بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ৪২/ আশ-শূরা | Ash-Shura | سورة الشورى আয়াতঃ ৫৩ মাক্কী
৪২ : ১১ فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ جَعَلَ لَكُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِكُمۡ اَزۡوَاجًا وَّ مِنَ الۡاَنۡعَامِ اَزۡوَاجًا ۚ یَذۡرَؤُكُمۡ فِیۡهِ ؕ لَیۡسَ كَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱۱﴾
فاطر السموت و الارض جعل لكم من انفسكم ازواجا و من الانعام ازواجا یذرؤكم فیه لیس كمثلهٖ شیء و هو السمیع البصیر ﴿۱۱﴾
• তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা; তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে জোড়া বানিয়েছেন এবং চতুষ্পদ জন্তু থেকেও জোড়া বানিয়েছেন, (এভাবেই) তিনি তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মত কিছু নেই আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।

-আল-বায়ান

• আকাশসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে যুগল সৃষ্টি করেছেন, চতুস্পদ জন্তুদের মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া, এভাবেই তিনি তোমাদের বংশধারা বিস্তৃত করেন, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সব শোনেন, সব দেখেন।

-তাইসিরুল

• তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং আন‘আমের জোড়া; এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন; কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

-মুজিবুর রহমান

• [He is] Creator of the heavens and the earth. He has made for you from yourselves, mates, and among the cattle, mates; He multiplies you thereby. There is nothing like unto Him, and He is the Hearing, the Seeing.

-Sahih International

১১. তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং গৃহপালিত জন্তুর মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন জোড়া। এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন; কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১১) তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন[1] এবং পশুদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন পশুদের জোড়া;[2] এভাবে তিনি ওতে তোমাদের বংশ বিস্তার করেন।[3] কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়।[4] তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ।

[1] অর্থাৎ, এটা তাঁর অনুগ্রহ যে, তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জোড়া বানিয়ে দিয়েছেন। কারণ, তোমাদের স্ত্রীদেরকে যদি মানুষের মধ্য থেকে না বানিয়ে অন্য কোন সৃষ্টি থেকে বানানো হত, তবে তোমরা এই প্রশান্তি লাভ করতে পারতে না, যা নিজেদের মধ্য থেকে এবং নিজেদের মতনই হওয়ার কারণে পারছ।

[2] অর্থাৎ, এই জোড়া (নর-নারী) বানানোর ধারা চতুষ্পদ জীব-জন্তুর মধ্যেও রেখেছি। আর চতুষ্পদ জন্তু বলতে সেই আট প্রকার নর ও মাদী জন্তু; যার উল্লেখ সূরা আনআমে করা হয়েছে।

[3] يَذْرَؤُكُمْ এর অর্থ, বিস্তার করা অথবা সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, তিনি অধিকহারে তোমাদেরকে বিস্তার করছেন। অথবা বংশ পরম্পরায় সৃষ্টি করছেন। মানববংশ এবং চতুষ্পদ জীব-জন্তুর বংশকেও। فِيْهِ অর্থাৎ, فِي ذَلِكَ الْخَلْقِ عَلىَ هَذِه الصِّفَةِ সৃষ্টি করার এই পদ্ধতিতে তোমাদেরকে তিনি প্রথম থেকেই সৃষ্টি করে আসছেন। অথবা فِيْهِ এর অর্থ, গর্ভাশয়ে কিংবা পেটে। বা فِيْهِ এখানে بِهِ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, তোমাদেরকে জোড়া জোড়া বানানোর মাধ্যমেই তোমাদেরকে সৃষ্টি করছেন অথবা বিস্তার করছেন। কারণ, এই জোড়াই হল বংশ বৃদ্ধির একমাত্র উপায়। (ফাতহুল ক্বাদীর ও ইবনে কাসীর)

[4] না তাঁর সত্তায় এবং না তাঁর গুণাবলীতে। তাঁর সদৃশ তিনিই। তিনি অতুল, অনুপম, একক ও অমুখাপেক্ষী।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১২ لَهٗ مَقَالِیۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّهٗ بِكُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۱۲﴾
لهٗ مقالید السموت و الارض یبسط الرزق لمن یشآء و یقدر انهٗ بكل شیء علیم ﴿۱۲﴾
• আসমানসমূহ ও যমীনের চাবি তাঁর কাছে; যার জন্য ইচ্ছা তিনি রিয্ক প্রশস্ত করেন এবং নিয়ন্ত্রিত করেন; নিশ্চয় তিনি সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞাত।

-আল-বায়ান

• আসমান ও যমীনের চাবিকাঠি তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। যার জন্য ইচ্ছে তিনি রিযক প্রশস্ত করেন ও (যার জন্য ইচ্ছে) সীমিত করেন। সব বিষয়েই তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী।

-তাইসিরুল

• আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই নিকট। তিনি যার প্রতি ইচ্ছা তার রিয্ক বর্ধিত করেন অথবা সংকুচিত করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

-মুজিবুর রহমান

• To Him belong the keys of the heavens and the earth. He extends provision for whom He wills and restricts [it]. Indeed He is, of all things, Knowing.

-Sahih International

১২. তাঁরই কাছে আসমানসমূহ ও যমীনের চাবিকাঠি। তিনি যার জন্যে ইচ্ছে তাঁর রিযিক বাড়িয়ে দেন এবং সংকুচিত করেন। নিশ্চয় তিনি সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১২) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই নিকট।[1] তিনি যার প্রতি ইচ্ছা তার রুযী বর্ধিত করেন এবং সংকুচিত করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

[1] مَقَالِيْدٌ হল, مِقْلِيْدٌ এবং مِقْلاَد এর বহুবচন। এর অর্থঃ ধন-ভান্ডারসমূহ অথবা চাবিসমূহ।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৩ شَرَعَ لَكُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا وَصّٰی بِهٖ نُوۡحًا وَّ الَّذِیۡۤ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡكَ وَ مَا وَصَّیۡنَا بِهٖۤ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ مُوۡسٰی وَ عِیۡسٰۤی اَنۡ اَقِیۡمُوا الدِّیۡنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوۡا فِیۡهِ ؕ كَبُرَ عَلَی الۡمُشۡرِكِیۡنَ مَا تَدۡعُوۡهُمۡ اِلَیۡهِ ؕ اَللّٰهُ یَجۡتَبِیۡۤ اِلَیۡهِ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَهۡدِیۡۤ اِلَیۡهِ مَنۡ یُّنِیۡبُ ﴿۱۳﴾
شرع لكم من الدین ما وصی بهٖ نوحا و الذی اوحینا الیك و ما وصینا بهٖ ابرهیم و موسی و عیسی ان اقیموا الدین و لا تتفرقوا فیه كبر علی المشركین ما تدعوهم الیه الله یجتبی الیه من یشآء و یهدی الیه من ینیب ﴿۱۳﴾
• তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।

-আল-বায়ান

• তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই বিধি-ব্যবস্থাই দিয়েছেন যার হুকুম তিনি দিয়েছিলেন নূহকে। আর সেই (বিধি ব্যবস্থাই) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে দিলাম যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ‘ঈসাকে- তা এই যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর, আর তাতে বিভক্তি সৃষ্টি করো না, ব্যাপারটি মুশরিকদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যার দিকে তুমি তাদেরকে আহবান জানাচ্ছ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তাঁর পথে বেছে নেন, আর তিনি তাঁর পথে পরিচালিত করেন তাকে, যে তাঁর অভিমুখী হয়।

-তাইসিরুল

• তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে। আর যা আমি অহী করেছিলাম তোমাদের এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে মতভেদ করনা। তুমি মুশরিকদেরকে যার প্রতি আহবান করছ তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তার অভিমুখী হয় তাকে দীনের দিকে পরিচালিত করেন।

-মুজিবুর রহমান

• He has ordained for you of religion what He enjoined upon Noah and that which We have revealed to you, [O Muhammad], and what We enjoined upon Abraham and Moses and Jesus - to establish the religion and not be divided therein. Difficult for those who associate others with Allah is that to which you invite them. Allah chooses for Himself whom He wills and guides to Himself whoever turns back [to Him].

-Sahih International

১৩. তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা আমরা ওহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মুসা ও ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি কর না।(১) আপনি মুশরিকদেরকে যার প্রতি ডাকছেন তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি দ্বীনের দিকে হেদায়াত করেন।

(১) দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ এ আয়াতে সর্বশেষ যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে ‘দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করো না’ কিংবা তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে না। পূর্ববর্তী উম্মতদের কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে এ ধরনের কাজ থেকে সাবধান করে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে একটি সরল রেখা টানলেন। অত:পর এর ডানে ও বায়ে আরও কয়েকটি রেখা টেনে বললেন, ডান-বামের এসব রেখা শয়তানের আবিস্কৃত পথ। এর প্রত্যেকটিতে একটি করে শয়তান নিয়োজিত রয়েছে। সে মানুষকে সে পথেই চলার উপদেশ দেয়। অত:পর তিনি মধ্যবর্তী সকল রেখার দিকে ইশারা করে বললেনঃ (وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ) “আর এটা আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর।” [মুসনাদে আহমাদ: ১/৪৩৫]

এ দৃষ্টান্তে সরল পথ বলে নবী-রাসূলগণের অভিন্ন দ্বীনের পথই বোঝানো হয়েছে। এতে শাখা-প্ৰশাখা বের করা ও বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম ও শয়তানের কাজ। এ সম্পর্কে হাদীসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামাত (সামষ্টিকভাবে সকল উম্মত) থেকে অর্ধ হাত পরিমাণও দূরে সরে পড়ে, সে-ই ইসলামের বন্ধনই তার কাধ থেকে সরিয়ে দিল’। [আবু দাউদ: ৪৭৬০] তিনি আরও বলেন, “জামাত (তথা মুসলিম উম্মতের) উপর আল্লাহর হাত রয়েছে। [নাসায়ী: ৪০২০]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “শয়তান মানুষের জন্য ব্যাঘ্রস্বরূপ। বাঘ ছাগলের পেছনে লাগে। অত:পর যে ছাগল পালের পেছনে অথবা এদিক ওদিক বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে সেটির উপরই পতিত হয়। তাই তোমাদের উচিত দলের সঙ্গে থাকা-পৃথক না থাকা। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৩২] মনে রাখতে হবে যে, মুসলিমরা সবাই এক উম্মত; তাদের থেকে কেউ আলাদা কোন দল করে পৃথক হলে সে উম্মতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটালো। এটাই শরীআতে নিন্দনীয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৩) তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন ধর্ম; যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে[1] এই বলে যে, তোমরা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত কর[2] এবং ওতে মতভেদ করো না।[3] তুমি অংশীবাদীদের যার প্রতি আহবান করছ, তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়।[4] আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেন[5] এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে ধর্মের দিকে পরিচালিত করেন।[6]

[1] شَرَعَ অর্থ, বর্ণনা করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং নির্দিষ্ট করেছেন। لَكُمْ (তোমাদের জন্য) এ সম্বোধন করা হয়েছে উম্মতে মুহাম্মাদীকে। অর্থাৎ, তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই নির্ধারিত করেছেন যার অসিয়ত পূর্বের নবীদেরকে করে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু মর্যাদাসম্পন্ন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন।

[2] الدِّيْنِ বলতে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, রসূলের আনুগত্য করা এবং তাওহীদ (একত্ব) ও শরীয়তকে মেনে নেওয়া। এটাই ছিল প্রত্যেক নবীর দ্বীন। এরই প্রতি তাঁরা স্ব-স্ব জাতিকে আহবান করেছেন। যদিও প্রত্যেক নবীর শরীয়ত ও নিয়ম-পদ্ধতির মধ্যে আংশিক পার্থক্য ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, {لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا} অর্থাৎ, তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরীয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সূরা মাইদাহ ৪৮ আয়াত) কিন্তু উল্লিখিত মৌলিক বিষয়ে সবাই শরীক ছিলেন। এই কথাটাকেই নবী (সাঃ) তাঁর এই ভাষায় ব্যক্ত করেছেন, ‘‘আমরা নবীরা হলাম বৈমাত্রেয় ভাইস্বরূপ। আমাদের সকলের দ্বীন একটাই।’’ (সহীহ বুখারী ইত্যাদি) আর সেই একটি দ্বীন হল তাওহীদ (একত্ব) ও রসূলের আনুগত্যের নাম। অর্থাৎ, এদের (ঐক্যের) সম্পর্ক এমন আংশিক মাসলা-মাসায়েলের সাথে নয়, যে ব্যাপারসমূহে দলীলাদির পরস্পর বিরোধ থাকে। অথবা যে ব্যাপারগুলোতে বুঝার মধ্যে কখনো তারতম্য ও তফাৎ থাকে। কেননা, এগুলোর ব্যাপারে নিজ নিজ ইজতিহাদী দ্বিমত অথবা মতবিরোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। এই কারণে এই শ্রেণীর গৌণ বিষয়াবলী ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং হতে পারে। কিন্তু তাওহীদ ও আনুগত্য (দ্বীনের) কোন আংশিক বিষয় না, বরং তা হল (দ্বীনের) মৌলিক বিষয় যার উপর কুফরী ও ঈমানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

[3] কেবল এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর আনুগত্য (অথবা তাঁর রসূলের আনুগত্য যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য) করাই হল ঐক্যের ও ভ্রাতৃত্বের মূল। আর তাঁর ইবাদত ও আনুগত্য থেকে বিমুখতা অথবা এতে অন্যকে শরীক করা হল বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের শিকড়। যাকে মহান আল্লাহ ‘মতভেদ করো না’ বলে নিষেধ করেছেন।

[4] আর তা হল সেই তাওহীদ এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য।

[5] অর্থাৎ, যাকে হিদায়াত পাওয়ার যোগ্য মনে করেন, তাকে হিদায়াতের জন্য নির্বাচন করে নেন।

[6] অর্থাৎ, আল্লাহর দ্বীন অবলম্বন করার এবং তাঁরই জন্য ইবাদতকে বিশুদ্ধ করার তাওফীক তাকেই দান করেন, যে তাঁর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি প্রত্যাবর্তিত হয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৪ وَ مَا تَفَرَّقُوۡۤا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَهُمۡ ؕ وَ لَوۡ لَا كَلِمَۃٌ سَبَقَتۡ مِنۡ رَّبِّكَ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی لَّقُضِیَ بَیۡنَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡرِثُوا الۡكِتٰبَ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ لَفِیۡ شَكٍّ مِّنۡهُ مُرِیۡبٍ ﴿۱۴﴾
و ما تفرقوا الا من بعد ما جآءهم العلم بغیا بینهم و لو لا كلمۃ سبقت من ربك الی اجل مسمی لقضی بینهم و ان الذین اورثوا الكتب من بعدهم لفی شك منه مریب ﴿۱۴﴾
• আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরও তারা কেবল নিজদের মধ্যকার বিদ্বেষের কারণে মতভেদ করেছে; একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পরে যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছিল, তারা সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।

-আল-বায়ান

• মানুষের কাছে ইলম আসার পর (বিভিন্ন অংশে) বিভক্ত হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে বাড়াবাড়ি করার কারণে। পূর্বেই যদি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফয়সালা মূলতবী রাখার কথা ঘোষিত না হত, তাহলে তাদের মধ্যে (পূর্বেই) ফয়সালা করে দেয়া হত। আগেকার লোকেদের পরে যারা (তাওরাত ও ইঞ্জিল এ দু’) কিতাব উত্তরাধিকার সূত্রে পাপ্ত হয়েছে, তারা অস্বস্তিকর সন্দেহে পতিত হয়েছে।

-তাইসিরুল

• তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পরিক বিদ্বেষ বশতঃ তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয়ে ফাইসালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে তারা কুরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।

-মুজিবুর রহমান

• And they did not become divided until after knowledge had come to them - out of jealous animosity between themselves. And if not for a word that preceded from your Lord [postponing the penalty] until a specified time, it would have been concluded between them. And indeed, those who were granted inheritance of the Scripture after them are, concerning it, in disquieting doubt.

-Sahih International

১৪. আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পারিক বিদ্বেষবশত(১) তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। আর এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে আপনার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয় ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পর নিশ্চয় তারা সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।

(১) এই মতভেদ সৃষ্টির চালিকা শক্তি ছিল নিজের নাম ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা, পারস্পরিক জিদ ও একগুয়েমি, একে অপরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা এবং সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন প্রচেষ্টার ফল। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৪) ওদের নিকট জ্ঞান আসার পরই পারস্পরিক বিদ্বেষবশতঃ ওরা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়।[1] এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অব্যাহতি সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে ওদের বিষয়ে ফায়সালা হয়েই যেত।[2] ওদের পর যারা গ্রন্থের উত্তরাধিকারী হয়েছে, নিশ্চয় তারা এ (কুরআন) সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। [3]

[1] অর্থাৎ, জ্ঞান অর্থাৎ হিদায়াত আসার এবং হুজ্জত কায়েম হওয়ার পর তারা মতবিরোধ ও অনৈক্যের পথ অবলম্বন করেছে। অথচ তখন মতবিরোধ করার কোনই বৈধতা অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু কেবল বিদ্বেষ, শত্রুতা এবং জিদ ও হিংসাবশতঃ তারা এ কাজ করেছে। এ থেকে কেউ কেউ ইয়াহুদী এবং কেউ কেউ মক্কার কুরাইশদেরকে বুঝিয়েছেন।

[2] অর্থাৎ, তাদের শাস্তি দানের ব্যাপারে বিলম্ব করার ফায়সালা যদি পূর্বে থেকেই হয়ে না থাকত, তবে সত্বর আযাব প্রেরণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হত।

[3] এ থেকে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে তাদের পূর্বেকার ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পর তাওরাত ও ইঞ্জীলের উত্তরাধিকারী বানানো হয়। অথবা আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে; যাদের মাঝে আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেন এবং তাদেরকে কুরআনের উত্তরাধিকারী বানান। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে, الكتاب (গ্রন্থ) বলতে, তাওরাত ও ইঞ্জীল এবং দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে তা হবে, কুরআন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৫ فَلِذٰلِكَ فَادۡعُ ۚ وَ اسۡتَقِمۡ كَمَاۤ اُمِرۡتَ ۚ وَ لَا تَتَّبِعۡ اَهۡوَآءَهُمۡ ۚ وَ قُلۡ اٰمَنۡتُ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ مِنۡ كِتٰبٍ ۚ وَ اُمِرۡتُ لِاَعۡدِلَ بَیۡنَكُمۡ ؕ اَللّٰهُ رَبُّنَا وَ رَبُّكُمۡ ؕ لَنَاۤ اَعۡمَالُنَا وَ لَكُمۡ اَعۡمَالُكُمۡ ؕ لَا حُجَّۃَ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَكُمۡ ؕ اَللّٰهُ یَجۡمَعُ بَیۡنَنَا ۚ وَ اِلَیۡهِ الۡمَصِیۡرُ ﴿ؕ۱۵﴾
فلذلك فادع و استقم كما امرت و لا تتبع اهوآءهم و قل امنت بما انزل الله من كتب و امرت لاعدل بینكم الله ربنا و ربكم لنا اعمالنا و لكم اعمالكم لا حجۃ بیننا و بینكم الله یجمع بیننا و الیه المصیر ﴿۱۵﴾
• এ কারণে তুমি আহবান কর এবং দৃঢ় থাক যেমন তুমি আদিষ্ট হয়েছ। আর তুমি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না এবং বল, ‘আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে ঈমান এনেছি এবং তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আমি আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের রব এবং তোমাদের রব। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই; আল্লাহ আমাদেরকে একত্র করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে’।

-আল-বায়ান

• অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে (হে নবী!) তাদেরকে আহবান কর (দ্বীনের প্রতি), আর তোমাকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তুমি তার প্রতি সুদৃঢ় থাক, আর তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না। আর বল, আল্লাহ যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। তোমাদের মাঝে ইনসাফ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরও প্রতিপালক, তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কাজের প্রতিফল আমরা ভোগ করব। আর তোমাদের কাজের প্রতিফল তোমরা ভোগ করবে। আমাদের আর তোমাদের মাঝে কোন ঝগড়া নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে (একদিন) একত্রিত করবেন, আর তাঁর কাছেই (সকলকে) ফিরে যেতে হবে।

-তাইসিরুল

• সুতরাং তুমি ওর দিকে আহবান কর এবং ওতেই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাক যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ এবং তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করনা। বলঃ আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে। আল্লাহই আমাদের রাব্ব এবং তোমাদেরও রাব্ব। আমাদের কাজ আমাদের এবং তোমাদের কাজ তোমাদের। আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে বিবাদ নেই। আল্লাহই আমাদেরকে একত্রিত করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই নিকট।

-মুজিবুর রহমান

• So to that [religion of Allah] invite, [O Muhammad], and remain on a right course as you are commanded and do not follow their inclinations but say, "I have believed in what Allah has revealed of the Qur'an, and I have been commanded to do justice among you. Allah is our Lord and your Lord. For us are our deeds, and for you your deeds. There is no [need for] argument between us and you. Allah will bring us together, and to Him is the [final] destination."

-Sahih International

১৫. সুতরাং আপনি আহবান করুন(১) এবং দৃঢ় থাকুন, যেভাবে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন। আর আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না; এবং বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে ঈমান এনেছি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করতে। আল্লাহ্ আমাদের রব এবং তোমাদেরও রব। আমাদের আমল আমাদের এবং তোমাদের আমল তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে একত্র করবেন এবং ফিরে যাওয়া তারই কাছে।(২)

(১) তাওহীদের দিকে, অথবা এ সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনের দিকে। যার নির্দেশ তিনি সমস্ত নবীরাসূলদের দিয়েছেন এবং তার ওসিয়ত করেছেন। [জালালাইন; মুয়াস্‌সার]

(২) হাফেয ইবনে কাসীর বলেন, দশটি বাক্য সম্বলিত এই আয়াতের প্রত্যেকটি বাক্যে বিশেষ বিশেষ বিধান বর্ণিত হয়েছে। সমগ্র কুরআনে আয়াতুল কুরসীই এর একমাত্র দৃষ্টান্ত। তাতেও দশটি বিধান বিধৃত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতের প্রথম বিধান হচ্ছে (فَلِذَٰلِكَ فَادْعُ) অর্থাৎ যদিও মুশরেকদের কাছে আপনার তাওহীদের দাওয়াত কঠিন মনে হয়, তথাপি আপনি এ দাওয়াত ত্যাগ করবেন না এবং উপর্যুপরি দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখুন।

দ্বিতীয় বিধান- (وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ) অর্থাৎ আপনি এ দ্বীনে নিজে অবিচল থাকুন, যেমন আপনাকে আদেশ করা হয়েছে। যাবতীয় বিশ্বাস, কর্ম, চরিত্র, অভ্যাস ও সামাজিকতার যথাযথ সমতা ও ভারসাম্য কায়েম রাখুন। কোন দিকেই যেন কোনরূপ বাড়াবাড়ি না হয়। কাফেদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই দ্বীনের মধ্যে কোন রদবদল ও হ্রাস-বৃদ্ধি করবেন না। ‘কিছু নাও এবং কিছু দাও’ নীতির ভিত্তিতে এই পথভ্রষ্ট লোকদের সাথে কোন আপোষ করবেন না। বলাবাহুল্য, এরূপ দৃঢ়তা সহজসাধ্য নয়। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহাবায়ে কেরামদের কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ شَيَّبَتْنِيْ هُوْد অর্থাৎ সুরা হুদ আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে। সূরা হূদের ১১২ নং আয়াতে এ আদেশ এ ভাষায়ই ব্যক্ত হয়েছে। সেখানেও দ্বীনের উপর অবিচল থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তৃতীয় বিধান- (وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ) অর্থাৎ প্রচারের দায়িত্ব পালনে আপনি কারও বিরোধিতার পরওয়া করবেন না। শুধু কোন না কোন ভাবে ইসলামের গণ্ডির মধ্যে এসে যাক, এ লোভের বশবর্তী হয়ে এদের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি এবং জাহেলী আচার-আচরণের জন্য দ্বীনের মধ্যে কোন অবকাশ সৃষ্টি করবেন না। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে যেভাবে নাযিল করেছেন কেউ মানতে চাইলে সেই খাঁটি ও মূল দ্বীনকে যেন সরাসরি মেনে নেয়। অন্যথায় যে জাহান্নামে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায় পড়ুক। মানুষের ইচ্ছানুসারে আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তন সাধন করা যায় না। মানুষ যদি নিজের কল্যাণ চায় তাহলে যেন নিজকেই পরিবর্তন করে দ্বীন অনুসারে গড়ে নেয়।

চতুর্থ বিধান- (وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ) অর্থাৎ আপনি ঘোষনা করুন: আল্লাহ তা'আলা যত কিতাব নাযিল করেছেন, সবগুলোর প্রতি আমি ঈমান এনেছি। অন্য কথায় আমি সেই বিভেদ সৃষ্টিকারী লোকদের মত নই। যারা আল্লাহর প্রেরিত কোন কোন কিতাব মানে আবার কোন কোনটি মানে না। আমি আল্লাহর প্রেরিত প্রতিটি কিতাবই মানি।

পঞ্চম বিধান- (وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ) এই ব্যাপকাৰ্থক আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হয়ঃ একটি অর্থ হচ্ছে, আমি এসব দলাদলি থেকে দূরে থেকে নিরপেক্ষ ন্যায় নিষ্ঠা অবলম্বনের জন্য আদিষ্ট। কোন দলের স্বার্থে এবং কোন দলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করা আমার কাজ নয়। সব মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক। আর সে সম্পর্ক হচ্ছে ন্যায় বিচার ও ইনসাফের সম্পর্ক। যার যে বিষয়টি ন্যায় ও সত্য সে যত দূরেরই হোক না কেন আমি তার সহযোগী। আর যার যে বিষয়টি ন্যায় ও সত্যের পরিপন্থী সে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও আমি তার বিরোধী। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাদের সামনে যে সত্য পেশ করার জন্য আদিষ্ট তাতে কারো জন্য কোন বৈষম্য নেই, বরং তা সবার জন্য সমান। তাতে নিজের ও পরের, বড়র ও ছোটর, গরীবের ও ধনীর, উচ্চের ও নীচের ভিন্ন ভিন্ন সত্য নেই। যা সত্য তা সবার জন্য সত্য। যা গোনাহ তা সবার জন্য গোনাহ। যা হারাম তা সবার জন্য হারাম এবং যা অপরাধ তা সবার জন্য অপরাধ। এই নির্ভেজাল বিধানে আমার নিজের জন্যও কোন ব্যতিক্রম নেই।

তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদিষ্ট। মানুষের মধ্যে ইনসাফ কয়েম করা এবং তোমাদের জীবনে ও তোমাদের সমাজে যে ভারসাম্যহীনতা ও বে-ইনসাফী রয়েছে তার ধ্বংস সাধনের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। পারস্পারিক বিবাদ-বিসংবাদের কোন মোকাদ্দমা আমার কাছে আসলে তাতে ন্যায় বিচার করার নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে। চতুর্থ অর্থ এই যে, এখানে عدل এর অর্থ সাম্য। সুতরাং আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, দ্বীনের যাবতীয় বিধি-বিধান তোমাদের মধ্যে সমান সমান রাখি, প্রত্যেক নবী ও প্রত্যেক কিতাবে বিশ্বাস স্থাপন করি এবং সব বিধান পালন করি।-এরূপ নয় যে, কোন বিধান মানবো আর কোনটি অমান্য করব। অথবা কোনটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব ও কোনটির প্রতি করব না।

ষষ্ট বিধান- (اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ) আল্লাহকেই একমাত্র রব হিসেবে মানব। তিনি আমাদের ও তোমাদের রব। একথা তোমরা স্বীকার করে থাক। কিন্তু এ কথার কারণে একমাত্র আল্লাহরই যে ইবাদাত করতে হবে, তোমরা এটা মানতে রাজী নও। কিন্তু আমি তা মানি। আর আমার অনুসারীরা সবাই এটা মেনে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করে।

সপ্তম বিধান- (لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ) অর্থাৎ আমাদের কর্ম আমাদের কাজে আসবে, তোমাদের তাতে কোন লাভ-লোকসান হবে না। আর তোমাদের কর্ম তোমাদের কাজে আসবে, আমার তাতে কোন লাভ ও ক্ষতি নাই। কেউ কেউ বলেন, মক্কায় যখন কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার আদেশ অবতীর্ণ হয়নি, তখন এ আয়াত নাযিল হয়েছিল। পরে জেহাদের আদেশ অবতীর্ণ হওয়ায় এই বিধান রহিত হয়ে যায়। কেননা, জেহাদের সারমর্ম এই যে, যারা উপদেশ ও অনুরোধে প্রভাবিত হয় না, যুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকে পরাভূত করতে হবে। তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিলে চলবে না। কেউ কেউ বলেন, আয়াতটি রহিত হয়নি এবং উদ্দেশ্য এই যে, দলীলের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর তোমাদের না মানা কেবল শক্রতা ও হঠকারিতা বশত:ই হতে পারে। শক্ৰতা সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর এখন প্রমাণাদির আলোচনা অর্থহীন। তোমাদের কর্ম তোমাদের সামনে এবং আমার কর্ম আমার সামনে থাকবে।

অষ্টম বিধান- (لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ) অর্থাৎ সত্য স্পষ্ট ও প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি তোমরা শক্রতাকেই কাজে লাগাও, তবে তর্ক-বিতর্কের কোন অর্থ নেই। কাজেই আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এমন কোন বিতর্ক নেই।

নবম বিধান- (اللَّهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا) অর্থাৎ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে একত্রিত করবেন। এবং প্রত্যেকের কর্মের প্রতিদান দেবেন।

দশম বিধান- (وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ) অর্থাৎ আমরা সকলেই তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করব। সুতরাং তোমরা চিন্তা করে দেখ কি করলে তখন তোমরা উপকৃত হবে। [দেখুন, ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৫) সুতরাং এ জন্য[1] তুমি আহবান কর এবং তোমাকে যেভাবে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকতে বলা হয়েছে, সেভাবে তুমি প্রতিষ্ঠিত থাক। আর ওদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।[2] বল, ‘আল্লাহ যে গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস করি এবং তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি।[3] আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের জন্য এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই।[4] আল্লাহই আমাদেরকে একত্রিত করবেন এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন।’

[1] অর্থাৎ, তাদের ঐ অনৈক্য ও সন্দেহের জন্য যার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তুমি তাদেরকে তাওহীদের প্রতি আহবান কর এবং এর উপর অটল থাক।

[2] অর্থাৎ, তারা তাদের খেয়াল-খুশী ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে যে জিনিসগুলো গড়ে নিয়েছে যেমন, মূর্তিপূজা ইত্যাদি, তাতে তুমি তাদের অনুসরণ করো না।

[3] অর্থাৎ, যখনই তোমরা নিজেদের কোন বিবাদ নিয়ে আমার কাছে আসবে, তখনই আমি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইনসাফের সাথে তার ফায়সালা করব।

[4] অর্থাৎ, কোন ঝগড়া নেই। কারণ, সত্য সুস্পষ্টরূপে বিকশিত হয়ে গেছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৬ وَ الَّذِیۡنَ یُحَآجُّوۡنَ فِی اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا اسۡتُجِیۡبَ لَهٗ حُجَّتُهُمۡ دَاحِضَۃٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ وَ عَلَیۡهِمۡ غَضَبٌ وَّ لَهُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ﴿۱۶﴾
و الذین یحآجون فی الله من بعد ما استجیب لهٗ حجتهم داحضۃ عند ربهم و علیهم غضب و لهم عذاب شدید ﴿۱۶﴾
• আর আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়ার পর আল্লাহ সম্পর্কে যারা বিতর্ক করে, তাদের দলীল-প্রমাণ তাদের রবের নিকট অসার। তাদের উপর (আল্লাহর) গযব এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

-আল-বায়ান

• আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়ার পর সে সম্পর্কে যারা বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের দলীল প্রমাণ তাদের রব্ব-এর কাছে বাতিল। তাদের প্রতি (আল্লাহর) গযব আর তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি।

-তাইসিরুল

• আল্লাহকে স্বীকার করার পর যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে তাদের যুক্তি-তর্ক তাদের রবের দৃষ্টিতে অসার এবং তারা তাঁর ক্রোধের পাত্র এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

-মুজিবুর রহমান

• And those who argue concerning Allah after He has been responded to - their argument is invalid with their Lord, and upon them is [His] wrath, and for them is a severe punishment.

-Sahih International

১৬. আর আল্লাহর আহ্বানে সাড়া আসার পর যারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের যুক্তি-তর্ক তাদের রবের দৃষ্টিতে অসার এবং তাদের উপর রয়েছে তাঁর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৬) আল্লাহকে মেনে নেওয়ার পর যারা তাঁর সম্পর্কে বিতর্ক করে[1] তাদের যুক্তিতর্ক তাদের প্রতিপালকের দৃষ্টিতে অসার।[2] ওরা তাঁর ক্রোধের পাত্র এবং ওদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।

[1] অর্থাৎ, এই মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা মেনে নিয়েছে। যাতে তাদেরকে পুনরায় সত্য পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়। অথবা এর লক্ষ্য হল, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা। যারা মুসলিমদের সাথে তর্ক করত এবং বলত, আমাদের ধর্ম তোমাদের ধর্মের চেয়েও উত্তম এবং আমাদের নবী হলেন তোমাদের নবীর পূর্বে, অতএব আমরা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

[2] دَاحِضَةٌ এর অর্থ, দুর্বল, বাতিল, অসার, ভিত্তিহীন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৭ اَللّٰهُ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ الۡكِتٰبَ بِالۡحَقِّ وَ الۡمِیۡزَانَ ؕ وَ مَا یُدۡرِیۡكَ لَعَلَّ السَّاعَۃَ قَرِیۡبٌ ﴿۱۷﴾
الله الذی انزل الكتب بالحق و المیزان و ما یدریك لعل الساعۃ قریب ﴿۱۷﴾
• আল্লাহ, যিনি সত্যসহ কিতাব ও মীযান* নাযিল করেছেন। আর কিসে তোমাকে জানাবে, হয়ত কিয়ামত খুবই নিকটবর্তী?

-আল-বায়ান

• তিনিই আল্লাহ যিনি সত্য ও ইনসাফের মানদন্ড সহকারে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তুমি কি জান, সম্ভবতঃ চূড়ান্ত ফয়সালার সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে।

-তাইসিরুল

• আল্লাহই অবতীর্ণ করেছেন সত্যসহ কিতাব এবং তুলাদন্ড। তুমি কি জান, সম্ভবতঃ কিয়ামাত আসন্ন?

-মুজিবুর রহমান

• It is Allah who has sent down the Book in truth and [also] the balance. And what will make you perceive? Perhaps the Hour is near.

-Sahih International

* সনদ, ন্যায় বিচার, ইনসাফ, ইত্যাদি।

১৭. আল্লাহ, যিনি নাযিল করেছেন সত্যসহকারে কিতাব এবং মীযান।(১) আর কিসে আপনাকে জানাবে যে, সম্ভবত কিয়ামত আসন্ন?

(১) অতঃপর উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এতে আল্লাহর হক ও বান্দার হকের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন-কানুন রয়েছে। (أَنْزَلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَالْمِيزَانَ) এখানে ‘কিতাব’ বলে কুরআনসহ সমস্ত আসমানী গ্ৰন্থকে বোঝানো হয়েছে এবং হক বলতে পূর্বোক্ত সত্যদ্বীনকে বোঝানো হয়েছে। ميزان এর শাব্দিক অর্থ দাঁড়ি-পাল্লা। এটা যেহেতু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার এবং অধিকার পূর্ণ মাত্রায় দেয়ার একটি মানদণ্ড তাই ইবনে আব্বাস এর তাফসীর করেছেন ন্যায় বিচার। মুজাহিদ বলেন, মানুষ যে দাঁড়ি-পাল্লা ব্যবহার করে এখানে তাই বোঝানো হয়েছে। সুতরাং হক শব্দের মধ্যে আল্লাহর যাবতীয় হক এবং ميزان শব্দের মধ্যে বান্দার যাবতীয় হকের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আর তখন ‘হকসহকারে’ এর অর্থ হবে, হকের বর্ণনা সম্বলিত। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে মীযান অর্থ আল্লাহর শরীয়ত, যা দাঁড়িপাল্লার মত ওজন করে ভুল ও শুদ্ধ, হক ও বাতিল, জুলুম ও ন্যায়বিচার এবং সত্য ও অসত্যের পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়। ওপরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে যে, “তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করার জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।” এখানে বলা হয়েছে যে, এই পবিত্ৰ কিতাব সহকারে সেই ‘মিযান’ এসে গেছে যার সাহায্যে এই ইনসাফ কায়েম করা যাবে। [তাবারী, কুরতুবী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৭) আল্লাহই সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন এবং (অবতীর্ণ করেছেন) তুলাদন্ড।[1] আর তুমি কি জান, সম্ভবতঃ কিয়ামত আসন্ন? [2]

[1] الْكِتَابَ বলতে সকল কিতাব। অর্থাৎ, সমস্ত নবীদের উপর যত কিতাবই অবতীর্ণ হয়েছে, সে সবই ছিল সত্য। অথবা বিশেষভাবে কুরআন মাজীদকে বুঝানো হয়েছে এবং তার সত্যতাকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা হয়েছে। ‘মীযান’ (তুলাদন্ড বা দাঁড়িপাল্লা)র অর্থ, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার। ইনসাফকে দাঁড়িপাল্লা বলে এই জন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, তা হল সমতা ও সুবিচারের যন্ত্র। এর মাধ্যমেই মানুষের মাঝে সমতা বজায় রাখা সম্ভব। এরই সমর্থক হল (নিম্নের) এই আয়াতগুলো, {لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمْ الْكِتَابَ وَالْمِيْزَانَ لِيَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسِ} অর্থাৎ, আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব এবং মীযান, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।’’ (সূরা হাদীদ ২৫ আয়াত) {وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ المِيْزَانَ، اَلاَّ تَطْغَوْا فِي الْمِيْزَانِ، وَأَقِيْمُوْا الْوَزَْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ} অর্থাৎ, তিনি আকাশকে সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদন্ড। যাতে তোমরা সীমলঙ্ঘন না কর তুলাদন্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না।’’ (সূরা রহমান ৭-৯ আয়াত)

[2] قريب ‘ মুযাক্কার’ (পুংলিঙ্গ) এবং ‘মুআন্নাষ’ (স্ত্রীলিঙ্গ) উভয়েরই ‘সিফাত’ (বিশেষণ) হিসাবে ব্যবহার হয়; বিশেষ করে ‘মউসুফ’ (বিশেষ্য) যদি কোন প্রাণী না হয়। যেমনঃ {اِنَّ رَحْمَتَ اللهِ قَرِيْبٌ مِنَ الْمُحْسِنِيْنَ} (ফাতহুল ক্বাদীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৮ یَسۡتَعۡجِلُ بِهَا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِهَا ۚ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مُشۡفِقُوۡنَ مِنۡهَا ۙ وَ یَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهَا الۡحَقُّ ؕ اَلَاۤ اِنَّ الَّذِیۡنَ یُمَارُوۡنَ فِی السَّاعَۃِ لَفِیۡ ضَلٰلٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۱۸﴾
یستعجل بها الذین لا یؤمنون بها و الذین امنوا مشفقون منها و یعلمون انها الحق الا ان الذین یمارون فی الساعۃ لفی ضلل بعید ﴿۱۸﴾
• যারা এতে ঈমান আনে না, তারাই তা ত্বরান্বিত করতে চায়। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা একে ভয় করে এবং তারা জানে যে, এটা অবশ্যই সত্য। জেনে রেখ, নিশ্চয় যারা কিয়ামত সম্পর্কে বাক-বিতন্ডা করে তারা সুদূর পথভ্রষ্টতায় নিপতিত।

-আল-বায়ান

• যে সব লোক তাতে বিশ্বাস করে না, তারাই তার (অর্থাৎ ক্বিয়ামতের) আগমনকে তরান্বিত করতে চায়। কিন্তু যারা বিশ্বাসী তারা তাকে ভয় করে আর তারা জানে যে, তা সত্য। জেনে রেখ, যারা ক্বিয়ামত সম্পর্কে বিতর্ক করে, তারা স্পষ্টতই সত্য পথ হতে বহু দূরে চলে গেছে।

-তাইসিরুল

• যারা এটা বিশ্বাস করেনা তারাই এটা ত্বরান্বিত করতে চায়। আর যারা বিশ্বাসী তারা ওকে ভয় করে এবং জানে যে, ওটা সত্য; জেনে রেখ, কিয়ামাত সম্পর্কে যারা বাক-বিতন্ডা করে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

-মুজিবুর রহমান

• Those who do not believe in it are impatient for it, but those who believe are fearful of it and know that it is the truth. Unquestionably, those who dispute concerning the Hour are in extreme error.

-Sahih International

১৮. যারা এটাতে ঈমান রাখে না তারাই তা ত্বরান্বিত করতে চায়। আর যারা ঈমান এনেছে তারা তা থেকে ভীত থাকে এবং তারা জানে যে, তা অবশ্যই সত্য। জেনে রাখুন, নিশ্চয় কিয়ামত সম্পর্কে যারা বাক-বিতণ্ডা করে তারা ঘোর বিভ্ৰান্তিতে নিপতিত।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৮) যারা এ বিশ্বাস করে না, তারাই এ তরান্বিত করতে চায়,[1] কিন্তু যারা বিশ্বাসী, তারা ওকে ভয় করে[2] এবং জানে তা সত্য। জেনে রাখ, কিয়ামত সম্পর্কে যারা বাক্-বিতন্ডা করে[3] তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে।[4]

[1] অর্থাৎ, বিদ্রূপ স্বরূপ এই মনে করে যে, তা কি আর আসবে নাকি? তাই বলে, ‘কিয়ামত সত্বর আসুক।’

[2] প্রথম কারণঃ তারা এর সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাসী। দ্বিতীয় কারণঃ তারা ভয় পায় যে, সেদিন ন্যায় বিচার হবে, অতএব তারাও আবার আল্লাহর পাকড়াও-এর আওতায় এসে পড়বে কি না। যেমন, অন্যত্র এসেছে, {وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوا وَّقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ} অর্থাৎ, আর যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে --এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করবার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে। (সূরা মু’মিনূন ৬০ আয়াত)

[3] يُمَارُوْنَ এর উৎপত্তি হল, مِرَاء ধাতু থেকে; যার অর্থ হল, তর্ক-ঝগড়া। অথবা এর উৎপত্তি হল, مِرْيَةٌ ধাতু থেকে; যার অর্থ, সন্দেহ-সংশয়। অর্থাৎ, কিয়ামত সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করে--।

[4] কেননা, তারা এই দলীলগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না, যা তাদের ঈমান আনার কারণ হতে পারে। অথচ এই দলীলগুলো দিবারাত্রি তারা পরিদর্শন করছে। তা তাদের চোখের সামনে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এবং তা তাদের জ্ঞান-বিবেকে আসতে পারে। তাই তারা সত্য থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ১৯ اَللّٰهُ لَطِیۡفٌۢ بِعِبَادِهٖ یَرۡزُقُ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ هُوَ الۡقَوِیُّ الۡعَزِیۡزُ ﴿۱۹﴾
الله لطیف بعبادهٖ یرزق من یشآء و هو القوی العزیز ﴿۱۹﴾
• আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা রিয্ক দান করেন। আর তিনি মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।

-আল-বায়ান

• আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের প্রতি মেহেরবান, তিনি যাকে যা ইচ্ছে রিযক দেন। তিনি প্রবল, মহাপরাক্রমশালী।

-তাইসিরুল

• আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা রিয্ক দান করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।

-মুজিবুর রহমান

• Allah is Subtle with His servants; He gives provisions to whom He wills. And He is the Powerful, the Exalted in Might.

-Sahih International

১৯. আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল; তিনি যাকে ইচ্ছে রিযিক দান করেন।(১) আর তিনি সর্বশক্তিমান, প্ৰবল পরাক্রমশালী।

(১) অভিধানে لطيف শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইবনে আব্বাস এর অর্থ করেছেন, দয়ালু, পক্ষান্তরে মুকাতিল করেছেন অনুগ্রহকারী। অন্য অর্থ, সুক্ষদর্শী। মুকাতিল বলেন, আল্লাহ তা'আলা সমস্ত বান্দার প্রতিই দয়ালু। এমনকি কাফের এবং পাপাচারীর উপরও দুনিয়াতে তাঁর নেয়ামত বর্ষিত হয়। বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ ও কৃপা অসংখ্য প্রকার।

আল্লাহ তা'আলার রিযিক সমগ্র সৃষ্টির জন্যে ব্যাপক। স্থলে ও জলে বসবাসকারী যেসব জন্তু সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না, আল্লাহর রিযিক তাদের কাছেও পৌছে। আয়াতে যাকে ইচ্ছা রিযিক দেন, বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার রিযিক অসংখ্য প্রকার। জীবনধারণের উপযোগী রিযিক সবাই পায়। এরপর বিশেষ প্রকারের রিযিক বন্টনে তিনি বিভিন্ন স্তর ও মাপ রেখেছেন। কাউকে ধন-সম্পদের রিযিক অধিক দান করেছেন। কাউকে স্বাস্থ্য ও শক্তির, কাউকে জ্ঞান এবং কাউকে অন্যান্য প্রকার রিযিক দিয়েছেন। এভাবে প্রত্যেক মানুষ অপরের মুখাপেক্ষীও থাকে এবং এই মুখাপেক্ষিতাই তাদেরকে পারস্পারিক সাহায্য ও সহযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করে, যার উপর মানব সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। [দেখুন: কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৯) আল্লাহ তাঁর দাসদের প্রতি অতি স্নেহশীল; তিনি যাকে ইচ্ছা রুযী দান করেন। আর তিনিই প্রবল, পরাক্রমশালী।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪২ : ২০ مَنۡ كَانَ یُرِیۡدُ حَرۡثَ الۡاٰخِرَۃِ نَزِدۡ لَهٗ فِیۡ حَرۡثِهٖ ۚ وَ مَنۡ كَانَ یُرِیۡدُ حَرۡثَ الدُّنۡیَا نُؤۡتِهٖ مِنۡهَا وَ مَا لَهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ نَّصِیۡبٍ ﴿۲۰﴾
من كان یرید حرث الاخرۃ نزد لهٗ فی حرثهٖ و من كان یرید حرث الدنیا نؤتهٖ منها و ما لهٗ فی الاخرۃ من نصیب ﴿۲۰﴾
• যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না।

-আল-বায়ান

• যে লোক পরকালের ক্ষেত করতে চায়, আমি তার জন্য তার ক্ষেতে বৃদ্ধি দান করি। আর যে লোক দুনিয়ার ক্ষেত চায়, আমি তাকে তাত্থেকে দেই, কিন্তু পরকালে তার অংশে (বা ভাগ্যে) কিছুই নেই।

-তাইসিরুল

• যে কেহ আখিরাতের প্রতিদান কামনা করে তার জন্য আমি তার ফসল বর্ধিত করে দিই এবং যে দুনিয়ার প্রতিদান কামনা করে আমি তাকে ওরই কিছু দিই। কিন্তু আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবেনা।

-মুজিবুর রহমান

• Whoever desires the harvest of the Hereafter - We increase for him in his harvest. And whoever desires the harvest of this world - We give him thereof, but there is not for him in the Hereafter any share.

-Sahih International

২০. যে কেউ আখিরাতের ফসল কামনা করে তার জন্য আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই এবং যে কেউ দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমরা তাকে তা থেকে কিছু দেই। আর আখেরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না।(১)

(১) একজন ঈমানদারের উচিত আখেরাতমুখী হওয়া। যে আখেরাতমুখী হবে সে দুনিয়া আখেরাত সবই পাবে। পক্ষান্তরে যে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিবে সে দুনিয়াও হারাবে আখেরাতও পাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মহান আল্লাহ্‌ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য নিজকে নিয়োজিত কর; আমি তোমার বক্ষকে অমুখাপেক্ষিতা দিয়ে পূর্ণ করে দেব। তোমার দারিদ্রতাকে দূর করে দেব। আর যদি তা না কর আমি তোমার বক্ষ ব্যস্ততায় পূর্ণ করে দেব। আর তোমার দারিদ্রতা অবশিষ্ট রেখে দেব।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৪৪৩, তিরমিযী: ২৪৬৬] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ জাতিকে সুসংবাদ দাও আলো, উচ্চমর্যাদা, দ্বীন, সাহায্য, যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠার। তবে এ উম্মতের মধ্যে যে কেউ আখেরাতের কাজ দুনিয়া হাসিলের জন্য করবে, আখেরাতে সে কিছুই পাবে না। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৩৪]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২০) যে ব্যক্তি পরলোকের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য পরলোকের ফসল বর্ধিত করে দিই[1] এবং যে কেউ ইহলোকের ফসল কামনা করে, আমি তাকে তারই কিছু দিই,[2] আর পরলোকে এদের জন্য কোন অংশ থাকবে না। [3]

[1] حَرْثٌ এর অর্থ বীজ বপন অথবা ফসল। এখানে রূপকার্থে আমলের ফলাফল এবং তার উপকারিতার জন্য তা ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজের সমস্ত আমল ও চেষ্টা-চরিত্র দ্বারা আখেরাতের নেকী ও সওয়াব লাভের আশা করবে, তার আখেরাতের ফসলকে আল্লাহ বাড়িয়ে দিবেন। একটি নেকীর প্রতিদান দশ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বরং তার থেকেও বেশী গুণ দান করবেন।

[2] অর্থাৎ, দুনিয়া কামনাকারী দুনিয়া তো পায়। তবে ততটা নয়, যতটা সে চায়; বরং ততটা, যতটা আল্লাহ চান ও তাঁর লিখিত তকদীরে নির্ধারিত থাকে।

[3] এটা সেই বিষয়ই যা সূরা বানী ইসরাঈলের ১৮নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, দুনিয়া তো আল্লাহ প্রত্যেককেই ততটা অবশ্যই দেন, যতটা তিনি তার ভাগ্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন; যে দুনিয়া চায় তাকেও এবং যে আখেরাত চায় তাকেও। কেননা, তিনিই সকলের রুযীর দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। তবে যে আখেরাত কামনা করে অর্থাৎ, আখেরাতের জন্য পরিশ্রম ও মেহনত করে, তাকে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً (বহুগুণ) নেকী ও সওয়াব দান করবেন। পক্ষান্তরে দুনিয়া কামনাকারীর জন্য আখেরাতে জাহান্নামের আযাব ব্যতীত কিছুই থাকবে না। এখন মানুষের চিন্তা-ভাবনা করে দেখা দরকার যে, তার লাভ দুনিয়া কামনা করাতে, না আখেরাত কামনা করাতে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 পরের পাতা »