بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ১৭/ আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | Al-Isra | سورة الإسراء আয়াতঃ ১১১ মাক্কী
১৭ : ১১ وَ یَدۡعُ الۡاِنۡسَانُ بِالشَّرِّ دُعَآءَهٗ بِالۡخَیۡرِ ؕ وَ كَانَ الۡاِنۡسَانُ عَجُوۡلًا ﴿۱۱﴾
و یدع الانسان بالشر دعآءهٗ بالخیر و كان الانسان عجولا ﴿۱۱﴾
• আর মানুষ অকল্যাণের দোআ করে, যেমন তার দোআ হয় কল্যাণের জন্য। আর মানুষ তো তাড়াহুড়াপ্রবণ।

-আল-বায়ান

• মানুষ (তার নির্বুদ্ধিতার কারণে কল্যাণকর ভেবে) অকল্যাণ প্রার্থনা করে যেমনভাবে কল্যাণ প্রার্থনা করা উচিত। মানুষ বড়ই তাড়াহুড়াকারী।

-তাইসিরুল

• মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষতো অতি ত্বরাপ্রবণ।

-মুজিবুর রহমান

• And man supplicates for evil as he supplicates for good, and man is ever hasty.

-Sahih International

১১. আর মানুষ অকল্যাণ কামনা করে;(১) যেভাবে কল্যাণ কামনা করে; মানুষ তো প্রকৃতিগতভাবে খুব বেশী তাড়াহুড়াকারী।

১. মানুষ কিভাবে অকল্যাণ কামনা করে তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ যখন নিজের কোন কাজের উপর রাগ হয় বা সন্তান-সন্ততির উপর বিরক্ত হয় তখন তাদের জন্য বদ-দোআ করতে থাকে। বলতে থাকে, আমার ধ্বংস হোক, আমার পরিবার নাশ হোক ইত্যাদি। এ জাতীয় দো'আ করলেও তার মন কিন্তু সে দোআ কবুল হওয়া চায় না। আবার যখন নিজে খুব ভালো অবস্থায় থাকে, বা সন্তান-সন্ততির উপর খুশী হয়ে যায় তখন বড় বড় নেক দো'আ করতে থাকে। সে তখন এটা কবুল হওয়া মন-প্ৰাণ থেকেই চায়। [আদওয়াউল বায়ান]

কিন্তু আল্লাহ তাঁর রহমতের কারণে মানুষের নেক-দো'আ সমূহকে কবুল করে থাকেন আর বদ-দোআর জন্য সময় দেন। মানুষের এ তাড়াহুড়াকারী চরিত্রের কারণে যদি তিনি তাদের শাস্তি দিতেন তবে অনেকেই ক্ষতিগ্ৰস্ত হতো। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে তার নিজের ও সন্তান সন্ততির উপর বদ-দোআ করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা তোমাদের নিজের এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও তোমাদের কর্মচারীদের উপর বদ-দো'আ করো না।  অনুরূপভাবে তোমাদের সম্পদ নাশের জন্যও বদ-দো'আ করো না। কারণ এমন হতে পারে যে, আল্লাহর দো'আ কবুলের সময় তোমাদের এ বদ-দো'আগুলো সংঘটিত হয়ে যাবে আর তা কবুল হয়ে যাবে।” [আবু দাউদঃ ১৫৩২]

অন্য এক হাদীসে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ কষ্ট ও যাতনায় পড়ে কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আর যদি তাকে মৃত্যু কামনা করতেই হয়, তবে সে যেন বলেঃ “আয় আল্লাহ! যতদিন বেঁচে থাকাটা আমার জন্য মঙ্গলজনক হয় ততদিন আমাকে জীবিত রাখেন এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম হয়, তখন আমার মৃত্যু দেন।” [বুখারীঃ ৬৩৫১]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১১) মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে; বস্তুতঃ মানুষ শীঘ্রতা-প্রিয়।[1]

[1] মানুষ যেহেতু দ্রুততা প্রিয় এবং দুর্বল মনের তাই যখন সে কোন কষ্টের শিকার হয়, তখন ধ্বংসের জন্য ঐভাবে বদ্দুআ করে, যেভাবে কল্যাণের জন্য স্বীয় প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে। এটা তো প্রতিপালকের দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের বদ্দুআ কবুল করেন না। এই বিষয়টাই সূরা ইউনুসের ১১ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১২ وَ جَعَلۡنَا الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ اٰیَتَیۡنِ فَمَحَوۡنَاۤ اٰیَۃَ الَّیۡلِ وَ جَعَلۡنَاۤ اٰیَۃَ النَّهَارِ مُبۡصِرَۃً لِّتَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّكُمۡ وَ لِتَعۡلَمُوۡا عَدَدَ السِّنِیۡنَ وَ الۡحِسَابَ ؕ وَ كُلَّ شَیۡءٍ فَصَّلۡنٰهُ تَفۡصِیۡلًا ﴿۱۲﴾
و جعلنا الیل و النهار ایتین فمحونا ایۃ الیل و جعلنا ایۃ النهار مبصرۃ لتبتغوا فضلا من ربكم و لتعلموا عدد السنین و الحساب و كل شیء فصلنه تفصیلا ﴿۱۲﴾
• আর আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টো নিদর্শন। অতঃপর মুছে দিয়েছি রাতের নিদর্শন এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানতে পার। আর আমি প্রত্যেক বিষয় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি।

-আল-বায়ান

• আমি রাত আর দিনকে দু’টো নিদর্শন বানিয়েছি। আমি রাতের নিদর্শনটিকে জ্যোতিহীন করেছি, আর দিনের নিদর্শনটিকে করেছি আলোয় উজ্জ্বল যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার আর যাতে বছরের সংখ্যা আর হিসাব জানতে পার; আমি সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছি।

-তাইসিরুল

• আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টি নিদর্শন; রাতকে করেছি নিরালোক এবং দিনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার; এবং আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।

-মুজিবুর রহমান

• And We have made the night and day two signs, and We erased the sign of the night and made the sign of the day visible that you may seek bounty from your Lord and may know the number of years and the account [of time]. And everything We have set out in detail.

-Sahih International

১২. আর আমরা রাত ও দিনকে করেছি। দুটি নিদর্শন(১) তারপর রাতের নিদর্শনকে মুছে দিয়েছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকপ্ৰদ করেছি; যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যা ও হিসাব জানতে পার; আর আমরা সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।(২)

১. আমার একত্ববাদ ও আমার অপার ক্ষমতার উপর প্রমাণ। [এ ধরনের আয়াত আরো দেখুন, সূরা ফুসসিলাতঃ ৩৭, ইয়াসীনঃ ৩৭, ইউনুসঃ ৬, আল-মু'মিনূনঃ ৮০, আল বাকারাহঃ ১৬৪, আলে ইমরানঃ ১৯০, আন-নূরঃ ৪৪. আল-ফুরকানঃ ৬২, আল কাসাসঃ ৭৩, জাসিয়াঃ ৫]

২. আলোচ্য আয়াতে দিবারাত্রির পরিবর্তনকে আল্লাহ্ তাআলার অপার শক্তির নিদর্শন সাব্যস্ত করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, রাত্রিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং দিনকে উজ্জ্বল করার মধ্যে বহুবিধ তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। রাত্রিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার তাৎপর্য এখানে বর্ণনা করা হয়নি। অন্যান্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাত্রির অন্ধকার নিদ্রা ও আরামের জন্যে উপযুক্ত। আল্লাহ্ তাআলা এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, রাত্রির অন্ধকারেই প্রত্যেক মানুষ ও জন্তুর ঘুম আসে। সমগ্ৰ জগত একই সময়ে ঘুমায়।

যদি বিভিন্ন লোকের ঘুমের জন্যে বিভিন্ন সময় নির্ধারিত থাকত, তবে জাগ্রতদের হট্টগোলে ঘুমন্তদের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হত। এ আয়াতে দিনকে ঔজ্জ্বল্যময় করার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, দিনের আলোতে মানুষ রুযী অন্বেষণ করতে পারে। মেহনত, মজুরী, শিল্প ও কারিগরী সব কিছুর জন্যে আলো অত্যাবশ্যক। আয়াতে দ্বিতীয় আরেকটি কথা বলা হয়েছে তাহলো, দিবারাত্রির গমনাগমনের দ্বারা সন-বছরের সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। এটা মূলতঃ দিন-রাত্রি উভয়টিরই উপকারিতা।

উদাহরণতঃ ৩৬০ দিন পূর্ণ হলে একটি সন পূর্ণতা লাভ করে। এমনিভাবে অন্যান্য হিসাব-নিকাশও দিবারাত্রির গমনাগমনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দিবারাত্রির এই পরিবর্তন না হলে মজুরের মজুরী, চাকুরের চাকুরি এবং লেন-দেনের মেয়াদ নির্দিষ্ট করা সুকঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া দিন-রাত্রি পরিবর্তন না হলে মানুষের পক্ষে তাদের ইবাদতসমূহের হিসাব রাখাও সম্ভব হতো না। তারা হজ্জের, সাওমের, মেয়েদের ইদ্দতের, জুম'আ ইত্যাদির হিসাব পেত না। [আদওয়াউল বায়ান থেকে সংক্ষেপিত]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১২) আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দু’টি নিদর্শন ও রাত্রিকে করেছি আলোকহীন এবং দিবসকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার।[1] আর আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। [2]

[1] রাতকে আলোকহীন অর্থাৎ, অন্ধকার বানিয়েছি, যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পার এবং তোমাদের সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আর দিনকে বানিয়েছি আলোক-উজ্জ্বল যাতে তোমরা জীবিকা উপার্জন ও প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান কর। এ ছাড়াও রাত ও দিনের দ্বিতীয় আর এক লাভ হল, এইভাবে সপ্তাহ, মাস এবং বছরের হিসাব তোমরা গণনা করতে পারবে। আর এই হিসাবেরও রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা। যদি রাতের পরে দিন এবং দিনের পরে রাত না এসে সব সময়ই রাত অথবা দিন থাকত, তবে তোমরা আরাম ও স্বস্তি লাভের অথবা কাজকর্ম করার কোন সুযোগ পেতে না। অনুরূপ মাস ও বছরের হিসাব করাও সম্ভব হত না।

[2] অর্থাৎ, মানুষের জন্য দ্বীন এবং দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সব কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি। যাতে মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হয়ে স্বীয় দুনিয়াকে সুন্দর করে এবং আখেরাতকে স্মরণে রেখে তার জন্যও প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৩ وَ كُلَّ اِنۡسَانٍ اَلۡزَمۡنٰهُ طٰٓئِرَهٗ فِیۡ عُنُقِهٖ ؕ وَ نُخۡرِجُ لَهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ كِتٰبًا یَّلۡقٰىهُ مَنۡشُوۡرًا ﴿۱۳﴾
و كل انسان الزمنه طٓئرهٗ فی عنقهٖ و نخرج لهٗ یوم القیمۃ كتبا یلقىه منشورا ﴿۱۳﴾
• আর আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার ঘাড়ে সংযুক্ত করে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য আমি বের করব একটি কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত।

-আল-বায়ান

• আমি প্রত্যেক লোকের ভাগ্য তার কাঁধেই ঝুলিয়ে রেখেছি (অর্থাৎ তার ভাগ্যের ভাল-মন্দের কারণ তার নিজের মধ্যেই নিহিত আছে) আর ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য আমি এক কিতাব বের করব যাকে সে উন্মুক্ত অবস্থায় পাবে।

-তাইসিরুল

• প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামাত দিবসে আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত।

-মুজিবুর রহমান

• And [for] every person We have imposed his fate upon his neck, and We will produce for him on the Day of Resurrection a record which he will encounter spread open.

-Sahih International

১৩. আর প্রত্যেক মানুষের কাজ আমরা তার গ্ৰীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমরা তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত।(১)

১. আয়াতে উল্লেখিত طائر শব্দটির অর্থ করা হয়েছে, কাজ। মূলতঃ এ শব্দটির দুটি অর্থ হতে পারে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

এক. মানুষের তাকদীর বা তার জন্য আল্লাহর পূর্বলিখিত সিদ্ধান্ত। মানুষ দুনিয়াতে যা-ই করুক না কেন সে অবশ্যই তার তাকদীর অনুসারেই করবে। কিন্তু মানুষ যেহেতু জানে না তার তাকদীরে কি লিখা আছে তাই তার উচিত ভালো কাজ করতে সচেষ্ট থাকা। কারণ, যাকে যে কাজের জন্য তৈরী করা হয়েছে এবং যাকে যেখানে যাওয়ার জন্য নির্ধারন করা হয়েছে। সে সমস্ত কাজ করা তার জন্য সহজ করে দেয়া হবে। সুতরাং তাকদীরের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ কারো নেই কিন্তু মানুষের উচিত নিজেকে ভালো ও সৎকাজের জন্য সদাপ্রস্তুত রাখা তাহলে বুঝা যাবে যে, তার তাকদীরে ভালো আছে এবং সেটা করতে সে সমর্থও হবে। পক্ষান্তরে যারা দুর্ভাগা তারা ভালো কাজ করার পরিবর্তে তকদীরে কি আছে সেটা খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সেটার পিছনে দৌড়াতে থাকে।

ফলে সে ভালো কাজ করার সুযোগ পায় না। তাই যারা ভালো কাজ করে এবং ভালো কাজ করার প্রয়াসে থাকে তাদের কর্মকাণ্ড আল্লাহর কাছে এমন প্রশংসিত হয়ে থাকে যে, যদি কোন কারণে সে ভালো কাজ করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও সেটা করতে সমর্থ না হয় তবুও আল্লাহ তার জন্য সেটার সওয়াব লিখে দেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রতিদিনের সুনির্দিষ্ট কাজের উপরই আল্লাহ তা’আলা বান্দার শেষ লিখেন তারপর যখন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন ফেরেশতাগণ বলে, হে আমাদের প্রভু! আপনার অমুক বান্দাকে তো আপনি (ভালো কাজ করা থেকে) বাধা দিলেন। তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ তাকে তার পূর্ব কাজের অনুরূপ শেষ পরিণতি লিখ, যতক্ষন সে সুস্থ না হবে বা মারা না। যাবে।” [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৬৪১]

দুই. মানুষের কাজ বা তার আমলনামা। অৰ্থাৎ মানুষ যে কোন জায়গায় যে কোন অবস্থায় থাকুক, তার আমলনামা তার সাথে থাকে এবং তার আমল লিপিবদ্ধ হতে থাকে। মৃত্যুর পর তা বন্ধ করে রেখে দেয়া হয়। কেয়ামতের দিন এ আমলনামা প্রত্যেকের হাতে হাতে দিয়ে দেয়া হবে, যাতে নিজে পড়ে নিজেই মনে মনে ফয়সালা করে নিতে পারে যে, সে পুরস্কারের যোগ্য, না আযাবের যোগ্য। [আত তাফসীরুস সহীহ]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৩) প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি[1] এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে উন্মুক্ত পাবে।

[1] طَائِرٌ এর অর্থ হল পাখী। আর عُنُقٌ এর অর্থ হল ঘাড়। ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) এখানে طَائِرٌ এর অর্থ নিয়েছেন, মানুষের আমল। আর فِي عُنُقِهِ বলতে তার সেই ভাল ও মন্দ আমল, যার ভাল অথবা মন্দ প্রতিদান তাকে দেওয়া হবে। গলার হারের মত তার সাথে থাকবে। অর্থাৎ, তার সমস্ত আমল লিখা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ এই লিখিত জিনিস সুরক্ষিত থাকবে। কিয়ামতের দিন এই অনুযায়ী তার বিচার-ফায়সালা হবে। আর ইমাম শাওকানী طَائِرٌ এর অর্থ করেছেন, মানুষের ভাগ্য। যা মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের আলোকে প্রথমেই লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। যার সৌভাগ্যবান ও আল্লাহর অনুগত হওয়ার ছিল, তা আল্লাহর জানা ছিল এবং যার অবাধ্য হওয়ার ছিল, তাও তাঁর জানা ছিল। এই ভাগ্যই (সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য) প্রত্যেক মানুষের সাথে গলার হারের মত লেগে আছে। সেই অনুযায়ী হবে তার আমল এবং কিয়ামতের দিন সেই অনুযায়ীই হবে তার ফায়সালা।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৪ اِقۡرَاۡ كِتٰبَكَ ؕ كَفٰی بِنَفۡسِكَ الۡیَوۡمَ عَلَیۡكَ حَسِیۡبًا ﴿ؕ۱۴﴾
اقرا كتبك كفی بنفسك الیوم علیك حسیبا ﴿۱۴﴾
• পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট।

-আল-বায়ান

• (তাকে বলা হবে) ‘পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তোমার হিসাব নেয়ার ব্যাপারে তুমিই যথেষ্ট।’

-তাইসিরুল

• (আমি বলব) তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব নিকাশের জন্য যথেষ্ট।

-মুজিবুর রহমান

• [It will be said], "Read your record. Sufficient is yourself against you this Day as accountant."

-Sahih International

১৪. তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসেব-নিকেশের জন্য যথেষ্ট।(১)

১. হাসান বসরী রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি তোমার হিসাবের ভার তোমার কাছেই অৰ্পণ করেছেন তিনি অবশ্যই তোমার সাথে সবচেয়ে বড় ইনসাফের কাজ করেছেন।” [ইবন কাসীর] কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ সেদিন সবাই তাদের আমলনামা পড়তে পারবে। যদিও সে দুনিয়াতে নিরক্ষর ছিল। [তাবারী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৪) (তাকে বলা হবে,) ‘তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৫ مَنِ اهۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَهۡتَدِیۡ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡهَا ؕ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ وَ مَا كُنَّا مُعَذِّبِیۡنَ حَتّٰی نَبۡعَثَ رَسُوۡلًا ﴿۱۵﴾
من اهتدی فانما یهتدی لنفسهٖ و من ضل فانما یضل علیها و لا تزر وازرۃ وزر اخری و ما كنا معذبین حتی نبعث رسولا ﴿۱۵﴾
• যে হিদায়াত গ্রহণ করে, সে তো নিজের জন্যই হিদায়াত গ্রহণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের (স্বার্থের) বিরুদ্ধেই পথভ্রষ্ট হয়। আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। আর রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি আযাবদাতা নই।

-আল-বায়ান

• যে সঠিক পথে চলবে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে চলবে, আর যে গুমরাহ হবে তার গুমরাহীর পরিণাম তার নিজের উপরেই পড়বে। কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। আমি ‘আযাব দেই না যতক্ষণ একজন রসূল না পাঠাই।

-তাইসিরুল

• যারা সৎ পথ অবলম্বন করবে তারাতো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য তা অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে তারাতো পথভ্রষ্ট হবে নিজেদেরই ধ্বংসের জন্য এবং কেহ অন্য কারও ভার বহন করবেনা; আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কেহকেও শাস্তি দিইনা।

-মুজিবুর রহমান

• Whoever is guided is only guided for [the benefit of] his soul. And whoever errs only errs against it. And no bearer of burdens will bear the burden of another. And never would We punish until We sent a messenger.

-Sahih International

১৫. যে সৎপথ অবলম্বন করবে। সে তো নিজেরই মঙ্গলের জন্য সৎপথ অবলম্বন করে এবং যে পথভ্রষ্ট হবে সে তো পথভ্রষ্ট হবে নিজেরই ধ্বংসের জন্য।(১) আর কোন বহনকারী অন্য কারো ভার বহন করবে না।(২) আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত শাস্তি প্রদানকারী নই।(৩)

১. অর্থাৎ সৎ ও সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন করে কোন ব্যক্তি আল্লাহ, রসূল বা সংশোধন প্রচেষ্টা পরিচালনাকারীদের প্রতি কোন অনুগ্রহ করে না বরং সে তার নিজেরই কল্যাণ করে। অনুরূপভাবে ভুল পথ অবলম্বন করে অথবা তার উপর অনড় থেকে কোন ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে না, নিজেরই ক্ষতি করে। [আদওয়াউল বায়ান] আল্লাহর রাসূল ও সত্যের আহবায়কগণ মানুষকে ভুল পথ থেকে বাঁচাবার এবং সঠিক পথ দেখাবার জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তা নিজের কোন স্বার্থে নয়, বরং মানবতার কল্যাণার্থেই চালান। কুরআনের অন্যত্রও আল্লাহ তা'আলা তা বলেছেন, যেমন, “যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। আপনার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন।” [সূরা ফুসসিলাত: ৪৬; সূরা আল-জাসিয়াহ: ১৫]

আরও বলেন, “যে কুফরী করে কুফরীর শাস্তি তারই প্রাপ্য; আর যারা সৎকাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখশয্যা।” [সূরা আর-রূম: ৪৪] আরও বলেন, “অবশ্যই তোমাদের রব এর কাছ থেকে তোমাদের কাছে চাক্ষুষ প্রমাণাদি এসেছে। অতঃপর কেউ চক্ষুষ্মান হলে সেটা দ্বারা সে নিজেই লাভবান হবে, আর কেউ অন্ধ সাজলে তাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে। আর আমি তোমাদের উপর সংরক্ষক নই।” [সূরা আল-আনআম: ১০৪] আরও বলেন, “যে সৎপথ অবলম্বন করে সে তা করে নিজেরই কল্যাণের জন্য এবং যে বিপথগামী হয় সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য আর আপনি তাদের তত্ত্বাবধায়ক নন।” [সুরা আয-যুমার: ৪১]

২. এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য। কুরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটি বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ এটি না বুঝা পর্যন্ত মানুষের কার্যধারা কখনো সঠিক নিয়মে চলতে পারে না। এ বাক্যের অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যক্তিগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি তার সাথে শরীক নেই। তবে অন্যত্র যে বলা হয়েছে, “ওরা নিজেদের ভার বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা” [সূরা আল-আনকাবূত: ১৩] এবং আরও যে এসেছে, “ফলে কিয়ামতের দিন তারা বহন করবে তাদের পাপের বোঝা পূর্ণ মাত্রায় এবং তাদেরও পাপের বোঝা যাদেরকে তারা অজ্ঞতাবশত বিভ্ৰান্ত করেছে”। [সূরা আন-নাহল: ২৫]

আয়াতদ্বয় এ আয়াতে বর্ণিত মৌলিক সত্যের বিরোধী নয়। কারণ তারা খারাপ কাজের প্রতি মানুষকে আহবান করে তাদের নিজেদেরকেই কলুষিত করেছে। তাই তারা অন্যের বোঝাকে নিজেদের বোঝা হিসেবে বহন করবে। অন্যের বোঝা হিসেবে বহন করবে না। এটা বান্দাদের সাথে আল্লাহর রহমত ও ইনসাফেরই বহিঃপ্রকাশ [দেখুন, ইবন কাসীর]

৩. তবে এ ধরনের আয়াত পড়ে যাদের কাছে কোন নবীর পয়গাম পৌঁছেনি। তাদের অবস্থান কোথায় হবে, এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির চিন্তা করা উচিত, তার নিজের কাছে তো পয়গাম পৌঁছে গেছে, এখন তার অবস্থা কি হবে? আর অন্যের ব্যাপারে বলা যায়, কার কাছে, কবে, কিভাবে এবং কি পরিামাণ আল্লাহর পয়গাম পৌছেছে এবং সে তার সাথে কি আচরণ করেছে এবং কেন করেছে। তা আল্লাহই ভালো জানেন। আলেমুল গায়েব ছাড়া কেউ বলতে পারেন না। কার উপর আল্লাহর প্রমাণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কার উপর হয়নি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস'আলা হলো, নাবালক বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের কি হুকুম হবে? এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথা হলো এই যে, মুমিনদের সন্তানগণ জান্নাতি হবে। কিন্তু কাফের মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে আলেমগণ বিভিন্ন হাদীসের কারণে সর্বমোট চারটি মতে বিভক্ত হয়েছেঃ

১. তারা জান্নাতে যাবে। এ মতের সপক্ষে তারা এ আয়াত এবং সহীহ বুখারীর এক হাদীস [৪০৪৭] দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন। অনুরূপ কিছু হাদীস মুসনাদে আহমাদ [৫/৫৮] ও মাজমাউয-যাওয়ায়েদ [৭/২১৯] ও এসেছে।

২. তাদের সম্পর্কে কোন কিছু বলা যাবে না। এ মতের সপক্ষেও সহীহ বুখারীর এক হাদীস [৩৮৩১, ৪৮৩১] থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

৩. তারা তাদের পিতাদের অনুগমণ করবে। [মুসনাদে আহমদে [৬/৪৮] বর্ণিত হাদীস থেকে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়।

৪. তাদেরকে হাশরের মাঠে পরীক্ষা করা হবে। সে পরীক্ষায় যারা পাশ করবে তারা হবে জান্নাতি। আর পাশ না করলে হবে জাহান্নামি। এ মতটি সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য মত। এ ব্যাপারে মুসনাদে আহমাদের [৪/২৪] এক হাদীস থেকে প্রমাণ পাই। সত্যান্বেষী আলেমগণ এ মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবন কাসীর এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৫) যারা সৎপথ অবলম্বন করবে, তারা তো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্যই সৎপথ অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে, তারা নিজেদেরই ধ্বংসের জন্যই হবে এবং কেউ অন্য কারো ভার বহন করবে না।[1] আর আমি রসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না। [2]

[1] অবশ্য যে নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকেও ‎ভ্রষ্ট করবে, সে নিজের ভ্রষ্টতার বোঝার সাথে সাথে যাদেরকে সে স্বীয় প্রচেষ্টায় ভ্রষ্ট করেছে, তাদের গুনাহের বোঝাও (তাদের গুনাহতে কোন কমতি না করেই) তাকে বহন করতে হবে। এ কথা কুরআনের অন্য কয়েকটি স্থানে এবং বহু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আর প্রকৃতপক্ষে এটা হবে তাদেরই গুনাহের বোঝা যা অন্যদেরকে ভ্রষ্ট করে তারা অর্জন করেছে।

[2] কোন কোন মুফাসসির এ থেকে কেবল পার্থিব শাস্তিকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, আখেরাতের আযাব থেকে স্বতন্ত্র হবে না। কিন্তু কুরআনে কারীমের অন্যান্য আয়াত থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমাদের কাছে কি আমার রসূল আসেনি? তারা ইতিবাচক উত্তর দিবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রসূল প্রেরণ এবং গ্রন্থ অবতরণ ছাড়া তিনি কাউকে আযাব দেবেন না। তবে কোন্ জাতি বা কোন্ ব্যক্তির কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছেনি, সে ফায়সালা কিয়ামতের দিন তিনিই করবেন। সেখানে অবশ্যই কারো সাথে অবিচার করা হবে না। বধির, পাগল, নির্বোধ এবং দুই নবীর মধ্যবর্তী যুগে মৃত্যুবরণকারী (যাদের নিকট দ্বীনের খবর একেবারেই অজানা সেই) ব্যক্তিদের ব্যাপারও অনুরূপ। এদের ব্যাপারে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাদের প্রতি ফিরিশতা পাঠাবেন এবং ফিরিশতারা তাদেরকে বলবেন যে, ‘জাহান্নামে প্রবেশ কর।’ অতএব তারা যদি আল্লাহর এই নির্দেশকে মেনে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করে যায়, তাহলে জাহান্নাম তাদের জন্য ফুল বাগান হয়ে যাবে। অন্যথা তাদেরকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসনাদ আহমদ ৪/২৪, ইবনে হিব্বান ৯/২২৬, সহীহুল জামে’ ৮৮১নং) মুসলিম শিশুরা জান্নাতে যাবে। তবে কাফের ও মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে নীরব থেকেছেন। কেউ কেউ জান্নাতে যাওয়ার এবং জাহান্নামে যাওয়ার অভিমত পেশ করেছেন। ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন, হাশরের মাঠে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। যারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করবে, তারা জান্নাতে এবং যারা অবাধ্যতা করবে, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তিনি (ইবনে কাসীর) এই উক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, এর ফলে পরস্পর বিরোধী বর্ণনাগুলোর মধ্যে সম¦বয় সাধন করা যায়। (বিস্তারিত জানার জন্য তাফসীর ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য) তবে সহীহ বুখারীর বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুশরিকদের শিশুরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে।

(দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী ৩/২৫৭, ১২/৩৪৮ ফাতহুল বারী সহ)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৬ وَ اِذَاۤ اَرَدۡنَاۤ اَنۡ نُّهۡلِكَ قَرۡیَۃً اَمَرۡنَا مُتۡرَفِیۡهَا فَفَسَقُوۡا فِیۡهَا فَحَقَّ عَلَیۡهَا الۡقَوۡلُ فَدَمَّرۡنٰهَا تَدۡمِیۡرًا ﴿۱۶﴾
و اذا اردنا ان نهلك قریۃ امرنا مترفیها ففسقوا فیها فحق علیها القول فدمرنها تدمیرا ﴿۱۶﴾
• আর যখন আমি কোন জনপদ ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন তার সম্পদশালীদেরকে (সৎকাজের) আদেশ করি। অতঃপর তারা তাতে সীমালঙ্ঘন করে। তখন তাদের উপর নির্দেশটি সাব্যস্ত হয়ে যায় এবং আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।

-আল-বায়ান

• আমি যখন কোন জনবসতিকে ধ্বংস করতে চাই তখন তাদের সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি (আমার আদেশ মেনে চলার জন্য)। কিন্তু তারা অবাধ্যতা করতে থাকে। তখন সে জনবসতির প্রতি আমার ‘আযাবের ফায়সালা সাব্যস্ত হয়ে যায়। তখন আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দেই।

-তাইসিরুল

• যখন আমি কোন জনপদ ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন ওর সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে সৎ কাজ করতে আদেশ করি, কিন্তু তারা সেখানে অসৎ কাজ করে। অতঃপর ওর প্রতি দন্ডাজ্ঞা ন্যায় সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমি ওটাকে সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত করি।

-মুজিবুর রহমান

• And when We intend to destroy a city, We command its affluent but they defiantly disobey therein; so the word comes into effect upon it, and We destroy it with [complete] destruction.

-Sahih International

১৬. আর আমরা যখন কোন জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন সেখানকার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি।(১), ফলে তারা সেখানে অসৎকাজ করে (২); অতঃপর সেখানকার প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমরা তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।(৩)

১. এ আয়াতে ব্যবহৃত أمرنا শব্দটির অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছেঃ

১) এখানে أمرنا শব্দের অর্থ, নির্দেশ। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, “সেখানকার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে আদেশ করি ফলে তারা সেখানে অসৎকাজ করে” কিন্তু প্রশ্ন হলো, আল্লাহ্ তা'আলা কিভাবে খারাপ কাজের নির্দেশ করেন? তাই এ অর্থ নেয়া হলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তার সমাধানে আলেমগণ কয়েকটি দিকনির্দেশ করেছেনঃ এক. এখানে ‘নির্দেশ’ মানে প্রকৃতিগত নির্দেশ ও প্রাকৃতিক বিধান। অর্থাৎ প্রকৃতিগত ভাবে সবসময় এমনটিই হয়ে থাকে। যখন কোন জাতির ধ্বংস হবার সময় এসে যায়, তার সমৃদ্ধিশালী লোকেরা ফাসেক হয়ে যায়।

আর ধ্বংস করার সংকল্প মানে এ নয় যে, আল্লাহ এমনিতেই বিনা কারণে কোন নিরপরাধ জনবসতি ধ্বংস করার সংকল্প করে নেন, বরং এর মানে হচ্ছে, যখন কোন জনবসতি অসৎকাজের পথে এগিয়ে যেতে থাকে এবং আল্লাহ তাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তখন এ সিদ্ধান্তের প্রকাশ এ পথেই হয়ে থাকে। দুই. এখানে নির্দেশ দেয়ার অর্থ অসৎকাজের নির্দেশ নয়। বরং এখানে একটি বাক্য উহ্য আছে। তাহলে, “সেখানকার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে সৎকাজের নির্দেশ করি কিন্তু তারা অসৎকাজে লিপ্ত হলে আমি তাদেরকে ধ্বংস করি।” তখন এ নির্দেশটি শরয়ী নির্দেশ বলে বিবেচিত হবে। [ইবন কাসীর]

২) ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি أمرنا শব্দের অর্থ করেছেন سلطان তখন অর্থ হবে, যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করতে চাই তখন তাদের উপর খারাপ লোকদের ক্ষমতায়ন করি ফলে তারা সেখানে আমার নাফরমানী করার কারণে তাদেরকে আমি ধ্বংস করি। [ইবন কাসীর]

৩) হাসান, কাতাদা সহ আরও অনেকে বলেন, أمرنا অর্থ بعثنا অৰ্থাৎ তাদের উপর এমন খারাপ লোকদের চড়াও করি যাতে তারা ধ্বংস হওয়ার কাজ করে। ফলে তাদের আমি ধ্বংস করি। [ফাতহুল কাদীর]

৪) ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এখানে أمرنا অর্থ أكثرنا অর্থাৎ তাদের মধ্যে আমি আধিক্য দান করি। ফলে আল্লাহকে ভুলে যায় এবং নাফরমানী করতে থাকে যাতে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। জাহেলিয়াতের যুগে যখন কোন গোত্রের লোক বেড়ে যেত এবং শক্তি বৃদ্ধি পেত তখন বলা হতো, أَمِرَ بَنُوْ فُلَانٍ সে হিসেবে এখানেও একই অর্থ নেয়া হবে। [বুখারীঃ ৪৭১১]

২. আয়াতে বিশেষভাবে অবস্থাপন্ন ধনীদের কথা উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জনসাধারণ স্বাভাবিকভাবেই বিত্তশালী ও শাসক-শ্রেণীর চরিত্র ও কর্মের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এরা কুকর্মপরায়ণ হলে সমগ্র জাতি কুকর্মপরায়ণ হয়ে যায়। তাই আল্লাহ্ তাআলা যাদেরকে ধন-দৌলত দান করেন, কর্ম ও চরিত্রের সংশোধনের প্রতি তাদের অধিকতর যত্নবান হওয়া উচিত। এমন হওয়া উচিত নয় যে, তারা বিলাসিতায় পড়ে কর্তব্য ভুলে যাবে এবং তাদের কারণে সমগ্র জাতি ভ্ৰান্ত পথে পরিচালিত হবে।

এমতাবস্থায় সমগ্র জাতির কুকর্মের শাস্তিও তাদেরকে ভোগ করতে হবে। তাছাড়া যখন কোন জাতির লোকেরা খারাপ কাজ করে এবং অন্যান্যরা সেটাতে বাধা না দেয় তখন তারা হয় সেটায় রাজি আছে হিসেবে অথবা তার বিরোধিতা না করার কারণে শাস্তি লাভ করে। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আমাদের মধ্যে সৎ লোকগণ থাকা অবস্থায়ও আমরা কি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবো?” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যা, যখন খারাপের পরিমান বৃদ্ধি পায়”। [মুসলিমঃ ২৮৮০]

৩. আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে এরূপ সন্দেহের অবকাশ ছিল যে, তাদেরকে ধ্বংস করাই ছিল আল্লাহ্ তা'আলার উদ্দেশ্য। তাই প্ৰথমে তাদেরকে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে ঈমান ও আনুগত্যের আদেশ দেয়া অতঃপর তাদের পাপাচারকে আযাবের কারণ বানানো এসব তো আল্লাহ তা’আলারই পক্ষ থেকে হয়। এমতাবস্থায় বেচারাদের দোষ কি? তারা তো অপারগ ও বাধ্য। এর জওয়াব হলো, আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছা শক্তি দান করেছেন এবং আযাব ও সওয়াবের পথ সুস্পষ্টভাবে বাতলে দিয়েছেন। কেউ যদি স্বেচ্ছায় আযাবের পথে চলারই ইচ্ছা ও সংকল্প গ্রহণ করে, তবে আল্লাহর রীতি এই যে, তিনি তাকে সেই আযাবের উপায় উপকরণাদি সরবরাহ করে দেন।

কাজেই আযাবের আসল কারণ স্বয়ং তাদের কুফরী ও গোনাহের সংকল্প। তাই তারা ক্ষমার যোগ্য হতে পারে না। এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, গোনাহ যদি সমৃদ্ধশালীরা করে থাকে, তবে তার জন্য সাধারণ জনসাধারণ কেন শাস্তি ভোগ করবে? এর দু'টি উত্তর হতে পারে। এক. যারা সমৃদ্ধশালী নয় তারা সমৃদ্ধশালীদেরই অনুগামী থাকে। সেজন্য তারা তাদের মতই শাস্তি ভোগ করবে। এখানে সমৃদ্ধশালীদের উল্লেখ এজন্যে করা হয়েছে যে, সাধারণত: এরাই নেতা গোছের লোক হয়ে থাকে। দুই. তাদের কেউ যেহেতু অন্যায় করেছিল। অন্যরা তাতে বাধা দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তারা যেহেতু তা করেনি। সুতরাং তারাও সমান দোষে দোষী। [আদওয়াউল বায়ান; সংক্ষেপিত]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৬) যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন ওর সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদেরকে (সৎকর্ম করতে) আদেশ করি, অতঃপর তারা সেথায় অসৎকর্ম করে; ফলে ওর প্রতি দন্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং ওটাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি। [1]

[1] এখানে সেই মূল নীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে, যার ভিত্তিতে জাতির বিনাশ সাধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর তা হল এই যে, তাদের সচ্ছল ও ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিরা আল্লাহর আদেশ লংঘন ও নির্দেশাবলী অমান্য করতে আরম্ভ করে এবং এদের দেখাদেখি অন্যরাও তা-ই করতে শুরু করে দেয়, আর এইভাবে এই জাতির মধ্যে আল্লাহর অবাধ্যতা ব্যাপক হয়ে যায়। ফলে তারা শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৭ وَ كَمۡ اَهۡلَكۡنَا مِنَ الۡقُرُوۡنِ مِنۡۢ بَعۡدِ نُوۡحٍ ؕ وَ كَفٰی بِرَبِّكَ بِذُنُوۡبِ عِبَادِهٖ خَبِیۡرًۢا بَصِیۡرًا ﴿۱۷﴾
و كم اهلكنا من القرون من بعد نوح و كفی بربك بذنوب عبادهٖ خبیرا بصیرا ﴿۱۷﴾
• আর নূহের পর আমি কত প্রজন্ম ধ্বংস করেছি! তোমার রব তাঁর বান্দাদের পাপের ব্যাপারে পূর্ণ অবহিত ও সর্বদ্রষ্টা হিসেবে যথেষ্ট।

-আল-বায়ান

• নূহের পর বহু বংশধারাকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, বান্দাদের পাপকাজের খবর রাখা আর লক্ষ্য রাখার জন্য তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।

-তাইসিরুল

• নূহের পর আমি কত মানবগোষ্ঠী ধ্বংস করেছি। তোমার রাব্বই তাঁর দাসদের পাপাচারণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট।

-মুজিবুর রহমান

• And how many have We destroyed from the generations after Noah. And sufficient is your Lord, concerning the sins of His servants, as Acquainted and Seeing.

-Sahih International

১৭. আর নূহের পর আমরা বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি এবং আপনার রবই তার বান্দাদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট।(১)

১. আয়াত থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, এখানে মক্কার কাফের মুশরিক এবং তাদের মত অন্যান্যদেরকে কঠোর সতর্কবাণী শোনানো হচ্ছে, তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে যে, যেভাবে নূহ ও অন্যান্য জাতির অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ্ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন তেমনিভাবে এদেরকেও সে পরিণতির সম্মুখিন হতে হবে। আয়াতের শেষে এমন এক সতর্কবাণী উচ্চারন করা হয়েছে যা চিন্তা করলে যে কোন খারাপ লোক তার যাবতীয় কুকর্ম থেকে বিরত হতে বাধ্য হবে। সেখানে বলা হয়েছে যে, আপনার প্রতিপালকই তাঁর বান্দাদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট। কেউ যদি আল্লাহকে সদা সর্বদা এ বিশ্বাসের সাথে খেয়াল রাখে যে, তিনি তাকে দেখছেন, জানছেন, তাহলে অবশ্যই খারাপ কাজ করার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা করবে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৭) নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি।[1] তোমার প্রতিপালকই তাঁর দাসদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট।

[1] তারাও ধ্বংসের এই মূল নীতির আওতায় পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৮ مَنۡ كَانَ یُرِیۡدُ الۡعَاجِلَۃَ عَجَّلۡنَا لَهٗ فِیۡهَا مَا نَشَآءُ لِمَنۡ نُّرِیۡدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهٗ جَهَنَّمَ ۚ یَصۡلٰىهَا مَذۡمُوۡمًا مَّدۡحُوۡرًا ﴿۱۸﴾
من كان یرید العاجلۃ عجلنا لهٗ فیها ما نشآء لمن نرید ثم جعلنا لهٗ جهنم یصلىها مذموما مدحورا ﴿۱۸﴾
• যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়।

-আল-বায়ান

• যে কেউ নগদ নগদ পেতে চায় তাকে আমি এখানেই জলদি করে দিয়ে দেই যাকে যা দিতে ইচ্ছে করি, অবশেষে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। তাতে সে জ্বলবে ধিকৃত ও রহমাত বঞ্চিত অবস্থায়।

-তাইসিরুল

• কেহ পার্থিব সুখ সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত অবস্থায়।

-মুজিবুর রহমান

• Whoever should desire the immediate - We hasten for him from it what We will to whom We intend. Then We have made for him Hell, which he will [enter to] burn, censured and banished.

-Sahih International

১৮. কেউ আশু সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমরা যাকে যা ইচ্ছে এখানেই সত্বর দিয়ে থাকি(১); পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি যেখানে সে শাস্তিতে দগ্ধ হবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায়।(২)

১. অর্থাৎ যারা শুধু দুনিয়াতেই নগদ পেতে চায়, আমি তাদেরকে নগদই দান করি। তবে সেজন্য দুটি শর্ত রয়েছে। একটি শর্ত হচ্ছে, আমি যতটুকু ইচ্ছা করি, ততটুকুই দান করি, তাদের চেষ্টা বা চাহিদা মোতাবেক দান করা আবশ্যক নয়। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, আমার হেকমত অনুসারে যাকে সমীচীন মনে করি, শুধু তাকেই নগদ দান করি। সবাইকে দিতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। এ আয়াতটি এ জাতীয় যত আয়াতে শর্তহীনভাবে দেয়ার কথা আছে সবগুলোর জন্য শর্ত আরোপ করে দিয়েছে। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

২. এর অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আখেরাতে বিশ্বাস করে না অথবা আখেরাত পর্যন্ত সবর করতে প্ৰস্তুত নয় এবং শুধুমাত্র দুনিয়া এবং দুনিয়াবী সাফল্য ও সমৃদ্ধিকেই নিজের যাবতীয় প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে, সে যা কিছু পাবে এ দুনিয়াতেই পাবে। আখেরাতে সে কিছুই পেতে পারে না। কারণ সে দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিয়েছে, সুতরাং সে আখেরাতের জন্য কিছুই করেনি। সুতরাং সে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৮) কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি, পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায়। [1]

[1] অর্থাৎ, প্রত্যেক দুনিয়া কামনাকারী দুনিয়া পায় না। দুনিয়া কেবল সেই পায়, যাকে আমি দেওয়ার ইচ্ছা করি। আর সেও ততটা দুনিয়া পায় না, যতটা সে চায়, বরং ততটাই সে পায়, যতটা তাকে দেওয়ার ফায়সালা আমি করি। তবে (আখেরাত বর্জন করে) এই দুনিয়া কামনার ফল হবে জাহান্নামের চিরন্তন আযাব ও লাঞ্ছনা ভোগ।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ১৯ وَ مَنۡ اَرَادَ الۡاٰخِرَۃَ وَ سَعٰی لَهَا سَعۡیَهَا وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِكَ كَانَ سَعۡیُهُمۡ مَّشۡكُوۡرًا ﴿۱۹﴾
و من اراد الاخرۃ و سعی لها سعیها و هو مؤمن فاولٓئك كان سعیهم مشكورا ﴿۱۹﴾
• আর যে আখিরাত চায় এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়, তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য।

-আল-বায়ান

• আর যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে আর তার জন্য চেষ্টা করে যতখানি চেষ্টা করা দরকার আর সে মু’মিনও, এরাই হল তারা যাদের চেষ্টা সাধনা সাদরে গৃহীত হবে।

-তাইসিরুল

• যারা বিশ্বাসী হয়ে পরকাল কামনা করে এবং ওর জন্য যথাযথ চেষ্টা করে তাদের প্রচেষ্টাসমূহ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে।

-মুজিবুর রহমান

• But whoever desires the Hereafter and exerts the effort due to it while he is a believer - it is those whose effort is ever appreciated [by Allah].

-Sahih International

১৯. আর যারা মুমিন হয়ে আখিরাত কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টা পুরস্কারযোগ্য।(১)

১. মুমিন যখনই যে কাজে আখেরাতের ইচ্ছা ও নিয়ত করবে, তার সেই কাজ গ্রহণযোগ্য হবে; যদিও তার কোন কোন কাজের নিয়তে মন্দ মিশ্রিত হয়ে যায়। এ অবস্থাটি হচ্ছে মুমিনের। তার যে কৰ্ম খাঁটি নিয়ত সহকারে অন্যান্য শর্তনুযায়ী হবে, তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং যে কর্ম এরূপ হবে না, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ আয়াতে চেষ্টা ও কর্মের সাথে سعيها শব্দযোগ করে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক কর্ম ও চেষ্টা কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে গ্ৰহণযোগ্য হয় না; বরং সেটিই ধর্তব্য হয়, যা আখেরাতের লক্ষ্যের উপযোগী।

উপযোগী হওয়া না হওয়া শুধু আল্লাহ ও রাসূলের বর্ণনা দ্বারাই জানা যেতে পারে। তাই তাকে সে কাজটি সুন্নাত অনুযায়ীই করতে হবে। কাজেই যে সৎকর্ম মনগড়া পন্থায় করা হয়- সাধারণ বেদআতী পন্থাও এর অন্তর্ভুক্ত, তা দৃশ্যতঃ যতই সুন্দর ও উপকারী হোক না কেন- আখেরাতের জন্যে উপযোগী নয়। তাই সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং আখেরাতেও কল্যাণকর নয়। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৯) যারা বিশ্বাসী হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, তাদেরই চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। [1]

[1] মহান আল্লাহর কাছে মূল্যায়নের জন্য তিনটি জিনিস এখানে বর্ণিত হয়েছে। (ক) আখেরাত কামনা। অর্থাৎ, কর্মে ইখলাস থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। (খ) যথাযথ প্রচেষ্টা করা। অর্থাৎ, সুন্নাহ অনুযায়ী কর্ম করা। (গ) ঈমান থাকা। কেননা, এ ছাড়া কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ, আমল কবুল হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে সাথে তাতে ইখলাস থাকা এবং সুন্নাহ অনুযায়ী সে আমল সম্পাদিত হওয়া জরুরী। (অন্য কথায়, প্রত্যেক আমল কবুল হওয়ার ভিত্তি হল ঈমান এবং ইখলাস ও মুহাম্মাদী তরীকা হল তার শর্ত। -সম্পাদক)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
১৭ : ২০ كُلًّا نُّمِدُّ هٰۤؤُلَآءِ وَ هٰۤؤُلَآءِ مِنۡ عَطَآءِ رَبِّكَ ؕ وَ مَا كَانَ عَطَـآءُ رَبِّكَ مَحۡظُوۡرًا ﴿۲۰﴾
كلا نمد هؤلآء و هؤلآء من عطآء ربك و ما كان عطـآء ربك محظورا ﴿۲۰﴾
• এদের ও ওদের প্রত্যেককে আমি তোমার রবের দান থেকে সাহায্য করি, আর তোমার রবের দান বন্ধ হওয়ার নয়।

-আল-বায়ান

• তোমার প্রতিপালকের দান থেকে আমি এদেরকে আর ওদেরকে সকলকেই সাহায্য করে থাকি, তোমার প্রতিপালকের দান তো বন্ধ হওয়ার নয়।

-তাইসিরুল

• তোমার রাব্ব তাঁর দান দ্বারা এদেরকে এবং ওদেরকে সাহায্য করেন এবং তোমার রবের দান অবারিত।

-মুজিবুর রহমান

• To each [category] We extend - to these and to those - from the gift of your Lord. And never has the gift of your Lord been restricted.

-Sahih International

২০. আপনার রবের দান থেকে আমরা এদের ও ওদের প্রত্যেককে সাহায্য করি এবং আপনার রবের দান অবারিত।(১)

১. অর্থাৎ দুনিয়ায় জীবিকা ও জীবন উপকরণ দুনিয়াদাররাও পাচ্ছে এবং আখেরাতের প্রত্যাশীরাও পাচ্ছে। এসব অন্য কেউ নয়, আল্লাহই দান করছেন। আখেরাতের প্রত্যাশীদেরকে জীবিকা থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা দুনিয়া পূজারীদের নেই এবং দুনিয়া পূজারীদের কাছে আল্লাহর নিয়ামত পৌঁছার পথে বাধা দেবার ক্ষমতা আখেরাত প্রত্যাশীদেরও নেই। তিনি সর্বময় কর্তৃত্ববান, তিনি কোন যুলুম করেন না। তিনি প্রত্যেককে তার সৌভাগ্য বা দূৰ্ভাগ্য সবই প্ৰদান করেন। তার হুকুমকে কেউ রদ করতে পারে না, তিনি যা দিয়েছেন তা কেউ নিষেধ করতে পারে না। তিনি যা ইচ্ছা! করেছেন তা কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২০) তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদের ও ওদের (পরলোককামী ও ইহলোককামী উভয়কে) সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। [1]

[1] অর্থাৎ, দুনিয়ার রুযী ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কোন পার্থক্য ছাড়াই মু’মিন এবং কাফের উভয়কেই দিয়ে থাকি। যে দুনিয়া কামনা করে তাকেও দিই এবং যে আখেরাত কামনা করে তাকেও দিই। আল্লাহর (পার্থিব) নিয়ামত থেকে কাউকেও বঞ্চিত করা হয় না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১১১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 9 10 11 12 পরের পাতা »