-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১১. (এ নির্দেশ দিয়ে যে) আপনি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী করুন(১) এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করুন। আর তোমরা সৎকাজ কর, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আমি তার সম্যক দ্রষ্টা।
(১) কাতাদাহ বলেন, সর্বপ্রথম বর্ম দাউদ আলাইহিস সালামই তৈরী করেন। তার আগে কেউ সেটা তৈরী করে নি। [তাবারী] কাতাদাহ আরও বলেন, তিনি এটা বানাতে আগুনের ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করতেন না। তাছাড়া লাঠি দিয়েও আঘাত করতে হতো না। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১১) এবং তাকে বলেছিলাম, তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী কর,[1] ওগুলির কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর[2] এবং তোমরা সৎকাজ কর। [3] তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয় আমি তার সম্যক দ্রষ্টা।
[1] سَابِغَاتٍ এর বিশেষ্য ঊহ্য আছে دُرُوْعًا ساَبِغاَتٍ অর্থাৎ পূর্ণ মাপের লম্বা লৌহবর্ম, যা যোদ্ধার পূর্ণ শরীর ঠিকভাবে আবৃত করে এবং তাকে শত্রুর আঘাত থেকে বাঁচাতে পারে।
[2] (কড়াসমূহ যথাযথ সংযুক্ত কর) যাতে ছোট বড় না হয়ে যায়, অথবা টাইট বা ঢিলা না হয়ে যায়। অর্থাৎ কড়াসমূহ সংযুক্ত করতে তার খিলগুলি এমন পাতলা না হয়, যাতে জোড়গুলি নড়াসড়া করতেই থাকে এবং তাতে স্থিরতা না আসে। পরন্তু এমন মোটাও যেন না হয়, যাতে তা ভেঙ্গেই যায় অথবা তা জমে না যায় এবং তা পরাই সম্ভব না হয়। এখানে দাউদ (আঃ)-কে লৌহবর্ম তৈরী করার নিয়ম বলা হয়েছে।
[3] অর্থাৎ সেই নিয়ামতের বদলে নেক আমল কর, যাতে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয়। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা যাকে পার্থিব নিয়ামত দান করেছেন তাকে সেই নিয়ামত হিসাবে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার। আর আসল কৃতজ্ঞতা হল, অনুগ্রহকারীকে সন্তুষ্ট করার পূর্ণ চেষ্টা রাখা। অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য করা ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১২. আর সুলাইমানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা ভোরে একমাসের পথ অতিক্রম করত ও সন্ধ্যায় একমাসের পথ অতিক্রম করত।(১) আমরা তার জন্য গলিত তামার এক প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম এবং তার রবের অনুমতিক্রমে জিনদের কিছু সংখ্যক তার সামনে কাজ করত। আর তাদের মধ্যে যে আমাদের নির্দেশ অমান্য করে, তাকে আমরা জ্বলন্ত আগুনের শান্তি আস্বাদন করাব।(২)
(১) এর অর্থ হচ্ছে প্রতিদিন তিনি দু’মাসের পথ বাতাসের উপর করে ভ্রমণ করতেন। [তাবারী]
(২) অর্থাৎ কোন জিন যদি সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য না করে, তবে তাকে আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে। অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে এখানে আখেরাতে জাহান্নামের আযাব বোঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দুনিয়াতেও আল্লাহ তাআলা তাদের উপর একজন ফেরেশতা নিয়োজিত রেখেছিলেন। সে অবাধ্য জিনকে আগুনের চাবুক মেরে মেরে কাজ করতে বাধ্য করত। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(১২) আমি বাতাসকে সুলাইমানের অধীন করেছিলাম, তার সকালের ভ্রমণ একমাসের পথ ছিল এবং সন্ধ্যার ভ্রমণও এক মাসের পথ ছিল।[1] আমি তার জন্য গলিত তামার এক ঝরনা প্রবাহিত করেছিলাম। [2] আল্লাহর অনুমতিক্রমে কিছু সংখ্যক জ্বিন তার সম্মুখে কাজ করত। ওদের মধ্যে যারা আমার নির্দেশ অমান্য করে তাদেরকে আমি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি আস্বাদন করাব। [3]
[1] অর্থাৎ সুলাইমান (আঃ) সভাসদ ও সৈন্যসহ তক্তায় বসে যেতেন। বাতাস তাঁর আজ্ঞাধীন হয়ে তিনি যেখানে আদেশ করতেন সেখানে তাঁকে এমন গতিতে নিয়ে যেত যে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত এবং অনুরূপ দুপুর থেকে রাত্রি পর্যন্ত এক মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত। এইভাবে এক দিনে দুই মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত।
[2] অর্থাৎ যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য লোহা নরম করে দেওয়া হয়েছিল, অনুরূপ সুলাইমান (আঃ)-এর জন্য আমি তামার ঝরনা প্রবাহিত করে দিয়েছিলাম যাতে তামা পদার্থ দ্বারা সে অনায়াসে ইচ্ছামত পাত্র ইত্যাদি বানাতে পারে।
[3] অধিকাংশ তফসীরবিদের মতে এ শাস্তি কিয়ামতের দিন দেওয়া হবে। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, এ শাস্তি হল দুনিয়ার শাস্তি। তাঁরা বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর একজন ফিরিশতা নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর হাতে আগুনের চাবুক থাকত। যে জ্বিন সুলাইমান (আঃ)-এর আদেশ অমান্য করত, তাকে ফিরিশতা চাবুক মারতেন; যাতে সে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। (ফাতহুল ক্বাদীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৩. তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ(১), ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আর আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ!
(১) মুজাহিদ বলেন, এগুলো ছিল প্রাসাদের চেয়ে ছোট আকৃতির ঘর-দোর বিশেষ। [আত-তাফসীরুস সহীহ] কাতাদাহ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য বিল্ডিং ও মাসজিদ। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৩) ওরা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, প্রতিমা, হওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির ওপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত।[1] (আমি বলেছিলাম,) ‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার দাসদের মধ্যে কৃতজ্ঞ অতি অল্পই।’
[1] مَحَارِيْبَ শব্দটি مِحْرَابٌ এর বহুবচন। অর্থ হল উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা, উদ্দেশ্য উঁচু উঁচু অট্টালিকা, বিশাল বিশাল বাসভবন বা মসজিদ ও উপাসনালয়। تَمَاثِيْلَ শব্দটি تِمْثاَلٌ এর বহুবচন। অর্থঃ প্রতিমা, মূর্তি। এ মূর্তি অপ্রাণীর হত। অনেকে বলেন, পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও নেক লোকেদের মূর্তি মসজিদে নির্মাণ করা হত, যাতে তা দেখে মানুষ (আল্লাহর) ইবাদত করে। তবে এ অর্থ ঐ সময় নেওয়া সঠিক হবে, যখন এটা মেনে নেওয়া যাবে যে, সুলাইমান (আঃ)-এর শরীয়তে মূর্তি নির্মাণ বৈধ ছিল। আর এ কথা সঠিক নয়। পক্ষান্তরে ইসলাম মূর্তি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। جِفَانٌ শব্দটি جَفْنَةٌ এর বহুবচন অর্থঃ বিরাট পাত্র, جَواَبٍ শব্দটি جَابِيَةٌ এর বহুবচন ,অর্থঃ হওয, ছোট চৌবাচ্চা, যাতে পানি জমা রাখা হয়। অর্থাৎ চৌবাচ্চার মত বড় বড় পাত্র قُدُوْرٌ ডেগ, رَاسِيَاتٌ অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। বলা হয় যে, এই সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত, যা স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না। যাতে এক সাথে এক হাজার মানুষের খাবার রান্না হত। আর এ সকল কাজ জ্বিনরা করত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৪. অতঃপর যখন আমরা সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন জিনদেরকে তার মৃত্যুর খবর জানাল শুধু মাটির পোকা, যা তার লাঠি খাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি পড়ে গেলেন তখন জিনরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা গায়েব জানত, তাহলে তারা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না।(১)
(১) কারণ, সুলাইমান আলাইহিস সালাম তার ঘরে ইবাদাতে মশগুল ছিলেন। তারপর জিনরা তার জন্য বিল্ডিং বানাচ্ছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ সুলাইমান আলাইহিস সালামের মৃত্যু দিলেন। কিন্তু জিনরা তা জানতেই পারল না। শেষ পর্যন্ত তার লাঠিতে যমীনের পোকা লেগে সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তিনি পড়ে গেলেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় সেটা ছিল পূর্ণ এক বছর পর। তখন জিনরা তাদের ভুল বুঝতে পারল যে, যদি তারা গায়েবের কিছু জানত তবে এতদিন কষ্ট করত না। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৪) যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন উই পোকাই জ্বিনদেরকে তার মৃত্যু বিষয় জানাল; যা সুলাইমানের লাঠি খাচ্ছিল। যখন সুলাইমান মাটিতে পড়ে গেল, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারল যে, ওরা যদি অদৃশ্য বিষয় অবগত থাকত, তাহলে ওরা এতকাল লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না। [1]
[1] সুলাইমান (আঃ)-এর সময়ে জ্বিনদের বিষয়ে এই খবর প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, জ্বিনরা গায়বের খবর জানে, আল্লাহ তাআলা সুলাইমান (আঃ)-এর মৃত্যু দ্বারা সেই আকীদার ভ্রষ্টতা পরিষ্কার করে দিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫. অবশ্যই সাবাবাসীদের(১) জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শনঃ দুটি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অন্যটি বাম দিকে।(২) বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের রবের দেয়া রিযিক ভোগ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।(৩) উত্তম নগরী এবং ক্ষমাশীল রব।
(১) হাদীসে এসেছে, ‘সাবা ছিল আরবের এক ব্যক্তির নাম। আরবে তার বংশ থেকে নিম্নোক্ত গোত্রগুলোর উদ্ভব হয়ঃ কিন্দাহ, হিম্য়ার, আয্দ, আশ’আরিয়্যীন, মায্হিজ, আনমার (এর দুটি শাখাঃ খাস'আম ও বাজীলাহ), আমেলাহ, জুযাম, লাখম ও গাসসান।’ [তিরমিযী: ৩২২২] ইবনে কাসীরের মতে, ইয়ামনের সম্রাট ও সে দেশের অধিবাসীদের উপাধি হচ্ছে সাবা। তাবাবেয়া সম্প্রদায়ও সাবা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। [ইবন কাসীর]
(২) শহরের ডানে ও বায়ে অবস্থিত পাহাড়দ্বয়ের কিনারায় ফল-মুলের বাগান তৈরী করা হয়েছিল। এসব বাগানে খালের পানি প্রবাহিত হত। সমগ্ৰ সাবা রাজ্য শ্যামল সবুজ ক্ষেত ও বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল। তার যে কোন জায়গায় দাঁড়ালে দেখা যেতো ডানেও বাগান এবং বাঁয়েও বাগান। এ সব বাগান পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় পাহাড়ের কিনারায় দু’সারিতে বহুদূর পর্যন্ত ছিল। এগুলো সংখ্যায় অনেক হলেও পবিত্র কুরআন দুটি বাগানের কথা ব্যক্ত করেছে। কারণ, এক সারির সমস্ত বাগান পরস্পর সংলগ্ন হওয়ার কারণে এক বাগান এবং অপর সারির সমস্ত বাগানকে একই কারণে দ্বিতীয় বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এসব বাগানে সবরকম বৃক্ষ ফল-মুল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত। কাতাদাহ প্ৰমুখের বর্ণনা অনুযায়ী একজন লোক মাথায় খালি ঝুড়ি নিয়ে গমন করলে গাছ থেকে পতিত ফলমুল দ্বারা তা আপনা-আপনি ভরে যেত; হাত লাগানোরও প্রয়োজন হত না। [ইবন কাসীর, কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
(৩) আল্লাহ তা'আলা নবীগণের মাধ্যমে তাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন, তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত এই অফুরন্ত জীবনোপকরণ ব্যবহার কর এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সৎকর্ম ও আল্লাহর আনুগত্য করতে থাক। আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ শহরকে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর শহর করেছেন। শহরটি নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত ছিল এবং আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর ও বিশুদ্ধ ছিল। সমগ্র শহরে মশা-মাছি ছারপোকা ও সাপ-বিছুর মত ইত্যর প্রাণীর নামগন্ধও ছিল না। বাইরে থেকে কোন ব্যক্তি শরীরে ও কাপড়-চোপড়ে উকুন ইত্যাদি নিয়ে এ শহরে পৌঁছালে সেগুলো আপনা-আপনি মরে সাফ হয়ে যেত। [দেখুন: কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫) সাবা’বাসীদের জন্য ওদের বাসভূমিতে এক নিদর্শন ছিল;[1] দু’টি বাগানঃ একটি ছিল ডান দিকে, অপরটি ছিল বাম দিকে;[2] ওদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দেওয়া রুযী ভোগ কর[3] এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।[4] এ শহর উত্তম[5] এবং তোমাদের প্রতিপালক ক্ষমাশীল।’ [6]
[1] سَبَأٍ (সাবা’) এক জাতি ছিল, যার রানী সাবা’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। যিনি সুলাইমান (আঃ)-এর সময় (তাঁরই হাতে) মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন। জাতির নামে দেশের নামও সাবা’ ছিল। বর্তমানে সে দেশ ইয়ামান নামে প্রসিদ্ধ। উক্ত দেশ বড় সুখী দেশ ছিল। স্থল ও জলপথের বাণিজ্যের জন্যও উত্তম ছিল এবং চাষ-বাস ও ফল-ফসল ইত্যাদিতেও বড় ভাল ছিল। আর বাণিজ্য ও চাষাবাদ উভয়ের উৎকর্ষই যে কোন দেশ ও জাতির সুখের কারণ হয়। এখানে সেই ধন-দৌলতের আতিশয্যকে আল্লাহর বিশাল ক্ষমতার একটি নিদর্শন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
[2] বলা হয়েছে যে, তাদের শহরের দুই দিকে পর্বত ছিল, সেখান থেকে ঝরনা ও নালা বেয়ে পানি শহরে প্রবেশ করত। তাদের শাসকগণ পর্বতের মাঝে বাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছিল এবং তার সাথে বহু বাগান লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে নির্দিষ্টভাবে পানি যাওয়ার রাস্তা হয়ে গিয়েছিল এবং বাগানে পানি পৌঁছতে সহজ ও সুবিধা হয়ে গিয়েছিল। সেই বাগানগুলিকে ডানে ও বামে দুটি বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেকে বলেন, جَنَّتَيْنِ এর অর্থ দুটি বাগান নয়; বরং উদ্দেশ্য হল ডান ও বাম পার্শ্ব। আর এ থেকে উদ্দেশ্য এত বাগান যে, যেদিকেই নজর যায় সেদিকেই সবুজ-শ্যামল বাগান আর বাগানই চোখে পড়ে। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[3] এই আদেশ তাদের পয়গম্বরের দ্বারা করা হয়েছিল অথবা উদ্দেশ্য সেই সকল নিয়ামতের বর্ণনা, যা তাদেরকে প্রদান করা হয়েছিল।
[4] অর্থাৎ, সেই দাতা ও অনুগ্রহকারীর আনুগত্য কর এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে দূরে থাক।
[5] অর্থাৎ, বাগানসমূহের আধিক্য ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূলের কারণে উক্ত শহর উৎকৃষ্ট ছিল। বলা হয় যে, সুন্দর আবহাওয়ার কারণে সেই শহর মশা, মাছি ও অনুরূপ অন্যান্য কষ্টদায়ক জীবজন্তু থেকেও মুক্ত ছিল। আর আল্লাহই ভালো জানেন।
[6] অর্থাৎ, যদি তোমরা প্রতিপালকের কৃতজ্ঞতা বর্ণনা করতে থাক, তবে তিনি তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এর অর্থ এও হল যে, যদি মানুষ তওবা করতে থাকে, তাহলে পাপাচরণ ব্যাপক ধ্বংস ও অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না; বরং আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেবেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৬. অতঃপর তারা অবাধ্য হল। ফলে আমরা তাদের উপর প্রবাহিত করলাম ‘আরেম’(১) বাঁধের বন্যা এবং তাদের উদ্যান দুটিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটি উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ এবং সামান্য কিছু কুল গাছ।
(১) ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী এই বাঁধের ইতিহাস এইঃ ইয়ামনের রাজধানী সানআ থেকে তিন মনযিল দূরে মাআরেব নগরী অবস্থিত ছিল। এখানে ছিল সাবা সম্প্রদায়ের বসতি। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় শহরটি অবস্থিত ছিল বিধায় উভয় পাহাড়ের উপর থেকে বৃষ্টির পানি বন্যার আকারে নেমে আসত। ফলে শহরের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যেত। দেশের সম্রাটগণ উভয় পাহাড়ের মাঝখানে একটি শক্ত ও মজবুত বাঁধ নির্মাণ করলেন। এ বাঁধ পাহাড় থেকে আগত বন্যার পানি রোধ করে পানির একটি বিরাট ভাণ্ডার তৈরী করে দেয়। পাহাড়ী ঢলের পানিও এতে সঞ্চিত হতে থাকে। বাঁধের উপরে-নীচে ও মাঝখানে পানি বের করার তিনটি দরজা নির্মাণ করা হয় যাতে সঞ্চিত পানি সুশৃংখলভাবে শহরের লোকজনের মধ্যে এবং তাদের ক্ষেতে ও বাগানে পৌঁছানো যায়। প্রথমে উপরের দরজা খুলে পানি ছাড়া হত। উপরের পানি শেষ হয়ে গেলে মাঝখানের এবং সর্বশেষে নীচের তৃতীয় দরজা খুলে দেয়া হত। পরবর্তী বছর বৃষ্টির মওসুমে বাঁধের তিনটি স্তরই আবার পানিতে পূর্ণ হয়ে যেত। বাঁধের নীচে পানি সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে একটি সুবৃহৎ আধার নির্মাণ করা হয়েছিল। এতে পানির বারটি খাল তৈরী করে শহরের বিভিন্ন দিকে পৌঁছানো হয়েছিল। সব খালে একই গতিতে পানি প্রবাহিত হত এবং নাগরিকদের প্রয়োজন মেটাত।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬) পরে ওরা আদেশ অমান্য করল। ফলে আমি ওদের ওপর বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা প্রবাহিত করলাম এবং ওদের বাগান দু’টিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দু’টি বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ। [1]
[1] অর্থাৎ, তারা পাহাড়ের মাঝে বাঁধ তৈরী করে পানি আটকে রাখার যে ব্যবস্থা করেছিল এবং তা চাষাবাদ ও বাগান সেচ করার কাজে লাগাত, আমি কঠিন বাঁধভাঙ্গা বন্যার দ্বারা সেই বাঁধকে ভেঙ্গে ফেললাম এবং সবুজ ও ফলদার বাগানকে এমন বাগানে পরিবর্তন করে দিলাম যাতে শুধু প্রাকৃতিক ঝাড় জঙ্গল থাকে। যাতে প্রথমতঃ কোন ফল হয় না। আর যদি কোন গাছে হয়, তবে তা তেতো, কষা ও এমন বদমজাদার যা কেউ খেতেই পারবে না। তবে কিছু কুল (বা বরই) গাছ ছিল তাতেও অধিক কাঁটা, আর কুল সামান্যই ছিল। عَرِمٌ -عَرِمَةٌ -এর বহুবচন অর্থ বাঁধ। অর্থাৎ, এমন জোরে পানির স্রোত পাঠালাম যা সেই বাঁধ ভেঙ্গে ফেলল এবং পানি শহরেও প্রবেশ করে গেল। যাতে তাদের ঘর-বাড়ী ডুবে গেল এবং গাছপালা উজাড় করে পতিত জমিতে পরিণত করে দিল। উক্ত বাঁধ সাদ্দু মা’রিব নামে প্রসিদ্ধ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৭. ঐ শাস্তি আমরা তাদেরকে দিয়েছিলাম তাদের কুফরির কারণে। আর অকৃতজ্ঞ ছাড়া আমরা আর কাউকেও এমন শাস্তি দেই না।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৭) আমি ওদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম ওদের সত্য অকৃতজ্ঞতা (বা অস্বীকারের) জন্য। আর আমি অকৃতজ্ঞ (বা অস্বীকারকারী)কেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৮. আর তাদের ও যেসব জনপদের মধ্যে আমরা বরকত দিয়েছিলাম, সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে আমরা দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ঐ সব জনপদে ভ্রমনের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম। বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্ৰমণ কর দিনে ও রাতে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৮) ওদের এবং যে সব জনপদে আমি প্রাচুর্য দান করেছিলাম[1] সেগুলির অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম[2] এবং ঐ সকল জনপদে ভ্রমণকালে বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে বিশ্রামস্থান নির্ধারিত করেছিলাম এবং ওদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা এ সব জনপদে রাত-দিন নিরাপদে ভ্রমণ কর।’ [3]
[1] ‘যে সব জনপদে আমি প্রাচুর্য দান করেছিলাম’ বলে বরকতময় শাম দেশের জনপদকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আমি সাবা’ (ইয়ামান) ও শামের মাঝে পথের ধারে ধারে বহু জনবসতি আবাদ করে রেখেছিলাম। অনেকে ظاهرة শব্দটির অর্থ মিলিত করেছেন। অর্থাৎ, এক অপরের সাথে মিলিত ও সংযুক্ত। তাফসীরবিদগণ সেই জনবসতির সংখ্যা চার হাজার সাত শত বলেছেন। এটাই তাদের ব্যবসার প্রধান রাস্তা ছিল, যার সংলগ্নে সাবা’ থেকে শাম পর্যন্ত কাছাকাছি জনবসতি প্রতিষ্ঠিত ছিল। যার ফলে প্রথমতঃ তাদের পানাহার ও আরাম করার জন্য পাথেয় সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন হত না। দ্বিতীয়তঃ জনশূন্য হওয়ার ফলে পথে যে চুরি-ডাকাতি, লুট-মার ইত্যাদির আশঙ্কা থাকার কথা, তা ছিল না।
[2] অর্থাৎ, এক জনবসতি থেকে অপর জনবসতি নির্দিষ্ট ও পরিচিত দূরত্বে অবস্থিত ছিল এবং সেই হিসাবে তারা অতি সহজে নিজেদের সফর অতিক্রম করত। যেমন সকালে সফর আরম্ভ করলে ঠিক দুপুর পর্যন্ত কোন গ্রাম বা জনবসতি পর্যন্ত পৌঁছে যেত। সেখানে খাবারের প্রয়োজন মিটিয়ে দুপুরের আরাম করত এবং পুনরায় সফর আরম্ভ করলে রাত্রি পর্যন্ত অন্য কোন জনপদে পৌঁছে যেত।
[3] এটা সকল প্রকার ভীতি থেকে সুরক্ষা ও পাথেয়-সামগ্রী বহন করার ব্যাপারে অমুখাপেক্ষিতার বর্ণনা যে, রাত বা দিনের যে কোন সময়ে তোমরা সফর করতে চাও কর, না জান-মালের কোন ভয়, আর না সফরের জন্য সাথে কোন সামগ্রী নেওয়ার প্রয়োজন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৯. অতঃপর তারা বলল, হে আমাদের রব! আমাদের সফরের মন্যিলের ব্যবধান বাড়িয়ে দিন। আর তারা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল। ফলে আমরা তাদেরকে কহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করলাম এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে, প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৯) কিন্তু ওরা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের সফরের বিশ্রামস্থান দূরে দূরে স্থাপন কর।’[1] এভাবে ওরা নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল। ফলে আমি ওদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করলাম[2] এবং ওদেরকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।[3] নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।
[1] অর্থাৎ, (ভ্রমণে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি বা বিপদ না এলে তাতে কোন মজা নেই --এই কথা স্মরণ করে তারা নিজেরাই প্রার্থনা করল যে,) যেমন মানুষ সফরের কষ্ট, সমস্যা এবং বিভিন্ন মৌসুমের নানা অসুবিধা ইত্যাদির বর্ণনা করে, অনুরূপ আমাদের জন্য ভ্রমণের দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যেন কাছাকাছি জনবসতি না হয়ে মাঝখানে জঙ্গল ও জনহীন প্রান্তর ও মরুভূমি বেয়ে আমাদেরকে পার হতে হয়, গ্রীষ্মের সময় রৌদ্রের কষ্ট এবং শীতের সময় বরফের ন্যায় ঠান্ডা হাওয়া আমাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলে এবং পথে ক্ষুৎ-পিপাসা ও মৌসুমের কঠিনতা থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে পাথেয়-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সাথে রাখতে হয়। তাদের এই দু’আ বানী-ইস্রাঈলের অনুরূপ ছিল, যারা কোন কষ্ট ও শ্রম ছাড়াই মান্ন্ ও সালওয়া (ইলাহী খানা) এবং আরো অন্যান্য সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু তারা সে সবের পরিবর্তে ডাল ও সবজি তরকারি ইত্যাদি পাওয়ার জন্য দু’আ করেছিল! তাদের এই দু’আ মৌখিক ছিল অথবা তাদের অবস্থা এ কথা বলেছিল।
[2] অর্থাৎ, তাদেরকে (সাবা’বাসীকে) এমনভাবে সর্বস্বান্ত করলাম যে, দুনিয়াতে তাদের বাগান ধ্বংসের কাহিনী প্রসিদ্ধ রয়ে গেল এবং মজলিস ও মহফিলের বক্তব্যের বিষয়রূপে পরিগণিত হল।
[3] অর্থাৎ, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম ও বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দিলাম। সুতরাং সাবাবাসীর প্রসিদ্ধ গোত্রগুলি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে লাগল, কেউ মদীনা কেউ মক্কা কেউ শাম এলাকায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২০. আর অবশ্যই তাদের সম্বন্ধে ইবলীস তার ধারণা সত্য প্রমাণ করল, ফলে তাদের মধ্যে একটি মুমিন দল ছাড়া সবাই তার অনুসরণ করল;
-
তাফসীরে জাকারিয়া(২০) তাদের উপর ইবলীস তার অনুমান সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল, ফলে ওদের মধ্যে একটি বিশ্বাসী দল ছাড়া সকলেই তার অনুসরণ করল;
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান