে চুক্তি ভঙ্গ করা বলে গণ্য করেছেন। এই জন্য তাঁদের নিকটে দু’টি শর্তই একত্রিত হয়। অতএব এই প্রকার যিম্মী ব্যক্তিকে হত্যা করা (মুসলিম সরকারের জন্য) বৈধ; যেমন বৈধ চুক্তি ভঙ্গকারীকেও হত্যা করা। (ফাতহুল ক্বাদীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৩. তোমরা কি সে সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করবে না, যারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রাসূলকে বের করে দেয়ার জন্য সংকল্প করেছে? আর তারাই প্রথম তোমাদের সাথে (যুদ্ধ) আরম্ভ করেছে।(১) তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? আল্লাহ্কে ভয় করাই তোমাদের পক্ষে বেশী সমীচীন যদি তোমরা মুমিন হও।
(১) অর্থাৎ কাফেররাই প্রথম শুরু করেছে, কি শুরু করেছে? কেউ কেউ বলেনঃ এর দ্বারা বদরের যুদ্ধ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [তাবারী] কারণ কাফের কুরাইশগণ যখন বদরে জানতে পারল যে, তাদের বাণিজ্য কাফেলা আশংকামুক্ত হয়েছে তখন তাদের মনের ভিতর হিংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তারা মুসলিমদের আক্রমণ করা ব্যতীত ক্ষান্ত হতে চাইল না, তারাই তখন বদরের প্রান্তরে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে পাগলপ্রায় হয়ে গেল। কেউ কেউ বলেনঃ এর দ্বারা তাদের চুক্তিভঙ্গ করে বনু বকরের সাথে মিলিত হয়ে রাসূলের মিত্র বনু খোযা’আকে আক্রমণ করা বুঝানো হয়েছে। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৩) তোমরা কি সে সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করবে না, [1] যারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে ও রসূলকে বহিষ্কার করার সংকল্প করেছে?[2] ওরাই প্রথম তোমাদের বিরুদ্ধে বিবাদ সৃষ্টি করেছে।[3] তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? আল্লাহই এ বিষয়ে বেশী হকদার যে, তোমরা তাঁকে ভয় কর; যদি তোমরা মু’মিন (বিশ্বাসী) হয়ে থাক।
[1] মহান আল্লাহ এখানে মুসলিমদেরকে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
[2] এ থেকে দারুন নাদওয়ার সেই পরামর্শ উদ্দেশ্য, যাতে মক্কার সর্দাররা নবী (সাঃ)-কে দেশ হতে বহিষ্কার, কারাবদ্ধ অথবা হত্যা করার ব্যাপারে মন্ত্রণা করেছিল।
[3] এ থেকে উদ্দেশ্য বদর যুদ্ধে মক্কার মুশরিকদের সেই আচরণ, যাতে তারা নিজেদের বাণিজ্যিক কাফেলার হিফাযতের জন্যই বের হয়েছিল। কিন্তু কাফেলা রক্ষা পেয়ে পার হয়ে গেছে দেখেও তারা বদর প্রান্তরে মুসলিমদের সাথে লড়াই করার প্রস্তুতি নিতে লাগল এবং তাঁদেরকে উত্ত্যক্ত করে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালো। যার কারণে পরিশেষে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েই গেল। কিম্বা এ থেকে কাবীলা বানী বাকরের সেই সাহায্য উদ্দেশ্য যা কুরাইশরা তাদের জন্য করেছিল। অথচ তারা রসূল (সাঃ)-এর অঙ্গীকারবদ্ধ মিত্র বানী খুযাআহ গোত্রের উপর হামলা করেছিল। বাস্তবপক্ষে কুরাইশদের এই সাহায্য চুক্তির পরিপন্থী ছিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৪. তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তোমাদের হাতে আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন, তাদেরকে অপদস্থ করবেন, তাদের উপর তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন এবং মুমিন সম্প্রদায়ের চিত্ত প্রশান্তি করবেন,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৪) তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর। তোমাদের হাতে আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দেবেন, ওদেরকে লাঞ্ছিত করবেন, ওদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন এবং বিশ্বাসীদের হৃদয় প্রশান্ত করবেন।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫. আর তিনি তাদের(১) অন্তরের ক্ষোভ দূর করবেন এবং আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তার তাওবা কবুল করবেন। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
(১) অর্থাৎ ঈমানদারদের মনের ক্ষোভ দূর করবেন। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫) এবং ওদের হৃদয়ের ক্ষোভ দূর করবেন। [1] আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তওবা করার তওফীক দিয়ে থাকেন। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
[1] অর্থাৎ, মুসলিমরা যখন দুর্বল ছিল তখন মুশরিকরা তাদের উপর অত্যাচার করত। যার কারণে মুসলিমদের হৃদয় দুঃখ-পীড়িত ও ব্যথিত ছিল। যখন তোমাদের হাতে ওরা খুন হবে এবং অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের ভাগে আসবে, তখন স্বাভাবিকভাবে অত্যাচারিত মুসলিমদের কলিজা ঠান্ডা হবে ও তাদের মনের রাগ ও ক্ষোভ দূর হয়ে যাবে
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৬. তোমরা কি মনে করেছ যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে অথচ এখনও আল্লাহ প্রকাশ করেননি যে, তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি(১)? আর তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।
(১) এখানে জিহাদের তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হল, জিহাদের দ্বারা মুসলিমদের পরীক্ষা করা। [তাবারী] এ পরীক্ষায় নিষ্ঠাবান মুসলিম এবং মুনাফিক ও দুর্বল ঈমান সম্পন্নদের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। অতএব, এ পরীক্ষা জরুরী। তাই বলা হয়েছেঃ তোমরা কি মনে কর যে, শুধু কলেমার মৌখিক উচ্চারণ ও ইসলামের দাবী শুনে তোমাদের এমনিতে ছেড়ে দেয়া হবে। অথচ আল্লাহ্ প্রকাশ্য দেখতে চান কারা আল্লাহর রাহে জিহাদকারী এবং কারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের ব্যতীত আর কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করছে না। এ আয়াতে সম্বোধন রয়েছে মুসলিমদের প্রতি। এদের মধ্যে কিছু মুনাফিক প্রকৃতির, আর কিছু দুর্বল ঈমানসম্পন্ন ইতস্ততঃকারী, যারা মুসলিমদের গোপন বিষয়গুলো নিজেদের অ-মুসলিম বন্ধুদের বলে দিত। সেজন্য এ আয়াতে নিষ্ঠাবান মুসলিমদের দুটি আলামতের উল্লেখ করা হয়।
এক. শুধু আল্লাহর জন্যে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে। দুই. কোন অমুসলিমকে নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু সাব্যস্ত করে না। আয়াতে উল্লেখিত শব্দ وليجة এর অর্থ, অন্তরঙ্গ বন্ধু, যে গোপন কথা জানে। অন্য এক আয়াতে এ অর্থে بطانة শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। [তাবারী]। এর আভিধানিক অর্থ কাপড়ের ঐ স্তর যা অন্যান্য কাপড়ের ভেতর পেট বা শরীরের স্পর্শে থাকে। বলা হয়েছেঃ “হে ঈমানদারগণ, মুমিনদের ব্যতীত আর কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধু সাব্যস্ত করো না, তারা তোমাদের ধ্বংস সাধনে কোন ক্রটি বাকী রাখবে না। [সূরা আলে ইমরানঃ ১১৮]
মোটকথাঃ আল্লাহ্ তা'আলার ইচ্ছা জিহাদের মাধ্যমে তিনি ঈমানদারদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিবেন। এ ধরনের কথা সূরা আল-আনকাবুত এর ১-৩, সূরা আলে ইমরানের ১৪২, ১৭৯ আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬) তোমরা কি মনে করেছ যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে, [1] অথচ এখনও আল্লাহ জেনে নেননি যে, তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে[2] এবং কে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও বিশ্বাসিগণ ব্যতীত অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি? [3] আর তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। [4]
[1] অর্থাৎ, পরীক্ষা ও যাচাই না করে ছেড়ে দেওয়া হবে?
[2] যেন জিহাদের দ্বারা পরীক্ষা করা হল।
[3] وَلِيجَة শব্দের অর্থঃ অন্তরঙ্গ প্রাণ-প্রিয় বন্ধু। যেহেতু মুসলিমদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করা হয়েছিল, সেহেতু এটাও পরীক্ষার একটি উপকরণ ছিল। যাতে মু’মিনদেরকে অন্যান্যদের থেকে পৃথক করা হয়েছে।
[4] অর্থাৎ, আল্লাহ তো পূর্ব হতেই সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। কিন্তু জিহাদ বিধিবদ্ধ করার হিকমত ও যৌক্তিকতা এই ছিল যে, এ থেকে খাঁটি ও অখাঁটি, অনুগত ও অবাধ্য বান্দা কে তা প্রকাশ পেয়ে সামনে এসে যাবে; যাদেরকে প্রত্যেক ব্যক্তি দেখে ও চিনে নিতে পারবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭. মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী স্বীকার করে তখন তারা আল্লাহর মসজিদসমূহের আবাদ করবে—এমন হতে পারে না।(১) তারা এমন যাদের সব কাজই নষ্ট হয়েছে(২) এবং তারা আগুনেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।
(১) অর্থাৎ যে মসজিদ একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর জন্য নির্মিত হয়েছে, তার মুতাওয়াল্লী, রক্ষণাবেক্ষণকারী, খাদেম ও আবাদকারী হওয়ার জন্য সেই লোকেরা কখনই যোগ্য বিবেচিত হতে পারে না, যারা আল্লাহর সাথে আল্লাহর গুণাবলী, হক-হুকুক ও ক্ষমতা-ইখতিয়ারের ব্যাপারে অন্যদের শরীক করে। আল্লাহর ইবাদাতের সাথে অন্যদেরও ইবাদত করে। তাছাড়া তারা নিজেরাই যখন তাওহীদের দাওয়াত কবুল করতে অস্বীকার করছে এবং নিজেদের দাসত্ব-বন্দেগীকে একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করতে প্রস্তুত নয় বলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে, তখন যে ইবাদতখানার নির্মাণই হয়েছে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য তার মুতাওয়াল্লী হওয়ার তাদের কি অধিকার থাকতে পারে? [তাবারী; ফাতহুল কাদীর; সা’দী; আইসারুত তাফসীর]
(২) অর্থাৎ তারা আল্লাহর ঘরের যে সামান্য কিছু খেদমত করেছে বলে যে অহঙ্কার করছে, তাও বিনষ্ট ও নিস্ফল হয়ে গেছে [ফাতহুর কাদীর] এই কারণে যে, তারা এ খেদমতের সঙ্গে সঙ্গে শির্কের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। [আইসারুত তাফসীর] তাদের সামান্য পরিমাণ ভালো কাজকে তাদের বড় আকারের মন্দ কাজ নিস্ফল করে দিয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭) অংশীবাদীরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী (অবিশ্বাস) স্বীকার করে, তখন তারা আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন হতে পারে না।[1] ওরা এমন যাদের সকল কর্ম ব্যর্থ [2] এবং ওরা জাহান্নামেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।
[1] مساجد الله থেকে মাসজিদুল হারাম উদ্দেশ্য। বহুবচন শব্দ ব্যবহার হয়েছে এই জন্য যে, এটা হল সমস্ত মসজিদের কিবলা এবং কেন্দ্রস্থল। অথবা আরবী ভাষায় একবচনের জায়গায় বহুবচন ব্যবহার করা বৈধ। উদ্দেশ্য হল যে, আল্লাহর ঘর (অর্থাৎ, মাসজিদুল হারাম) নির্মাণ বা আবাদ করা হল ঈমানদারদের কাজ; যারা শিরক ও কুফরী করে এবং সে কথা স্বীকারও করে, তাদের কাজ নয়। যেমন তালবিয়াতে তারা বলত, لبيك! لا شريك لك، إلا شريكًا هو لك، تملكه وما ملك। অর্থাৎ, আমি তোমার জন্য হাযির, তোমার কোন শরীক নেই। তবে সেই শরীক যা তোমার আছে। তুমি তার ও তার মালিকানাভুক্ত সবকিছুর মালিক। (মুসলিমঃ তালবিয়া পরিচ্ছেদ) কিম্বা এ থেকে উদ্দেশ্য সেই স্বীকার যা প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরা করে থাকে ও বলে যে, আমি ইয়াহুদী, আমি খ্রিষ্টান, আমি অগ্নিপূজক বা আমি পৌত্তলিক ইত্যাদি। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[2] অর্থাৎ, তাদের সেই আমল যা বাহ্যতঃ ভাল মনে হয়; যেমন, কা’বাগৃহের তওয়াফ, উমরাহ, হাজীদের খিদমত প্রভৃতি সবই ব্যর্থ। কেননা, ঈমানবিহীন এই সমস্ত আমল ফলহীন বৃক্ষের মত (নিষ্ফল) অথবা সেই ফুলের মত যার কোন সৌরভ নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৮. তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করবে(১), যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।(২)
(১) এ আয়াতে আল্লাহর মসজিদ নির্মানের ও আবাদের যোগ্যতা কাদের রয়েছে তা জানিয়ে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহর মসজিদ আবাদ করার যোগ্যতা রয়েছে উপরোক্ত গুণাবলীসম্পন্ন নেককার মুসলিমদের। এই থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি মসজিদের হেফাযত, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও অন্যান্য ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকে কিংবা যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকর বা দ্বীনী ইলমের শিক্ষা দানে কিংবা শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাতায়াত করে, তা তার কামেল মুমিন হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সকালসন্ধ্যা মসজিদে উপস্থিত হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি স্থান প্রস্তুত করেন। [বুখারীঃ ৬৬২, মুসলিমঃ ৬৬৯]
সালমান ফারেসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মসজিদে আগমনকারী ব্যক্তি আল্লাহ্র যিয়ারতকারী মেহমান, আর মেজবানের কর্তব্য হল মেহমানের সম্মান করা। [আত-তাবরানী ফিল কাবীর ৬/২৫৫]
তৃতীয় খলীফা উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মসজিদে নববী নতুন করে তৈরী করছিলেন তখন লোকেরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলছিল। তখন তিনি বললেন, তোমরা বড্ড বেশী কথা বলছ, অথচ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মসজিদ বানাবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ একটি ঘর বানাবেন। [বুখারী ৪৫০; মুসলিম: ৫৩৩]
(২) ইবন আব্বাস থেকে এ আয়াতের অর্থ এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ ব্যক্তিই মসজিদ নির্মাণ করবে, যে আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেছে, শেষ দিবসের উপর ঈমান এনেছে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা স্বীকার করে নিয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম করেছে, আর আল্লাহ ব্যতীত কারও ইবাদত করেনি, নিশ্চয় তারাই হবে সফলকাম। কুরআনে যেখানেই আল্লাহ্ তা'আলা আশা করা যায় বলেছেন সেটাই অবশ্যম্ভাবী। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৮) তারাই তো আল্লাহর মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা আল্লাহতে ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং যথাযথভাবে নামায পড়ে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না, ওদেরই সম্বন্ধে আশা যে, ওরা সৎপথ প্রাপ্ত হবে। [1]
[1] যেমন হাদীসেও এসেছে যে, নবী (সাঃ) বলেছেন ‘‘যখন তোমরা দেখবে যে, মানুষ মসজিদে (নামাযের জন্য) নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে, তখন তোমরা তার ঈমানের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও।’’ (তিরমিযীঃ সূরা তাওবার তাফসীর, হাদীসটিকে আল্লামা আলবানী যয়ীফ বলেছেন, যয়ীফুল জামে’ ৫০৯নং) কুরআন মাজীদে এখানেও আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমানের পর যে সব আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল নামায, যাকাত এবং আল্লাহর ভয়। যা হতে নামায, যাকাত ও আল্লাহ-ভীতির মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব প্রকাশ পায়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৯. হাজীদের জন্য পানি পান করানো ও মসজিদুল হারাম আবাদ করাকে তোমরা কি তার মত বিবেচনা কর, যে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে?(১) তারা আল্লাহর কাছে সমান নয়।(২) আর আল্লাহ্ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।(৩)
(১) সুতরাং জিহাদ ও আল্লাহর উপর ঈমান এ দুটি অবশ্যই হাজীদেরকে পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের আবাদ বা সেবা করা থেকে বহুগুণ উত্তম। কেননা, ঈমান হচ্ছে দ্বীনের মূল, এর উপরই আমল কবুল হওয়া নির্ভর করে এবং চারিত্রিক মাধুর্যতা প্রকাশ পায়। আর আল্লাহর পথে জিহাদ হচ্ছে দ্বীনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, যার মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামী সংরক্ষিত হয়, প্রসারিত হয়, সত্য জয়যুক্ত হয় এবং মিথ্যা অপসৃত হয়। পক্ষান্তরে মসজিদুল হারামের সেবা করা এবং হাজিদেরকে পানি পান করানো যদিও সৎকাজ, কিন্তু এ সবই ঈমানের উপর নির্ভরশীল। ঈমান ও জিহাদে দ্বীনের যে স্বার্থ আছে তা এতে নেই। [সা'দী]
(২) এ আয়াত এবং এর পরবর্তী তিনটি আয়াত একটি বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। তা হারামের আবাদ ও হাজীদের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আমরাই করে থাকি। এর উপর আর কারো কোন আমল শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হতে পারে না। নুমান ইবন বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ এক জুমআর দিন তিনি কতিপয় সাহাবার সাথে মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বারের পাশে বসা ছিলেন। উপস্থিত একজন বললেনঃ ইসলাম ও ঈমানের পর আমার দৃষ্টিতে হাজীদের পানি সরবরাহের মত মর্যাদাসম্পন্ন আর কোন আমল নেই এবং এর মোকাবেলায় আর কোন আমলের ধার আমি ধারি না। তার উক্তি খণ্ডন করে অপরজন বললেনঃ মসজিদুল হারাম আবাদ করার মত উত্তম আমল আর নেই এবং এর মোকাবেলায় আর কোন আমলের ধার আমি ধারি না।
অপর আরেকজন বললেনঃ আল্লাহর রাহে জিহাদ করার মত উত্তম আমল আর নেই এবং এর মোকাবেলায় আর কোন আমলের ধার আমি ধারি না। এভাবে তাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে ধমক দিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বারের কাছে শোরগোল বন্ধ কর! জুম'আর সালাতের পর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিষয়টি পেশ কর। কথামত প্রশ্নটি তার কাছে রাখা হল। এর প্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়। [সহীহ মুসলিমঃ ১৮৭৯] এতে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি সরবরাহের উপর জিহাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
সে যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে মুশরিকদের কা'বা নিয়ে গর্বের অন্ত ছিল না। আল্লাহ তা'আলা সূরা আল-মুমেনুনের ৬৬, ৬৭ নং আয়াতেও তা উল্লেখ করেছেন। আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল মুলতঃ মুশরিকদের অহংকার নিবারণ উদ্দেশ্যে। অতঃপর মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে যে সকল ঘটনা ঘটে, তার সম্পর্কে প্রমাণ উপস্থাপিত করা হয় এ সকল আয়াত থেকে। যার ফলে শ্রোতারা ধরে নিয়েছে যে, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াতগুলো নাযিল হয়। উপরোক্ত আয়াতে যে সত্যটি তুলে ধরা হয় তা হল, শির্ক মিশ্ৰিত আমল তা যত বড় আমলই হোক কবুল যোগ্য নয় এবং এর কোন মূল্যমানও নেই। সে কারণে কোন মুশরিক মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি সরবরাহ দ্বারা মুসলিমদের মোকাবেলায় ফযীলত ও মর্যাদা লাভ করতে পারবে না। অন্যদিকে ইসলাম গ্রহণের পর ঈমান ও জিহাদের মর্যাদা মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পানি পান করানোর জায়গায় আসলেন এবং পানি চাইলেন, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে ফযল! তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে পানি নিয়ে আস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাকে পানি পান করাও। আব্বাস বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা পাত্রের পানিতে হাত ঢুকিয়ে ফেলে। তিনি বললেন, আমাকে পানি দাও। অতঃপর তিনি তা থেকে পান করলেন। তারপর তিনি যমযমের কাছে আসলেন, দেখলেন তারা সেখানে কাজ করছে। তখন তিনি বললেন, তোমরা কাজ করে যাও, তোমরা ভালো কাজ করছ। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যদি তোমাদের কাজের উপর ব্যাঘাত আসার সম্ভাবনা না থাকত তাহলে আমিও নীচে নামতাম এবং এর উপর অর্থাৎ ঘাড়ের উপরে করে পানি নিয়ে আসতাম। [বুখারী: ১৬৩৫]
মোটকথাঃ নেক আমলগুলোর মর্যাদার তারতম্য রয়েছে। সেমতে আমলকারীর মর্যাদায়ও তারতম্য হবে। অর্থাৎ সকল আমলকারীকে একই মর্যাদায় অভিষিক্ত করা যাবে না। আর একটি কথা হল, আমলের আধিক্যের উপর ফযীলত নির্ভরশীল নয়; বরং আমলের সৌন্দর্যের উপর তা নির্ভরশীল। সূরা আল-মুলকের দ্বিতীয় আয়াতে আছেঃ (لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا) অর্থাৎ “যাতে আল্লাহ পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের কার আমল কত সৌন্দর্যমণ্ডিত।”
(৩) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না। এখানে যুলুমের সর্বশেষ পর্যায় অর্থাৎ কুফর ও শির্ক বোঝানোই উদ্দেশ্য। সুতরাং যারা কুফরী করবে তারা কখনো ভাল কাজ দ্বারা উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাবে না। তারা ভাল কাজ করার তাওফীকও পাবে না। [মুয়াসসার] বস্তুত: ঈমান হল আমলের প্রাণ। ঈমানবিহীন আমল প্রাণশূন্য দেহের মত যা গ্রহণের অযোগ্য। আখেরাতের মুক্তির ক্ষেত্রে এর কোন দাম নেই। গোনাহ ও পাপাচারের ফলে মানুষের বিবেক ও বিচারশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে সে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। এর বিপরীতে অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর, তবে তিনি ভাল-মন্দ পার্থক্যের শক্তি দান করবেন।” [সূরা আল-আনফাল: ২৯ অর্থাৎ ইবাদাত-বন্দেগী ও তাকওয়া-পরহেযগারীর ফলে বিবেক প্রখর হয়, সুষ্ঠ বিচার বিবেচনার শক্তি আসে। তাই সে ভাল-মন্দের পার্থক্যে ভুল করে না। পক্ষান্তরে যারা যালিম, যারা নিজেদের নাফসের উপর যুলুম করেছে, তারা ভাল-মন্দের পার্থক্যে ভুল করে, ফলে তাদের হিদায়াত নসীব হয় না।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৯) যারা হাজীদের পানি সরবরাহ করে এবং মাসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তোমরা কি তাদেরকে তাদের সমজ্ঞান কর, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে? আল্লাহর নিকট তারা সমতুল্য নয়।[1] আল্লাহ অনাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। [2]
[1] মুশরিকরা হাজীদেরকে পানি পান করানো ও মাসজিদুল হারামের দেখাশোনা করার যে কাজ করত, তার দরুন তাদের বড় গর্ব ছিল। কিন্তু সে তুলনায় তারা ঈমান ও জিহাদের কোন গুরুত্ব দিত না। অথচ এর গুরুত্ব মুসলিমদের কাছে ছিল। আল্লাহ তাআলা বললেন, তোমরা কি হাজীগণকে পানি পান করানো মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার সমতুল্য মনে কর? জেনে রাখ! আল্লাহর নিকট উভয় সমতুল্য নয়; বরং মুশরিকদের কোন কর্মই গ্রহণযোগ্য নয়; যদিও তা আপাতদৃষ্টিতে ভাল মনে হয়। যেমন পূর্বোক্ত আয়াতের (حَبِطَت أعمَالُهُم) (তাদের সকল কর্ম ব্যর্থ) শব্দাবলীতে সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোন কোন বর্ণনায় এ আয়াত অবতীর্ণের কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, একদা মসজিদে নববীর নিকট কিছু মুসলমান একত্রিত ছিল। তার মধ্যে একজন বলল, ইসলাম গ্রহণ করার পর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমল আমার নিকটে হাজীগণকে পানি পান করানো। দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, মাসজিদুল হারামকে আবাদ করা। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, বরং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হল সব আমলের মধ্যে উত্তম আমল। উমর (রাঃ) যখন তাদেরকে আপোসে ঐরূপ কথাবার্তা বলতে শুনলেন তখন তাদেরকে ধমক দিয়ে বললেন, তোমরা রসূল (সাঃ)-এর মিম্বরের নিকট নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না। সেদিন ছিল জুমআর দিন। হাদীসের বর্ণনাকারী নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন যে, আমি জুমআর পর নবী (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে আমাদের আপোসের সেই কথোপকথন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল। (মুসলিমঃ ইমারাহ অধ্যায়) যাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ সব থেকে বেশী উত্তম আমল। কথা প্রসঙ্গে আসলে এখানে জিহাদের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া কোন আমল গ্রহণযোগ্য নয়, এই জন্য প্রথমে তা বর্ণনা করা হয়েছে। মোটকথা প্রথমতঃ জানা গেল যে, জিহাদ থেকে বড় আমল আর কিছু নেই। দ্বিতীয়তঃ জানা গেল যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ মুশরিকদের অমূলক ধারণা ছাড়াও মুসলিমদের নিজ নিজ অনুমান অনুযায়ী কিছু আমলকে অন্য কিছু আমলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়াও ছিল। অথচ এ কাজ শরীয়তদাতারই ছিল; কোন মুমিনের নয়। মু’মিনদের কাজ হল, প্রত্যেক সেই কথার উপর আমল করা, যা আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
[2] অর্থাৎ, এই লোকেরা যা ইচ্ছা তাই দাবী করুক। আসলে তারা অনাচারী যালেম; অর্থাৎ, মুশরিক। কেননা, শিরক হল সব চাইতে বড় যুলুম ও অনাচার। এই যুলুমের কারণে তারা আল্লাহর হিদায়াত থেকে বঞ্চিত। এই জন্য তাদের সাথে হিদায়াতপ্রাপ্ত মুসলিমদের কোন তুলনাই নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২০. যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজেদের সম্পদ ও নিজেদের জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদায় শ্ৰেষ্ঠ। আর তারাই সফলকাম।(১)
(১) এ আয়াতে পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখিত ‘সমান নয়’ এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] বলা হয়েছেঃ “যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে মাল ও জান দিয়ে যুদ্ধ করেছে, আল্লাহর কাছে রয়েছে তাদের বড় মর্যাদা এবং তারাই সফলকাম।” পক্ষান্তরে তাদের প্রতিপক্ষ মুশরিকদের কোন সফলতা আল্লাহ দান করেন না। তবে সাধারণ মুসলিমগণ এ সফলতার অংশীদার, কিন্তু দেশত্যাগী মুজাহিদগণের সফলতা সবার উর্ধ্বে। তাই পূর্ণ সফলতার অধিকারী হল তারা। সে হিসেবে অর্থ দাঁড়ায়, “যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে তারা তাদের থেকে উত্তম যারা ঈমান আনলেও হিজরত করেনি। কারণ, তারা হিজরত না করার কারণে অনেক জিহাদেই অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। এ আয়াতে হিজরত বলে মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করা বোঝানো হয়েছে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(২০) যারা ঈমান এনেছে, (দ্বীনের জন্য স্বদেশত্যাগ) হিজরত করেছে এবং নিজেদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় বড়। আর তারাই হল সফলকাম।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান